#অপ্রিয়_তুমি
#পর্ব৪
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
উৎসা গাল ফুলিয়ে গাড়িতে বসে আছে বেচারি বলেছিলো বাবার বাড়ি যাবে কিন্তু মেহরাব ওকে অন্যে রাস্তায় নিয়ে এসেছে। এটা ওদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় নয়। তাহলে মেহরাব ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে? উৎসা মুখ খানা গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করলো,
“এই রাস্তায় দিয়ে আমরা কোথায় যাচ্ছি? এটা তো বাড়ির রাস্তায় না”
মেহরাবের উত্তর,
“দেখতে থাকো”
গাড়ি এসে থামলো একটা শপিং মলের সামনে। মেহরাব গাড়ি পার্ক করে উৎসার হাত নিজের হাতের মাঝে পুড়ে হাঁটা শুরু করলো। পুরো সপিং মল ঘুরে ঘুরে অনেক কিছু কিনছে। কিন্তু এতো জিনিস কাঁদের জন্য কেনা কাঁটা করছে? তাহলে কি ওরা অন্য কোথায় যাবে? উৎসার কপালে ভাজ পড়লো। যাওয়ার কথা ওদের বাড়ি কিন্তু উনি শপিং করছেন কেন?
“আমরা শপিং করতে এসেছি কেন?”
“বোকা বউ! নতুন জামাই শশুর বাড়ি গেলে তাঁদের জন্য গিফ্ট নিয়ে যেতে হয়। আর এখন তো আমিও তাঁদের ছেলে। তাঁদের প্রতি আমারও তো কিছু দায়িত্ব কর্তব্য আছে নাকি?”
উৎসার মনে মেহারাবে জন্য এক রাশ ভালো লাগা কাজ করলো। লোকটা যতোই গু*ন্ডা, বদমাইশ, লুচু হোক বিয়ের পর পরই কি সুন্দর ওর বাবা-মা কে নিজের বাবা-মা হিসেবে এক্সেপ্ট করেছে। কি সুন্দর তাঁদের নিয়ে ভাবছে। ব্যাপারটা উৎসার কাছে ভালো লাগলো। প্রতিটা মেয়েই তো এমন বর চায় যে তার বাবা-মা কে সম্মান করবে, আপন করে নিবে তাঁদের। মেহরাব শপিং শেষে গাড়ি স্টার্ট দিলো। মাঝে গাড়ি থামিয়ে ফল মিষ্টি কিনতে ভুললো না। ফল, মিষ্টি, শপিং দিয়ে গাড়ি ভরপুর করে অতঃপর উৎসাদের বাড়ির দিকে এগোলো। এদিকে উৎসা বসে বসে মেহরাবের কাণ্ড দেখছে। লোকটা কতোটা পা*গলামো করছে। ওকে কিছু জিজ্ঞেস ও করছে না। মেহরাব নিজ ইচ্ছেতে বেছে বেছে বেস্ট টা নিচ্ছে। উৎসাদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে দুজন নেমে এলো। বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দরজা খোলার অপেক্ষায়। কিছুক্ষনের মাঝে দরজা খুলে দিলো উৎসার কাজিন। ওদের দেখে সবাইকে ডাকতে শুরু করলো। মেহরাবের হাত ভর্তি জিনিস পত্র। উৎসার মা তনয়া বেগম মেহবারের হাতে এতো কিছু দেখে ছুটে এলেন। ওর হাত থেকে জিনিস গুলো নিতে নিতে বললেন,
“কেমন আছো বাবা? তোমার বাড়ির সবাই কেমন আছে? আসতে কষ্ট হয়নি তো?”
“আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে। না, না আমাদের আসতে কোনো কষ্ট হয়নি মা। বাবার কি অবস্থা? উনি এখন ভালো আছেন তো?”
“এখন আগে থেকে অনেকটাই ভালো। এতো কিছু আনার কি দরকার ছিল বাবা?”
“আমি আমার বাবা-মা কে দেখতে এসেছি। খালি হাতে কিভাবে আসি বলুন মা। তাই এই সামান্য জিনিস নিয়ে এলাম”
“এতো কিছুকে তুমি সামান্য বলছো?”
“সামান্য নয়তো কি! ছেলে হিসেবে আপনাদের জন্য আরো করতে পারলে আমি খুশি হতাম”
তনয়া বেগমের গর্বে বুক ফুলে উঠলো। চোখে পানি আসতে নিলেও উনি নিজেকে সামলে নিলেন। এর মাঝে তিয়াস এলো ড্রয়িং রুমে। মেহরাবকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কখন এলি?”
“এইতো সবে। গাড়িতে এখনো কিছু জিনিস রয়ে গেছে। কষ্ট করে নিয়ে আয় ভাই”
“ঠিক আছে তুই যা আমি আনছি”
উৎসা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবার কাণ্ড দেখছে। ও যে এসেছে ওকে কেউ পাত্তাও দিচ্ছে না। কি এক বদ লোক সাথে করে এনেছে তার খোঁজ খবরই নিচ্ছে। সাথে যে তাঁদের মেয়েও আছে সে খেয়াল তাঁদের নেই। মেয়ে গোটা একটা দিন বাড়িতে ছিল না সে খবর আছে কারো? নাহ! উৎসা মনে মনে বলল,
“কি আজব কাণ্ড? আমি যে এসেছি সেটা কারোই খেয়াল নেই”
তারা তাঁদের জামাই বাবাজিকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেছে। উৎসার অভিমান হলো। থাকবে না সে এখানে। যেখানে তার কদর নেই সেখানে থেকে কি করবে?উৎসা শব্দ করে বলে উঠলো,
“আমি কি তাহলে চলে যাবো? আমায় তো কারোর চোখেই পরছে না। আমি পর হয়ে গেছি তাই না? থাকো তোমরা তোমাদের মেয়ে জামাইকে নিয়ে, আমি গেলাম”
উৎসা সোজা হাঁটা দিলো বাবার রুমের দিকে। এতক্ষনে তনয়া বেগমের মেয়ের দিকে খেয়াল পড়লো। সুধালো,
“কিরে মা কেমন আছিস?”
উৎসা মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“এতক্ষন যাকে মাথায় তুলে নাচ ছিলে তাকে নিয়েই থাকো। আমি কেমন আছি সে খবর দিয়ে তোমাদের কি? এতদিন শুনেছি মেয়ে বিয়ে হলে পর হয়ে যায় আজ তা নিজ চোখে দেখে নিলাম। থাকবো না তোমাদের বাড়ি, চলে যাবো আর আসবো না। তখন দেখো”
তনয়া বেগম বিপরীতে কিছু বলবেন সেই সুযোগও দিলো না। তনয়া বেগম কপাল চাপড়ালেন। মেয়ে তার অভিমানী স্বভাবের। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই অভিমান করে বসে। এখন নিশ্চই বাবার বুকে মুখ গুঁজে একে একে নালিশ জানাবে। ছোটবেলা থেকে এটাই উৎসার স্বভাব। কেউ কিছু বললে বাবার বুকে মুখ গুঁজে কান্না করবে আর নালিশ জানাবে। হলোও তাই। উৎসা সোজা বাবার রুমে যেয়ে ঢুকলো। উজ্জ্বল সাহেব বসে বসে বই পড়ছিলেন। উৎসা এক ছুটে যেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। মুখ গুজলো বাবার বুকে। গোটা একটা দিন পর বাবাকে পেয়ে আবেগী হয়ে পড়লো।
“কেমন আছো? তোমার শরীর এখন ঠিক আছে তো? ওষুধ খেয়েছো ঠিক মতো?”
উজ্জ্বল সাহেব মেয়ের আকুলতা দেখে হাসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। মেয়ে তার ছোটো বেলায় থেকেই বাবা পা*গল। বাবাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। বাবার কিছু হলে উৎসার চিন্তার শেষ নেই। উজ্জ্বল সাহেব মেয়ের কপালে চুমু একে দিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ মা আমি ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ”
“ওবাড়ির সবাই কেমন আছে? সবাই তোকে মেনে নিয়েছে? সব ঠিক ঠাক আছে তো!”
“ও বাড়ির সবাই ভালো আছে। সবাই আমাকে মেনে নিয়েছে। জানো আঙ্কেল নিজ থেকে আমার খোঁজ নিয়েছে, আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা সেটাও জিজ্ঞেস করেছে”
“এটা তো ঠিক না মা?”
উৎসা কপালে ভাজ ফেলে সুধালো,
“কোনটা বাবা?”
“এইযে তুমি মেহরাবের বাবাকে আঙ্কেল ডাকছো। মেহরাবকে দেখছো কি সুন্দর বিয়ে হতে না হতেই সবাইকে আপন করে নিয়েছে তেমনই তুমিও তাঁদের আপন করে নেও। এখন থেকে তুমি তাঁদের সাথেই থাকবে। তারাই তোমার সব। তাই যতো আপন করবে ততই ভালোবাসা পাবে”
উজ্জ্বল সাহেব এমনি সময় মেয়েকে “তুই”করে সম্মোধন করেন। মেয়েকে কোনো কিছু বোঝানোর সময় “তুমি”সম্মোধন করেন। উৎসা বাবার কথায় গাল ফুলালো। সবাই কেন ওই বজ্জাত লোকটারই উদাহরণ দিবে? তাকে কি কারো চোখে পরে না? সব কথার আগে পরে মেহরাব, মেহরাব আর মেহরাব। তার প্রশংসায় পঞ্চ মুখ সবাই। উৎসা গাল ফুলিয়ে বলল,
“শেষ মেষ তুমিও ওই গু*ন্ডাটার সাইড টানছো? বাহ্ বেশ ভালো। এখন তোমাদের কাছে তোমাদের মেয়ের থেকে ওই লোকটা বেশি হয়ে গেল?”
“এভাবে বলে না মা। মেহরাব তোমার স্বামী। ওর সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে। তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলো”
উৎসা মুখ ভেংচি কাটলো। বিড়বিড় করে বলল,
“সম্মান না ছাই। কঁচু দিবো বেটাকে”
অতঃপর হাঁটা দিলো নিজের রুমের দিকে। উৎসাদের ছোটো খাটো ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়িতে মানুষ মাত্র চার জন। ওপরে উৎসা আর তিয়াসের রুম।
নিজের রুমে এসে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো উৎসা। একদিনের ব্যাবধানে মনে হচ্ছে কতো গুলো দিন কেটে গেছে। উৎসা মন খুলে শ্বাস নিলো। নিজের রুমের শান্তিই আলাদা। বিগত দশ বছর যাবত এই ঘর তার সঙ্গী। এই রুমে ওর কতো আবেগ ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। রুমের প্রতিটা কোনা উৎসা নিজের মতো করে সাজিয়েছে। আর আজ একটা শব্দের, একটা সাইনের ব্যাবধানে উৎসা এ বাড়িতে মেহমান হয়ে গেছে। আগে যেই বাড়িতে সারাদিন ঘুরে বেরিয়েছে এখন এই বাড়িতেই সে কিছু মুহূর্তের জন্য এসেছে। উৎসার মন খারাপ হলো। মেয়েদের জীবন এতটা কঠিন কেন? যেই বাড়িতে তারা বেড়ে ওঠে সেই বাড়িতেই একদিন তারা মেহমান হয়ে যায়? উৎসা কখনো বাবা-মাকে ছাড়া থাকেনি। যেখানেই যেত বাবা-মায়ের সাথেই যেত। এই প্রথম ও গোটা একটা দিন একটা অপরিচিত জায়গায় কাটিয়ে এলো। তাও কিনা সেখানে ওকে সারাজীবনের জন্য থাকতে হবে। কথাটা ভেবেই উৎসার কান্না পেল। বলতে বলতে চোখ বেয়ে পানি পরে গেল। উৎসা চোখে পানি নিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। উৎসার বারান্দা তেমন বড় নয়। তবে ওর মনের মতো। উৎসা রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। মেজাজ খারাপ এখন। মেহরাবকে পেলে বেটার চুল টেনে টাক বানিয়ে ফেলতো। উৎসা ঝট পট কল্পনা করে ফেললো মেহরাবের টাক মুখ খানা। কল্পনায় মেহরাবে চেহারা সুরত দেখে উৎসা খিল খিল করে হেসে দিলো। তবে অবাক ওরা কাণ্ড বেটাকে টাক মাথাও হ্যান্ডসাম লাগে। হাসতে হাসতে উৎসার খেয়াল হলো মেহরাব টাক হয়ে গেলে লোকে তাকে,
“টাকলা বেডার বউ” বলবে। তাই প্ল্যান ক্যানসেল। তবে মেহরাবকে সামনে পেলে এটা অবশ্যই জিজ্ঞেস করবে,
“মানুষ পটানো শিখেছে কোথা থেকে?”
সাধারণত ছেলেরা মেয়ে পটায়। আর এদিকে মেহরাব এমন ছেলে মেয়েরা তো এমনিতেই বেডার প্রেমে উস্টা খায় এখন ওর বাবা-মাও তাকে চোখে হারায়। কি আছে এই লোকের মাঝে? উৎসা ভেবে পায় না। মেহরাবকে বকতে বকতে উৎসা পাড়ি জমালো অতীতের পাতায়।
প্রায় বছর দশ হবে। উৎসা তখন ক্লাস থ্রি কিংবা ফোর এ পড়ে। তিয়াস তখন ক্লাস নাইনে। নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছে তিয়াস। নতুন নতুন বন্ধু মহল তার। তাদের মাঝে প্ৰিয় বন্ধু হলো মেহরাব। একদিন মেহরাবকে বাড়ি নিয়ে এসেছিলো। উৎসা তখন অনেকটা ছোটো। মেহরাব ওদের বাড়ির পাশের ছোটো বাগানটা ঘুরে দেখছিলো। উৎসা সবে স্কুল থেকে ফিরে মেহরাবেক দেখে ভেবেছে এটা বোধ হয় ওর ভাইয়া। দুজনের হাইট সেম। পিছন থেকে দেখতেও অনেকটা একই রকম। ছোটো উৎসা লাফিয়ে মেহরাবকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ভাইয়া তুমি এসেছো? আজকে এতো তাড়াতাড়ি এলে যে? প্রতিদিন তো বিকেলে করে আসো”
মেহরাব পিছু ফিরে ধমক দিয়ে বলেছিলো,
“এই মেয়ে কে তুমি? যাকে তাকে জড়িয়ে ধরে ভাইয়া ভাইয়া করছো?”
উৎসা মুখ তুলে চাইলো। মানুষটা তো ওর ভাইয়া না। উৎসার কান্না পেল। ভ্যা ভ্যা করে কান্না করে দিলো। ওর বাবা-মা কিংবা ভাই কখনোই কেউ ওকে এভাবে ধমক দেয়নি। যেভাবে মেহরাব দিয়েছে। উৎসাকে কান্না করতে দেখে মেহরাব ঘাবড়ে গেল। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। উৎসার গালে হাত রেখে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে আকুল কণ্ঠে বলল,
“সরি পিচ্চি। আমি বুঝতে পারিনি। কান্না করে না বাবু”
উৎসা শুনলে তো! ও ওর মতো কান্না করেই যাচ্ছে। পিচ্চি গুলু মুলু বাচ্চাটাকে কান্না করতে দেখে মেহরাবের মায়া হলো। ও ব্যাস্ত হয়ে পড়লো উৎসার কান্না থামাতে। এর মাঝেই বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো তিয়াস। বোনকে কান্না করতে দেখে ছুটে কাছে এলো। চট করে কোলে তুলে নিলো বোনকে। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সুধালো,
“কি হয়েছে আমার বনুর? বনু কান্না করছিস কেন? কান্না করে না। ভাইয়া এসে গেছে তো”
তিয়াসের অনেক ভালোবাসার তার বোন। বোনকে সে অনেক ভালোবাসে। অতো টুকু বয়সে নিজের টিফিনের টাকা জমিয়ে বোনের জন্য চকলেট, তো কখনো খেলনা নিয়ে আসে। ভাইয়ের আদর পেয়ে উৎসা আরো জোরে কেঁদে দিলো। কান্না করতে করতে বলল,
“তুমি কোথায় ছিলে ভাইয়ু? এই ছেলেটা আমায় বকেছে”
মেহরাব চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে উৎসার দিকে। উৎসা পাত্তাই দিলো না। তিয়াস বোনকে সান্তনা দিতে বলল,
“কান্না করেনা বনু। এটাও তোমার একটা ভাইয়া। ভাইয়া বুঝতে না পেরে তোমার বকে ফেলেছে। আর কখনো বকবে না”
মেহরাবের বোধ হয় “ভাইয়া” সম্মোধন পছন্দ হলো না। নাক মুখ কুঁচকে নিলো। সেদিনের পর উৎসার মনের মেহরাব জায়গা পেল“অপ্রিয়”হিসেবে।
চলবে।