#পারমিতা
#পর্ব_৫৮(অন্তিম)
#লেখিকা_Nabila_Ahmed
–না।
অরিয়নের কথা শুনে যেন পা থেকে মাটি সরে গেলো মিতার। কথা বলার কোনো শক্তিই নেই মিতার মধ্যে।
–তুই ঔষধ খাস নি ঠিক মতো?
মিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে অরিয়ন।
–ঔষধ খেলেও তা ১০০% সব সময় কাজ করে না,রিয়ন।
মিতার কথার উত্তরে কষ্ট আর রাগ স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে।
–আমি ভেবেছিলাম তুমি খুশি হবে কিন্তু…কিন্তু তোমার মুখ অন্য কিছু কেন বলছে রিয়ন? কেন তুমি খুশি নও? আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন এই পৃথিবীতে আসুক তা কী তুমি চাও না?
কথাগুলো বলতেই মিতার চোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু করেছে।
–কেন চাইবো না?
নিজের দুই হাত দিয়ে মিতার গাল ধরে বলে অরিয়ন।
–তা…তাহলে?
কথাটা বলতেই হেচকি তুললো মিতা।
–আমি চাই আমাদের অনেকগুলো বাবু হোক। পুরো ঘরে তাদের হইচইপূর্ণ হয়ে যাক। কিন্তু..
–কিন্তু?
–কিন্তু তুই এখনো ছোট। সামনে তোর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। আমি চাই না এই বাচ্চার জন্য তুই তোর স্বপ্ন ত্যাগ কর। কারণ পরী, আমি সব কিছু সহ্য করতে পারবো কিন্তু, কখনো আমাদের সন্তানকে দেখে তুই আফসোস কর সেটা আমি চাই না। আমি চাই সে পৃথিবীর সেরাটা পাক। তার জন্য যদি আমাকে অপেক্ষা করতে হয় তাহলে আমি অপেক্ষা করতে রাজি আছি।
–এটাই কারণ? অন্য আর কোনো কারণ নেই তোমার খুশি না হওয়ার?
প্রশ্ন করে মিতা।
–নাহ।
উত্তর দেয় অরিয়ন।
–তাহলে মন খারাপের কিছুই নেই। আমি সব কিছু সামলে নিতে পারবো, রিয়ন। আমার দায়িত্ব আর স্বপ্ন কখনো একে অপরের জন্য বাধা হবে না। তুমি জানো না খবরটা জানার পর থেকে কত খুশি হয়েছি আমি।
নিজের চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে মিতা।
–সত্যি সামলে নিতে পারবি? আফসোস করবি না তো?
আবারও প্রশ্ন করে অরিয়ন।
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে মিতা।
–তুই…তুই জানিস না আমাকে কি দিয়েছিস।
কথাটা বলেই মিতাকে কোলে তুলে নেয় অরিয়ন। মিতাকে কোলে নিয়েই ঘুরতে থাকে।
–কি করছো তুমি, মাথা ঘুরাবে তো।
অরিয়নের কাঁধ শক্ত করে ধরে বলে মিতা।
–আমার মনে হচ্ছে আমি খুশিতে পাগল হয়ে যাবো,পরী। আমি বাবা হতে যাচ্ছি। বাবা।
মিতাকে কোলে নিয়েই বিছানার উপর বসে অরিয়ন।
মিতার গালে আলতো করে চুমু খায় অরিয়ন।
–আজকেই তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। তুই কিন্তু কোনো ভারি কাজ করবি না। আর হ্যাঁ, কোনো…কোনো টেনশন করবি না। যত টিচার লাগে সব এনে দিবো তোকে। ফেল হলে দরকার হলে আবার দিবি এক্সাম তাও টেনশন করবি না।
নিশ্বাস না ফেলেই একের পর এক কথা বলতে থাকে অরিয়ন।
–শান্ত হও রিয়ন। তুমি তো দেখি আমার থেকে বেশি পাগল হয়ে যাচ্ছো।
–হবো না? তুই জানিস না কবে থেকে আমার ইচ্ছ করছিলো বাবা হওয়ার কিন্তু, তোর কথা ভেবে ধৈর্য্য ধরে ছিলাম।
মিতার কপালে চুমু দিয়ে বলে অরিয়ন।
–তোমার কি মনে হয়, আমি একজন ভালো মা হতে পারবো?
প্রশ্ন করে মিতা।
–তুই সবথেকে সেরা মা হয়ে দেখাবি।
মৃদু হেসে উত্তর দেয় অরিয়ন।
–আর তুমি বাবা।
কথাটা বলেই অরিয়নকে জড়িয়ে ধরে মিতা।
***********************
মিতার রুমে মানুষের হইচই মেলে গেছে। খাটের উপর বসে আছে মিতা। মিতার সাথেই এক পাশে বসে আছে মায়া চৌধুরী। আনিকা চৌধুরীর সাথে এটাসেটা নিয়ে কথা বলতে ব্যস্ত। দুজনে মিলে কীভাবে কী করবে তাই ঠিক করছে। মিতার অন্য পাশে বসে আছে আফরিন। খালা হিসেবে কি কি দায়িত্ব পালন করবে সেটাই বলছে মিতাকে।
হাবিব চৌধুরী আর ওয়াহিদ চৌধুরী পার্টির আয়োজন করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চৌধুরী বাড়ির উত্তরাধিকার আসছে এর থেকে বড় খুশির হয়তো আর কিছুই নেই তাদের কাছে।
–আরিয়ানের বিয়ের ঝামেলাটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলেই মিতাকে ঢাকা পাঠিয়ে দিতে হবে।
বলে হাবিব চৌধুরী।
–নিচ তলা পুরোটা ভালোভাবে মিতার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। উপরে উঠানামা করা ওর জন্য একটুও ঠিক হবে না।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।
–কিন্তু ওর সাথে অরিয়নের পাশাপাশি আর থাকবে কে? কাজের লোক ছাড়াও পরিবারের একজন থাকা উচিৎ দেখাশোনা করার জন্য৷
আবারও বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।
–আমি থাকবো, মিতার সাথে।
বলে মায়া চৌধুরী।
–তাহলে ত…
–আমি থাকতে চাই।
হাবিব চৌধুরীর কথা শেষ হওয়ার আগেই আনিকা চৌধুরী বলে উঠে। হাবিব চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে আছে আনিকা চৌধুরী।
–তুমি থাকবে?
প্রশ্ন করে হাবিব চৌধুরী।
–হ্যাঁ। আমার নাতি-নাতনির খেয়াল আমি রাখতে চাই।
জবাব দেয় আনিকা চৌধুরী।
আনিকা চৌধুরীর কথা শুনে খুশি হয়ে যায় মিতা। এই সন্তান এখনো পৃথিবীতে আসেই নি, তাতেই সবার সাথে কেমন যেন ভালো সম্পর্ক তৈরি করে দিচ্ছে। নিজের অজান্তেই পেটে হাত দেয় মিতা।
–তাহলে তাই হবে। আরিয়ানের বিয়ের পর অরিয়নের সাথে আনিকাও ঢাকা যাবে।
বলে হাবিব চৌধুরী।
আনিকা চৌধুরীর নিজ থেকে এমন পদক্ষেপে বাড়ির সকলেই অনেক খুশি। বিশেষ করে অরিয়ন।
**********************
আবরারের বিয়ের তারিখ ঘনিয়ে আসছে। আগামী সপ্তাহেই আবরারের বিয়ে। মিতা নিজের রুমে বসে থাকা আর মাঝে মধ্যে সব ঠিক মতো হচ্ছে নাকি তা দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে হচ্ছে না। হচ্ছে না বললে ভুল হবে, কেউ কিছুই করতে দিচ্ছে না। অরিয়ন বরং দুটো কাজের লোক মিতার জন্য বেশি রেখেছে। সারাক্ষণ মিতার আশেপাশে ঘুরঘুর করে তারা।
রুমে একা একা ভালো লাগছে না বলেই একটু আগেই নিচে নেমে আসে মিতা। পুরো বাড়িতে মেহমানের আনাগোনা। একেক জন কাজের লোক একেক কাজ ব্যস্ত। মিতার মাত্র দুই মাস অতিক্রম হয়েছে কিন্তু সবাই যেভাবে মিতার দেখাশোনা করছে, মনে হচ্ছে ৮/৯ মাস হয়ে গেছে মিতার।
ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসে মিতা। টেবিল জুরে এটাসেটা রাখা। প্রেগন্যান্সি যে এতো কষ্টের হবে তা ভাবতেও পারেনি মিতা। দিনের অর্ধেক বেলা মাথা ঘুরায় তো বাকি অর্ধেক বেলা শুধু বমি বমি ভাব। মিতা তো মাঝে মধ্যে না পারতে অরিয়নকেই বকাঝকা করে।
টেবিলের রাখা ফল দেখে হুট করেই খেতে মন চায় মিতার। লোভ যেন সামলাতেই পারছে না। ইচ্ছে করছে এই ফলটা টমেটো সস দিয়ে খেতে। কেমন অদ্ভুত ইচ্ছা এটা তা নিজেও বুঝতে পারছে না মিতা। তাও লোভ না সামলাতে পেরে হাতে তুলে নেয়।
–মিতায়ায়ায়া…
ফলটা মুখের কাছে নিতেই পিছন থেকে আনিকা চৌধুরীর ডাক শুনতে পায় মিতা।
মিতা কিছু বুঝে উঠার আগেই আনিকা চৌধুরী হাত থেকে ফল কেড়ে নেয়। মিতা অবাক হয়ে আনিকা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে থাকলো।
–কি হয়েছে আন্টি?
প্রশ্ন করে মিতা।
–কি করতে যাচ্ছিলে তুমি? কয় টুকরা খেয়েছো?
প্রশ্ন করে আনিকা চৌধুরী।
–এখনো এক টুকরাও খাই নি।
বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জবাব দেয় মিতা।
–দাঁড়াতে হবে না। বসে পড়ো। গর্ভবতীদের আনারস বেশি খেতে নেই। এতে বাচ্চা ন*ষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
চিন্তিত সুরে বলে আনিকা চৌধুরী।
মিতা টেবিলে রাখা আনারসের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকায়। কি হতে পারতো তা ভাবতেই হাত পা কাঁপছে মিতার।
–বেশি ইচ্ছে করলে এক টুকরো খেতে পারো। এতে সমস্যা হবে না, ইনশাআল্লাহ।
বলে আনিকা চৌধুরী।
–না না, আমি একটুকরো ও খাবো না। তুমি না থাকলে কী যে হতো আন্টি।
হঠাৎ করে আনিকা চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে বলে মিতা।
আনিকা চৌধুরী অবাক হয় কিছুটা। এরপর আস্তে আস্তে মিতার মাথায় হাত রাখে। নিজের মাথায় আনিকা চৌধুরীর হাত অনুভব করতেই চোখ দিয়ে পানি পড়ে মিতার।
–উপরে গিয়ে রেস্ট নেও যাও।
বলে আনিকা চৌধুরী।
–আচ্ছা।
চোখের পানি মুছে বলে মিতা।
*******************
আবরারের বিয়েটা ভালোভাবেই শেষ হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই মধ্যেই মিতাকে ঢাকা পাঠিয়ে দেওয়া হবে। যেহেতু মিতার ঢাকা মেডিকেলে চান্স হয়েছে সেহেতু ঢাকাতে যেতে হবে মিতাকে। ঢাকার ব্যবসা দেখার ভার পড়েছে অরিয়নের আর চট্রগ্রামের টা আবরারের কাঁধে। যদিও ফাহমিদাও ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছিলো কিন্তু সেখানে ভর্তি হয়নি ফাহমিতা। গতমাসেই ফাহমিতার বাবা হঠাৎ করেই স্ট্রোক করেন। তার কন্ডিশন এতোটাই খারাপ ছিলো যে, বাবাকে রেখে এক শহর থেকে অন্য শহর যেতে চাইছিলো না ফাহমিতা। ভেবেছিলো ন্যাশনালের কোনো একটা সাবজেক্টে অনার্স করে ফেলবে। কিন্তু আবরার জোর করে প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে ফাহমিদাকে।
ঢাকা চলে এসেছে অরিয়ন, মিতা আর আনিকা চৌধুরী। নিচ চলায় মিতা আর অরিয়ন থাকে। উপর তলায় আনিকা চৌধুরীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে অরিয়ন। আজ কাজের খুব প্রেশার গেছে অরিয়নের উপর। তাই বিছানাতে শুতেই ঘুমিয়ে যায়।
অরিয়নের ঘুম ভাঙ্গে গুন গুন করার শব্দে। চোখ খুলতেই দেখতে পায় মিতা বিছানায় বসে কাঁদছে। মিতার চোখে পানি দেখতেই লাফিয়ে উঠে অরিয়ন। বুখ যেন ধরফর করতে লাগলো অরিয়নের।
–কি হয়েছে? কাঁদছো কেন তুমি?
তাড়াতাড়ি মিতার মুখোমুখি হয়ে বলে অরিয়ন।
অরিয়নকে দেখে যেন আরও বেশি কাঁদতে লাগলো মিতা।
–আরে লাভ, এভাবে কাঁদছো কেন? কি হয়েছে আমাকে বলো?
চিন্তিত সুরে বলে অরিয়ন।
–আমার খিদে পেয়েছে।
কাঁদতে কাঁদতে বলে মিতা।
–এঁ্যাহ?
থতমত খেয়ে বলে ফেলে অরিয়ন।
মিতার কান্না দেখে ভেবেছিলো সিরিয়াস কিছু হয়তো হয়েছে। কিন্তু খিদে লেগেছে তাই কান্না করছে তা ভাবতেও পারছে না মিতা।
–হ্যাঁ। একটু পর পর শুধু খিদে লাগে। কিন্তু কিছুই খেতে পারিনা। কিন্তু…কিন্তু…
কথাটা বলেই আবারও কান্না করা শুরু করে মিতা।
–ওমা, খিদে লাগলে খাবে। তাতে কাঁদতে হবে কেন? আমাকে বলো কি খাবে তুমি?
মিতার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে অরিয়ন।
–তুমি তো জানোই…আমি পুদিনাপাতা একদমও পছন্দ করিনা।
–হ্যাঁ লাভ, আমি তো জানি।
–আমার পুতিনাপাতার চাটনি খেতে ইচ্ছে করছে..এঁ্যায়ায়ায়ায়ায়ায়া।
কথাটা বলেই কান্না করতে থাকে মিতা।
অরিয়ন হাসতে গিয়েও হাসলো না। গুগলে পড়েছিলো গর্ভবতীদের হরমোন চেঞ্জ হয়। তাই তাদের মুডটাও চেঞ্জ হয়। তাই বলে এতো চেঞ্জ হবে তা কল্পনাও করতে পারেনি অরিয়ন।
–আচ্ছা লাভ, আমি এক্ষুনি তোমাকে পুনিদার চাটনি এনে দিচ্ছি।
নিজের হাসি আটকানোর চেষ্টা করতে করতে বলে অরিয়ন।
–তুমি আমাকে তুমি তুমি করে কেন বলছো? তুমি না তুই বলো? তুমি কি আমার উপর রাগ?এঁয়ায়ায়ায়ায়ায়া…
কথাটা বলে আবারও কান্না শুরু করে মিতা।
–আরে বাবা। কান্না করে না। আমি রাগ না তো।
মিতাকে নিজের কোলে বসায় অরিয়ন।
–তাহলে?
–তাহলে, কিছুদিন পর আমাদের সন্তান আসবে। এরপর সে এসে যদি দেখে তার মায়ের সাথে আমি তুই তুই করে কথা বলি তাহলে কী ভাববে বলো তো! আমি চাই আমার সন্তান ভাবুক আমরা পৃথিবীর সেরা মা-বাবা ও স্বামী-স্ত্রী।
–ওহ।
–হ্যাঁ।
–পুদিনাপাতায়ায়ায়া…
কথাটা বলে আবারও কান্না শুরু করে মিতা।
–আরে বাবা যাচ্ছি তো আমি। একটু ধৈর্য্য ধর।
কথাটা বলেই তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে যায় অরিয়ন।
**************************
মিতার পাঁচ মাস চলছে।
পেটের বাবু এখন নড়াচড়া করতে শুরু করেছে। ইদানীং মিতার ঘুম ভাঙ্গে পেটের উপর অরিয়নের মাথা অনুভব করে। যতোক্ষণ এক সাথে থাকে ততোক্ষণ শুধু বাচ্চা কী করছে, লা*থি দিয়েছে কি না তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। পুরো ঘরে ছোট ছোট বাচ্চাদের পোস্টারে ভরে গেছে।
অন্যদিকে আনিকা চৌধুরী মিতাকে প্রতিনিয়ত আদর যত্ন করেই যাচ্ছে। নিজের নাতি-নাতনির যেন কোনো রুপ সমস্যা না হয় সেই দিকে খেয়াল রাখছে।
আফরিনের বিয়ে ঠিক হয়েছে কিছুদিন আগেই। অরিয়ন সব খোঁজ নিয়ে জানতে পেয়েছে ছেলে খুবই ভালো মানুষ। যেহেতু মিতার জন্য জার্নি করা কষ্টের হয়ে যাবে তাই বিয়েটা ঢাকাতেই করবে বলে ঠিক করেছে দুই পরিবার। সবাই মিলে তাই আফরিনের বিয়ের জন্য বাজার করতে গিয়েছে। মিতা খাটে বসে নিজের পড়ালেখা করতে ব্যস্ত।
********************
নিজের রুমে বসে টিভি দেখছে আফরিন। একটু আগেই সবাই মিলে বসুন্ধরা শপিংমল থেকে বিয়ের শপিং করে ফিরেছে। পুরো রুম এটা সেটায় ভরে আছে। বিছানায় বসতেই চোখ যায় টিভির দিকে। ব্রেকিং নিউজে কিছুওটা দেখতেই উঠে দাঁড়ায় আফরিন।
“আজ দুপুরের পর থেকেই ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্যকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ধারণা করা হচ্ছে তাকে অপ*হরণ করা হয়েছে ”
আফরিন নিউজটা দেখে যেন এড়িয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু যখনি মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে যাবে ঠিক করলো তখনি চোখ যায় টিভির পর্দায়। সামনেই ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্যের ছবি ভাসছে। ছবিটা দেখে চোখ বড় বড় হয়ে যায় আফরিনের। মনে পড়ে যায় এই লোককেই দেখেছিলো আজ বসুন্ধরা শপিংমলে।
ফ্ল্যাশব্যাক :
শপিং করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সকলেই। ফাহমিদা, মায়া চৌধুরী, ওয়াহিদ চৌধুরী ও হাবিব চৌধুরী এসেছে আফরিনের সাথে। ১১ টা করে বাসা থেকে বের হলেও এখন প্রায় ২:৩০ টা।
–কিছু খেয়ে নি মা। খুব খিদে লেগেছে।
মায়া চৌধুরীকে ডাক দিয়ে বলে আফরিন।
–আচ্ছা চল।
সকলে গিয়ে একটা খাবারের দোকানে বসেছে। খাবার অর্ডার দেওয়া হয়েছে গেছে। সকলের উদ্দেশ্যে ড্রিংকস দিয়ে গেছে ওয়েটার। ড্রিংকসে চুমুক দিতেই আফরিনের চোখ যায় একটু দূরের দোকানে বসে থাকা এক লোকের দিকে। চেনাচেনা লাগছে ভেবে উঠে দাঁড়ায় আফরিন।
–কোথায় যাচ্ছিস?
প্রশ্ন করে ওয়াহিদ চৌধুরী।
–তোমরা বসো, আমি এইতো আসছি।
কথাটা বলেই হাটা শুরু করে আফরিন।
যতো এগিয়ে যাচ্ছে ততোই যেন নার্ভাসনেস কাজ করছে আফরিনের। লোকটির কাছাকাছি যেতেই লক্ষ্য করে মধ্য বয়স্ক এক লোকের সাথে কিছু নিয়ে কথা বলছে ছেলেটি।
–সাদমান?
পিছন থেকে ডাক দেয় আফরিন।
আফরিনের কথা শুনেই ফিরে তাকায় সাদমান। বড় করে নিশ্বাস ছাড়ে আফরিন। যার কারণে আজ বাড়িতে নিরাপদে থাকতে পারছে আফরিন, যার কারণে এক জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে এসেছে তাকে সামনে দেখতে পেয়ে খুশি হয়ে যায় আফরিন।
–আমাকে চিনতে পেরেছো? আমি সেই মে..
–চিনতে পেরেছি আপু।
আফরিন কথা বলার আগেই জবাব দেয় সাদমান।
–চিনতে পেরেছো! তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। তোমার জন্য আমি আ..
–আমি একটু ইমার্জেন্সি মিটিংয়ে আছি।
বলে উঠে সাদমান।
–ওহ। আচ্ছা। বাই।
কথাটা বলতেই সাদমান নিজের টেবিলে ঘুরে বসে। ক্ষণিকের জন্য আফরিনের চোখ যায় পাশে বসে থাকা লোকের দিকে।
বর্তমান
————————————
আফরিনের ধ্যান ভাঙ্গে নিমিষেই। সাদমানের সাথে বসে থাকা লোকটিই সেই লোক যাকে অপ*হরণ করা হয়েছে বলে ব্রেকিং নিউজ চলছে। তাহলে সাদমানের এখানে আসার উদ্দেশ্য কী এটাই ছিলো? এই লোকটাই বা কী করেছে?
এতোকিছু না ভেবে তাড়াতাড়ি করে মোবাইল হাতে নেয় আফরিন। উদ্দেশ্য পুলিশকে সব জানানো। কিন্তু মোবাইল হাতে নিতেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায় আফরিন।
যেই ছেলের জন্য আজ এভাবে বাঁচতে পারছে আফরিন তাকে কীভাবে পুলিশে ধরিয়ে দিবে আফরিন? আফরিনের মন যে তা মানছে না।
“যা হওয়ার হবে” কথাটা ভেবেই মোবাইল রেখে দেয় আফরিন।
***********************
–কংগ্রেচুলেশন, আপনার মেয়ে হয়েছে।
হাসপাতালের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অরিয়নকে দেখে বলে নার্স।
–পরী? পরীর কী অবস্থা? ও ঠিক আছে তো?
প্রশ্ন করে অরিয়ন।
–মা ও বাচ্চা দুজনেই সুস্থ আছে।
বলে নার্স।
নার্সের কথা শুনতেই সকলেই খুশিতে লাফিয়ে উঠে। হাবিব চৌধুরী নার্সদের বকসিস দিতে চলে যায়। অন্য দিকে আনিকা চৌধুরী ও মায়া চৌধুরী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে।
–মিতাকে কখন দেখতে পারবো?
প্রশ্ন করে মায়া চৌধুরী।
–এইতো কিছুক্ষণের মধ্যে কেবিনে নিয়ে গেলেই দেখতে পারবেন।
কথাটা বলেই চলে যায় নার্স।
কেবিনের মধ্যে:
মিতাকে কেবিনে আনতেই আগে তাড়াতাড়ি করে রুমে প্রবেশ করে অরিয়ন। সকলেই বাইরে অপেক্ষা করছে। সন্তানকে প্রথমবার দেখার সুযোগটা আগে অরিয়নকে দিতে চায় বলেই অপেক্ষা করছে সবাই।
মিতা বিছানায় বসে আছে। বাচ্চটা মিতার কোলে। অরিয়নকে দেখতেই যেন মুখটা ভার হয়ে এলো মিতার।
–কি হয়েছে?
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে অরিয়ন।
–কি হয়েছে? ১০ টা মাস কষ্ট করলাম আমি। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো কিছুই করতে পারনি। আর ইনি, ইনি দেখতে হয়েছে সেইম টু সেইম তোমার কপি।
মুখ ভেংচি কেটে বলে মিতা।
অরিয়ন মিতার দিকে এগিয়ে যেতেই বাচ্চাকে অরিয়নের দিকে এগিয়ে দেয় মিতা। সাদা তোয়ালে জড়ানো মেয়েটা এতোই ছোট কীভাবে কোলে নিবে তাও বুঝতে পারছে না অরিয়ন। কোনোমতে সামলে নেয় অরিয়ন। মেয়ের দিকে তাকাতেই হাসি ফুঁটে অরিয়নের মুখে।
–আমার প্রিন্সেস।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।
এগিয়ে গিয়ে মিতার কপালে চুমু খায়।
–ধন্যবাদ। আমাকে এতোবড় একটা উপহার দেওয়ার জন্য। আমার অপরাজিতাকে দেওয়ার জন্য।
বলে অরিয়ন।
–অপরাজিতা?
বলে মিতা।
–হ্যাঁ। আমার মেয়ের নাম অপরাজিতা চৌধুরী।
–খুব সুন্দর হয়েছে।
বলে মিতা।
–কই বাকি সবাই তাড়াতাড়ি আসো আমার মেয়েকে দেখতে।
বাইরের সবার উদ্দেশ্যে বলে অরিয়ন।
অরিয়নের কণ্ঠ শুনতেই সকলে দ্রুত রুমে প্রবেশ করে। আনিকা চৌধুরী অরিয়নের কোল থেকে মেয়েকে আগে নিয়ে নেয়। কপালে চুমু খেতে থাকে একের পর এক।
**************************
২ মাস পর।
হলের বাইরে অপরাজিতাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অরিয়ন৷ পাশেই হাতপাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আনিকা চৌধুরী।
আজ মিতার প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। যেহেতু দুধের বাচ্চা তাই বাচ্চাসহই আসতে হয়েছে মিতাকে। কিছুক্ষণ পর পর এসে বাচ্চাকে দুধ খায়িয়ে যায় মিতা।
–অপরাজিতা মা আমার, নিজের মাকে পরাজিত হতে দিও না মামুনি।
মেয়েকে কোলে দোলাতে দোলাতে বলে অরিয়ন।
–ও তো সেই কখন থেকেই ঘুমাচ্ছে। তুই শুধু শুধু কথা বলে ওকে উঠিয়ে দিচ্ছিস।
বলে আনিকা চৌধুরী।
–দেখো না মা, সেই যে ৩০ মিনিট আগে ঘুমালো আর তো উঠলো না। আমার তো টেনশন হয়।
বলে অরিয়ন।
–দুধের বাচ্চারা ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুমায়। কিন্তু তোর মতো বাপ থাকলে এরা শান্তিতে ঘুমাতেও পারবে না।
–আচ্ছা আচ্ছা তোমার নাচনিকে আর জ্বালাবো না।
কথাটা বলেই আবারও দোলাতে থাকে অরিয়ন।
এক্সাম হল থেকে বের হতেই দৌড়ে অরিয়নের কাছে যায় মিতা। অপরাজিতা দ্রুত নিজের কোলে তুলে নেয়। আনিকা চৌধুরী মিতার হাত থেকে ফাইলটা নিজেই নিয়ে নেয়।
–কান্না করেনি তো?
বলে মিতা।
–মেয়ে আমার বাবা পাগল। তোমার জন্য কান্না করবে না হুহু।
প্রাউডলি বলে অরিয়ন।
মিতা কিছু বললো না। ভেংচি কাটলো। আনিকা চৌধুরী মুচকি হাসি দিলো।
–একদিন ওকে নিয়েও আমাদের স্কুল-কলেজ যেতে হবে তাই না?
হাটতে হাটতে বলে মিতা।
–ওকে কিন্তু গার্লস স্কুল কলেজে পড়াবো আমি বলে দিলাম।
বলে অরিয়ন।
–আদিম যুগের মানুষ।
কথাটা বলেই গাড়িতে উঠে বসে মিতা আর অরিয়ন।
আনিকা চৌধুরী সামনের সিটে গিয়ে বসে।
গাড়িতে বসতেই মিতা নিজের মাথা অরিয়নের কাঁধে রাখে। অরিয়ন আলতো হাতে মিতার হাত স্পর্শ করে।
–আই লাভ ইউ।
বিরবির করে বলে মিতা।
–আই লাভ ইউ টু মাই লাভ।
উত্তর দেয় অরিয়ন।
–চলুন কাকা।
ড্রাইভারের উদ্দেশ্য বলে অরিয়ন।
গাড়ি চলতে শুরু করে। সাথে করে চলতে শুরু করে গাড়িতে থাকা মানুষের জীবন। যে জীবনে সুখ-দুঃখ তো থাকবেই কিন্তু বিচ্ছেদ বলে কিছু নেই। যা আছে তা শুধু ভালোবাসা আর পরিপূর্ণতা।
সমাপ্ত।