পরাণ বধূয়া পর্ব-০৯

0
86

#পরাণ_বধূয়া —০৯
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
[সতর্কতা — কপি নিষিদ্ধ]

শান্ত চোখে তাকালো সাইফন। অদ্রিজা কথা বলতে বলতে চোখ তুলে সাইফানের দিকে তালো তরপর নিষ্পাপ হাসলো। বড় অদ্ভুত লাগলো সেই হাসি। সাইফান এখনো নির্বিকার। অদ্রিজা লম্বা শ্বাস টানলো তারপর বলতে শুরু করে।

‘ যখন থেকে বুঝতে শিখলাম। আব্বাকে আমাদের বাসায় খুব একটা পেতাম না। আসতো চলে যেতো। এই আসতো, চলে যেতো। আমাদের বাসায় খুব একটা থাকতেন না তিনি। আমি তখন জিজ্ঞেস করার মতো কিছুই খুঁজে পাই নি। আম্মাকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতাম —‘

‘ আব্বা কেনো আমাদের সাথে থাকে না?’

প্রতিবার আম্মা হাসি মুখে প্রশ্ন উড়িয়ে দিতো। তা তো বুঝতাম না। তবে এতোটুকু বুঝতাম আব্বা আমাদের সাথে থাকবেন না। তারপর সময় গড়ালো। স্কুলে ভর্তি করালো আম্মা – স্কুলে যেতাম। বাচ্চাদের বাবা মা তাদের আনতে যেতো। আমি দেখতাম। মন খারাপ করে মা কে জিজ্ঞেস করতাম —

‘ আব্বা কেনো আমায় নিতে আসে না?’

আম্মা তখনও হাসতেন। ওই হাসির পেছনে একটা লুকায়িত যন্ত্রণা ছিলো। তখন না বুঝলেও পরে বুঝেছি! আবারো সময় গড়ালো। আব্বা আসতো, আমিও বায়না ধরতাম আব্বা আজকে থেকে যান। আজকে আমরা বাহিরে ঘুরতে যাবো। আরো কত কত বায়না। কখনোই তা পুরণ হতো না। ’

অদ্রিজা থামলো। তারপর কেমন অদ্ভুত ভাবে যেনো হাসলো। চোখের কোণ বেয়ে জল নামার আগে তা খুব সন্তর্পণে মুছে ফেললো অদ্রিজা। সাইফান দেখলো; তারপর ঢোক গিলে ঘুমন্ত ছেলের দিকে তাকালো। একজন বাবা হয়ে এসব করা যায়? সে তো পারে নি? অবশ্য বলে লাভ কি! হুট করেই অদ্রিজার ছোটবেলার কথা শুনে রামিশার কথা মনে উঠলো। মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসলো। জন্ম দিলে কি আর বাবা মা হওয়া যায়? সাইফানের ভিতরকার এক সত্তা চেঁচিয়ে বলে— ‘ নাহ্ হওয়া যায় না।’

আবারো অদ্রিজার কথায় মন দেয় সাইফান। অদ্রিজা ঢোক গিলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো বলতে শুরু করে।

‘ আমার যখন বয়স এগারো মনে হয়। তখন বুঝতে পারলাম আমরা আব্বার একমাত্র পরিবার না। তার আরো একটা পারিবার আছে। বড় মা আর আরিমা আপু ছিলো সেই পরিবারে। আম্মা আব্বার ব্যাপার গুলো বুঝতো তবে সে জানতো না; সে আব্বার দ্বিতীয় পক্ষ ছিলো। রাতে আব্বার সাথে আম্মার তুমুল ঝগড়া হয়। তারপর আব্বা চলে যায়। সকালে সব দিনের মতো ঘুম থেকে উঠলাম তবে পাশে আম্মাকে না পেয়ে একটু অবাক হয়েছিলাম। যদিও আম্মা সকালে রান্না করতে সকাল সকাল উঠতো। কিন্তু ঘরের মাঝে তেমন কোনো আচ পাই নি। তাই কেমন মন উলোটপালোট হয়ে উঠলো। আমাদের রুমের বারান্দা, ওয়াশরুম দেখালাম। মাকে পাই নি। তাই আমাদের রুম থেকে বের কিচেন আর বাকি সব চেক করে পাশের রুমে গেলাম – দরজাটা হালকা চাপানো ছিলো। ওই রুমটা সব সময় বন্ধ থাকতো তাই নিজের মনের সন্দেহ প্রধান্য দিয়ে রুমের দরজা ঠেলে খুলতেই আমার চোখো যা ভেসে উঠলো৷ তা আমার জীবন উলোটপালোট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো।’

থম মারলো অদ্রিজা। সাইফান আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ততক্ষণে ব্যন্ডেজ শেষ। এতোদিন একটা জ্বলনী ভাব থাকলেও। আজকে কথার মাঝে ড্রেসিং করার সময় তা একটুও অনুভব হয় নি সাইফানের। সে জানে এটা কেনো হয়েছে। তাই প্রতিক্রিয়াবিহীন রইলো। অদ্রিজার চোখে জল জমা হয়েছে। তা মুছে নিয়ে আবারো তাচ্ছিল্য হাসলো। তারপর শান্ত স্বরে বলে—-

‘ আম্মা সু-ইসা-ইড করেছে। আমি অবুঝ ছিলাম না। বুঝতে অসুবিধা হলো না। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো আমি কান্না করিনি। একটুও কান্না করিনি। কিন্তু আব্বা আর আম্মার ওপর চাপা অভিমান হলো। আমি ভাবলাম আব্বাকে কল দেবো। কিন্তু অনেক সকাল হবার কারণে আমি কল দেই নি। ঘরে রাতের যা ছিলো তা খেলাম। পুতুল খেললাম। তারপর ভাবলাম একটু স্কুলে যাবো তারপর আবার যাই নি! আমি খুব নির্দয় তাই না? হয়তো। আমার কষ্ট লাগে নি। অদ্ভুত রাগ উঠেছিলো। কেমন রাগ জানেন? খু-ন করার মতো রাগ! আজকে যখন ওই সোসাইটির লোকেরা আসলো উল্টোপাল্টা কথা বললো। আমার মন খারাপ হয় নি। আমার রাগ লেগেছিলো ওই খু-ন করার মতো রাগ! কিন্তু প্রকাশ না করার কারণে কেঁদেছিলাম। আমার রাগ উঠলে কান্না আসে। আটকাতে পারি না।’

এতোটুকু বলে শ্বাস ফেললো অদ্রিজা। সাইফান স্থীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এতো সাবলীল ভাবে কখনো কাউকে এসব বলতে দেখেনি সাইফান। ভীষণ অবাক হলো। সাথে বুঝতে পারলো — অদ্রিজাও তার মতো শান্ত চরিত্রের এক নারী তবে চুপচাপ থাকে কিন্তু রেগে গেলে মানুষও খু-ন করতে পারবে!

কিন্তু এবার কেনো যেনো অবাক হলো না সাইফান। অবাক হতে চেয়েও পারলো না। শ্বাস ফেললো তারপর আবারো অদ্রিজার দিকে তাকাল। অদ্রিজা একটু সরে বসলো। কারণ ব্যান্ডেজ করা শেষ৷ তাই এতো কাছে আপতত লোকটার অনুমতি বিহীন না আসাটাই ভালো।

অদ্রিজা শ্বাস ফেলে আবারো বলতে শুরু করে —-

‘ সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে আব্বাকে কল দিলাম। আব্বা বললো ব্যস্ত আছে সে পরে কল দেবে। আমিও আব্বার কলের অপেক্ষা করলাম। আব্বার কল এলো দুপুর দুটোর পরে। আব্বাকে জানালাম আম্মা সু-ইসা-ইড করেছে। আব্বা তারপর জানালো সে আসছে! তার আসতে আসতে সাড়ে চারটার বেশি। সাথে পুলিশ এলো। আম্মাকে পুলিশ নিয়ে গেলেন। পোস্টমর্টেম হলো। আম্মা রাতের দ্বিতীয় প্রহরে অর্থাৎ আমি ঘুমিয়ে যাবার পরই গলায় দ-ড়ি দিয়েছিলেন। যার কারণে শেষ সময়ে তার শরীর পচতে শুরু করে। আব্বা টাকা দিয়ে আম্মার শরীর কোনো মতে নিজের কাছে এনে একটা এতিমখানা সহ কবরস্থান দেখে আম্মাকে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করলো। সাথে আমার জায়গা হলো ওই কবরস্থানের পাশের এতিমখানায়। বড় হলাম ওখানে। শান্ত – নির্জব – নিষ্প্রাণ। কাটলো দিন; তারপর যখন আঠারো হল — এতিমখানার নিয়ম অনুযায়ী ওখান থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। আব্বাকে কল দিয়ে জানালাম৷ তখন আব্বা যেয়ে ওই এতিমখানা থেকে নিয়ে এলো আরিমা আপুদের বাসা। ওইখানে দশ মাস থাকলাম। আরিমা আপুর মা ঝামেলা করেছে অনেক। তবে এতিমখানায় যেই ঝামেলায় দিনের পর দিন কাটিয়েছি তার থেকে কম লেগেছে। এসব, কিন্তু যখন বিয়ের জন্য সিজান কে বলল, আমি আগে থেকে অনেক কিছুই নজরে রাখতাম। শুধু কখনো কাউকে বলা হয় নি। দেখা করতে যেয়ে ভাবলাম ওখান থেকে পালাবো৷ কিন্তু মাঝে আপনি আসায় সব ভন্ডুল হলো। বাসায় ফিরে আপুকে সব বললাম; আপু পালাতে সাহায্য করল তারপর? তারপর উনার ফ্রেন্ডের বাসায় যাওয়ার কথা থাকলেও ভালো ভাগ্য বলেন আর দুর্ভাগ্য বলেন — আপনার সাথে দেখা হলো। আর আমার জন্য আপনাকে সমস্যা পোহাতে হয়েছে তা ভেবে ভয় পেয়েছিলাম। তারপর? তারপর সব আপনার সামনেই! এই তো — এই আমার ছোট জীবনের লম্বা যাত্রা! ’

কথাটা বলে লম্বা শ্বাস ফেলে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। তারপর ঢোক গিলে সানাফের দিকে তাকালো। শরীরে হাত বুলালো সানাফের। তারপর আবারো শান্ত স্বরে বলে—-

‘ বুঝ হবার পর থেকে আম্মার এমন ভাঙ্গাজোড়া সংসার দেখে মনে মনে পণ করেছিলাম। আর যাইহোক — যাকে বিয়ে করবো তার ব্যপারে সব যেনে বিয়ে করবো। আর যাইহোক তার দ্বি-তীয়… দ্বিতীয়পক্ষ হতে পারবো না। তবে ভাগ্য দেখুন! তাই হলো। আপনার হয়তো আব্বা কোথায় জানার ইচ্ছে আছে? সে নেই! মানে আছে – আমি তার সাথে কথা বলি না। ব্যবসার জন্য বেশির ভাগ সময় বাসার বাহিরেই থাকতো। এখনোও থাকে। তাই তার সাথে আমার যোগাযোগ নেই।’

খিকখিক করে তাচ্ছিল্য হাসলো অদ্রিজা। তারপর বলে—–

‘ এখন আমায় অনেক অদ্ভুত লাগছে তাই না? এই যে প্রথম দিন একটা মানুষকে কেমন দেখলাম আর তাকে নববধূ রূপে এতো নিকৃষ্ট মানুষ হিসেবে তার অতীত শুনছেন? আমার আপতত এমন কিছুই মনে হচ্ছে না। আমার বিয়ে হয়েছে। আমি আপনাকে মেনে নিয়েছি৷ আপনি যদি স্বামী স্ত্রী রূপে সম্পর্ক ঠিকঠাক করতে চান আমি তাতেও রাজি। তবে শর্ত আছে — যদি আমার হন! তাহলে আমারই হতে হবে! পিছনে ফেরা যাবে না। যা চলে গেছে তা চলে গেছে! যদি আপনি পিছনে ফিরে চান তবে আমি আপনাকে কি করবো আমি নিজেও জানি না। এখন আপনি হয়তো অবাক হচ্ছেন যে আমি কেনো শর্ত দিচ্ছে? আমি আমার মায়ের ভাগ্য পেতে চাই না৷ আমি আপনাকে, আমার ছেলে… সানাফ তো আমার ছেলেই এখন। সবাই কে সামলে নিতে পারবো। সানাফ কে নিয়ে ভাববেন না। যে তার ছোট বেলায় বাবা – মায়ের ওসব দেখে বড় হয়েছে। সে এটলিস্ট তার বাচ্চাদের ওইসব ফেইজ করতে দেবে না। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। কিন্তু — কি-ন্তু আপনাকে ঠিক থাকতে হবে। আপনাকে শক্ত থাকতে হবে। রামিশার সাথে আপনার কি হয়েছে; আমি জানি না। আমি সব শুনবো। কিন্তু আমি চাইবো যদি আমায় মেনে নেন তাহলে বাকিদের পিছুটান ছেড়ে আমায় আর আমার ছেলেকে আপন করতে হবে। আর না হলে বলে দেবেন; চলে যাবো! কোথায় যাবো খুঁজবেন না। সমস্যা নেই আমি বিয়ে করবো না। দাবি নিয়ে আসবো না আর না কোনো ঝামেলা করবো; কিন্তু মনে রাখবো একদিনের জন্য আমার বিয়ে হয়েছিলো, আমার একটা ডক্টর স্বামী ছিলো। আর তিন বছরের আদুরে আর তুলতুলে ছানা — না মানে ছেলে ছিলো।’

——
চলবে—!