পরাণ বধূয়া পর্ব-১০

0
330

#পরাণ_বধূয়া —১০
#প্রানেশা_আহসান_শীতল
[সতর্কতা — কপি নিষিদ্ধ]

অদ্রিজা নিজের কথা বলে থামলো। সাইফান এতোটা সময় চুপ করে অদ্রিজার সব কথা শুনলো। তবে জবাবে কি বলা উচিত সে জানে না। তার অদ্রিজাকে সিমপ্যাথি দেখাতে ইচ্ছে করছে না তবে এতোটা সময়ে একটু জিনিস সে ঠিক ধরছে। তা হলো অদ্রিজাকে ডক্টর বলতে ভালো সাইক্রোয়াটিস্ট দেখাতে হবে। অদ্রিজা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সানাফের শরীরে এখনো হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। এই বার সাইফানের মনে হলো তার দিক থেকেও সব বলা উচিত। তাই মৃদুশব্দ করে গলা পরিষ্কার করে সাইফান। তারপর লম্বা শ্বাস টানে। সাইফানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ভঙ্গি বুঝতে পেরে অদ্রিজা প্রশ্নবিদ্ধ মুখে তাকালো। সাইফান সানাফের দিকে তাকিয়ে বলে—–

‘ রামিশা আর আমি ব্যাচমেট ও বন্ধু ছিলাম। তাই আমাদের বাসায় ওর অবাধে আশা যাওয়া চলতো। ছোট থেকেই ওর মা ছিলো না। বাবা আর ওর ছোট সংসার। তাই আমার মা ওকে ভীষণ আদর করতো। আর আমার ওর সাথে চলাফেরার এতো সময় পার হবার পর কখন যে ওকে ভালো লাগলো বুঝতেই পারলাম না। যদিও কখনো কাউকেই এসব বলা হয় নি। মেডিক্যাল থার্ড ইয়ারে উঠার পর ওর বাবা ওকে বিয়ের জন্য জোর করলে ও স্বীকারোক্তি দেয় ও আমাকে ভালোবাসে এবং ও নিজেই আমায় প্রপোজ করলো। আমার ছোট বোন সাবরিনার সাথে এসব কিছু শেয়ার করলে, সাবরিনা বললো, বাসায় রামিশাকে সবাই পছন্দ করে শুধু বড় আপা ছাড়া। তাই ওর মনে হয় না কোনো ঝামেলা হবে। তাই আমিও সব কিছু ভেবে পাঁচ মাস পর রাজি হই। যদিও আমি আগে থেকেই ওকে পছন্দ করতাম তা কেউ কখনো বুঝতে দেই নি। এই পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিলো। আমি ফাইনাল ইয়ারের উঠতেই মা কিভাবে যেনো টের পেয়ে গেলো এসব কথা৷ তারপর বাবাকে বলতেই বাবা রামিশার বাবার সাথে কথা বললেন। ওদের ছোট ঝুট-ঝামেলা-হীন সংসার আর আমাদের দিক থেকে আমাদের পরিবার বেশ নাম ডাক ছিলো। তাই বিয়ের প্রস্তাব রামিশার বাবা ফেলতে পারেন নি। আমাদের ঘরোয়া ভাবে বিয়ের ব্যবস্থা করে। তারপর আমাদের ছোট সংসার। আমাদের পড়ালেখা কমপ্লিট করে — রামিশা গাইনি ডক্টর। আর আমি নিউরোসার্জন। তারপরের দিন ভালো ছিলো। হুট করে একদিন জানতে পারি আমার এক কলিগের সাথে ওর পরকীয়ার আলাপ চলছে সাথে শারীরিক সম্পর্কও বিদ্যমান ছিলো। আর এই জিনিসটা ঘটে আমার অবর্তমানে। আমি চার মাসের জন্য এমার্জেন্সি অপারেশন ও হসপিটালের থেকে আমাকে বাছাই করে দেশের বাহিরে পাঠিয়েছিলো তখন। ওই চার মাশে রামিশা আমার হসপিটালের এক কলিগের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়। পরে দেশে ফিরলে এসব নিয়ে আমাদের ঝামেলা হয়। ও রাগ করে ওর বাবার বাড়ি চলে যায়। আমিও রাগ করে আর ওকে ফিরিয়ে আনতে যাই নি৷ ওখানে ছ’মাস ছিলো৷ তারপর হসপিটালের কোনো এক সিজার ও ভুল চিকিৎসার কারণে বাচ্চা ও মা মারা যাওয়াতে রামিশার লাইসেন্স বাতিল করা হয়। এইসব ট্রমা নিতে না পেরে রামিশা ড্রাগ এডিকটেড হয়। সাথে সুইসাইড এট্যাম্পড করে। ওর বাবা মেয়ের এতো সব ডাউনফল দেখতে না পেরে স্ট্রোক করে। আমার হাতেই তার চিকিৎসা হলো। তার মেয়ের হয়ে সে মাফ চাইলো। লজ্জিত হলো সব কিছু যেনে। যত-যাই হোক আমি তো রামিশাকে ভালোবাসতাম। তাই ওই মৃতসজ্জা লোকটার কথা ফেলতে পারিনি৷ মাফ করে মেনে নেই। তবে রামিশার ক্লাব, পার্টি, নেশাদ্রব্য, ড্রাগ এসব কমাতে পারলাম না৷ তাই ওর বাবার সাথে আলোচনা করে রিহেব সেন্টারে পাঠালাম। ওখানে থাকার দুমাসের মাথায় ওর বাবা মারা যায়। আবারো শান্ত হয়ে উঠে রামিশা৷ তাই রিহেব সেন্টারে মোট তিন মাস রেখে বাসায় আনলাম। তারপর সব স্বাভাবিক। আমিও ভাবলাম এখন সব স্বাভাবিক। সানাফের আগমনটা তার কিছুদিন বাদেই। যদিও ও আমাদের কাছে একদম অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো। তবে আমি ভীষণ খুশি হলেও রামিশা খুশি ছিলো না। উল্লেখ সে স্বাস্থ্যসচেত ও বিউটিফ্রিক ছিলো। তবে বাসার সবার এতো উৎসাহ দেখে কিছু বলতে পারে নি। আর আমি যেহেতু নিজেও ডক্টর তাই ভয়েও কোনো ঔষধ খেতে সাহস করে নি। কেনো করেনি তা পরে বুঝতে পারি। এসব কিছু যখন শান্ত তখন যখন ওর প্রেগন্যান্সির পাঁচ মাস চলে তখন ও সিজানের সাথে!’

কথার এই পর্যায়ে এসে নাকমুখ কোঁচকায় সাইফান। অদ্রিজা নিশ্চুপ। সাইফান আবারো বলতে শুরু করে——–

‘ তখন আমি প্রতিক্রিয়া করিনি, বাচ্চার কথা ভেবে চুপ ছিলাম। গায়ে হাত তোলা আমার ধাতে নেই। আর না আমি কাপুরুষের মতো গায়ে হাত দেবো। কথা বলা আমাদের আগে থেকেই কম ছিলো। কিন্তু তারপর থেকে আমাদের কথা বলা একদমই বন্ধ। ছ’মাসের মাথায় টের পেলাম ও আবারো সেই ডক্টরের সাথে কথা বলতে শুরু করে। এসব নিয়ে আমাদের মাঝে আবারো ঝামেলা হয়। এবারের ঝামেলায় এক পর্যায়ে জানতে পারি রামিশা আমাকে কখনো ভালোই বাসেনি। শুধু স্বার্থের ও টাকার কারণে আমার সাথে থেকেছে। রামিশারা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ তাই সে আমায় শুধু আমাদের সম্পত্তির লোভে বিয়ে করেছে। তবে সে যখন বুঝে গেছে আমি তেমন ছেলে নই তখন ও পরকীয়া আশক্ত হয়। ব্যাপার গুলো এতোটাই গুরুতর হলো শেষে আমার শেষ সিদ্ধান্ত গিয়ে ঠকল আমাদের ডিভোর্স হবে। আমিও রাজি হয়ে যাই। তবে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ডিভোর্স কার্যকরী হয় না৷ তাই সানাফের জন্মের অপেক্ষায় রইলাম। তারপর যখন সানাফ হলো তখন পাকাপোক্ত ভাবে আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে তবে কোর্ট থেকে অর্ডার অনুসারে সানাফের কাস্টাডি পায় রামিশা। কারণ সানাফ দুধের বাচ্চা, কিন্তু সানাফের সার্টিফিকেট অনুযায়ী যখন তিনবছর হবে তখন সানাফকে আমার কাছে হস্তান্তর করা হবে। তাই আমিও এর উপরে যেয়ে কথা বলতে পারি নি। তবে আমি প্রায় প্রায় সানাফকে দেখতে যেতাম। রামিশা সব সময় নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলো। ছেলেকে দেখার মতো সময় তার ছিলোই না। বাসায় কাজের বুয়া ঠিক করে দিলাম রামিশার। তবুও সেই একই অবস্থা। তবে ততদিনে রামিশাও টের পায় আমি সানাফের উপর ভীষণ দুর্বল। এতো এতো দুর্বলতা দেখে রামিশা নতুন গুটির চাল দিলো তা হলো শর্ত — সানাফকে আমি চাইলে নিতে পারবো তবে রামিশা যখন টাকা চাইবে। যত চাইবে তখনই দিতে হবে আর ততই দিতে হবে। ছেলের প্রতি এতোই আচ্ছন্ন যে আমি আগে পরে কিছু ভাবি নি। আমার ছেলে চাই যাকে বুকে ঝাপ্টে ধরে থাকতে পারবো। এই ভাবেই দিন গেছে। রামিশা যখন চেয়েছে টাকা দিয়েছি একমাত্র সানাফের কারণে নাহলে এমন কিছু করতাম না। এখন আর সে আমার থেকে কোনো টাকা পাবে না। কারণ সানাফ এখন তিন বছরে পড়েছে। ঝামেলা করলে কেস করে দেবো। আর না তার সাথে আর যোগাযোগ থাকবে। সব ছিন্ন করেছি। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। তবে এতো এতো ঝামেলার সাথে আমি নিজেও বাবার বাসা ছেড়েছি। এখন আর আমি বাবার বাসায় যাই না। ওই বাসাতে বাবা আর মা-ই থাকেন। সানাফকে আনার পর থেকে সাবরিনা আমার সাথে এখানে থাকতো তার আগে পর্যন্ত সাবরিনাও বাবার বাসায় থাকতো। এভাবেই তিনবছর দেখলাম। মাঝে রামিশার হুটহাট টর্চার, সাবরিনের হুট করে বিয়ে তাই আমার সব সামলে উঠতে সময় লেগেছে তার মাঝেই আপনার সাথে দেখা হলো। তবে ভাগ্য বলতে হবে। আমার বউ নিয়ে সিজান যা করেছে তাই বলতে পারেন ভাগ্য আমাকে সিজানের হবু বউকেই নিজের স্ত্রীর বানানোর তৌফিক দিয়ে দিলো। আশ্চর্য রকম কথা হলো — সিজানের উপর আমার চাপা একটা রাগ ছিলো। আপনাকে বিয়ে করার পর থেকে, আপনাকে দেখলেই মনে হয় সিজানকে এটলিস্ট এবার দমাতে পেরেছি। যাই-হোক, আপনি শক্ত থাকবেন; তাহলেই হবে। বাকিটা আমি সালে নেবো। কে কি বললো না বললো তা কানে দেবার দরকার নেই। এখন আমার কাছে আসুন তো।’

বোকার মতো সব কথা শুনে অদ্রিজা বোকা গলায় জিজ্ঞেস করে——–

‘ হু কি?’

‘ কাছে আসুন।’

অদ্রিজা সামনে এগিয়ে আসে। তাই সাইফান শরীর ছেড়ে উঠতে চাইলো সাথে সফল হয়ে উঠে বসলো। তারপর অদ্রিজার ছোট হাত টা নিজের মাঝে পুরে নিয়ে থম নেরে বসে থেকে ঘরিতে সময় দেখে। ঘরিতে সময় রাত তিনটা সাতচল্লিশ। তারপর সেখান থেকে চোখ সরিয়ে অদ্রিজার উদ্দেশ্য বলে—–

‘ আপনার দিকটা আমি শুনেছি। আমার দিকটাও শুনেছেন। তাই আমরা দুজনই ক্লিয়ার। আমার দিক থেকেআমার কোনো সমস্যা কিংবা দ্বিমত নেই। আজ থেকে এই ঘরে আপনি নির্দ্বিধায় থাকতে পারবেন মিসেস ইয়াজিদ। আর ছেলেকে দেখে রাখার দায়িত্বও আপনার তবে একশর্তে—!’

অদ্রিজা অবাক গলায় জিজ্ঞেস করে——

‘ কিসের শর্ত?’

‘ আগে আমার উত্তর দিন। আমায় নিয়ে কোনো সমস্যা আছে?’

শীতল চোখে তাকায় অদ্রিজা। তারপর শান্ত গলায় বলে—–

‘ আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। লোক হিসেবে চমৎকার তবে আমার ওই রামিশার জন্য আফসোস লাগছে আবার কষে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে!’

অদ্রিজার এমন কথায় কপাল কুঁচকায় সাইফান তারপর সন্দিগ্ধ গলায় বলে—*

‘ কেনো?’

‘ উনি আপনাকে না ছাড়লে আমি আপনাকে পেতাম কোথায় বলুন তো? সে যাক গে — বলুন কি শর্ত!’

‘ আপনাকে ডক্টর দেখাতে হবে।’


চলবে—!