#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_36
#ইয়াসমিন_খন্দকার
আফিফা আরিশার রুমে এসে আরিশাকে দেখতে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে ওঠে। অতঃপর আরিশার রুম থেকে বাইরে এসে পুরো বাড়িজুড়ে আরিশাকে খুঁজতে থাকে। তবুও আরিশার দেখা না পেয়ে তাকে ফোন করে। কিন্তু আরিশার ফোনও সুইচ স্টপ বলছে। আফিফা এবার উপায়ন্তর না দেখে নির্ঝরের কাছে গিয়ে বলল,”আচ্ছা, তুমি আরিশাকে কোথায় দেখেছ? অনেকক্ষণ থেকে ওর কোন খোঁজ নেই, সারা বাড়িতে খুঁজেও ওকে পেলাম না।”
“আশেপাশেই কোথাও আছে হয়তো৷ তুমি ওকে ফোন করে দেখ।”
“আমি কল করেছিলাম কিন্তু ওর ফোন বন্ধ বলছে।”
এবার নির্ঝরও একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। ছবি বেগম হঠাৎ এসে বলেন,”কি হয়েছে? তোমাদের এমন লাগছে কেন?”
আফিফা বলে,”আরিশাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না, দাদি। ওর জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।”
“কি বলছ দিদিভাই, আরিশাকে তো তখন দেখলাম বৃষ্টি দিদিভাইয়ের সাথে নাচগান করতে। এরমধ্যে হঠাৎ করে আবার কোথায় চলে গেল?”
আফিফা বলে,”ওর কোন বিপদ হয় নি তো? আমার ভীষণ ভয় লাগছে নির্ঝর। আরিশা তো আমাকে না বলে কোথাও যায় না। এমনিই ওর শত্রুর শেষ নেই। ঐ জাঈদ শেখ তো হাত ধুয়ে পড়ে আছে আমার বোনটার পেছনে।”
নির্ঝর আফিফার কাধে সান্ত্বনার হাত দিয়ে বলে,”তুমি এতোটা চিন্তা করো না, আফিফা৷ আমি দেখছি কি করা যায়। তুমি একটু শান্ত হও।”
বলেই নির্ঝর বেরিয়ে যেতে নেয় এমন সময় ছবি বেগম বলে ওঠেন,”তুমি কি করবে দাদুভাই? তুমি তো লন্ডনে মানুষ, সিলেটের কিছুই চেনো না। আমি বরং দেখছি আমার চেনাজানা কাউকে ফোন করে। কেউ যদি সাহায্য করতে পারে।”
“আচ্ছা।”
~~~~~~
জাঈদের ঘুম ভাঙতেই তার চোখে সূর্যের আলো এসে পড়ে। সে ভালো ভাবে তাকিয়ে দেখে সকাল হয়ে গেছে। জাঈদ উঠেই বলে,”আমি তো সন্ধ্যার দিকে আরিশাকে প্রপোজ করার জন্য আয়োজন করছিলাম। এরমধ্যেই হঠাৎ করে সকাল হয়ে গেল কিভাবে? আরিশা তো বলেছিল ও আসবে…ও কি এসে আমায় না পেয়েই ফিরে গেলো..ওহ শিট।”
জাঈদ মনে করার চেষ্টা করে তার সাথে কি হয়েছিল৷ কিন্তু কিছুতেই ভেবে উঠতে পারে না। এরইমধ্যে জাঈদ হোস্টেল থেকে বাইরে চলে আসে। অতঃপর আরিশার ফোনে একটা কল করে। কিন্তু ফোন বন্ধ পায়। জাঈদ ভাবে,”নিশ্চয়ই আরিশা এখানে এসে আমাকে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে গেছে। হায় আল্লাহ! এত বড় ভুল আমি কিভাবে করলাম? কত বড় একটা সুযোগ ছিল আরিশার সাথে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নেবার৷ যাইহোক, এখন আমাকে শহরে ফিরতে হবে। সেখানে গিয়ে আরিশার কাছে ক্ষমা চেয়ে আবারো ওর মন জয় করার চেষ্টা করতে হবে।”
এহেন ভাবনা থেকেই জাঈদ শহরের উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।
নিজের বাসার সামনে এসেই জাঈদ দেখতে পায় বাড়ির সামনে অনেক জটলা এবং একটি পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে৷ জাঈদ বিড়বিড় করে বলে,”কি আবার হলো? বাড়ির সামনে এত জটলা কেন?”
এমন ভাবনা থেকে একটু এগিয়ে যেতেই জাঈদ দেখতে পেল ভেতরে তার বাবা-মার সাথে আফিফা তর্ক করছ৷ তার সাথে নির্ঝর, সায়ন ও পুলিশও এসেছে। জাঈদ তাদের কথোপকথন শুনতে থাকে। আফিফা জাঈদের মা-বাবার দিকে আঙুল তুলে বলে,”ভালোয় ভালোয় বলুন, আপনাদের ছেলে আমার বোনকে নিয়ে কোথায় গেছে। নাহলে কিন্তু ভালো হবে না।”
জামিলা শেখ বলেন,”এই মেয়ে মুখ সামলে কথা বলো। তোমার বোন কোথায় গেছে সেটা আমার ছেলে কিভাবে জানবে হুম? দেখো, ঐ মেয়েই কোথায় যেন পালিয়ে গেছে। তুমি শুধুশুধু আমার নির্দোষ ছেলেকে দোষারোপযোগ্য করছ কেন?”
“ও আচ্ছা, আপনার ছেলে নির্দোষ? এটা দেখুন, আরিশার কল রেকর্ড। সর্বশেষ আপনার ছেলে জাঈদের সাথেই ওর কথা হয়েছিল কাল সন্ধ্যার দিকে। আর তারপর থেকেই ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি নিশ্চিত আপনার ছেলেই আমার বোনের সাথে কিছু একটা করেছে।”
“এসব ভুলভাল বকা বন্ধ করো। আমার ছেলে তোমার বোনকে কল করেছিল মানে এই না যে, ঐ তোমার বোনের সাথে কিছু করেছে।”
“বেশ,তাহলে ডাকুন আপনার গুণধর ছেলেকে। ও নিজে এসেই বলুক, ও কিছু করেছে নাকি করে নি।”
আফিফার কথা শুনে জাঈদ এগিয়ে গিয়ে বলে,”কি হয়েছে আরিশার?”
আফিফা রেগেমেগে এগিয়ে এসে জাঈদের কলার ধরে বলে,”জানোয়ার, বল কি করেছিস আমার ছেলের সাথে।”
জামিলা শেখ রেগে নিজের স্বামী জাহাঙ্গীর শেখের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে কি দেখছ? তোমার সামনে তোমার ছেলের সাথে এরা এমন ব্যবহার করার সাহস পায় কি করে? তুমি না এই এলাকার কাউন্সিলর, সামনে এমপি হতে চলেছ। তোমার কি কোন ক্ষমতা নেই এদের আটকানোর?”
জাহাঙ্গীর শেখ কিছুটা চিন্তায় ছিলেন। কারণ সামনেই নির্বাচন। এই সময় তিনি কোন কেলেঙ্কারিতে জড়াতে চাইছিলেন না। এমন সময় হঠাৎ যদি তার ছেলের এসব কেস সামনে আসে তাহলে তিনি বিপদে পড়তে পারেন। সেজন্য জাহাঙ্গীর শেখ এগিয়ে এসে পুলিশ অফিসারকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেন,”দেখুন ইন্সপেক্টর,আপনারা কোন প্রমাণ ছাড়া আমার ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসতে পারেন না, আর এখানে তো পুরোপুরি আমার ছেলেকে হেনস্তা করা হচ্ছে।”
কয়েকজন মহিলা পুলিশ এগিয়ে গিয়ে আফিফাকে জাঈদের থেকে আলাদা করে। জাঈদ বলে ওঠে,”আমি সত্যি জানি না আরিশা কোথায়। হ্যাঁ, কাল রাতে আমি ওকে পাহাড়ি চা-বাগানের ঐদিকে দেখা করতে ডেকেছিলাম কিন্তু..”
জাঈদ মনে করার চেষ্টা করে গতকাল রাতের কথা।
এমন সময় হঠাৎ করে এমপি নির্বাচনে জাহাঙ্গীর শেখের প্রতিদ্বন্দী আলমগীর খন্দকার চলে আসেন সেই স্থানে। নিজের বিশ্বস্ত কিছু অনুচরের মাধ্যমে তিনি খবর পেয়েই মূলত এসেছেন। এই নির্বাচনে জাহাঙ্গীর শেখই তার প্রধান প্রতিদ্বন্দী৷ তাই তাকে কোনভাবে কোন কেলেঙ্কারিতে ফাঁসাতে পারলেই কেল্লাফতে। এহেন ভাবনা থেকেই আলমগীর খন্দকার এসেই বলে ওঠেন,”কি ব্যাপার, এভাবে নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজের ছেলের ক্রাইম আপনি ধামাচাপা দিতে চাচ্ছেন শেখ সাহেব?”
আলমগীর খন্দকার সাথে করে কিছু জনপ্রিয় নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিকও নিয়ে এসেছেন। যা দেখে জাহাঙ্গীর শেখ শুকনো ঢোক গিললেন। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন যে বেশ বড়োসড়ো একটা ঝটকা খেতে চলেছেন আজ।
আলমগীর খন্দকারের মুখে বাঁকা হাসি। তিনি এগিয়ে গিয়ে আফিফাকে জিজ্ঞেস করেন,”তুমি একদম চিন্তা করো না, মা। আমি তোমার পাশে আছি। তুমি অন ক্যামেরায় বলো এই জাহাঙ্গীর শেখ ও তার পরিবার তোমার সাথে কি কি অন্যায় করেছে। গোটা সিলেটবাসী জানুক,তাদের ভবিষ্যত এমপি পদপ্রার্থীর আসল চেহারা কি।”
আফিফা এবার ক্যামেরার সামনে একে একে সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে লাগল। জাহাঙ্গীর শেখের বিপি হাই হতে লাগল। তিনি বুঝে গেলেন এসব কিছু প্রকাশিত হবার পর তার এমপি নির্বাচিত হবার বিন্দুমাত্র আশা আর রইল না। আফিফা নিজের কথা শেষ করে হাতজোড় করে সবার সামনে বললো,”আমার বোনুটা বড্ড অসহায়। দয়া করে ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন।”
আলমগীর খন্দকার যদিওবা রাজনৈতিক স্বার্থেই এসব কিছু করছেন আর তাই নিজের জনপ্রিয়তা আরো বাড়ানোর জন্যই আফিফার মাথায় হাত দিয়ে বললেন,”তুমি চিন্তা করো না। তোমার বোনকে ঠিকই উদ্ধার করা হবে এবং তার সাথে হওয়া প্রতিটা অন্যায়ের ন্যায়বিচারও সে পাবে।”
এদিকে জামিলা শেখ হার মারার পাত্র নন। তিনি বলেন,”এই মেয়ে সবকিছু মিথ্যা বলছে। আমাদের পরিবারের বদনাম করার জন্যই এসব ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। ঐ আরিশার সাথে যা হয়েছে তাতে আমাদের কোন হাত নেই।”
এমন সময় হঠাৎ করে মাথায় ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় এগিয়ে এসে কেউ বলে উঠল,”তাই বুঝি?”
কন্ঠটা শোনামাত্রই সবাই অবাক হয়ে সেদিকে তাকালো। আফিফা খুশি হয়ে বলল,”বোনু!”
জামিলা শেখের গলা যেন শুকিয়ে গেল। তিনি বললেন,”এটা কি করে হতে পারে? এত উপর থেকে পড়েও এই মেয়ে বেঁচে গেল কিভাবে?”
আরিশা এগিয়ে এসে বলল,”কার হাত আছে আর কার হাত নেই, এবার সবটা আমি বলছি।”
to be continue…….
#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_37
#ইয়াসমিন_খন্দকার
আরিশা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে। আরিশা যতোই এগিয়ে আসছিল জামিলা শেখের নিঃশ্বাস যেন ঠিক ততোই গলায় আটকে যাচ্ছিল। আরিশা একদম জামিলা শেখ এর সামনাসামনি এসে বলে,”অনেক হিসাব-নিকাশ এখনো বাকি আছে,কি বলেন?”
জামিলা শেখ ভাবতে থাকেন,”এই মেয়েটা বেঁচে গেল কিভাবে? এত উপর থেকে পড়েও মরল না। এর তো কই মাছের প্রাণ দেখছি।”
আফিফা এসে আরিশাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”বোনু, তুই ঠিক আছিস তো? আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম যে এই জানোয়া*রগুলো তোর কোন বড় ক্ষতি না করে দেয়।”
আরিশা আফিফাকে ভরসা দিয়ে বলে,”তুমি এত চিন্তা কোরো না, আপ্পি। রাখে আল্লাহ তো মারে কে।”
বলেই সে একবার জামিলা শেখ ও একবার জাঈদের দিকে তাকিয়ে বলে,”যদিওবা কিছু শয়তান চেষ্টা করছিল আমায় শেষ করে দেওয়ার কিন্তু তাদের সেই উদ্দ্যেশ্য সফল হয়নি। তারা পারে নি আমায় শেষ করতে।”
আলমগীর খন্দকার বুঝে যান এই সময় পরিস্থিতি তার অনুকূলে। তাই তিনি এগিয়ে এসে আরিশার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”মা, তুমি একদম ভয় পেয়ো না। তোমার সাথে যা যা অন্যায় হয়েছে সবকিছু ক্যামেরার সামনে বলো। সারাদেশ শুনুক, তোমার প্রতি হওয়া সব অন্যায়ের কথা।”
আরিশা আলমগীর খন্দকারের দিকে তাকায়। অতঃপর ক্যামেরার সামনে বলতে শুরু করে,”গতকাল সন্ধ্যার দিকে মিস্টার জাঈদ শেখ আমায় সিলেটি পাহাড়ি এলাকার দিকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন দেখা করার জন্য। আমি তার কথামতো সেখানে যাই তার সাথে দেখা করতে। তার শর্তমতে নিজের পরিবারের কাউকে কিছু জানাই নি আর এটাই আমার সবথেকে বড় ভুল ছিল। আমি ওখানে যাওয়ার পর জামিলা শেখ সেখানে চলে আসেন। আর উনি এসে বলেন, এটা আমার জন্য একটা ফাঁদ পাতা হয়েছিল আর এটা বলার পরই উনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন পাহাড় থেকে। তবে সৌভাগ্যবশত, আমি একেবারে খাদে পড়ে যাইনি, কিছুটা নিচেই সমতল ভূমিতে পড়েছিলাম এবং মাথায় সামান্য আঘাত পেয়েছিলাম। সেখান থেকে চা-বাগানের কিছু শ্রমিক আমায় উদ্ধার করে তারাই আমায় হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি হাসপাতাল থেকেই সরাসরি এখানে এসেছি।”
জামিলা শেখ বলে ওঠেন,”মিথ্যা, মিথ্যা এই সব কিছু মিথ্যা। আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত হচ্ছে।”
জাহাঙ্গীর শেখ এগিয়ে এসে জামিলা শেখকে থা*প্পড় মা*রেন। জামিলা শেখ হতবাক হয়ে যান। জাহাঙ্গীর শেখ রাগে ফুসতে ফুসতে বলেন,”তোমার আর তোমার ছেলের জন্য আমার এতদিনের সুনাম সব ধ্বংস হয়ে গেল। তোমরা যে এত নিচে নামবে আমি কখনো ভাবতে পারিনি।”
জামিলা শেখ করুণ স্বরে বলে ওঠেন,”এসব তুমি কি বলছ? তুমিও আর সবার মতো এই বাইরের মেয়ের কথা বিশ্বাস করছ?”
জাহাঙ্গীর শেখ তো ভীষণ রেগে গেছেন। কারণ তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে যে ধ্বস নামতে চলেছে এটা তিনি বেশ ভালোই বুঝতে পারছেন। তবুও শেষ মুহুর্তে রাজনৈতিক চাল চেলে যাতে ড্যামেজ কিছুটা হলেও কন্ট্রোল করা যায় তাই তিনি বলেন,”আমি কখনোই তোমাদের মতো অপরাধীদের পাশে থাকব না, সে তোমরা আমার যতোই আপন হও। আমি যদি আগেই জানতাম যে তোমরা আরিশার উপর এত অন্যায় করছ তাহলে আগেই কিছু করতাম। আমার অগোচরে যে এত কিছু হয়ে গেছে সেটা আমি জানতামই না। ইন্সপেক্টর,আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন? গ্রেফতার করুন এদের। আর দেখবেন এদের যেন কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি হয়। আজ থেকে এদের মা-ছেলের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, আমার পদবীও যেন এরা আর ব্যবহার না করে। আমি যত দ্রুত সম্ভব এই মহিলাকে তালাক দেব আর জাঈদকেও ত্যায্যপুত্র করে নিজের সব সম্পত্তি, অংশীদারত্ব থেকে ওকে মুছে ফেলব।”
জামিলা শেখ হতবাক হয়ে যান নিজের স্বামীর কথা শুনে। এদিকে জাঈদের অবস্থাও অনেকটা একই। কয়েকজন মহিলা পুলিশ এগিয়ে এসে জামিলা শেখের হাতে হাতকড়া পড়িয়ে তাকে টানতে থাকেন।
এদিকে জাঈদকে কিছু পুলিশ সদস্য গ্রেফতার করতে গেলে সে তাদের পাশ কাটিয়ে আরিশার সামনে এসে বলে,”আরিশা, বিশ্বাস করো, যা কিছু হয়েছে তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি তো তোমার ক্ষতি করার কথা চিন্তাই করতে পারি না। আমি তো কাল তোমার সাথে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিতেই তোমায় ডেকেছিলাম কিন্তু হোটেলে একটা শরবত..”
আরিশা ঠাস করে জাঈদের গালে একটা থা*প্পড় বসিয়ে দেয়। জাঈদ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আরিশা রাগে ফুসতে ফুসতে বলে,”ব্যস,অনেক নাটক করেছেন। আর নাটক করবেন না। আপনার দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। আপনাকে তো বিশ্বাস করেই আমি কাল পাহাড়ি এলাকায় গিয়েছিলাম। সেই বিশ্বাসের কি মর্যাদা দিলেন আপনি? এখন যান জেলে গিয়ে পচে মরুন।”
আরিশার কথা শুনে জাঈদের মতো কঠিন মানুষের চোখেও পানি চলে আসে। এদিকে জামিলা শেখ বলে ওঠেন,”আমার ছেলে সত্যিই নির্দোষ৷ ও কিছু করে নি,যা করার আমিই করেছি। আমিই ওর শরবতে..”
পুলিশ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”কে দোষী আর কে নির্দোষ সেটা নাহয় কোর্টে প্রমাণিত হবে।”
অতঃপর জাঈদ ও জামিলাকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয়। জাঈদ যতক্ষণ পারা যায় আরিশার দিকে তাকিয়ে ছিল। আরিশার চোখের ঘৃণা, অবিশ্বাস সবকিছু তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। তাকে তার অতীতের করা অন্যায়গুলো মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
এরমধ্যে আফিফা এগিয়ে এসে আরিশাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া যে তুই একদম ঠিক আছিস। এবার ঐসব অপরাধীদের শিক্ষা পাওয়ার পালা।”
আরিশার মন তবুও যেন খচখচ করছিল। জাঈদের চোখ দেখে কেন জানিনা তার মনে হচ্ছিল জাঈদ সত্যি কথাই বলছে। আরিশা নিজের এই ভাবনার উপর বিরক্ত হয়ে স্বগোতক্তি করে বলে,”আমি আর ওনার কথা ভাবব না। উনি একজন অপরাধী,উনি আমায় মারতে চেয়েছেন।”
~~~~~~
টিভির সামনে বসে এতক্ষণ ধরে নিউজ দেখে চলেছেন রাহেলা খন্দকার। তার শ্বাশুড়ি সিতারা বেগম তার কাছে এসে বললেন,”কি হয়েছে বৌমা? এত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছ?”
রাহেলা খন্দকার বলেন,”আম্মা,আপনাকে আমি একটা মেয়ের ব্যাপারে বলেছিলাম না, যে কিছুদিন আগে আমায় সাহায্য করেছিল রাস্তায়।”
“হুম, বলেছিলে তো। মেয়েটাকে নাকি তোমার কাছে অনেক আপন মনে হয়েছে।”
“দেখুন টিভিতে নিউজটা দেখাচ্ছে। আপনার ছেলে আজ এই মেয়েটাকে সাহায্য করেছে।”
“কি বলছ তুমি? আলমগীর তো নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু করার ছেলে নয়।”
“ঐ মেয়েটা আপনার ছেলের প্রতিদ্বন্দ্বী জাহাঙ্গীর শেখের পুত্রবধূ ছিল। মেয়েটাকে ওর শ্বাশুড়ি ও স্বামী মিলে মে*রে ফেলার চেষ্টা করেছিল। তবে মেয়েটা বেচে ফিরে এসে ওদের মুখোশ খুলে ফেলেছে।”
“ওহ এই ব্যাপার।।সেইজন্যই আলমগীর ছুটে গেছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। সামনেই তো ইলেকশন। এই ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই এমন নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝে না। নিজের মেয়েকে হারানোর পর তুমি যখন ভেঙে পড়েছিলে তখনো ও নিজের রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত ছিল। কি আর বলবো ওর কথা।”
“এসব বাদ দিন, আম্মা। আমার তো মেয়েটার জন্য খুব খারাপ লাগছে। কতই বা বয়েস হবে? এই বয়সে এত কিছু দেখতে হলো। আমি মেয়েটার সাথে দেখা করতে চাই। ওর সাথে দেখা করে ওর কথা শুনতে চাই। ওকে দেখলেই আমার ভীষণ আপন মনে হয় আম্মা।”
to be continue…….
#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_38
#ইয়াসমিন_খন্দকার
আরিশা নিজের ঘরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। মাথায় এখনো তার প্রচণ্ড ব্যথা। তবে এত কিছুর মাঝেও জাঈদের শেষ দিকের করুণ চাহনি তাকে এখনো ভাবাচ্ছে। আরিশা এসব কিছুই ভাবছিল এমন সময় হঠাৎ করে আফিফা তার রুমে চলে আসে। আফিফা এসেই আরিশাকে বলে,”বোনু, এখন কেমন আছিস তুই?”
আরিশা আফিফার কথায় নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে বলে,”ভালো তবে মাথায় এখনো কিছুটা ব্যথা করছে।”
“চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। যাইহোক, তোর সাথে একজন দেখা করতে এসেছে।”
“আমার সাথে? কিন্তু কে?”
” আমি।”
হঠাৎ করে এক মায়াভরা কন্ঠস্বর শুনে আরিশা দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় রাহেলা খন্দকারকে। তার মনে পড়ে যায় কিছুদিন আগেই রাস্তায় এই মহিলাটির সাথে তার দেখা হয়েছিল। আরিশা মৃদু হেসে বলে,”আন্টি,আপনি?”
“হুম,তোমার খোঁজ নিতে আসলাম।”
“আসুন, ভেতরে আসুন।”
রাহেলা খন্দকার ভেতরে এসে একদম আরিশার শিয়রের কাছে বসে বলেন,”টিভিতে নিউজে আমি সবটা দেখলাম। এসব দেখে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলাম না। তাই চলে এলাম তোমার সাথে দেখা করার জন্য। এই টুকুনি একটা মেয়ে তুমি আর এই বয়সেই কত কিছু সহ্য করতে হলো।”
আরিশা নিজের অতীতের কিছু খারাপ স্মৃতি মনে করে বলল,”সবই বুঝি ছিল নিয়তির খেলা। কি আর করব বলুন।”
“আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করব যেন তোমার জীবনে আর কোন দুঃখ কষ্ট কখনো প্রবেশ করতে না পারে। অতীতের সব দুঃখ ভুলে যেন তুমি এক সুন্দর জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে পারো।”
আরিশা বলে,”আমার জন্য আরেকটা দোয়া করতে পারবেন আন্টি? জানেন, আমার জন্মের পরই আমার আসল পরিবার আমায় ত্যাগ করে। এই পৃথিবীতে আমায় একা ফেলে চলে যায়। তারপর যদিওবা এই পরিবারের মানুষ গুলো আমায় অনেক ভালোবাসা দিয়েছে, একদম নিজের মেয়ের মতো করে মানুষ করেছে। আমার তাদের নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। কিন্তু একটি বারের জন্য হলেও আমি আমার আসল মা-বাবার মুখোমুখি হতে চাই। তাদের সাথে দেখা করে শুধু তাদের একটি মাত্র প্রশ্নই করতে চাই যে কেন..কেন তারা আমায় এই অবস্থায় একা ফেলে গেল। কি দোষ করেছিলাম আমি?”
আরিশার কথা শুনে রাহেলা খন্দকারের বুক হাহাকার করে ওঠে। বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করে তিনি বলেন,”জানিনা,একজন মা কিভাবে তার সন্তানকে এভাবে ত্যাগ করতে পারে। যেখানে আমি নিজের সন্তানকে হারানোর পর এখনো অব্দি একটি বারও দুচোখের পাতা এক করতে পারি নি।”
আরিশা কিছুটা অবাক স্বরে বলে,”আপনি নিজের সন্তানকে হারিয়েছেন?”
রাহেলা খন্দকার বলেন,”হুম, জানো আমার না বিয়ের পর থেকে দীর্ঘ ১২ বছর কোন সন্তান হয় নি। এক সময় তো আমি মা হবার আশাও ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এমন সময় আল্লাহ মুখ তুলে চাইলেন। আমি সন্তান সম্ভবা হলাম। সেই সময় যে আমি কত খুশি হয়েছিলাম সেটা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু ঐ যে কথায় আছে না, অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকায়ে যায়। আমারও হয়েছিল সেই দশা। আল্লাহ আমায় সন্তান গর্ভে ধারণ করার সৌভাগ্য তো দিলেন তিনি সন্তান্তের গর্ভে মা ডাক শোনার সৌভাগ্য দিলেন না। জন্মের পরপরই আমার সন্তান মারা যায়। এই ঘটনায় যেন আমি পুরোপুরি ভেঙে পড়ি। এরপর আর কখনো দ্বিতীয় বার মা হবার সুযোগ পাই নি। জানো, তোমায় দেখলে কেন জানি আমার ভীষণ আপন লাগে। আমার সন্তান যদি বেঁচে থাকত তাহলে নিশ্চয়ই তোমার মতোই হতো।”
আরিশা করুণ চোখে তাকায় রাহেলা খন্দকারের দিকে। এরইমধ্যে আফিফা বলে ওঠে,”আসলে, সকল মানুষের জীবনেই কোন না কোন দুঃখ থাকে। কিন্তু আমাদের সেই সমস্ত দুঃখে ভেঙে পড়লে চলবে না। আমাদের সেই সব দুঃখকে ভুলে সামনে এগোতে হবে।”
রাহেলা খন্দকার নিজের চোখের জল মুছে বলেন,”একদম ঠিক বলেছ তুমি। আচ্ছা, আরিশা মা, তাহলে তুমি বিশ্রাম নাও। আমি তাহলে এখন আসি।”
আরিশা বলে,”আন্টি, আপনি লাঞ্চটা এখানেই করে যাবেন।”
“আরে না,না এত ব্যস্ত হতে হবে না তোমাদের। আমি বাসায় গিয়ে..”
আফিফাও বলে,”না, আন্টি। আমরা আপনার কোন কথা শুনব না। আজকের জন্য আপনি আমাদের গেস্ট আর তাই আপনাকে লাঞ্চ করে তবেই যেতে দেব।”
রাহেলা খন্দকার এবার হার মেনে নিয়ে বলেন,”বেশ, খেয়েই যাব নাহয়।”
আরিশা ও আফিফা দুজনেই খুশি হয়। রাহেলা খন্দকার আরিশার দিকে আবারো তাকান। মেয়েটির দিকে তাকালেই অদ্ভুত শান্তি খুঁজে পান তিনি।
——++++——–+++++++——–+++++
আনিকা খান রান্নাঘরে রান্নাবান্না করতে ব্যস্ত ছিলেন। নিঝুম রান্নাঘরে প্রবেশ করেই বলে ওঠেন,”আরে আনিকা, তুমি একা একা সবকিছু করছ কেন? বুয়া আজকে আসেনি?”
“আর বলো না আপু, বুয়ার স্বামী নাকি ভীষণ অসুস্থ তাই সে কিছুদিন আসতে পারবে না।”
“সে কি! তাহলে তুমি এত কাজ একা সামলাবে কিভাবে? কিছুক্ষণ আগেই তো হাসপাতাল থেকে ফিরলে এত রোগী দেখে আর এখন এত রান্না একা করবে। তুমি বের হও, আমি সব করে দিচ্ছি।”
আনিকা খান বলে ওঠেন,”না, আপু। তার প্রয়োজন হবে না। রান্না প্রায় হয়েই গেছে আর বুয়া বলে গেছে, ওর পরিবর্তে আজকেই নতুন কাউকে পাঠাবে। কিন্তু তার তো আরো অনেক আগেই আসার কথা ছিল৷ এখনো কেন আসছে না বুঝতে পারছি না।”
এমন সময় হঠাৎ করে বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠতেই আনিকা খান বলে ওঠেন,”ঐ যে, নতুন বুয়া বোধহয় এসে গেছে।”
নিঝুম বলেন,”বেশ, তুমি তাহলে এদিকটা সামলাও আমি গিয়ে দেখছি।”
“আচ্ছা।”
নিঝুম গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পান একজন মধ্যবয়সী নারীকে। যার পরনে মলিন বস্ত্র, হাতে একটা পুটলি। নিঝুম তাকে দেখেই বলে ওঠেন,”তুমি কি নতুন বুয়া?”
“জে ম্যাডাম, আমিই আপনেদের নতুন বুয়া। আপনাদের বাড়ির আগের বুয়া আমারে পাঠাইল।”
“তুমি আসতে এত দেরি করলে কেন? এসো ভেতরে এসো।”
“আর বলবেন না, আমি তো আরো কয়েকটা বাড়িতে কাজ করি তাই সব কাজ ছেড়ে আসতে দেরি হয়ে গেল।”
নতুন বুয়া বাড়িতে প্রবেশ করেই চারিদিকে চোখ বোলাতে বোলাতে বলেন,”বাব্বাহ, কি বড় বাড়ি আপনাগো।”
“তা তোমার নাম কি?”
“জে, জরিনা।”
এমন সময় আনিকা রান্নাঘর থেকে আসতে আসতে বললেন,”নতুন বুয়া এসে গেছে আপু.. ”
বলতে বলতে এগিয়ে আসতেই তার নজর যায় জরিনার দিকে। সাথে সাথেই বিস্ময়ে তার চোখ বড়বড় হয়ে যায়। এদিক জরিনাও আনিকা খানকে দেখে হতবাক হয়ে যান। শুকনো ঢোক গিলতে শুরু করেন। আনিকা খান বলে ওঠেন,”তুমি!”
জরিনা বাড়ি থেকে দ্রুত চলে যেতে নেন এমন সময় আনিকা খান এগিয়ে গিয়ে তার পথ আটকে বলেন,”দাঁড়াও, এভাবে যেতে পারবে না তুমি। আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি।”
জরিনা আমতাআমতা করে বলে,”আপনের সাথে তো ২০ বছর আগেই আমার যা সওদা হওনের হয়ে গেছিল। তাইলে এহন কেন আমায় আটকাইতাছেন?”
“আটকাচ্ছি তার কারণ আছে। এত গুলো বছর পর তোমার দেখা পেলাম, এতদিন পর যখন এসেছ একবার নিজের মেয়ের সাথে দেখা করে যাও। ভয় নেই, তার কোন দায়িত্ব তোমায় নিতে হবে না। এতগুলো বছর যখন আমরা তাকে সামলেছি তখন সামনেও সামলাব।”
নিঝুম বলে ওঠেন,”তুমি এনাকে চেনো আনিকা?”
“জ্বি, আপু। ইনিই হলেন আরিশার আসল মা। আজ থেকে ২০ বছর আগে ইনিই দারিদ্র্যের অযুহাতে নিজের সদ্যজাত মেয়েকে হাসপাতালে ফেলেই পালিয়ে যান।”
নিঝুম হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। ততক্ষণে রাহেলা খন্দকারও নিচে নেমে আসেন। জরিনার নজর যায় রাহেলা খন্দকারের দিকে। সাথে সাথেই তিনি শুকনো ঢোল গিলতে থাকে। রাহেলা খন্দকারও অবাক স্বরে বলেন,”জরিনা, তুমি!”
to be continue…….