মেঘমেদুর দিনে পর্ব-২৩+২৪

0
84

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৩]

রমাদান মুসলিমদের জন্য একটি নেয়ামত। বছরের এই একটি মাস মানব জীবনে নিয়ে আসে আত্মশুদ্ধি। এই মাস একজন মুসলিমকে মুমিন হতে শেখায়। শেখায় ঠিক ভুলের পার্থক্য এবং আত্মসংযম। তবে বছরের প্রথম রোজাটা এবার আর রাখা হলো না আবৃত্তির। একান্তই মেয়েলি সমস্যার কারণে। দুপুরের দিকে হঠাৎ করেই মোজাম্মেল হোসেনের কল এলো। রিসিভ করে সালাম দিতেই তিনি সালামের জবাব নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে বাইরে আয় মামা। বাসায় ফিরবো।”

আবৃত্তি অবাক হলো ভীষণ। আচমকা তাকে নিতে আসার কারণ কিছুতেই যেন ধরতে পারলো না। সব নিয়ম-কানুনের পাট চুকিয়ে নিচে নামতে নামতে অনেকটা সময় লাগলো তার। এগিয়ে এসে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “ক্লাস তো এখনো চলছে, মামা। হঠাৎ বাড়ি যাব যে? কিছু হয়েছে?”

“না, কী হবে? তোর মামী বলছিল, রোজার মাসে বাইরে থাকবে মেয়েটা? ওকে বরং বাসায় নিয়ে এসো। তাই নিতে চলে এলাম। ক্লাস ওখান থেকে যাওয়া আসা করেই না হয় করবি।”

মামী বলেছে! এ কথাটা বিশ্বাস হলো না আবৃত্তির। তবু কিছু বললো না। সায় জানিয়ে উঠে বসলো গাড়িতে। জ্যাম না থাকায় পৌঁছাতে বেশি একটা সময় লাগলো না তাদের।

সাবেরা বিবি গিয়েছেন ছোটো মেয়ের বাড়ি। এবারের রমজান মাসটা ওখানেই থাকবেন। উনাকে না দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল আবৃত্তি। বৃদ্ধা তেমন সুবিধার নয়। সুযোগ পেলেই তাকে দিয়ে গাধার মতো খাটিয়ে নেয়। সবসময় তো বড়োদের মুখে মুখে আর তর্ক করা যায় না। তাছাড়া আবৃত্তি সেসব পারেও না। তার আগমনে শাহিনূর খুশি হননি বলেই মনে হলো। দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেলেন। কথা বললেন না। উনাকে আবৃত্তি ঠিক বুঝতে পারে না। একেক সময় একেক রকম আচরণ করেন। তাই সেদিকে আর মাথা ঘামালো না সে। সুশ্রী বাড়িতে নেই। রোজার মধ্যেই ক্লাসে দৌড়াতে হচ্ছে মেয়েটাকে। ওদিকে শাফিনের স্কুলও বন্ধ দেয়নি। সম্ভবত দশ রোজা গেলে দিবে। মিশমির তো এখন লেখাপড়া নেই। ইদের পর কলেজে ভর্তি হওয়ার ফরম বের হবে। তাই তার দিনগুলো কাটে বাড়িতে, আলস্যে।

আবৃত্তির আগমনে সবচেয়ে খুশি হলো মিশমি। দৌড়ে এসে জাপটে ধরল। গালে গাল মিলিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল,“তোমাকে খুব মিস করছিলাম, আবৃত্তি আপু। এবার আর আমার দিনগুলো একদম বোরিং যাবে না।”

আবৃত্তি হাসলো। সৌজন্যতা রক্ষার্থে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুমি?”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

মোজাম্মেল হোসেন গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,“ঘরে যা। ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নে। ইফতারের পর তোর সঙ্গে কথা আছে।”

নিজের কথা শেষ করে চলে গেলেন তিনি। আবৃত্তির মনে ক্ষণিকের জন্য ভয় ঢুকে গেলো। পরিবেশ তেমন একটা সুবিধার ঠেকছে না। নইলে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করেই মামা তাকে আনতে গেলেন কেনো? আর এসেই এমন কথা? শিথিলের ব্যাপারে জেনে যায়নি তো? কিন্তু সেকথা তো উনার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাহলে? শিথিল কী বলে দিলো সব? ভয় আর চিন্তায় আঁকুপাঁকু করছে মন। মিশমি টেনেটুনে তাকে নিজের ঘরে এনে বসালো। সঙ্গে আনা ব্যাগটা পড়ার টেবিলে রেখে বললো,“আপুর ঘরে যেতে হবে না। তুমি এবার আমার ঘরে থাকবে। ঠিক আছে?”

অসম্মতি প্রকাশ করল না আবৃত্তি। চুপচাপ মেনে নিলো মামাতো বোনের কথা।

তখন বিকাল। আছরের নামাজ পড়ে মিতাকে নিয়ে ইফতারের আয়োজন করছেন শাহিনূর। আজিজের সঙ্গে গিয়ে দোকান থেকে জিলাপি আর বোঁদে কিনে এনেছে শাফিন। সুশ্রী, আবৃত্তি এসব না খেলেও বাকিরা আবার খুব পছন্দ করে। এক দুপুর ঘুমিয়ে আবৃত্তি রান্নাঘরে এলো। সাহায্য করতে। মিতা বেগুনীর জন্য বেগুন কেটে বেসন মাখাচ্ছে।পাশেই দাঁড়িয়ে ছোলা বুট রান্না করছেন শাহিনূর। আবৃত্তি কিছু বললো না। নিরবে সিদ্ধ আলুগুলো ছিঁলে এরপর লবণ আর ভাঁজা মরিচ দিয়ে মাখতে লাগলো। শাহিনূর আড়চোখে সেসব লক্ষ্য করলেন কিন্তু তবুও কিছু বললেন না।

মিতা কাজ করতে করতে মুখ খুললো,“তুমি রোজা রেখেছো?”

আবৃত্তি ইতস্তত করে দুদিকে মাথা নাড়াল। মিতা হেসে ফিসফিস করল,“আমিও না।”

“কেনো?”

“তুমি যে জন্য রাখোনি।”

শাহিনূর এবার কথা বললেন,“তাহলে দুপুরে খেলে না কেনো? শাফিন বাচ্চা মানুষ তাই ওর জন্য রান্না করে রাখতে হয়। আমি অবশ্য মিতাকে দিয়ে একটু বেশিই করিয়ে রাখি।”

“ক্ষুধা লাগেনি তাই।”

“লজ্জা পাবে না। কাল থেকে খাবে। এটা লজ্জার কিছু নয়।”

আবৃত্তি মাথা নাড়াল। ছোট্ট করে আচ্ছা বলে হাত দ্রুত চালালো। সুশ্রী এলো ঠিক মাগরিবের আজান দেওয়ার কিছুক্ষণ পর। ততক্ষণে সকলে ইফতার করে নামাজে চলে গিয়েছে। আসার পথে যানবাহনেই পানি আর রুটি খেয়ে রোজা ভেঙেছে সে। বাড়িতে ফিরে সর্বপ্রথম টেবিল থেকে একটা চপ তুলে মুখে পুরলো। আবৃত্তিকে দেখে বেজায় খুশি হলো।

মোজাম্মেল হোসেন বসে আছেন শয়ন কক্ষের ইজি চেয়ারে। ঠিক মাগরিবের পরে ডাক পড়ল আবৃত্তির। ভেতরে প্রবেশ করে অজানা ভয়ে কু ডেকে উঠল মেয়েটার মন। এর আগে মামা কখনো তাকে এভাবে কথা বলার জন্য ডাকেনি। মোজাম্মেল হোসেন ভাগ্নিকে দেখে সোজা হয়ে বসলেন। হাতের ইশারায় সম্মুখ চেয়ারে বসার নির্দেশ দিলেন। দুরু দুরু বুকে বসলো আবৃত্তি।মিনমিনে স্বরে জিজ্ঞেস করল,“আমি কী কিছু করেছি, মামা?”

মোজাম্মেল হোসেন মাথা নাড়ালেন,“হ্যাঁ, এমনটা তোর থেকে আমি আশা করিনি।”

“কী করেছি?”

মোজাম্মেল হোসেন খানিকটা সময় চুপ রইলেন। গম্ভীর মুখে বললেন,“দুদিন আগে তুই তোর বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলি?”

অবাক দৃষ্টিতে মাথা তুলে ভদ্রলোকের পানে তাকালো আবৃত্তি। এমন গোপন সত্য তিনি জানলেন কীভাবে? এ কথা আবৃত্তি কাউকে জানায়নি। তাই কারো জানার কথাও নয়। তার নিরবতায় হতাশ হলেন মোজাম্মেল হোসেন। বললেন,“আইয়ুব আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তোর সঙ্গে আবার দেখা করতে চাইছে। আমি বললাম, তুই এখানে থাকিস না। তখন তোর ঠিকানা চাইলো। এতদিন পর হঠাৎ করে মেয়ের খবর নিচ্ছে ভেবেই সন্দেহ হলো, তাই চেপে ধরলাম। এরপর জানতে পারলাম সমস্ত কথা। কেনো দেখা করেছিলি?”

“প্রয়োজন ছিল।”

“যে লোক বাপের দায়িত্ব পালন না করে অন্যত্র বিয়ে করে সুখের সংসার করছিল তার সঙ্গে এত বছর পর কীসের প্রয়োজন?”

“কেনো দায়িত্ব পালন করেনি সেটাই জানার জন্য। এতটুকু জানার অধিকার তো আমার আছে।”

ফটাফট উত্তরে বেশ অবাক হলেন বলেই মনে হলো মোজাম্মেল হোসেনকে। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে কণ্ঠে স্নেহ ঢেলে বললেন,“সে তোকে কখনো চায়নি,আবৃত্তি। যদি চাইতো তাহলে এত বছর কেনো খোঁজ নেয়নি? সে কী পারতো না? তুই দেখা করার পর কাল আমার সঙ্গে ঠিকই যোগাযোগ করতে পেরেছে। তাহলে এতদিন কেনো পারেনি? তোর মা বেঁচে থাকাকালীন ওই মগবাজারে আমার লোহার ব্যবসা। সবাই ফারজানাকে ত্যাগ করলেও আমি করিনি। অগোচরে মাঝেমধ্যেই গিয়ে দেখা করতাম। তোর বড়ো মামার মৃত্যুর পর আমি নিজে ওই লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছি, আবৃত্তি এখনো ছোটো। ওর একটা ভবিষ্যৎ আছে। বাবা, বড়ো ভাই আর বেঁচে নেই। এবার তুমি ওকে নিয়ে যেতে পারো। কিন্তু ও কী বললো জানিস? বললো, আমি এখন দেশে নেই। আমার ছেলেরা ছোটো। ওদের নিয়েই সময়টা ব্যস্ততায় কাটছে। আপনাদের কাছেই আবৃত্তি ভালো থাকবে।”

লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল আবৃত্তির। মোজাম্মেল হোসেন পুনরায় বললেন,“তুই কষ্ট পাবি বলে আমি কখনো তোকে এসব কিছু জানাইনি। কিন্তু এখন তুই প্রাপ্ত বয়স্ক। তোর জানার অধিকার রয়েছে। ওই হীন বাপের কাছে তুই যেতে চাস?”

“চাই না, এখন আর যাওয়ার সময় নেই। যখন বাবা, মা আর একটা সুন্দর পরিবারের প্রয়োজন ছিল তখন তা পাইনি। বরং মামা-মামী, খালা-খালু, মামাতো ভাইদের তোপ আর মানসিক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে আমাকে ভয়ে, লজ্জায় বড়ো হতে হয়েছে। তাই এসব সয়ে গিয়েছে। এখন আর অসবের ভয় নেই। বাপ দিয়ে আর কী করবো? আমি শুধু গিয়েছিলাম সরাসরি উনার মুখ থেকে প্রশ্নের উত্তর শুনতে। এটা আমার অধিকার। আমার জীবনের সুন্দর সময় নষ্ট করার দায় কী কোনো অংশে কম উনার?”

ক্ষণিকের জন্য নিরব হয়ে গেলেন মোজাম্মেল হোসেন। এতগুলো দিন দশ কথায় রা না পারা মেয়েটার এতশত অভিযোগে অবাক না হয়ে পারছেন না। আবৃত্তি ফের বললো,“বাবা যেমন নানার থেকে আমার মাকে কেড়ে নিয়েছিল ঠিক সেই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নানা বাবার থেকে কেড়ে নিয়েছিল আমাকে। তাদের দ্বন্দ্বের জেরে ভুক্তভোগী হতে হয়েছে আমাকে। তাই ওই লোক আবার আমাকে নিয়ে কিছু বললে এড়িয়ে যেও। যা কথা ছিল সব মিটে গিয়েছে। আর দেখা করার প্রয়োজন নেই।”

তারপর পুরো ঘর জুড়ে অনেকক্ষণ পিনপতন নিরবতা চলে। একপর্যায়ে মোজাম্মেল হোসেন বললেন,“আমি জানি সবটা। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। হাত- পা যে বাঁধা ছিল। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু করার চেষ্টা করেছি। তবে কতটা সফল হয়েছি তা জানি না। তুই তো আর অবুঝ নস।”

“তোমাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। বাবা বেঁচে থাকতেও এসব দায়িত্ব তো আর তোমাদের নয়। তবুও আমার জন্য তোমরা কম করোনি।তাই তোমাদের কাছে আমি ঋণী।”

“আমি তোর বিয়ে দিতে চাই।”

আশ্চর্য হলো আবৃত্তি। বিয়ে? হুট করে? মোজাম্মেল হোসেন বুঝতে পারলেন তার মনোভাব। বললেন, “তোকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়। অভিভাবক ছাড়া একটা মেয়ের জন্য এই সমাজ ভীষণ কঠিন রে মা। বিয়ে সবাইকেই একসময় না একসময় করতে হয়। তাই আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোর বিয়ে দিতে চাই। সাজানো গোছানো একটা সংসার দিতে চাই। মামার উপর এতটুকু ভরসা রাখ। ঠকবি না। এটাই বিয়ের উপযুক্ত সময়।”

কী বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না যেন আবৃত্তি। সরাসরি না বলা তার সাজে না। মামাদের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা মেয়েদের আবার নিজস্ব মতামত কীসের? সারাজীবন তো আর অন্যের ঘাড়ে বসে খেতে পারবে না। তাছাড়া জীবনে একা একা পথ চলা একটা মেয়ের জন্য যে কতটা কঠিন তা সে এই ছয় মাসেই ভালো করে টের পেয়েছে। ভাবতে ভাবতে শিথিলের মুখখানি ভেসে উঠল স্মৃতিপটে। ছেলেটা তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। ভাবার জন্য মাসখানেক সময় দিয়েছে। তাকে না ভেবে মামাকে হ্যাঁ বলে দেওয়া কী ওই ভালো, ব্যক্তিত্ববান ছেলেটার অপমান করা নয়? শীতল কণ্ঠে আবৃত্তি শুধু বললো,“আর কয়েকটা মাস সময় দাও। তারপর যা বলবে তাই শুনবো।”

মোজাম্মেল হোসেন সন্তুষ্ট হলেন। কথা শেষে মামার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো আবৃত্তি। সুশ্রী তাকে চেপে ধরলো। মুড়ি মাখা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল,“বাবা ডেকেছে কেনো? কী বললো?”

অভিজ্ঞদের মতো সত্যিটা চেপে গেলো আবৃত্তি। মিথ্যে বললো। তার এই মিথ্যে কথাটাই খুব সহজে বিশ্বাস করে নিলো সুশ্রী। ঘাঁটানোর প্রয়োজন কী? আমতা আমতা করতে করতেই আবৃত্তি ফটাফট বলে বসলো, “একটা প্রশ্ন করবো, আপু?”

“হুম কর, আগে মুড়ি খা।”

“আমি খেয়েছি।”

“আচ্ছা।”

দুমনা করতে করতে খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,“তোমার খালাতো ভাই শিথিল ছেলেটা কেমন?”

মুড়ি খেতে খেতে মোবাইল দেখছিল সুশ্রী। প্রশ্ন শুনে চট করে মাথা তুলে তাকালো ফুফাতো বোনের দিকে। প্রবল সন্দেহ নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,“কেমন মানে? হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

ভয় পেয়ে গেলো আবৃত্তি। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। ফের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললো,“এমনি। অনেকবার দেখা হয়েছিল, কথা হয়েছিল তার উপর!”

“তার উপর?”

“মনে আছে আমি বিয়ে থেকে পালিয়ে খালার বাড়ি থেকে এখানে চলে এসেছিলাম? তাও রাতে?”

“হ্যাঁ, তো?”

“ওই রাতেই বাসে উনার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। রাস্তাঘাট না চেনার কারণে উনার কাছে সাহায্য চাই।তাই উনিই বেইলী পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন আমায়। তারপর কাকতালীয়ভাবে অনেকবার দেখা। চারিত্রিক দিক থেকে তিনি ভালো তা আমি আঁচ করতে পেরেছি কিন্তু কখনো জানা হয়নি মানুষ হিসেবে কেমন।”

উৎসুক হয়ে উঠল সুশ্রী। কথাটা শুনে বিষম খেলো। উৎফুল্ল হয়ে বললো,“ওয়াও! বলিস কী? এত্ত বড়ো কাহিনী ঘটে গেলো অথচ কখনো বলিসনি তো?”

“অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি।”

“ছেলে হিসেবে শিথিল ভাই লাখে একটা। কি অমায়িক ব্যবহার! পরোপকারী মানুষ বললেও ভুল হবে না। বিশেষ করে আঙ্কেল অর্থাৎ উনার বাবা খুব ভালো মানুষ। এই জন্যই মূলত তিনিও ভালো মানুষ। বাবার স্বভাব রপ্ত করেছেন। খারাপ দিক হচ্ছে, মেয়েদের তেমন পাত্তা দেন না। এমনকি আমাকে আর মিশমিকেও না। মাসের পর মাস ম্যাসেজ দিয়ে রাখলেও সিন করার নামগন্ধ নেই। আত্মীয়-স্বজনদের এড়িয়ে চলেন। নিজের বড়ো বোনকেও। এসব নিয়ে উনার উপর অভিযোগের অন্ত নেই।”

“ধরো সে যদি তোমায় বিয়ের প্রস্তাব দেয় কখনো? রাজি হবে?”

এটা আবার কেমন প্রশ্ন? লজ্জা পেলো সুশ্রী। নাজুক স্বরে বললো,“রাজি না হওয়ার কোনো কারণ তো নেই। ভালো পরিবারের ছেলে। দেখতে শুনতে ভালো। পড়াশোনায়ও খুব ভালো। ব্রাইট ফিউচার তার।”

চুপ রইল আবৃত্তি। আবারো নতুন করে ভাবতে বসলো।
___________

প্রথম রোজাটা ভীষণ শান্তিতে কাটলো। সন্ধ্যায় বাবা, চাচার সাথে ইফতার করে মাগরিবের নামাজ, এরপর তারাবীহ পড়ে ঘুমিয়েছিল শিথিল। ভোরে ঘুম ভাঙলো বাবার ডাকে। সেহরি খেয়ে ফজরের নামাজ পড়ে দিলো আবারো একটা ঘুম।

সকাল সাড়ে আটটা। হামিদুল হক বাহু ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ডাকতে লাগলেন,“এই শিথিল! সকাল হয়ে গিয়েছে। ওঠ তাড়াতাড়ি। শিথিল! এবার কিন্তু পিঠে মাইর পড়বে।”

শিথিল উঠে বসলো। তবে ঘুমের চোটে চোখ খুলতে পারলো না। ঘুম ঘুম কণ্ঠে বাচ্চাদের মতো করে বললো,“একটু আগেই না ঘুমালাম? আরেকটু ঘুমাই।একেবারে আজান দিলে উঠে গোসল করে নামাজে যাবো।”

“কাল রাতেই না বললি, আজ চলে যাবি? পড়ার খুব চাপ? ওই যে শান্ত এসেছে। বসার ঘরে অপেক্ষা করছে।”

চোখ মেলে তাকালো শিথিল। শোয়া থেকে উঠে মুখ ধুয়ে ঘর থেকে বের হলো। শান্ত সোফায় বসে মোবাইল ঘাঁটছে। শিথিলকে দেখতেই বলে উঠল,“এত ঘুমায় কেমনে মানুষ? নয়টার ট্রেন মিস করতে না চাইলে তাড়াতাড়ি রেডি হ।”

“তুই এত সকাল সকাল বিরক্ত করতে আসলি কেনো? হুজুরের সঙ্গে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। সবে ঘুমটা এসেছিল।”

“তোর হাতে পনেরো মিনিট সময় আছে। তৈরি হয়ে আয়।”

হামিদুল হক পেছন থেকে ধমকালেন,“কিছু শেখ ওর থেকে। কী সুন্দর টাইম মেইনটেইন করে চলে। আর আমার গর্দভটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে এখানে।”

বিপরীতে শান্ত অমায়িক হাসলো। যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। কি ভদ্র! শিথিল চোয়াল শক্ত করে কঠিন দৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে একপলক তাকিয়ে চলে গেলো ঘরে। রোজার দিন বলে মনে মনে গালিও দিতে পারলো না। এই শান্তটা বরাবরই বদমাইশ। সারা দুনিয়া জুড়ে অপকর্ম করে বেড়ালেও বন্ধুদের বাবা- মায়ের সামনে হয়ে থাকে সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চাদের মতো নিষ্পাপ। গতকাল শিথিল আর সে একসঙ্গেই ট্রেনে করে এসেছে নিজেদের জেলায়। এরপর যে যার মতো রওশন সড়ক পর্যন্ত এসেই হয়ে গিয়েছে আলাদা।

শিথিল ধীরে সুস্থে গোসল করে তৈরি হলো। এরপর ব্যাগ গুছিয়ে ঘর থেকে বের হলো। হামিদুল হক সুযোগ বুঝে ছেলের পকেটে টাকা গুঁজে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“দুজনে সাবধানে যাবি। ট্রেন না পেলে এখান থেকে সোজা অটোয় করে টঙ্গী গিয়ে সিএনজি নিবি। রোজা রেখে জ্যামে বসে থাকতে হবে না।”

শিথিল মুখ ভার করল,“টাকা আমার কাছে আছে। এখন আর লাগবে না। লাগলে চেয়ে নিবো।”

হামিদুল হক ছেলেকে চোখ রাঙালেন। শান্ত’র উদ্দেশ্যে বললেন,“লেখাপড়া কেমন চলছে তোর?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো, চাচা। এ বছরই বিএসসি শেষ করে বের হবো।”

“সে কী! শিথিলের তো এখনো আরো এক বছর বাকি রয়েছে। তাহলে তোরটা এ বছর কীভাবে?”

“আবার ভুলে গেছেন, চাচা? ডিপার্টমেন্ট আলাদা। আমি সিএসই নিয়ে পড়ছি।”

“ওহ আচ্ছা, ভালো করে লেখাপড়া করে বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল কর। সাবধানে যাস।”

হাস্যোজ্জ্বল মুখে মাথা নাড়িয়ে বিদায় নিলো শান্ত। যেতে যেতে কড়াকড়ি ভাবে বাবার উদ্দেশ্যে বলে গেলো শিথিল,“নিজের যত্ন নিবে। রাত জেগে একদম বই পড়বে না। নোংরা পোশাক লন্ড্রিতে পাঠাবে। সময় না থাকায় এবার আর ধুয়ে দিতে পারলাম না। ইদের আগেরদিন এসে ধুয়ে দিবো।”

হামিদুল হক হাসলেন। গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললেন,“হ্যাঁ, এবার আপনি যান পন্ডিত মশাই। দেখে শুনে যাবেন। টো টো করে না ঘুরে মন দিয়ে লেখাপড়া করবেন। দেড় বছর পর কিন্তু আপনার টাকায় আয়েশ করার জন্য আমি রিটায়ার্ড করছি।”

শিথিল প্রত্যুত্তরে হেসে বিদায় নিলো।

চলবে __________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৪]

অন্যান্য দিনের তুলনায় সূর্যের তাপ আজ বোধহয় একটু বেশি। ব্যাচেলর ভাড়া ঘরে ফিরে লম্বা একটা ঘুম দিলো শিথিল। সেই ঘুম ভাঙলো গিয়ে আছরের আজানের শব্দে। অযু করে নামাজ পড়ে এলো সে। ক্যাম্পাসে বন্ধুরা মিলে সকলের থেকে চাঁদা তুলে আজ ইফতারের আয়োজন করেছে। এই আয়োজনটা ওরা দু’বার করে। দ্বিতীয় আর সাতাশ রোজায়। শরবত তৈরির গুরু দায়িত্ব পড়েছে শান্তর উপর। তার তৈরি শরবত আবার বেশ ইউনিক। যেমন প্রথমে সে মাঝারি সাইজের একটা ড্রামে পানির সাথে বরফের টুকরো দিয়েছে। বরফ কিনে এনেছে পাশের এক দোকান থেকে। এরপর একে একে গুড়, ট্যাঁ, চিনি, লেবু, ইসবগুলের ভুসি, লবণ সব দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ একসঙ্গে মিশিয়ে এক চামচ শরবত তুলে ধরলো স্বাধীনের মুখের সামনে। ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,“নে, টেস্ট করে দেখ তো সব ঠিক আছে কিনা।”

ঘাসের উপর বসে আলুর চপ, বেগুনী হাত দিয়ে ছিঁড়ে ছোটো ছোটো টুকরো করছিল স্বাধীন। শান্তর এমন কান্ডে রেগে গেলো সে। এমনিতেই শেষবেলা কাজের চোটে গলা শুকিয়ে এসেছে। রোজায় ধরেছে। তার উপর এমন মশকরা! ছ্যাৎ করে উঠল,“রোজার মধ্যে টেস্ট করমু কেমনে? আজান দিছে? তুই টেস্ট করতে পারোস না?”

“আমি তো রোজা। আমি কেমনে টেস্ট করমু?”

“তো আমি কী রোজা রাখি নাই?”

“কিহ! তুই রোজা রাখছোস? কবে থাইক্কা শুরু করলি? কয়ডা রাখছোস?”

“তুই আমার লগে সন্ধ্যার পর দেখা করবি শান্তির জামাই। তোরে আমি কোলে বসাইয়া ডিটেইলসে উত্তর দিমু।”

চামচ সরিয়ে নিলো শান্ত। বাকিদের উদ্দেশ্যে বিদ্রুপ করে বললো,“সেদিন কল দিলাম। নিশু রিসিভ করে বলে, ভাইয়া খাচ্ছে। বোঝ তাইলে কত্ত বড়ো রোজাদার আমগো স্বাধীইন্না!”

সকলেই হেসে উঠল। স্বাধীন চোখ রাঙালো। রোজা না থাকলে এতক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়তো শান্তর উপর। বহু কষ্টে কন্ট্রোল করল নিজেকে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, “সেহরিতে কল দিয়েছিলি, গাধা।”

শান্তকে সেই কথায় বিশেষ পাত্তা দিতে দেখা গেলো না। মুড়ি মাখানোর দায়িত্ব পড়ল শিথিলের উপর। তার হাতের মুড়ি মাখানো সুস্বাদু। মুড়ি মাখানোর মাঝপথে কতগুলো জিলাপি নিয়ে এলো আরফিন। বাটির দিকে হাত বাড়াতেই তার হাত ধরে ফেললো শিথিল। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,“কী করিস?”

“জিলাপি দিয়ে মাখা। সেই টেস্ট, মামা!”

শান্ত রেগে গেলো,“এইসব আজেবাজে খাওয়া শিখছস কই?”

স্বাধীন ঠেস দিয়ে বললো,“তোর রুচি খারাপ, আরফিইন্না। এই জন্যই তোর গফ চইল্লা গেছে। মাইয়া একেবারে বাইচ্চা গেছে।”

আরফিন সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনের পিঠে কিল বসালো। তুহিন মুখ ভার করে বললো,“মজাই তো লাগে। এমন করিস কেনো?”

সজীব মুখ বাঁকিয়ে বললো,“বেশি লেখাপড়া করা পোলাপাইন আবার মজা না মজার কী বুঝে?”

শিথিল ধমকালো,“ঝগড়া করিস কেনো? এই দুইটার স্বভাব তো বরাবরই এমন। গতবারও মাঝখানে এসে জিলাপি আর বোঁদে দিয়েছিল এই দুই শয়তান। এই কারণেই ওদের জন্য আলাদা বাটি এনে রেখেছি এবার। মাখানো শেষ হলে তোদেরটায় তোরা যা ইচ্ছে দিয়ে খাস।”

ঝামেলা মিটে গেলো। দুজনেই সন্তুষ্ট হলো। তুহিন পেছন থেকে আলিঙ্গন করে বললো,“এই জন্যই তোকে আমি রোল মডেল মানি, শিথিল।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই আজান দিয়ে দিলো। সকলে দোয়া করল। রোজা ভেঙে একসঙ্গে ইফতার করে চলে গেলো নামাজ পড়তে।

নামাজ শেষে সর্বপ্রথম মসজিদ থেকে বেরিয়ে শান্তকে চেপে ধরলো স্বাধীন। পিঠে ধুমধাম দুটো কিল বসিয়ে দৌড় দিলো। শান্ত চেঁচিয়ে উঠল,“এইডা কী মানুষ? তুই দাঁড়া হ্লারপুত! ওইখানেই দাঁড়া। আজ তোর একদিন কী আমার একদিন।”

বলেই পিছুপিছু শান্তও ছুটলো। বাকিরা তাদের এই বাচ্চামো দেখে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুধু। এরা বড়ো হবে কবে?
__________

মোজাম্মেল হোসেনের বাড়িতে আজ বড়ো করে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। প্রত্যেক রমাদান মাসেই আত্মীয়-স্বজন, কর্মচারী, ভাড়াটে এবং মাদ্রাসার ছাত্রদের দাওয়াত করে এনে ইফতার করান ভদ্রলোক।

পুরুষদের জন্য ছাদে প্যান্ডেল টানিয়ে ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। আর নারীদের জন্য করা হয়েছে দু তলার খালি ফ্ল্যাট দুটোতে। শাহিনূরের বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির নারী এবং ছেলে-মেয়েদের বসানো হয়েছে নিজেদের ফ্ল্যাটেই। তবে চাচা শ্বশুরের বাড়িতে দাওয়াত থাকায় সুহাসিনী আজ আর এখানে আসতে পারেনি। শিথিলও আসেনি। নিজের তৈরি ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে। তাদেরকে বেড়ে খাওয়ানোর গুরু দায়িত্ব পড়েছে সুশ্রী, মিশমি আর আবৃত্তির উপর।আর শাফিন পালন করছে শরবতের দায়িত্ব।

বসার ঘর আর শাহিনূরের ঘরে নারীরা ব্যস্ত। খেতে খেতে পৃথিবীর নানাবিধ আলোচনা চলছে তাদের মধ্যে। ইফতারি হিসেবে রান্না হয়েছে তেহারি। হাতের বিশাল বাটিতে তেহারি থাকলেও গোশত সব গায়েব। বেছে বেছে সব খেয়ে নিয়েছে উপস্থিত ভদ্রমহিলারা। আবৃত্তি ফের রান্নাঘরে এলো। বাটির গোশত ছাড়া সব তেহারি পাতিলে ঢেলে বাকিগুলোর সঙ্গে মিশিয়ে গোশতসহ আবারো তুলতে লাগলো বাটিতে। কাজের ব্যস্ততায় সে এতোটাই মগ্ন ছিল যে কারো উপস্থিতিও টের পেলো না। হঠাৎ তার মাথায় চাটি পড়ল। আঁতকে উঠল আবৃত্তি। ধুম করে বসে পড়ল মেঝেতে। পেছন থেকে সশব্দে হেসে উঠল ফায়াজ। পা ঝুলিয়ে বসলো সিল্কের উপরে। বিদ্রুপ করে বললো,“তুই তো এখনো সেই ভীতুর ডিম রয়ে গেলি রে, আবৃত্তি!”

ছেলেটাকে একদম সহ্য হয় না আবৃত্তির। তাই কিছু বললো না। চোখমুখ কুঁচকে পুনরায় করতে লাগলো নিজের কাজ। পাত্তা না পেয়ে বিরক্ত হলো ফায়াজ। মুখ বাঁকিয়ে বললো,“এতদিন পর দেখা হলো। ভাব নিচ্ছিস কেনো? মহাসুন্দরীও তো হয়ে যাসনি। তোর থেকে আমার গার্লফ্রেন্ড বেশি সুন্দর।”

“তো গার্লফ্রেন্ডকে গিয়েই বিরক্ত কর। আমার মাথা খাচ্ছিস কেনো?”

“আমি তোকে বিরক্ত করছি?”

“কোনো সন্দেহ?”

“এত কথা শিখলি কোত্থেকে? আগে তো ম্যানম্যান করতি।”

“তুইও তো আগে সুন্দর ছিলি। এখন গোরিলার মতো দেখতে হয়েছিস কীভাবে?”

ফায়াজের চোয়াল ঝুলে পড়ল যেন। ক্যামেরা অন করে ভালো করে নিজেকে দেখলো। মুখ লটকে বললো,“তুই আমার চেহারা নিয়ে খোঁটা দিলি নাকি মজা নিলি? কত বড়ো সাহস!”

“এখানে কী? মেয়েদের পিছুপিছু ঘুরার স্বভাব এখনো যায়নি?”

“আমি মেয়েদের পিছুপিছু ঘুরি?”

“অবশ্যই।”

“তুই মেয়ে?”

“কোনো সন্দেহ?”

“অবশ্যই, তুই তো আমার ভাই। ছোটোবেলায় একসঙ্গে হাফপ্যান্ট পরে খেলতাম, ঘুমাতাম। ভুলে গেছিস?”

আবৃত্তি তপ্ত শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। পিছু ঘুরতেই আচমকা কারো সঙ্গে ধাক্কা লাগলো। হাতের বাটিটা পরতে পরতে কেউ ধরে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “চোখে দেখিস না?”

দু কদম পিছু হটলো আবৃত্তি। সম্মুখে ভালো করে তাকাতেই দেখা মিললো দানবীয়, লম্বা চওড়া এক পুরুষের। সে বিরক্ত চোখে তাকালো ফায়াজের দিকে। ধমকালো,“তোকে কী করতে পাঠিয়েছি আর তুই কী করছিস?”

ফায়াজের হাবভাব সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বললো,“দেখো ভাই, দেখো। আমাদের আবৃত্তি কত বড়ো হয়ে গিয়েছে। তাই একটু গল্প করছিলাম।”

ছেলেটিকে চিনতে বেগ পেতে হলো না আবৃত্তির। এই ছেলে ফায়াজের সেই বড়ো ভাই ফারিশ। আবৃত্তির মামাতো ভাই। ফারিশ আবারো তাকালো আবৃত্তির দিকে। মেয়েটির ড্যাবড্যাব দৃষ্টি নিজের দিকে দেখে নড়েচড়ে উঠল,“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? আর কখনো সুন্দর ছেলে দেখিসনি?”

চোখ সরিয়ে নিলো আবৃত্তি। শরীরের গঠন বদলালেও দুই ভাইয়ের অহংবোধ এখনো বদলায়নি। হাত থেকে বাটিটা টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে গেলো,“আমি তো এরচেয়েও সুন্দর ছেলে দেখেই অভ্যস্ত।”

দুই ভাই চমকালো তার কথায়। ফায়াজ মুখ লটকে বললো,“মেয়ে বড়ো হতেই একদম বিগড়ে গিয়েছে। আমাদের কাছে থাকলে এমন হতো না।”

ফারিশ ছোটো ভাইকে ধমকালো,“আরো এক গামলা তেহারি লাগবে। নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি।”

ফায়াজ আর কথা বলার সুযোগ পেলো না। বড়ো ভাইকে ভীষণ ভয় পায় সে। বিপরীতে গেলেই পিঠে পড়ে ঠাসঠুস। তাই যা বলা হয়েছে তাই করল। ইফতার শেষে যে যার মতো চলে গেলো নামাজে। নারীরা পড়ল ঘরেই। এরপর ধীরে ধীরে খালি হয়ে গেলো পুরো বাড়ি।

আসাদুল ইসলাম, মোজাম্মেল হোসেন, সাইফুল আলম এবং শাহিনূরের ভাই, দুলাভাইসহ সমবয়সী সকলে ড্রয়িং রুমে বসে গল্প করছে। এমনটা সচরাচর হয় না। সবার দেখা হয় বছরের এই একটা দিনই। মাঝেমধ্যে বিরাট কোনো অনুষ্ঠান থাকলে হয়তো দেখা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আবৃত্তি বসেছিল বিছানায়। মিশমি তার থেকে কয়েক হাত দূরে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। তেমন কিছু না করেও এমন ভাব, যেন কি না কি করে ফেলেছে। ক্লান্ত কণ্ঠে বললো,“কোথায় ভাবলাম সেজেগুজে একটু ক্রাশের সামনে দিয়ে ঘুরবো। তা না, কাজের মেয়ের মতো এখানে বসে আছি।”

“তো সেজেগুজেই বসে থাকো।”

“দেখছো না আমি ক্লান্ত?”

“এখানে তোমার ক্রাশ এলো কোত্থেকে?”

“কেনো? ফারিশ ভাইয়া। আগের থেকে সুন্দর হয়েছে, তাই না?”

“চাচাতো ভাই মানে নিজের ভাই। এসব কী কথা?”

“মায়ের পেটের ভাই ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো ভাই নিজের ভাই হতে পারে না। বুঝলে? এসব চিন্তাভাবনার কারণেই তুমি সিঙ্গেল।”

“তোমার চিন্তাভাবনা তো ভালো। তা তুমি সিঙ্গেল কেনো?”

“আর বলো না। ত্রিশ নাম্বার ক্রাশের সঙ্গে প্রায় মিঙ্গেল হয়েই যাচ্ছিলাম। কিন্তু মাঝখানে এসে বাগড়া দিলো আটাশ নাম্বার ক্রাশ।”

“সেটা আবার কে?”

“আরে ভুলে গেলে? আমার খালাতো ভাই শীতল।”

“শিথিল!”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় মিশমি। এই বিষয়ে আবৃত্তিকে এখনো জানানো হয়নি। এ বাসায় আসার পর থেকে নিজের সকল গোপন কথাই সে আবৃত্তিকে জানায়। যেমন সেই যে স্কুলে একবার লুকিয়ে সুশ্রীর বই বিক্রি করেছিল সে বিষয়ে আবৃত্তি ভুলেও সুশ্রীকে জানায়নি। এমনকি মিশমি প্রায় ধরা পড়ে গেলেও আবৃত্তিই তাকে রক্ষা করেছিল বোনের হাত থেকে। এরপর থেকে সমস্ত কথাই সে আবৃত্তিকে জানায়। পুরো কাহিনী শুনে আবৃত্তি বেশ মজা পেলো যেন। মুচকি হেসে বললো, “ভাই হিসেবে ভুল কিছু তিনি করেননি। ঠিকই তো, এটা তোমার প্রেমের বয়স? এখনো কত সময় বাকি আছে!”

“এতদিনে বিয়ে দিয়ে দিলে আমার বাচ্চা তোমায় খালা বলে ডাকতো। আর তুমি এসব বলো? ছিঃ!”

তখনি আগমন ঘটলো সুশ্রী আর ফারিশের। ফারিশ মুখ কুঁচকে বললো,“বড়ো ভাই-বোনদেরই এখনো বিয়ে হলো না আর এই লিলিপুট বাচ্চার মা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।”

কথাটা শেষ করেই তাকে উঠিয়ে দিয়ে চেয়ার দখল করে নিলো ফারিশ। আড়চোখে তাকালো আবৃত্তির পানে। মিশমি পাঁশুটে মুখে বললো,“কারো ঘরে ঢোকার আগে পারমিশন নিতে হয়। এতোটুকু ম্যানারস নেই?”

“তোরা ছোটো ছোটো পোলাপাইন। চোখের সামনে হাফপ্যান্ট পরে বড়ো হয়েছিস। কোলে উঠে ঘুরেছিস। তোদের ঘরে পারমিশন নিয়ে আসতে হবে?”

“এখন বড়ো হয়েছি। চাইলেই কোলে নিতে পারবা না।”

“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। নইলে নিজের বিয়ে নিয়ে কে কথা বলে?”

“তোমার তো প্রেমিকা আছে। দুদিন পরপর দেখি চোখ, ঠোঁট, হাত,পায়ের ছবি ছেড়ে ক্যাপশন দাও ‘মাই মাইন! বিয়ে ছাড়াই যদি অপকর্ম করা যায় তাহলে বিয়ে করবে কেনো?”

“কত পেকে গিয়েছে মেয়েটা! দেখেছিস সুশ্রী?”

সুশ্রী দীর্ঘশ্বাস ফেললো,“এ আর নতুন কী?জন্ম থেকেই ধান্দাবাজ।”

বোনের কথায় বিশেষ পাত্তা দিতে দেখা গেলো না মিশমিকে। ফারিশের দৃষ্টি ঘুরেফিরে শুধু আবৃত্তির উপর গিয়েই থামছে। কথার ফাঁকে এবার তার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,“কী রে আবৃত্তি? মামাতো ভাইদের পাত্তা দিচ্ছিস না শুনলাম? আগে তো ভয়ে ঠিকই কাঁপাকাঁপি করতি।”

“কত বছর আগের ঘটনা?”

“সঠিক মনে নেই। হাফপ্যান্ট পরতি তখন।”

“এখন পরি না তাই ভয়ও পাই না।”

আবৃত্তির দৃষ্টি মেঝেতে স্থির। যাতে বিরক্ত হলো ফারিশ। অজানা কারণেই এই মেয়েটাকে তার সহ্য হয় না। ছোটোবেলায়ও এ কারণেই রোজ রোজ কোনো না কোনো শাস্তি সে দিতোই। কত যে কান ধরিয়ে চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে তারও ইয়াত্তা নেই। সেসব কী এখনো মনে পুষে রেখেছে আবৃত্তি? এই জন্যই কী এত বছর বাদে দেখা হওয়ার পরেও পাত্তা দিচ্ছে না? অসহ্য হয়ে উঠল ফারিশের মন। তাই অপমান করার জন্য বললো,“শুনেছিলাম একবার নাকি বিয়ে না করে পালিয়েছিলি?”

আবৃত্তি উত্তর দিলো না। ফারিশকে সে ভালো করেই জানে। এও জানে এই ছেলে তাকে একদম পছন্দ করে না। সুশ্রী তার হয়ে জবাব দিলো,“এ তো বহু পুরোনো কাহিনী। নতুন কিছু বলো।”

“তাও ঠিক। সেমিস্টার পরীক্ষার কারণে তখন আসতে পারিনি।”

“শুনেছি, বেকার ঘুরছো? চাকরি বাকরি করবে না নাকি?”

”মাস ছয়েক আগেই না চাকরিতে জয়েন করলাম? খবর পাসনি?”

মিশমি কথা কাটলো,“ও তো পেত্মী। সারাক্ষণ বই নিয়ে বসে থাকে। কারো খবর রাখে নাকি? বুঝি না, মেয়ে মানুষ এত লেখাপড়া করে করবেটা কী? সেই তো জামাই আর বাচ্চাকাচ্চাই সামলাতে হবে।”

“এই জন্যই কী তুই লেখাপড়া করিস না?”

“একদম।”

ফারিশ হাসলো। আবৃত্তির উদ্দেশ্যে বললো,“আর তুই? বিয়ে টিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস নাকি অন্য কোনো চক্কর চলছে?”

“দেখতে খারাপ। চক্কর চালানোর জন্য মানুষ পাবো কোথায়? বিয়ে টিয়েই করে নিবো। মামা বলেছেন দিয়ে দিবেন।”

“কোন মামা?”

“সেজো মামা।”

“তা কবে করছিস? কাকে করছিস?”

“তোমাদের আগেই সম্ভবত হয়ে যাবে। যার সাথে ঠিক করবে তাকেই করে নিবো। আমার কী আর তোমাদের মতো পরিবার আছে নাকি যে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকবে?”

একটা কথাতেই মুখ বন্ধ হয়ে গেলো ফারিশের। বলার মতো খুঁজে পেলো না কিছু। এই মেয়েটার হঠাৎ বদল নিকটীয়দের মাঝেমধ্যেই ভীষণ অবাক করছে। আবৃত্তি আর সেখানে বসলো না। উঠে চলে এলো ঘরের বাইরে।
____________

বহুদিন মিথিনের সঙ্গে দেখা হয় না শিথিলের। ছেলেটা এ বছর স্কুলে ভর্তি হয়েছে। লম্বাও হয়েছে দুই ইঞ্চি। তা নিয়ে কি আনন্দ তার! নবম রোজায় ইফতার করেই বেরিয়ে পড়ল শিথিল। সুহাসিনীর কেক আর আনারস ভীষণ পছন্দ। মিথিনের পছন্দ চকলেট, আইসক্রিম, চিপস, জ্যাম রুটিসহ বিভিন্ন ফাস্টফুড। এমনিতে এসব পছন্দ নয় শিথিলের। তবে আজ সে বোন আর ভাগ্নের জন্য তাদের পছন্দের খাবার কিনলো। সাথে কিনলো একটা বাঙ্গি। মেহমাদকে জ্বালানোর জন্য।

শ্বশুর-শাশুড়ি এখন আর সারাবছর সুহাসিনীর সঙ্গে থাকেন না। উনাদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে মেহমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে ঝামেলা হয়েছে তার। সারাদিন গাধার মতো খাটাখাটুনির পরেও যদি নিজের বাপ ভাই বাড়ি এলে কথা শুনতে হয় তাহলে এসব করে লাভ কী? স্ত্রীর সঙ্গে ঝামেলা করায় অভ্যস্ত নয় মেহমাদ। স্ত্রীকে সে ধৈর্যশীল রমণী হিসেবেই জানে। সেই ধৈর্যশীল রমণীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে দেখে আর কিই বা বলার ছিল তার? তাই আদনানের সঙ্গে বসে ঠিক করল, বাবা-মা এক মাস বড়ো ভাইয়ের কাছে থাকবেন তো আরেক মাস তাদের সাথে। বুড়ো বুড়ি শুরুতে এ নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাধ্য হয়েই শেষমেশ মেনে নিতে হয়েছে সিদ্ধান্ত। পুত্রবধূর সঙ্গে মিলেমিশে না থাকতে পারলে এমন অবস্থাই হয়।

শিথিলের হঠাৎ আগমনে মা-ছেলে চমকালো। মিথিন বরাবরের মতোই দৌড়ে এসে জাপটে ধরলো মামাকে। মামাকে নিয়ে তার কত আহ্লাদ! থাকাটাই স্বাভাবিক। একটামাত্র মামা যে তার। হাতের প্যাকেটগুলো বোনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মিথিনকে কোলে নিয়ে সোফায় বসলো শিথিল। আমোদিত কণ্ঠে বললো, “প্রিয় ভাগ্নে!”

মিথিনও তেমন করেই ডাকলো,“মামু!”

“মামু ভাগ্নে যেখানে বিপদ নাই সেখানে। বল বুলবুলি।”

“মামু বাগ্নে যেকানে বিপত আছে সেকানে।”

অধরের হাসি মিলিয়ে গেলো শিথিলের। চোখমুখ কুঁচকে মিথিনকে সেন্টার টেবিলের উপর বসালো। বললো,“মানসম্মান আবার নষ্ট করে দিলি।”

হাসতে হাসতে তাদের দিকে এগিয়ে এলো মেহমাদ। যেন কৌতুক শুনেছে। বললো,“এতদিনে আমার মিথিন ঠিক কথা বলেছে। তোমরা দুইটাই অসুবিধার। যেখানে যাবে সেখানেই বিপদ ঘটিয়ে আসবে।”

“আপনার কী কাজকর্ম নেই? ব্রয়লার মুরগির মতো ঘরে বসে কী করেন?”

“আমি হলাম দেশি মোরগ। ব্রয়লার মুরগি তোমরা দুই ভাই-বোন। সাথে আমার এই চার ব্যাটারিও আছে। পয়দা করলাম আমি কিন্তু গুণ পেয়েছে সব মামার।”

কেক খেতে খেতে নিজের তৈরি ডাব আর তরমুজের পুডিং এনে ভাইয়ের সামনে রাখলো সুহাসিনী। তৃপ্ত কণ্ঠে বললো,“উম, কেকটা কিন্তু সেই মজা।”

মেহমাদ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,“বোন ভাগ্নের জন্য কেক, চকলেট আনলা আর আমার জন্য?”

“আপনার জন্য বাঙ্গি এনেছি। দুলা ব্রোকে বাঙ্গি কেটে দাও, আপু।”

মুখ পাঁশুটে করল মেহমাদ। অনাগ্ৰহ প্রকাশ করল, “ছিঃ! এসব খাই না।”

“কবে থেকে খান না?”

“কোনোকালেই খাই না।”

“নতুন শুনলাম।”

বিমূঢ় হয়ে বসে রইল মেহমাদ। এই শত্রু শ্যালক নিয়ে কোথায় যাবে সে? সারাক্ষণ খোঁচা মারা কথা। মামার জন্য আনা পুডিং খেতে খেতে মিথিন বললো,“জানো মামু, আমি আটারোটা রোজা রেখেছি।”

“আঠারোটা! কীভাবে? আজ তো নয় রোজা।”

মেহমাদ উঠে গেলো। যেতে যেতে বললো,“তোমার ভাগ্নে তোমার মতোই ফটকা। একদিনে দুইটা করে রোজা রেখেছে তাও দুইবেলা খেয়ে।”

“বলেন কী? কি রে বুলবুলি, এই ফটকা গুণ কার থেকে পেয়েছিস? নিশ্চয়ই বাপের থেকে?”

মিথিন দুদিকে মাথা নাড়াল,“তোমার থেকে।”

পথিমধ্যে থেমে দাঁড়াল মেহমাদ। পিছু ফিরে আবারো গা কাঁপিয়ে হাসলো। শিথিল অপমানিত বোধ করল। মুখ ভার করে বললো,“এই ভাগ্নে আমার আর লাগবে না। আমার নতুন ভাগ্নে লাগবে। উহু ভাগ্নে নয় ভাগ্নি। দুলা ব্রো আর কত বছর অপেক্ষা করবো?”

ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো মেহমাদ।আড়চোখে তাকালো শিথিলের দিকে। সুহাসিনী ভাইয়ের মাথায় চাটি মারলো। চোখ রাঙিয়ে বললো,“মুখে কিছু আটকায় না?”

“সত্য কথা আটকাবে কেনো? কী রে মিথিন তোর বাবা-মাকে বিরক্ত করিস কেনো?”

“কই? একদম করি না।”

“আবার মিথ্যা বলিস? মামার মতো সর্বদা সত্যি বলবি। বাপের মতো মিথ্যাবাদী হলে সমস্যা। ইদ যেতে দে। এরপর তোকে একটা মামী এনে দিবো।”

মেহমাদ ঠেস মেরে বললো,“দেখো সুহা, দেখো। আসল কথা হলো, তোমার ভাইয়ের মাথায় বিয়ের ভূত চেপেছে। তাই আমাদের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে তারপর বলছে।”

“সরাসরিই বলছি।”

সুহাসিনী মুখোমুখি বসলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“বাবা জানলে তোর পিঠে বাঙ্গি ভাঙবে। লেখাপড়া এখনো শেষ হলো না আর উনি বিয়ে করবেন।”

“বাবা সব জানে। আমি একজন লয়্যাল, বাধ্যগত ছেলে তো। তোমার মতো নাকি? বিয়ে মানেই সফলতা।”

মেহমাদ জিজ্ঞেস করল,“শ্বশুরমশাইও জানে? রাজি হয়েছে নাকি পিঠে পড়েছে? শার্ট খোলো দেখি।”

শিথিল বোনের কাছে অভিযোগ করল,“তোমার জামাই যে একটা লুচ্চা তা কী তুমি জানো?”

“একদম আমার জামাইয়ের নামে অপবাদ ছড়াবি না।”

মেহমাদ আবারো এসে বসলো। মোবাইলের গেম দিয়ে মিথিনকে পাঠিয়ে দিলো ঘরে। সুহাসিনীর বাহুতে মুখ ঘষে অসহায় কণ্ঠে বললো,“নিজ চোখেই তো দেখলে, জান। তোমার ভাই এখনো আমাদের সংসারে গিট্টু লাগাতে চায়।”

শিথিল মুখ বাঁকালো,“ন্যাকা, নির্লজ্জ।”

সুহাসিনী গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল,“তুই তো প্রেম করার মানুষ নস। তাহলে হঠাৎ বিয়ে করতে চাইছিস? সত্যি নাকি মজা করছিস?”

“সত্যি।”

“মেয়ে কে?”

“বলবো না।”

“এ মা, কেনো?”

“তুমি বিবিসি টেপ রেকর্ডার। বললেই এখান থেকে ওখানে চলে যাবে।”

“এক চড় মারবো বান্দর। আমি মেয়ে চিনি?”

“আমি কীভাবে জানবো?তবে মেয়ের অভিভাবকদের চেনো। গলায় গলায় ভাব।”

অবাক হলো স্বামী-স্ত্রী দুজনে। কে হতে পারে সেই মেয়ে? শিথিল তাদেরকে ভাবতে সময় দিয়ে নিজের আনা কেকে কামড় বসালো। সুহাসিনী আচমকাই চেঁচিয়ে উঠল,“সুশ্রী!”

চোখমুখ কুঁচকে নিলো শিথিল। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বোনের উচ্ছ্বাসে ব্যাঘাত ঘটালো,“উহুম, ডাক্তার আমার পছন্দ নয়। তবে কাছাকাছি।”

“তাহলে মিশমি? শেষমেশ আরেক বান্দর?”

“ছিঃ! কী বলো এসব? গেস করা বন্ধ করো তো। ও তো ছোটো বোন।”

“তাহলে কে?”—মেহমাদ জিজ্ঞেস করল।

“যেই হোক, আপনাকে কিন্তু আমার বিয়েতে দাওয়াত দিবো না।”

“কেনো দিবে না? আমার বিয়েতে তো ঠিকই কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছিলে।”

“এই চেহারা দিয়ে আমার সুন্দরী বোন নিয়েছেন। আবার বড়ো বড়ো কথা!”

ব্যস, প্রসঙ্গ মুহূর্তেই বদলে গেলো। দুজনের মধ্যে শুরু হলো তর্ক বিতর্ক। কিন্তু সুহাসিনী ভাবতে বসলো। কে সেই মেয়ে? ভাই যে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা ভাবতেই সে অবাক হচ্ছে। তাদের কথায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে আচমকাই ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুহাসিনী বলে উঠল,“ওদের বাড়ির কাজের মেয়ে মিতা নয়তো?”

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)