অপ্রিয় তুমি পর্ব-০২

0
67

#অপ্রিয়_তুমি
#পর্ব২
#আফিয়া_আফরোজ_আহি

বাসর ঘরে বসে আছে উৎসা। এটাকে বাসর ঘর বললে ভুল হবে। ঘরে নেই কোনো ফুলের অস্তিত্ব আর না আছে কোনো সাজ সজ্জা। পুরো বাড়ি ফাঁকা। আত্মীয় সজনের কোলাহল নেই, লাল, নীল হলুদ রঙের আলো নেই, একদম সাদামাটা বাড়ি। আর থাকবেই বা কি করে? যে বাড়ির ছেলে হুট্ করে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসে সেখানে সাজ সজ্জা থাকবে না এটাই তো স্বাভাবিক। আলো অন্ধকারের খেলা চলছে কক্ষ জুড়ে। উৎসা বসে থাকতে থাকতে ঝিমিয়ে যাচ্ছে। ঘুম চোখের পাতায় চেপে বসেছে। সকাল সকাল উঠতে হয়েছে ওকে। বেচারি রাতেও ভালো মতো ঘুমাতে পারেনি। যার ফলে এখন ঘুমে ঢোলে পড়ছে। কিন্তু ঘুমানো ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। মেহরাব এখনো আসেনি। বাড়ি আসার মিনিট কয়েকর মাঝে মেহরাবকে ওর বাবা ডেকে পাঠিয়েছে। উৎসাকে মেহরাবের ভাবি তার রুমে বসিয়ে গেছে। উৎসা আশেপাশে তাকিয়ে পর্যন্তবেক্ষণ করলো। ঘরটা আর কারো না। ওয়ান এন অনলি মেহরাব মির্জা সাহেবের। উৎসা চোখ বুলালো একবার। সাজানো গোছানো রুম। উৎসা অবাক হলো। ছেলে মানুষের রুমও এতটা গুছানো হয়! তাও আবার সে যদি এমন গু*ন্ডা বদমাইশ টাইপের হয়। ভদ্র ছেলেদের রুম সাজানো গোছানো হলে মানা যায়। উৎসার ইচ্ছে করছে এক ছুটে বাড়ি চলে যেতে। বাবার কথা বেশি মনে পড়ছে। বাবা এখন সুস্থ আছে তো! কি করছে? আচ্ছা বাবা কি উৎসাকে মিস করছে? তার একটা মাত্র মেয়ে আজ বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে এতে কি তাঁদের কষ্ট হচ্ছে না! কান্না পাচ্ছে না। উৎসার তো কান্না পাচ্ছে।
————
মির্জা বাড়ির বড় ছেলে মিজান মির্জা। তার তিনজন সন্তান। দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে মাহিন মির্জা। মাহিন বিয়ে করেছে, তার বউয়ের নাম রিনি। তারপর মেয়ে সিঁথি। সিঁথির বিয়ে হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর। সে শুশুর বাড়িতে থাকে। তার তিন বছরের একটা বাচ্চাও আছে। ছোটো ছেলে অর্থাৎ এ বাড়ির ছোট কর্তা মেহরাব মির্জা। যার নাকের ডগায় সব সময় রাগ চড়ে থাকে। কিছু বলার আগেই টেম্পারেচার ৪২০ ডিগ্রিতে চড়ে থাকে। মিজান মির্জারা চার ভাই। তাঁদের বাড়ি পাশাপাশি। সিরিয়ালে একজনের বাড়ি।
—————
দরজার খুলে প্রবেশ করলো মেহরাব। পাঞ্জাবীর হাতা গোটাতে গোটাতে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। আহারে বেচারি বউ তার। নিশ্চই তাকে বকতে বকতে ঘুমিয়েছে। মেহরাবের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। এতদিনে তার রুমটা পরিপূর্ণতা পেল। হাত ঘড়ি খুলতে গিয়ে খেয়াল হলো রাত একটা বেজে পঁচিশ মিনিট। মেয়েটা নিশ্চই তার অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়েছে। কিন্তু সেই বা কি করবে? বাড়ি আসতে না আসতে বাবা জরুরি তলবে ডেকে নিলো। বাবার থেকে ছাড়া পেতেই কল এলো। সদ্য বিয়ে করা বউকে যে একটু সময় দিবে সেটাও পারলো না। এমনিতেই মেয়েটা ওকে দু চোখে দেখতে পারে না। দেখলে দশ মাইল দুরুত্ব বজায় রেখে চলে। মনে হয় ও কোনো বাঘ বা ভাল্লুক। ড্রেসিং টেবিলের সামনে ঘড়ি খুলে রেখে বিছানার দিকে অগ্রসর হলো। পুরো বিছানা ফাঁকা। মেহবের ভ্রু কুঁচকে এলো। উৎসা গেল কোথায়? ঝট পট লাইট জ্বালালো। সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে উৎসা কে পেল কাউচের ওপর। গুটি শুটি মেরে শুয়ে আছে। মেহারাবের ঠান্ডা মেজাজ মুহূর্তেই গরম হয়ে গেল। মেয়েটা পেয়েছে টাকি? এটা কি বাংলা সিনেমা পেয়েছে? কাউচের কাছে গিয়ে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলো উৎসাকে। অতঃপর শুইয়ে দিলো বিছানায়। লাইট নিভিয়ে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে টাওয়াল কোনো মতে চেয়ারের ওপর ছুড়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। শরীর ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসছে। শরীর আর চলছে না। বিছানায় শুয়ে উৎসাকে এক টানে কাছে নিলো এলো। অতঃপর বিয়ে করা বউকে জড়িয়ে চোখ বুঝলো। মনের মাঝে কেমন সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে। কতো সাধনার বউ তার। আর যাই হোক বিয়ে করে বউ দূরে রেখে ঘুমানোর পাত্র সে নয়। ক্লান্তিতে কিছু মুহূর্তের মাঝে মেহরাব ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।

গভীর রাত। আশেপাশে কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। উৎসার ঘুমের মাঝে অস্বস্তি হতে লাগলো। মনে হচ্ছে কেউ ওকে জাপ্টে ধরে রেখেছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। অবশেষে টিকতে না পেরে চোখ খুলল। নিজেকে আবিষ্কার করলো কারো শক্ত বাহু বন্ধনে। উৎসা ঘাবড়ে গেল। এতো রাতে ওর রুমে কে এলো? আর কেই বা ওকে এভাবে জাপ্টে ধরে রেখেছে? ভালো করে লক্ষ্য করে মেহরাবের মুখ খানা দেখে শান্ত হলো। মনে পরলো কয়েক ঘন্টা আগে এই বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা স্বরূপ তাকে ঝুলানো হয়েছে। উৎসার ইচ্ছে করলো মেহরাবের চুল গুলো টেনে ধরতে। হাত বাড়িয়েও ফিরিয়ে নিলো। বেচারা শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত ব্যক্তিকে আঘাত করা উচিত না। কিন্তু উৎসা কি করবে? ও যে এভাবে ঘুমিয়ে অভ্যস্ত নয়। হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে অভ্যস্ত ও। একটু নড়াচড়া করার মতো ফাঁকফোকরও রাখেনি মেহরাব। একদম শক্ত করে চেপে রেখেছে। উৎসার ঘুম আসছে না। কিছু করার নেই। দূর থেকে ভেসে এলো কুকুরে ডাক। উৎসা ভয় পেল। ভয়ে গুটি শুটি মেরে মুখ লুকালো মেহরাবের বুকে। এক সময় ঘুমিয়ে গেল।

সূর্যের আলো এসে চোখে পারতেই ঘুম ছুটে গেল মেহরাবের। চোখ খুলে উৎসাকে নিজের বুকে গুটিসুটি মেরে ঘুমাতে দেখে হাসলো। অতঃপর হাত বাড়িয়ে সামনে আসা চুল গুলো সরিয়ে দিলো। মেয়েটা ভীষণ মায়াবী। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ গাঁয়ের রঙ। উপচে পড়া সৌন্দর্য না হলেও দেখতে বেশ সুন্দরী। গোল গাল মুখ খানায় এক রাশ মায়া মাখা। মেহরাবের ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে ছুঁয়ে দিতে। একটু খানি ছুঁয়ে দিলে কি ভুল কিছু হবে? অবশ্যই না। তার বিয়ে করা বউ। কবুল পরে ইসলামী শরীয়ত মতে বিয়ে করেছে। এখানে ভুলের কিছুই নেই। মেহরাব আলতো করে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো উৎসার গালে। উৎসা ঘুমের মাঝে কেঁপে উঠলো। চোখ পিট পিট করছে। মেহরাব বুঝে গেল উৎসার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। তাই ঘুমানোর ভান ধরলো। উৎসা চোখ মেলে চাইলো। রাতের ন্যায় নিজেকে মেহরাবের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ দেখে মেজাজ খারাপ হলো। তখন রাত বলে কিছু বলেনি। এখন সে মোটেও ছেড়ে দিবে না। মেহরাবকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ডাকা শুরু করলো,
“এইযে মিস্টার গু*ন্ডা। উঠুন, উঠুন বলছি। একটা মানুষকে সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরে নিজে কি সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে”

মেহরাব হাই তুলার ভঙ্গিমা করে উঠে বসলো,
“কি হয়েছে কাকের মতো কা কা করে সকাল সকাল চেঁচাচ্ছ কোনো? কোকিলের মতো মিষ্টি করে বলতে পারো না?”

উৎসা তেতে উঠে বলল,
“না পারি না। আপনার মতো অ*সভ্য লোকেদের জন্য তো আরো আগেই না”

মেহরাব ভ্রু কুঁচকে সুধালো,
“আমি কি করেছি?”

“একটা মেয়ের পারমিশন ছাড়া তাকে সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরেছেন তার ওপর জিজ্ঞেস করছেন কি করেছি? এতো পুরো চোরের মায়ের বড় গলা টাইপ”

“ও হ্যালো আমি আমার বিয়ে করা বউকে জড়িয়ে ধরেছি কোনো পর নারীকে না”

“বিয়ে করছেন বলে কি হয়েছে? তাই বলে পারমিশন না নিয়েi টাচ করবেন?”

“বউ শিকেয় তুলে রাখার জন্য বিয়ে করিনি আমি। বিয়ে করেছি ইচ্ছে হলে বউকে জড়িয়ে ধরবো ইচ্ছে হলে চুমু খাবো এতে তোমার কি?”

কথা গুলো বলতে বলতে মেহরাব উৎসাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমুও দিয়ে দিলো। উৎসা ছিটকে দূরে সরে গেল। গাল মুছতে মুছতে বলল,
“লুচু বেডা”

মেহরাব দাঁত কেলিয়ে ৩২ পাটি বের করে হাসি দিলো। সেই হাসিতে জ্বলে উঠলো উৎসার শরীর। বেচারি পারছে না মেহরাবকে চোখ দিয়ে ভস্ম করে দেয়। মেহরাব গাঁ জ্বালানো হাসি দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।

————
বসার ঘরে সবার সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে উৎসা। ওর সামনে বসে আছে সবাই। মিজান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার ঘুম ভালো হয়েছে মা? আমাদের বাড়িতে কোনো সমস্যা হচ্ছে নাতো?”

উৎসা একবার আড় চোখে মেহরাবের দিকে চাইলো। এরকম বজ্জাত মার্কা এক খান বর নামক বর্বর কপালে জুটলে কারো ঘুমই ভালো করে হওয়ার কথা না। কিন্তু আর যাই হোক এতোগুলো মানুষের সামনে বলা যাবে না। উৎসা মিহি কণ্ঠে বলল,
“না না আঙ্কেল কোনো সমস্যা হচ্ছে না”

“আঙ্কেল কি? বাবা বলে ডাকবে। যেভাবেই হোক তোমাদের বিয়েটা হয়েছে তো। বড় বউমা যেমন বাবা বলে ডাকে তুমিও বাবা বলে ডেকো”

উৎসা মাথা নেড়ে সায় জানালো। এর মাঝে লাঠি হাতে বসার ঘরে প্রবেশ করলো মেহরাবের দাদু। মেহরাব এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরলো। দাদু ওকে আঘাত করতে করতে বলল,
“সর হা*রা*ম*জা*দা তুই আমায় ধরবি না। আমার লাগি সতীন নিয়া আইলি আমায় একফির কইলিও না। সতীন পছন্দ না হইলে কিন্তু ফিরত পাঠামু বইলে দিলাম”

মেহরাব ফিসফিস করে বলল,
“পছন্দ হবে কি দেখে তাকিয়ে থাকবে রীতিমতো ডার্লিং”

“মেলা সুন্দর নি?”

মেহরাব সায় জানালো। দাদুকে এনে উৎসার পাশে বসলো। দাদু উৎসাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। উৎসার ভয় হচ্ছে, অস্বস্তি লাগছে। দাদু থুতনিতে হাত রেখে উৎসার মুখ খানা ওপরের তুলল,
“দেখি বইন তোর রূপ খানা। যেই রূপে আমার নাতি আটকে যেয়ে আমারে না জানিয়ে বিয়ে করে নিলো”

উৎসাকে ভালো করে পর্যন্তবেক্ষণ করে বলল,
“মাশাআল্লাহ মেলা সুন্দর বউ। এই জন্যই নাতি আমার পা*গল হয়ে গেছে। এই রূপ দেখিয়ে বশ করেছিস নাকি বউ?”

উৎসা মনে মনে বলল,
“আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। এমন বেলাজ বেডাকে বশ করতে যাবো”

মিজান সাহেব ছেলেদের সাথে পরামর্শ করছেন কি করা যায়! ছেলে হুট্ করে বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে এখন অনুষ্ঠান করে আত্মীয় স্বজন ডেকে তাঁদের জানাতে হবে তো। মির্জা বাড়ির একটা মান সম্মান আছে।

উৎসা রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। কাজে হেল্প করতে চাইলে সালেহা বেগম দিলেন না। একে তো নতুন বউ তার ওপর যদি হাত টাত পুড়িয়ে বসে। উৎসা এর আগে হাতে গোনা কয়েকবার এসেছিলো মেহরাবদের বাসায়। একবার মেহরাবের জন্মদিনে আরেকবার সালেহা বেগম ওকে দেখতে চেয়েছিলো বলে। সেই সুবাদে তাঁদের কিছুটা আলাপ আছে। মাহিনের বিয়েতেও সে তিয়াসের সাথে গিয়েছিলো। তখন যদিও উৎসা আরো ছোটো ছিল। মাহিনের বউ রিনি মেয়েটা ভীষণ মিশুকে। উৎসার সাথে সেঁধে সেঁধে কথা বলছে। এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। এর মাঝেই হাঁক শোনা গেল মেহরাব চেঁচাচ্ছে,
“উৎসা, এই উৎসা। কোথায় তুমি? এদিকে এসো?”

রিনি মুখ টিপে হাসলো। উৎসার রাগ হলো। ব্যাটা এমন আচরণ করছে যে সবাই ভাবতে বাধ্য তাঁদের মাঝে কিছু আছে। প্রেমের বিয়ে তাঁদের। কিন্তু আদতে সেটা মোটেও সত্যি নয়। মেহরাব আর তার মাঝে আদায় কাঁচকলা সম্পর্ক। উৎসা মনে মনে প্রস্তুতি নিলো সোজা যেয়ে লোকটার গলা চেপে ধরবে। রিনি হাসতে হাসতে বলল,
“উৎসা তোমার এখানে কাজ নেই। মেহরাব ডাকছে ওর কাছে যাও”

#চলবে?