একটি শব্দ
লাবিবা আল তাসফি
১.
নুপুরে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের কথা নুপুর আজ জানতে পেরেছে। সেঘরে একটা সন্তানও রয়েছে নাকি! কথাগুলো নুপুর জানতে পেরেছে তার বাড়ির কাজের মেয়ে পুতুলের কাছ থেকে। পুতুল অন্য যে বাসায় কাজ করে সে বাসার সামনের ফ্লাটেই নাকি নুপুরের সেই সতীন থাকেন। আজ সকালে পুতুল নুপুরের স্বামীকে দেখেছে ফ্লাট থেকে বের হতে। পুতুলের সন্দেহ হওয়ায় বাসার মালকিনকে জিজ্ঞাসা করলে জানায় ওটা সামনের বাসার মহিলার স্বামী। তাদের একটা ছোট বাচ্চাও আছে।
পুতুলের থেকে শোনা কথা যে নুপুর চট করে বিশ্বাস করে নিয়েছে এমন নয়। আজকাল কাজের মেয়েদের কথা বিশ্বাস যোগ্য না। এদের কাজই হলো সংসারে আগুন ধরানো। ঠিক ভুল বিচার না করেই ফট করে একটা কথা বলে ফেলে তারা। কাজেই এমন ভাসা কথায় স্বামীকে সন্দেহ করার মতো মেয়েলোক নয় নুপুর।
তাছাড়া নুপুর আর সাকিবের সংসার এই চার বছরে পড়েছে। ভালোবেসে বিয়ে করেছে তারা। নিজের স্বামীকে সে অন্য পাঁচটা মানুষের থেকে ভালো জানে।
সাকিব শান্ত ধরণের মানুষ। কথা কম বলে। তাকে খুব সহজে রাগতে দেখা যায় না। খুব ভয়ংকর কোনো অন্যায় করলেও সে হাসি মুখে তা মাফ করে দিতে পারে। নুপুর মানুষটাকে যত দেখে ততই মুগ্ধ হয়। এই চার বছরের সংসারে তাদের কখনো কোনো বিষয়ে ঝগড়া হয়নি। ঝগড়া তো অনেক দূরের কথা নুপুরকে আজ পর্যন্ত গাঢ় গলায় কোনো কথা বলেনি পর্যন্ত সাকিব। চায়ে চিনির বদলে লবণ দেওয়ায় যে লোকটা মুচকি হেসে বলে,
‘চিনির স্বাদ নোনতা হয় আগে দেখিনি তো! কোথায় পেলে এমন চিনি?’
এমন লোকের সাথে ঝগড়া হওয়ার কোনো স্কোপ নেই। স্বামী হিসেবে সে সর্বদিক থেকে সেরা। নুপুর কল্পনাতেও এমন একজন মানুষকে সন্দেহ করতে পারবে না।
‘এতসব দিকে চোখ না দিয়ে নিজের কাজটা তো ঠিকঠাক ভাবে করতে পারিস। দেখ কাপড় গুলো দুদিন যাবত পরে আছে। কে ধোবে ওগুলো? দিন চারেক হলো আমার কোমড়র সাইডটা ব্যাথা করছে। নয়তো তোর আশায় তা ফেলে রাখি আমি? আজ মনে করে কেঁচে দিস।’
পুতুল ঘর ঝাড়ু দেওয়া বাদ দিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলে,
‘আমার কতা বিশ্বাস করলেন না তাই না? আপনেরে মিত্যা কেন কইতে যাব আমি? আপনারে আপনার স্বামীর খোঁজ দিলে কি দুই টাকা বেশি দেবেন আপনে? তাইলে আমি কেন সাইদে আপনেরে খোঁজ দেব?এইনে আমার লাভ লস কিচ্চু নাই।’
নুপুর চুলা থেকে মাছের হাড়িটা নামাতে নামাতে বলে,
‘সেটাই তো! কেন দিচ্ছিস?’
‘দিতাসি কারণ আপনে মেলা ভালো মানুষ। এই দুনিয়ায় ভালো মানুষেরা সবথিকা কষ্টে থাকে। কিন্তু ভালো মানুষগেও সুখে থাকনের অদিকার আছে। আমি চাই আপনেও সুখে থাকেন।’
‘আমি সুখেই আছি পুতুল। বেশি পাকা কথা না বলে কাজ শেষ কর। আজ তোকে নিয়ে শপিং এ যাবো। যদি না যেতে চাস তাহলে মুখ চালিয়ে যেতে পারিস।’
পুতুল এবার দমলো। কিন্তু তার মন অশান্ত থেকে গেল। ম্যাডাম যে স্যারকে এত বিশ্বাস কেন করে সে বোঝে না। অবশ্য সে নিজেও এ কথা প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি। নিজের চোখে দেখা বলেই না বিশ্বাস হলো! ওমন মাটির মতো মানুষটা তলে তলে শয়তানের নানা, এ কথা জানলে সে এ বাড়িতে কাজ নিতো না। ভালো মানুষদের কষ্ট পেতে দেখলে তার খুব দুঃখ হয়। আল্লাহ যে কেন ভালো মানুষদের এত কষ্ট দেয়!
২.
সাকিব আজ দুপুরে ফেরেনি। এটা নতুন নয়। প্রায়ই সে বাসার বাহিরে লাঞ্চ করে। এর কারণ কখনোই নুপুর জানতে চায়নি। প্রতিটা মানুষের জীবনে কিছু ব্যক্তিগত স্পেস দরকার। একটু স্বাধীনতা দরকার। সবকিছুতেই যদি কাউকে জবাবদিহি করতে হয় তাহলে জীবনের প্রতি বিরক্তি চলে আসে।
নুপুর এ বিষয়টা সবার থেকে ভালো ভাবে উপলব্ধি করতে পারে। তার বাবা মা মারা যাওয়ার পর মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে সে। সেখানে তার জীবন জেলখানার কয়েদিদের থেকে ভিন্ন কিছু ছিল না। এক চিমটি লবণের জন্য ও তাকে কৈফিয়ত দিতে হতো। স্কুলের ফিসের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টার মামার রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। কি ভয়ংকর সেসব অতীত। লজ্জায়, অপমানে সে যে কতবার নিজের মৃত্যু কামনা করেছে!
নিজের সেসব অতীতকে ভেবে সে কখনো আগ বাড়িয়ে সাকিবকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না। সংশয় তার অস্থির সাথে জড়িয়ে গেছে যেন। তারপর ও আজকাল বুকের ভেতরটা যেন কেমন করে ওঠে। বিশ্বাস না করলেও কেন যেন সন্দেহটা মাথার ভেতর শিকড় গেড়ে বসেছে। আজকাল রাতে তার ঠিক করে ঘুম হয় না। হঠাৎ হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে যায়। না চাইতেও অন্ধকারে হাত চলে যায় পাশে। যেন তারা নিশ্চিত হতে চায় পাশের মানুষটা এই আঁধারেও তার পাশেই আছে। হ্যাঁ তার কাছেই আছে!
নুপুর খাবার প্লেট সামনে নিয়ে বসে থাকে। পেটেও যেন টান নেই কোনো। নুপুর বার কয়েক ঘড়ির দিকে তাকায়। সময় কি একটু বেশিই ধীরে আগাচ্ছে?
হাঁসফাঁস করতে করতে অবশেষে সে ফোন হাতে সাকিবের ফোনে কল দিয়েই ফেলল। কয়েকবার রিংয়ের পর কল রিসিভ হলো। আশ্চর্য জনক ভাবে নুপুরের কথা বলতে যেন লজ্জা লাগছে। ঠিক লজ্জা নয়, খানিক জড়তা হয়তো! কেন? সে মনের কোনে যে সূক্ষ্ম সন্দেহ নিয়ে কল করেছে তার জন্য? ঠিক জানা নেই।
‘নুপুর? শরীর খারাপ করেছে? আমি আসবো?’
সাকিবের কন্ঠ অন্য সময়ের থেকে ভিন্ন লাগলো। এ কন্ঠে ছিল নুপুরের জন্য চিন্তা। এমন চিন্তিত কন্ঠ নুপুর আগেও একবার শুনেছিল। এক বর্ষণমুখর রাতে নুপুর কাঁদতে কাঁদতে সাকিবকে কল করেছিল। মামীর সাথে কথা কাটাকাটির পর্বটা সেদিন অনেকদূর গড়িয়েছিল। ফলস্বরূপ মামার শক্ত হাতের কঠিন থাপ্পড় পড়েছিল তার নরম গালে। এর আগে মামা কখনো তার গায়ে হাত তোলেনি। নুপুর একটু বেশিই ভেঙে পড়েছিল। নুপুরের কান্নার ধ্বনি শুনতেই সাকিবের স্বর চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। নুপুর সেদিন প্রথম আবিষ্কার করে সাকিব নামক এই বরফের মতো শীতল মানুষটার কন্ঠও গ্রীষ্মের উষ্ণ রোদের মতো হতে পারে। সেই বর্ষণমুখর রাতে সাকিব তার হলের দেয়াল টপকে বেরিয়ে হাজির হয়েছিল নুপুরকে আনতে নুপুরের বাড়ির সামনে। সাকিবের মতো শান্ত মানুষটাও সেদিন প্রচন্ড রেগে যেয়ে নুপুরের মামার সামনে থেকে নুপুরের হাত ধরে বেড়িয়ে এসেছিল। এত হিসাব করে চলা মানুষটা সেদিন কোনো কিছু না ভেবেই রাত এগারোটা প্রায় সময়ে নুপুরের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে হাজির হয়েছিল কাজী অফিসের সামনে। জরুরী তলবে সাকিবের দুজন বন্ধু এসে হাজির হয় খানিক বাদেই। হয়ে যায় আয়োজন ছাড়া এক সাদামাটা বিবাহ। ঠিক যেন হঠাৎ করেই সে কাগজে, কলমে এবং সম্পূর্ণ রূপে সাকিবের সাথে জড়িয়ে গেল। পুরোটা সময় নুপুর কেবল বড় বড় চোখ করে সাকিবকে দেখেছে। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করেছে এটাই কি তার সেই শীতল প্রেমিক? আবার নিজেই উত্তর দিয়েছে, হ্যাঁ এটা তার উষ্ণতায় গলে যাওয়া প্রেমিক।
সেদিনের পর থেকে সাকিব আবারো পূর্বের শীতলতায় নিজেকে মুড়িয়ে নিয়েছিল। এতদিন বাদে সেই উষ্ণ কন্ঠস্বর শুনতেই নুপুরের বুকের ভেতরটা ছলকে উঠলো। নিজেরপ্রতি চরম ক্ষোভে ঠোঁট কামড়ে কেঁদে ফেলল। কিভাবে সে সব ভুলে সন্দেহে জড়ালো নিজেকে! কিন্তু শব্দ ফোনের ওপাড়ে পৌঁছাতে দিল না। মানুষটাকে আতঙ্কিত করতে চাইল না সে। কান্না চাপিয়ে জবাব দিলো,
‘খেয়েছো?’
ওপাশ থেকে উত্তর এলো খানিক দেরীতে,
‘হুম। মাত্রই ফিরলাম। তুমি?’
‘খাচ্ছি।’
‘আচ্ছা।’
এরপর দুজনেই নীরব। নুপুর আরো কিছু বলতে চাইল কিন্তু খুঁজে পেল না। কিছু ঘন্টার ব্যবধানে মানুষটা বাড়িতে ফিরে আসবে জানা সত্ত্বেও কেন যেন নুপুরের কল কাটতে ইচ্ছা হলো না। সাকিব বুঝলো বোধহয়। চুপ থাকলেও সে কল কাটলো না। সময় গড়ালো। এক মিনিট, দুই মিনিট করে পুরো বারো মিনিট। নুপুর তখনো চুপ করে কানে ফোন ঠেকিয়ে বসে আছে।
‘কিছুটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। রাখছি! দ্রুত ফিরব আজ। খেয়ে নাও।’
কল টুট টুট করে কেটে গেলো। লজ্জায় নুপুরের গাল লাল হয়ে আসে। সে কি একটু বেশিই নির্লজ্জের মতো কাজ করে ফেললো? সাকিব তাকে ধরে ফেলেছে!
নুপুর ফোন নামিয়ে রেখে এক গ্লাস পানি খেয়ে লম্ব শ্বাস নেয়। আজে বাজে চিন্তায় সে তাদের সরল সম্পর্কটাকে জটিল করে ফেলছিলো ভেবেই লজ্জা পায়। সাকিব কখনো জানতে পারলে তাকে কি খুব নিচ মানসিকতার বলে মনে করবে? নুপুর চটজলদি ওজু করে নফল নামাজে দাঁড়ায়। শয়তান ভর করেছে। শয়তান সর্বদা মানুষের দুর্বলতার সুযোগ খোঁজে। নুপুর শয়তানকে অনেক বড় সুযোগ করে দিয়েছে। এই খারাপ চিন্তা থেকে বের হতে হবে তাকে।
৩.
মাজার ব্যাথাটা খাপ ছাড়িয়েছে। ঠিক করে বসতেও পারছে না নুপুর। তা দেখে সাকিব বেশ চিন্তিত স্বরে বললো,
‘আমি অনলাইনে টিকিট কেটে দিচ্ছি। সময় মতো যেয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আসো? একা যেতে ভয় লাগলে আমায় কল করিও। এক ঘন্টা সময় নিয়ে আমিও যাবো নাহয়!’
‘তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। এটুকু আমি একাই পারব।’
‘সত্যিই পারবে?’
নুপুর কপাল কুঁচকায়। বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,
‘তোমার কি আমাকে সেকেলে মনে হয়?’
সাকিব গলার টাই বাঁধাতে বাঁধতে নুপুরের দিকে না তাকিয়েই বললো,
‘না। তবে খুব আধুনিক ও না। পড়নের কাপড়টা দেখ! এলোমেলো অগোছালো যেমনটা আমার নানিকে দেখতাম!’
সাকিবের কথায় নুপুর খানিক লজ্জা পায়। ঘুম থেকে উঠতে আজ দেরী হয়ে গেছে। কাজেই চট জলদি নাস্তা বানাতে গিয়ে শাড়ির কুচি ঠিক করা হয়নি। মানুষটা যে এ ব্যাপারটা ধরে ফেলবে কে বুঝেছে? সাকিবের শীতল গলায় বলা কথা যে কোনো সময় যে কোনো মানুষেকে নুপুরের মতো অস্বস্তিতে ফেলে দিতে পারে। মানুষটার কথা ঠিক বরফের মতোই ধারালো।
সাকিব একবার নুপুরের দিকে তাকিয়ে পুনরায় নিজ কাজে মনোযোগ দেয়। শান্ত গলায় বলে,
‘খেতে দাও। দেরী হচ্ছে।’
,
,
কথায় আছে গরিবের কথা মিষ্টি হয় বাসি হলে। এখানেও তেমনটাই ঘটেছে। সময় হয়ে আসলেও নুপুরের কিছুতেই এই ভর দুপুরে একা বের হতে ইচ্ছা করছে না। অন্যদিকে সাকিবকে কল করতেও তার ইগোতে প্রচন্ড আঘাত হানছে। সকালে ওভাবে অপদস্থ হওয়ার পর আরো এক পর্যায়ে অপদস্থ হওয়ার মানসিক জোর নেই তার।
‘পুতুল চল আমার সাথে। একটু ডাক্তারের দরজা থেকে বেরিয়ে আসি।’
‘আপনের বাড়ির কাজ করার কাজ নিছি। ডাক্তারখানায় যাওনের কাজ তো নিই নাই। পারতাম না।’
নুপুর ধমক দেয় পুতুলকে। মেয়েটার শুধু বড় কথা। কথার ভার বয়সের থেকেও বেশি। এত কথা যে কোথা থেকে শেখে!
পুতুল এই ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়ার ব্যাপারে মোটেও খুশি না। এই রোদের মধ্যে জ্যামে বসে থেকে ডাক্তারের চেম্বার পর্যন্ত যাওয়া মোটেও তার কাজ না। এখানে ইঞ্চি পরিমাণ তার লাভ নেই। নুপুর পুতুলের গোমড়া মুখে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে। নরম গলায় বলে,
‘পাঁচশ টাকা দিবনি। এখন তো চল!’
পুতুল হাতের পানি ওড়নায় মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়। থমথমে মুখে বলে,
‘ফেস ওয়াসটা দ্যান। মুখটায় একটু পানি দেই। বাইরে যে গরম!’
‘বাথরুমে আছে। তাড়াতাড়ি করবি। বিয়ে বাড়ীতে যাচ্ছি না কিন্তু।’
চলবে….