#পারমিতা
#পর্ব_১৩
#লেখিকা_Nabila_Ahmed
–আমি তোমাকে সেভাবে ভালোবাসি যেভাবে একজন নারী একজন পুরুষকে ভালোবাসে, যেখাবে একজন স্ত্রী তার স্বামীকে ভালোবাসে, যেভাবে আফ…যেভাবে আফরিন আপু তোমাকে ভালোবাসতো।
এক নিশ্বাসে বলে ফেলে মিতা।
মিতার কথা শুনে কাধ থেকে হাত সরিয়ে নেয় অরিয়ন। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিতার দিকে। পরক্ষণেই চেহারায় গাম্ভীর্য ফুটে উঠে। মিতার থেকে দূরে সরে ঘুরে দাঁডায় অরিয়ন। নিজের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মিতা অরিয়ন কি করছে তা দেখতে ব্যস্ত। কেনো হঠাৎ করে মনের কথা বলে দিলো তা বুঝতে পারছে না তবে বলাটা জরুরি ছিলো। রে*পিস্ট? না, অরিয়ন এসব ভুলেও করতে পারবে না। তবে আফরিন ভেবে যা হয়েছে তাতে কি মিতার একটু ও কষ্ট হয়নি? হয়েছিলো।
–তুই এসব কিছুই বলিসনি।
মিতার দিকে না তাকিয়েই সিরিয়াস হয়ে বলে অরিয়ন।
–কিন্তু আমি তো..
বলতে নেয় মিতা।
–তুই কিছুই বলিস নি। আমি ও ভেবে নিবো আমি কিছুই শুনিনি। এরকম কিছু তুই বলেছিস সেটা ভুলে যা।
বলে ফেলে অরিয়ন।
–কিন্তু অরিয়ন..
–অরিয়ন ভাইয়ায়ায়া…খবরদার নাম ধরে ডাকবি না পরী।
মিতার দিকে ঘুরে চেচিয়ে বলে উঠে অরিয়ন।
হঠাৎ করে অরিয়নের এরূপ প্রতিক্রিয়া দেখে ভয়ে দু পা পিছিয়ে পড়ে মিতা।
–যা বলেছি তাই হবে। এখন যেতে পারিস।
আবারও ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে অরিয়ন।
নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা মিতার চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে। মিতার ভালোবাসা অরিয়ন মেনে নিবে না তা মিতা ভালো করেই জানে তাই বলে এতোটা রেখে যাবে তা বুঝতে পারেনি মিতা। অরিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকলেও অরিয়ন মিতার দিকে আর একবার ও ফিরে তাকায় নি। অবশেষে কান্না করতে থাকা মিতা টেবিলের উপর থেকে বইটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে রুম থেকে।
–ফা************কককককক।
চেচিয়ে উঠে অরিয়ন।
********************
রুম থেকে বেরিয়েই কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে দৌড়ে চলে যেতে নেয় মিতা।
–মিতা?
পেছন থেকে ডাক দেয় আবরার।
আবরারের কথা শুনে দাঁড়িয়ে পরে মিতা। তাড়াতাড়ি করে নিজের চোখের পানি দু হাত দিয়ে মুছে চুলগুলো সামনে এনে গলায় থাকা দাগগুলো ঢাকা চেষ্টা করে।
–জি আরিয়ান ভাইয়া?
আবরারের দিকে তাকিয়ে হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে বলে মিতা।
মিতা ফিরে তাকাতেই আবরারের চোখ যেন কপালে উঠে গেলো। মিতার চোখ লাল হয়ে আছে, চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কান্না করেছে। ঠোঁটের আর গলার দাগগুলো আবরারের নজরে আসতেই চোখেমুখে রাগ ফুটে উঠে আবরারের। নিজের হাত মুঠ করে রাখে শক্ত করে।
–কিছু না।
দাঁতে দাঁত চেপে বলে আবরার।
আবরারের কথা শুনে মিতা একটা হাসি দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা আবরারের নজর থেকে মিতা সরতেই দ্রুত হেটে অরিয়নের রুমের দিকে যেতে থাকে আবরার।
অনুমতি নিয়ে রুমে প্রবেশ করার প্রয়োজন মনে না করেই দরজা খুলে রুমে ঢুকে পড়ে আবরার।
–তুই আবারও..
দরজা খোলার শব্দে মিতা ভেবে বলে উঠে অরিয়ন।
আবরার কোনো কথা না বলেই দু কদমে অরিয়নের সামনে গিয়ে স্বজোরে এক ঘুসি মারে অরিয়নের মুখে। হুট করে আবরারের এহেন কান্ডে অবাক হয়ে যায় অরিয়ন।
–হোয়াট হেভ ইউ ডান টু হার, ইউ ফা*কং মনস্টার।
আবারও একটা ঘুসি মারে আবরার।
–আরিয়ান।
আবরারের হাত ধরে চেচিয়ে উঠে অরিয়ন।
–তোর সাহস কীভাবে হলো মিতাকে স্পর্শ করার?
–ভুলে হয়ে..
আরবারের হাত ছেড়ে দিয়ে বলতে নেয় অরিয়ন
–ভুলে? ভুলে তুই মিতার জীবন শেষ করে দিবি? তুই জানিস না তোদের ডিভোর্স হয়ে যাবে তা? তাও ওর গায়ে হাত দিয়েছিস তুই।
–তুই যেমন ভাবছি..
–আমি যেমনটা ভাবছি ঠিক তেমন ই। আমি নিজের চোখে মিতার অবস্থা দেখে এসেছি। তুই একটা জা*নোয়ার।
–মুখ সামলে কথা বলবি আরিয়ান।
এবার গম্ভীর হয়ে বলে অরিয়ন।
–আমি মুখ সামলে কথা বলবো? তুই আগে বল তোর সাহস কীভাবে হলো মিতাকে স্প..
–শি ইজ মাই ওয়াইফ। আই হেভ অল দা রাইট আরিয়ান।
হুট করেই আবরারের গলা চেপে ধরে অরিয়ন।
হঠাৎ করে অরিয়নের এমন করা দেখে থতমত খেয়ে যায় আবরার। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে অরিয়নের দিকে।
–শি. ইজ. মাই. ওয়াইফ। মাই, নট ইউরস আরিয়ান। সো স্টে ইন ইউর লিমিট।
আবরার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অরিয়নের দিকে। অরিয়নের হঠাৎ কি হলো অরিয়ন জানেনা শুধু জানে বার বার মিতা মিতা নামটা শুনতে বিরক্ত লাগছে অরিয়নের। দু জন দু জনের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন ঘোর কাটলো অরিয়নের। তাড়াতাড়ি করে আবরারের গলা থেকে হাত সরিয়ে দু পা পিছিয়ে পড়ে অরিয়ন। মিনিটেই চোখে মুখে ফুটে উঠে অনুশোচনা। আরিয়ান? নিজের আদরের ছোট ভাই আরিয়ানের গায়ে কখনো হাত তুলেনি অরিয়ন আর আজ সেই ভাইয়ের গ*লা টি*পে ধরেছে তা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না নিজেই।
একবার নিজের হাতের দিকে একবার আবরারের দিকে তাকিয়ে থাকে।
–আরি..
অরিয়ন কথা বলার আগেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় আবরার।
–ফা* ফা* ফা* ফা*।
রাগে দেয়ালে অনবরত ঘুসি মারতে মারতে বলতে থাকে অরিয়ন।
*****************
সারাদিন মিতা নিজের রুম থেকে বের হয়নি। শায়লাকে দিয়ে রুমের মধ্যে খাবার আনিয়ে খেয়ে নিয়েছে। এখনও নিজের রুমে বসে একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে গান শুনে যাচ্ছে মিতা।
“আচ্ছা আমার কি উচিৎ তোমাকে ঘৃণা করা রিয়ন?” মনে মনে ভাবে মিতা। “কিন্তু কি জন্য করবো? তুমি একজনকে মন থেকে ভালোবেসেছিলে তাই? তা জানা স্বত্তেও তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি তাই? তাকে ভেবে তুমি নিজের ফিলিংস আমার কাছে শেয়ার করেছো তাই? নাকি তোমাকে ভালোবেসে আমি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি তাই? নাকি তোমার মতো কাউকে চাইতে চাইতে তোমাকেই চেয়ে বসেছি তাই?নাকি তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসবে না তাই?” আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবতেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে মিতার।
**************
দু দিন ধরে রুম থেকে মিতা তেমন একটা বের হয়নি। বিশেষ করে যখন হাবিব চৌধুরী আর আনিকা চৌধুরী বাসায় থাকে তখন এটা সেটার বাহানা দিয়ে রুমেই থেকে যাচ্ছে মিতা। শরীরে থাকা গায়ের দাগগুলো আগের থেকে হালকা হয়ে এসেছে। নিজেকে আয়নায় আরও একবার ভালো করে দেখে মিতা। কাল থেকে কলেজ যাওয়া শুরু করবে আবার।
–মিতা? মিতা?
দরজায় নক করে শায়লা।
শায়লার ডাক শুনে তাড়াতাড়ি করে ওড়না গায়ে দিয়ে দরজা খুলে দেয় মিতা।
–জি শায়লা আপু?
–হাবিব স্যার ডিনার করতে ডাকছে তোকে।
–আচ্ছা আপু আমি আসছি।
জবাব দেয় মিতা।
*************
খাবারের টেবিলে সবাই মিলে অপেক্ষা করছে মিতার জন্য। অরিয়ন হাবিব চৌধুরীর পাশেই বসেছে। অন্য পাশে আনিকা চৌধুরী বসেছে। আবরারকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মিতা হাবিব চৌধুরীর কাছাকাছি আসতেই রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসে আবরার। নিজের জায়গায় বিরাজমান হতে চেয়ার টান দেয় আবরার।
–আরিয়ান।
ডাক দেয় হাবিব চৌধুরী।
–জি বাবা?
জবাব দেয় আবরার।
–ওটা মিতার জায়গা, এখন থেকে অরিয়নের পাশে মিতা বসবে।
আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে হাবিব চৌধুরী।
–কিন্তু বাবা
–কোনো কিন্তু নয়।
জানিয়ে দেয় হাবিব চৌধুরী।
–কিন্তু হাবিব, এতোদিন ধরে আরিয়ান এখানে বসে আসছে।
বলে উঠে আনিকা চৌধুরী।
–আমি জানি আনিকা। এতোদিন অরিয়নের বিয়ে হয়নি, এখন হয়েছে।
আনিকা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে হাবিব চৌধুরী।
আনিকা চৌধুরী আর কোনো কথা বললো না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিতার দিকে তাকিয়ে রইল।
–নিজের জায়গায় গিয়ে বস মিতা।
মিতার দিকে তাকিয়ে বলে হাবিব চৌধুরী।
মিতা বা অরিয়ন কোনো কথা বললো না। অরিয়ন নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে।
মিতা চেয়ার টেনে অরিয়নের পাশে বসে। সবাই যার যার জায়গায় বসে পড়লেই শায়লা আর অন্যরা খাবার দিতে থাকে প্লেটে।
হাবিব চৌধুরী একটা খাম অরিয়নের সামনে রাখে।
–কি এটা?
জিজ্ঞেস করে অরিয়ন।
–খুলে দেখো।
বলে হাবিব চৌধুরী।
চামচ রেখে খাম খুলতেই অবাক হয়ে হাবিব চৌধুরীর দিকে তাকায় অরিয়ন। সবাই তাকিয়ে আছে অরিয়ন আর হাবিব চৌধুরীর দিকে।
–ইউ আর জোকিং।
বলে অরিয়ন।
–ইউ নো আই ডোন্ট ডু দিস।
খাবার মুখে দিতে দিতে বলে হাবিব চৌধুরী।
–কি আছে খামে?
প্রশ্ন করে আনিকা চৌধুরী।
–আমি যাবো না কোথাও।
জানিয়ে দেয় অরিয়ন।
–তাহলে নিপ প্রোজেক্ট থেকে তুমি বাদ।
সাফ জানিয়ে দেয় হাবিব চৌধুরী।
–আর ইউ সিরিয়াস বাবা? এই প্রোজেক্ট এর জন্য আমি দিনরাত কাজ করেছি। তুমি এটা করতে পারো না।
রেগে গিয়ে বলে অরিয়ন।
–আর তুমি ভুলে যাচ্ছো এই কোম্পানির মালিক আমি তাই আমি যা খুশি তাই করতে পারি।
অরিয়নের দিকে তাকিয়ে বলে হাবিব চৌধুরী।
–হয়েছেটা কি কেউ বলবে?
রেগে বলে আনিকা চৌধুরী।
–বাবা আমার আর পরীর জন্য হ্যানিমুন যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
বলে অরিয়ন।
–কিহ?
অবাক হয়ে বলে আবরার।
–কি?
বলে উঠে মিতা।
–হাবিব, এইসব কি করছো তুমি?
বলে আনিকা চৌধুরী।
–আমার কাছে যা ভালো মনে হচ্ছে তাই।
বলে হাবিব চৌধুরী।
–আর অরিয়ন শুনো, তোমার কাছে কাল দিনটাই সময় আছে এর মধ্যে তোমার মতামত জানিয়ে দিবে। আমার আবার নতুন মানুষ ঠিক করতে হবে প্রোজেক্ট এর জন্য।
কথাটা বলেই টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ায় হাবিব চৌধুরী।
–আর মিতা?
ডাক দেয় হাবিব চৌধুরী।
–জি চাচ্চু?
জবাব দেয় মিতা।
–খাওয়া শেষ হলে আমার রুমে আসিস, কথা আছে।
–ওকে চাচ্চু।
মাথা নিচু করে বলে মিতা।
–কাজটা বাবা ঠিক করছে না।
বলেই উঠে চলে যায় আবরার।
–আরিয়ান খেয়ে যা বাবা।
আবরারের পেছন পেছন চলে যায় আনিকা চৌধুরী।
–তুই..
হঠাৎ করে নিজের চেয়ার মিতার দিকে ঘুরিয়ে বলে উঠে অরিয়ন।
–তুই বাবাকে বলবি তুই যেতে পারবি না,ঠিক আছে?
মিতার দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে মিতা।
চলবে….
#পারমিতা
#পর্ব_১৪
#লেখিকা_Nabila_Ahm
–চাচ্চু ভিতরে আসবো?
দরজায় নক করে অনুমতি চায় মিতা।
–আয়।
ভেতর থেকে উত্তর আসে।
দরজা খুলে ধীরগতিতে রুমে প্রবেশ করে মিতা। রুমের একপাশে রাখা সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন হাবিব চৌধুরী।
–আয়, এখানে বস।
নিজের পাশের সোফা দেখিয়ে বলে হাবিব চৌধুরী।
মিতা কোনো কথা না বলে চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসে। যদিও হাবিব চৌধুরী মিতাকে খুবি আদর করে থাকে তাও কেমন যেন হাবিব চৌধুরীকে দেখলেই মিতার ভয় লাগে। হয়তো বয়সে বড় বলেই।
–দিনকাল কেমন কাটছে এখানে?
মিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে হাবিব চৌধুরী।
–ভালো চাচ্চু।
মৃদু হেসে জবাব দেয় মিতা।
–আর পড়ালেখা?
আবারও বলে হাবিব চৌধুরী।
–পড়ালেখাও ভালো যাচ্ছে।
জবাব দেয় মিতা।
হাবিব চৌধুরী টিভি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, ডেকে পাঠিয়েও কেনো আর কিছু বলছেন না একা একা বসে সেটাই ভাবছে মিতা। কিছুক্ষণ রুমের এদিকটা তো কিছুক্ষণ ঐদিকটা দেখতে মিতাও ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
–অরিয়নের সাথে সব কিছু কেমন যাচ্ছে?
হুট করেই বলে উঠে হাবিব চৌধুরী।
হঠাৎ করে কথা বলাতে ভয় পেয়ে যায় মিতা। বইয়ের তাক থেকে নজর সরিয়ে হাবিব চৌধুরীর দিকে তাকায়।
–হ্যাঁ?
কি জবাব দিবে বুঝতে পারছে না মিতা।
–আফরিন আর ফিরবে না মিতা, সেটা কি তুই জানিস?
টিভিটা বন্ধ করে হাবিব চৌধুরী মনোযোগ দেয় মিতার দিকে।
–জ্বি চাচ্চু।
মন খারাপ করে জবাব দেয় মিতা।
–আমি জানি তুই অরিয়নকে খুব ভালোবাসিস।
হাবিব চৌধুরীর কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মিতা।
–গাধাটা অন্ধ হতে পারে কিন্তু আমি অন্ধ নই। আর আমার এই চুল? এই চুল বাতাসে পাকেনি মিতা।
এবার মিতা মাথা নিচু করে নিজের হাতের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কি বলবে তা বুঝতে পারছে না মিতা।
–তোকে দেখলেই বোঝা যায়। অরিয়ন তোর আশে পাশে আসলেই তোর চোখে যেন এক অন্য রকম আনন্দ ফুটে উঠে। আমি সব কিছুই খেয়াল করি মিতা।
–আগে ব্যাপারটা অন্যরকম ছিলো কিন্তু এখন তেমন নয়। আফরিন আর ফিরবে না, তাই অরিয়নকে নিয়ে সংসার করলে তুই খারাপ হয়ে যাবি না। কেউ বলবে না তুই নিজের বোনের হবু বরকে কেরে নিয়েছিস। এখন অরিয়ন তোর স্বামী, আফরিনের আর কিছুই না।
–অরিয়ন আর আফরিনের মধ্যে যা ছিলো কবুল বলার সাথে সাথে সবটা চিরতরে শেষ হয়ে গিয়েছে।
একের পর এক কথাগুলো হাবিব চৌধুরী মিতার উদ্দেশ্যে বলে যাচ্ছেন।
–পৃথিবীতে সব চাইতে কঠিন কাজ কি জানিস?
প্রশ্ন করে হাবিব চৌধুরী।
মিতা নিজের মাথা তুলে হাবিব চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়।
–সবচাইতে কঠিন কাজ কাউকে ভালোবাসলে সেই ভালোবাসাটা ধরে রাখা।
হাবিব চৌধুরী বলে।
–যে একবার ভালোবাসতে পারে সে দ্বিতীয়, তৃতীয় বারও ভালোবাসতে পারে। তার শুধু চাই একজন বিশ্বস্ত মানুষ, যে কিনা তাকে প্রমাণ করে দিবে দ্বিতীয়বার বা তৃতীয়বার ভালোবেসে সে কোনো ভুল করেনি।
–অরিয়নও তোকে ভালোবাসবে, আর তার জন্য তোকে বার বার ট্রাই করে যেতে হবে। অরিয়নকে দেখিয়ে দিতে হবে তুই আফরিনের মতো ধোকা দিবি না অকে,দেখিয়ে দিতে হবে তোর সাথে অকে বিয়ে দিয়ে আমি কোনো ভুল কাজ করিনি। তোর প্রতি আমার যে অটুট বিশ্বাস তা তুই কখনো ভাঙ্গতে দিবি না আমি জানি।
–কিন্তু চাচ্চু, অরিয়ন ভা..
–কোনো কিন্তু মিন্তু না মিতা, এটা আমার অনুরোধ তোর কাছে। তুই অরিয়নকে নিয়ে ঘুরে আয় কিছুদিনের জন্য। নিজেদেরকে সময় দে, এই সম্পর্ককে সময় দে, তাহলেই সব ঠিক হবে। প্লিজ মিতা না করিস না। একজন বাবা হিসেবে তার ছেলের জন্য তোর কাছে আমি হাত জোড় করে অনুরোধ করছি।
মিতার হাত ধরে বলে হাবিব চৌধুরী।
হাবির চৌধুরীর চেহারায় তার ছেলের জন্য যে ডেস্পারেশন ফুটে উঠেছে, মিতা তা কিভাবে ইগনোর করে যাবে তা জানেনা। তবে কিছু কথা মিতার নিজেরও ঠিক মনে হয়েছে। বিয়ের সম্পর্ক কোনো ছেলেখেলা নয়। যে কারণেই হোক, অরিয়ন এখন মিতার স্বামী তাই নিজের বিয়েটা সফল করতে মিতারও উচিৎ একটু চেষ্টা করা।
–ওকে চাচ্চু, আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো।
বড় করে শ্বাস নিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে মিতা।
–দ্যাটস মাই গার্ল। আমি জানতাম তুই কখনো আমাকে নিরাশ করবি না।
মিতার মাথায় হাত রেখে বলে হাবিব চৌধুরী।
–যা আর বেশিক্ষণ আটকে রাখবো না। রাত হয়ে গিয়েছে, গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
বলে হাবিব চৌধুরী।
–আচ্ছা চাচ্চু।
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ায় মিতা।
–আর মিতা শুন, সব কাপড় গুছিয়ে রাখ।
–কিন্তু অরিয়ন ভাইয়া যাবে না বললো যে?
জবাব দেয় মিতা।
–অরিয়ন অবশ্যই যাবে। শুধু তুই নিজের জায়গায় স্থির থাক, ও যাই বলুক ভয় পেয়ে না করবি না। ঠিক আছে?
বলে হাবিব চৌধুরী।
–ওকে।
উত্তর দেয় মিতা।
হাবিব চৌধুরীর সাথে কথা শেষ করে মিতা রুম থেকে বের হওয়ার জন্য দরজা খুলতেই সামনা-সামনি দেখা হয়ে যায় আনিকা চৌধুরীর সাথে। আনিকা চৌধুরী মিতাকে দেখতেই যেন তার মুডটা খারাপ হয়ে গেলো। মিতা কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে দরজা আটকাতেই ভেতর থেকে আনিকা চৌধুরীর কণ্ঠ ভেসে আসে।
–তুমি এরকম কিছুই করবে না হাবিব, অরিয়ন আর ঐ মেয়ে। আমি এমনটা কখনো হতে দিবো না।
–এমনটাই হবে আনিকা।
–সব কিছু জানার পরও তুমি এরকম করবে? ঐ মেয়েকে আমি কতটা ঘৃণা করি তা জানার পরও?
কাঁদতে কাঁদতে বলে আনিকা চৌধুরী।
–বিনা কারণেই তুমি অকে ঘৃণা করছো আনিকা, যা হয়েছে তাতে ওর কোনো দোষ নেই।
শান্ত গলায় জবাব দেয় হাবিব চৌধুরী।
মিতা দরজার সামনে আর দাঁড়িয়ে না থেকে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। নিজের রুমে প্রবেশ করে খাটের উপর গিয়ে বসে।
“কি এমন করেছি যার জন্য এতো ঘৃণা করো আমাকে? কি এমন ক্ষতি করেছি তোমার? অরিয়নকে ভালোবাসাই কী আমার দোষ নাকি বিয়ে করাটা? কিন্তু এর আগে থেকেই তো আমাকে দেখতে পারতে না তুমি” মনে মনে ভাবে মিতা।
“তবে কি এমন কোনো কারণ আছে যা সম্পর্কে আমি অবগত নই?” প্রশ্ন জাগে মিতার মনে। “সত্যটা আমাকে জানতেই হবে” বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে ভাবে মিতা।
********************
আজ রাতেও ডাইনিং টেবিলে সবাই এক সাথে বসে আছে। অপেক্ষা করছে অরিয়নের জন্য। অরিয়ন এসে নিজের ডিসিশন জানালেই কাল সকালের ফ্লাইটে প্যারিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে অরিয়ন আর মিতা।
অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে আসতেই বুঝতে পারে সকলেই অপেক্ষা করছে অরিয়নের জন্য। মিতার পাশের চেয়ার টেনে বসে অরিয়ন।
–তোমার ডিসিশন কি অরিয়ন?
বসতে না বসতেই প্রশ্ন করে হাবিব চৌধুরী।
হাবিব চৌধুরীর কথা শুনে মনে মনে হাসে অরিয়ন। অরিয়নের ডিসিশন কি তা কিছুই ম্যাটার করে না, যা ম্যাটার করে তা হলো মিতার। আর মিতাকে গতকাল ভালো করেই যা বোঝানোর তা বুঝিয়ে দিয়েছে অরিয়ন।
–আমি রাজি।
জবাব দেয় অরিয়ন।
–ওকে, তাহলে সবকিছু গুছি..
–পরী তোমাকে কিছু বলতে চায় বাবা।
হাবিব চৌধুরীর কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে অরিয়ন।
অরিয়নের কথা শুনে অবাক হয় মিতা। কিছুক্ষণ হাবিব চৌধুরীর দিকে আবার কিছুক্ষণ অরিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকে। অরিয়ন চোখের ইশারা দিয়ে মিতাকে বোঝায় যা বলার তা বলে দিতে। অন্যদিকে, হাবিব চৌধুরী চোখের ইশারায় জানতে চাইছে ঘটনা কি।
–কি হয়েছে বল..
মিতাকে কিছু বলতে না দেখে একটু গম্ভীর হয়ে বলে অরিয়ন।
–আমি বলতে চেয়েছিলাম যে…যে…যে আরিয়ান ভাইকেও সাথে করে নিয়ে যাই?
কি বলবে বুঝতে না পেরে চোখের সামনে আবরারকে দেখতে পেয়ে বলে ফেলে মিতা।
–একদম না। হানিমুনে থার্ড পারসন যায় না।
বলে হাবিব চৌধুরী।
–আচ্ছা।
জবাব দেয় মিতা।
অরিয়ন যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। রাগে মিতার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মিতা ভয়ে আর অরিয়নের দিকে তাকায় নি। চুপচাপ নিজের খাবার শেষ করে নিজের রুমে চলে যায়।
***************
ঘুমন্ত মিতার ঘুম ভাঙ্গে রুমের দরজা খোলার শব্দে। তাড়াতাড়ি করে মোবাইল হাতে নিতেই বুঝতে পারে সময় প্রায় ১ টা। এতো রাতে কে বাইরে থেকে লক খোলার চেষ্টা করছে বুঝতে পারছে না মিতা।
–কে? কে ওখানে?
ভয়ে ভয়ে বলে মিতা।
দরজা খুলতেই মোবাইলের আলো দরজার দিকে ধরতেই নজরে আসে অরিয়নকে।
–রিয়ন..
বিরবির করে বলে মিতা।
চোখের সামনে অরিয়নকে এতো রাতে দেখতে পেয়ে যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে মিতার। কিন্তু মিতার স্বপ্ন ভাঙ্গে লাইট ধরাতেই। সামনের দাঁড়িয়ে আছে অরিয়ন, দেখে মনে হচ্ছে একটুও ঘুমায় নি।
রুমের দরজা ভেতর থেকে আবারও লক করে অরিয়ন।
–তুমি এখানে এতোরাতে? কিছু বলবে?
মিতা খাট থেকে নামতে নামতে বলে।
–কিছু হিসাব বরাবর করার ছিলো।
মিতার দিকে ধীরে ধীরে হেটে এগিয়ে আসতে আসতে বলে অরিয়ন।
–মানে?
বুঝতে না পেরে বলে মিতা।
–তোকে বলেছিলাম বাবাকে না করে দিতে।
অরিয়নের কথায় মনে পড়ে মিতার। অরিয়ন যা বলেছিলো তার উলটোটাই করেছে মিতা। ঘুমের ঘোরে মনেও ছিলো না মিতার। এই কথা বলতে এতো রাতে রুমে এসেছে ভাবতেই ভয় কাজ করতে মিতার।
–বাবাকে না করিস নি কেনো?
দাঁতে দাঁত চেপে বলে অরিয়ন।
মিতা কিছু না বলে চুপ করে রইল। কি বলবে নিজেও বুঝতে পারছে না।
–সকালে উঠেই বাবাকে না করে দিবি তুই।
মিতার সামনে এসে বলে অরিয়ন।
–না।
জবাব দেয় মিতা।
–কি বললি?
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে অরিয়ন।
–আমি…আমি এরকম কিছুই বলবো না চাচ্চুকে।
আমতা আমতা করে বলে মিতা।
–হাহাহহাহাহাহাহাহাহ।
শব্দ করে হাসতে থাকে অরিয়ন।
হঠাৎ করে কেনো এভাবে হাসতে শুরু করেছে কিছুই বুঝতে পারছে না মিতা। তবে এই হাসি আনন্দের না, এই হাসি তাচ্ছিল্যের হাসি। পরক্ষণেই হাসি বন্ধ করে গম্ভীর হয়ে মিতার দিকে তাকায় অরিয়ন। দু পা এগিয়ে যায় মিতার দিকে,অন্যদিকে মিতাও দু পা পিছিয়ে পড়ে।
–বর বউ খেলার শখ হয়েছে তোর!
মিতার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে অরিয়ন।
–তুই ভাবছিস তোর সাথে দু চারদিন সময় কাটালে তোকে ভালোবাসবো আমি?
বাঁকা হাসি দিয়ে বলে অরিয়ন।
–তুমি…তুমি যেমন ভাবছো…তে..।
পিছিয়ে যেতে যেতে আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করে মিতা।
–তুমি মনে করিস তুই…তুই আমাকে,আমাকে সামলাতে পারবি?
দেয়ালের সাথে লেগে যাওয়া মিতার একদম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলে অরিয়ন।
দেয়ালের সাথে লেগে যাওয়া মিতা পেছনের দিকে তাকিয়ে যাওয়ার আর কোনো জায়গা না দেখতে পেয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় অরিয়ন, মিতার একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। আর এক পা এগিয়ে আসলেই একে অপরের নিশ্বাস নেওয়া অনুভব করতে পারবে এতোটা।
–আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু হার্ট ইউ পরী।
এক দৃষ্টিতে মিতার দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।
–তাই আবারও বলছি, বাবাকে তুই না করে দিবি।
নিজের ডান হাত দিয়ে মিতার গাল স্পর্শ করে বলে অরিয়ন।
অরিয়নের দৃষ্টি এখন আর মিতার চোখের দিকে নেই, যেখানে অরিয়নের হাত মিতার গালকে স্পর্শ করেছে সেখানে তাকিয়ে আছে অরিয়ন। কি ভাবছে বা কি করতে চাইছে কিছুই বুঝতে পারছে না মিতা। কিন্তু এখন যে ভয় পাওয়ার সময় নয় তা ভালোই জানে মিতা। একবার চেষ্টা না করে হার মানতে চায় না মিতা।
–না।
সাফ জানিয়ে দেয় মিতা।
মিতার জবাব শুনে অরিয়নের হাত স্থির হয়ে রইল নিজের জায়গায়। নজর আবারও ফিরে আসলো মিতার চোখের দিকে। মিতার চোখে যেন সিরিয়াসনেস ছাড়া আর কিছুই দেখলো না অরিয়ন। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো শক্ত করে।
–ওকে।
হঠাৎ করে বলে উঠে অরিয়ন।
এতো সহজে অরিয়ন মেনে যাবে তা যেন বিশ্বাস হচ্ছে না মিতার। অবাক হয়ে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু বোঝায় চেষ্টা করছে। অরিয়নের নজর আবারও মিতার চোখ থেকে সরে গলায় কামড় দেওয়া জায়গার দিকে গিয়ে আটকায়। কামড়ের দাগটা অনেকটা হালকা হয়ে এসেছে। পরক্ষণেই অরিয়নের হাত দিয়ে স্পর্শ করে সেই জায়গা। হঠাৎ অরিয়নের হাত গলাতে স্পর্শ করায় চোখ বন্ধ করে নেয় মিতা।
–আহ…
হুট করেই অরিয়ন কামড়ের জায়গায় দু আঙ্গুল দিয়ে চিমটি কাটায় ব্যাথায় শব্দ করে উঠে মিতা।
অরিয়নের হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় মিতা।
–ওয়েলকাম টু মাই হেল..
–ওয়াইফ।
কথাটা বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে যায় অরিয়ন।
মিতা দৌড়ে আয়নার সামনে যেতেই দেখতে পায় হালকা হয়ে যাওয়া দাগটা আবারও লালচে হয়ে উঠেছে।
চলবে….
#পারমিতা
#পর্ব_১৫
#লেখিকা_Nabila_Ahmed
প্লেনে বসে আছে মিতা আর অরিয়ন। সকাল ৬ টার ফ্লাইটে আগে দুবাই যাবে এরপর সেখান থেকে ফান্সের জন্য রওয়ানা হবে। ফার্স্টক্লাস ফ্লাইটে নিজেদের কেবিনে বসে থাকা অরিয়ন আর মিতাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে যায় এয়ার হোস্টেজ।
কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেন ছাড়তেই মিতা নিজের জায়গায় নড়েচড়ে বসে। অরিয়ন মোবাইলে প্রোজেক্টের সব কিছু বাকিদের বুঝিয়ে দিচ্ছে একটু পর পর।
মোবাইলে কথা বলা শেষ করে মিতার দিকে আড় চোখে তাকাতেই দেখতে পায় মিতা কেমন যেন করছে। মিতার বসে থাকা অস্বাভাবিক লাগছে,মুখ একদম শুকিয়ে আছে, দু হাত দিয়ে শক্ত করে সিট ধরে রেখেছে। এক প্রকার খিচ মেরেই বসে আছে। প্লেন আকাশে স্বাভাবিক ভাবে নিজের গতিতে চলতে শুরু করে দিয়েছে এতোক্ষণে। মিতার থেকে চোখ সরিয়ে নিজের কাজে মন দেয় অরিয়ন। মিতার প্রতি রাগটা এখনো কমেনি বলেই ইগনোর করে গেলো অরিয়ন। কিন্তু নিজের রাগ যেন বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলো না অরিয়ন। আবারও আড় চোখে মিতার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারে মিতা একপ্রকার দম বন্ধ করেই বসে আছে। অবশেষে নিজের রাগ বিসর্জন দিয়ে সিটবেল্ট খুলে নেয় অরিয়ন।
–কি হয়েছে তোর?
নিজের সিট বেল্ট খুলে মিতার সামনে গিয়ে কিছুটা নিচু হয়ে জিজ্ঞেস করে অরিয়ন।
মিতা কোনো কথা বললো না। এক নজরে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে রইল।
–কি হয়েছে কথা বল! কি ওয়াশরুমে যাবি?
মিতার চেহারায় অস্বস্তির উপস্থিতি টের পেয়ে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করে অরিয়ন।
মিতা মাথা নাড়িয়ে না বলে।
–তাহলে?
অরিয়নের কথা শেষ হওয়ার আগেই মিতার পেটে যা ছিলো সব গিয়ে পড়ে অরিয়নের কাপড়ের উপর। হুট করে বমি করে দেয় মিতা। অরিয়ন আহাম্মকের মতো মিতার দিকে তাকিয়ে রইল। এরকম কিছু হতে পারে তা কল্পনার বাইরে ছিলো অরিয়নের।
–সরি, সরি, সরি।
ভয়ে অরিয়নের শার্ট থেকে বমি মুছে ফেলতে নিজের হাত এগিয়ে দিতেই হাত ধরে ফেলে অরিয়ন।
–মোশন সিকনেস। সব সময় এরকম হয় আমার।
ভয়ে ভয়ে বলে মিতা।
–বমির ঔষধ খেয়ে আসিস নি?
প্রশ্ন করে অরিয়ন।
–খেয়ে এসেছি, তাও এরকম হয়। প্রচন্ড মাথা ঘুরাচ্ছে আর বমি বমি লাগছে।
মাথা নিচু করে জবাব দেয় মিতা।
অরিয়ন আর কোনো কথা না বলে কেবিন থেকে বেড়িয়ে পড়ে। মিতা নিজের সিটে শুয়ে একটু মনটা অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পর কেবিনে প্রবেশ করে অরিয়ন। বমি পরিষ্কার করে এসেছে, শার্টের বেশি অংশই ভিজে আছে পানি দিয়ে পরিষ্কার করার কারণে। মিতা চোখ বন্ধ করে এটা সেটা ভাবতে ব্যস্ত,যদি কোনো মতে অস্থিরতা একটু কমে।
–চল।
বলে অরিয়ন।
–কোথায়?
চোখ খুলে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে মিতা।
–ফ্রেশ হতে।
–আমি হাটতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না, মাথা প্রচুর ঘু..
মিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই মিতাকে নিজের কোলে তুলে নেয় অরিয়ন।
–কি করছো তুমি?
হঠাৎ করে কোলে তুলে নেওয়াতে অবাক হয়ে বলে মিতা।
–তোর শরীর থেকে দুর্গন্ধ আসছে,পরিষ্কার না করলে এখানে বসা যাবে না।
মিতাকে নিয়ে হাটতে হাটতে বলে অরিয়ন।
অরিয়নের এহেন কথায় লজ্জা পেয়ে যায় মিতা। মনে মনে নিজের এরকম হওয়াকে বকতে থাকে। অরিয়নের সামনে এরকম করাতে এখন অরিয়ন কি ভাববে তা ভাবতে ভাবতেই নিজের মাথা অরিয়নের কাধের উপর রাখে মিতা।
মিতাকে কোলে নিয়ে ওয়াশরুমে এসে এক কর্ণারে দাঁড় করায় মিতাকে। নিজের একহাত দিয়ে মিতার কোমর শক্ত করে ধরে যাতে পড়ে না যায়,অন্যহাত দিয়ে ট্যাপ ছেড়ে পানি নিয়ে মিতার মুখের কাছে নিয়ে যায় অরিয়ন। “আচ্ছা অরিয়নের কি উচিৎ না এসব থেকে দূরে থাকার?” ভাবতে ভাবতেই মুখে পানি তুলে নেয় মিতা। কুলি করা শেষ হলে অরিয়ন হাতে আবারও পানি নিয়ে মিতার মুখ মুছে দেয়। নিজের দু হাত দিয়ে মিতার হাত ধরে হাত ধুয়িয়ে দেয়। মিতা এক নজরে মুগ্ধতার মোহজালে নিজেকে বার বার পেচিয়ে নিচ্ছে।
“এজন্যই কি তোমাকে আপু ভালোবেসেছিলো? এতো কেয়ার করলে কি কেউ ভালো না বেসে থাকতে পারবে? আমার জন্য এতোটা করতে পারলে যাকে ভালোবাসো তার জন্য কতটা করতে পারো তুমি? তা কি দেখার সৌভাগ্য কখনো হবে আমার? আমি কি তোমার মনে ঐরকম জায়গা করতে কখনো সফল হবো? ” অরিয়নের দিকে এক নজরে তাকিয়ে থেকে ভাবতে থাকে মিতা।
মিতাকে একবার ভালো করে দেখে নেয় অরিয়ন। ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়েছে কি না তা চেক করে নেয়। যথেষ্ট মনে হলে আবারও কোলে তুলে নেয় মিতাকে। কেবিনে এসে মিতাকে শুয়িয়ে দেয় নিজের সিটে। নিজের সিটে অরিয়ন বসতে বসতেই তাকায় মিতার দিকে। অযথা কোনো আশা দিতে চায়নি বলেই দুর্গন্ধ আসছে কথাটা বলেছে অরিয়ন। ইদানীং মিতার চোখের দিকে তাকালে অরিয়নের এক প্রকার অস্বস্তি অনুভব হয়। এই চোখে শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না অরিয়ন। ঠিক তেমনটাই যেমনটা একটা সময় অরিয়নের চোখে আফরিনের জন্য ভালোবাসা প্রকাশ পেতো।
একদিকে যেমন মিতার চোখ দেখলে অস্বস্তি লাগে অরিয়নের ঠিক তেমনই মিতার শরীরে দেওয়া অরিয়নের দাগগুলোর দিকে তাকাতেই যেন এক অজানা সেটিসফেকশন অনুভব করে অরিয়ন। মিতার উপর এক অজানা অধিকার অনুভব করে। এই জিনিসটাই ভয় পেয়ে আসছে অরিয়ন, অরিয়ন আর আগের মতো নেই তা ভালোই বুঝতে পারছে অরিয়ন। এই অরিয়নের মধ্যে ভালোবাসা নিয়ে নেই কোনো কোমলতা বা বিশ্বাস। নিজের এই এলোমেলো জীবনে মিতাকে জড়াতে চায় না অরিয়ন। নিজের পরীর জীবনটা নষ্ট করতে চায় না অরিয়ন আর তার জন্য যদি মিতার মন ভাঙ্গতে হয়, তাহলে তাই করবে।
সিটে শুয়ে থাকা মিতার অস্থিরতা যেন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এর আগে যতোবার বিদেশ গিয়েছে মিতা ততোবারই মায়া চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো আর মায়া চৌধুরীও মিতাকে এটা সেটা বলে ভুলিয়ে রাখতো। মিতার কি হলো জানেনা, শুধু জানে একটু পরেই সিট থেকে নেমে অরিয়নের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজের সামনে কারো টের পেয়ে চোখ খুলে তাকায় অরিয়ন। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আধ-মরা মিতা।
–আই এম সো সরি,অরিয়ন ভাইয়া।
মিতা কথাটা বলেই অরিয়নের কোলে উঠে বসে।
নিজের হাত দিয়ে অরিয়নের গলা জড়িয়ে ধরে আবারও নিজের মাথা মিশিয়ে দেয় অরিয়নের বুকের সাথে। নিজের জায়গায় স্তব্ধ হয়ে থাকা অরিয়ন কতক্ষণ এভাবে রইল জানেনা, শুধু জানে একটু পরেই অরিয়নের হাত ধীরে ধীরে জড়িয়ে ধরে মিতাকে। “আমার কি উচিৎ পরীকে সরিয়ে দেওয়া?” মনে মনে ভাবে অরিয়ন। নিজের মনকে শক্ত করে মিতাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য মিতার দিকে তাকাতেই যেন মিতার মুখটা দেখে মায়া হতে লাগল অরিয়নের। বমি করার কারণে মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না, একদম ভেঙ্গে পরেছে মিতা।
–কিছু বলো বা জিজ্ঞেস করো যাতে আমার ব্রেনটা অন্যদিকে ডাইভার্ট হয় অন্যদিকে।
চোখ বন্ধ করা অবস্থায় বলে মিতা।
মিতা চোখ বন্ধ করে রাখলেও অরিয়নের চোখ এক মিনিটের জন্যও মিতার থেকে সরছে না।
–প্রতিবার মা এটা সেটা বলে আমার মন অন্য দিকে ব্যস্ত করে দেয়, তাই বেশি সমস্যা হয় না।
আবারও বলে মিতা।
–তুই ডাক্তার হতে চাস কেনো?
হঠাৎ করে প্রশ্ন করে অরিয়ন।
অরিয়নের প্রশ্ন শুনে চোখ খুলে মিতা, অরিয়নের গলা জড়িয়ে ধরা হাতটা যেন আগের থেকে একটু শক্ত হলো।
–তোমার জন্য..
জবাব দেয় মিতা।
“তোমার জন্য” সামান্য দুটি বাংলা শব্দ। কিন্তু এই সামান্য শব্দ দুটো শুনেই যেন অরিয়নের বুক ধুকধুক করে উঠতে শুরু করেছে।
–মনে পড়ে সেদিনের কথা? যেদিন মা-বাবা এক্সিডেন্টে মারা গেলো?
অরিয়নের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে মিতা। মিতার দিকে দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরিয়ন। মিতার কথাটা শুনতেই নিজের হাত দিয়ে মিতাকে যেন আরও একটু শক্ত করে ধরলো অরিয়ন।
এক্সিডেন্টের দিন
——————
মিতা – বয়স ৫। অরিয়ন – বয়স ১৬।
হাসপালের এক রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কৈশর বয়সের অরিয়ন। চোখ মুখ শক্ত করে রেখেছে যেন যেকোনো মুহুর্তে চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করবে। অরিয়নের কনিষ্ঠ আঙ্গুল ধরে দাঁড়িয়ে আছে ৫ বছরের ছোট্ট মিতা।
রুমের ভেতর থেকে কান্নার শব্দ আসছে, আবার মাঝে মধ্যে সবার রাগারাগি শোনা যাচ্ছে।
–মা কোথায় অনিয়ন?
অরিয়নের আঙ্গুল ঝাকিয়ে প্রশ্ন করে ছোট্ট মিতা।
মিতার কথা শুনে মিতার দিকে তাকায় অরিয়ন। একটু হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে কোলে তুলে নেয় মিতাকে।
–মা বাবা অনেক দূরে বেড়াতে গেছে পরী।
বলে অরিয়ন।
–কখন আসবে?
–আর আসবে না।
আনমনে বলে ফেলে অরিয়ন।
–কেনো?
কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে মিতা।
–কারণ যেই ডাক্তার নিয়ে আসবে সে এখানে নেই।
মিতার দিকে মায়ার নজরে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।
–ডাক্তার থাকলে কি তারা ফিরে আসতো?
প্রশ্ন করে অবুঝ মিতা।
–হ্যাঁ।
মিতার মাথায় হাত দিয়ে বলে অরিয়ন।
–আচ্ছা।
————–
বর্তমান
ঐদিন যদি ডাক্তারের কথাটা অরিয়ন না বলতো তাহলে হয়তো ছোট্ট মিতার মাথায় কথাটা এভাবে গেঁথে থাকতো না। সেদিনের পর থেকে যতোবার মা বাবার এক্সিডেন্টের কথা শুনেছে মিতা ততোবার শুধু ডাক্তার হওয়ার কথাই ভেবেছে। অরিয়ন নিজের হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মিতাকে। মিতাও নিজের মাথা এলিয়ে দিয়েছে অরিয়নের বুকে।
–কলেজ কেমন যাচ্ছে?
প্রশ্ন করে অরিয়ন।
মিতা কোনো উত্তর দিলো না।
মিতার উত্তর আসতে না দেখে মিতার দিকে তাকায় অরিয়ন, ক্লান্তির কারণে ঘুমিয়ে পড়েছে মিতা। অরিয়ন আর কোনো কথা না বলে নিজের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল।
——————
দীর্ঘ ১৬ ঘন্টা জার্নি করার পড় ফ্রান্সের হোটেলে এসে পৌঁছেছে অরিয়ন আর মিতা। যেখানে ক্রমাগত মোশন সিকনেসের কারণে মিতার প্রায় মরা মরা অবস্থা সেখানে অরিয়নের মরা মরা অবস্থা মিতাকে কোলে রাখতে রাখতে।
–আমি যদি জানতাম বাবা এতোদূর প্ল্যান করবে তাহলে প্রোজেক্ট গোল্লায় গেলেও আসতাম না।
মিতাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিতে দিতে বলে অরিয়ন।
মিতাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিতেই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো মিতা। বড় বড় করে শ্বাস নিয়ে যতোটুকু সম্ভব অক্সিজেন নেওয়ার চেষ্টা করলো। অরিয়ন আর কোনো কথা না বলেই বিছানার অন্যপাশে গিয়ে শুয়ে একটু রেস্ট নেওয়ার চেষ্টা করে।
*****************
সূর্যের আলো চোখে পড়তেই মিটমিট করে চোখ খুলে মিতা। গতকাল রাতে এতোটাই ক্লান্ত ছিলো যে, কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তা মনেও নেই মিতার। জাগন্ত মিতা নিজের ঘাড়ে কারো নিঃশ্বাস নেওয়া অনুভব করতেই আত্নকে উঠে কোথা থেকে আসছে তাকাতেই দেখতে পায়, ঘুমন্ত অরিয়নের মুখ গুজে আছে মিতার ঘাড়ে। নিজে একটু সরে এসে তাকিয়ে থাকে অরিয়নের দিকে।
সামনে ঘুমিয়ে থাকা অরিয়নকে এতো কাছ থেকে বুঝ হওয়ার আর কখনো দেখেনি মিতা। অরিয়নের ডান পাশের চোখের নিচে ছোট একটা লাল তিল রয়েছে যা আজ প্রথম দেখলো মিতা। চোখের পাপড়িগুলো চোখের নিচ স্পর্শ করছে।
অরিয়নকে দেখতে থাকা মিতার চোখ যায় অরিয়নের ঠোঁটের দিকে। এই ঠোঁটে মিতা শেষ প্রকৃত হাসি দেখতে পেয়েছিলো বিয়ের দিন সন্ধ্যায়, এরপর যেন সব কিছু বদলে গেলো।
নিজের ঘোরের মধ্যে বিদ্যামান মিতার হাত যেন নিজে থেকেই এগিয়ে গেলো অরিয়নের ঠোঁট স্পর্শ করতে।
অরিয়নের ঠোঁট স্পর্শ করতে যাবে তখনি চোখ খুলে তাকায় অরিয়ন। শক্ত করে ধরে ফেলে অরিয়নের দিকে থাকা হাতটি। গতকাল যতোটা কোমলতা দেখতে পেয়েছিলো মিতা আজ যেন তার ছিটেফোঁটাও নেই অরিয়নের চোখে।
ক্ষণিকের মধ্যে মিতাকে ঘুড়িয়ে দিয়ে উপুর করে শুয়িয়ে দিয় অরিয়ন। মিতার ধরে রাখা হাত ঘুরিয়ে নিয়ে আসে মিতার পিঠের উপর। নিজের শক্তি দিয়ে মোচড় দিয়ে ধরে মিতার হাত।
–আহ…
হাত মোচড় দেওয়াই ব্যাথায় শব্দ করে উঠে মিতা।
–নিজের লিমিটের মধ্যে থাকবি।
মিতার হাত শক্ত করে ধরে রাখা অবস্থায় নিজের মুখ মিতার কানের কাছে নিয়ে বলে অরিয়ন।
ব্যাথায় মিতার চোখে পানি জমতে শুরু করেছে।
–গতকাল যা হয়েছে তাতে ভেবে নিস না তোর জন্য আমার মনে কিছু তৈরি হয়েছে। তোকে দেখে করুণা হচ্ছিলো বলেই এগিয়ে গিয়েছিলাম, তোর জায়গায় অন্যকেউ হলেও তাই করতাম।
কথাটা বলেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় মিতার হাত।
বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায় অরিয়ন।
বিছানায় উপুর হয়ে পড়ে থাকা মিতার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়ছে অনবরত।
চলবে….