#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৫]
সেন্টমার্টিন দ্বীপের পশ্চিম সৈকতে সূর্যাস্ত হয় আয়োজন করে। উত্তাল সাগরের ধারে সূর্যাস্ত দেখার দৃশ্যটা, আহা কি মনোমুগ্ধকর! হৃদয় যেন প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। বিকেলের দিকে হোটেল থেকে বেরিয়ে এসেছে সকলে। শুধুমাত্র সূর্যাস্ত দেখার জন্যে।
চারিদিকে রাতের আঁধারের ঘনত্ব বাড়তেই স্বাধীন গিয়ে কিনে নিয়ে এলো কোরাল মাছ। বারবিকিউ করবে। সাগর পাড়ে বারবিকিউ তৈরির হিড়িক পড়েছে তখন। হারুন চাচা বিশাল সাইজের মাছটার আঁশ ছাড়িয়ে নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কার করলেন। তারপর পর্যাপ্ত মসলা দিয়ে হামিদুল হক ভালো করে মাছটা মাখলেন। ছেলের সঙ্গে প্রতি বছর চাঁদ রাতে ছাদে বারবিকিউ করায় এসবে বেশ অভিজ্ঞ তিনি।
পরের কাজগুলো শিথিল আর স্বাধীন মিলেই করল। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দুজনে মিলে কিনে এনেছে এখানকারই এক দোকান থেকে। বারবিকিউ পোড়াতে পোড়াতে রাত নয়টা সাড়ে নয়টা বাজলো। হারুন চাচার জটিল একটা অভ্যাস রয়েছে। তিনবেলাই উনার ভাত লাগে। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত কিংবা পান্তা ভাত। ভাত উনার লাগবেই। মাঝেমধ্যে ভাতের বদলে মুড়ি কলা দিয়ে চালিয়ে দিতে পারলেও রুটি উনি খেতে পারেন না। হোটেলের দুজন কর্মচারীর সাথে উনার বেশ ভাব হয়েছে। দুপুরে রান্না করতে গিয়ে কিচেনের শেফের থেকেও শিখে এসেছেন নতুন কিছু রেসিপি।
সে যাই হোক, হারুন চাচা এক ফাঁকে গিয়ে একটা বক্সে করে ভাত আনলেন। পোড়া মাছের লেজের অংশটা তুলে নিলেন পাতে। শিথিল আবার মাছের কাঁটা বেছে ঠিকমতো খেতে পারে না। এর সম্পূর্ণ দায়ভার হারুন চাচার। ছোটো থেকে খুব আহ্লাদে বড়ো করেছেন ছেলেটাকে। সবসময় পাতে তুলে দিয়েছেন কাঁটা বিহীন পেটির অংশ।হামিদুল হক কতবার নিষেধ করেছিলেন, “আহা ছেলেটার এসব বদঅভ্যাস তৈরি করিস না তো, হারুন। সবকিছু দিয়েই খাওয়া শিখতে হবে। এত আহ্লাদ না করে কাঁটা কীভাবে বাছতে হয় সেটা শেখা।”
কিন্তু হারুন চাচা তো হারুন চাচাই। কারো কথা শোনার সময় আছে নাকি তার? সবাই গোল হয়ে বালুর ওপরে চাদর বিছিয়ে খেতে বসেছে। হামিদুল হক চাপা স্বরে বললেন,“তুই একটা আহাম্মকই রয়ে গেলি রে, হারুন। সারা জীবন বারবিকিউর সাথে খেয়ে গেলি ভাত।”
গাল ভরতি ভাত চিবোতে চিবোতে হারুন চাচা উত্তরে বললেন,“বাঙালি মানুষ, ভাইজান। ভাত ছাড়া চলে না আমার। ভাতের মতন তৃপ্তিদায়ক খাবার কী আর আছে?”
শিথিল হাসলো,“এর জন্য আপনাকে সেরা বাঙালির একটা অ্যাওয়ার্ড দেওয়া উচিত, চাচা।”
“এই দেশে ভালা মাইনষের কদর নাই। তাই বাইচাঁ থাকতে আমারে পুরষ্কার দিবো কেডায়?”
হামিদুল হক উনার কাঁধে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে বাহবা দিলেন। নিজের প্লেট থেকে কাঁটা বেছে এক টুকরো মাছ ছেলের প্লেটে তুলে দিয়ে হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
সেন্টমার্টিন ভ্রমণের দিনগুলো পরিবার, বন্ধুসহ ভালোই কাটছে শিথিলদের। সেদিন রাতটা খোলা আকাশের নিচে খেয়ে, গল্প করে, আনন্দ করেই কাটলো। যেই হোটেলে তারা উঠেছিল সেই হোটেল আর বদলানোর প্রয়োজন পড়ল না। সবদিক দিয়েই হোটেলের পরিবেশ ভালো হওয়ায় ওখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলো।
পরের দিন সকালে খাবার খেয়েই সকলে মিলে চললো ছেঁড়া দ্বীপে। ছেঁড়া দ্বীপ বাংলাদেশের দক্ষিণের শেষ সীমানা। মূল দ্বীপ বা ভূখণ্ড থেকে কিছুটা আলাদা হওয়ায় স্থানটি ছেঁড়া দ্বীপ নামেই পরিচিত। সেন্টমার্টিন দ্বীপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা হয়তো ছেঁড়া দ্বীপকেই বলা হয়।
এখানে এসে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হলো হামিদুল হক আর হারুন চাচার। তাদের মধ্যে আবার একজনের নাম আইয়ুব আলী। ভদ্রলোক পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে থাকেন। পৈতৃক নিবাস নরসিংদী। ছুটি কাটাতে স্ত্রী, সন্তান নিয়ে দেশে ফিরেছেন তিনদিন হয়েছে। আর ফিরেই সর্বপ্রথম এসেছেন কক্সবাজারে। সেখানে দু রাত কাটিয়ে গতকাল এসে উঠেছেন সেন্টমার্টিনের একটি হোটেলে। সন্তানদেরকে নিজস্ব জন্মভূমি সম্পর্কে না জানালে হয়? ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো হামিদুল হকের। ভদ্রলোক ভালো মানুষ। নইলে আজকাল নিজ জন্মভূমির প্রতি কজনেরই বা এত টান থাকে?
কথাবার্তা শেষ করে নিজ পরিবার নিয়ে সৈকতের পাড় চলে এলেন হামিদুল হক। মানুষের সাড়াশব্দ পেয়ে বালুর উপরে হাঁটতে থাকা লাল রঙের ছোটো ছোটো কাঁকড়াগুলো দৌড়ে চলে গেলো নিজেদের তৈরি ঘরে। পাড়ে ভেসে ওঠা বেশকিছু অর্ধ মৃত এবং জীবিত জেলি ফিস। সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে চলে এসেছে ডাঙায়। শিথিল হাতে নিলো সেসব। কি মশ্রিণ! উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,“দেখো বাবা, জেলি ফিস!”
ছেলের কণ্ঠস্বর আর হাবভাবে মুচকি হাসলেন হামিদুল হক।এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, এটা উনার সেই ছোট্ট শিথিল। যে সামান্য কিছুতেই হেসে ওঠে, চিৎকার করে বাবাকে ডাকে। এগিয়ে এসে ছেলের পাশে দাঁড়ালেন। বললেন,“এভাবে ধরিস না, হাত জ্বলবে।”
বাবার কথা শুনলো শিথিল। এগিয়ে গিয়ে দুই হাতের জেলি ফিস দুটি ছেড়ে দিলো সাগরের নীল, স্বচ্ছ, হীরের মতো চকচক করা পানিতে। এরপর আচমকাই কিছু পানি তুলে ছুঁড়ে মারলো বাবার দিকে। হামিদুল হক চোখমুখ কুঁচকে নিলেন। ধমকে উঠলেন,“বাপের সাথে বেয়াদবি করছিস? দাঁড়া ওখানে। দাঁড়া বলছি।”
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে শিথিল। হামিদুল হক কাঁধের চাদর ওড়নার মতো গলায় প্যাঁচিয়ে দু হাত ভর্তি পানি ছেলের দিকে তেমন করেই ছুঁড়ে মারলেন। কিন্তু সেই পানি ছুঁতে পারলো না শিথিলের গা। সে এক লাফে সরে গেলো। প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো,“এসব তুমি পারবে না। আমার গায়ে পানি ছোঁড়া এত সহজ?”
কথাটা গায়ে লাগলো হামিদুল হকের। দুদিনের ছোকরা কিনা বাপের সাথে ভাব নেয়?এ তো বিশাল বেইজ্জতি! তাই পুনরায় পানি নিলেন হাতে। ফের ছুঁড়লেন। পূর্বের মতো ব্যর্থ হলেন আবারো। মুহূর্তেই লেগে গেলো কে কাকে ভেজাতে পারে নামক বাপ-ছেলের হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা। শিথিল পারলেও হামিদুল হক একবারের জন্যও ছেলেকে ভেজাতে পারলেন না। একসময় ক্লান্ত দেহ নিয়ে ধপ করে বসে পড়লেন তীরে। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলতে ফেলতে বললেন,“হারুনের সাথে থাকতে থাকতে তোর আচার আচরণ একেবারে বাঁদরের মতো হয়ে গেছে।”
শিথিল এগিয়ে এসে দাঁড়াল বাবার সামনে।হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,“হ্যাঁ, এখন তো তাই বলবে। পারোনি যে।”
হামিদুল হক তার হাত ধরলেন না। বরং করে বসলেন ছলচাতুরি। দু হাতে পানি নিয়ে ছুঁড়লেন ছেলের মুখে। প্রবল উৎসাহ নিয়ে বললেন,“বাপ সবসময় বাপই হয়। বুঝেছিস গর্দভ?”
“এটা কিন্তু চিটিং, বাবা!”
মুখ ভার করে বাবার পাশ ঘেঁষে বসে পড়ল শিথিল। পাঞ্জাবীর হাতায় মুখ ঘষলো। এরপর দুজনে একত্রেই হেসে উঠল। হাসতে হাসতে চোখের কোণে জমলো অশ্রু। আনন্দের অশ্রু। দূরে দাঁড়িয়ে অবাক নয়নে বাবা ছেলের এক অপূর্ব মুহূর্তের সঙ্গে পরিচিত হলো স্বাধীন। করে রাখলো সব ক্যামেরাবন্দি। বাবা-ছেলের মধ্যেও এত সুন্দর, বন্ধুসুলভ সম্পর্ক হতে পারে? কই তার বাবার সঙ্গে তো তার এমন সম্পর্ক নেই। বরং স্বাধীনের বাবা সর্বদা ব্যস্ত থাকেন ব্যবসায়িক কাজে। মাসের নির্দিষ্ট একটি সময়ে কিংবা প্রয়োজন হলেই টাকা দিয়ে বাকি সব দায় এড়িয়ে চলেন।মাঝেমধ্যে খাবার টেবিলে দেখা হলেও ভদ্রলোক তাদের সঙ্গে কখনো হেসে কথা বলেন না। টুকটাক সৌজন্যতা আর দায়িত্বের খাতিরেই কিছু হয়তো বলে। বাইশটা বছর এটাকেই তো পরিবার হিসেবে জেনে এসেছিল স্বাধীন!
অথচ তার ধারণা এবং জানা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে দিলো বন্ধু শিথিল। সেটা কোনোভাবেই একটা পরিবার হতে পারে না। পরিবারে থাকতে হয় প্রাণ, সম্পর্কের ভেতরে অদৃশ্য ভালোবাসার মেলবন্ধন। এখানে মন খুলে হাসতে হয়। এখান থেকেই তো শিক্ষার শুরু। স্বাধীনের মনে হলো, শিথিল ছেলেটা তার চেয়েও সুখী। শিথিলের মা না থাকলেও একজন বাবা আছেন। আদর্শ বাবা। যিনি পরিবেশ, স্থান এবং সময় অনুযায়ী বিভিন্ন রূপ ধারণ করেন। কখনো পিতা, কখনো মাতা, কখনো শিক্ষক আবার কখনো বা একজন ভালো বন্ধু।
__________
আবৃত্তির লেখাপড়া লাটে উঠেছে। অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে মামার বাড়িতে তার অবস্থা খালার বাড়ির চেয়েও করুণ। বিশেষ করে সাবেরা বিবি বাড়িতে পা দেওয়ার পর থেকে মামী শাহিনূরের কী হয়েছে কে জানে? ভদ্রমহিলা কুটোটিও নাড়েন না এখন। সারাক্ষণ মিতা এই কর, ওই কর। এমনকি আবৃত্তিকেও কাজে লাগিয়ে দিতে কার্পণ্য করেন না। এইতো দুদিন আগে মিতা কাজে আসেনি। পেট ব্যথার অজুহাতে ছুটি নিয়েছিল ফোনে। ব্যস, শাহিনূর এসেই ইনিয়ে বিনিয়ে বললেন,“আজ আর তোমাকে কলেজ যেতে হবে না। একদিন কলেজে না গেলে কিছু হয় না। নিলুফা আপার কাছে শুনেছি তুমি নাকি ভালো রাঁধতে পারো? ওখানেও তো তুমিই রাঁধতে। আজ মিতা আসবে না। রেঁধে ফেলো তো।”
আবৃত্তি চুপচাপ সেকথা মেনে নিলো। মেনে না নেওয়ার কোনো উপায়ও অবশ্য নেই। সে তো সর্বদা ভিতু আর দুর্বল মেয়ে। তাই কলেজে গেলো না। সকালের নাস্তা, দুপুর আর রাতের খাবার একা হাতেই রান্না করল। মাঝেমধ্যে শাহিনূর এসে শুধু তদারকি করে গেলেন। এরপর থেকে সকালের নাস্তা তৈরির দায়িত্ব পড়েছে আবৃত্তির উপর। মিতা মেয়েটা আসে সকাল নয়টার পর। তখন কী নাস্তা তৈরির সময়?
তার মধ্যে সাবেরা বিবি কেমন যেন। বৃদ্ধার দু পায়ে বয়সজনিত ব্যথা। ডাক্তারের ভাষ্যমতে, বয়সের ভারে হাড় ক্ষয়ে গিয়েছে। ডায়াবেটিসের রোগী। মাঝেমধ্যে রাতবিরেতে প্রেশার ওঠে। তাই সুশ্রীর ঘর থেকে নিজের মায়ের ঘরে আবৃত্তিকে পাঠিয়ে দিয়েছেন শাহিনূর। সেবা করার জন্য। যেন বিনে পয়সায় বাড়ির কাজের লোক সে। মোজাম্মেল হোসেন বিষয়টি লক্ষ্য করে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,“সুশ্রীর সাথে থাকছিল থাকতো। মায়ের ঘরে কেনো আবার পাঠাতে গেলে ওকে? মা নয়টার আগে আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু আবৃত্তি তো স্টুডেন্ট মানুষ। ওর তো রাত জেগে পড়তে হয়, তাই না?”
শাহিনূর চট করে মিথ্যা বললেন,“তোমার কী মনে হয় আমি জোর করে ওকে মায়ের ঘরে পাঠিয়েছি? ওর নিজেরই সুশ্রীর সঙ্গে থাকতে ভালো লাগছিল না। সারা ঘরে জিনিসপত্র ছড়িয়ে রাখে সুশ্রী। রাত জেগে পড়ে।তাই আমার কাছে এসে আবৃত্তি বলতেই আমি মায়ের ঘরে ওর থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম।”
শাহিনূর ভালো করে মিথ্যা বলতে পারেন না। বিশেষ করে স্বামীর সামনে। তাই মোজাম্মেল হোসেন সহজেই বিষয়টি ধরে ফেললেন। কিন্তু বলতে পারলেন না কিছু। কোন পুরুষ কি আর চায় অযথা ঘরণীর সঙ্গে ঝগড়া ঝামেলায় জড়াতে?
রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না আবৃত্তির। কদিনেই পুরো ফ্ল্যাটটা তার কাছে নরক মনে হচ্ছে। যতক্ষণ না বৃদ্ধা ঘুমান ততক্ষণ বিরতিহীন উনার পা টিপতে হয়। আবার রাতবিরেতে হঠাৎ ব্যথা উঠলে ঘুমন্ত আবৃত্তির ঘুম ভাঙাতেও ভুলেন না। একবার ঘুম ভাঙলে পরবর্তীতে আর ঘুমাতে পারে না আবৃত্তি। তার উপর সে আবার ফজরের নামাজ পড়ে। সকালের নাস্তা তৈরি করে এরপর কলেজ যেতে হয়। কলেজ থেকে ফিরে আবার নেমে পড়তে হয় ঘর পরিষ্কারের কাজে। বৃদ্ধা প্রচুর পান খায়। পানের পিক কিংবা সুপারি বিছানা বা মেঝেতে ফেলে রাখেন। গোসল করে কাপড় ধৌন না। মাথায় উকুনে ভরতি। ছোটো মেয়ের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছেন সম্ভবত। বিকেলে বসে মাথার উকুন সব তাকেই আনতে হয়।
উফ! এসব কী আবৃত্তির কাজ? সে কেনো করবে? এ ঝামেলা তো শ্বশুরবাড়িতেও মনে হয় না পোহাতে হয় মেয়েদের। ওদিক দিয়ে আবার বৃদ্ধা সেয়ানা ভীষণ। নিজের নাতি নাতনিদের দিয়ে তিনি কখনোই কোনো কাজ করান না। অথচ খাটের নিচের পানির বোতলের জন্যও আবৃত্তিকে পড়ার মাঝখান থেকে উঠিয়ে আনেন। অগত্যা কিছু বলতেও পারে না মেয়েটা। যদি মাথার উপর থেকে ছাদ চলে যায়?
দিনে পড়ার সুযোগ পায় না সে। বৃদ্ধা আলো নিভিয়ে দেন। আলোতে নাকি উনার ঘুম আসে না। সকলে ঘুমিয়ে গেলে বাধ্য হয়ে ড্রয়িং রুমের ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়তে বসে আবৃত্তি। একবার কলেজটা শেষ হোক। এরপর আবৃত্তি আর এখানে থাকবে না। কিছুতেই না।
আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এই দিনে অন্যান্য দিনের তুলনায় বাড়িতে খুব ভালো আয়োজন হয়। দুপুরের রান্নাগুলো সব আবৃত্তি নিজেই করল। বেশিরভাগ রান্না সে শিখেছে খালার কাছে। তার মধ্যে পোলাও, মাংস আর পায়েস শিখেছে পাশের বাড়ির এক চাচীর থেকে। ভদ্রমহিলা খুব ভালো রান্না জানতেন। উনার বাপের বাড়ি ছিল বরিশাল আর স্বামীর বাড়ি চট্টগ্রাম। তাই হয়তো রান্নার হাত একটু বেশিই ভালো ছিল।
রোজকার মতো বিকেলের দিকে শাহিনূরকে চা দিয়ে ঘরে এলো আবৃত্তি।সাবেরা বিবি পান চিবোতে চিবোতে বলে উঠলেন,“হওড়ার তেল দিয়া আমার পা দুইডা মালিশ কইরা দে। কহন ধইরা চিলিক মারতাছে।”
ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসে উঠলেও বাইরে তা প্রকাশ করল না আবৃত্তি। দাঁতে দাঁত চেপে রান্নাঘর থেকে সরিষার তেল এনে মালিশ করতে লাগলো রুক্ষ পায়ে। সন্ধ্যা পর্যন্ত সেসব চললো। একটু পরপর বৃদ্ধা আহ উহ শব্দ করে পা বাঁকিয়ে বললেন,“এখানে দে, ওখানে দে।”
আজান পড়তেই এর থেকে নিস্তার মিললো আবৃত্তির। অযু করে নামাজ আদায় করে বই নিয়ে পড়তে বসলো। সাবেরা বানু চোখমুখ কুঁচকে নিলেন,“পড়তে বইলি যে? পা টিপার কী হইবো? নামাজের লাইগ্গা না ছাড়ছি তোরে।”
হঠাৎ করেই যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো আবৃত্তির। খালা যাই করুক, কখনো পড়ার মাঝখানে বাঁধা দিতো না তাকে। তাছাড়া গতকাল ইংরেজি ক্লাসে পড়া না পারায় সকলের সামনে দাঁড় করিয়ে অনেক কথা শুনিয়েছেন স্যার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বললো,“আমার অনেক পড়া বাকি আছে। আপনি মিতা আপাকে কিংবা মিশমিকে ডেকে বলুন।”
“তুই থাকতে হেগো ডাকমু ক্যান? হেরা কী তোর মতো আজাইরা?”
“আমিও আজাইরা না। আমার পড়া আছে। তাছাড়া আমি আপনার নার্স নই যে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা সেবা করবো।”
অবাক হলেন বৃদ্ধা। হায় হুতাশ করে চেঁচিয়ে উঠলেন, “নূর! কই গেলি রে নূর! দেইখা যা। দেইখা যা তগো বাড়িতে থাকা মাইয়া আমারে কী কয় এসব!”
চেঁচামেচিতে শাহিনূর আর মিশমি দৌড়ে এলো। মাকে এখনো চিৎকার করতে দেখে শাহিনূর জিজ্ঞেস করলেন,“কী হয়েছে, মা? এভাবে চিৎকার করছো কেনো?”
বৃদ্ধা সবটা বললেন। সাথে একটু বাড়িয়েই বললেন, “এই মাইয়া আমারে খোডা দেয়। একটু পা টিপতে কইছি দেইখা কত কথা কইয়া দিলো। আমি কি এমনি এমনি পা টিপতে কইছি?”
শাহিনূরের চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট। কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,“তোমার থেকে এমনটা আশা করিনি, আবৃত্তি। গুরুজনদের সঙ্গে এ কেমন আচরণ?”
আজ অদৃশ্য কোনো কারণে আবৃত্তির ভেতরের সব ভয় ডর মিলিয়ে গেলো। নরম স্বরে বললো,“সারাদিন বাড়ির সমস্ত কাজ আমি করেছি, পুরো বিকেল উনার পা মালিশ করে দিয়েছি। রাতবিরেতে উনার জন্য ঘুমাতে পারি না, তখনো হাত-পা টিপে দিতে হয়। দ্রুত আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ায় পড়তে পারি না। কাল স্যারের কাছে অনেক কথা শুনেছি— এখন কী আমি পড়বো না? আমি তো নার্স নই যে সারাক্ষণ উনার সেবা করবো।যখন আমি ছিলাম না তখন এসব কে করেছে? আমার কেউ নেই বলেই বাধ্য হয়ে আপনাদের এখানে থাকতে হচ্ছে। তাই বলে সারাদিন এসব করবো? আমি লেখাপড়া করবো না?”
একনাগাড়ে বলা কথাগুলো শুনে শাহিনূর চমকালেন। এই মেয়েকে তো তিনি বোবা ভেবেছিলেন। আবৃত্তি ফের মিনমিনে স্বরে বললো,“আমায় নিয়ে যে আপনাদের সমস্যা হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি। তাই সেজো মামার সঙ্গে আরেকবার এ বিষয়ে কথা বলে দেখবো। আমায় যেন উনি হোস্টেলে পাঠিয়ে দেন।”
আঁতকে উঠলেন শাহিনূর। স্বামীর কান পর্যন্ত কথাটা গেলে মহা ঝামেলা হয়ে যাবে। কিছু বলবেন তার আগেই মিশমি মুখ বাঁকিয়ে বললো,“এই বুড়ি এমনই। কারো শান্তি দেখতে পারে না। এর আগেও একটা কাজের লোক এই বুড়ির নির্যাতনে চলে গিয়েছে। তুমি আমার ঘরে এসো তো, আপু। তোমাকে এর কথা আর শুনতে হবে না।”
নাতনির কথায় সাবেরা বিবি তেতে উঠলেন। এ তো ঘর শত্রু বিভীষণ!
চলবে ________
#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৬]
কবির বর্ণনার মতো সুন্দর একটি দিন। ধরিত্রী জুড়ে খেলা করছে ঝলমলে রোদ্দুর। আকাশে উড়ে বেড়ানো শঙ্খচিল আজ প্রচন্ড ক্ষুধায় কাতর হয়ে খুঁজে ফিরছে শিকার। তারপর বছর দেড়েক পেরোলো। লেখাপড়ার ব্যস্ততায় শিথিলের অবস্থা নাজেহাল। তৃতীয় বর্ষ শেষ করে চতুর্থ বর্ষে উঠেই সকল ছলচাতুরি ছেড়ে এক দফা লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করতে হয়েছে ছেলেটাকে।
ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, ক্যাম্পাস, টিউশন, সবকিছুতেই যেন হাঁপিয়ে উঠেছে শিথিল। এবার একটু শান্তি আর স্বস্তি দরকার। কিন্তু সেই শান্তি আর স্বস্তির বদলে তার মনটা আজ ভীষণ উদাস।
ইমন, তৌসিফ, রিজভীর গ্ৰাজুয়েশন শেষ হয়েছে মাস তিনেক আগে। রিজভী অবশ্য ভেবে রেখেছে, মাস্টার্স সে করবে।তবে বিপত্তি বেঁধেছে ইমন আর তৌসিফকে নিয়ে। ওরা ওদিকে আর যাবে না। ইমন কোনো এক প্রাইভেট কোম্পানিতে মোটামুটি ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। ভবিষ্যতে পদোন্নতি পাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। অযথা আর অত লেখাপড়া করে হবেটা কী? তাছাড়া প্রেমিকাও বছর তিনেক ধরে অপেক্ষায় বসে আছে। লুকিয়ে চুপিয়ে ভাঙছে অজস্র বিয়ে। মেয়েটাকে এত অপেক্ষা করানো মোটেও কোনো ভালো পুরুষ এবং প্রেমিকের কাজ হতে পারে না। তাই তো নাওয়া, খাওয়া ভুলে মাস দুয়েক শুধু চাকরির পেছনেই ছুটে বেরিয়েছে সে। ওদিকে তৌসিফের চিন্তাভাবনা ভিন্ন। স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে যাবে সে। কানাডায় নাকি তার কোন মামা থাকে। ওখানে গিয়েই উঠবে। উচ্চশিক্ষা নিবে।
বন্ধুদের সাফল্যে আনন্দিত হওয়া উচিত। কিন্তু শিথিলের সেই আনন্দ হচ্ছে না। তার ভীষণ মন খারাপ। যেই ছেলেগুলোর সঙ্গে সে এই ফ্ল্যাটে তিন বছর ধরে ছিল— তারা এই ফ্ল্যাটে আর থাকবে না। চাইলেই আর ঝগড়া করা হবে না। করা হবে না রাত জেগে গল্প। একজনের দোষ আরেকজনের উপরেও চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। ওরা চলে যাবে নিজ নিজ জীবনের গন্তব্যে। অথচ শিথিলকে এখানে থাকতে হবে। আরো এক বছর। কিংবা তার চেয়েও আরেকটু সময় বেশি!
এশার পরপর ঘরে ফিরে পড়তে বসে শিথিল। সেই ছোটোবেলার অভ্যাস হঠাৎ করেই আবার গড়ে উঠেছে তার। ইমন ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। ব্যাগপত্র সব গোছানো শেষ। আগামীকালকের মধ্যেই ফ্ল্যাট ছাড়বে সম্ভবত। জিজ্ঞেস করল,“কী রে, মন খারাপ?”
শিথিল পেছন ফিরে তাকালো না। দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,“আমার কী আর প্রেমিকা আছে নাকি যে মন খারাপ হবে?”
“আমরা কী প্রেমিকার থেকে কোনো অংশে কম?”
“গে নাকি ভাই?”
শব্দ করে হেসে উঠল ইমন। এগিয়ে এসে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলো। তারপর হঠাৎ করেই কিছুক্ষণ নিরব রইল। উদাস কণ্ঠে বললো,“আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর একটা সময় আমি কাটিয়েছি ঢাকা শহরের এই দুই কামড়ার চার দেয়ালের মাঝে। কত হাহাকার, সুখ, দুঃখ, হাসি, চোখের পানির সাক্ষী যে আছে এই দেয়াল আর ভেতরে থাকা মানুষগুলো! এসব আমি কখনো ভুলতে পারবো না।”
তারপর আবারো ক্ষণকালের জন্য চুপ হয়ে গেলো ইমন। আজ নিজের অনুভূতি সে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদায়বেলা অনেক সহপাঠী মেয়েদের একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখেছে সে। কিন্তু একটা ছেলেও কাঁদেনি। এই যে আজ যেমন সে নিজেই কাঁদতে পারছে না। অথচ ছেলেদের বন্ধুত্বই তো হয় সবচেয়ে গভীর, বিশেষ। একে অন্যের জন্য বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেও তারা দু’বার ভাবে না। অথচ! স্লান হাসলো ইমন,“এটাই জীবনের নিয়ম। জীবন কিংবা সময় কোথাও কারো জন্য থেমে থাকে না। তাদের সাথে আমাদেরও কাঠের পুতুলের মতো চলতে হয়। কিছু করার নেই। এই দুই কামড়ায় বন্ধুদের নিয়ে থাকার সময় আমার ফুরিয়েছে। তোরও একদিন ফুরাবে। সবারই ফুরিয়ে যায়। তবে খুব মন খারাপ হলে কিংবা ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা, উড়ে যাওয়া সিগারেটের ধোঁয়ায় তোদের কথা সবসময় আমার মনে পড়বে। এটাই জগতের নিয়ম। ভালো সময়ে বন্ধুদের মনে পড়তে নেই। যেমন সুস্থ শরীর নিয়ে মানুষ ওষুধ সেবন করে না?”
শিথিল মৃদু হাসলো। দুঃখ প্রকাশ করতে কিংবা আবেগ দেখাতে সে পারে না। এসব কিছু একান্তই তার নিজের। ভেতরের বাগিচায় চাপা পড়ে থাকে কোথাও। সহজ স্বরে ঠাট্টা করে বললো,“প্রেম করা মানুষরা সবকিছুতে এত আবেগ দেখায় কেনো? বুঝি না। তোদের জন্য আমার একদম কষ্ট হচ্ছে না। আমার শুধু চিন্তা হচ্ছে, পরের রুমমেটগুলো কেমন হবে? আদৌ ওদের সঙ্গে থাকতে পারবো তো? তোরা তো জানিসই, আমি কত খুঁতখুঁতে স্বভাবের মানুষ!”
ইমন তাকিয়ে রইল শিথিলের পানে। তবে অবাক হলো না। এই ছেলেটাকে সে চিনে। ভাঙবে তবু মচকাবে না। কলিং বেল বেজে ওঠার শব্দ হলো। রিজভী, তৌসিফ ঘরে নেই। কোথায় গিয়েছে কে জানে? আজ আর দরজা খোলার জন্য ইমনকে ধমকিয়ে পাঠালো না শিথিল। বসা থেকে নিজেই উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আচমকা ইমন এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। শিথিল থমকালো। ধমক দিলো,“ছিঃ, ছিঃ! একা ঘরে একটা ছেলেকে পেয়ে কী করছিস?”
কয়েক সেকেন্ড পর ছেড়ে দিয়ে তার বুকে আলতো কিল বসিয়ে দিলো ইমন। যেতে যেতে বললো, “আমার হবু বউ আছে, ভাই। পরে যাতে আফসোস না করিস তার জন্য বড়ো ভাই হিসেবে সান্ত্বনা দিয়ে গেলাম।”
অগোচরে মুচকি হাসলো শিথিল। ইমন গিয়ে দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড়িয়ে একে একে ভেতরে প্রবেশ করল স্বাধীন, সজীব, তুহিন, শান্ত। হেসে একত্রে বলে উঠল,“বিদায় উপলক্ষ্যে আজ সারারাত পার্টি চলবে, ব্রো।”
এদের হঠাৎ আগমনে ইমন ভড়কে গেলো। পেছন পেছন তৌসিফ আর রিজভীও এলো। দু হাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ নিয়ে।
মুহূর্তেই ছোট্ট নিরব ড্রয়িং রুমটা ভরে উঠল চিৎকার, চেঁচামেচি আর আনন্দে। এখানেই আজ রান্না হবে। বিরিয়ানি। প্রায় দুই বছর ধরে পিকনিক করা হয় না। সেই যে সেই কবে বিরিয়ানি রাঁধতে গিয়ে স্বাধীনের চক্করে খিচুড়ি রেঁধে ফেলেছিল ইমন এরপর আর করা হয়নি পিকনিকের আয়োজন।
শিথিল সবাইকে একপলক দেখে প্রশ্ন ছুঁড়ল,“তোদের কী লেখাপড়া নেই? এই অসময়ে এখানে ঝামেলা করতে এসেছিস কেনো?”
তার কথায় পাত্তা দিতে দেখা গেলো না কাউকে। শান্ত বললো,“লেখাপড়া তোর আর তুহিনের জন্য। তোরা কর গিয়ে।”
“একজন কম কম লাগছে। আরফিন কোথায়?”
“জানি না। ইদানিং হুটহাট কোথায় যেন হারিয়ে যায়। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে না। বিকেল থেকে রুমেও নেই। ফোন করেছিলাম কিন্তু ধরেনি। এরপর ম্যাসেজও দিয়েছিলাম কিন্তু রেসপন্স করেনি।” —সজীব বললো।”
তুহিন বিজ্ঞের মতো বললো,“আমার মনে হয় আরফিন প্রেমে পড়েছে। একবার শান্তর কাছে ধরাও পড়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন কথা বলে কনভেন্স করে ওই ব্যাপারটা ওখানেই ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছিল। তবে ওর হাবভাব সুবিধার নয়। ক্লাস ফাঁকি দেয়, রাত জেগে ফোনালাপ করে। গত সেমিস্টারে সিজিপিএ লো হয়ে গিয়েছে দেখলাম।”
স্বাধীন ভাবলেশহীন কণ্ঠে বললো,“তোর কথা যদি সত্যি হয় রে, তুহিন্না! তাইলে আরফিইন্নার কপালে বিশাল দুঃখ আছে।”
শান্ত পাঁশুটে মুখে বললো,“দুইদিন পর যহন কাঁদতে কাঁদতে আইবো তখন ওর পাছায় আমি দুইটা লাত্থি মারমু দেখিস।”
ইমন চোখমুখ কুঁচকে নিলো,“শ্লা তোরা প্রেম করিস না বলে আর কী কেউ করতে পারবে না? সবাই কিন্তু ছ্যাঁকা খায় না।”
“তুমি তো মিয়া ভুলবশত জিতে গেছো। নেহাৎ আগে আগেই বান্ধবীর সাথে আকাম ঘটিয়ে ফেলেছিলে তাই বেচারি ছাড়তে পারেনি তোমায়।”
ইমন চেতে গেলো স্বাধীনের কথায়,“একদম বাজে কথা বলবি না। সিমি খুবই অনেস্ট, লয়্যাল আর ভালো একটা মেয়ে। আমরা কখনো একে অপরকে জড়িয়ে পর্যন্ত ধরিনি।”
“ভালো মেয়েরা কখনো প্রেম করে না, ব্রো। সাড়ে তিন বছর ধরে একটা সম্পর্ক এমনি এমনিও চলে না। সব জানি আমি।”
ব্যাপারটা এবার হাতের বাইরে চলে যাওয়ার মতো অবস্থা। ইমন নিজের ব্যক্তিগত নারী সম্পর্কে অন্য পুরুষের মুখে কোনো কথা সহ্য করতে পারে না। শিথিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টা করতে বিরক্ত হয়ে বললো,“থাম তো তোরা। অন্যের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে কথা বলে ঝামেলা না বাঁধালেই হচ্ছে না?”
ইমন মুখ ভার করে বললো,“ওকে বল। সব বিষয়ে এত পাকনামি কেনো করে?”
“নির্দিষ্ট কাউকে বলিনি। সবাইকেই বলেছি।”
বাকিরাও নিমিষেই প্রসঙ্গ বদলে ফেললো। শুরু করে দিলো রান্নার আয়োজন। তবে আজ আর আসরটা তেমন জমলো না। গিটারিস্ট আরফিনের বিভিন্ন সুর আন্দোলিত করল না কাউকে। উৎসুক হয়ে গলা ছেড়ে গানও গাইল না কেউ। টুং টাং সুর ছাড়া গান হয় নাকি?
____________
দিনটি সোমবার। ইমনরা পরেরদিন ঠিক দুপুরের সময় যে যার মতো বিদায় নিয়ে চলে গেলো। যাওয়ার আগে অবশ্য রুমমেটও ঠিক করে দিয়ে গেলো। ছেলেগুলো ওদেরই জুনিয়র এবং পরিচিত। তাদের সঙ্গে এখনো আলাপ হয়নি শিথিলের। ক্লাস করে ঘরে ফিরে গোসল সেরেই সে বেরিয়ে এসেছে। চাবি দিয়ে এসেছে দারোয়ানের কাছে। ছেলেগুলো এলে যেন দিয়ে দেয়।
চারিদিকে তখন বসন্তের আগমনী উৎসব। বাসন্তী রঙের শাড়ি, পাঞ্জাবী পরিধিত পুরুষ রমণীর ঢল নেমেছে পথে প্রান্তরে। কেউ মেতে আছে বইমেলা নিয়ে আবার কেউ বা মেতেছে বসন্ত উৎসবে। শিথিলের সেসবে ধ্যান জ্ঞান নেই। বইমেলায় সে এখনো যায়নি। এখনকার বইমেলা তার ভালো লাগে না। ছেলেবেলায় বাবার হাত ধরে বহুবার গিয়েছিল। তখন অবশ্য অলিতে গলিতে ক্যামেরা, মাইক হাতে ভুলভাল সংবাদ ছাপানো যত্রতত্র সাংবাদিক ছিল না। ছিল না লেখার মানের চেয়ে স্যোশাল মিডিয়ার ফলোয়ার দেখে যা তা বই বের করার অত তাগিদ। তখন মেলায় আসতো জাদুকরেরা। তাদের নিয়ে মেতে উঠতো পড়ুয়া মানুষের দল। সংবাদে প্রচার হতো মানসম্মত লেখা। এখন অবশ্য তা হয় না বললেই চলে। সচেতন, জ্ঞানী, পড়ুয়া প্রকাশক এবং পাঠকের ভীষণ অভাব!
সাহিত্যের এই অধঃপতন দেখে আজকাল বাবা ভীষণ আফসোস করেন। এইতো সেদিন এ বিষয় সম্পর্কেই তাকে বিশাল বড়ো একটা চিঠি লিখে পাঠালেন। শিথিল তা মন দিয়ে পড়েছে। না পড়ে উপায় নেই। বাবা ছাড়া এই ভালোবাসাটা কোথায় আর পাবে সে? তবে বিপরীতে শিথিল কোনো চিঠি লিখেনি। তার চিঠি লিখতে ভালো লাগে না। এই জন্য বাবা তাকে নিয়ে প্রায় সময় মজা কুড়োয়। মাঝেমধ্যে হতাশ হয়ে বলেন, “স্যোশাল মিডিয়া নিয়ে পড়ে থাকা ছেলে- মেয়েগুলো চিঠির মর্ম বুঝলো না। সবকটা গর্দভ।”
শিথিল সেসব শুনে শব্দহীন হাসে। চিঠির মর্ম বুঝতে হলেও এই শহরে ডাক পিয়নের যে ভীষণ দরকার! সেই ডাক পিয়নই তো কোথাও নেই। তাই সে চিঠির উত্তর দেয় ম্যাসেঞ্জারে। কখনো বা হুট করে বাড়িতে চলে যায়। বাবার মুখোমুখি বসে কথার ফাঁকে ফাঁকে বলে দেয় মনের সকল কথা।
রমনা পার্কে কপোত কপোতীর ভিড়। তাই বন্ধুদের সঙ্গে চন্দ্রিমা উদ্যানে এসেই গাছের ছায়ায় বসেছিল শিথিল। আজকের আড্ডার মধ্যমণি আরফিন। আগাগোড়া তাকে দেখলো শিথিল।কেমন মনমরা হয়ে আছে। চোখ দিয়ে উপচে পড়তে চাইছে নীল বেদনার দল। তার প্রিয় গিটারটা আজ বড়ো অযত্নে স্বাধীনের দুহাতের আগলে পড়ে রয়েছে। সেদিকে আরফিনের ধ্যান নেই। অথচ গিটারের অযত্ন সে সহ্য করতে পারে না।স্বাধীনের সাথে যে এ নিয়ে কতবার ঝগড়া লেগেছিল এই শান্তশিষ্ট ছেলেটার! তার হিসেব নেই।
সজীব প্রথম মুখ খুললো,“গতকাল রাতে তুহিনের কথাটাই মিলে গেছে। ব্যাটা দুই বছর ধরে আমাদের অগোচরে প্রেম করে ফাইনালি দুদিন আগে ছ্যাঁকা খেয়েছে।”
শিথিল জিজ্ঞেস করল,“কথা কী সত্য?”
আরফিন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মলিন হেসে লেকের দিকে তাকিয়ে রইল। বিকাল রোদে হীরার মতো চিকচিক করছে পানি। বসন্তের বাতাসে ঢেউ খেলছে। সময় নিয়ে সে মাথা নাড়াল। ভারি কণ্ঠে বললো,“আজ ওর গায়ে হলুদ। কাল সম্ভবত বিয়ে। ছেলে কর্পোরেট অফিসার। মাস শেষে মোটা অংকের টাকা মাইনে। শহরে উচ্চবিত্ত পরিবার নিয়ে বসবাস। তাই বাবার মুখের উপর আর না করতে পারলো না।”
কত সহজে অবলীলায় কথাগুলো বলে দিলো আরফিন! অথচ বুকে জমে রইল হাজারো বেদনা। বন্ধুরা খুব সহজেই তা টের পেলো। এই জন্যই তো তারা বন্ধু।
আরফিনের বাবা নেই।বছর তিনেক আগে কলের কাজ করতে গিয়ে মারা গিয়েছেন।ভদ্রলোক দিনমজুর ছিলেন। যখন যা পারতেন তা করেই কোনোমতে ছয় সদস্যের পরিবার চালাতেন। আরফিনদের পরিবারে অভাব অনটন নিত্যদিনের সঙ্গী। বাবা মারা যাওয়ার পর তা আরো বেড়েছে। চার ভাই-বোনদের মধ্যে সে দ্বিতীয়। বড়ো বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বোন জামাই রাজমিস্ত্রী। সংসারে তিন তিনটে ছেলে-মেয়ে। অথচ দুলাভাই ভীষণ লোভী। শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সাহায্য করা তো দূরে থাক বরং যৌতুক নেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। বোনটাও হয়েছে যা তা। পরিস্থিতি বুঝতে চায় না। মা কতবার যে বোঝালো,“তোর বাপ নাই। সংসার কেমনে চলতাছে সবই তো জানোস। তারপরেও তগো আবদার আমি কেমনে মিটামু? আমি কি কামাই করি?”
অথচ তবুও সে বোঝে না। মায়ের কথায় বিরক্তিতে মুখ কালো করে রাখে। ছোটো দুই ভাই-বোন লেখাপড়া করছে। ভাইটা গত বছর সবে কলেজে উঠেছে আর সবার ছোটো যে বোনটা, সে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। মা বলেছেন, মাধ্যমিক দিলেই ভালো পাত্র পেলে তাকে বিয়ে দিয়ে দিবেন। বাপ মরা দরিদ্র পরিবারের সন্তানের আবার অত লেখাপড়া কীসের? আরফিনের গল্পটা সবার চেয়ে ভিন্ন। আজকের অবস্থানে আসতে তাকে কষ্ট করতে হয়েছে। অনেক চড়াই উৎরাই পাড়ি দিতে হয়েছে। সংসারের দায়িত্বও এসে পড়েছে তার উপর। যে কটা টিউশন করায় তার থেকে প্রাপ্ত টাকা কিছুটা রেখে বাকি সব পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে। আর মাসের শেষ দিকে নিজেরই চলতে হয় টানাটানি করে। তবুও কেউ সেসব জানতে পারে না। আরফিন জানতে দেয় না। তার কষ্ট তার নিজের। সে বিশ্বাস করে, কষ্টের মধ্যেই রয়েছে স্বস্তি। সফলতার দিন একদিন আসবে। আঁধার কেটে আলো আসবেই আসবে।
তবে দীপ্তির সঙ্গে কীভাবে যে জড়িয়ে গেলো! সে লম্বা এক গল্প। সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে দীপ্তি তার এক বছরের জুনিয়র। একই ডিপার্টমেন্ট। প্রথম যেদিন ফ্রেশার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিল তখন দেখা হয়েছিল ক্যাম্পাসে। নিজ ডিপার্টমেন্ট খুঁজে না পেয়ে মেয়েটা সাহায্য চেয়েছিল তার কাছে। আরফিন তখন সাহায্য করে। সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দেয় ক্লাসরুম। পরের সপ্তাহে আবারো দেখা। এরপর ক্যাম্পাস, হল বিল্ডিং, ক্যান্টিন ঘুরিয়ে দেখায়। মাঝেমধ্যে পড়া না বুঝলে সাহায্যও অবশ্য করেছে।
মেয়েটি রূপবতী। পুরুষ মনে রূপবতীর জন্য প্রেম আসা কঠিন কিছু নয়। তাই আরফিনের মনেও এসেছিল। কিন্তু প্রকাশ সে করেনি। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো অন্যায়। কিন্তু প্রথম হাত বাড়ালো দীপ্তি নিজেই। কীভাবে কীভাবে যেন কেটে গেলো দুটি বছর। অথচ তাদের প্রেমকথন চাপা পড়ে রইল রমনা, গুলিস্তান, নীলক্ষেত, বইমেলা, লাইব্রেরি আর গাজরার ভাঁজে। কেউ জানতেই পারলো না সেকথা! সেই দীপ্তির নাকি কাল বিয়ে। অন্যের জন্য বউ সাজবে মেয়েটা।
বন্ধুর দুঃখ কারো সহ্য হলো না। শিথিল বলে উঠল, “প্রেম করার সময় বাপের মতামত, ইচ্ছা অনিচ্ছার দাম যখন দেয়নি তাহলে বিয়ের সময় কেনো বাপের কথায় ভেজা বিড়াল হয়ে বিয়ে করবে? আর তুই বা মুখ এমন করে রেখেছিস কেনো, ভাদাইম্মা? পুরুষ মানুষের এমন করে থাকা মানায়?”
“তো কী করবো? দুঃখ সারাতে সময় তো লাগে।”
“চল গিয়ে তুলে নিয়ে আসি। তোরা দুইটাই তো প্রাপ্ত বয়স্ক। সর্বপ্রথম কোর্ট ম্যারেজ করাবো। এরপর মেয়ের বাপ এমনিতেই মেনে নিবে। না মানলে পায়ে ধরে কান্না করবি। ঠিক শরিয়াহ মতে বিয়ে দিয়ে দিবে।”
স্লান হাসলো আরফিন। শান্ত তৎক্ষণাৎ ধমকালো, “বেহায়ার মতো হাসিস ক্যান? পাগল হয়ে গেছিস? শিথিলের আইডিয়া তো খারাপ না।”
স্বাধীন মাথা নাড়াল,“ইয়েস ইয়েস। শিথিল ইজ রাইট।”
আরফিন বললো,“বাবা তো শুধুই একটি মাধ্যম মাত্র। দীপ্তি নিজেই রাজি। ফেসবুকে দেখলাম মেহেদী রাঙা হাতের ছবি আপলোড দিয়েছে। মুখে কি অমায়িক হাসি! যে নিজ থেকে চলে যায় তাকে কোনোভাবেই বেঁধে রাখা যায় না।”
সূর্য পশ্চিমাকাশে কিছুটা হেলে পড়েছে। স্বাধীন গিটারে শব্দ তুললো। দু হাতে ভর করে বসে আছে শিথিল। হঠাৎ করেই সে গেয়ে উঠল,
‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম
প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়
এমনই মায়ার ছলনায়…
আড্ডা জমে উঠল। সঠিক সময়ে সঠিক গানের জন্য বাহবা দিয়ে উঠল শিথিলকে। কিন্তু শিথিল হঠাৎ থেমে গেলো। হয়ে উঠল অন্যমনস্ক। তার ধ্যান, জ্ঞান, দৃষ্টি কোথাও হারিয়ে গেলো। কারো কথা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছালো না। এভাবে কত সময় পেরোলো কে জানে? আরফিন হয়তো একসময় তা খেয়াল করল। তার বাহুতে ধাক্কা মেরে বললো,“তোর আবার কী হলো? কোথায় হারিয়ে গেলি? শিথিল! এই শিথিল!”
হুঁশ ফিরল শিথিলের। কিন্তু দৃষ্টি সরলো না।পূর্বের মতো স্থির রইল। শুকিয়ে এলো গলা। শুকনো ঢোক গিলে আচমকাই বলে বসলো,“আমার কেমন কেমন যেন হচ্ছে। বুক ধড়ফড় করছে। মনে হচ্ছে…
“কী মনে হচ্ছে?”
“মনে হচ্ছে, প্রেমে পড়ে যাচ্ছি।”
“কার? দূর বাল, কথা শেষ কর ভালো করে।”
অধৈর্য হয়ে পড়ল স্বাধীনসহ বাকিরাও। শিথিল কথা শেষ করল,“একটা মেয়ের।”
সবাই অবাক হলো। সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল,“হোয়াট!”
ওদের বিস্ময়ে পাত্তা দিতে দেখা গেলো না শিথিলকে। সে চোখ বুঁজে পুনরায় গলায় সুর তুললো,
এরপর বিষণ্ন দিন বাজে না মনবীণ,
অবসাদে ঘিরে থাকা সে দীর্ঘ দিন,
হাজার কবিতা, বেকার সবিতা
তার কথা কেউ বলে না!
সে প্রথম প্রেম আমার…..
চলবে________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)