#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_1
#ইয়াসমিন_খন্দকার
“নির্ঝর ভাইয়া দীর্ঘ ৫ বছর পর বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে আপ্পি! চল দেখে আসবি সবার জন্য কত সুন্দর সুন্দর উপহার এনেছে।”
নিজের ছোট বোনের মুখে এহেন কথা শুনে আফিফা খুব একটা আগ্রহ দেখালো না৷ পড়ার টেবিলে যেভাবে বসে ছিল ঠিক সেভাবেই বসে রইল। মনযোগ দিল নিজের আইটেমটি সঠিক ভাবে সম্পূর্ণ করার দিকে। এদিকে নিজের বড় বোনকে নীরব দেখে আরিশা বলে উঠল,”এই আপ্পি! কিছু বলছ না কেন? চলো না নিচে যাই।”
আফিফা এবার চোখ তুলে তাকালো আরিশার দিকে৷ অতঃপর নিজের মোটা ফ্রেমের চশমায় হাত বুলিয়ে বলল,”তুই যা। আমি এখন যেতে পারব না। আমার এখন অনেক পড়া বাকি আছে। কালকের মধ্যে এই আইটেমটা জমা দিতে হবে। সামনেই আমাদের মেডিকেল সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম।”
নিজের বড় বোনের এই সিরিয়াস কথাগুলোকে আরিশা মোটেই পাত্তা দিল না। বরং গাল ফুলিয়ে বলল,”হ্যাঁ, জানি জানি। তুমি কত বড় পড়ুয়া! ছোট থেকেই তো এসব শুনেই বড় হয়েছি। বড় আপ্পির মতো পড়াশোনায় মনযোগ দাও, বড় আপ্পির মতো লাইফ নিয়ে সিরিয়াস হও। উফ আপ্পি! তুমি কি এই জীবন নিয়ে একটুও ক্লান্ত হওনা? তোমার কি একটুও হৈ-হুল্লোড় করতে ইচ্ছা করে না?”
আফিফা যথারীতি কোন উত্তর দিল এই কথার৷ আরিশা নিজের বড় বোনকে চুপ দেখে বলল,”কিছু তো বল?”
আফিফা বলল,”আমায় ডিস্টার্ব করিস না রে। যা এখান থেকে।”
আরিশা আফিফার দিকে তাকিয়ে মুখে ভেংচি কেটে বেরিয়ে গেল। আরিশা বেরিয়ে যেতেই আফিফা ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,”পাগলীটা আর বড় হলো না! এখনো সেই আগের মতো বিচ্ছুই রয়ে গেল।”
বলেই সে নিজের পড়ায় মনযোগ দিল। ২০ বছর বয়সী এই মেয়েটা পড়াশোনায় বেশ মনযোগী। ছোটবেলা থেকে তুখোড় মেধাবী।সবসময় টপ রেজাল্ট করেছে। বর্তমানে সিলেট মেডিকেল কলেজের একজন ব্রাইট স্টুডেন্ট। অপরদিকে তার ছোট বোন ১৮ বছর বয়সী আরিশা চরিত্রের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ তার বিপরীত। পড়াশোনায় আরিশার কোন মনযোগই নেই। সে সারাদিন হেসে-খেলেই জীবন কাঁটায়। জীবনের ব্যাপারে কোন সিরিয়াসনেসই নেই! এই দুই বোনই মাতিয়ে রেখেছে খান ভিলাকে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আরিশা দৌড়াতে দৌড়াতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল। অতঃপর ড্রয়িংরুমের কাছাকাছি এসে হঠাৎ খেই হারিয়ে পড়ে যেতে নিল এমন সময় দুটো বলিষ্ঠ হাত তাকে আগলে নিল। আরিশা তো ভয়ে চোখ বন্ধই করে নিয়েছিল। পড়ে যায়নি এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই চোখ খুলল। চোখ খুলতেই নির্ঝরকে দেখতে পেল সে। যে নিজের বলিষ্ঠ হাতে আগলে রেখেছিল তাকে। ছবি বেগম একটু দূরেই সোফায় বসে ছিলেন। এ দৃশ্য দেখে তিনি ভীষণ রেগে বললেন,”এই আরিশা! তুই কি দিন দিন ছোট হচ্ছিস নাকি? ১৮-তে তো পা দিলি। তোর মতো বয়সে আমি বিয়ে করা বাচ্চার মা হয়ে গেছি। আর এই মেয়েকে দেখো কেমন বাচ্চাদের মতো লাফালাফি করে বেড়াচ্ছে।”
আরিশার মনটা খারাপ হয়ে যায় নিজের দাদির মুখে এমন কথা শুনে। নির্ঝর সেটা লক্ষ্য করে। আরিশাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে একটু দূরে সরে এসে বলে,”এভাবে বলছ কেন গ্র্যানি? ও তো এখনো ছোটই,কি আর এমন বয়স হয়েছে। এই বয়সে তো একটু এমন করবেই।”
এমন সময় আরিশার মা ডাক্তার আনিকা খান এগিয়ে এসে বলেন,”তুমি আর ওকে তোল্লাই দিও না নির্ঝর। এমনি বাবা আর বোনের আহ্লাদে মাথায় উঠে বসে আছে। এত বড় মেয়ে তার কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই!”
আরিশা নাক ফুলিয়ে বলে,”হ্যাঁ, এখন তো এসব বলবাই। আপ্পিই তো তোমার নিজের মেয়ে আমি তো মেলায় কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে তাই আমার সাথে সব সময় এমন করো। ”
“শুনেছ মেয়ের কথা!”
এমন সময় আবির খান হুইল চেয়ারে করে এগিয়ে আসতে আসতে বলেন,”আবার কি হলো?”
“কি আর হবে? তোমার আদরের মেয়ের বাদরামি!”
“উফ আনিকা! তুমিও না। সবসময় আমার লিটল প্রিন্সেসের পেছনে কেন পড়ে থাক?”
আনিকা কিছুটা রাগী স্বরে বলে,”আমার তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই তোমার মেয়ের পিছনে পড়ে থাকব। আমি এখন হসপিটালে যাচ্ছি। একটা জরুরি অপারেশন করতে হবে।”
বলেই তিনি নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলেন,”কিছু মনে করো না, বাবা। তুমি এত বছর পর দেশে এলে..অথচ এই সময় আমায় এভাবে চলে যেতে হচ্ছে। আসলে হঠাৎ করে ইমার্জেন্সি পড়ে গেছে।”
নির্ঝর বিনয়ের সাথে বলে,”কোন ব্যাপার না কাকি। আমি তোমার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। আমার আম্মুও তো একজন ডাক্তার। এই পেশার ব্যস্ততা আমি জানি।”
নির্ঝরের কথায় ভীষণ মুগ্ধ হন আনিকা খান। অতঃপর আরিশার দিকে তাকিয়ে বলেন,”শোন, আমি এখন যাচ্ছি। আমার না থাকার সুযোগে কোন গণ্ডগোল করো না আর নির্ঝর ভাইয়া অনেক দূর জার্নি করে এসেছে তাকে মোটেও বিরক্ত করবে না। সামনে তোমার ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের হাফ ইয়ারলি এক্সাম সেটা খেয়াল রেখো। এমনিতে এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করতে পারো নি। এবার এইচএসসিতে যেন তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। ”
আরিশার ইচ্ছা ছিল কিছু একটা বলবে কিন্তু সে কিছুই বলল না। এখন আর মায়ের সাথে তর্ক করতে ইচ্ছা করছে না। কি এমন খারাপ রেজাল্ট করেছে সে? এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪.৮৬ পেয়েছে। সেটা কি খারাপ কি? তাও আবার সাইন্স থেকে। তার তো সাইন্সে পড়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না মায়ের জোরাজুরিতেই নেয়া। ইন্টারেও সেম অবস্থা। এসব ভেবেই সে মনে মনে রাগে ফুঁসতে থাকে।
ইতিমধ্যেই আনিকা খান বেরিয়ে পড়েন হাসপাতালের উদ্দ্যেশ্যে। ছবি বেগমও টিভির সামনে বসে পড়েন। এখন তার পছন্দের সিরিয়াল দেখছেন। আবির নির্ঝরের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তাহলে তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও?”
“আচ্ছা, চাচ্চু।”
আবিরও হুই চেয়ারে করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ান। এদিকে আরিশা তখন অবাক চোখে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে ছিল। বছর ২৫ এর যুবক নির্ঝর। সুঠামদেহী, পেশিবহুল চেহারা। সৃষ্টিকর্তা যেন এই যুবকের মাঝে সমস্ত সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে৷ তার উপর ছোটবেলা থেকে বিদেশে মানুষ হয়েছে। চেহারাতেও অনেকটা তেমন ভাব চলে এসেছে।
নির্ঝর আরিশার দিকে তাকাতেই তাদের চোখাচোখি হয়ে যায়। এতে আরিশা লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। নির্ঝর আরিশাকে জিজ্ঞেস করে,”আচ্ছা, তোমার বড় বোন আফিফা কোথায়? এসেছি থেকে তো ওকে একবারও দেখলাম না।”
আরিশা বলে,”আপ্পি! আপ্পির কথা আর কি বলবো৷ আপ্পি তো পারে না সারাদিন পড়ার টেবিলে মুখে বই গুঁজে বসে থাকে!”
“মানে?”
“তুমি আসার পর তো আমি আপ্পিকে বলতে গেছিলাম তোমার আসার কথা। কিন্তু আপ্পি বলল সে এখন পড়াশোনায় ব্যস্ত তাই নিচে আসতে পারবে না।”
“ওহ।”
সংক্ষিপ্ত ভাবে উত্তর দেয় নির্ঝর। অতঃপর আরিশার দিকে একটা বক্স বাড়িয়ে দেয়। আরিশা কৌতুহলের সাথে সেটা হাতে নিয়ে বলে,”কি আছে এখানে?”
“আইফোনের লেটেস্ট ভার্সন।”
“ওয়াও!”
“পছন্দ হয়েছে?”
“ভীষণ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ নির্ঝর ভাইয়া।”
এদিকে ছবি বেগম বলেন,”হ্যাঁ, এটারই বাকি ছিল। এখন নতুন ফোন দিয়ে সারাদিন সেলফি তুলে বেড়াবে আর রিল না ফিল কিসব ওসব বানাবে। ”
আরিশা রেগে বলে,”তুমি তোমার সিরিয়াল দেখায় মন দাও তো দাদি। শুধু বাগড়া দেবে। দাদার মৃত্যুর পর থেকেই তুমি কেমন খিটখিটে হয়ে গেছ ধুর! ”
বলেই আরিশা আইফোন হাতে নিয়ে ছুটতে ছুটতে নিজের রুমের দিকে যায়। যাওয়ার আগে একবার ফিরে তাকায় নির্ঝরের দিকে। তার তো ইচ্ছা করছিল জনম জনম ধরে এই মুখের পানে চেয়ে থাকতে। এদিকে নির্ঝর উপরের দিকে তাকিয়ে বলে,”আফিফা কেন এলো না নিচে? ও কি জানে না এক জোড়া চোখ এক যুগ থেকে ওকে দেখার তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আছে!”
বলেই সে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে পা বাড়ায়। দোতলায় উঠেই খুঁজতে থাকে কাঙখিত কক্ষটি। একটু পরই সেটা খুঁজেও পেয়ে যায়। অতঃপর আস্তে করে দরজা খুলে দেখতে পায় একটি মেয়ে ভীষণ মনযোগ দিয়ে পড়ছে। এ দৃশ্য দেখে যেন তার দুই চোখ জুড়িয়ে যায়!
To be continue……