মায়াকুমারী পর্ব-৩৪/খ

0
113

#মায়াকুমারী ❤️
#মেহেরিন_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(৩৪/খ)
___________________

ভোর রাতের দিকে প্রচুর পরিমাণে রক্তবমি করলো অনিক। ডক্টর কিছুতেই রাখতে চাইলেন না। অবস্থা সুবিধাজনক নয় দেখে দ্রুত এয়ার এম্বুল্যান্সে করে থাইল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হলো। পুত্রশোকে মূহ্যমান আদনীন ফেরদৌস রাত থেকে এই অব্ধি বার তিনেক মূর্ছা গেলেন। পুত্র এবং স্ত্রীর অবস্থায় আপসেট হয়ে পড়লেন অনিকের বাবা।
__

ভ্যানিলা ফুলের সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে গেল ধ্রুব। বসে থাকা দায় হয়ে পড়লো! কীভাবে থাকে এরা দু’জন বুঝে পায় না। মাথা ঘুরছে,কেমন মাতাল মাতাল লাগছে! ফজরের আযান হয়। পাখিদের কিচিরমিচির ডাক শোনা না গেলেও নারিকেল গাছে সংসার বাঁধা একজোড়া কাক দম্পতির টুকটাক ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘরে নতুন অতিথি এসেছে বোধহয়! ফুল কলিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভোরের আলো ফুটতেই নিশুকে শুইয়ে বেরিয়ে গেল ধ্রুব। মসজিদে যাওয়ার জন্য সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই ব্যপারটি চোখে পড়লো আসাদ সাহেবের। নীরবে পা বাড়ালেন বাইরে। নামাজ আদায় করে রুম থেকে বেরুলেন দিলরুবা খাতুন। পুরো বাড়ি কেমন থমথমে লাগলো উনার। আকস্মিক ছলকে উঠলো হৃদপিণ্ড! পুরো বাসাটা কেমন জানি গুমোট হয়ে রয়েছে! যদিও আগে কখনো এমন হয়নি। ভুতুড়ে বাড়ির মতো মনে হলো! নিশু-দ্যুতি নামাজ পড়তে উঠেছে কিনা সাড়াশব্দ পেলেন না। পা চালিয়ে এগিয়ে এলেন। ভেড়ানো দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলেন ঘুমাচ্ছে। ভেতরে ঢুকে এগিয়ে এলেন।

“নিশু-দ্যুতি উঠ নামাজ পড়বি না?”

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দু’জন।

“এই উঠ সূর্য উঠে যাচ্ছে! পরে আবার ঘুমাস!”

নড়েচড়ে উঠলো নিশু।

“নিশু নামাজ পড়বি না?”

“আমার নামাজ নেই ফুপি।”

অস্পষ্ট স্বরে বলে ঘুমিয়ে পড়লো নিশু। দ্যুতিকে ডাকতে গিয়েও কী মনে করে আর ডাকলেন না। কেন জানি মায়া হলো। কাছে এগিয়ে গেলেন। গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন। কেমন জানি বিষন্ন দেখালো মেয়েটাকে। কান্নার ছাপ স্পষ্ট তবে গালের মধ্যে শুকিয়ে রয়েছে অশ্রু। বুকটা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠলো। দ্যুতিকে হাসিখুশি দেখালেও ভীষণ গভীর মেয়েটা! কোনো সমস্যা হলে কিংবা কষ্ট পেলে সহজেই প্রকাশ করে না। মেয়েটার মধ্যে দুঃখ পুষে রাখার দারুণ একটা ক্ষমতা রয়েছে। মেয়ের চিন্তায় কাল রাতে ছাড়া ছাড়া ঘুম হয়েছিল উনার। শেষ রাতের দিকে চোখ লেগে আসতেই আযানের স্বরে জেগে গেলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বুক অব্ধি কাঁথা টেনে বেরিয়ে গেলেন।
__

ডাইনিংয়ে বসে রইলেন উনারা দু’জন। সবাই আজ ঘুমে। কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না দিলরুবা খাতুন। ভ্যানিলা আর মহুয়া ফুলের সুগন্ধে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল নিশুর। আড়মোড়া ভেঙে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকে এক বালতি পানি এনে ব্যালকনিতে গেল। অনেকগুলো ভ্যানিলা (অর্কিড) ফুল ফুটেছে! ইন্ডিয়া যাওয়ার পর দার্জিলিং ঘুরতে গিয়ে গাছটা এনেছিল সে। জাফরানের পর এই ভ্যানিলাকেই বিবেচনা করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ও জনপ্রিয় সুগন্ধী মশলা হিসাবে। গ্রিলের সঙ্গে পেঁচিয়ে দিতেই এই সাড়ে তিন বছরে কেমন তরতরিয়ে বেড়ে উঠেছে। সবুজ-হলুদ রঙের সুন্দরী ফুলগুলো দেখতেই ভীষণ বায়না করেছিল এরপর কিনে দিয়েছিল ধূসর। গাছটা বাঁচবে কিংবা ফুল ফুটবে এটা ছিল কল্পনাতীত। গাছগুলোর গোড়ায় পানি দিয়ে একপলক তাকায়। বৃষ্টির পানি পড়তেই কাঠচাঁপারা যেন প্রতিযোগিতা করে নতুন কুঁড়ি ফেটে ফুটতে শুরু করেছে! কি তীব্র সুবাস তাদের! নাক এগিয়ে থোকা থেকে প্রাণভরে সুগন্ধি টেনে নিলো। চোখ পড়লো বুলবুলির ছানার উপর। কাঠচাঁপা গাছে বাসা বেঁধেছে একজোড়া বুলবুলি দম্পতি। ডিম ফুটে ছোট্ট ছোট্ট তিন-চারটা কলিজার টুকরো বেরিয়েছে। ভীষণ আদুরে লাগলো। চোখ পড়লো বাইরে। বাসার পিছনে অনেকগুলো মহুয়াগাছ। আসাদ সাহেবের ভীষণ প্রিয় গাছগুলো। বৃষ্টির মতো টুপটুপ করে পড়ছে ফুলগুলো। নিশুর যেতে ইচ্ছে করছে তবে একা নয় কিন্তু দ্যুতি তো ঘুমে।

হেব্বী লাগে খেতে
ফুলের নেশায় মেতে
ওগো মহুয়া সুন্দরী
আহা মরি মরি!

হ্যাঁ,মাতাল করা তীব্র সুগন্ধ এই ফুলের। রাতের বেলায় বাদুড় এসে ফুলগুলো ভীষণ মজা করে খায়! দারুন একটা মিষ্টি গন্ধ ঠিক যেন মনে হয় পায়েস রান্না হচ্ছে! পায়েসের মতোই সুগন্ধ ছড়ায়! অবশ্য পায়েস রান্না করলেও মন্দ হয় না! ফুলগুলো রসালো এবং স্বাদ অম্লমধুর। নিশুর তো খেতে ভীষণ মজা লাগে ঠিক কিসমিসের মতো মিষ্টি! গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকলে বৃষ্টির মতো টুপটুপ করে ঝরে পড়ে,সে এক আলাদাই অনুভূতি! নিশু রোজ ছয়-সাতটা ফুল এনে বাসায় রেখে দেয়। পুরো বাসা গোবিন্দভোগ চালের মতো সুগন্ধে ভরে যায়। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো গাছতলার দিকে। যেন টুপটুপ করে ফুলবৃষ্টি ঝরছে! দ্যুতিকে ডাকতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো রাতের কথা। মুহূর্তেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো বুকের ভেতর। সে-তো বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল! অনিক কেমন আছে? অস্থির হয় নিশু। দ্রুত হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে নিলো। রুম থেকে বেরুতেই নিচ থেকে ডাক পড়লো,”নিশু উঠেছিস?”

“জ্বী।”

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো।

“আজ সবাই ঘুমে কী ব্যপার?”

কিছু বলতে পারলো না নিশু।

“তোর ভাইয়াদের ডাক দিয়ে আয়। নাস্তা করবে কখন বেলা হয়ে যাচ্ছে।”

“আচ্ছা।”

ধীরাজকে আগে ডেকে ধূসরের রুমে নক করতেই দেখলো ভেড়ানো। উঁকি দিয়ে দেখলো বিছানায় নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ পেলো। চোখ পড়লো টেবিলে। সেদিনের মতো ডায়েরিটা রাখা। কৌতুহলী হয়ে ভীত এবং গুটিগুটি পায়ে রুমে ঢুকলো। ডায়েরি হাতে নিলো। কলম রাখা ভেতরে। খুলতেই চোখ পড়লো বেশ কিছু লেখায়। কলম তুলে হাতে নিলো।

“একসময় ভাবতাম,আকুল হয়ে কাউকে চাইলে বোধহয় পাওয়া যায়। লোকে বলে,চেষ্টায় নাকি সব হয়। আমিও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম,সত্যিকারের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব বোধহয় মিলেই যায় একদিন। তীব্র আকুতি নিয়ে কাউকে চেয়েছিলাম। তবে চেষ্টার কমতি ছিল কিনা জানি না। তবুও স্রষ্টা আমার প্রার্থনা বোধহয় শুনেননি হয়তো বা এরচেয়ে উত্তম কিছু রেখেছেন বলেই।”

ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হতেই ছুটে বেরিয়ে গেল নিশু। ভ্যাগিস তাকে দেখেনি। হাফ ছেড়ে বাঁচলো তবে ভীত হলো! ধ্রুবর ডোরের নব ঘুরাতেই খুলে গেল। ধুকপুক বুক নিয়ে গুটিগুটি পায়ে ভেতরে ঢুকলো। ডাকতে নিয়েও হঠাৎ থেমে গেল। হাঁটু গেঁড়ে গালে হাত দিয়ে বিছানার নিচে বসে তাকিয়ে রইলো। ফিসফিসিয়ে বলল,”এত সুন্দর করে কীভাবে ঘুমাও ধ্রুবতারা?”

মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো নিশু।

“এই যে ঘুমিয়ে আছো কী যে সুন্দর লাগছে! তুমি যদি তোমাকে দেখতে তাহলে হোঁচট খেয়ে তোমার প্রেমে তুমি পড়তে!”

মাথার চুলে হাত বুলাতে নিয়েও গুটিয়ে নিলো।

“আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ তুমি! সত্যি তোমার মতো সুদর্শন পুরুষ আর দুটি নেই ধ্রুবতারা!”

চোখের পাপড়ি ঝাপটালো।

“অনেকদিনের শখ ছিল তোমায় এইভাবে দেখার।”

গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো নিশু।

“জানোই তো,ধ্রুবতারার কোনো গতি নেই। সে স্থির ও অচঞ্চল। প্রতি রাতে আকাশের এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে বলে তার নাম ধ্রুবতারা। কিন্তু তুমি আমার মনের মধ্যে স্থির হয়ে আসন গেঁড়ে বসেছো তাই তুমি আমার অন্য এক ধ্রুবতারা।”

হঠাৎ ফোনের স্ক্রীন জ্বলে উঠলো। সাইলেন্ট করা। নিশু তাকায়। দেখলো নীলি নামের আইডি থেকে টেক্সট এসেছে। মোচড় দিয়ে উঠলো বুকের ভেতর। আতঙ্ক ভর করলো মনের মধ্যে। কম্পিত হাতে ফোন তুলে নিলো। উপর থেকে দেখলো,”ফুটফুটে একটা বউ পেয়েছো তুমি! কারুকার্যময়ী জবাফুলের নকশায় লাল টুকটুকে রঙের শাড়ি,কোমরের নিচ অব্ধি লম্বা চুল,বেলিফুলের গাজরা,ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক আর প্রশান্তির হাসি,পাশে তুমিও ছিলে; ক্লিন শেভড,ব্ল্যাক টি-শার্ট,রিমলেস চশমা,অ্যাপেল হ্যান্ডওয়াচ। কোথায় দেখলাম জানো?তোমাকে দেখলাম কাল হাজারটা মানুষের ভিড়ে। তোমাদের একসঙ্গে হাসিখুশি দেখে সামনে আসার আর সাহস হয়নি! লুকিয়ে লুকিয়ে দেখলাম! মনপ্রাণ ভরে দেখলাম! দু-চোখ জুড়ে তৃপ্তি নিয়ে দেখলাম! তবে জানো,দূরে থাকলেও আমি অনুভব করেছিলাম তোমার কাছ থেকে ভেসে আসছিল আমার ভীষণ প্রিয় আফটার শেভের গন্ধ! জানোই তো আমার প্রিয় সুবাস! তোমার সব কিছুই তো আমার ভীষণ প্রিয়! ভালোবাসি তোমাকে প্রিয়! এতকিছুর পরেও আমি তোমাকে ভালোবাসি!”

ভেজা ঢোক গিললো নিশু। তার স্বামীকে আরেক মেয়ে ভালোবেসে টেক্সট দিচ্ছে। সেখানে আবার ভালোবাসি বলছে! ভালোবাসি কথাটুকু শুনে ধ্রুব যদি মেয়েটার উপর প্রভাবিত হয় তাহলে? জলপ্রপাতের ন্যায় টুপটুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। উঠে পা বাড়াতেই ধ্রুবর মুখের মধ্যে চুলগুলো আঁচড়ে পড়তেই ঘুম হালকা হয়ে এলো। চোখ খুলতেই দেখলো নিশু বেরিয়ে যাচ্ছে। বুঝে উঠতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো। চোখ বুজে রইলো কতক্ষণ। মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে। আড়মোড়া ভেঙে হামি দিয়ে ফোন হাতে তুলে সুইচড প্রেস করতেই স্ক্রীনের উপর চোখ পড়তেই টেক্সটটা দেখতেই বড় বড় করে তাকালো।
__

হাত-মুখ মুছে ডায়েরিটা তুলে রাখার জন্য কলমটা নিতেই হঠাৎ তার লেখার নিচে কিছু লেখায় চোখ পড়তেই চমকিত নয়নে তাকালো।

“এর পরের জন্মে তুই শুধু আমার হবি ধুতরাফুল!”

“পরের জন্ম বলে কিছু নেই,যদিও থাকে তাহলে এর পরের জন্মেও আমি শুধু ধ্রুব ভাইয়ার হতে চাই!”

বিস্ফোরিত হলো ধূসর। কাঁপতে লাগলো হঠাৎ। এত দুঃসাহস তার ডায়েরি ধরে!

“কতটুকু ভালোবাসলে তুমি আমার হবে শুধুই আমার?”

“ভালোবাসা কি মাপে ধরা যায়?”

চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।

“কত কোটিবার নাম ধরে ডাকলে,হাজার রাত নির্ঘুম কাটালে,অগুনিত প্রার্থনায় তোমার নাম এলে তবেই আমি তোমার হবো?”

“আমি সংখ্যায় ভালোবাসা বুঝি না। তবে ভালোবাসায়,অধিকার,আশ্রয়,নাম ধরে রাখার অদম্য ইচ্ছে থাকে তবে ভেবে নিও আমি ছিলাম থাকব শুধু তোমার! তবে সেটা তুমিই তোমার জন্যই!”

কাঁপতে লাগলো ধূসর। হিতাহিতজ্ঞান ভুলে গেল। দ্রুত পা বাড়ালো ওদের রুমে দিকে। ভেতরে ঢুকতেই দেখলো বিষন্ন মুখে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিশু। আচমকা একটা থাপ্পড় পড়তেই অবিশ্বাস্য নয়নে হতভম্ব হয়ে তাকালো নিশু।

“হাউ ডেয়ার ইউ?”

আতঙ্কিত চোখে তাকালো নিশু। ঘুম ভেঙে গেল দ্যুতির।

“সাহস ভালো তবে দুঃসাহস না!”

ভীত চোখে তাকায় নিশু।

“আমার কিছু ধরবি না তুই!”

অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

“আজকের পর থেকে তুই আমার সামনে আসবি না।”

নিভু নিভু ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইলো দ্যুতি। ঘুমু ঘুমু গলায় জিজ্ঞেস করলো,”কী হয়েছে ভাইয়া?”

“দুঃসাহস!”
_____

চলবে~