অশ্রুজলে বোনা বিয়ে ২ পর্ব-১২+১৩+১৪

0
69

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_12
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আরিশা দ্রুত কফি বানিয়ে আনে জাঈদের জন্য। জাঈদ আরিশাকে দেখেই বাকা হেসে বলে,”শেষপর্যন্ত আমার জন্য কফি নিয়ে আসতেই হলো। তাহলে শুরুতে এত নাটক করার কি দরকার ছিল?”

আরিশার রাগে মাথা খারাপ হয়ে যায়৷ জাঈদ তার কাছ থেকে কফি নেয়ার জন্য সামনে এগোতেই আরিশা পুরো গরম কফি ঢেলে দেয় জাঈদের হাতে। জাঈদ ব্যথায় আহ করে ওঠে। আরিশা তৃপ্তির হাসি হেসে বলে,”আমাকে কষ্ট দিয়ে নিজে সুখে থাকবেন ভেবেছেন? সেটা আমি হতে দেব না। আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলে আমিও আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করব। বুঝতে পারলেন?”

জাঈদ রেগে আরিশার দিকে এগোতে নিতেই আরিশা বলে ওঠে,”এই ভুল একদম করবেন না। আমাকে অসহায় বাঙালি নারী ভাববেন না। আমি মোটেই কোন অসহায় নারী না। আমি চাইলে আপনার সাথে ঠিক সেরকম ব্যবহার করতে পারি যেমন ব্যবহার আপনি আমার সাথে করেন।”

“তোমার মনে হয় না, তুমি নিজেকে একটু বেশিইই শক্তিশালী ভাবছ? আমার সাথে পাঙ্গা নেয়ার ফল কিন্তু ভালো হবে না।”

“আমি আপনাকে মোটেই ভয় পাই না, বুঝতে পেরেছেন আপনি? আপনার যা করার আপনি করুন। আমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকব। আমি মোটেই আপনাকে ভয় পেয়ে চলবো না।”

বলেই আরিশা বাইরে চলে আসে৷ জাঈদ রাগে কাপতে থাকে।

—————
দুপুর বেলা, আরিশা চুপচাপ ঘরের এককোণায় সোফায় বসে ছিল। এমন সময় জাঈদ হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করে৷ আরিশা জাঈদকে আসতে দেখেই উঠে দাঁড়ায়। জাঈদ আরিশার কাছে এসে তার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,”তোমার বোন আফিফা আর দুলাভাই নির্ঝর এসেছে তোমার সাথে দেখা করতে। ওদের সামনে কোন ভাবেই সব সত্য বলবে না৷ এর ফল কি হবে জানো তো? ভালো মেয়ের মতো, আমার কথা শোনো। ওদের কে গিয়ে তুমি বলো, তুমি আমার সাথে সুখী আছ। ওদের সাথে ফিরতে চাও না।”

আরিশা কোন কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বের হয়। ড্রয়িংরুমেই আফিফা ও নির্ঝর বসেছিল। জাঈদের মা জামিলা শেখ তাদেরকে দেখেই বলে ওঠে,”এসেছ অনেক ভালো হয়েছে। এমনিতেও আমি এই বিয়েটা মেনে নেই নি। তোমার বোনকে নিজের সাথে নিয়ে চলে যাও। আমার ছেলের জন্য আমি আরো অনেক ভালো মেয়ে দেখে রেখেছি।”

এমন সময় আরিশা সেখানে উপস্থিত হয়েই আফিফা ও নির্ঝরকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”আপনারা এখানে কেন এসেছেন?”

আরিশাকে আসতে দেখেই আফিফা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”আমি তোকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি বোনু! আমি জানি, এই শয়তানটা নিশ্চয়ই জোর করে তোকে বিয়ে করেছে। জোর করে তোকে এখানে আটকে রাখতে চাইছে, তাইনা? তোকে আর এক মুহুর্ত এখানে থাকতে হবে না। তুই আমাদের সাথে ফিরে চল। একদম একে ভয় পাবি না। আমি আছি তোর পাশে।”

বলেই আফিফা এগিয়ে গিয়ে আরিশার কাধে হাত রাখে। আরিশা সেই হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে,”বাড়ি? কার বাড়ি? আপনাদের বাড়ি? সেখানে আমি কেন ফিরে যাব? আমি তো আপনাদের কেউ না। আমি তো একজন অনাথ, যে আপনাদের বাড়িতে আশ্রিতা ছিলাম এতদিন। আপনারা আমার জন্য যা করেছেন তার ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না। কিন্তু এখন অন্তত আমায় শান্তিতে সংসার করতে দিন। আমি আর আপনাদের কাছে ফিরতে চাই না।”

“বোনু!”

“হ্যাঁ, ফিরে যান আপনারা। আমার সংসারে দয়া করে কোন অশান্তি সৃষ্টি করবেন না।”

আফিফা আর কিছু বলতে যাবে এমন সময় জাঈদ বলে ওঠে,”আপনাদের যা শোনার তা শুনেছেন নিশ্চয়ই এখন ভালোয় ভালোয় বেরিয়ে যান এখান থেকে।”

নির্ঝরও রেগে বলে,”আফিফা, চলো এখান থেকে। তোমার বোন যখন এখানেই থাকতে চাইছে ওকে থাকতে দাও। চলো এখন। আমি আর অপমানিত হতে চাই না।”

“নাহ, আমি যাবো না। আরিশাকে নিশ্চয়ই এই শয়তানটা ভয় দেখিয়েছে।”

নির্ঝর৷ আফিফার কোন কথা না শুনে তাকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসে। আফিফা আর নির্ঝরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আরিশা। আর জামিলা শেখ হতাশ স্বরে বলেন,” আপদ টা বিদায় হলো না!”

আরিশা জাঈদের রুমের দিকে পা বাড়ায়। রুমে এসেই দরজা লাগিয়ে দিয়ে কান্না করতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও আপ্পি! আমি যা করেছি তোমার ভালোর জন্যই করেছি। যদি আমি আজ তোমাদের সাথে ফিরে যেতাম তাহলে নিশ্চয়ই ঐ জাঈদ তোমার আর নির্ঝর ভাইয়ার ক্ষতি করতে চাইত। আমি কিছুতেই সেটা হতে দেব না। প্রয়োজনে আমি কষ্টে থাকব, তবুও সেই কষ্টের আঁচ তোমার উপর পড়তে দেব না। নিজের কষ্টের বিনিময়ে তোমায় সুখী করব আমি। তোমার পরিবার আপন না হয়েও এতদিন আমাকে নিজেদের মেয়ের মতো পালন করেছে। তার বিনিময়ে তোমার জন্য এতটুকু ত্যাগ স্বীকার আমি করতেই পারি!”

বলেই আরিশা নিজের চোখের জল মুছতে থাকে। একটু পরই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে সে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। জাঈদ দ্রুত বেগে রুমের ভেতরে ঢুকে পড়ে। তাকে দেখেই আরিশা ঘৃণার দৃষ্টি দিয়ে সরে আসে। জাঈদ আরিশাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলে,”বাহ, কি অভিনয়টাই না করলে! তোমার অভিনয় দেখে আমি মুগ্ধ।”

“ছাড়ুন আমায়! আমার ঘৃণা হয় আপনার স্পর্শে।”

“তুমি কি মনে করেছ? নিজেকে ভেবেছ টা কি? রাণী ভিক্টোরিয়া যে তোমায় স্পর্শ করতে আমি উতলা হয়ে থাকব?”

বলেই জাঈদ আরিশাকে দূরে ঠেলে দিয়ে বলে,”তোমার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই। নিজের চেহারাটা একবার ভালো করে আয়নায় দেখে ভাবিও তো তুমি আমার যোগ্য কিনা।”

জাঈদের এই কথা শুনে আরিশা ভালো করে তার দিকে তাকায়। জাঈদকে কখনো সেভাবে খেয়াল করে নি সে। জাঈদ ভীষণ লম্বা, বলিষ্ঠদেহী একজন পুরুষ। গায়ের রঙও উজ্জ্বল ফরসা। এক কথায় তাকে সুদর্শন বলা যায়। সত্যিই হয়তোবা আরিশা তার পাশে কিছুই না। এই জন্যই বোধহয় নির্ঝরও তার বোন আফিফাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে। ছোটবেলা থেকেই তো আরিশা এটাই জেনে এসেছে আফিফা সুন্দরী আর সে ততটা নয়। তাই আর এসব নিয়ে খুব একটা আফসোস হয় না। আরিশা নিজের চোখের জল মুছে বলে,”ঠিকই বলেছেন আপনি। আমি আপনার যোগ্য নই। আপনি একটা কাজ করুন। আমায় ছেড়ে দিয়ে নিজের যোগ্য কাউকে বিয়ে করে নিন।।আমি কথা দিচ্ছি, আপনি কিভাবে আমায় বিয়ে করেছিলেন সে ব্যাপারে কাউকে কিছু বলব না, অনেক দূরে চলে যাব সিলেট থেকে। তবুও আমায় মুক্তি দিন।”

জাঈদ বাকা হেসে বলে,”এমনটা যদি ভেবে থাকো যে আমি তোমায় মুক্তি দেব তাহলে তুমি বোকার স্বর্গে বাস করছ। তোমাকে এখানেই থাকতে হবে, আমার সাথেই থাকতে হবে। তোমার বোন আমাকে যতটা কষ্ট দিয়েছে তার শোধ না তোলা পর্যন্ত আমি তোমায় ছাড়ব না।”

–+++-+++++++++++++
নির্ঝর ও আফিফা বাসায় ঢুকতেই ছবি বেগম এগিয়ে এসে বলেন,”কিরে! খুব তো সকাল সকাল ঐ মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনতে গেলে। তা কোথায় সেই মহারাণী?”

নির্ঝর বলে,”ও আমাদের সাথে আসতে চায়নি দাদি।”

ছবি বেগম বলেন,”এই ব্যাপারে তো আমি আগেই বলেছিলাম। শুধু শুধু ঐ অকৃতজ্ঞ মেয়েটার কাছে গিয়ে অপমানিত হবার কি দরকার ছিল তোমাদের?”

আফিফা বলে ওঠে,”আমি জানি, আরিশা মন থেকে ওসব বলে নি। নিশ্চয়ই ঐ জাঈদই কিছু করেছে। আমি আরিশাকে ফিরিয়ে আনবোই।”

নির্ঝর এবার রেগে বলে,”তোমার এই বোন ভক্তি বাদ দাও আফিফা! আমি কিন্তু ভীষণ বিরক্ত। আর ঐ মেয়েটা তো তোমার নিজের বোনও নয়। তবুও কেন একটা বাইরের মেয়ের জন্য এত ভাবছ।”

“নির্ঝর! তুমি এসব বলছ?”

ছবি বেগম বলেন,”একদম ঠিক বলছে নির্ঝর দাদুভাই। আজ থেকে তুমি আর ঐ মেয়ের কোন খোঁজ করবে না। আজ থেকে ও আমাদের সবার কাছে মৃত।”

“দাদি!”

to be continue…….

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_13
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আরিশা মন খারাপ করে ঘরের এককোণায় বসে ছিল৷ তার বিয়ের পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে৷ এই এক সপ্তাহ তার কাছে যেন ছিল এক সহস্র যুগের সমান। জীবনের সবথেকে কঠিন দিনগুলো সে কাটাচ্ছে এখন। আরিশা উদাস হয়েই বসে ছিল এমন সময় জাঈদ রুমে প্রবেশ করে আরিশার উদ্দ্যেশ্যে বলল,”সারাদিন কি ঘরে বসে থাক নাটক করার জন্য?”

আরিশা জাঈদের কথায় কোন পাত্তা দিল না। জাঈদ রেগে আরিশার কাছে এসে তাকে টান নিয়ে নিজের একদম কাছে এনে বলে,”আমি কিছু বলছি তোমায়, তুমি শুনতে পাচ্ছ?”

আরিশার ধ্যান ভাঙে। সে জাঈদের দিকে ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”আপনার কথা শোনার কোন ইচ্ছা নেই।”

“এই, আমাকে চোখ রাঙাবে না। আমি তোমার হাতের রান্না খেতে চাই৷ যাও আমার জন্য কিছু রান্না করে আন।”

“আপনাকে পারলে তো আমি বিষ খাইয়ে দেই। ছাড়ুন তো!”

বলেই আরিশা জাঈদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোফায় এসে বসে। জাঈদ আরিশার এমন একগুঁয়েমি দেখে রাগে কাপছিল। সে বলে,”এর ফল তোমায় ভোগ করতেই হবে!”

বলেই সে রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। জাঈদকে বেরিয়ে যেতে দেখে আরিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”আল্লাহ, এ কোন জালিমের সঙ্গে তুমি আমার ভাগ্য জড়িয়ে দিলে! কি অন্যায় করেছিলাম আমি? আমাকে এই জীবন থেকে মুক্তি দাও৷ এর থেকে তো মৃত্যুও ভালো!”

বলেই সে কাঁদতে শুরু করে।

—————————————–
আফিফা উদাস মনে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। যদিও তার মন মানসিকতা একদম ভালো নেই। নির্ঝরসহ পরিবারের বাকি লোকদের আপত্তির কারণে সে আরিশার সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারছে না। আরিশার জন্য তার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। এক সপ্তাহ থেকে আরিশার কোন খবরই নেই তার কাছে৷ আফিফা তার বোনের জন্য ভীষণ দুশ্চিন্তা করছে। মনে মনে হাপিত্যেশ করে বলছে,”না জানি, আমার বোনটা এখন কি অবস্থায় আছে!”

আফিফার ভাবনার মাঝেই কেউ পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে। আফিফা চমকে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকিয়ে নির্ঝরকে দেখে অবাক স্বরে বলে,”আপনি!”

নির্ঝর হালকা হেসে বলে,”এখনও তোমার আপনি আপনি বলা গেল না। আমি ছাড়া আর কার সাহস আছে তোমায় স্পর্শ করার?”

আফিফাও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে একটু হাসি দেয় জোরপূর্বক। নির্ঝর হাতে একটা চিরুণী নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল আছড়াতে আছড়াতে বলে,”কোথাও যাচ্ছ নাকি?”

“হ্যাঁ, মেডিকেলে যাচ্ছি। আজ অনেক জরুরি ক্লাস আছে।”

নির্ঝর আফিফার কথা শুনে বিরক্তির সুরে বলে,”রোজ, রোজ কি তোমার মেডিকেলে না গেলেই নয়? বিয়ের পর তো ভালো ভাবে তোমার সাথে টাইমই স্পেন্ড করতে পারলাম না। কোথায় আমরা নিউলি ম্যারিড কাপল, এই সময় লাইফটা এনজয় করব। আর তুমি নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত!”

আফিফা বলে,”কি করবো বলুন? ক্লাসটা যে অনেক ইম্পর্ট্যান্ট। আমাকে যেতে হবে।”

নির্ঝর আফিফাকে বারণ করে বলে,”আজ তোমায় কোথাও যেতে হবে না। চলো, আমি তোমায় নিয়ে ঘুরতে যাই। শুনেছি, সিলেটে অনেকেই হানিমুন করতে আসে। আমরাও নাহয় কোন সুন্দর স্থানে..”

আফিফা বলে ওঠে,”আজ সম্ভব নয়। আমি নাহয় অন্য কোনদিন সময় বের করে নেব।”

নির্ঝর নাছোড়বান্দা। সে বলে,”আমি যা বলছি তাই শোনো। তোমার ক্যারিয়ার নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই৷ কিন্তু আমাদের দাম্পত্যের মধ্যে তোমার ক্যারিয়ারকে এনো না। এরকম করে কিন্তু তুমি স্বামীর অধিকার থেকে আমায় বঞ্চিত করছ।”

“আপনি ভুল বুঝছেন আমায়!”

“আমি একদম ঠিক বুঝেছি।”

আফিফা আর কিছু বলতে যাবে এমন সময় নির্ঝর রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আফিফাও তাকে বোঝানোর জন্য তার পেছন পেছন আসে। নির্ঝর ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হয়। আফিফাও তার পেছন পেছন সেখানে আসে। এমন সময় ছবি বেগম যিনি ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন তিনি বলে ওঠেন,”কি হয়েছে নির্ঝর দাদুভাই? তোমায় এমন লাগছে কেন?”

নির্ঝর কিছুই বলে না। আদৃতা হঠাৎ সেখানে চলে আসে। আবরাজ ও নিঝুম তাদের কাজের জন্য আবার লন্ডনে ফিরে গেছে। তবে আদৃতাকে রেখে গেছে। যদিও আদৃতা এখানে থাকতে চায়নি কিন্তু ছবি বেগম অনুরোধ করায় কিছু বলতেও পারে নি। সে এসেই বলে ওঠে,”কি ব্যাপার ব্রো? এত সকাল সকাল তুমি কোথায় যাচ্ছ?”

“একটু বাইরে বের হচ্ছি।”

“বাহ, ভালো তো। তাহলে তোমার ওয়াইফকেও সাথে নিয়ে যাও। বিয়ের পর তো সেরকম ঘোরার সময়ই পেলে না৷”

ছবি বেগমও আদৃতার তালে তাল মিলিয়ে বলেন,”তাই তো, আদৃতা দিদিভাই তো ঠিক কথাই বলেছে। নির্ঝর দাদুভাই, তুমি আফিফা দিদিভাইকে নিয়ে ঘুরে আসো কোথাও থেকে।”

নির্ঝর তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,”কি যেন বলো না তুমি দাদি! তোমার নাতনী হলো একজন মেধাবী মেডিকেল স্টুডেন্ট। তাকে ঘুরতে নিয়ে গিয়ে আমি কি তার গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করতে পারি?”

বলেই সে বেরিয়ে যায়। ছবি বেগম বুঝতে পারেন কোন একটা ঝামেলা হয়েছে। তিনি আফিফার দিকে তাকিয়ে বলেন,”কি হয়েছে আফিফা দিদিভাই? তোমাদের মধ্যে কি কোন ঝামেলা হয়েছে?”

আফিফা কিছু না বলে মাথা নিচু করে মেডিকেলে যাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।

———————————
রাত্রি তখন ১২ টা, আরিশা রুমের মধ্যে চুপচাপ শুয়ে ছিল। জাঈদ সেই সকালে বেরিয়েছে এরপর এখনো অব্দি ফিরে আসে নি। সেসব নিয়ে আরিশার কোন ভাবান্তর নেই। দুপুর ও রাত্রে এই বাড়ির কাজের লোক এসে তাকে খাবার দিয়ে গেছে। সেও দিব্যি সেসব খেয়ে নিয়েছে৷ এখন আপাতত শুয়ে শুয়ে নিজের পরিবারের সবার কথা ভাবছিল। বিশেষ করে আফিফা ও নির্ঝরের কথা। তাদের কথা ভেবেই সে বিড়বিড় করে বলে,”তুমি এখন অনেক সুখী তাই না আপ্পি? আমি তো সবসময় তোমাকে সুখীই দেখতে চেয়েছি। হতে পারে তোমার সাথে আমার কোন রক্তের সম্পর্ক নেই৷ কিন্তু আমাদের মধ্যে যে আত্মিক সম্পর্ক আছে তা যে রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি!”

এমন সময় হঠাৎ একটা শব্দ পেয়ে আরিশা উঠে বসে। জাঈদ টলতে টলতে রুমে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দেয়। অতঃপর আরিশাকে দেখেই তার দিকে এগোতে থাকে৷ জাঈদ যতোই আরিশার দিকে এগোচ্ছিল আরিশা তখন নাকে একটা বড্ড বাজে গন্ধ অনুভব করছিল৷ জাঈদ আরিশার একদম কাছে আসলে আরিশা নিজের মুখ সরিয়ে নিয়ে বলে,”আপনি নেশা করেছেন!”

জাঈদ রেগে আরিশার চুলের মুঠো টেনে ধরে বলে,”বেশ করেছি, আমার বাপের টাকায় নেশা করেছি..তোর বাপের টাকায় নয়..উপস..সরি তোর তো বাপই নেই!”

জাঈদের কথা শুনে আরিশার মনের ক্ষত জেগে ওঠে৷ সে কেঁদে ফেলে। জাঈদ এতোটাই নেশাগ্রস্ত ছিল সে সেসবকে পাত্তা না দিয়ে আরো জোরে আরিশার চুল টেনে ধরে। আরিশা আর সহ্য করতে না পেরে বলে,”ছা…ছাড়ুন আমায়…”

জাঈদ যেন আজ নিজের মধ্যে ছিল না। নেশা তার হুশ কেড়ে নিচ্ছিল। নেশার ঘোরে সে আরিশার মধ্যে আফিফাকে দেখতে থাকে। অতঃপর বলে ওঠে,”আফিফা..তুমি এসেছ..আজ আমি তোমায় নিজের করে নেব। তুমি শুধু আমার..ঐ নির্ঝরের নও।”

বলেই সে আরিশাকে কাছে টেনে নিয়ে তার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। আরিশা জাঈদকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু তার শক্তির সাথে পেরে ওঠে না। জাঈদ আরিশাকে নিজের আরো কাছে টেনে নেয়। আফিফা মনে করে তার ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। একসময় আরিশাকে কোলে তুলে নিয়ে তাকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে ফেলে দেয়। আরিশার পরনের সালোয়ার কামিজটা টেনে খুলতে থাকে। আরিশা কান্না করতে করতে অনুরোধ করে থেমে যেতে কিন্তু জাঈদ কোন কথাই শোনে না। সে আরিশাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে নিজের জামাকাপড়ও খুলতে শুরু করে। অতঃপর আরিশাকে সম্পুর্ণ নিজের আওতায় এনে নেয়৷ বাকি সময়টা আরিশার জন্য ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। সে ঐ অবস্থায় যন্ত্রণায় কাতড়াতে থাকে। পুরো ঘর তার আহাজারির শব্দে ভারী হয়ে ওঠে। জাঈদ নিজের খোয়াইশ মিটিয়ে আরিশার উপর থেকে সরে গিয়ে তাকে নিজের বুকে জড়িয়ে বলে,”আফিফা..তুমি শুধু আমার আফিফা…”

আরিশা এমনিতেই অনেক কষ্টে ছিল তার উপর যখন বুঝতে পারে জাঈদ এতক্ষণ ধরে তাকে আফিফা মনে করে ভোগ করল তখন নিজের প্রতি ঘৃণায় তার ইচ্ছা করে মাটিতে মিশে যেতে।

to be continue…….

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_14
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আরিশা পরদিন সকালে উঠেই নিজেকে জাঈদের পাশে দেখে ঘৃণায় উঠে বসে৷ নিজের পোশাকটা হাতে নিয়ে দ্রুত পরিধান করে নেয়৷ অতঃপর ওয়াশরুমে গিয়ে পানি ছেড়ে কাঁদতে থাকে৷ এদিকে জাঈদেরও ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখে সে কিছুটা অবাক হয়। অতঃপর গতকাল রাতের ঘটনা মনে করে সে বলে ওঠে,”ড্যাম ইট, এটা আমি কি করলাম? ঐ মেয়েটার সাথে এমনটা আমি কিভাবে করতে পারলাম? ওর সাথে তো এই বিয়েটা জাস্ট একটা..ওহ শিট৷ কাল রাতে একটু বেশিই নেশা করে ফেলছিলাম। এটা হয়তো তারই প্রভাব। কিন্তু এখন কি হবে? কিভাবে এর মোকাবিলা করব সেটাই বুঝতে পারছি না।”

কিছু সময় পর আরিশা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই জাঈদ তার দিকে একটা পিল বড়ি এগিয়ে দিয়ে বলে,”এটা খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি। আমি চাই না, আর কোন বড় দূর্ঘটনা ঘটুক।”

“লাগবে না, সরান এটা।”

“কেন? তোমার কি আমার বাচ্চার মার হওয়ার খুব শখ হয়েছে নাকি?”

আরিশা জাঈদের শার্টের কলার ধরে বলে,”আপনার মতো শয়তানের বাচ্চার মা আমার শত্রুও না হোক এই কামনা করি। আমার এই পিল লাগবে না কারণ আমি কোনদিনও বাচ্চার মা হতে পারব না, বুঝলেন আপনি?”

বলেই সে অঝোরে কাঁদতে থাকে। একটু দম নিয়ে বলে,”কাল রাতে আপনি যা করলেন তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এর জন্য আমি আপনাকে কখনো ক্ষমা করব না, কখনো না। এর শাস্তি আপনি পাবেন একদিন না একদিন। মিলিয়ে নেবেন আমার কথা।”

বলেই আরিশা কাঁদতে কাঁদতে চলে যেতে ধরে। এমন সময় জাঈদ আরিশাকে আটকে বলে,”কাল যা হয়েছে তা মোটেই আমার ইচ্ছায় হয়নি। আমার কোন আগ্রহ ছিল না তোমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করার..আমি তো নেশায় ছিলাম আর তোমাকে আফিফা ভেবে..”

জাঈদ নিজের পুরো কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই আরিশা তার গালে ঠাস করে থা*প্পড় বসিয়ে দিয়ে বলে,”খবরদার আপনার এই পাপিষ্ঠ মুখে আমার আপ্পির নাম উচ্চারণ করবেন না।”

“তুমি আমায় মারলে..”

“হ্যাঁ, মারলাম। প্রয়োজনে আবারো মারব…কি করবেন আপনি? আবারো কাল রাতের মতোন..”

জাঈদ আরিশার মুখ চেপে ধরে বলে,”তোর মতো মেয়েকে স্পর্শ করতেও ঘৃণা লাগে..বললাম না, কালকের রাতে যা ঘটেছিল তা কেবলই একটা দূর্ঘটনা? বুঝলি না কেন তাহলে?”

বলেই আরিশাকে দূরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। আরিশা ফ্লোরে পড়ে যায়। তার হাতে পায়ে বেশ চোট লাগে কিন্তু জাঈদ সেদিকে কোন দৃষ্টিপাত না করে বেরিয়ে যায়।

ফ্লোরে পড়ে থাকা আরিশা ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নেয়। চোখের কোন দিয়ে নেমে আসা অশ্রুর ধারা সে আর নিতে চায় না। তার ভেতরটা আগুনে পুড়ছে, তবুও তার নিজেকে সামলাতে হবে। নিজেকে দুর্বল দেখালে এই মানুষটা হয়তো ভাববে, সে ভেঙে পড়েছে। কিন্তু না, সে ভাঙবে না!

কষ্ট আর ঘৃণার কাঁপুনি নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে জাঈদ চলে গেছে, কিন্তু তার মনে হচ্ছে সেই শয়তানের উপস্থিতি এখনও ঘরের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে আছে। নিজেকে পরিষ্কার করার জন্য ওয়াশরুমে যেতে চায়, কিন্তু পা একদম জমে গেছে। অবশেষে নিজেকে জোর করে ওয়াশরুমে ঢোকে, আয়নার সামনে দাঁড়ায়।

আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আর নিজেকে চিনতে পারে না। চুল এলোমেলো, চোখ লালচে আর গাল দুটো ফুলে আছে। নিজেকে দেখতে এত ভয়ঙ্কর লাগছে যে, মনে হচ্ছে আয়নাটা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে জানে, আয়না ভাঙলে চেহারা বদলাবে না, তার জীবনের ভয়ংকর সত্য বদলাবে না।

আরিশা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে বলে,
“তুই দুর্বল নস, আরিশা! তোর সাথে যা হয়েছে, তার জন্য তুই কাঁদবি না। তুই এখনো বেঁচে আছিস, তাই তোর যুদ্ধ করার সময় এসেছে।”

নিজেকে শক্ত করে বেরিয়ে আসে। এক মুহূর্তও এই ঘরে থাকা যাবে না। এখানকার প্রতিটি দেয়ালে, প্রতিটি আসবাবে, বিছানার সেই রক্তের দাগে লেপ্টে আছে তার অসহায়ত্বের প্রমাণ। আর সে চায় না এই প্রমাণ আর কেউ দেখুক।

———++++
আরিশা মন খারাপ করে বসে ছিল ঘরের মধ্যে। এমন সময় কারো আসার শব্দ পেতেই সে চমকে ওঠে। দুচোখ তুলে তাকাতেই সে দেখতে পায় জাঈদের মা জামিলা শেখ কে। তাকে দেখে আরিশা বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না৷ জামিলা শেখ হঠাৎ করে আরিশার পাশে বসে আরিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আরিশা জামিলা শেখের এমন আকস্মিক ব্যবহারে বেশ অবাক হয়। জামিলা শেখ সেটা বুঝতে পেরে বলেন,”জানি, তুমি আমায় দেখে বেশ অবাক হচ্ছ। হয়তো তুমি আমায় অনেক খারাপ ভাবো। তবে একটা কথা জানো কি? আমি আসলে ওতোটাও খারাপ মানুষ নই। আমারও একটা ভালো মন আছে। আমি আমার ছেলের ভালোর কথাই ভাবি৷ আর নিজের ছেলের স্বভাব সম্পর্কেও আমি ওয়াকিবহাল। আমি খোঁজ নিয়ে সব জেনেছি, জাঈদ কোন পরিস্থিতিতে আর কেন তোমায় বিয়ে করেছে৷ সবটা জেনে তোমার জন্য আমার ভীষণ খারাপ লাগছে জানো! তুমি কোন দোষ না করেও শুধু শুধু এত কষ্ট পাচ্ছ।”

আরিশার অবাক হওয়া যেন কোন ক্রমেই কমছিল না। জামিলা শেখ আরো বলে ওঠেন,”আমি জানি, জাঈদ কিছুতেই তোমায় শান্তিতে থাকতে দেবে না। কিন্তু এই অশান্তিময় জীবন তুমি ডিজার্ভ করো না। তোমারও তো সুখে থাকার একটা অধিকার আছে, তাই না? আমি জানি তোমার কেমন লাগছে এখানে থাকতে। তাই তোমায় একটা পরামর্শ দেই। এখানে থেকে নরকের মতো জীবনযাপন না করে এখান থেকে চলে যাও।”

আরিশা অবাক স্বরে বলে,”চলে যাব?”

“হ্যাঁ, যাও এখান থেকে। তাহলেই তুমি সুখী হতে পারবে।”

আরিশা নিজের চোখের জল মুছে বলে,”কিন্তু আমি যদি এখান থেকে চলে যাই তাহলে যে জাঈদ শেখ আমার আপ্পির ক্ষতি করতে।”

জামিলা শেখ আরিশাকে ভরসার সুরে আশ্বাস দেন,”তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি জাঈদকে বোঝাব যেন ও তোমার আপ্পির কোন ক্ষতি না করে। আমি বোঝালে ও ঠিকই বুঝবে। কিন্তু তুমি যদি এখানে ওর সামনে থাকো তাহলে ও তোমার জীবনটা একদম নরক বানিয়ে দেবে। তাই আমি বলছি, নিজের ভালো চাইলে তুমি চলে যাও এখান থেকে অনেক দূরে।”

জামিলা শেখ এত কথা আরিশাকে ভাবিয়ে তোলে। জামিলা শেখ আবারো জোর দিয়ে বলেন,”এত ভেবো না! তোমার হাতে বেশি সময় নেই। জাঈদ এখন বাড়িতে নেই কিন্তু যেকোনো সময় চলে আসতে পারে। ও বাড়িতে এলে তুমি আর পালানোর সুযোগ পাবে না। তাই এখনই পালিয়ে যাও।”

আরিশা উঠে দাঁড়ায়। বলে,”বেশ, আমি এখনই এখান থেকে চলে যাচ্ছি।”

জামিলা শেখ খুশি হয়ে বলেন,”এই তো বুদ্ধিমতীর মতো সিদ্ধান্ত”

বলেই তিনি আরিশার হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলেন,”এই টাকা টুকু রাখো, এটা দিয়ে বাসায় যেও।”

“লাগবে না, আন্টি।”

“আরে রাখো। রাস্তায় চলাফেরায় কাজে লাগবে। এখন জলদি যাও।”

আরিশা একটা কৃতজ্ঞতা সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বেরিয়ে যায়।

এদিকে আরিশা বেরিয়ে যেতেই জামিলা শেখ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,”যাক, ভুলভাল বুঝিয়ে এই আপদটাকে বিদায় করতে পারলাম! এখন আমি চাইলেই আমার জাঈদের সাথে আমার বোনের মেয়ে সন্ধ্যার বিয়ে দিতে পারব!”

এদিকে আরিশা জাঈদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমেই উদ্দ্যেশ্যহীন হয়ে পড়ে। এখন কোথায় যাবে সে? আফিফাদের বাড়ি? নাহ, আরিশা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় ওখানে আর ফিরবে না। যারা তার আপন নয় তাদের কাছে কেন যাবে? যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকেই এখন যাবে সে। এসব ভেবেই চোখের জল মুছে সামনের দিকে রওনা দেয় আরিশা।

to be continue…….