#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_9
#ইয়াসমিন_খন্দকার
নির্ঝর ও আফিফা একসাথে নিজেদের ঘরের দিকে যেতে ধরেছিল। ঠিক সেই সময়েই সেখানে এসে উপস্থিত হলো জাঈদ ও আরিশা৷ জাঈদ আরিশার হাতটা শক্ত করে ধরেছিল। তাদের দুই জনকে একসাথে দেখে উপস্থিত সবাই চরম অবাক হয়। আফিফা অবাক স্বরে বলে,”আরিশা! বোনু তুই এই ছেলেটার সাথে কি করছিস?”
আনিকা খান বলেন,”ইনি কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর শেখের ছেলে না? কিন্তু এখানে কি করছেন আর আরিশাই বা ওনার সাথে কি করছে?”
নির্ঝরও অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। জাঈদ আরিশাকে সাথে নিয়ে সবার সামনে এসে বলে,”শুধু নিজেদের বড় মেয়েকে দোয়া করলেই তো চলবে না, আপনারা নিজেদের ছোট মেয়েকেও দোয়া করুন।”
ছবি বেগম জিজ্ঞেস করেন,”তুমি কে? আর কিসব বলছ? আরিশাকে দোয়া করব কেন?”
জাঈদ শেখ বাকা হেসে বলে,”কারণ আমি আরিশাকে বিয়ে করেছি৷ তাই আপনাদের তো উচিৎ নবদম্পতির জন্য দোয়া করা তাইনা? শুধু তাই নয়, আপনাদের ছোট মেয়েকে বিদায়ও তো দিতে হবে!”
জাঈদের কথা শুনে উপস্থিত সবাই ভীষণ পর্যায়ের অবাক হয়। কারো মুখে কোন কথা নেই। আবির খান বলে ওঠেন,”এসব কি বলছ কি তুমি ছেলে? আমার মেয়ে, আমার আরিশা ওকে তুমি বিয়ে করেছ?”
জাঈদ বলে,”হ্যাঁ করেছি।”
আনিকা বলে,”এটা কিভাবে সম্ভব? আরিশা তুমি এভাবে আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে নিলে! আমাদের কে কি নিজের পরিবার মনে করো না?”
আফিফা এগিয়ে এসে আনিকার হাত ধরে বলে,”এসবের মানে কি বোনু? তুই এই বখাটে ছেলেটাকে কিভাবে বিয়ে করলি? নিশ্চয়ই এর পেছনে কোন রহস্য আছে। এই ছেলেটা নিশ্চয়ই কোন চক্রান্ত করে তোকে বিয়ে করেছে, তাই না? সত্যি করে বল আমায় সব৷ আমি বিশ্বাস করি, আমার বোনু এরকম বখাটে একটা ছেলেকে বিয়ে করবে না।”
জাঈদ শেখ বলে,”এই বখাটে কাকে বলছেন? আমার স্ত্রীর বড় বোন জন্য আপনাকে সহ্য করছি অন্য কেউ হলে..যাইহোক আমরা একে অপরকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছি। তাই না আরিশা?”
বলেই আরিশার দিকে অন্যরকম একটা দৃষ্টিতে তাকায় আরিশা। তার চাহনিতে স্পষ্ট সতর্কবার্তা ছিল৷ আরিশা শুকনো একটা ঢোক গিলে। তার মনে পড়ে যায় কিছু সময় আগে জাঈদ তাকে কি হুমকি দিয়েছিল। এই বাড়িতে আসার সময়ই জাঈদ কার্যত তাকে হুমকি দিয়ে বলে, যদি সে সবাইকে সত্যটা বলে দেয় তাহলে আফিফা ও নির্ঝরের ক্ষতি করবে৷ এই ভয়েই আরিশা থমকে যায়। সে চায় না তার বোন কিংবা নির্ঝর এর কোন ক্ষতি হোক৷ তাই সে কান্নারত স্বরে বলে,”উনি যা বলছেন তাই সত্য। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি আপ্পি! আর সেজন্যই আমরা বিয়ে করে নিয়েছি। আমি ভয়ে ছিলাম যে আমাদের সম্পর্ক কেউ মেনে নেবে কিনা। আর এই ভয় থেকেই আমরা লুকিয়ে বিয়েটা করে নেই।”
“বোনু!”
নিঝুম ও আবরাজ খানও অবাক হয়ে সব দেখছিলেন। আদৃতা তাদের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”মম, ড্যাড তোমরা দেখ। কেমন মেয়ের সাথে ব্রোয়ের বিয়ে দিলে। যার বোন এভাবে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে তার চরিত্র আর কত সুন্দর হবে বোঝাই যায়।”
আবরাজ খান রেগে বলেন,”আহ, আদৃতা। তুমি চুপ করো। অবস্থাটা বুঝতে দাও।”
নিঝুম বলে,”হ্যাঁ, আদৃতা তোমার এই ব্যাপারে কিছু না বলাই ভালো। এমনিতেই পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না।”
এরইমধ্যে ছবি বেগম বলে ওঠেন,”এটা তো হওয়ারই ছিল। এজন্যই বলে পর কোনদিন আপন হয়না!”
আবির খান হতবাক স্বরে বলে ওঠেন,”আম্মু!”
আফিফা ও আরিশাও অবাক চোখে ছবি বেগমের দিকে তাকায়। আফিফা বলে,”এসব তুমি কি বলছ দাদি? বোনু আমাদের পর হতে যাবে কেন? ও আমার বোন, আম্মু-আব্বুর মেয়ে,তোমার নাতনী..”
আনিকা খান মাথা নিচু করে নেন। তার এতদিনের লুকিয়ে রাখা সত্যটা কি তবে এবার সামনে আসতে চলেছে। এই ভাবনায় তার বুক কেপে ওঠে। আবির খানও বলে ওঠেন,”আরিশা আমাদের পর নয়। ও আমার মেয়ে…হ্যাঁ হয়তো আজ ও একটা অন্যায় করে ফেলেছে কিন্তু তাই বলে ও আমাদের পর হয়ে যায় নি। আমি আর আনিকা মিলে ওকে মানুষ করেছি। আমি এই হুইল চেয়ারে করে ওকে প্রথম খাইয়ে দিয়েছি, ও ভাসা ভাসা স্বরে আমায় বাবা বলে ডেকেছে, আমার হাত ধরে হাটা শিখেছে, আমি আর আনিকা ওকে স্কুলে নিয়ে গেছি৷ ও কিভাবে আমাদের পর হয়? আনিকা তুমি চুপ করে আছ কেন কিছু বলো?”
আনিকা খান আজ আর কিছু বলতে পারেন না। ছবি বেগম বলে ওঠেন,”তুই অনেক বোকা আবির! এক গাছের ছাল কখনো এক গাছে লাগে না। কোকিল হয়তোবা কাকের বাসায় ডিম পাড়ে এবং কাকও সেই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চার জন্ম দেয় কিন্তু সেই বাচ্চাটা কোকিলের বাচ্চাই হয়, কাকের বাচ্চা নয়।”
আরিশা আজ যেন অবাকের উপর অবাক হচ্ছিল৷ এই একদিনের তার উপর দিয়ে আর কত ঝড় যাবে? আফিফা ছবি বেগমকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”দাদি! এসব কি আজেবাজে কথা বলছ তুমি?”
আবির খানও চেচিয়ে উঠে বলেন,”আম্মু! আল্লাহর দোহাই লাগে চুপ করো তুমি।”
ছবি বেগম বলেন,”আমি আজ আর চুপ থাকব না। এই অকৃতজ্ঞ মেয়ের আজ সব সত্যটা জানা দরকার! এই আরিশা তুই শোন, তুই না তো আমার নাতনী, না তো আবির ও আনিকা মেয়ে আর না তো আফিফার বোন! তুই ছিলি একটা দরিদ্র পরিবারের ৫ম সন্তান! তোর বাবা-মা ভাসমান বস্তির বাসিন্দা ছিল৷ দারিদ্র্যর মধ্যে এত সন্তান পালন করতে তারা হাসফাস খাচ্ছিল৷ তাই তোর জন্মের পরই তারা তোকে হাসপাতালের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে চলে গেছিল। সেখান থেকেই আনিকা তোকে উদ্ধার করে এনেছিল কিছুদিন ধরে তোর পরিবারের খোঁজ পেয়ে তাদের আর পায়না! কারণ তারা আবার অন্য কোন শহরে চলে গেছিল৷ তখন আনিকাই তোর দায়িত্ব কাধে তুলে নেয়। আমার ছেলে-বৌমা তোকে নিজের মেয়ের স্বীকৃতি দেয়। আমি তো শুরুতেই ওদের মানা করে দিয়েছিলাম। আনিকাও প্রথমে তোকে অনাথ আশ্রমে রাখতে চাইছিল কিন্তু এরইমধ্যে আবির তোর মায়ায় পড়ে যায়। আর তাই ওরা তোকে দত্তক নেয় নিজেদের মেয়ে থাকা সত্ত্বেও। এই সত্য এতদিন শুধু আমি, আনিকা আর আবিরই জানতাম। কারণ তোকে যখন আনা হয়েছিল তখন আফিফা দিদিভাই মাত্র ২ বছরের শিশু ছিল, আবরাজ-নিঝুম ওরা বিদেশে ছিল৷ তাই তারা মনে করে তুই সত্যিই এই বাড়ির মেয়ে। কিন্তু আসল সত্যটা হলো তুই আমাদের কেউ না। আর আজ আবার তুই নিজে এটা প্রমাণ করে দিলি।”
ছবি বেগমের কথায় যেন পুরো খান ভিলায় একটা ছোট খাটো বিস্ফোরণ ঘটে যায়। আরিশার দুচোখ বেয়ে বাঁধাহীন ভাবে অশ্রু পড়ছিল। আফিফা বলতে থাকে,”এটা হতে পারে না, আরিশা ও আমার বোন..আমি এসব বিশ্বাস করি না…বিশ্বাস করি না আমি।”
বলতে বলতেই আফিফা আরিশাকে জডিয়ে ধরে। আরিশাও আফিফাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”দাদি এসব কি বলছে আপ্পি? আমি কি তোমার বোন না? আমাকে কি ডাস্টবিন থেকে তুলে এনেছে ওরা? এজন্য কি আমি তোমার মতো মেধাবী নই? এজন্যই কি আমি তোমার মতো এত সুন্দরীও নই? ছোটবেলায়ও তো সবাই আমায় বলত, তোর বোন এত ফর্সা অথচ তোর গায়ের রংটা একটু চাপা! এটাই কি তার কারণ?”
আফিফা আরিশাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,”না, তুই আমার বোনু! এটাই সত্য। আর কোন কিছু নয়।”
আরিশা আফিফাকে ছাড়িয়ে দিয়ে আনিকা খানের সামনে গিয়ে বলে,”আম্মু! তুমি সবসময় আপ্পিকে আমার থেকে বেশি আদর করেছ। আপ্পির প্রতি যতটা খেয়াল রেখেছ আমার প্রতি তেমন রাখো নি। মনে আছে, ছোটবেলায় প্রতিরাতে তুমি নিজের হাতে আপ্পিকে খাইয়ে দিতে, তাকে পড়তে বসাতে অথচ আমায় কখনো নিজ হাতে খাইয়ে দাওনি, না তো পড়তে বসিয়েছ। আমাকে হয় আব্বু খাইতে বসিয়েছে আর নয়তো আমি নিজে খেয়েছি। আমার কোন ব্যাপারেই তুমি খেয়াল রাখতে না। আমার খাওয়া,পড়া কোন কিছু নিয়েই মাথা ঘামাতে না। দাদিও সবসময় আমার সাথে কেমন অস্পৃশ্যের মতো ব্যবহার করে গেছে। এটাই কি তার পেছনে কারণ? আমি কি সত্যিই তোমাদের মেয়ে না?”
আরিশা খান বলে ওঠেন,”হ্যাঁ, এটাই সত্যি!”
to be continue…….
#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_10
#ইয়াসমিন_খন্দকার
আনিকা খানের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল আরিশা। তার পায়ের তলার মাটি যেন এক মুহুর্তের জন্য সরে গেল। তার পুরো জীবন, এতদিন ধরে গড়ে তোলা সম্পর্ক কোনটাই তাহলে সত্য নয়? আফিফা তার বোন নয়, আবির খান তার বাবা নয়, আনিকা খান তার কেউ নয়…এই পরিবারের কারো সাথেই তার কোন সম্পর্ক নেই! ভাবতেই আরিশার পুরো পৃথিবীটা থমকে গেল। এদিকে জাঈদ শেখ গভীর চোখে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল। সে তো ভেবেছিল এখানে এসে আরিশার সাথে নিজের বিয়ের ঘোষণা দিয়ে সে পুরো খান ভিলাকে চমকে দেবে কিন্তু এখন তো সে নিজেই চমকে যাচ্ছে। আফিফার উপর তার প্রতিশোধ নেয়ার স্বপ্ন কি তাহলে অধরাই থেকে যাবে?
এদিকে আফিফা এগিয়ে এসে আনিকা খানের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”প্লিজ আম্মু..এমন করে বলো না তুমি। আরিশা..ও আমার বোনু। এটা মিথ্যা হতে পারে না।”
নির্ঝর এগিয়ে এসে আফিফার কাধে হাত রেখে বলে,”নিজেকে সামলাও আফিফা৷ এরকম পাগলামি করো না।”
“কিভাবে নিজেকে সামলাবো আমি বলতে পারেন? আমার বোনুকে ওরা আমার পর করে দিচ্ছে। ও নাকি আমার কেউ নয়। আচ্ছা এটা কিভাবে হতে পারে? ছোটবেলা থেকে আমি নিজ হাতে আগলে ওকে বড় করেছি, ওর সব আবদার পূরণ করেছি। যার সাথে এতগুলো দিন বেড়ে উঠলাম সে আমার কেউ নয় এটাও আমায় বিশ্বাস করতে হবে? আব্বু, তুমি কিছু বলছ না কেন? তুমি বলো না যে, আরিশাই আমার বোন।”
আবির খান নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন,”সব সম্পর্ক কি শুধুই রক্তের হয় রে মা? কিছু সম্পর্ক হয় আত্মার সম্পর্ক। আরিশার সাথেও আমাদের সম্পর্ক ঠিক তেমনই। হ্যাঁ, ওর সাথে আমার কোন রক্তের সম্পর্ক নেই,ও আমার ঔরসজাত সন্তান নয়। কিন্তু ও আমার কাছে আফিফার থেকে কোন অংশে কম নয়। সবসময় আমি ওকে নিজের মেয়ের নজরেই দেখেছি এবং সামনেও তাই দেখে যাব।”
ছবি বেগম রাগী কন্ঠে বলেন,”এতকিছুর পরও তোর চোখ খুলবে না আবির? আজ এই মেয়ে কিভাবে আমাদের মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিল দেখলি না? যদি সত্যিই ও আমাদেরকে নিয়ে চিন্তা করত তাহলে এভাবে আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করত না।”
আরিশা শুধু কেঁদেই যাচ্ছিল। ছবি বেগম আরিশার দিয়ে এগিয়ে গিয়ে তার হাতটা শক্ত করে ধরে বলেন,”তোর এই সব নাটক বন্ধ কর৷ এসব দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমাদের কারো নেই। এক্ষুনি বেরিয়ে যা এই বাড়ি থেকে। যাকে বিয়ে করেছিস তাকে নিয়েই বাকি জীবনটা কাটা যা।”
আফিফা এগিয়ে এসে বলে,”এসব তুমি কি বলছ দাদি? বোনু কোথাও যাবে না এমন করো না তুমি।”
আবরাজ খানও বলে ওঠেন,”এটা আপনি ঠিক করছেন না। ছোটরা ভুল করবেই কিন্তু তাই বলে তাদের প্রতি এমন ব্যবহার করা ঠিক নয়।”
নিঝুম খানও বলেন,”হ্যাঁ, চাচি। আপনি একটু বেশিই নির্দয় হয়ে উঠছেন। দয়া করে, একটু মানবিকতা দেখান।”
আদৃতা অবশ্য ছবি বেগমের সমর্থনেই বলে,”দাদি একদম ঠিক কাজ করছে। এই রাস্তার মেয়েকে রাস্তাতেই পাঠানো উচিৎ। ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও একে।”
ছবি বেগম আদৃতার কথায় উদ্বুগ্ধ হয়ে আরিশাকে জোরে একটা ধাক্কা দেন যাতে আরিশা পড়ে যেতে নেয়। কিন্তু সে পড়ে যাওয়ার আগেই একজোড়া বলিষ্ঠ হাত তাকে আগলে নেয়৷ আরিশা অবাক চোখে তাকায় জাঈদ শেখের দিকে। সে রক্তিম চোখে তাকিয়ে ছিল ছবি বেগমের দিকে। আরিশাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে সে বলে,”আরিশাকে যখন আমি বিয়ে করেছি তখন ওর দায়িত্ব আমিই নেব। আপনাদের কাউকে আর ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না।”
বলেই সে আরিশার হাতটা শক্ত করে ধরে নিজের সাথে নিয়ে যেতে থাকে। আফিফা তাকে আটকানোর চেষ্টা করলে ছবি বেগম আফিফাকে আটকে বলেন,”ওকে যেতে দে ওর স্বামীর সাথে। এই জীবনটা ও নিজেই বেছে নিয়েছে। আমরা এতদিন মানবতা দেখিয়ে ওকে লালন-পালন করেছি। এখন যদি ও এসবের মর্ম না বোঝে তার দায় কোনভাবেই আমাদের নয়।”
নিজের দাদির মুখে এমন নির্দয় কথা শুনে আফিফা অবাক হয়। সে বলে ওঠে,”ছাড়ো আমায়, আমি আমার বোনুকে কোথাও যেতে দেব না। বোনু, তুই ঐ বখাটে লম্পটটার সাথে যাস না। ও যে তোকে একেবারে শেষ করে দেবে। দাদি, ছাড়ো আমায়..আমার বোনুর জীবনটা শেষ হয়ে যাবে।”
এবার ছবি বেগমের সাথে আদৃতাও যোগ দেয়। তারা দুজন মিলে আফিফাকে আটকে ধরে। নির্ঝর রেগে বলে,”কি করছ টা কি তোমরা? ছেড়ে দাও আফিফাকে।”
ছবি বেগম রাগী কন্ঠে বলেন,”যা ঠিক তাই করছি দাদুভাই। তুমি এই বিষয়ে নাক গলিও না।”
আবির খান আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠেন। আনিকা খানের চোখেও বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণার দেখা মেলে। এদিকে আফিফা তো চিৎকার করতে করতে বলতে থাকে,”আমার বোনুর কিছু হলে আমি কাউকে ছাড়ব না, কাউকে না৷ সবার শেষ দেখে ছাড়ব আমি।”
জাঈদ আরিশাকে নিয়ে যেতে যেতে এসব দেখে বাকা হেসে মনে মনে ভাবে,”তোমাকে শায়েস্তা করার উপায় আমি পেয়ে গেছি আফিফা! নিজের বোনকে তুমি খুব ভালোবাসো তাই না? এবার তোমার এই বোনের মাধ্যমেই আমি তোমার উপর প্রতিশোধ নেব। ঐ নির্ঝরকে বিয়ে করে তুমি আমায় যতটা কষ্ট দিয়েছ তার দ্বিগুণ কষ্ট আমি তোমায় ফিরিয়ে দেব। এ তো কেবল আমার প্রতিশোধের শুরু হলো। সামনে দেখো, আরো কত কি হয়।”
বলতে বলতেই সে আরিশার হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে। আরিশার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল এতে করে তাই সে বলে ওঠে,”আহ! লাগছে।”
এতে করে জাঈদ শেখ একটা বিশ্রী হাসি দিয়ে বলে,”এটা তো কেবল শুরু। এতেই এত ব্যথা পেলে চলবে?”
জাঈদের চোখে প্রছন্ন হুমকি লুকিয়ে ছিল। যা বুঝতে পেরেই আরিশার গলা শুকিয়ে যায়। আরিশাকে খান ভিলার বাইরে নিয়ে এসেই জোরপূর্বক নিজের গাড়িতে টেনে তোলে জাঈদ শেখ। অতঃপর গাড়ি চালানো শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে আরিশা একদম ক্লান্ত। তার ভীষণ ভয়ও লাগছিল। এদিকে আরিশার কান্নায় জাঈদ শেখ বিরক্ত হয়ে বলে,”এসব ফ্যাচফ্যাচানি বন্ধ করো। নাহলে ধাক্কা দিয়ে তোমায় গাড়ি থেকে ফেলে দেব!”
জাঈদের থেকে এমন হুমকি পেয়ে আরিশা ভয়ে চুপ হয়ে যায়। জাঈদ আরিশার দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,”এখনই সব অশ্রু শেষ করলে কি হবে? এই বিয়েটার মাধ্যমে তো কেবল তোমার অশ্রুপাত শুরু হলো। সামনে দেখো, আরো কত অশ্রুজল ফেলতে হয়। কারণ এটাতো ছিল একটা অশ্রুজলে বোনা বিয়ে!”
~~~~ ~~~~~~~~~~~
বাসর ঘরে বসে আছে আফিফা। কিন্তু তার মনে স্বাভাবিক আনন্দ একেবারেই নেই। কিছু সময় আগেই ছবি বেগম ও আদৃতা এসে জোরপূর্বক তাকে এখানে বসিয়ে দিয়ে গেছে। এখনো নিজের বোনের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত সে। এমন সময় নির্ঝর বাসর ঘরে প্রবেশ করল। নির্ঝর এর উপস্থিতি টের পেতেই আফিফা নিজের দুই চোখে জমা অশ্রু মুছে ফেলল। নির্ঝর ধীর পায়ে এগোতে লাগল আফিফার দিকে। আফিফার পাশে এসে বসে তার কাধে হাত রেখে বলল,”আমার থেকে নিজের কষ্ট লুকানোর দরকার নেই। তোমার দুঃখের ভাগীদার যদি না-ই হতে পারলাম তাহলে কিসের আর জীবনসঙ্গী?”
নির্ঝরের এই কথা শুনে তার বুকে মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে উঠল আফিফা। কাঁদতে কাঁদতে বলল,”আমার বোনুকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনো! ঐ জাঈদ শেখ ওকে শেষ করে ফেলবে। যে যাই বলুক আমি জানি আমার বোনটা ঐ জানোয়ারটাকে নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করেনি। নিশ্চয়ই ও জোর করে আমার বোনুকে বিয়ে করেছে। বোনুর জীবন শেষ হয়ে যাবে ঐ জাঈদের সাথে থাকলে। আপনি কিছু করুন।”
নির্ঝর আফিফার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তুমি একদম চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তোমার পাশে।”
এই সান্ত্বনাই যেন যথেষ্ট ছিল আফিফার জন্য। তার বেদনা কিছুটা লাঘব হয়। অতঃপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে সে।
to be continue…….
#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_11
#ইয়াসমিন_খন্দকার
আরিশাকে টানতে টানতে নিজের বাড়ির সামনে এসে দাঁড় করায় জাঈদ শেখ। আরিশার হাতে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছিল। তাই সে মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে। জাঈদ শেখ নিজের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে কলিং বেল চাপে৷ কিছু সময় পর একজন মহিলা এসে দরজা খুলে দেন৷ মহিলাটি হলো জাঈদের মা জামিলা শেখ। তিনি জাঈদকে এভাবে একটা মেয়ের সাথে দেখে অবাক কন্ঠে বললেন,”কি হয়েছে জাঈদ? এত রাতে কোথা থেকে এলে তুমি? আর এই মেয়েটা কে?”
জাঈদ আরিশার দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,”ওকে বাড়িতে ঢুকিয়ে আমার রুমে নিয়ে যাও। ওকে আমি বিয়ে করেছি।”
জাঈদের কথা শুনেই চমকে ওঠেন জামিলা শেখ। তার চোখমুখে হঠাৎ করে অন্ধকার নেমে আসে, অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তিনি তাকালেন জাঈদের দিকে। অতঃপর বেশ ভারিক্কি কন্ঠে বললেন,”এসব কি বলছ তুমি? তুমি এই মেয়েটাকে বিয়ে করেছ মানে? আমাদের না জানিয়ে তুমি কিভাবে বিয়েটা করলে?”
জাঈদ বিরক্তিতে মুখ দিয়ে চ জাতীয় শব্দ করে বলল,”বেশি কথা বলতে ভালো লাগছে না। ওকে ভেতরে নিয়ে যাও তো।”
জামিলা শেখ এবার রেগে গেলেন। বললেন,”আমার বোনের মেয়ে সন্ধ্যা তোমায় কত ভালোবাসে সেটা ভুলে গেলে নাকি? আর তুমি কিনা কোথা থেকে কোথাকার একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে ফেললে৷ এই বিয়ে আমি মানি না।”
জাঈদ ভীষণ রেগে যেতে থাকে। এরইমধ্যে জাহাঙ্গীর শেখ এসে বলেন,”কি হয়েছে? এত রাতে এত চিৎকার চেচামেচি কিসের ?”
জামিলা শেখ বলেন,”তোমার ছেলের কাণ্ডজ্ঞান দেখে যাও। ও কাকে যেন বিয়ে করে নিয়ে এসেছে।”
জাহাঙ্গীর শেখ এগিয়ে এসে আরিশার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”ওদের ভেতরে নিয়ে যাও। এমনিতেই সামনে ইলেকশন, আমাকে অনেক ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এখন আর নতুন করে কোন অশান্তি চাই না। ওর মনে হয়েছে ও বিয়ে করেছে। এতে আমার কিছু বলার নেই।”
“তুমি এবারও ছেলেটাকে কিছু বলবে না? মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকাও? ওকে কি দেখে মনে হচ্ছে ও এই বাড়ির যোগ্য? গায়ের রংটাও চাপা আর না তো দেখতে আহামরি সুন্দর। ভালো ঘরের মেয়ে বলেও তো মনে হয়না। আমি তো ভেবে রেখেছিলাম আমার বোনের মেয়ে সন্ধ্যার সাথে জাঈদের বিয়ে দেব। ও দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি সিলেটের এক বনেদী পরিবারের মেয়ে। লন্ডনে বড় হয়েছে। আর তোমার ছেলে এ কাকে বিয়ে করে নিয়ে এলো। এই মেয়েকে আমি কিছুতেই ছেলের বউ হিসেবে মানব না। এই মেয়ে বের হও এখান থেকে।”
বলেই তিনি আরিশার দিকে এগিয়ে যান। এমন সময় জাঈদ আরিশার হাত ধরে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। জামিলা শেখ চেচামেচি করে চলেন। তিনি বলেন,”এই মেয়েকে আমি বাড়ি থেকে বের করেই ছাড়ব।”
এমন সময় জাহাঙ্গীর শেখ জামিলা শেখকে শান্ত করতে তাকে সোফায় বসিয়ে বলেন,”এখন আর এ নিয়ে কোন অশান্তি করো না। তোমার কি মনে হয়, আমি যে কাউকে এই শেখ বাড়ির বউ বলে মেনে নেবো? তুমি নিজের ছেলেকে চেনো না? এখন হয়তো জেদের বসে এই বিয়েটা করেছে সাময়িক ফূর্তির জন্য আপাতত ব্যাপারটা নিয়ে বেশি জলঘোলা করো না। আমার উপর ভরসা রাখো, একবার ইলেকশনটা মিটে যাক। এবার আমি অনেক কষ্টে দল থেকে এমপি হওয়ার টিকিট পেয়েছি। একবার এমপি নির্বাচিত হলেই এই মেয়েকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব। তারপর সন্ধ্যাকেই এই বাড়ির বউ করে আনব।”
“সত্যি বলছ তো?”
“আমি কি কখনো তোমায় মিথ্যা বলি?”
জামিলা শেখ এবার একটু শান্ত হন।
~~~~~~~~~~~~~~~
আরিশা বিছানার এক কোণায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে৷ এরইমধ্যে জাঈদ বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। আরিশা তখনো কেঁদে চলেছিল৷ জাঈদ রেগে বিছানায় শুয়ে পড়ে বলে,”আমি ঘুমাবো এখন। তোমার ফ্যাচফ্যাচানি বন্ধ করো। যদি তোমার কান্নার আওয়াজ আর একবার আমার কানে আসে..তাহলে আই সয়ার, আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”
আরিশা আর চুপ থাকতে পারল না। প্রতিবাদ জানিয়ে বলল,”কি ভেবেছেন টা কি আপনি? আমি আপনার কেনা পুতুল? আপনি যা বলবেন তাই শুনে চলব আমি? কখনোই না। আপনার মতো একটা বখাটে, মস্তানের কথা আমি শুনবো না।”
জাঈদ রেগে আরিশার কাছে এসে তার মুখ চেপে ধরে বলে,”এই একদম চুপ। আমার মুখের উপর কথা বললে তার ফল ভালো হবেনা।”
আরিশা জাঈদের হাতটা ছিটকে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ফ্লোরে বসে পড়ে। অতঃপর বলে ওঠে,”আমাকে স্পর্শ করবেন না,আপনার স্পর্শেও আমার ঘৃণা অনুভব হয়।”
জাঈদ তাচ্ছিল্য করে বলে,”তোমার কি মনে হয়? তোমার মতো মেয়েকে স্পর্শ করার জন্য আমি মরে যাচ্ছি? নিজেকে আয়নায় দেখেছ কখনো? কোথায় তোমার বোন আফিফা আর কোথায় তুমি। উপস, সরি তুমি তো আবার ওর নিজের বোনও না। পালিত সন্তান!”
জাঈদের কথাগুলো আরিশাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। এসব যেন তার কাটা গায়ের উপর নুনের ছিটা ছিল৷ আরিশা জাঈদের কথার জবাবে আর কিছু বলে না৷ শুধু নীরবে অশ্রু ফেলে যায়। জাঈদও আর কথা না বাড়িয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এদিকে আরিশা ফ্লোরেই শুয়ে মনে মনে বলে,”কেন আল্লাহ কেন? আমার জীবনটা এমন এলোমেলো হয়ে গেল কেন? কি অন্যায় করেছিলাম আমি?”
~~~~~~~~~~~~~
সকালে ঘুম ভাঙতেই আফিফা নিজেকে আবিষ্কার করে নির্ঝরের বুকে মাথা রাখা অবস্থায়। নির্ঝরের ঘুমও ভেঙে যায়। দুজনে একসাথে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। নির্ঝর আফিফাকে বলে,”দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নাও। কাল রাতের পর তো আর কিছু খাও নি।”
আফিফা বলে,”এখন কোন খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না। আপনি প্লিজ, আমাকে বোনুর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিন। ওর সাথে দেখা করতে না পারলে আমার ভালো লাগবে না।”
নির্ঝর বলে,”আচ্ছা, তুমি এত কিছু ভেবো না। আমি দেখছি কি করা যায়।”
নির্ঝরের কথায় আফিফা কিছুটা স্বস্তি পায়। তার মনটা বড্ড ছটফট করছে আরিশার কথা ভেবে। আফিফা বলতে থাকে,”না জানি আমার বোনুটা এখন কোন অবস্থায় আছে। ঐ শয়তানটা কেমন ব্যবহার করছে ওর সাথে!”
~~~~~~
চোখে পানির ঝাপটা পড়তেই আরিশার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙতেই সে নিজের চোখের সামনে জাঈদকে দেখতে পায়। সে হাতে একটা মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আরিশা উঠে বসে বলে,”এসবের মানে কি?”
জাঈদ বলে,”সারাদিন কি পড়ে পড়ে ঘুমাবে নাকি? এখানে এসে কি ঘুমানোর জন্য তোমায় বিয়ে করেছি?”
আরিশা বলে,”আপনাকে কে বলেছিল আমায় বিয়ে করতে? আমার যতক্ষণ ইচ্ছা আমি ঘুমাবো। আপনার কি?”
“এই মেয়ে, বেশি মুখ চালাবে না। আমার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে এসো যাও।”
“পারবো না। আপনার শখ হলে আপনি নিজে বানিয়ে খান। আমি এখন কলেজে যাব।”
“তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। বেশি বাড়াবাড়ি না করে আমি যা বলছি তাই করো। কফি বানিয়ে আনো। নাহলে এর ফল ভালো হবে না।”
“এই শুনুন, এসব হুমকি অন্য কাউকে গিয়ে দেবেন। আমি আপনার এসব হুমকিতে মোটেই ভয় পাইনা। দূর হন আমার সামনে থেকে।”
জাঈদ শেখ এবার রাগী চোখে আরিশার দিকে এগোতে থাকে। আরিশাও ঢোক গিলে এক পা, দু পা করে পিছাতে থাকে৷ জাঈদ রক্তিম চোখে বলে,”কি বলছিলে যেন? আমায় ভয় পাও না?”
আরিশা কাপা কাপা কন্ঠে বলে,”না..পাই..পাই না..”
আরিশা পিছোতে পিছোতে একদম দেয়ালের সাথে গিয়ে ধাক্কা খায়। আর পেছানোরও যায়গা নেই। জাঈদ আরিশার কাছে এসে তার গলা চেপে ধরে বলে,”এবার আমি এমন কিছু করব..যাতে আমায় ভয় পেতে তুমি বাধ্য হবে।”
“ছা..ছাড়ুন আমায়..”
“ছাড়বো না। কি করবে?”
আরিশার দুচোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে। কিন্তু জাঈদের মনে যেন একটুও দয়া হয় না। সে আরো জোরে আরিশার গলা চেপে ধরে। আরিশার শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়। সে কাশতে থাকে। জাঈদ একটু পর আরিশাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,”এক্ষুনি কফি নিয়ে আয় আমার জন্য। নাহলে তোকে মেরেই ফেলব!”
to be continue…….