পারমিতা পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
113

#পারমিতা
#পর্ব_২৫
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

আজ অফিসে যায় নি অরিয়ন। মিতা যখন ঘুম থেকে উঠলো অরিয়ন তখন মিতার দিকে পাশ করে ঘুমিয়ে ছিলো। ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে আসে মিতা। এখন প্রায় পুরোপুরি সুস্থ মিতা। সবার সাথে বসে ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছে। অরিয়নের নাস্তা রুমে পাঠানো হয়েছে অরিয়নের নির্দেশে।

সকাল ১১ টা করে মিতার টিউশন টিচার চলে এসেছে মিতাকে পড়াতে। ড্রয়িং রুমে পড়তে বসেছে মিতা। মিতার রুম পুড়ে যাওয়ার কারণে এখন এখানেই পড়তে হচ্ছে মিতাকে। টিচার আসার একটু পরেই নাস্তা দিয়ে যায় শায়লা।

অরিয়ন উপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে মিতা আর টিচারকে দেখছে। এই প্রথম মিতার টিচারকে দেখলো অরিয়ন। ছেলেটি প্রায় অরিয়নের সম-বয়সি হবে,দেখতে শুনতেও খুব সুর্দশন। শায়লা থেকে শুনেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স পাশ করেছে। মিতা মনোযোগ দিয়ে নিজের পড়া পড়ছে। সিড়ি বেয়ে আনিকা চৌধুরীকে উপরে উঠতে দেখেই নিজের রুমের দিকে হাটা শুরু করে অরিয়ন। অরিয়নকে চলে যেতে দেখে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল আনিকা চৌধুরী। একবার মিতার দিকে ও একবার অরিয়নের দিকে তাকায়।

প্রায় ১২:৩০ টা করে মিতার পড়া শেষ হয়। পড়া শেষ হতেই তাড়াতাড়ি করে রুমের দিকে হাটা শুরু করে মিতা, বিকালে সব বন্ধুরা আসবে তাই গোসল,খাওয়া-দাওয়ার পর্ব আগেই শেষ করতে হবে। রুমের দরজা খুলতেই কাশতে শুরু করে মিতা। পুরো ঘর ধোঁয়া দিয়ে ভরে গেছে। ঘোলাটে দেখাচ্ছে রুমের সব কিছু। রুমের বেলকনির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে অরিয়ন। পেছন থেকে অরিয়নের চেহারা দেখতে না পারলেও মিতা ঠিকি বুঝতে পারছে অরিয়ন স্মো*কিং করছে।
“কতগুলা সিগারেট খেয়েছো? এতো ধোঁয়া?” মনে মনে বলে মিতা।

মিতার কাশি শুনতেই মিতার দিকে ফিরে তাকায় অরিয়ন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মিতা। ওড়না দিকে নাক ঢেকে রেখেছে। চোখের পলক ফালাচ্ছে বার বার। অরিয়ন হেটে গিয়ে রুমের ফ্যান অন করে দেয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই রুমের ধোঁয়ার পরিমাণ কমে আসে। অরিয়ন মিতার দিকে তাকিয়ে থেকেই খাটের উপরে গিয়ে বসে। হাতে থাকা সি*গারেট ঠোঁটে নিয়ে টানতে থাকে। মিতা কোনো কথা না বলে আলমারি থেকে নিজের কাপড় বের করে গোসল করতে চলে যায়।

গোসল করে মিতা যখন ওয়াশরুম থেকে বের হলো, অরিয়ন খাটের উপর একই ভাবে বসে আছে। হাতে তখন ও সি*গারেট। একটু আগেই নিয়েছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অরিয়ন সি*গারেট খেতো তা সন্দেহ করেছিলো মিতা কিন্তু এতো বেশি পরিমাণে খায় তা ভাবতে পারেনি মিতা।
ড্রেসিং টেবিল থেকে লোশন নিয়ে হাতে মাখতে থাকে মিতা।

–পরী।
হঠাৎ করে ডাক দেয় অরিয়ন।

অরিয়নের দিকে ফিরে তাকায় মিতা। সি*গারেট হাতে মিতার দিকে তাকিয়ে আছে অরিয়ন।

–এদিকে আয়।
সি*গারেট দু ঠোঁটের মাঝখানে নিয়ে বলে অরিয়ন।

মিতা বড় করে শ্বাস নিয়ে নেয়। সিগা*রেটের গন্ধে মাথা ধরেছে মিতার। অরিয়নের কাছাকাছি গেলে এই গন্ধ যে আরও মাথা ব্যাথা বাড়িয়ে দিবে তা ভালোই জানে মিতা। কিছুটা গম বন্ধ করেই অরিয়নের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

–আরও কাছে আয়।
বলে অরিয়ন।

–এখান থেকেই বলো, গন্ধে অস্থির লাগছে আমার।
জবাব দেয় মিতা।

মিতার কথা শোনা মাত্রই সি*গারেট ছুড়ে ফেলে দেয় অরিয়ন। কোথায় গিয়ে পড়লো সেদিকে তাকিয়ে রইল মিতা,বেলকনিতে গিয়ে পড়েছে।

–এখন তো আসতে সমস্যা নেই!
মিতার দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।

ধীরে ধীরে হেটে অরিয়নের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মিতা। অরিয়ন নিজের দু হাত দিয়ে মিতার দু হাতের কব্জি ধরে নিজের একদম কাছাকাছি নিয়ে আসে।

–ডিসিশন কি নিবি কিছু ভেবেছিস?
মিতার দু হাত নিজের ঠোঁটের কাছে এনে তালুকে চুমু দিয়ে বলে অরিয়ন।

মাথা নাড়িয়ে না বলে মিতা। মিতার মুখ দিয়ে যেন কথা আসছে না। প্রতিদিন অরিয়নের একেক রূপ আসছে মিতার সামনে। অবাক দৃষ্টিতে শুধু অরিয়নের দিকে তাকিয়েই রইল মিতা।

–ভালো করে দেখ আমাকে…
মিতার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেই একটু থামে অরিয়ন।

–দেখ কি অবস্থা আমার। আই নিড পিস ,আই নিড ইউর হেল্প লাভ। অনলি ইউ ক্যান গিভ মি পিস। হেল্প মি লাভ।
দাঁড়িয়ে থাকা মিতাকে জড়িয়ে ধরে বলে অরিয়ন।
নিজের দু হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে মিতাকে।

বিপদে পড়ে থাকা মানুষ যেমন অন্য কারো কাছে নিরুপায় হয়ে অনুরোধ করে, হাত বাড়িয়ে দেয়,অরিয়নও যেন ঠিক তেমন ভাবেই মিতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে সাহায্য চাইছে। যেই অসহ্য যন্ত্রণা অরিয়নের বুকের মধ্যে বাসা বেধেছে তা ভাঙ্গতে মিতাকে অনুরোধ করছে অরিয়ন।

–আমি যদি…আমি যদি হ্যাঁ বলি তাহলে..
কথাটা বলে একটু অপেক্ষা করে মিতা।

মিতার কথা শুনতেই মিতাকে ছেড়ে ভালো করে বসে অরিয়ন। তাকিয়ে থাকে মিতার দিকে।

–তাহলে কি ২ টা জিনিস প্রমিস করতে পারবে তুমি?
প্রশ্ন করে মিতা।

–কি?
জানতে আগ্রহ প্রকাশ করে অরিয়ন।

–১. আমাদের এই সম্পর্ককে কখনো অসম্মান করবে না!

–কখনো করবো না, আই প্রমিস।
মিতার কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই বলে অরিয়ন।

–২.যদি কোনোদিন এমন হয় যে, আমার মনে হয়েছে আমি এই সম্পর্কে থাকতে চাই না তাহলে তুমি আমাকে যেতে দিবে।
নিজের কথা শেষ করে মিতা।

–ওকে তাই হবে। আমি শুধু চাই তুই আমাকে একটা সুযোগ দে। এরকম সিচুয়েশন কখনো আসার সুযোগ দিবো না আমি।
অনায়াসে বলে ফেলে অরিয়ন।

মিতা অরিয়নের দিকে তাকিয়ে রইল। কতো সহজেই রাজি হয়ে গেছে তা দেখছে মিতা। একটু শান্তির জন্য কতটা মরিয়া হয়ে গেছে অরিয়ন। শুধু ডেস্পারেশন ছাড়া আর কিছুই দেখছে না মিতা। “ডেস্পারেশন থেকেও তো ভালোবাসা হতে পারে তাই না? সবাই তো একটা সুযোগ ডিসার্ভ করে” মনে মনে ভাবে মিতা।

–ওকে। আমার উত্তর হ্যাঁ।
জবাব দেয় মিতা।

–থ্যাংক ইউ লাভ, থ্যাংক ইউ সো মাচ।
মিতাকে আবারও জড়িয়ে ধরে বলে অরিয়ন। মুখে হাসি ফুটে উঠেছে অরিয়নের।

কতদিন পর অরিয়নের মুখে আবারও এরকম রিয়েল হাসিটা দেখছে। মিতা নিজেও হাসে, অরিয়নের হাসি দেখে। ধীরে ধীরে নিজের হাত রাখে অরিয়নের পিঠে। নিজেও জড়িয়ে ধরে অরিয়নকে।

*************

দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে অরিয়ন অফিসে গিয়েছে একটা ইম্পোর্টান্ট মিটিং এটেন্ড করতে। মিতাও খাওয়া শেষ করে নিজের রুম গুছিয়ে নিয়েছে,একটু পরেই ফ্রেন্ডরা সবাই চলে আসবে।

–কিরে,কোথায় তোরা? আর কতক্ষণ লাগবে?
কাউচে বসে মোবাইলে কল দিয়ে বলে মিতা।

–আচ্ছা আমি আসছি। ওয়েট কর।
কথাটা বলেই রুম থেকে দৌড়ে বের হয়ে যায় মিতা।

মিতা ড্রয়িং রুমে আসার একটু পরেই সাদা রঙের গাড়ি এসে দাঁড়ায় দরজার সামনে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে সুমাইয়া ও ফয়সাল। গাড়ি থেকে ওদের বের হতে দেখেই দৌড়ে গিয়ে সুমাইকে জড়িয়ে ধরে মিতা।

–কেমন আছিস? কতদিন হলো দেখিনা তোদের।
সুমাইয়াকে জড়িয়ে ধরেই বলে মিতা।

–তোকে তো দেখে মনে হচ্ছে না তুই অসুস্থ।
ভ্রু কুচকে বলে সুমাইয়া।

–ধুর, কিছুই হয়নি আমার। একদম সুস্থ আমি।
হেসে বলে মিতা।

–এখানে আমিও আছি।
পেছন থেকে বলে ফয়সাল।

–হেহেহেহে, তুই ও এসেছিস? আমি তো খেয়ালই করিনি।
ফিক করে হেসে দিয়ে বলে মিতা।

–হ্যাঁ,হ্যাঁ। এখন তো খেয়াল করবি ই না। নিজের দেবদাস পেয়েছিস তো তাই।
রাগ করার অভিনয় করে বলে ফয়সাল।

–তুই ওকে সব বলে দিয়েছিস।
ভ্রু কুচকে সুমাইয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে মিতা।

–হ্যাঁ।
দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলে সুমাইয়া।

–তোকে তো…

–এখানেই দাঁড় করিয়ে রাখবি?
মিতা সুমাইকে মারতে তেড়ে যেতেই বলে উঠে সুমাইয়া।

–তোকে আমি পরে দেখে নিবো। এখন ভিতরে চল।
সুমাইয়া আর ফয়সালের উদ্দেশ্যে বলে মিতা।

****************

–ফাহমিদা আসেনি কেনো? আমার এতো বড় একটা এক্সিডেন্ট হলো শুনেও আসলো না।
সোফায় বসে থাকা মিতা বলে।

–ওর আম্মু আজ বাসায় নেই, তাই আসেনি। কাল কলেজে দেখা করবে বলেছে।
চা খেতে খেতে বলে সুমাইয়া।

–আর তুই সাল্লু ভাই, এতো চুপ করে আছিস কেনো?
ফয়সাল কোনো কথা বলছে না দেখে প্রশ্ন করে মিতা।

–নাস্তাগুলো অনেক মজা হয়েছে, আগে খেয়ে নেই এরপর কথা বলবো।
জবাব দেয় ফয়সাল।

–খা, সব খা। এই পৃথিবীটাও খেয়ে ফেল।
ফয়সালের মাথায় একটা থাপ্পড় মেরে বলে সুমাইয়া।

সুমাইয়া থাপ্পড় দিতেই ফয়সাল ও সুমাইয়ার চুল ধরে টান দেয়।

–তোরা আবারও মারামারি শুরু করেছিস? এবার আমার হাতে খা।
কথাটা বলে মিতাও ঝাপিয়ে পড়ে দুজনের উপর।
ঠাস ঠাস করে দু জনের পিঠে থাপ্পড় মারে মিতা।

–উফফফফ…ভাইরে ভাই, তুই চিকন হলে কি হবে। তোর থাপ্পড়ে অনেক ব্যাথা পাওয়া যায়। আর মারবি না বলে দিলাম।
হাত দিয়ে পিঠ ডলতে ডলতে বলে ফয়সাল।

–আমি ও সাল্লু ভাইয়ের সাথে একমত।
বলে সুমাইয়া।

ওদের কথা শুনে মিতা শুধু হাসতে থাকে।

****************

বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতে দিতে রাত হয়ে গিয়েছে। সবাই মিলে ভিডিও গেমস খেলেছে, বাগানে একসাথে ছবি তুলেছে। ফাহমিদার সাথে ভিডিও কলে কথা বলে ওকে জেলাস ফিল করিয়েছে। রাতের খাবার খেয়ে সুমাইয়া আর ফয়সালকে বিদায় জানাতে এগিয়ে দিতে এসেছে মিতা।

–কাল কলেজে দেখা হবে।
গাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে সুমাইয়া।

–বাড়িতে আবার আসিস, আসলে অনেক মজা হয়।
বলে মিতা।

–আসবো। যাই।
কথাটা বলেই গাড়িতে ঢুকে সুমাইয়া। ফয়সাল দরজা খুলে দাঁড়ায়।

–তোর ভুবন চৌধুরীকে দেখা হলো না।
বলে ফয়সাল।

–ভুবন চৌধুরী? সে আবার কে?
বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে মিতা।

–পারুর স্বামী।
কথাটা বলেই হাসতে শুরু করে ফয়সাল।

এতোক্ষণে মিতার মাথায় সব ঢুকেছে। দেবদাস উপন্যাসে পারুর স্বামীর নাম ভুবন চৌধুরী ছিলো তাই ব্যঙ্গ করে মিতাকেও সেটা বলেছে ফয়সাল।

–তোকে তো..
কথাটা বলেই আবারও ফয়সালের পিঠে থাপ্পড় মারে মিতা।

–উফফফ…শেষ, শেষ আমি।
কুজো হয়ে বলে ফয়সাল।

অরিয়নের গাড়ি এসে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে। প্রবেশ করতেই মিতাকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজের অজান্তেই হাসি ফুঁটে অরিয়নের মুখে। ভালো করে তাকাতেই লক্ষ্য করে মিতা কোনো ছেলের সাথে কথা বলছে। প্রথমে কিছু একটা শুনে মিতা বুঝতে পারেনি, কিন্তু ছেলেটা কিছু বলার পরেই হেসে গায়ে হাত তুলে মিতা। ছেলেটাও হাসতে হাসতে মিতার চুল ধরে টান দিয়েই গাড়িতে উঠে যায়। ছেলেটা মিতার বয়সি হবে। মিতার মতো প্রাণবন্ত লাগছে। অরিয়নের গাড়ি দরজার সামনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অন্য গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছে।

***************

সুমাইয়ার গাড়ি ছেড়ে দিতেই মিতা চলে যায় মায়া চৌধুরীর রুমে। মার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলবে ঠিক করেছে। অন্যদিকে, অরিয়ন গাড়ি থেকে নেমে সোজা নিজের রুমে গিয়েছে। হাতে আজ সাদা রজনীগন্ধা ফুলের তোড়া। মিতার যে রজনীগন্ধা ফুল খুব পছন্দ তা অরিয়ন জানে। তাই আসার পথে ফুল নিয়ে এসেছে অরিয়ন। হাতে ফুল নিয়ে রুমে প্রবেশ করে অরিয়ন।

কিছুক্ষণ আগে গাড়িতেও হাসিখুশি ছিলো অরিয়ন। কিন্তু মিতাকে ঐ ছেলের সাথে দেখার পর থেকেই কেমন জানি লাগছে। “দু জনেই কম বয়সি, একে অপরকে পছন্দ করতে শুরু করবে না তো?” কিসব খেয়াল আসছে অরিয়নের মাথায় অরিয়ন নিজেও বুঝতে পারছে না। ফুলের তোড়া টেবিলের উপর রাখতে গিয়েই লক্ষ্য করে মিতার মোবাইলে আলো জ্বলছে। নোটিফিকেশন এসেছে। ফয়সাল থেকে মেসেজ এসেছে। কিছু বুঝার আগেই মোবাইল হাতে তুলে নেয় অরিয়ন। অন করতেই বুঝতে পারে মোবাইল লক করা।
“লক করা কেনো? লুকানোর মতো কিছু কি আছে?” মনে মনে ভাবে অরিয়ন।

মায়া চৌধুরীর সাথে কথা শেষ করে রুমে আসতেই যেন মন ভালো হয়ে গেলো মিতার। পুরো রুম রজনীগন্ধার সুঘ্রাণে ভরে গেছে। টেবিলের উপর ফুল দেখেই দৌড়ে যায় মিতা।

–রজনীগন্ধা।
ঘ্রাণ নিতে নিতে বলে মিতা।

–তোর খুব পছন্দ তাই নিয়ে এসেছি।
পেছন থেকে অরিয়নের কণ্ঠ ভেসে আসতেই একটু চমকে যায় মিতা। পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে অরিয়নের দিকে তাকায় মিতা।

–ধন্যবাদ।
মিষ্টি এক হাসি দিয়ে বলে মিতা।

–ছেলেটা কে?
মিতার দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–কোন ছেলে?
অরিয়নের কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে মিতা।

–গাড়ির ওখানে যার গায়ে হাত তুললি।
বলে অরিয়ন।

–ওহ, ফয়সাল। আমার বন্ধু। আমাকে দেখতে এসেছিলো।
জবাব দেয় মিতা।

–একাই এসেছিলো?
মিতার হাত ধরে খাটে নিয়ে বসিয়ে বলে অরিয়ন।

–না। আমার বান্ধুবী সুমাইয়াও এসেছিলো।

–তুই কি ঐ ছেলেকে পছন্দ করিস?
মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে হুট করে বলে উঠে অরিয়ন।

অরিয়নের কথা শুনে অবাক হয় মিতা। অরিয়নের হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নেয়। কি আজেবাজে বলছে অরিয়ন? কিছুদিন আগেও মিতা অরিয়নকে ভালোবাসে তা স্বীকার করেছে, নিজেদের বিয়ের সম্পর্ককে একটা সুযোগ দিবে বলেছে তাহলে অন্য কাউকে পছন্দ করার প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? তা যেন মাথায় ঢুকছে না মিতার।

–কি সব বলছো তুমি?
অবাক হয়ে বলে মিতা।

–হ্যাঁ কি না?
আবারও বলে অরিয়ন।

–না।
সাফ জানিয়ে দেয় মিতা।

–আমার পছন্দ না ওর সাথে তোর এতো মেলামেশা করা। কোনো ছেলের সাথেই পছন্দ না।

–কিন্তু ও আমার বন্ধু, আমার ক্লাসমেট..

–বন্ধু,ক্লাসমেট থেকেই ভালোবাসার সম্পর্ক শুরু হতে পারে। এভাবেই সব হয়।
মিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই চেচিয়ে উঠে অরিয়ন।

একটু আগেও ভালো থাকা অরিয়ন ক্ষণিকের মধ্যে রেগে গিয়েছে। এই রাগের কারণ বুঝতেও মিতার সময় লাগেনি। “ভয়” অরিয়ন ভয় পাচ্ছে, ভয় পাচ্ছে আফরিনের মতো মিতাও যদি ক্লাসমেট কারো প্রেমে পড়ে যায়। মিতাও যদি আফরিনের মতো অরিয়নকে একা করে রেখে যায়, সেই ভয়।

–অরিয়ন।
ডাক দেয় মিতা।

অরিয়নের নাম ধরে ডাকতেই মিতার দিকে তাকায় অরিয়ন। মিতা নিজের হাত দিয়ে অরিয়নের হাত স্পর্শ করে। স্পর্শ করতেই অরিয়ন কিছুটা রিলাক্স হয়।

–আমি ওকে পছন্দ করিনা। ও শুধুই আমার বন্ধু।
আলতো এক হাসি দিয়ে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে বলে মিতা।

অরিয়ন অপলক দৃষ্টিতে মিতার দিকে তাকিয়ে থাকে।

–আমি তোমাকে অন্য কারো জন্য কোনোদিনও ছেড়ে যাবোনা।
মিতার কথাটা শুনতেই মিতার হাত শক্ত করে ধরে অরিয়ন। মিতার চোখে তাকিয়ে কোনো মিথ্যে বা ছলনা খুজতে থাকে কিন্তু কিছুই পায় না।

–আমি আফরিন আপুর মতো কিছুই করবো ন..

–সে দ্যাট ইউ লাভ মি।
মিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই হুট করে মিতার একদম কাছাকাছি এসে বলে অরিয়ন।
এতোটাই কাছে এসেছে যে অরিয়নের নিশ্বাস নেওয়া অনুভব করতে পারছে মিতা।

–আমি তোমাকে ভালোবাসি।
অরিয়নের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে মিতা।

–এগেইন।
বলে অরিয়ন।

–আমি তোমাকে ভালোবাসি রিয়ন।
মিতার মুখে নিজের জন্য আলাদা নাম শুনতেই নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারেনি অরিয়ন।

অরিয়নের ঠোঁট গিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে মিতার ঠোঁটে। অরিয়নের ঠোঁট নড়তে শুরু করলে মিতাও তার সাথে তাল মিলায়। নিজের দু হাত দিয়ে অরিয়নের গলা জড়িয়ে ধরে। মিতাকে চুমু খেতে খেতেই মিতার গলার ওড়না ধরে অরিয়ন।

–ক্যান আই?
মিতার দিকে তাকিয়ে অনুমতি চায় অরিয়ন।

মিতার চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। চোখের ইশারায় নিজের অনুমতি দিতেই ওড়না সরিয়ে নেয় অরিয়ন।

–ইউ আর মাইন,ওয়াইফ। অনলি মাইন।
কথাটা বলেই আবারও মিতার ঠোঁটে চুমু খায় অরিয়ন।

চলবে….

#পারমিতা
#পর্ব_২৬
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

মিতার ঘুম ভাঙ্গে গলায় আর ঘাড়ে কারও স্পর্শ অনুভব করতেই। মিটমিট করে চোখ খুলতেই দেখতে পায় পাশেই মিতাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে অরিয়ন। মিতার ঘাড়ে নিজের মুখ গুজে রেখেছে। মিতার ঘাড়ে আর গলায় অনবরত চুমু দিয়ে যাচ্ছে অরিয়ন।

–রিয়ন?
ধীরে ধীরে বলে উঠে মিতা।

অরিয়নের চুমু দেওয়ার কারণে মিতার যেমন শিহরণ জাগছে ঠিক তেমন কাতুকুতু লাগছে খুব।

–রিয়ন?
আবারও ডাক দেয় মিতা।

–হুম লাভ?
চুমু খেতে খেতেই জবাব দেয় অরিয়ন।

–আমার ক্লাস আছে আজকে, উঠতে হবে।
নিজের হাত দিয়ে অরিয়নের বুকে ধাক্কা দিতে গিয়ে বলে অরিয়ন।

–যা, আমি কি ধরে রেখেছি?
কথাটি বলেই মিতার এগিয়ে দেওয়া হাত শক্ত করে বিছানায় চেপে ধরে অরিয়ন।

–হাহহাহহাহাহাহাহহা
অনেক চেষ্টা করেও মিতা আর নিজের হাসি আটকে রাখতে পারেনি। নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি অরিয়নকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে হাসতে থাকে মিতা।

–আমা..আমার কাতুকুতু লাগছে..হাহাহাহাহ…সরি…হাহাহহহা।
হাসতে হাসতে বলে মিতা।

অরিয়ন অপলক দৃষ্টিতে মিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। দিন দিন মিতা যেন আগের থেকে বেশি সুন্দরী হয়ে যাচ্ছে।

–তুমি কি অফিসে যাবে? আমার ক্লাসে যেতে হবে আজ থেকে।
হাসতে হাসতে বিছানা থেকে উঠে বলে মিতা।

–যাবো, যাবার পথে তোকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে যাবো আমি।
বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলে অরিয়ন।

–ওকে।
বলেই ওয়াশরুমে যেতে নেয় মিতা।

–লাভ?
ডাক দেয় অরিয়ন।

–হুম।
নিজের অজান্তেই সারা দেয় মিতা। অরিয়নের কাছ থেকে কথাটা শুনলেই মন ভালো হয়ে যায় মিতার।

–আমি ও আসি?
বাঁকা হাসি দিয়ে বলে অরিয়ন।

–কোথায়?
বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে মিতা।

–গোসল করতে।
দাঁত দেখিয়ে বলে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে অরিয়ন।

–নিলর্জ্জ কোথাকার।
কথাটা বলেই দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে যায় মিতা।
দরজা লক করতেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় অরিয়ন। দরজার সাথে নিজের মাথা লাগিয়ে নক করতে থাকে বারবার।

–কাজ হবে না রিয়ন, যাও অন্য ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।
হাসতে হাসতে বলে মিতা।

অরিয়ন নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আলতো করে হাসলো। ২৯ বছরের অরিয়নের মন যেন ১৭/১৮ বছরের ছেলেদের মতো হয়ে গেছে। এতো শান্তি আর আনন্দ কখন অনুভব করেছিলো ভুলেই গেছে অরিয়ন। আলমারি থেকে কাপড় বের করে চলে যায় গেস্টরুমে।

***************

নাস্তার টেবিলে আজ অরিয়নের পাশের চেয়ারে নিজ থেকেই মিতা বসেছে। আবরার বন্ধুদের সাথে ঢাকা গিয়েছে ট্যুরে। আনিকা চৌধুরী হাবিব চৌধুরীর পাশেই বসে আছে। মিতা আর অরিয়ন আড় চোখে একে অপরের সাথে চোখাচোখি করছে। হাবিব চৌধুরীর নজর থেকে তা বাদ গেলো না। নিজের ছেলের মুখে এতোদিন পর সেই হাসি ফুঁটতে নিজেও হাসে। আনিকা চৌধুরী সব কিছু দেখে যাচ্ছে। কীভাবে তার অরিয়ন মিতার দিকে মুগ্ধতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর কিভাবে প্রতিবার মিতা লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই হাতের চামচ শক্ত করে ধরে আনিকা চৌধুরী।

***************

গাড়িতে বসে আছে মিতা আর অরিয়ন। মিতার হাত নিজের হাতে নিয়ে মুঠ করে ধরে রেখেছে অরিয়ন। মিতা বাইরের দিকে তাকিয়ে সব কিছু দেখছে।

–কাকা, গাড়ি থামান।
হুট করে বলে উঠে অরিয়ন।

–কেনো? কি হয়েছে?
রাস্তায় কোনো সমস্যা হলো নাকি তা দেখার জন্য বাইরে তাকায় মিতা।

–তেমন কিছুনা। বস এখানে তুই।
কথাটা বলেই গাড়ি থেকে বের হয় অরিয়ন।

অরিয়ন কি করছে তা বুঝতে পারে যখন অরিয়ন গিয়ে ফুলের দোকানে গিয়ে ঢুকে। একটু পরেই রজনীগন্ধা হাতে দোকান থেকে বের হয় অরিয়ন। খুশিতে আত্নহারা হয়ে যায় মিতা। অরিয়ন এতোটা কেয়ার করবে তা জীবনেও ভাবেনি মিতা।

–নে, তোর না পছন্দ।
গাড়িতে ঢুকে মিতার হাতে দিয়ে বলে অরিয়ন।

–হ্যাঁ।
কথাটা বলতেই চোখের কোণে পানি চলে আসে মিতার।

–কাঁদছিস কেনো? ফুল দেখে? এখনি ফেলে দিচ্ছি দাঁড়া।
বলেই ফুল হাত থেকে নিয়ে যেতে নেয় অরিয়ন।

–না, না। তুমি এতো কেয়ার করছো তাই।
জবাব দেয় মিতা।

মিতার কথা শুনে হেসে দেয় অরিয়ন।

–অভ্যাশ করে নে, এখন থেকে সব সময় এরকম ট্রিটমেন্ট পাবি।
একটু গম্ভীর হয়ে বলে অরিয়ন।

অরিয়নের কথা শুনে হেসে ফেলে মিতা। অরিয়নও হেসে দেয়। মিতার হাত নিয়ে তাতে চুমু খায় অরিয়ন।

কলেজের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়াতেই গাড়ির পার্টিশন নামিয়ে দেয় অরিয়ন।

–শব্দ করবি না।
কথাটা বলেই মিতার ঠোঁটে চুমু খেতে থাকে অরিয়ন। মিতাও তাল মিলিয়ে অরিয়নকে চুমু খায়।

একে অপরকে ছেড়ে দিতেই অরিয়ন নিজের কপালের সাথে মিতার কপাল স্পর্শ করে বড় বড় করে শ্বাস নিতে থাকে। পরক্ষণেই আক্রমণ করে মিতার গলায়।

–রিয়ন, আমার ক্লাস আছে।
আস্তে আস্তে বলে মিতা।

–আই নো।
বলেই আবারও একটা চুমু দিয়ে সরে আসে অরিয়ন।

–আই উইল মিস ইউ।
মাথা নিচু করে বলে অরিয়ন।

–মি টু।
কথাটা বলেই আলতো করে অরিয়নের ঠোঁটে চুমু খায় মিতা।

–আই লাভ ইউ সো মাচ, রিয়ন।
অরিয়নের দিকে তাকিয়ে বলে মিতা।

অরিয়ন মিতার দিকে তাকিয়েই রইল। এর উত্তরে কিছুই বললো না।

–যাচ্ছি, লেট হয়ে যাচ্ছে।
বলেই বের হয়ে মিতা।

অরিয়ন গাড়িতে বসে চলে যেতে থাকা মিতার দিকে তাকিয়ে রইল। মিতার কনফেশনে অরিয়ন কোনো জবাব দিতে পারেনি। কি বলবে তা জানা নেই অরিয়নের।

“আই লাভ ইউ সো মাচ, রিয়ন”

“ইউ ডোন্ট ডিসার্ভ হার”

“আই লাভ ইউ সো মাচ, রিয়ন”

“ইউ ডোন্ট ডিসার্ভ হার ”

“ইউ ডোন্ট ডিসার্ভ হার ”

“ইউ ডোন্ট ডিসার্ভ হার ”
কথাটা মন্ত্রের মতো বার বার ঘুরতে লাগলো অরিয়নের মাথায়।

“নো, নো, শি লাভস মি, শি লাভস মি, আই ডিসার্ভ হার। শি ইজ মাইন, মাইন, মাইন” চেচিয়ে একা একাই বলতে থাকে অরিয়ন।

–কি হয়েছে অরিয়ন বাবা?
প্রশ্ন করে ড্রাইভার কাকা।

ড্রাইভারের কথা শুনে যেন নিজের কল্পনার রাজ্য থেকে বের হলো অরিয়ন। নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।

–কিছুনা, চলুন।
জবাব দেয় অরিয়ন।

****************

ক্লাসে এসে বসেছে মিতা। সুমাইয়া, ফয়সাল বা ফাহমিদা এখনো কেউ আসেনি। ব্যাগ থেকে বই বের করে পাশের বেঞ্চে সবার জন্য জায়গা রাখে মিতা। নিজের জায়গায় যেতেই দেখতে পায় মোবাইলে মেসেজ এসেছে অরিয়নের নাম্বার থেকে।

অরিয়ন ভাইয়া :
কলেজ থেকে বাড়ি পৌঁছে মেসেজ দিস।

অরিয়নের মেসেজ দেখে মিষ্টি এক হাসি ফুটে মিতার। অরিয়ন এমনটাই হবে মিতা তা ভালোই জানতো। তাই তো বুঝ হওয়ার পর থেকে অরিয়নের মতো একজন ছেলের স্বপ্ন দেখেছিলো মিতা। কিন্তু ভাগ্যে যে স্বয়ং অরিয়ন থাকবে তা জানা ছিলো না মিতার।

****************

ক্লাস শেষ করে মাত্র বাড়িতে ঢুকেছে মিতা। আগামী মাস থেকে মিতার ইন্টারমিডিয়েট এক্সাম শুরু। সব কিছু গুছিয়ে নিতে হবে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করতেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায় মিতা। বিশাল এক রজনীগন্ধা তোড়া রাখা খাটের উপর। ধীরে ধীরে খাটের সামনে যেতেই দেখতে পায় ফুলগুলো একদম তাজা। তার মানে ফুলগুলো আজকের। ফুলগুলো হাতে তুলে নিজে ঘ্রাণ নিতেই বিশাল এক হাসি ফুঁটে মিতার মুখে। তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে মিতা।

মিতা :
বাড়িতে পৌঁছেছি আমি আর ধন্যবাদ।

অরিয়ন :
ধন্যবাদ চাই না। বিনিময়ে অন্য কিছু চাই।

সাথে সাথে অরিয়নের মেসেজ আসে।

মিতা :
কি?

অরিয়ন :
ভালোই জানিস কি।

মিতা লজ্জায় লাল হয়ে রইল। কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না।

অরিয়ন :
লজ্জা পেয়ে লাভ নেই। ৩০ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে থাক। ড্রাইভার এসে নিয়ে যাবে তোকে। ডিনার বাইরে করবো আমরা।

অরিয়নের মেসেজ দেখেই তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হতে চলে যায় মিতা।

*************

রেডি হয়ে ড্রয়িং রুমে অপেক্ষা করছে মিতা। বেবি পিংক কালারের গাউন পরেছে মিতা। চুলগুলো খোপা করা। খোপার এক পাশে রজনীগন্ধা ফুল ছিড়ে গুজে দিয়েছে মিতা। ঠোঁটে পিংক কালারের গ্লোজ দেওয়া।
গাড়ির হর্ন শুনতেই তাড়াতাড়ি করে দরজার সামনে যায় মিতা। গাড়ি থামতেই উঠে বসে।

গাড়ি আপন গতিতে চলতে শুরু করেছে। চারিদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। শীতের দিন হওয়াতে খুব তাড়াতাড়ি রাত হয়ে যাচ্ছে এখন। ঘড়িতে ৬:৩০ টা বাজে। কিন্তু চারিপাশ থেকে মনে হচ্ছে গভীর রাত।

৭ টা করে গাড়ি এসে দাঁড়ায় বিশাল এক রেস্টুরেন্টের সামনে। মাঝে মধ্যে পরিবার আর বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে গিয়েছে মিতা। কিন্তু এটায় কখনো আসা হয়নি। পুরো রেস্টুরেন্ট বাইরে থেকে সুন্দর করে ডেকোরেশন করা। গাড়ি থেকে বের হতেই শীতের ঠান্ডা হাওয়া স্পর্শ করে মিতার শরীর। কেঁপে উঠে মিতা। ধীরে ধীরে রেস্টুরেন্টের দরজার সামনে দাঁড়াতেই দেখতে পায় অরিয়ন দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।

দরজার সামনে মিতাকে দেখতেই যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো অরিয়নের। মিতাকে দেখতে সত্যিই কোনো পরীর মতো লাগছে। এতো সুন্দর আর পবিত্র পরী কিভাবে অরিয়নের ভাগ্যে আসলো তা যেন নিজেই বুঝতে পারছে না অরিয়ন।

–ইউ আর লুকিং সো বিউটিফুল, লাভ।
নিজের হাত মিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে অরিয়ন।

মিতা মিষ্টি এক হাসি ফিরিয়ে দিয়ে অরিয়নের হাতে হাত রাখে। অরিয়ন মিতাকে নিয়ে চলে যায় নিজেদের টেবিলে। ওয়েটার আসতেই অরিয়ন মিতার পছন্দ মতো খাবার অর্ডার দেয়। অরিয়ন আর মিতা যেখানে বসেছে তার একটু দূরেই লাইভ মিউজিক এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিউজিসিয়ান গানের সুর চালু করতেই নিজের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় অরিয়ন। মিতার দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত দেয়।

–কি?
প্রশ্ন করে মিতা।

–ডান্স উইথ মি।
বলে অরিয়ন।

–না, না। আমি ডান্স করতে পারিনা।
উত্তর দেয় মিতা।

–আমি শিখিয়ে দিবো।
কথাটা বলেই মিতার হাত ধরে ডান্স ফ্লোরে নিয়ে যায় অরিয়ন।

নিজের হাত দিয়ে মিতার হাত নিজের কাধে ও অন্য হাত নিজের হাতে নেয় অরিয়ন। অরিয়ন নিজের অন্য হাত রাখে মিতার কোমরে। মিউজিসিয়ান গান গাওয়া শুরু করে।

I found a love for me

Oh, darling, just dive right in and follow my lead

Well, I found a girl, beautiful and sweet

Oh, I never knew you were the someone waiting for me

‘Cause we were just kids when we fell in love, not knowing what it was

I will not give you up this time

Oh, darling, just kiss me slow, your heart is all I own

And in your eyes, you’re holding mine

Baby, I’m dancing in the dark with you between my arms

Barefoot on the grass while listening to our favourite song

When you said you looked a mess,

I whispered underneath my breath
But you heard it, “Darling, you look perfect tonight”

গান শেষ হতেই রেস্টুরেন্টে থাকা সকলেই হাতে তালি দেয় একসাথে। মিতা আর অরিয়ন আলতো করে এক হাসি ফিরিয়ে দেয় সবাইকে।

****************

খাওয়া দাওয়া শেষ করে গাড়িতে বসে আছে মিতা আর অরিয়ন। এখন প্রায় রাত ১০ টা। অরিয়নের বুকে মাথা দিয়ে রেখেছে মিতা। সবকিছু যেন মিতার কাছে কল্পনার মতো লাগছে। মিতার জীবনটা এতো রঙ্গিন হয়ে যাবে তা ভাবতেও পারেনি মিতা।

–লাভ?
বলে উঠে অরিয়ন।

–হুম?
অরিয়নের বুক থেকে মাথা তুলে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে বলে মিতা।
অরিয়ন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিতার দিকে।

–তুই বললে এই পৃথিবীর সব কিছু তোর পায়ের নিচে এনে দিবো আমি।
বলে অরিয়ন।

অরিয়নের কথায় শুধু সিরিয়াসনেস প্রকাশ পাচ্ছে।

–বিনিময়ে তুই প্রমিস কর,আমাকে কখনো ছেড়ে যাবি না তুই।

অরিয়নের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মিতা। “ছেড়ে যাবে? তাও আবার অরিয়নকে?” সেটা এখন আর সম্ভব নয় মিতার জন্য। অরিয়নের সাথে শারীরিক আর মানুসিক ভাবে জড়িয়ে গেছে মিতা। অরিয়ন হয়তো জানেনা, মিতা নিজেও অরিয়নকে ছাড়া আর ভালো থাকতে পারবে না। মিতার ও অরিয়নকে ততোটাই প্রয়োজন যতোটা অরিয়নের মিতাকে প্রয়োজন।

–আই অনলি ওয়ান্ট ইউ।
অরিয়নের চোখে চোখ রেখে বলে মিতা।

–আই এম সো সরি লাভ, আমি জানি তুই ভালো কাউকে ডিসার্ভ করিস কিন্তু আম যে অনেক সেলফিশ।
মাথা নিচু করে বলে উঠে অরিয়ন।

–সরি বলবে না। আমি তোমাকে ডিসার্ভ করি রিয়ন, তাই আল্লাহ তোমাকে দিয়েছে।
অরিয়নের গাল ধরে মাথা উপরের দিকে তুলে বলে মিতা।

–চোখ বন্ধ কর।
হঠাৎ করে বলে মিতা।

–কেনো?
প্রশ্ন করে মিতা।

–কর তো।
অরিয়নের কথা শুনে চোখ বন্ধ করে মিতা।

নিজের পকেট থেকে ছোট একটা বক্স বের করে অরিয়ন। মিতার কাছাকাছি নিয়ে যায়। বক্স খুলে মুখে হাসি ফুটিয়ে মিতার দিকে তাকায়।

–চোখ খুলতে পারিস।
বলে অরিয়ন।

মিতা চোখ খুলতেই চমকে যায়। মিতার সামনে ছোট বক্সে পিংক কালারের বিশাল বড় এক ডায়মন্ডের রিং। রিংটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা খুব এক্সপেন্সিভ। ওভাল সাইজের রিংটায় দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মিতা। অবাক হয়ে তাকায় অরিয়নের দিকে।

–তোর জন্য।
হেসে বলে অরিয়ন।

–এতো দামী এ…

–তোর সামনে কিছুই না।
মিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে অরিয়ন।

–মে আই?
পড়িয়ে দেওয়ার অনুমতি চায় অরিয়ন।

–হুম।
বলে মিতা।

অরিয়ন বক্স থেকে রিংটা খুলে মিতার বাম হাতে পড়িয়ে দেয়। মিতা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। ডায়মন্ডের দাম কেনো এতো বেশি তা আজ বুঝতে পারছে মিতা। এই রিংটা যেন পুরোপুরি মিতার গেটআপ চেঞ্জ করে দিয়েছে।

–আই লাভ ইউ সো মাচ।
খুশিতে বলে উঠে মিতা।

–হুম।
বলেই নিতার ঠোঁটে আলতো করে চুমু খায় অরিয়ন।

গাড়ি এসে দাঁড়ায় দরজার সামনে। অরিয়ন বের হয়ে মিতার জন্য দরজা খুলতেই মিতা অরিয়নের হাতে হাত রেখে বেরিয়ে আসে। দু জনে একে অপরের হাত ধরে দরজায় এক পা রাখতেই মিতা নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে যায়।

–কি হয়েছে?
প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–রিং এর বক্সটা গাড়িতেই রেখে এসেছি। আমি নিয়ে আসছি ওয়েট।
বলে মিতা।

–আমি যাচ্ছি দাঁড়া।
বলে অরিয়ন।

–না, তুমি থাকো আমি যাচ্ছি।
কথাটা বলেই মিতা দৌড়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খুলে গাড়ির সিট থেকে বক্সটা হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে আবারও এসে অরিয়নের হাত ধরে। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে অরিয়নের সাথে তাল মিলিয়ে হাটতে থাকে মিতা।

–মায়ে কল দিয়ে রিংটা দেখাবো…এত্ত সুন্দর। কি ব..
অরিয়নকে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিতা কথা বন্ধ করে অরিয়নের দিকে তাকায়।

–কি হয়েছে দাঁড়িয়ে রইলে কেনো?
অরিয়নকে প্রশ্ন করে মিতা। কিন্তু মিতার কথা যেন অরিয়নের কানে গেলো না। এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।

কিসের দিকে তাকিয়ে আছে দেখতে মিতাও ফিরে তাকায় সেদিকে।

–আফনান।
দূর থেকে ভেসে আসে অরিয়নের নাম।

চলবে….

#পারমিতা
#পর্ব_২৭
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

–আফনান।
দূর থেকে ভেসে আসে অরিয়নের নাম।

মিতার চোখের সামনে যেন সবকিছু স্লো মোশনে হতে লাগলো। ড্রয়িং রুম থেকে দৌড়ে আসা মানুষটির দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকলো মিতা।

–আফরিন আপু।
বিরবির করে বলে মিতা।

ক্ষণিকের মধ্যে দৌড়ে আশা আফরিন জড়িয়ে ধরে অরিয়নকে। নিজের দু হাত দিয়ে অরিয়নের গলা জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে শুরু করে আফরিন। মিতার হাত ধরে থাকা অরিয়নের হাত নিজে নিজেই হালকা হয়ে আসলো। মিতার হাত ছেড়ে আফরিনকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে অরিয়ন।

–আফনান…আফনান। আমার আফনান।
অরিয়নের গলায় চুমু খেতে খেতে কাঁদতে থাকে আফরিন।

মিতা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। পরক্ষণেই তাকায় আফরিন আর অরিয়নের দিকে। ড্রয়িং রুমের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সকলেই তাকিয়ে আছে আফরিন আর অরিয়নের দিকে। হাবিব চৌধুরী, মায়া চৌধুরী আর ওয়াহিদ চৌধুরী অপরাধীর মতো মন খারাপ করে মিতার দিকে তাকিয়ে আছে।

অনবরত কাঁদতে থাকা আফরিন হুট করেই চুপ হয়ে যায়।

–আফরিন?
ধীরে ধীরে ডাক দেয় অরিয়ন।

আফরিনের কোনো সারা শব্দ না পেয়ে ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝতে পারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে আফরিন।

–আফরিন? আফরিন?
চেচিয়ে বলে অরিয়ন।

অন্যরা দরজার দিকে এগিয়ে আসার আগেই অরিয়ন আফরিনকে নিজের কোলে তুলে নেয়। তাড়াতাড়ি করে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। অরিয়নের পেছন পেছন হাবিব চৌধুরী, আনিকা চৌধুরী ও ওয়াহিদ চৌধুরী যায়। মিতা ধীরে ধীরে হেটে যায় মায়া চৌধুরীর সামনে।

–মিতা য..

–মা, আপু ফিরে এসেছে। আপু ফিরে এসেছে মা।
খুশি হয়ে বলে মিতা।

আফরিন ফিরে এসেছে তা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলো না মিতা। মায়া চৌধুরীর পাশে স্যুট পরা অচেনা একজনকে দেখতে পায় মিতা।

–ইনি?
প্রশ্ন করে মিতা।

–আফরিনের সাথে এসেছে।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–ওহ। দাঁড়িয়ে থেকো না, তাড়াতাড়ি চলো।
কথাটা বলেই রুমের দিকে হাটা শুরু করে মিতা।

মিতার পেছন পেছন মায়া চৌধুরীও হাটা শুরু করেছে। মিতা তাড়াতাড়ি হাটতেই বুঝতে পারে আফরিনকে অরিয়নের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দরজা খোলা, রুমে ঢুকতেই দেখতে পায় আফরিন বিছানায় শোয়া। পাশেই চেয়ার নিয়ে বসে আছে অরিয়ন। আফরিন শক্ত করে অরিয়নের হাত ধরে রেখেছে। বিছানার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে হাবিব চৌধুরী ও আনিকা চৌধুরী।

–ডাক্তারকে কল করেছি, কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে।
অরিয়নের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

মায়া চৌধুরী দৌড়ে গিয়ে খাটের অন্য পাশে উঠে বসে, আফরিনের হাত ধরে রাখে। “আফরিন আপু ফিরে এসেছে, রিয়নের প্রকৃত ভালোবাসা ফিরে এসেছে।” মনে মনে ভাবে মিতা।

–এইগুলা এখান থেকে ফালাও, জানোনা আফরিনের এলার্জি আছে?
হুট করে অরিয়ন নিজের জায়গা থেকে উঠে ড্রেসিং টেবিলের উপর থাকা রজনীগন্ধা ফুলের তোড়া ছুড়ে ফেলে দিয়ে চেচিয়ে উঠে।

মিতা অরিয়নের দিকে তাকিয়ে আছে। অরিয়নের চেহারা দেখে কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারছে অনেক বেশি চিন্তিত মনে হচ্ছে অরিয়নকে। অরিয়নের চেচামেচি শুনেই শায়লা দৌড়ে এসে ফ্লোরে পড়ে থাকা ফুল নিয়ে যায়।
অরিয়ন আবারও নিজের জায়গায় গিয়ে বসে আফরিনের হাত শক্ত করে ধরে আফরিনের দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের খোপায় থাকা ফুলগুলো টেনে বের করে নেয় মিতা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার চলে আসে। আফরিনকে ভালো ভাবে দেখে নেয়।

–টেনশনের কিছু নেই। বেশি উত্তেজিত হওয়ার কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
বলে ডাক্তার।

–ভয়ের কিছু নেই তো?
প্রশ্ন করে মায়া চৌধুরী।

–না। তবে জ্ঞান ফিরলে কিছু পরীক্ষা দিবো।
বলে ডাক্তার।

–ওকে।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

ডাক্তার আর কিছু না বলেই চলে গেছে। সবাই যার যার জায়গায় চেয়ার নিয়ে বসেছে। মিতা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কি বলবে জানা নেই। তবে আফরিন ফিরে এসেছে তার জন্য খুশি। কিন্তু বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করছে মিতা। আফরিন জড়িয়ে ধরার পর থেকে একবার ও অরিয়ন মিতার দিকে ফিরে তাকায় নি। যেন মিতার কোনো অস্তিত্ব নেই এই বাড়িতে। অরিয়নের মুখে আর চোখে তাকাতেই দেখতে পায় অরিয়ন এখনো তাকিয়ে আছে আফরিনের দিকে।

মিটমিট করে চোখ খুলে আফরিন। চোখ খুলে অরিয়নকে দেখে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না আফরিনের।

–আফনান।
লাফ দিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরে অরিয়নকে।

–আমি ফিরে এসেছি আফনান। তোমার আফরিন ফিরে এসেছে।
অরিয়নকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে আফরিন।

–আফরিন?
ডাক দেয় মায়া চৌধুরী।

মায়া চৌধুরীর ডাক শুনে অরিয়নকে ছেড়ে মায়া চৌধুরীর দিকে তাকায় আফরিন।

–মা।
মায়া চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে আফরিন।

–শান্ত হ মা, একটু শান্ত হ।
আফরিনের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে মায়া চৌধুরী।

–হুম মা।
কথাটা বলেই একটু সরে আসে আফরিন। অরিয়নের হাত শক্ত করে ধরে সামনের দিকে তাকাতেই চোখ যায় মিতার দিকে।

–মিতা।
মিতার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে আফরিন।

–আপু।
মিতা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় আফরিনের দিকে।

আফরিনের কথা শুনে যেন বাস্তবে ফিরে এলো অরিয়ন। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল মিতার দিকে। মিতার ঠোঁটের কোণে হাসি কিন্তু চোখ ছলছল করছে পানিতে। অরিয়ন এক দৃষ্টিতে মিতার দিকে তাকিয়ে থাকলেও মিতার নজর আফরিনের দিকে।

–এখানে বস। কেমন আছিস তুই?
বিছানায় মিতাকে বসতে বলে আফরিন।

–ভালো আপু, তুমি কেমন আছো? এতোদিন কোথায় ছিলে?
বিছানায় বসে প্রশ্ন করে মিতা।

–তোকে অনেক সুন্দর লাগছে মিতা। একদম নতুন বউয়ের মতো। কি বলো আফনান, তাই না? দেখো না, একদম বউ বউ লাগছে।
অরিয়নের কাধে মাথা রাখতে রাখতে বলে আফরিন।

অরিয়নের কাধে কত সহজেই নিজের মাথা রাখলো আফরিন তা দেখছে মিতা। বুকের মধ্যকার যন্ত্রণা যেন সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে মিতার জন্য। কি করলে এর শেষ হবে মিতার জানা নেই।

–তোর স্বামী কোথায়? এতোদিন পর কেনো এসেছিস।
প্রশ্ন করে বসে হাবিব চৌধুরী।

বাড়িতে ঢুকার পর থেকে মিতার অবস্থা ঠিকি খেয়াল করেছে হাবিব চৌধুরী। মিতার দিকে তাকাতেই যেন অপরাধবোধ ছেয়ে যাচ্ছে নিজের মধ্যে।

–স্বামী? কিসের স্বামী?
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে আফরিন।

–যার সাথে তুই পালিয়ে গিয়েছিলি।
শান্ত গলায় বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–কি সব আজেবাজে বলছো? আমি কেনো পালিয়ে যাবো? আমি তো…
কথাগুলো বলে থেমে যায় আফরিন। ঘটনা বুঝতেই পেরেই বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে সবার দিকে।

–তোমরা, তোমরা জানতেই পারোনি ঘটনা কি?
অবাক হয়ে বলে আফরিন।

–মানে? কি বলতে চাচ্ছো তুমি?
অন্য কেউ কথা বলার আগেই বলে উঠে অরিয়ন।

–তুমি বিয়ের দিন পরীর হাতে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলে আফরিন, এরপর…এরপর তোমাকে আর পাওয়া যায়নি। তন্নতন্ন করে খুজেছি তোমাকে।
রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলে অরিয়ন।

–হ্যাঁ আমি চিঠি দিয়েছিলাম আফনান, কারণ আমি সত্যি তোমার সাথে প্র‍্যাংক করতে চেয়েছিলাম।
জবাব দেয় আফরিন।

–এসব কিছুর মানে কি? কি সব বলছো তুমি?
চেচিয়ে চেয়ার থেকে উঠে যায় অরিয়ন।

–কি বলছিস তুই এসব আফরিন? সব সত্যি হলে এতোদিন এতোদিন কোথায় ছিলি তুই? আর নিচে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি কে?
আফরিনের পেছন থেকে প্রশ্ন করে উঠে মায়া চৌধুরী।

–পতি*তালয়ে।
জবাব দেয় আফরিন।

আফরিনের কথা শুনে যেন সবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। পুরো ঘরে নিস্তব্ধতা ছেয়ে যায়।

–পতি*তালয়ে?
বিরবির করে বলে মিতা।

–কি বলছিস? ঐখানে কিভাবে গেলি তুই?
কাঁদো কাঁদো কন্ঠে প্রশ্ন করে মায়া চৌধুরী।

–কি বলছিস আফরিন?
ওয়াহিদ চৌধুরী আফরিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে।

–বিয়ের দিন প্ল্যান মাফিক মিতাকে চিঠিটা দিয়ে আমি পার্লারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলাম। মাঝ রাস্তায় মিরাজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ি থামাই আমি।
কাঁদতে কাঁদতে বলে আফরিন।

–মিরাজ কে?
প্রশ্ন করে আনিকা চৌধুরী।

–আমার ক্লাসমেট।
বলে আফরিন।

–মিরাজের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম ওর মা মারা গেছেন, গাড়ির জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করছে। লোকালে যেতে অনেক সময় লাগবে। যেহেতু আমার বিয়ের এখনো অনেক সময় বাকি ছিলো আর আমি ও দেরী করে আসরে আসতে চাইছিলাম তাই আমি গাড়ি করে কুমিল্লা দিয়ে আসার কথা বলি।
আবারও বলে উঠে আফরিন।

–চট্রগ্রাম ছাড়িয়ে কুমিল্লার রাস্তায় কিছুক্ষণ যেতেই একটা মহিলাকে দেখি বাচ্চাসহ রাস্তায় পাশে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে আর কান্না করছে। গাড়ি থামিয়ে আমি আর মিরাজ কথা বলতে নিয়েই হুট করে ৫/৬ জন কোথা থেকে চলে আসলো বুঝতেই পারিনি।
চোখের পানি মুছে বড় বড় শ্বাস নেয় আফরিন।

–ওরা আমাদের ব*ন্দুক আর চা*পাতি নিয়ে গাড়িতে তুলে। আমার, মিরাজ আর ড্রাইভারের চোখে কাপড় বেধে ফেলে সাথে সাথে। নিয়ে যায় কুমিল্লা বর্ডারের কাছে। প্রথমে ছিনতাইকারী ভাবলেও পরে বুঝতে পারি এরা আসলে ছিনতাইকারী না। বর্ডারে এদের নিজস্ব লোক আছে, গোপন রাস্তা দিয়ে আমাদের ভা*রত পাচার করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ পার হতেই ওরা মিরাজ আর ড্রাইভার আংকেলের কি করেছে আমি জানিনা, শুধু জানি চোখ খুললে আমি নিজেকে অনেকগুলো মেয়ের সাথে একা পাই। বুঝতে পারি এরা হিউম্যান ট্রা*ফিকিংয়ের সদস্য।

আফরিনের কথা গুলো শুনতেই মাটিতে ধপ করে বসে পড়ে ওয়াহিদ চৌধুরী। মায়া চৌধুরী নিজের হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে। দু চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে তার। ফ্লোরে বসে পড়া ওয়াহিদ চৌধুরীকে দৌড়ে গিয়ে ধরে হাবিব চৌধুরী। মিতা অবাক হয়ে শুধু আফরিনের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বইছে মিতার। অরিয়ন দূরে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। চেহারার এক্সপ্রেশন দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

–কি থেকে কি হয়ে গেলো মাথায় যেন কিছুই ঢুকছিলো না আমার। আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় এক পতি*তালয়ে,যেখানে জোরপূর্বক আমাদের দিয়ে পতি*তাবৃত্তি করানো হতো। যারা করতে চাইতো না তাদের উপর নির্যাতন চালানো হতো।
কথাগুলো বলতেই নিজের মুখ দু হাত দিয়ে ঢেকে ফেলে আফরিন।
মায়া চৌধুরী আফরিনকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে শুরু করলেন আবারও।

–মা প্লিজ কেঁদো না, আপু নিজেকে সামলাও।
মিতাও আফরিন আর মায়া চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগে।

–ওখানে…ওখানে ৩ মাস রাখা হয়েছিলো আমাকে, এরপর…এরপর আমাদের কয়েকজনকে রাশিয়া পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানের একটা পতিতালয়ে আরও ৪ মাস ছিলাম আমরা।
হেচকি দিতে দিতে বলে আফরিন।

–এরপর আমাকে আর দু জন মেয়েকে পাঠানো হয় রাশিয়ান এক মা*ফিয়া ফ্যামিলিতে। সেখানে একজন ভালো মানুষ আমার সব জানতে পারে। সেই ব্যবস্থা করে তার মানুষ দিয়ে আমাকে এখানে পাঠিয়েছে।
মায়া চৌধুরীর বুকে নিজের মুখ গুজে কাঁদতে কাঁদতে বলে আফরিন।

–ওরা, ওরা আমাকে নির্যাতন করেছে মা। কি অসহ্য সেই যন্ত্রণা। আমি শুধু, আমি শুধু প্রে করতাম তোমাদের আর…আর আফনানের। আমাকে খুজে বের করার। কিন্তু…কিন্তু..
কথা বলতে বলতে আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে আফরিন।

–আফরিন? আফরিন?
বলে মায়া চৌধুরী।

–আপু? আপু কথা বলো?
বলে মিতা।

–মায়া, ও আবারও উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। ওকে একটু রেস্ট নিতে দেও।
নিজের চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে হাবিব চৌধুরী।

–আমি গিয়ে নিচে থাকা লোকটার সাথে কথা বলছি, উনি না থাকলে আফরিনকে পেতাম না আমরা।
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় আনিকা চৌধুরী।

জ্ঞানহীন আফরিনকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়েছে মিতা আর মায়া চৌধুরী। দু জনের চোখের পানি যেন এক মিনিটের জন্যও থামছে না। অরিয়ন এক দৃষ্টিতে বিছানায় শুয়ে থাকা আফরিনের দিকে তাকিয়ে আছে। পরক্ষণেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় অরিয়ন।

–মিতা? অরিয়নের পিছন পিছন যা। ও আবার কি করে বসে।
মিতার কাধে হাত রেখে বলে হাবিব চৌধুরী।

–কিন্তু আপু…

–আফরিনকে দেখার জন্য আমরা আছি। তুই যা।
আবারও বলে হাবিব চৌধুরী।

অরিয়ন নিজের রুম থেকে বের হয়েই আবরারের রুমে গিয়ে প্রবেশ করে। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা অরিয়ন বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। নিজের দু হাত কোমরে রাখা। দাঁতে দাঁত চেপে আছে। চোখ মুখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে।

–আয়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া।
চিৎকার করে উঠে অরিয়ন।

রুমে থাকা জিনিস একের পর মাটিতে ছুড়ে ফেলতে শুরু করে। কিছুতেই যেন নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারছে না অরিয়ন।

–আয়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া।
নিজের মাথার চুল রাগে টেনে ধরে চেচিয়ে উঠে অরিয়ন।

কি করবে কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না অরিয়নের। চোখের সামনে শুধু সব কিছু ভাসছে। বিয়ের দিনের কথা, আজ আফরিনের কথা।

–অরিয়ন?
রুমে প্রবেশ করতে নিয়েই ডাক দেয় মিতা।

নিজের জায়গায় পাথর হয়ে রইল মিতা। পুরো রুম এলোমেলো করে ফেলেছে অরিয়ন। বিছানার চাদর, ফুলের টব, ড্রেসিং টেবিলের আয়না সব চুরমার হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অরিয়ন নিজের চুল টানছে পাগলের মতো। অরিয়নের অবস্থা দেখে মিতার মনটাও যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে।

–অরিয়ন?
আবারও ডাক দেয় মিতা। মিতার চোখে পানি ছলছল করছে।

মিতার ডাক শুনতেই ফিরে তাকায় অরিয়ন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মিতা। চোখেমুখে দুঃখের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কান্না করার কারণে চোখ মুখ লাল হয়ে আছে মিতার। খোপায় থাকা ফুলগুলো আর খোপায় নেই। এলোমেলো চুল মিতার মুখে এসে পড়েছে।

“ইউ নিড পিস”

“ইউ নিড পিস”

“ইউ নিড পিস”

“শি ইজ হেয়ার”

“ইউ নিড হার”

“ইউ নিড হার”

“আই নিড পিস”

অরিয়নের মাথায় বারবার ঘুরপাক খেতে থাকে কথাগুলো। দু কদমে হেটে গিয়ে মিতার সামনে দাঁড়ায় । হঠাৎ করে অরিয়ন সামনে চলে আসাতে ভয়ে এক পা পিছিয়ে নিতে নেয় মিতা। মিতা পিছপা হতেই মিতার বাহু ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে অরিয়ন। পরক্ষণেই মিতার ঠোঁট স্পর্শ করে অরিয়নের ঠোঁটকে।

চলবে….