পরাণ বধূয়া পর্ব-০৩

0
90

#পরাণ_বধূয়া —০৩
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
সতর্কতা — কপি নিষিদ্ধ।

রেলস্টেশনের একটা বেন্ঞ্চে আলতো শরীর এলিয়ে বসে আছে সাইফান। তার থেকে কিছুটা দূরত্বে একই বেন্ঞ্চে বসে আছে অদ্রিজা। এক হাতে তার ব্যাগ আরেক হাত দিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চেপে গুনগুন করে কাঁদছে সে। রেলস্টেশনের অবস্থা এখন আগের থেকে নির্জন, কেউ নিই বললেই চলে। নিস্তব্ধতা চাপা স্টেশনে অদ্রিজার গুনগুন করে কান্না করাটাও কানে বাজছে। বিরক্ত হয়ে হতাশ শ্বাস ফেলে সাইফান তারপর ঘুরে অদ্রিজার দিকে তাকায়। চোখ মুখ লাল বর্ণ ধারণা করেছে। চোখ সরালো সাইফান তারপর খুব কষ্ট করে নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে। তারপর কল লাগায় যে আসার কথা সেই ফ্রেন্ডকে। রিসিভ হলো না; হতাশ হলো সাইফান। ফোন পকেটে রাখতে যাবে তখন মেসেজ আসার টোন বাজে।সাইফান ফোন অন করলো। মেসেজ এসেছে সেই বন্ধুর থেকে সে কিছুটা এমন লিখছে যে।

‘ আগের স্টেশনে সে নেমে গেছে। রাত হয়েছে ওই স্টেশনের কাছাকাছি তার মামীর বাসা তাই সে ওই বাসায় সবার সাথে দেখা করতে গেছে। আজকে ওখানেই থাকবে। আগামীকাল সে সরাসরি বিয়ের ভেন্যুতে আসবে। ’

মেসেজটা পরে কেনো যেনো ভীষণ হাসি পেল সাইফানের। বিয়ের ভেন্যুতে যেয়ে কি করবে; যেখানে বউ পালিয়েছে — এখন তার পাশে বসেই গুনগুন করে কাঁদছে সেই মেয়ে। আবারো কিছু সময় চুপ করে থাকলো। পেটে যন্ত্রণা করছে। তবে ড্রাইভ করে বাসায় কিংবা হসপিটালে যাওয়া কেনো ভাবেই পারবে বলে মনে হচ্ছে না। বিরক্ত ধরলো মনে; তাই বিরক্ত কণ্ঠে অদ্রিজাকে উদ্দেশ্য করে বলে—–

‘ একটু থামবেন? কান্না করছেন কেনো?’

অদ্রিজা ভীত মুখে তাকালো তারপর অভিমানী দৃষ্টি নিয়ে বলে—–

‘ আপনি আবার আমায় বাসায় নিয়ে যাবেন তাই না মামা?’

খানিক অবাক ও বিরক্ত হয় সাইফান সাথে মামা ডাক শুনে চোখ মুখ কুঁচকে আসে; বিয়ে হতে পারলো না তার আগে মামা; বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে —-

‘ আমি আপনার কোন জন্মের মামা?

ভরকায় অদ্রিজা! কিছু বলার পূর্বে সাইফান আবারো বলে—–

‘ আর আপনাকে বাসায় নিয়ে যাবো বলতে?’

অদ্রিজা নাক টানে তারপর বলে—–

‘ আমি তো বাসা থেকে পালিয়েছি। আর আপনি তো সিজান ভাইয়ের মামা। তাই আমিও মামা বলেছি; সবাই এতো সময়ে তো জেনে গেছে আমি পালিয়েছি। তাই হয়তো খুঁজতে বেড়িয়েছে। আর হয়তো আ-আপনিও তাদের সাথে খুঁজতে বেড়িয়েছেন; আর আমায় এখানে পেলেন। এখন নিশ্চয়ই আবারো বাসায় নিয়ে যাবেন! তাই না?’

চোখ মুখ কুঁচকে আসে সাইফানের। উল্টোপাল্টা কথা বলছে আর কি সব লজিক! তবুও নিজস্ব গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে বলে—–

‘ আপনার কেন মনো হলো আমি আপনাকেই নিতে বা খুঁজতে এসেছি?’

অবুঝের মত তাকালো অদ্রিজা। তারপর বলে—–

‘ কারণ আমি বাড়ি থেকে পালিয়েছি।’

‘ পালিয়েছেন কেন?’

‘ বিয়ে করব না বলে!’

‘ এক্সজেক্টলি; দ্যাট’স দ্য পয়েন্ট!’

অদ্রিজা অবাক হয় সাইফানের কথায়। ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছে সাইফান? অদ্রিজাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাইফান নিজেকে টেনে আরেকটু ঠেস দিয়ে বেন্ঞ্চে বসে তারপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে—–

‘ আপনি বিয়ে করবেন না বলে বাড়ি থেকে পালিয়েছেন। আই থিংক আপনি প্রাপ্তবয়স্ক। আপনরা সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার আছে; এখানে কারোর জোড় জবরদস্তি নেই। আর আমি আপনাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ নই আর না কোনো গুরুদায়িত্ব নিয়েছি। মানুষ নিজের ভালো বোঝে। আপনি হয়তো সব ভেবেই পালিয়েছেন!’

অবাক হয়ে যায় অদ্রিজা, অদ্ভুত গলায় বলে—–

‘ আমার জন্য আসেন নি?’

‘ উহু!’ – সাবলীলভাবে উত্তর দিতেই অদ্রিজা দ্বিধাদ্বন্দিত মুখে তাকিয়ে শুধালো—

‘ তাহলে?’

‘ নিজের কাজে এসেছি!’

‘ আর এসেই আমার জন্য আপনাকে বিপদে পড়তে হলো!’

অদ্রিজা ভীষণ অনুতাপ হচ্ছিল। সাইফান দেখলো তবে সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ তারপর কি মনে করে সাধারণ কণ্ঠে শুধালো—–

‘ পালিয়েছেন কেনো?’

‘ বিয়ে করবো না তাই!’

‘ সমস্যা কোথায়? বিয়ে নাকি সিজান?’

চমকে যায় অদ্রিজা। বলা কি ঠিক হবে? যেখানে এটা স্বয়ং সিজানের মামা। সাইফান উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। অদ্রিজা কুণ্ঠাবোধ করে আঙ্গুলের নখ খুঁটতে খুঁটতে মিনমিন করে বলে—–

‘ সিজান ভাই!’

‘ ভালো ছেলে!’

সাথে সাথে কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে অদ্রিজা বলে—–

‘ সিজান ভাই ভালো না। উনি আমাকে উল্টোপাল্টা প্রস্তাব দিয়েছে। উনার সাথে আমি পাঁচ তলার ভাবীকেও দেখেছি। ভাবীর চালচলণ আমার পছন্দ না আর উনিও। আমি প্রথমে বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পেরেছি। আর সিজান ভাই আরিমা আপুর ভার্সিটির সিনিয়র। তাই আরিমা আপুও আমায় অনেক কিছু বলেছে। যদিও প্রথমে বিশ্বাস হয় নি। কিন্তু সামনাসামনি আজকে দেখার পর আমার ভুল ভেঙ্গে গেছে!’

সাইফান সাধারণ চোখে সব শুনলো। প্রতিক্রিয়া করলো না। সে জানে সিজান উৎসৃঙ্খল তবে এতো কিছু সে জানতো না। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো সাইফান তারপর আবারও রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে সাবলীলভাবে বলে—–

‘ তাহলে রাজি হয়েছেন কেনো?’

ভীত ও ব্যথিত মুখে তাকালো অদ্রিজা। একজনকে এতো কথা বলা ঠিক হবে? সাইফান অদ্রিজার মুখ দেখলো। বাচ্চা মেয়েটার ভালোমন্দ বুঝ এখনো হয় নি ঠিকমতো। মুখ থেকেও একটা বাচ্চা আভা সরে নি; অথচ বিয়ে করবে না বলে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। কিন্তু সে কি এতোটুকু ভাবে নি যে সে এই রাতে পালিয়েছে; আল্লাহ না করুক তার সাথে যদি খারাপ কিছু হয়? মেয়েটার বাচ্চামি এখনো ছাড়েনি অথচ পরিবার থেকে বিয়ের জন্য তাড়া দিয়ে দিচ্ছে।

সাইফানের নিজের বোনের ব্যাপারে ধারণা আছে। সেও কেনো উঠে পড়ে লেগেছে; মূলত সাইফান যখন বিয়ে করেছে তারপর বৈবাহিক জীবনে ঝামেলা হলো তাই ওই কথাটাই সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করলো এবং সবাই কে বিশ্বাস করাতে চাইলো — বউ ছোট হলেই সে জামাইয়ের সব কিছু মেনে সংসার করবে! আর বিয়ের জন্য ছোট বাচ্চা মেয়েই ভালো। এই যুগে এসেও বোনের এমন কান্ড জ্ঞানহীন কাজের উপর তাচ্ছিল্যতা এলো। সাথে সিজানের এসব উৎসৃঙখল কাজ বন্ধ করতে বলির পাঠা বানালো এই বাচ্চা মেয়েকে!

অদ্রিজা মনে মনে আইঢাই করে সাইফানের দিকে তাকালো তারপর নিষ্পাপ কণ্ঠে জড়তা নিয়ে বলে—–

‘ সৎ মায়ের জন্য। ’

মনে মনে খানিক চমকে গেলো সাইফান। তবে প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। চুপ করে বসে রইলো কিছুক্ষণ; এর মধ্যে আজকের স্টেশনের শেষ ট্রেন চলে আসে। তা দেখে চন্ঞ্চলা হরিণীর মতো ছটফটিয়ে উঠে অদ্রিজা। দ্রুত বেন্ঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সাইফানকে তাড়া দিয়ে বলে—–

‘ আমার যেতে হবে। আপনাকে ধন্যবাদ। ’

সাইফান ট্রেনের দিকে তাকালো তারপর অদ্রিজার চন্ঞ্চল মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলে—–

‘ কোথায় যাবেন?’

‘ আরিমা আপুর ফ্রেন্ডের বাসায়। খুলনা!’

‘ তার সাথে কথা বলে নিয়েছেন? এতোটা পথ একা একা যাবেন তাও রাতে। যদি রাস্তায় কোন বিপদে পড়েন।’

থমকায় অদ্রিজা। আসলেই তো কথা বলা হয় নি আপুর বান্ধবীর সাথে। তাই দ্রুত ফোন বের করে নম্বর খুঁজে কল লাগায় সেই নম্বরে। কিন্তু তিন-চার বার কল দেবার পরও সুইচঅফ বলছে। ভীত হয় অদ্রিজা। চোখ মুখ শুঁকিয়ে এলো। ভয় ও হতাশ নিয়ে সাইফানের দিকে তাকিয়ে ব্যথিত গলায় বলে—–

‘ নম্বরটা বন্ধ।’

‘ তাহলে না জেনে এই রিস্কটা নিলে কি হতো বুঝতে পারছেন? ’

সচকিত দৃষ্টি নিয়ে তাকায় অদ্রিজা। আসলেই সে এসব ভাবেনি। যদি সে আগেই ট্রেনে উঠতো তারপর কোনো বিপদে পড়তো। হতাশ হয়ে আবারো বেন্ঞ্চিতে বসে। আরিমাকে এখন কল দেয়া সম্ভব নয়। কারণ আরিমার ফোন অদ্রিজার কাছে। তাই কোন যোগাযোগের পথ খোলা নেই। সাইফান অদ্রিজাকে দেখলো তারপর বলে—–

‘ এবার কোথায় যাবেন?’

‘ জানিনা।’ -ভঙ্গুর সে গলা। কান্না আঁটকানোর বৃথা সে প্রচেষ্টা। পাড়লো না অদ্রিজা। গলা থেকে ছিটকে বেড়িয়ে এলো অভিমানী চোখে জল। সবার উপর অভিমান ভারি হলো। সাইফান দেখলো একটা বাচ্চা মেয়েকে। তবে এই দৃশ্যটা কেনো যেনো অনিন্দ্য ও উপভোগ্য লাগলো সাইফানের। সাইফানের কি হয়েছে সে জানে না। তবে এই বাচ্চা খরগোশ দেখতে মেয়েটার অভিমানী আশ্রু দেখতে ভালো লাগছে। পে-টের দিকে চিনচিন ব্যাথা করছে। এবার আর সহ্য করতে পারলো না তাই ছোট গলায় বলে—–

‘ আমায় একটু হসপিটালে নিয়ে যাবেন?’

—-
চলবে—!