#পরাণ_বধূয়া —০৭
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
[সতর্কতা — কপি নিষিদ্ধ]
অদ্রিজা শান্ত চোখে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে পুরোটা সময় নিরব রইলো। ততক্ষণে সোসাইটির লোকেরা কাজি নিয়ে এসেছে সোসাইটির মসজিদ থেকে। সাইফান শান্ত চোখে পুরোটা সময় রামিশাকে দেখলো। যখন কাজি এসে উপস্থিত হয়েছে তখন একজন জিজ্ঞেস করে——–
‘ তাহলে ডক্টর সাহেব কি ডিসিশন নিয়েছেন? সোসাইটি ছাড়বেন নাকি বিয়ে করবেন?’
সাইফান শুনলো সব কথা। মহিলারা হেও করে অদ্রিজার দিকে তাকাচ্ছে যা অদ্রিজাকে কষ্ট দিয়ে শংকায় কাটা দিয়ে উঠছে তার শরীর৷ এখনে তার কি বলা উচিত অদ্রিজা বুঝতে পারছে না, সাইফান শুধু তাকে সাহায্য করে এখানে আশ্রায় দিয়েছে এছাড়া তাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই৷ সেখানে তার প্রাক্তন স্ত্রী লোকটার চরিত্রে কালি লেপ্টে দিচ্ছে যা অদ্রিজার খারাপ লাগলো সাথে সোসাইটির লোকেরা তো এমনই হয় কিছু পেলেই তারা তামাশা করে সব কিছু ঘেটে দিয়ে কাহিনী টেনে বড় করে।
তবে এতোটা সময় অদ্রিজা এতটুকু বুঝতে পারল সাইফান ভীষণ শান্ত, শক্ত ও চাপা ব্যক্তিত্বের মানুষ। তবে অদ্রিজা কিছু বলার আগে সাইফান রামিশার সামনে এসে দাড়িয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো। তাতেই রামিশা ভরকে গেলো। লোকজন একটু দ্বিধায় পড়লো সাইফানের রহস্যময় হাসিতে। সাইফান দ্বিধাহীন রামিশার মুখের সামনে পড়ে থাকা চুল গুলো কানের পিছনে নিয়ে শান্ত স্বরে বলে—–
‘ তোমার কথা একদম ঠিক রামিশা। আসলেই আমি কেমন তা তুমি খুব ভালো করে জানো৷ এটা এখানের কেউ না জানলেও আমি তা জানি। তোমার শিরায় শিরায় কি চলে তা তোমার চোখে তাকিয়ে বলতে পারি। আফটারঅল উই নো ইচ আদার ফর সেভেন ইয়ারস৷ ’
এতোটুকু কথা শেষ হতেই রামিশা বিচলিত হলো। অদ্রিজা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে সাইফানের পানে। সাইফান আবারো ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো তারপর শান্ত স্বরে আবারো বলে—–
‘ অদ্রিজাকে বিয়ে করাটা বড় ব্যপার নয় রামিশা; কথা হলো আমারও তোমার মতো শর্ত আছে — তোমার কি শর্ত ছিলো তা সবার সামনে না বলি। আমি চাই না তোমায় কেউ খারাপ বলুক। ওই সব ব্যপার গুলো পার্সোনাল থাকুক। কিন্তু এইগুলো না জানলেই নয়; আমি অদ্রিজাকে বিয়ে করবো — তার প্রথম শর্ত তুমি আমার সাথে কোনো সম্পর্ক কিংবা যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতে পারবে না। দ্বিতীয় শর্ত, তুমি আমার থেকে আর কোনো টাকা পাবে না, আর না সানাফের ব্যপারে কোনো হস্তান্তর করবে – কারণ কোর্ট অনুযায়ী সানাফের বয়স তিনবছর হলে ওকে আমাকে দেবার কথা ছিলো আর আজকে সার্টিফিকেট অনুযায়ী সানাফের তৃতীয় জন্মদিন। আর তৃতীয় ও শেষ শর্ত – আমার বিয়ের পর তুমি আমার, সানাফ এবং অদ্রিজার জীবনে হস্তান্তর করতে পারবে না; আর না নিজের এই মুখ নিয়ে আমার আশেপাশে আসবে। আমি বিয়ে কবুল বলার সাথে সাথে তুমি আর আমার জীবন এবং বাসার আশেপাশে থাকতে পারবে না; আর না আমার কর্মস্থলে এবং অণ্যকোনো জায়গায় মোট কথা তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না; বিয়ের সাথে তোমার সাথে আমার সব এখানেই ছিন্ন। ’
শক্ত গলায় সাইফানের প্রতিটি উচ্চারিত কথা যেন রামিশার কাছে বিষ বানের মতো ছিলো। সে তো ভেবেছিলো তামাশা করবে তবে সাইফান যে আগে থেকেই পাকা খেলোয়াড়ের মতো দান দেবে তা কখনোই রামিশা ভাবে নি৷ এসব না মেনে নিলো যাচ্ছে তাই অবস্থা হবে এখানে তার। সোসাইটির লোকেরা সাইফানের কথায় আস্বস্ত হয়ে রামিশার দিকে তাকিয়ে আছে তার জবাবের আশায়। রামিশা এদিক সেদিক তাকায়। সে নিজেই সাইফানকে গেঁড়াকলে ফেলতে চেয়ে নিজেই ঝামেলায় পড়ে গেলো। তবুও হার মানলে চলবে না। তাই রামিশাও জেদ ধরে বলে—–
‘ আমি রাাজি কিন্তু সানাফ—’
কথা সম্পূর্ণ করতে দিলো না সাইফান। গম্ভীর কণ্ঠে বলে—
‘ আমার ছেলের নাম উচ্চারণ করবে না। তুমি ওর মা হবার যোগ্যতা অনেক আগেই হারিয়েছো। ওকে তোমার প্রয়োজনে মনে পড়তো, এমনি নয়। তাই তোমার জন্য এটাই ভালো হবে- তুমি ভুলে যাও ও তোমার ছেলে; তুমি ওর কেউ নও। একটু পরে ওর নতুন মা হবে। আশা রাখবো সানাফকে আর তোমার দরকার পড়বে না আর দয়া করে সানাফকে নিয়ে কোনো সিনক্রিয়েট করো না।’
কথা থেমে যায় রামিশার ঢোক গিললো সে। কোনো গুটি কাজ করছে না। রামিশা হতাশ মুখে যখন পরের চাল খুঁজতে ব্যস্ত তখন সাইফান সবার উদ্দেশ্য বলে—–
‘ আমি বিয়ে তে রাজি তবে আমার অদ্রিজার সাথে পার্সোনাল কিছু কথা আছে৷ আশা করি আমাদের একটু স্পেস দেবেন। এক্সকিউজ আস… ’
কথাটা বলে অদ্রিজার রুমের দিকে চলে যায় সাইফান। অদ্রিজাও সাইফান কথা শুনে ধীরে পায়ে ওর পিছনে চলে যায়। সাইফানে নিঃশব্দে এসে বিছানায় বসে। অদ্রিজা এসে পাশে দাঁড়াতেই সাইফান মুখ তুলে তাকায়। অতিরিক্ত রাগে সাইফানের চোখ মুখ রক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে। সাইফান স্থীর দৃষ্টি নিয়ে অদ্রিজার পানে চেয়ে রইলো কিছুসময় তারপর শান্ত গলায় বলে—–
‘ বিয়ে করবেন আমায়?’
থমকায়, চমকায়, বাকরুদ্ধ হয় অদ্রিজা। ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চায় তবে সে পারছে না। এভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেয় কে? পুরোটা পরিস্থিতি নিজের চোখেই দেখেছে অদ্রিজা। তবে বিয়ের প্রস্তাব এতো ক্যাজুয়াল দেখে হতবাক হয়ে কথা খুঁজে পায় না অদ্রিজা। সাইফান অদ্রিজার মুখ পরক্ষ করে বলে——
‘ আমার জন্য নয়; এই মানুষগুলোর কথা, রামিশা আপনাকে অপমান করেছে তার জবাব আর শেষে আমার ছেলেটার জন্য যদি আপনাকে চাই! আপনি কি অনুমতি দেবেন?’
আবারো বোকা হয়ে যায় অদ্রিজা। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে ঢোক গিললো তারপর বলে—–
‘ কিন্তু…’
‘ আপনার বয়স নিয়ে সমস্যা?’
মাথা নাড়িয়ে বলে—–
‘ উহু, আমার আঠারো চলছে, দুমাস বাদে উনিশ হবে… কিন্তু এসব কি আদোও ঠিক হবে?’
‘ রামিশার ব্যপারে আমি আপনাকে পরে কোন এক সময় বলবো। কিন্তু আপতত সোসাইটির লোকদের মুখ বন্ধ করতে হবে। আমি চাইনা রামিশার এসব কুরুচিপূর্ণ আচরণের কারণে আমাদের চরিত্রে কালি লাগুক কিংবা লোকেরা উল্টো পাল্টা ভাবুক। আপনি এমনিতেও এখানে থাকবেন। যদি এখান থেকে চলে যান লোকেরা রামিশা যা বলেছে তাই মেনে নেবে। আর একটা ভয়ংকর পরিবেশ ও পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আর আপনি এই রাাতে যাবেনই বা কোথায়? তার থেকে বরং আমার জন্য নয়, এটলিস্ট আমাদের নিয়ে যে কথা উঠেছে তা বন্ধ করতে এবং আমার ছেলের জন্য রাজি হয়ে যান!’
শান্ত চোখে প্রতিটা কথা অদ্রিজা শুনলো। তারপর সাইফানের দিকে স্থীর দৃষ্টি নিয়ে কি কি ভাবলো। সময় গড়ালো। তারপর অদ্রিজা নিজের কোলে তাকালো। সানাফ আবারো ঘুমিয়ে গেছে তার বুকে লেপ্টে। ছেলেটার জন্য মায়া হলো। সানাফের লাল গাল, ঠোট, চোখের পাতা, নাক, ঠোঁটের নিচে সাইফানের মতো থুতনিতে একটা কালো তিল। গাঢ় দৃষ্টি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে স্থীর দৃষ্টি নিয়ে সানাফের মুখের পানে চোখ রেখেই মিনমিন করে বলে——
‘ আমি রাজি। কিন্তু —!’
সাইফান স্বস্তি পেলেও কিন্তু শুনে থমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে—–
‘ কিন্তু? ’
‘ আপনার বোন, বোনের ছেলে – ওই পরিবার?’
সাইফান উঠে দাঁড়ালো তারপর অদ্রিজার সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়ে অদ্রিজার ভীত ও চিন্তিত মুখটা দেখলো। অদ্রিজা তাকিয়ে আছে। তাই সাইফান আঁচল তুলে অদ্রিজার মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে—–
‘ আমার ছেলের প্রক্টর হন এখন, আপনাদের পুরো দুনিয়া থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার।’
কথাটা বলে সাইফান চলে যায়। অদ্রিজা তাকিয়ে দেখলো। ছেলে কোলে থাকার কারণে সাাইফান নিজেই ঘোমটা তুলে দিয়েছে। ব্যপারটা ভালো লেগেছে অদ্রিজার। সাথে সেও বিরবির করে বলে—–
‘ শুধু ছেলে নয়; সামলাতে হলে ছেলে আর তার বাবা দুজনকেই করবো। সে তার দিক থেকে আমাদের রক্ষা করলে আমারও দায়িত্ব আমার দিক থেকে তাদের সামলানো।’
——
‘ আলহামদুলিল্লাহ ’ পড়ে বলে বিয়ে কবুল করলো সবাই। তবে মহিলা গুলো এখনো অদ্রিজার পানে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে আর গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছে। প্রথমবার অদ্রিজার খারাপ লাগলেও সাইফানের অর্ধাঙ্গি হবার পর আর তেমন কিছু লাগছে না। রামিশা ঝামেলা করতে এসে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে৷ এখন বিচলিত ও নাটকীয় ভঙ্গিতে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় সাইফানকে উদ্দেশ্য করে বলে—–
‘ তুমি তো বিয়ে করে নিলে সাইফান। আমি তাহলে আসছি। বউ, বাচ্চা নিয়ে ভালো থাকবে।’
কথাটা বলেই রামিশা দরজার দিকে পা বাড়াতেই অদ্রিজা উচ্চ স্বরে গম্ভীর গলায় বলে—–
‘ একটু দাঁড়ান। ’
সাইফান চমকায় তারপর অদ্রিজার পানে তাকায়৷ অদ্রিজা স্বাভাবিক মুখাভঙ্গি নিয়ে সানাফকে নিজের কোল থেকে সাইফানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে—–
‘ ওকে একটু নেবেন।’
সাইফান সানাফকে কোলে তুলে নেয়। তবে অদ্রিজা কি করতে চাইছে তার বোধগম্য হলো না। অদ্রিজা সানাফকে সাইফানের কোলে তুলে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সবার দিকে একবার তাকায়। তারপর বিড়াল পায়ে এগিয়ে এসে রামিশার সামনে দাঁড়ায়। রমিশার মুখের দিকে তাকিয়ে আবারো ঘাড় ঘুরিয়ে সাইফানের দিকে তাকায়। সাইফান উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অদ্রিজা শান্ত গলায় সাইফানকে প্রশ্ন জিজ্ঞাস করে—–
‘ এখন আমরা বিবাহিত?’
সাইফান ঢোক গিললে বলে—–
‘ জ্বি!’
‘ আমি আপনার বউ?’
‘ জ্বি!’
‘ প্রাক্তন স্ত্রী থেকে বর্তমান স্ত্রীর আপনার ওপর হক বেশি তাই না?’
বিব্রত ঠেকল এই প্রশ্ন, তবুও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রদান করে সাইফান। রামিশা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে৷ অদ্রিজা এবার মাথা ঘুরিয়ে রামিশার দিকে তাকিয়ে তার সারা মুখে দৃষ্টি বুলিয়ে অপেক্ষা না করে সশব্দে চড় দিয়ে বসে রামিশার গালে৷ সবাই হতবাক হয়ে যায়। রামিশা গালে হাত দিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকাতেই অদ্রিজা শক্ত গলায় বলে—–
‘ মাঝ রাতে ভদ্রলোকের বাসায় এমন ভাবে আসার জন্য এবং চেঁচামেচি করে সিনক্রিয়েট করার জন্য এই চড় টা।’
কথাটা শেষ হতেই আরো একটা চড় দিয়ে বলে—–
‘ এসে তামাশা করে আমার এবং আমার স্বামীকে জড়িয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলার জন্য। ’
তারপর আরো একটা ঠাটিয়ে চড় মেরে বলে——
‘ এই চড় টা হলো যতবার আমার পরিবারের কথা মনে পড়বে ততবার এই চড়’টার কথা মনে পড়বে। নেক্সট টাইম যেন আমি আপনাকে আমার বাসার আশেপাশে এবং আমার স্বামীর আশেপাশে না দেখি। তাহলে এবারের মতো ভুলে যাবো আপনি আমার বড় এবং আমার স্বামীর প্রাক্তন স্ত্রী ছিলেন। এখন আপনি আসতে পারেন!
——
চলবে—!