মেঘমেদুর দিনে পর্ব-১৭

0
73

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৭]

গোধূলি লগ্ন। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই দেখা যায় শুধু কপোত কপোতী। সেই সুযোগে ফুল, বাদাম আর মুখরোচক খাবার বিক্রেতারা আনাচে-কানাচে ব্যবসার পসরা সাজিয়ে বসেছে। মুহূর্তেই নিরিবিলি স্থানটিকে করে তুলেছে কোলাহলপূর্ণ। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথায় ওখানকার এক ফাঁকা স্থানে বসে পড়েছে আবৃত্তি। এর মধ্যে বেশ কজন ঝুড়ি ভর্তি ফুল বিক্রেতা ঘুরে গিয়েছে তার পাশ দিয়ে।

ফুল আবৃত্তির পছন্দ হলেও তা সে কিনল না। এত টাকা খরচ করে ফুল কিনে হাতে নিয়ে ঘুরার অহেতুক ইচ্ছে তার নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামবে। হঠাৎ মনে হলো পাশের ফাঁকা স্থানটি দখল করে নিয়েছে কেউ। নড়েচড়ে বসলো আবৃত্তি। সরে গিয়ে পাশ ফিরে চাইলো। তৎক্ষণাৎ দুই ভ্রুয়ের মাঝখানে ভাঁজ পড়ল। শিথিল মৃদু হেসে বললো,“আবৃত্তি?”

ফ্যালফ্যাল নয়নে কয়েক মুহূর্ত পুরুষালি মুখ পানে তাকিয়ে রইল আবৃত্তি। তার চাহনিতে অধরের হাসি ফ্যাকাশে হয়ে গেলো শিথিলের। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে অপ্রস্তুত ভঙিতে বললো,“আমি শিথিল। সুশ্রী, মিশমির দুঃসম্পর্কের কাজিন। অনেকদিন দেখা হয়নি তাই হয়তো চিনতে পারছো না।”

আবৃত্তি এবার মুখ খুললো,“দেড় বছর। সত্যিই অনেক দিন!”

বলেই চমৎকার হাসলো। শিথিল কিছুটা অবাক হলো। ভড়কালো। কাছ থেকে আজ মনোযোগ দিয়ে দেখলো মেয়েটিকে। চোখের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির হাসিও অদ্ভুত সুন্দর। মুখশ্রীতে আগের মতো জড়তা, অপ্রস্তুত ভঙি আর নেই। ভর করেছে পূর্ণ পরিপক্কতা। তা লক্ষ্য করে সহসা চটপটে ছেলের মতো আজ আর কথা বলতে পারলো না শিথিল। সময় নিলো। মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে নিলো। কিছুক্ষণ আগে বন্ধুদের সামনে মুখ ফসকে যা তা বলে দিয়ে বেহাল পরিস্থিতিতে পড়েছিল বেচারা। এরপর নানাবিধ মিথ্যে বলে পরিস্থিতি থেকে পিঠ বাঁচিয়ে সকলের চোখে ফাঁকি দিয়ে এখানে এসে পৌঁছাতে পেরেছে সে।

“মাঝখানে তিনবার আন্টির বাসায় গিয়েছিলাম। এক বারও তোমার দেখা পাইনি। দুইবার কলেজে ছিলে। আর শেষবার অর্থাৎ কদিন আগে গিয়ে শুনলাম, এখন আর ওখানে থাকো না।”

“আমায় খুঁজেছিলেন?”

প্রশ্নটি করে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে রইল আবৃত্তি। এই মেয়েটিই একসময় কারো মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারতো না। জড়তা, ভয় কাজ করতো। অথচ আজ কত অবলীলায় অকপটে স্বল্প পরিচিত এক পুরুষের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে? শিথিল সেই প্রশ্নের উত্তর দিলো না। কোমল স্বরে বললো, “নিজের সম্পর্কে বলো। কোথায় থাকো? লেখাপড়া চলছে? নাকি বিয়ে করে ফেলেছো? দেখতে বউ বউ লাগছে।”

প্রত্যুত্তরে আবৃত্তি হেসে বললো,“বউ বউ লাগছে? চারিদিকে সবাই তো শাড়ি পরে ঘুরছে। শাড়ি কী শুধু বউরা পরে?”

“ওদের থেকে তুমি আলাদা। যতবার আমাদের দেখা হয়েছিল ততবারই লাজুক লতা ছিলে। ঠিকমতো কথা বলতে না।প্রথমবার যেদিন শাড়ি পরা অবস্থায় দেখেছি সেদিন বিয়ে থেকে পালিয়ে এসেছিলে। মুখ দেখিনি। আর তাছাড়া একা একা তো আর এখানে আসোনি। সাথে একটা ছেলেকেও দেখেছিলাম। তাই মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।”

“বিয়ে-শাদি হলে আপনি খবর পেতেন না?”

“উহুম, পাওয়ার কথা নয়।”

“কেনো?”

“এখন কেনোর উত্তর কীভাবে দেই?”

“লেখাপড়া করছি। বদরুন্নেসা কলেজের বাংলা বিভাগের ছাত্রী। মামার বাড়ি এখন আর থাকি না। ভর্তি হওয়ার পরপরই ছাত্রীনিবাসে চলে এসেছি। মোটামুটি সবই তো জানেন? আর সাথে যাকে দেখেছেন সে এক আত্মীয় বা পরিচিত বলতে পারেন। একটা ব্যক্তিগত কাজে এদিকে আসা। সঙ্গে এক বান্ধবীও অবশ্য ছিল। উম বলতে পারেন রুমমেট আমার। তার জোরাজুরিতে শাড়ি পরেছিলাম। আজ কীসের নাকি বসন্ত উৎসব। আমি তো অতশত বুঝি না। এখন আর সেই বান্ধবীর দেখা পাচ্ছি না। কে জানে কোন চিপায় গিয়ে ঘুরছে?”

ভেতরে এক চাপা আনন্দ উপলব্ধি করল শিথিল, তবে কারণটা যেন কিছুতেই ধরতে পারলো না। কিংবা পারলেও এড়িয়ে গেলো বলেই মনে হলো। আবৃত্তি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,“তা আপনি এ পথে?”

“বন্ধুদের সঙ্গে এসেছিলাম। একজনের প্রেমিকার কাল বিয়ে। সেই জন্যই আরকি বেচারা কষ্ট পাচ্ছে।”

“ওহ, তা আপনার লেখাপড়া কতদূর? শেষ হয়েছে?”

“না, এখনো হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী আরো দেড় বছর। যেহেতু বাংলাদেশ সেহেতু দুই বছরও লাগতে পারে। বলা যাচ্ছে না।”

এরপর আর কেউই বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেলো না। আবৃত্তি শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে উঠে দাঁড়াল। মোবাইলে সময় দেখে বললো,“এখন আমায় ফিরতে হবে। ছাত্রীনিবাসে থাকি তো! সন্ধ্যার পরে বাইরে কখনো থাকা হয়নি।”

“তোমার ফ্রেন্ড?”

“ওর জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই। আসার হলে চলে আসতো এতক্ষণে।”

“আচ্ছা, সাবধানে যেও।”

মাথা নাড়িয়ে মুচকি হাসলো আবৃত্তি। বিদায় নিয়ে চলে গেলো নিজের পথে। শিথিল সেখানেই ঠাঁয় বসে রইল। বুক ভার হয়ে এলো তার। কিছু বলার জন্য উশখুশ করতে লাগলো কণ্ঠনালী। কিন্তু পারলো না। স্বভাবের বিপরীতে যেতে পারলো না কিছুতেই।

শিথিল এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না। সে ঘূর্ণির মতো ঘুরে বেড়ায় এখান থেকে ওখানে। চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নীলক্ষেত এসে উপস্থিত হলো। ততক্ষণে সিগারেট ধোঁয়া হয়ে উড়ে গিয়েছে বাতাসে। ছাই হয়ে ঝরে পড়েছে রাস্তায়।

আব্দুল মিয়ার জীবনে দুঃখ নেই। গত তিন বছর ধরে শিথিল যতবার এখানে এসেছে ততবারই উনাকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো হাসতে দেখেছে। চায়ে দুধ, চিনি মেশাতে মেশাতে গলা ছেড়ে গান গাইতে শুনেছে। তাই এখানে এলে সে স্বস্তি পায়। নিজের থেকে ভিন্ন স্বভাবের মানুষ জীবনে সুখে থাকার জন্য যে যে পন্থা অবলম্বন করে তা দেখে নিজেও সুখ পায়। সব সময়কার মতো আব্দুল মিয়া চা আর বিস্কুট দিয়ে গেলেন বেঞ্চে। জিজ্ঞেস করলেন,“এই দুধ, চিনি ছাড়া তিতা চা আমনে খান কেমনে, মামা? কী মজাই বা পান?”

আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজলো শিথিল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুখ দিয়ে প্রশান্তির শব্দ বের করে বললো,“তৃপ্তি পাই। ট্রাই করে দেখতে পারেন।”

“না, আমি চা খাই না। আমার পানই ঠিক আছে।”

“ভুলু কোথায়? অনেকদিন ধরে দেখি না।”

আব্দুল মিয়ার মুখশ্রী মলিনতায় ছেয়ে গেলো।এই প্রথম ভদ্রলোককে মন খারাপ করতে দেখলো শিথিল। ভারাক্রান্ত মনে বললেন,“কেডায় জানি পিডাইয়া মাইরা ফেলাইছে, মামা। কাইল বাজারের দিকে গিয়া দেহি এক পাশে মইরা পইড়া রইছে। মাইনষেরে জিগানের পর জানলাম কার রুডিতে বলে কামড় মারছিল তাই প্রাণে মাইরা দিছে।”

আহত হলো শিথিল।বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল। আজ হয়তো দিনটাই মন খারাপের। ভুলুর মৃত্যু সংবাদ তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিলো। এই শহরে যত শুভাকাঙ্ক্ষী, পরিচিত, বন্ধু-বান্ধব শিথিলের হয়েছিল তার মধ্যে ভুলুও ছিল একজন। হয়তো সে বোবা প্রাণী তবুও মানুষের থেকে ঢের ভালো। পাঁচ, দশ টাকার রুটি খাইয়ে তার ক্ষুধা নিবারণ করা মানুষদের কখনো ভুলতো না। লেজ নাড়িয়ে আনন্দ, ভালোবাসা প্রকাশ করতো।

আব্দুল মিয়া গামছায় চোখের পানি মুছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন,“এই দুনিয়াত মাইনষের মধ্যে দয়া মায়া বইল্লা কিচ্ছু আর নাই, মামা। সব অমানুষ হইয়া গেছে। একটা অবুঝ প্রাণীরে কয় টাকার রুডির লাইগ্গা মাইরা কী এমন লাভ হইলো তাগো? অথচ যারা দেশ আর মাইনষের বিশ্বাস খাইয়া ফেলতাছে? তাগো ক্যান মারে না?”

আব্দুল মিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না শিথিল। সে নিজেও ভাবতে বসলো— মানুষের নিষ্ঠুরতা নিয়ে। যারা ভুলুকে মেরেছিল তাদের সব সমস্যার সমাধান কী হয়েছে? তারা কী খুব সুখে আছে? তাদের কী কোনো অনুশোচনা হচ্ছে না?

অনুশোচনা! মানুষ হয়ে মানুষকেই কত অবলীলায় মেরে ফেলছে সেখানে আবার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো বোবা প্রাণী হত্যার জন্য অনুশোচনা? দীর্ঘশ্বাস ফেলল শিথিল। হাতঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো। টিউশনির সময় হয়ে এসেছে। পরপর দুইটা টিউশন পড়িয়ে ফিরতে হবে তাকে।

ছাত্রীনিবাসে ফিরে আরামদায়ক পোশাক পরে নিজ বিছানায় শুয়ে পড়ল আবৃত্তি। আশেপাশের সিটগুলো খালি। যে যার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে বাইরে। মোবাইলটা হঠাৎ বেজে উঠল। বাজতে বাজতে একসময় কেটেও গেলো কল। আবৃত্তি নড়ল না। কে ফোন করেছে তা জানা বা দেখারও কৌতূহল জাগলো না।

সেজো মামার বাড়ি সে ছেড়েছে মাস ছয়েক আগে। মামা চেয়েছিলেন ওখান থেকেই যেন লেখাপড়াটা সে চালিয়ে যায়। সুশ্রী, মিশমিও অবশ্য অনেক জোরাজুরি করেছিল কিন্তু আবৃত্তি শোনেনি। ওই একটা বছরেই মামী আর মামীর মায়ের যন্ত্রণায় ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল সে। এরপর দোরগোড়ায় যখন এসব থেকে মুক্তি আর পরিত্রাণ পাওয়ার সুযোগ এসে দাঁড়াল তখন সেই সুযোগ মেয়েটা হাতছাড়া করতোই বা কীভাবে?

পৃথিবীতে নারীই নারীর অন্যতম শত্রু। নারী তার নিজের নাড়ি ছেঁড়া ধনের জন্য মমতাময়ী মা হয়ে উঠতে পারলেও অন্যের সন্তানের বেলা তা পারে না। নিজের সন্তানের জন্য বুকে অগাধ মায়া লালন পালন করলেও অন্যের সন্তানের বেলা হয়ে ওঠে নিষ্ঠুর আর হিংস্র। তা আবৃত্তি স্বচক্ষে দেখেছে। সহ্য করেছে। সহ্য করতে করতে সহ্য ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। প্রতি মুহূর্তে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে। চোখের পানিরও তো শেষ আছে নাকি?

দরজা খুলে ভেতরে কারো প্রবেশের আওয়াজ পেয়ে উঠে বসলো আবৃত্তি। রুমমেট বিপাশা ফিরে এসেছে। আবৃত্তিকে বিছানায় দেখে ক্ষুব্ধ হলো সে। আয়নার সামনে গিয়ে মাথা থেকে বেলী ফুলের গাজরাটা খুলে ফেলল। টিস্যু দিয়ে গাঢ় লিপস্টিক মুছে ভেজা চুল খুলে ছড়িয়ে দিলো পিঠে। ক্ষোভ ঝেড়ে বললো, “গেলি আমার সঙ্গে কিন্তু ফিরে এলি একা? কত খুঁজেছি তোকে, জানিস?”

“আমিও তো তোমায় খুঁজেছি। আমায় ওখানে বসিয়ে রেখে কোথায় চলে গিয়েছিলে? ফোন দেওয়ার পরেও রিসিভ করোনি।”

“তুই নিজ থেকেই ওই ছেলেটার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিস। তাই আমি তোদের একটু স্পেস দেওয়ার জন্যই তো অন্যদিকে চলে গিয়েছিলাম।”

“ওই ছেলের সাথে আমি প্রেম করতে যাইনি। নেহাৎ খুবই প্রয়োজন ছিল তাই বাধ্য হয়ে দেখা করে কথা বলতে গিয়েছিলাম।”

“হুট করে রিশাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। আমি ওকে ফোনে মিথ্যে বলেছিলাম যাতে তোর সাথে বের হতে পারি। কিন্তু ব্যাটা হুট করে সামনে এসে দাঁড়াল। বুঝতে পারছিস কেমন একটা ধরা খেয়ে গেলাম? একটুর জন্য ব্রেকাপটা হয়নি। এরপর ওকে নিয়ে তোর কাছেই যাচ্ছিলাম‌। কিন্তু তুই আরেক ছেলের সঙ্গে বসে হেসে হেসে কথা বলছিলি। তাই বিরক্ত করিনি।”

“আচ্ছা, স্যরি। ভুল আমার ছিল। হ্যাপি এবার?”

উজ্জ্বল হয়ে উঠল বিপাশার মুখশ্রী। হেসে ফেলল সে।_________

রাতে ফ্ল্যাটে ফিরতেই নতুন নতুন মুখের দেখা মিললো। তুহিন বসে তাদের সঙ্গে গল্প করছে। শিথিলকে দেখে সকলে এসে সালাম দিয়ে হাত মিলালো। এক ব্যাচ জুনিয়র তারা। রিজভী তাদের ক্যাম্পাসের বড়ো ভাই। ভিসির সাথে উঠাবসা। রিজভীর সঙ্গে কথা বলেই এখানে তারা উঠেছে। ভার্সিটি হলে থাকতে থাকতে যে ছেলেরা বিরক্ত এবং তটস্থ তা তাদের কথাতেই বুঝা গেলো।

যে যার মতো নিজেদের বিছানা গুছিয়ে সেদিনের মতো রাতটা পার করল। পরেরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখা মিললো না আরফিনের। না ক্লাসে, না ক্যাম্পাসে আর না হলরুমে। হঠাৎ করে ছেলেটা কাউকে না জানিয়েই কোথায় চলে গিয়েছে কে জানে? কল দেওয়ার পর মোবাইলটাও বন্ধ বলছে।

শান্ত, সজীব ইচ্ছেমতো ছেলেটাকে গালি দিতে দিতে বললো,“শ্লা নির্ঘাত প্রাক্তনের দুঃখে কোনো চিপায় গিয়ে ন্যাকা কান্না কাঁদছে। কাল সারারাত মশার কামড় খেতে খেতে ওরে বোঝালাম, পুরুষ মানুষের এসব ছোটো খাটো দুঃখ সয়ে নিতে হয়। লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরি পেলে এমন হাজারটা দীপ্তির বাপ তোর বাড়িতে এসে বসে থাকবে। কিন্তু বুঝলোই না। একবার ওরে পাই হাতের কাছে।”

সজীব শান্ত’র সঙ্গে সহমত পোষণ করে বললো,“ওর নাক বরাবর আমি একটা ঘুষি মারবো।”

তুহিন বিরক্তি প্রকাশ করল,“বেচারা কী তোদের মতো নাকি? ও সত্যি সত্যি দীপ্তিকে ভালোবেসেছিল। তাই কষ্ট লাগাটাই স্বাভাবিক নয় কী?”

শিথিল সিগারেট ফুঁকে পায়ে পিষলো। বললো, “ভালোবাসা! সেটা আবার কী? এত ভালোবাসা এদের আসে কোত্থেকে? নিজের থেকে বেশি ভালো কাউকে বাসতে নেই। এত বছর আমার সাথে থেকেও শিখলো না?”

স্বাধীন আড়চোখে সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে আগাগোড়া ভালো করে দেখলো শিথিলকে। বাকিরা সরে যেতেই এক ফাঁকে শিথিলকে ধরে নিয়ে বসলো গাছের ছায়ার নিচে। এলোমেলো চুল ঠিক করতে করতে শিথিল জিজ্ঞেস করল,“এখানে আনলি কেনো? তুইও আবার প্রেম করছিস নাকি?”

“এসবে আমি নেই।”

“কেনো নেই?”

“আম্মা বলেছে, বড়ো হলে সুন্দরী মামাতো বোনের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিবে। তাই প্রেম পিরিতি থেকে আমি একশ হাত দূরে।”

“আর কত বড়ো হবি? অলরেডি বয়স তো চব্বিশের বেশি হয়ে গিয়েছে।”

“হুস, বাড়িয়ে বলিস না। সবে চব্বিশ ছুঁইছুঁই।”

“তুই আমার থেকে চার মাসের বড়ো। ছুঁইছুঁই কীভাবে, মিথ্যুক?”

“চার মাসের বড়ো মানে? আট মাসের মাথায় আমার আম্মার ব্যথা উঠেছিল বলে বাটপার ডাক্তার আগে আগেই অপারেশন করে টেনে হিচড়ে আমায় পেট থেকে বের করেছে। এর মানে আমাদের মাত্র দুই মাসের পার্থক্য।”

শিথিল না চাইতেও হেসে ফেললো বন্ধুর কথায়। স্বাধীন গম্ভীর মুখে বললো,“সত্যি করে বল মেয়েটার নাম কী? প্রেমে পড়েছিস কীভাবে? লাভ এট ফার্স্ট সাইড?”

“কোন মেয়ে? কীসের প্রেম?”—অবাক হলো শিথিল।

“সবার চোখে ফাঁকি দিলেও আমার চোখে তুই ফাঁকি দিতে পারবি না। কাল তুই নিজ মুখে বলেছিস। এরপর ওই মেয়ের সঙ্গে গিয়ে কথাও বলেছিলি। এবার সুন্দর করে গলা ঝেড়ে কাশ।”

“মেয়েটা পরিচিত। শান্তিনগরে আমার যেই আন্টি থাকে সেই আন্টির ননদের মেয়ে। প্রায় দেড় বছর পর দেখা হয়েছে।”

“দেড় বছর পর এসে প্রেমে পড়লি?”

“আবোল তাবোল কথা বলা বাদ দিবি নাকি ঘুষি খাবি?”

স্বাধীন দমলো না কিছুতেই,“এসব নাটক আর ভন্ডামি বাকিদের সামনে করলেও আমার সামনে একদম করবি না। তোর বাপের পরে একমাত্র আমিই হলাম সেই মানুষ অর্থাৎ তোর দ্বিতীয় বাপ। যে কিনা তোর হাবভাব দেখে সবকিছু বুঝে ফেলতে পারে।”

এবার সত্যি সত্যিই তার পিঠে কিল বসিয়ে দিলো শিথিল। চোখমুক কুঁচকে ধমকের সুরে বললো,“এখন আবার বাপ হতে চাস, হ্লারপুত?”

“হ্লারপুত বলবি না। বর্তমানে আমার কোনো ফুফু নেই। মাস ছয়েক আগে মারা গিয়েছে।”

শিথিল প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। স্বাধীন বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেও পেট থেকে কোনো কথা বের করতে না পেরে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। উদাস দৃষ্টিতে অদূরে আড্ডারত দলগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো,“অনুভূতি চাপিয়ে রাখা হচ্ছে বোকামি। আজ কাউকে ভালো লাগবে, কাল সেই ভালো লাগাকে চাপা দিয়ে ভুলে যেতে চাইবি। পরশু আপনাআপনি তোর সেই ভালোলাগা ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়ে যাবে। মানব মন বড়োই জটিল। সাথে বেহায়া আর অদ্ভুতও। কখন কাকে জায়গা দিয়ে বসে থাকে নিজেও জানে না। তাই ভালো লাগলে তা প্রকাশ করে দেওয়াই শ্রেয়।”

“এই বয়সটাই এমন। হুটহাট কাউকে ভালো লাগলেই বলে দেওয়ার মতো বোকামি আর দ্বিতীয়টি নেই। এর থেকে অপেক্ষা করা ভালো।”

“মেয়ে মানুষ হচ্ছে পাকা ফলের মতো। আর পুরুষ হচ্ছে মাছি। যেখানে ফল থাকবে সেখানেই মাছি ভনভন করবে। এটাই জগতের নিয়ম। তাই অন্য মাছি সেই পাকা ফলকে দখল করে নেওয়ার আগে তুই তাকে নিজের করে নিলেই ভালো।”

“এতকিছু রেখে শেষমেশ মাছির সাথে তুলনা দিলি?”

“তুলনাতে কী আসে যায়? কথা তো ভুল নয়।”

“তোরা আমায় শান্তি দিবি না। জোর করে হলেও প্রেমে ফেলবিই?”

“প্রেমে ফেলছি না। আমরা চাই তোর জীবনে একজন নারী আসুক। ছন্নছাড়া জীবনটা নিজের কন্ট্রোলে নিয়ে তোকে ঘরমুখী করুক। তাছাড়া আগে তো হুটহাট কখনো কাউকে ভালোও লাগেনি। এবার লেগেছে। তাই তাকে আঁকড়ে ধর। এটাই সঠিক সময়। ক’দিন পর তো বিএসসি কমপ্লিট করে হয় চাকরির পেছনে ছুটবি নয়তো দেশের বাইরে। তখন সময় কোথায় মনের মতো মানুষ খুঁজে পাওয়ার? মানুষের সাথে না চললে না মিশলে বুঝা যায় না তার আসল সত্তা। তাই এরেঞ্জ ম্যারেজ সবার জন্য সুখ বয়ে আনে না। তার উপর বউ হিসেবে কিন্তু বাঙালি মেয়েরাই বেস্ট, বুঝলি?”

শিথিল নিরবে শুনলো। বেশ কিছুক্ষণ নিরব রইল। অবচেতন মনে একসময় দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে আচমকাই খোলা বইয়ের মতো নিজেকে মেলে ধরলো বন্ধুর সামনে। তৃতীয় সাক্ষাতের পর আবৃত্তি মেয়েটা হঠাৎ করেই একদিন তার ভাবনায় চলে এলো। সেই ভাবনা কেটে গিয়েছিল মুহূর্তেই। ইমনের কথায়। শিথিল কঠোর হৃদয়ের ছেলে। একটা মেয়ে কখনো তার ভাবনা এলোমেলো করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। তারপর সে ইচ্ছে করেই মুখোমুখি হয়নি মেয়েটার। একসময় হয়তো ভুলেও গিয়েছিল। কিন্তু গতকাল! গতকাল হঠাৎ সেই একই মেয়েকে ভিন্ন রূপে দেখে ভীষণ অবাক হলো শিথিল। মন, মস্তিষ্কে ছড়িয়ে গেলো মুগ্ধতা। এরপর যখন পাশাপাশি বসে কথা বললো! কি ছিল সেই মেয়ের হাসিতে কে জানে? শিথিল ভুলতে পারে না। সারারাত সেই হাসি আর দৃষ্টি কল্পনার পাতায় ভেসে উঠেছে বারংবার। অথচ শিথিলের মন কঠোর। এই কঠোর মন ভাঙা অত সহজ নয়। তারপরেও কীভাবে যে?

স্বাধীন সব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। একসময় বিজ্ঞের মতো করে বললো,“সরাসরি বলে দে।”

“কী?”

“ওকে তোর ভালো লেগেছে।”

“তারপর? রিজেক্ট করে দিলে?”

“রিজেক্ট করলে আবার বলবি। বারবার বলবি। কতবার রিজেক্ট করবে?”

“আমি কী ছ্যাঁচড়া? সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমার সেল্ফ রেসপেক্ট।”

“শখের নারীর কাছে একটু ছ্যাঁচড়া না হলে হয় না।”

“সে আমার শখের নারী নয়। শুধু ভালো লেগেছে।”

“তাহলে পরিচয় গোপন করে চিঠি লিখে পাঠা। মেয়ে মানুষ চিঠি আর ফুল সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে।”

“তুই জানলি কীভাবে?”

“আমি প্রেম না করলে কী হবে? এসবে আমি ভীষণ অভিজ্ঞ।”

“কীভাবে পাঠাবো? শুধু কোন কলেজে পড়ে তা জানি। কিন্তু কোন রুমে থাকে তা জানি না।”

“আমার এক পরিচিত আছে। ওখানেই পড়ে, হলে থাকে। তুই শুধু ডিপার্টমেন্ট, ইয়ার, মেয়ের নাম আর চেহারার বর্ণনা ডিটেইলসে আমায় জানিয়ে চিঠি লেখা শুরু কর। প্রয়োজন হলে তোর জন্য আমি ডাকপিয়ন হতেও রাজি।”

“হ্যাঁ, ডাকপিয়ন হতে গিয়ে না আবার প্রেমিক হয়ে যাস তার কী গ্যারান্টি? সর ব্যাটা, ক্ষুধা লেগেছে।”

“আহা, আমারে বিশ্বাস না করলে তোর ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার হয়ে যাবে! চল কাচ্চি খেয়ে আসি। গরম গরম কাচ্চি খেতে খেতে ডিসকাস করা যাবে।”

শিথিলের পিছু নিলো স্বাধীন। ধমক দেওয়ার পরেও ছাড়ল না তার পিছু। শিথিল বিরক্ত হলো। এই ছেলে যে তাকে গাছের আগায় উঠিয়ে মই কেড়ে নেওয়ার পায়তারা করছে তা সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। মই ছাড়া গাছের আগায় উঠে বসে থেকে জীবন নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না।

তবুও শিথিল মনের বিরুদ্ধে গিয়েই ঘরে ফিরে লিখে ফেলল একখানা চিঠি,
‘তোমায় কি নামে সম্বোধন করবো আমি? চন্দ্রপ্রভা? যে সদা গাছের ডালে উজ্জ্বীবিত হয়ে ভালোবাসা ছড়ায় ধরিত্রীতে। কাজল লতা? যার চোখের গাঢ় কাজলে মন কেমনের বৃষ্টি ঝরে, লতার মতো মুড়িয়ে নেয় মায়ার চাদরে। নাকি মিষ্টি মেয়ে আবৃত্তি? যে নামের মতোই মিষ্টি এক কবিতা।

সম্বোধন নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ততা আজ না হয় থাক।মেঘমেদুর দিনে দ্বিধা, মন খারাপ মানায় না। আচ্ছা তুমি কী রোজ আকাশ দেখো? কিংবা দেখো কী সন্ধ্যার আকাশে উড়ে চলা দলবদ্ধ পাখিদের? ওদের মতো তোমারো কী কোনো বন্ধু আছে? যে বন্ধু হতাশ দিনের বাদল হয়ে দুঃখ সারায়? নেই, তাই তো? আমি জানি। কীভাবে জানি সেটা না হয় নাই বললাম। তোমার কী চিঠি পছন্দ? আমার অবশ্য তেমন একটা পছন্দ নয়। তবু বাবা আমায় চিঠি পাঠান— সম্বোধনহীন, ধমক দিয়ে। কিন্তু তোমায় আমি কেমন করে চিঠি লিখবো? কী লিখবো? ভেবে পাচ্ছি না। মন কেমন করছে। তোমায় দেখার পর থেকে হঠাৎ করে কী যে হলো? কী হলো আমার? বলতে পারবে, আবৃত্তি?

ইতি—
এক দ্বিধান্বিত পুরুষ ’

সেই চিঠি পড়ে শিথিল নিজেই অবাক হলো। পিপাসা মেটাতে শেষ করে ফেলল এক বোতল পানি। এরপর এক উপন্যাসের বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখলো। এ চিঠি প্রেয়সী পর্যন্ত পৌঁছানোর সাহস যে তার নেই।

চলবে _________