মেঘমেদুর দিনে পর্ব-৩০+৩১

0
54

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩০]

ভোর রাত থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। পরীক্ষা শেষে সকালের ট্রেনে বাড়ি ফিরে এসেছে শিথিল। তবে এবার আর বৃষ্টিতে ভিজে আসেনি। সঙ্গে করে এনেছে ছাতা। হামিদুল হক বাড়িতে নেই। সকাল নয়টায় উনি কলেজে যান। ফিরতে ফিরতে কখনো দুপুর আবার কখনো বা বিকেল হয়। হারুন চাচাকেও এই সময়ে বাড়িতে পাওয়া গেলো না। অগত্যা এক্সট্রা চাবি দিয়েই ভেতরে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে নিলো শিথিল।নিজেই করল দুপুরের রান্না। ফ্রিজে রুই মাছ ছিল। সেটাই ভুনা করেছে আর সঙ্গে করেছে সাদা ভাত।

খাবার খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমালো শিথিল। বহুদিন ঠিক মতো ঘুম হয় না। পরীক্ষার চাপে, বিরহে। যদিও বিরহ সে স্বীকার করে না। তবে ভোরের বৃষ্টি থামলো না। ঘুম ভাঙার পর বাবাকেও সে পেলো না। সম্ভবত এখনো ফিরেনি। ড্রয়িং রুমের কেবিনেটের পাশে ছাতাটাও নেই। হাঁটু পর্যন্ত একটা প্যান্ট আর কালো রঙের টি-শার্ট পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে। মোবাইল রেখে এসেছে ঘরে। এই বৃষ্টির মধ্যে মোবাইল নিয়ে বের হলে ভিজে যাবে। একটা ছোট্ট কাগজে,“রান্না করে রেখেছি। খেয়ে নিও, বাবা। বাইরে থেকে ঘুরে আসি। চিন্তা করো না। ফোন করে লাভ নেই। মোবাইল ঘরে।” লিখে কাগজটা টেবিলের উপর ফুলদানির নিচে চাপা দিয়ে সদর দরজায় তালা মারলো। তারপর বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো শিথিল। রাজবাড়ীর মাঠে তখন খেলা করছে ছেলেদের দল। শিথিলকে দেখেই দুজন হাত নাড়িয়ে ডাকল,“ভাই! কবে এলে?”

শিথিল মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর করল,“আজকেই।”

“আসো এক গেম খেলে যাও। দেখি আজ কয়টা গোল দিতে পারো।”

অমত করল না শিথিল। যদিও বাবা জানলে ভীষণ রাগ করবেন তবুও বৃষ্টির মধ্যেই ভেজা, কর্দমাক্ত মাটিতে খেলতে চলে এলো সে। যদি মনটা ভালো হয়! মুহূর্তেই পুরোনো দিনের স্মৃতি অকপটে ভেসে উঠল মস্তিষ্কে। স্কুল, কলেজ জীবনে ইউনিফর্ম পরে বন্ধুদের সঙ্গে কতবার যে এভাবে খেলেছে সে! এরপর চোরের মতো লুকিয়ে চুপিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে হারুন চাচাকে দিয়ে ধুইয়ে নিয়েছে কাঁদা মাখানো পোশাক। তাও বাবার অগোচরে। তার সকল দুষ্টুমি, বাঁদরামির সঙ্গী ছিলেন এই হারুন চাচা। অথচ পরদিন স্কুল, কলেজে গিয়ে মায়ের হাতে বন্ধুদের মাইর খাওয়ার ঘটনা শুনে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গিয়েছে তার। নিজেকে নিয়ে বরাবরই গর্ব হয়েছে।

হাড্ডাহাড্ডি খেলা শুরু হলো দুই দলের ভেতরে। তাদের মধ্যে শিথিল হচ্ছে সবার বড়ো। এক সময় ফুটবলে লাথি মারতে গিয়ে আরেক ছেলের ধাক্কায় চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো সে। সারাদেহ মেখে গেলো কাঁদায়। চুল, মুখ, কানও বাদ গেলো না যেন।

খেলা শেষ করতে করতে বিকেল পেরোলো। ওদের সঙ্গেই স্টেডিয়ামে গিয়ে কাদামাটি পরিষ্কার করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হলো। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, তাকে এই অবস্থায় দেখেও হামিদুল হক রাগলেন না।ধমকালেন না। কিংবা কিছু বললেন না পর্যন্ত। অথচ নিয়ম অনুযায়ী খুব রাগ নিয়ে উনার বলার ছিল, “মাথা গেছে? কাদাঁমাটিতে খেলার বয়স এখনো তোর আছে? এভাবে ভিজেছিস কেনো?কোথায় গিয়ে গড়াগড়ি করে এসেছিস? গর্দভ একটা। এত পড়াশোনা করেও বুদ্ধি সুদ্ধি হলো না।”

সেসবের কিছু আজ তিনি বললেন না।ভেতরে প্রবেশের জন্য জায়গা করে দিয়ে দরজা আটকালেন। খানিক চিন্তিত হয়ে বললেন,“ফুটবল খেলেছিস? ভালো করেছিস। খেলাধুলা করলে শরীর মন ভালো থাকে। যা গোসল করে শুকনো কাপড় পরে আয়। চুলায় চা চাপিয়েছি।”

ঠান্ডায় কাঁপছে শিথিল। যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, “জানলে কীভাবে?”

“আসার পথে মাঠে তোকে দেখেছি। তাড়াতাড়ি যা নইলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”

আর কৌতূহল দেখালো না শিথিল। ঘরে এসে লম্বা একটা শাওয়ার নিলো।গরম পোশাক পরে বসার ঘরের সোফায় এসে বসতেই হামিদুল হক ট্রে তে করে দুই কাপ ধোঁয়া ওঠা চা আর চানাচুর দিয়ে ঝালমুড়ি মাখা নিয়ে এলেন। বললেন,“কখন এসেছিস? এসে দেখি রান্নাবান্না কমপ্লিট। মাছটা কিন্তু দারুণ হয়েছে।”

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পরপর তিনটে চুমুক দিলো শিথিল। মুঠো ভরে মুড়ি নিতে নিতে বললো,“সকালের ট্রেনে এসেছি। এসে দেখি বাড়িতে কেউ নেই। যা ক্ষুধা লেগেছিল না! হারুন চাচা কোথায় গিয়েছে? আবার নিরুদ্দেশ নাকি?”

“আরে না, গ্ৰামে গিয়েছে।আমিই পাঠিয়েছি জমিগুলো দেখে আসতে।”

“ওহ, ফোনে বলেছিলে গ্ৰামে যেতে হবে। কী নাকি দরকার?”

“পৈতৃক সম্পত্তি তোর চাচার থেকে উদ্ধার করতে যাবো। অনেক হয়েছে। অনেক ছাড় দিয়েছি।”

“এতোদিন যখন দেয়নি, এখন কী আর দিবে?”

“দিবে না মানে? দিতেই হবে। সে যেহেতু ছোটো ভাই- বোনদের ছাড় দেয়নি আমিও আর দিবো না। প্রয়োজন হলে জেল খাটাবো। তোর ফুফুরা এই মাসেই দেশে আসবে। উকিলের সঙ্গে অনেকদিন ধরেই আমার কথা চলছিল। পুরোনো মামলা নতুন করে খুলেছি। গ্ৰামের গুরুজন আর চেয়ারম্যানদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। এবার বেঈমানি করে যাবে কোথায়? তুইও তো বিয়ে করবি। আমার নাতি নাতনি আসবে। সম্পত্তি ছাড়া হয় কিছু?”

চুপচাপ শুনলো শিথিল। হামিদুল হক ফের বললেন, “এই বাড়িটা তোর নামে লিখে দিয়েছি। সুহাসিনীকে দিবো হাড়িনালের জমিটা।”

মাথা তুলে বাবার দিকে তাকালো শিথিল। হামিদুল হক মুচকি হাসলেন। বিদ্রুপ করে বললেন,“তবে বাড়ির পুরো মালিকানা পাবি আমার মৃত্যুর পর। বেঁচে থাকতে মালিক আমি।”

এই পর্যায়ে শিথিলও হেসে দিলো। বললো,“শেয়ানা আছো।”

“এবার সত্যি করে একটা কথা বল। বাপের সামনে মিথ্যা বললে কিন্তু পাপ হবে।”

“তোমায় আমি মিথ্যে বলেছি কবে?”

“বলিসনি? এই যে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাস সেটা কখনো বলেছিস?”

বিষম খেলো শিথিল।নিজ মাথায় কয়েকবার হাত দিয়ে থাপড়িয়ে বিস্ফোরিত নেত্রে তাকালো বাবার দিকে। হামিদুল হক নির্লিপ্ত ভঙিতে বসে আছেন। রিমোট হাতে টিভিতে নিউজ চ্যানেল ছেড়ে বললেন, “বাপ যেখানে জীবনেও এসব ছোঁয়নি সেখানে ছেলে চিপায় চাপায় গিয়ে ধূমপান করে। এ দুঃখ আমি রাখবো কোথায়? হার্টের অসুখ বাঁধালে কিন্তু আমি চিকিৎসা করাবো না বলে দিচ্ছি।”

ভয়ে সরে বসলো শিথিল। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল,“কবে থেকে জানো? কীভাবেই বা জানো?”

“সেটা বড়ো বিষয় নয়। বাপ হই তোর‌। দ্রুত ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা কর। এসব খাওয়া ভালো না।”

“চেষ্টা করছি।”

“ওহ, আসল কথাই জিজ্ঞেস করা হলো না। বিয়ের ব্যাপারে কী ভাবলি?”

“কিছু না। লেখাপড়া শেষ হোক। চাকরি বাকরি পাই। এরপর দেখা যাবে।”

“সেকি কেনো? ক’দিন আগে না বিয়ে করতে চাইলি? আবৃত্তি মেয়েটাকে পছন্দ হলো?”

“ওর অভিভাবক নূর আন্টির হাজব্যান্ড। কিন্তু নূর আন্টি রাজি নয়। তুমি যাওয়ার পরেও রাজি হয়নি। মাঝখানে একবার বাসায় ডেকে যা বললো! তাতে বুঝা যায়, আমার সঙ্গে আবৃত্তির বিয়ে হোক তা উনি চান না। নানু তো একেবারে হিংস্র হয়ে উঠলেন। এরপর শুনলাম মাকসুদা আন্টির ভাসুরের ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছে। আঙ্কেল তো স্ত্রী, শাশুড়ির কথায় উঠেন আর বসেন। নিজের মতামত আছে? ওকে বললাম, চলো কোর্ট ম্যারেজ করে ফেলি কিন্তু রাজি হলো না। এরপর আমার আর কী করার আছে? এতোদিনে সম্ভবত বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা। সুশ্রী, মিশমির সঙ্গে যদিও কথা হয় না। এ নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। সম্ভবত ভাগ্যে ছিল না।”

কথাগুলো বলতে গিয়ে মুখখানি মলিন হয়ে গেলো শিথিলের। হামিদুল হক তা খেয়াল করলেন। ছেলে মন খারাপ করে থাকলে উনার একদম ভালো লাগে না। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যখন নিজ থেকে ছেলেটা বিয়ে করতে চাইলো তখন কি খুশি যে তিনি হয়েছিলেন! সুহাসিনীকে নিয়ে উনার কোনো চিন্তা নেই। ওর জন্য মেহমাদ আর মিথিন আছে। কিন্তু শিথিলের জন্য নিজের মানুষ বলতে বাবা ছাড়া আর কে আছে? ছেলের জীবনটা গুছিয়ে দেওয়ার আগেই মারা গেলে আফসোসের আর শেষ থাকবে না ভদ্রলোকের। তখন কে সামলাবে এই ছোট্ট, অবুঝ ছেলেটাকে? একটা তো ভরসার হাত লাগবে নাকি? তাই তিনি কিছু না ভেবেই সেদিন রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ! না এভাবে ছেলেকে তিনি কষ্ট পেতে দেখতে পারবেন না।
_________

সেদিনের অসুস্থতায় আবৃত্তির বিয়ের সব কথাবার্তা পিছিয়েছে। এ নিয়ে আপাতত শাহিনূর আর কিছু বলেননি। তর্কে তর্কে আছেন, কখন স্বামীর মেজাজ ঠান্ডা হবে। সকালে আজ আর দোকানে গেলেন না ভদ্রলোক। ফুরফুরে মেজাজে নাস্তা করতে টেবিলে বসলেন। বাকি চেয়ারগুলো দখল করে আছে মিশমি, সুশ্রী আর আবৃত্তি। খেয়ে তারা নিজেদের কলেজের উদ্দেশ্যে বের হবে।

শাহিনূর আপাদমস্তক স্বামীকে পর্যবেক্ষণ করলেন। না আজ ভদ্রলোককে রসিক দেখাচ্ছে। খাবার বেড়ে দিয়ে বললেন,“ওরা আর দেরি করতে চাইছে না। এখন তো আবৃত্তি সুস্থ। কলেজ যাচ্ছে। ওদের আসতে বলি? শুভ কাজে দেরি করতে নেই।”

মোজাম্মেল হোসেন খুব শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “কাদের?”

“সুজনের পরিবার।”

“বলে দাও।”

অনুমতি পেয়ে অবাক হলেন শাহিনূর। খুশিও হলেন ভীষণ। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন,“তাহলে আজ বিকেলেই চলে আসতে বলি?”

“না, আজ নয়। আজ আবৃত্তিকে নিয়ে আমি একটু বের হবো। ফিরতে ফিরতে রাত হবে। তুমি বরং কাল ডেকো।”

“কোথায় বের হবে?”

“তা তোমার না জানলেও চলবে। ওর বাপের দিকের কিছু জরুরি কাজ ছিল।”

সম্মতি দিলেন শাহিনূর। তবুও স্বামী যে রাজি হয়েছেন এতেই তিনি স্বস্তি পেয়েছেন। আবৃত্তি এতক্ষণ প্লেটের দিকে তাকিয়ে খাচ্ছিল।মামার কথায় মাথা তুলে সামনে তাকালো। মোজাম্মেল হোসেন তার উদ্দেশ্য বললেন,“আজ আর কলেজে যেতে হবে না। একদিন না গেলে কিছু হবে না। ঘরে গিয়ে তৈরি হয়ে নে। অনেক দূর যেতে হবে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, বইখাতা, পোশাক গুছিয়ে নিস।”

শাহিনূর কথা কেড়ে নিলেন,“তুমি না বললে রাতে চলে আসবে? তাহলে সবকিছু গুছিয়ে নিবে মানে?”

“সবকিছু বলিনি। বলেছি প্রয়োজনীয় সবকিছু। মানে সারাদিন ওখানে অনেক মানুষের মধ্যে থাকতে হবে তো তাই আরকি।”

“আচ্ছা।”

“মিশমি চাইলে সঙ্গে যেতে পারিস কিন্তু। একটা সঙ্গী পেলো আবৃত্তি।”

“মিশমির কী কাজ? ওর যেতে হবে না। ও কলেজে যাবে। কোচিং ও তো আছে।”

মিশমি লাফিয়ে উঠল। এসব ব্যাপারে সে এক পায়ে খাঁড়া। লেখাপড়া গোল্লায় যাক। মুখের খাবার না চিবিয়ে গিলে ফেলল। বললো,“আমি রাজি। প্রয়োজনীয় সব আমারো কী গুছিয়ে ফেলা উচিত, বাবা?”

“না, শুধু আবৃত্তিকে গুছিয়ে দে।”

কিছুই মাথায় খেলছে না শাহিনূরের। কী করতে চাইছে উনার স্বামী? অজস্র প্রশ্ন নিয়েই চুপ রইলেন। পাছে যদি নিজের মত বদলে ফেলেন ভদ্রলোক? সুশ্রী খেয়ে উঠে গেলো। সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হলো। আবৃত্তি আর মিশমিও চলে গেলো ঘরে। তৈরি হতে হবে তো!

সকালে বেশ দেরি করে ঘুম ভাঙলো শিথিলের। বাবা যে কেনো ডেকে দিলো না কে জানে? ঘুম থেকে উঠেই কড়া এক কাপ চা নিয়ে সোফায় বসলো সে। রিমোট হাতে নিতেই দৌড়ে এসে তাকে জাপটে দিলো ছোট্ট এক বাচ্চা ছেলে। হাতের চা ভর্তি কাপটা নড়ে উঠল। পড়ে যাওয়ার হাত থেকে কাপটা রক্ষা করে বাচ্চার দিকে তাকাতেই বিস্মিত হলো শিথিল। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল,“মিথিন!”

মিথিন হাসলো। দুই হাত দিয়ে মামাকে জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ ঘষে আমোদিত কণ্ঠে ডাকলো,“মামু!”

তারপর ছোট্ট মাথাটা তুলে তাকালো শিথিলের মুখের দিকে। শিথিলের বিস্ময় ভাব এখনো কাটেনি। চায়ের কাপ রেখে কোলে নিলো ভাগ্নেকে। জিজ্ঞেস করল, “কখন এলি? কার সঙ্গে এসেছিস? আম্মু নাকি বাবা?”

“দুজনের সাথেই ইকটু আগে এসেছি।”

“কোথায় তারা? দেখলাম না তো। তোর নানা কই?”

“নানাভাই আর বাবা বাদারে গেছে। আম্মু ঘরে।”

“এখনো ভুল উচ্চারণ! বাজার হবে।”

সেকথায় পাত্তা দিলো না মিথিন। পুলকিত হয়ে উঠল সে,“মামী কই?”

“কার মামী?”

“আমার মামী। দেকতেই তো এসেছি।”

“তোর মামা কয়টা?”

“একতা।”

“তাহলে মামী এলো কোত্থেকে ব্যাটা? বিয়ে করেছি আমি?”

অধরের হাসি বিলীন হয়ে কৌতূহল ফুটে উঠল মিথিনের মুখশ্রীতে। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,“সত্তি করোনি?”

“না বলদ। করলে তো তোর সামনে বসেই করতাম।”

“বাবা মিত্তা বলেছে?”

“তোর বজ্জাত বাপ বলেছে?”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় মিথিন। শিথিল বিরক্ত হলো। সকাল সকাল মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। তখনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সুহাসিনী। পেছন থেকে চাটি মারলো ছোটো ভাইয়ের মাথায়। মজা উড়িয়ে বললো, “কী রে কুমড়ো পটাস? মুখ লটকে বসে আছিস কেনো?”

“তোমার জামাইকে ভালো হয়ে যেতে বলো। ছোটো বাচ্চাটাকে আজেবাজে শিক্ষা দিচ্ছে।”

“একদম ওর নামে অপবাদ দিবি না। মেরে হাড়গোড় ভেঙে দিবো।”

“পারবা আমার সঙ্গে? একটা টোকা দিলেই না উল্টে পড়বে?”

চোখ রাঙাল সুহাসিনী। তখনি কলিং বেল বাজলো। দরজা খুলে দিতেই ভেতরে প্রবেশ করলেন হামিদুল হক এবং মেহমাদ। হাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ তাদের। সুহাসিনী ব্যাগগুলো নিলো। রান্নাঘরের সামনেই ব্যাগ খুলে একে একে বের করল গরুর মাংস, মুরগির মাংস, কয়েক পদের মাছ আর বেশ কিছু সবজি। নানা, বাবাকে দেখে মামার কোল ছেড়ে দৌড়ে গেলো মিথিন। চা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। ঠান্ডা চা-টাই শরবতের মতো খেয়ে নিলো শিথিল। প্রশ্ন ছুঁড়ল,“আজ কোনো বিশেষ দিন নাকি? হঠাৎ এত বাজার সদাই আর অতিথি?”

মেহমাদ ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীর নিয়ে এসে বসলো পাশে। বললো,“বিশেষ দিনই। তবে অতিথি কাকে বলছো?”

“কেনো, আপনি।”

“আমি অতিথি নই‌।”

“তো কী?”

“এ বাড়ির জামাই।”

“বিয়ে এপ্রোভ করেছি?”

“ছোটো মানুষের এপ্রোভ মানি না।”

“পরেরবার আসলে মুলা আর শালগম খাওয়াবো। যেহেতু বাড়ির সদস্য বলে কথা!”

হাসলো মেহমাদ। শিথিল এবার সিরিয়াস ভঙিতে ফের জিজ্ঞেস করল,“কী বিশেষ দিন? আমি কিছু জানি না কেনো?”

“তোমার বিয়ে।”

মেহমাদকে ভীষণ আনন্দিত দেখালো। কিন্তু শিথিল পাত্তা দিলো না সেকথায়। হেলায় উড়িয়ে দিলো।বাজার হাতে পেতেই সুহাসিনী গিয়ে ডেকে আনলো পাশের বাড়ির কাজের মেয়েটাকে। এরপর বসিয়ে দিলো রান্না। সবকিছুই মাথার উপর দিয়ে যেতে লাগলো শিথিলের। মিথিনকে খুঁচিয়েও আর পেট থেকে বের করা গেলো না কোনো রহস্য। আর মেহমাদ! একে তো কস্মিনকালেও বিশ্বাস করে না সে। তাই ব্যাটাকে অগুরুত্বপূর্ণ লিস্টেই রেখে দিলো।

হামিদুল হক ছেলেকে ধমকালেন,“এখনো বসে আছিস কেনো? যা গিয়ে গোসল করে আয়। মাথায় শ্যাম্পু করবি। নতুন পাঞ্জাবি এনেছি। গোসল সেরে ওইটা পরে আতর লাগিয়ে তৈরি হয়ে নে।”

“কোরবানি দিতে নিবে নাকি?”

“হ্যাঁ, তার আগে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতে হবে। সন্তান কোরবানি দেওয়া চারটে খানি কথা?”

“কিন্তু আজ তো শুক্রবার নয়।”

“তুই যা।”

দৃষ্টিতে সন্দেহ খেলে গেলো শিথিলের। বুঝতে পারলো তার বাপ আর অপ্রিয় দুলাভাই মিলে নিশ্চিত কোনো একটা জগাখিচুড়ি পাকাচ্ছে। কিন্তু সেটা কী? শেষ পর্যন্ত দেখার জন্য বাধ্য ছেলের মতো গিয়ে তৈরি হয়ে এলো সে। যহরের আজান দিতেই ছেলেকে টেনে ধরলেন হামিদুল হক। বগল দাবা করে বললেন, “চল।”

“সেজেগুজে যাচ্ছি কোথায়?”

পেছন থেকে মেহমাদ হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে উঠল, “চাংড়িপোতা।”

“কীসের জন্য?”

“নেমন্তন্ন।”

মজার ছলে শিথিলও অমন করেই পাল্টা জবাব দিলো,“বিয়ের বুঝি?”

“হ্যাঁ, বাবুজী।”

“কার বিয়ে?”

“শিথিলের বিয়ে!”

বাঁকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল শিথিল। কোলে থাকা মিথিনও বাবার সঙ্গে শরীর দুলিয়ে হেসে উঠল। বাদ গেলেন না হামিদুল হকও।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩১]

বাংলাদেশের প্রকৃতি বড়োই বেখেয়ালি, চলে আপন নিয়মে। আগাম বার্তা না দিয়েই হুটহাট বৃষ্টি নামে তো আবার গা ঝলসানো রোদে ঢেকে দেয় পুরো ধরণীকে। দুপুরের প্রাণবন্ত রোদে আবৃত্তির শ্যামলা মুখখানি ঘামে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। সেই ঘাম মুছে ফাউন্ডেশন ও কনসিলার লাগাতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ে গেলেন দক্ষ মেকআপ আর্টিস্ট মেয়েটি।

ব্রাইডাল মেকআপ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা আবৃত্তির নেই। তার সাজপোশাক খুবই সাধারণ। তাতে মুখ ফর্সা দেখানোর কোনো আগ্ৰহ নেই। ঘামলে তার মুখ জ্বালাপোড়া করে— এখনো করছে‌। শেষমেশ ধৈর্য হারিয়ে মুখের ঘাম টিস্যু দিয়ে মুছে বললো,“অনেক হয়েছে। ছেড়ে দিন এবার। আমার মুখে এমনিতেও মেকআপ স্যুট করে না।”

মেয়েটিকে দ্বিধান্বিত দেখালো,“তা কী করে হয়, আপু? আঙ্কেল তো বলে গিয়েছেন, আপনাকে ঠিক করে যেন ব্রাইড সাজিয়ে দেই।”

“আপনি শুধু চুল বেঁধে শাড়িটা পরিয়ে দিন। চোখে কাজল আর লিপ গ্লোস আমি নিজেই না হয় লাগিয়ে নেব।”

মিশমি সুযোগ পেয়ে বাবার টাকা নষ্ট করে অন্য পাশ থেকে ম্যানিকিওর-পেডিকিওর করিয়ে এলো। তাই কথাগুলো তার কানেও এলো। উঁচু গলায় শাসন করার ভঙিতে বললো,“বিয়ের দিন এমন কেউ করে নাকি! তুমি চুপচাপ বসে থাকো, ওই আপু তোমার থেকেও ভালো জানে।”

“আমি সাজবো না। ভালো লাগছে না।”

“ভালো‌ লাগছে না বললেই হবে? বিয়ে কি কেউ রোজ রোজ করে, আবৃত্তি আপু?”

“এমন করো না, মিশমি। বেশি সাজলে আমার নিজের কাছেই কেমন যেন লাগে, অস্বস্তি হয়।”

মিশমি আর কথা বাড়ালো না। হাল ছেড়ে দিয়ে হতাশ কণ্ঠে বললো,“যেভাবে বলছে সেভাবেই সাজিয়ে দিন, আপু। হাতে তেমন একটা সময়ও নেই।”

মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে প্রথমে নিখুঁতভাবে লাল বেনারসি শাড়িটাই পরালো। চুলে খোঁপা করে তাতে গুঁজে দিলো সুগন্ধি বেলী আর লাল গোলাপ। কপাল পর্যন্ত নামিয়ে সাজিয়ে দিলো দু পাট্টা ওড়না। আয়নায় নিজেকে দেখে লজ্জায় গুটিয়ে গেলো আবৃত্তি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ও সে জানতো না— আজকের দিনটা যে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিবে। গাজীপুরে এসে যখন গাড়ি থামলো এক পার্লারের সামনে, তখন মামার মুখে সে শুনেছে সবকিছু। মামীকে রাজি করানো সম্ভব নয় জেনে শিথিলের বাবার সঙ্গে গোপনে কথা বলে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মোজাম্মেল হোসেন। হুট করেই আবার একটা বিয়ে, সেই দুই বছর আগের মতো!

তবে এবারের বিয়েতে আবৃত্তির দ্বিমত নেই। মনে নেই কোনো দ্বিধা। বরং মনে মনে আজ সে ভীষণ খুশি।

আবৃত্তির দিকে তাকিয়ে মিশমি মুচকি হেসে বাবাকে ফোন দিয়ে জানালো— তাদের হয়ে গিয়েছে। এরপর এগিয়ে এসে বললো,“মাশাআল্লাহ, দারুণ লাগছে তোমাকে।তোমার আর শিথিল ভাইয়ের বিয়ে ব্যাপারটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ইশ, কী লজ্জা!”

দৃষ্টি নত করে নিলো আবৃত্তি। তার লাজুকতায় অধরের হাসি চওড়া হলো মিশমির। তাড়া দিয়ে বললো,“আর লজ্জা পেতে হবে না। চলো এবার। বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছে। এখানকার পেমেন্ট বাবা আগেই করে দিয়ে গিয়েছে।”

উঠে দাঁড়াল আবৃত্তি। মিশমির পিছুপিছু বেরিয়ে এলো পার্লার থেকে। তার নিজেরও কেমন কেমন যেন লাগছে। শিথিলের সঙ্গে বিয়ে, বাসর, সংসার ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। কীভাবে ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সে?

যহরের নামাজ শেষে মসজিদে বন্ধুদের দেখে আসল ব্যাপারটা এবার ধরতে পারলো শিথিল। সত্যিই আজ তার বিয়ে! কিন্তু কার সঙ্গে? তারচেয়েও ভারি অবাক করা বিষয়— নিজের বিয়ে সম্পর্কে সে অবগত নয়। হামিদুল হক মসজিদের ইমামের সঙ্গে কথা বলছিলেন। শিথিল পাশে এসে দাঁড়াল। কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। ইমাম সরে যেতেই বাবাকে চেপে ধরলো,“আমি তোমার মেয়ে নই, বরং ছেলে। এভাবে বলা নেই, কওয়া নেই হুট করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছো— এটা কেমন কথা, বাবা?”

“হুটহাট কীভাবে? তুই নিজেই তো বিয়ে করতে চেয়েছিলি। আমি শুধু তোর চাওয়াকে মূল্যায়ন করে বাস্তবে রূপ দিচ্ছি।কত ভালো বাবা আমি, দেখেছিস?”

“কতবার বলেছি, তখন অন্য বিষয় ছিল। এখন আবার কার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছো? যাকে তাকে কিন্তু আমি বিয়ে করবো না, বাবা।”

“যাকে চেয়েছিলি, তার সাথেই দিচ্ছি। এখন চুপ থাক। নতুন বরদের বেশি কথা বলতে নেই। কবুলের সময় হলে মুখ খুলবি।”

ভড়কে গেলো শিথিল। যার সঙ্গে চেয়েছিল তার সাথেই মানে? কী এক অজানা জটিলতায় জড়িয়ে গেলো সে! হামিদুল হক সরে গেলেন। ছেলের বাবা হিসেবে উনার ব্যস্ততার শেষ নেই।

মিথিন দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়াল। দুই হাত উপরে তুলে আবদার জুড়লো,“কোলে নাও, মামু।”

শিথিল তাকে কোলে নিলো। কোলে উঠেই গলা জড়িয়ে ধরলো মিথিন। তারপর তাকে কোলে নিয়ে বন্ধুদের কাছে গেলো শিথিল। সেখানে দাঁড়িয় কিছু নিয়ে আলোচনা করছিল সজীব আর আরফিন। বাকিরা গিয়েছে শান্তর সঙ্গে। যেহেতু শান্ত এই জেলার ছেলে, অলিগলিও তার ভালো করেই চেনা।

শিথিলকে দেখে কথা থেমে গেলো দুই বন্ধুর। অকারণে হেসে সজীব জিজ্ঞেস করল,“কেমন আছিস, বন্ধু?”

শিথিল গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,“তার আগে বল, এখানে কী?”

“তোর বিয়ে উপলক্ষে এসেছি।”—উত্তর দিলো সজীব।

“অথচ আমিই কিছুই জানি না?”

“আমরা জেনেছি গতকাল বিকেলে। আঙ্কেল শান্ত আর স্বাধীনকে ফোন করে আমাদের আসতে বললেন। তাই চলে এসেছি।”

“বউ কে?”

“আমরা জানবো কীভাবে? তা তো তুই জানিস।”

চুপ করে গেলো শিথিল। কাউকে আর কোনো প্রশ্ন করল না। মিথিনকে নিয়ে আশেপাশে হাঁটলো। গরম থেকে স্বস্তি পেতে মামা-ভাগ্নে মিলে দুটো আইসক্রিমও খেলো। তারপর দুজনের মুখে দুটো ললিপপ গুঁজে দিয়ে আবার প্রবেশ করল ভেতরে। মুখ থেকে ললিপপটা বের করে হঠাৎ বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল মিথিন,“মামু, বউ!”

তার চিৎকারে সবাই ফিরে তাকালো তাদের দিকে। শিথিল থমকে দাঁড়াল। অবাক হলো ভীষণ। অদূরে বধূ বেশে মোজাম্মেল হোসেনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আবৃত্তি। চোখাচোখি হতেই লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো মেয়েটি। শিথিলের বুকটা ধ্বক করে উঠল। বিয়ে তবে আবৃত্তির সঙ্গে? স্বাধীন এসে মিথিনকে নিয়ে নিলো নিজের কোলে। গাল টেনে বললো, “তোমার ভবিষ্যৎ মামী।”

“মামী!”

“আস্তে বলো।”

“ছাড়ো, মামীর কাছে যাবো।”

“আগে কবুল বলুক তারপর গিয়ে কোলে বসে থেকো। কেউ কিছু বলবে না।”

“তাহলে মামুর কাছে যাবো।”

“না, মামু এখন বিয়ে করবে। বিরক্ত করা যাবে না।”

বিয়ে কীভাবে করে, মিথিনের জানা নেই। তবে মামা বিয়ে করবে শুনে তার আনন্দ যেন আর ধরছে না। ভালো বাচ্চার মতো স্বাধীনের কোলেই চুপটি করে বসে থাকলো। দূর থেকে হামিদুল হক ইশারা করে ছেলেকে ডাকলেন। মেহমাদ খোঁচা মেরে বললো, “যাও শালা, ছক্কা মেরে দিয়ে এসো। আমরা তো এই বয়সে বিয়ের কথা ভাবতেও পারিনি।”

“ভাববেন কীভাবে? এই বয়সে তো অন্যের বোনদের প্রেমের জালে ফাঁসাবেন কীভাবে সেই ফন্দি এঁটেছেন।”

বলে বাবার দিকে এগিয়ে গেলো শিথিল। দিন দুপুরে খোঁচা খেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেহমাদ।

কাজীকে নিয়ে এসেছে শান্ত আর তুহিন। শিথিল যেতেই তাকে আর আবৃত্তিকে পাশাপাশি বসিয়ে শুরু হলো বিয়ে পড়ানোর কাজ।

শিথিল বরাবরই নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখতে অভ্যস্ত। নিজের উত্তেজনা, অভিমান বা আবেগ—কোনো কিছুই সে অন্যের সামনে সহজে প্রকাশ করতে পারে না। এবারো পারলো না।জীবনে হঠাৎ ঘটে যাওয়া এমন নাটকীয়, অপ্রত্যাশিত এক ঘটনার পরেও সে যেন বাহ্যিকভাবে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক! কাজীর কথামতো সহজ গলায় পরপর তিনবার কবুলও বলে দিলো।

কিন্তু আবৃত্তির বেলায় সেটা সহজ হলো না। সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো লাগছে তার কাছে— দোলা লাগা, অকল্পনীয় এক পরিস্থিতি! তবুও সে জানে এটা স্বপ্ন নয় বরং চরম বাস্তব। তাই দুরু দুরু বুকে কবুল বললো সে। আর সেই মুহূর্তেই সারা শরীর কেঁপে উঠল যেন কোনো এক অভ্যন্তরীণ ভূমিকম্পে।

সেদিন রাতে ছেলের নিস্তেজ কণ্ঠস্বর শুনেই এত মাইল দূরে থেকেও তার ভেতরের অস্থিরতা, দুর্দশা টের পেয়ে গিয়েছিলেন হামিদুল হক। একমাত্র ছেলেকে তিনি কখনো কষ্ট পেতে দেননি। হয়তো মাঝেমধ্যে কারণে অকারণে বকাঝকা করেছেন তবে পরমুহূর্তেই ভালোবেসে ভুলিয়েও দিয়েছেন সেসব। তাই সেই রাতেই মোজাম্মেল হোসেনকে ফোনে করেন তিনি।

পরদিন ঢাকা থেকে গাজীপুরে উনার সঙ্গে দেখা করতে চলে আসেন মোজাম্মেল হোসেন— স্ত্রীর অগোচরে। দুপুরে খেতে খেতে দুজনে অনেক কথা বলেন, পরিকল্পনা করে, পরামর্শ করে নিজেরা নিজেরাই ঠিক করেন বিয়ে। এছাড়া যে আর কোনো উপায় নেই। শাহিনূর এ বিয়ে কিছুতেই মানবেন না, তা উনারা জানেন। কিন্তু একজন মানুষের একগুঁয়ে সিদ্ধান্তের জন্য দুজন ছেলে-মেয়ের জীবন তো আর নষ্ট হতে পারে না।

মোজাম্মেল হোসেনও চান আবৃত্তি মেয়েটা ভালো থাকুক, নিরাপদে শান্তিতে জীবন কাটাক। আর শিথিলের মতো এমন আদর্শ, বোঝদার ছেলে জীবনসঙ্গী হিসেবে আর কোথায় পাবে আবৃত্তি?
____________

বিয়ে পড়ানো শেষে মসজিদে উপস্থিত সকলের মধ্যে খেজুর ছিটানো হলো। নব দম্পতির জন্য করা হলো দোয়া। নববধূকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো তার মোহরানা। পুত্রবধূকে নিয়ে খুশির আর অন্ত রইল না যেন হামিদুল হকের। তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন তিনি। মোজাম্মেল হোসেন আর মিশমি এলো মেহমাদের সঙ্গে। আর শিথিল? বন্ধুদের পেয়েই বিয়ে শেষে উধাও হয়ে গেলো কোথাও!

অতিথিদের আপ্যায়নে রান্নাবান্না শেষে পুরো বাড়ি ঝাড়পোঁছ করে সাজিয়ে রেখেছে সুহাসিনী। এরপর গোসল সেরে, পরিপাটি হয়ে বসে ছিল সকলের অপেক্ষায়। অবশেষে কলিং বেলের শব্দে তার সেই অপেক্ষার অবসান ঘটলো। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে সর্বপ্রথম চোখ গেলো নতুন বউয়ের বেশে দাঁড়িয়ে থাকা আবৃত্তির দিকে। হাসিমুখে মায়ের পরিবর্তে দায়িত্ব পালন করে বরণ করে ঘরে তুললো একমাত্র ভাইয়ের স্ত্রীকে। থুতনিতে আলতো ছুঁয়ে ভালো করে মেয়েটিকে দেখে বাবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,“শিথিল কোথায়?”

“বন্ধুদের পেয়েছে না? তাদের সঙ্গেই কোথাও গিয়েছে হয়তো। ওকে বরং ঘরে নিয়ে যা। সেই কোন সকালে ঢাকা থেকে এসেছে! নিশ্চয়ই ক্লান্ত।”

বাবার কথামতো আবৃত্তিকে শিথিলের পাশের ঘরটিতে নিয়ে এলো সুহাসিনী।ঘরটা তার জন্যই সকালে গুছিয়ে রেখেছিল সে। এদিকে হামিদুল হক মোজাম্মেল হোসেনকে নিয়ে সোফায় বসলেন। মিশমি তখন বাড়ির ভেতরে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। মা তাকে এতোক্ষণে বেশ কয়েকবার ফোন করেছে। রিসিভ করতে না করতেই শুরু করে দিয়েছে জেরা, “কী রে কোথায় গিয়েছিস তোরা? কী হচ্ছে ওখানে?”

সত্যিটা মাকে বলেনি মিশমি। বাবার কড়া নিষেধাজ্ঞা। তাই আপাতত মায়ের কল রিসিভ না করে এড়িয়ে চলছে সে।

ভাইয়ের বউকে বিছানায় বসিয়ে জানালা খুলে দিলো সুহাসিনী। অন্ধকার কেটে গিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল সূর্যের আলো আর দখিনা হাওয়া। গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করল,“নাম কী তোমার?”

“আবৃত্তি।”

“নামটাও তোমার মতোই ভারি মিষ্টি।”

প্রত্যুত্তরে সৌজন্য হাসলো আবৃত্তি। সুহাসিনী বললো, “আমি শিথিলের বড়ো বোন। অর্থাৎ তোমার ননাস। তবে বিবাহিত।”

“জানি।”

“জানো?”

“হু, উনি বলেছেন।”

“উনি না, তুমি।”

“হ্যাঁ?” থতমত খেয়ে গেলো আবৃত্তি।

সুহাসিনী আলমারিতে কিছু একটা করতে করতেই বললো,“স্বামী হয়। আগের যুগের মতো আপনি, উনি আবার কী? তুমি করে বলবে, বুঝলে?”

“আচ্ছা।”

“শুনেছি তোমার নাকি ইহকালে কেউ নেই?”

“হুম।”

“হুম আবার কেমন উত্তর?”

ঘাবড়ে যাচ্ছে আবৃত্তি। শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছে জড়সড় হয়ে বসলো। নম্র গলায় বললো,“কেউ নেই।”

“উত্তরটা ভুল। কেউ নেই কীভাবে? এই যে কিছুক্ষণ আগে আমার ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে হলো। এত ভালো একটা স্বামী পেলে, বাবার মতো শ্বশুর আর আমার মতো একটা ননাস পেলে— তাহলে কেউ নেই কীভাবে? তোমার তো এখন ভরা সংসার মেয়ে।” থামলো সুহাসিনী। একটা জামদানী শাড়ি নিয়ে এগিয়ে এসে আবৃত্তির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,“আমাকে ভুলেও কিন্তু কুচুটে ননদিনী কিংবা শত্রু ভেবো না। আমি মানুষটা খারাপ নই। আপাতত এখানে কেউ নেই বলে নিজের প্রশংসা নিজেই করছি। বাপের বাড়ি নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাই না। তাই পুরো সংসার আপাতত তোমার একার। ননদের বদলে বড়ো বোন ভাবলে আশা করি তোমার জন্যই ভালো হবে, জড়তা কেটে যাবে। যেহেতু আমাদের মা নেই তাই ভাইয়ের সংসারটা গুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটাও আমার। আর সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, সেদিন জন্ম নেওয়া ছেলে-মেয়েগুলো এখনো লেখাপড়া শেষ করতে পারলো না অথচ বিয়ে করে বসে আছে! এই বাচ্চা ছেলে-মেয়ে কী সংসার করবে? ভাবলেই মাথা ধরে যায়। যদি কখনো কোনো সমস্যার সম্মুখীন হও বা কিছু বুঝতে না পারো তাহলে আমায় ফোন করো। ঠিক আছে?”

এবার কিছুটা স্বস্তি পেলো আবৃত্তি। ননদ নামক মানুষটিকে এখন অন্তত খারাপ বলে মনে হচ্ছে না তার। হেসে মাথা নাড়ল,“আচ্ছা।”

“এবার শাড়িটা বদলে ফেলো। খাবার আমি ঘরে দিয়ে যাচ্ছি। মিশমিকেও পাঠিয়ে দিচ্ছি। লজ্জা পাবে না একদম। এখন থেকে এই বাড়িটা তোমারও।”

বলেই চলে গেলো সুহাসিনী। আবৃত্তি উঠে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। চারিদিকে একবার তাকালো। আসবাব বলতে একটা খাট, ড্রেসিং টেবিল আর আলমারি। সম্ভবত কেউ থাকে না এ ঘরে।

আবৃত্তির খাবার যথাসময়ে ঘরে দিয়ে গেলো সুহাসিনী। বন্ধুদের নিয়ে শিথিল বাড়ি ফিরতেই খাবার বেড়ে সবাইকে ডেকে টেবিলে বসিয়ে দিলো সে। আর মিথিন! সে তো এসে থেকেই নতুন মামীর কাছে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। হারুন চাচা খেতে খেতে বিস্ময় নিয়ে বললেন,“আমার তো এহনো বিশ্বাসই হইতাছে না যে শিথিল বাবায় বিয়া কইরা ফেলাইছে। এই তো সেইদিন কোলে লইয়া রথমেলায় ঘুরলাম। সেই পোলায় কিনা!”

বাকিরা হাসলো। শিথিলের ভীষণ লজ্জা লাগছে। শুধু পারছে না সবার মাঝখান থেকে উঠে চলে যেতে। বিয়ে ব্যাপারটা এত লজ্জাকর জানলে কখনোই তাড়াহুড়ো করতো না সে। বন্ধুরা তো এতক্ষণে তাকে নিয়ে অনেক ঠাট্টা, মজা করে ফেলেছে। বাকি ছিল শুধু পরিবারের লোকজন। তারাও এবার শুরু করে দিয়েছে। একা হাতে সবাইকে খাবার বেড়ে খাওয়াতে হিমসিম খাচ্ছে সুহাসিনী। তুহিন তা দেখে রান্নাঘরে এলো সাহায্য করতে। হেসে বললো,“আমায় দিন, আপু। আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

সুহাসিনী বাঁধা দিলো,“তুমি গিয়ে খেতে বসো। আমি করে নিবো।”

“দিন তো।”

একপ্রকার টেনেই হাত থেকে পোলাও এর বাটিটা নিয়ে গেলো তুহিন। পিছু ফিরতেই মুখোমুখি হলো মিশমির। মুখখানা দেখে চিনতে অসুবিধা হলো না। সামনাসামনি দেখা না হলেও ছবি তো দেখেছিল! তবে মসজিদে মেয়েটাকে তখন সে খেয়াল করেনি। বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে। ঘাবড়াটে দেখালো তুহিনকে। পাশ কাটিয়ে চলে এলো খাবার টেবিলের কাছে।

সকলের খাওয়া দাওয়া শেষে তুহিনও বসে পড়ল খেতে। মিশমি নিজের প্লেটটা নিয়ে তার মুখোমুখি এসে বসলো। এতক্ষণ আবৃত্তির সঙ্গে থাকায় বাকিদের সঙ্গে সে খেতে বসেনি। মেয়েটিকে দেখে তুহিন নিজেকে গুটিয়ে নিলো কিছুটা। আশেপাশে তাকিয়ে বাকিদের খুঁজলো। শালারা এখনি মরেছে। দ্রুত খাওয়া শেষ করার চেষ্টা চালাতে গিয়ে খাবার আটকে গেলো গলায়। পানির গ্লাসটা তার দিকে এগিয়ে দিলো মিশমি। বিরক্ত কণ্ঠে বললো,“আমি বাঘ কিংবা ভাল্লুক নই। ধীরে সুস্থে খান।”

পানি খেয়ে ছোট্ট করে ধন্যবাদ জানালো তুহিন। মিশমি জিজ্ঞেস করল,“আমায় ব্লক করার কারণ?”

“স্যরি।”

“কারণ জানতে চেয়েছি।”

“এমনি।”

“এমনি এমনি কেউ কারো সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়? ব্লক করে দেয়?”

খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে নিলো তুহিন। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,“তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে। আমার সাথে তোমার যায় না।”

“আমি বাচ্চা মেয়ে? তাহলে প্রথমে কেনো প্রশ্রয় দিয়েছিলেন? তখন এ কথা মনে পড়েনি?”

“তখন জানতাম না। তুমি আমায় সঠিকটা বলোনি।”

“বয়স কোনো ফ্যাক্ট নয়। কতই বা পার্থক্য হবে? সাত কিংবা আট।”

“ভুলে যাও। গোটা একটা ভবিষ্যৎ তোমার পড়ে আছে। ওই ঘটনারও বহুদিন পেরিয়েছে।”

তাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে রান্নাঘরে প্লেটটা রেখে ছাদে চলে গেলো তুহিন। বাকিদের দেখা ওখানেই পেয়ে গেলো। স্বাধীন তার ঘাড়ে হাত রেখে বললো,“কোথায় ছিলি এতক্ষণ? চল আমাদের প্রিয় বন্ধুর বাসরঘর সাজিয়ে দিয়ে আসি। তোর কাছে সিসি ক্যামেরা আছে?”

তুহিন দুদিকে মাথা নাড়ায়,“না নেই। এসব কেউ সঙ্গে নিয়ে ঘুরে?”

“তাও ঠিক। চল, ফুল আর সিসি ক্যামেরা কিনে আনি।”

সজীব প্রশ্ন ছুঁড়ল,“সিসি ক্যামেরা দিয়ে কী করবি?”

“শিথিলের ঘরে লাগাবো। দেখতে হবে না, সারারাত কী করে?”

শিথিল তার পিঠে শক্তপোক্ত কিল বসিয়ে ধমকালো, “শ্লা, লুচ্চামি যায় না?”

সেই সুযোগে শান্তও আরেকটা কিল মারলো,“জন্মগত লুচ্চা। জন্মগত অভ্যাস কী বদলায়?”

স্বাধীন চেঁচিয়ে উঠল,“তুই মারলি ক্যান? ছাদ থেকে ফেলে দিবো?”

“আয় ফেলে দেখা।”

শিথিল আবারো ধমকালো,“এখন ঢাকা ফিরে যা তোরা।”

আরফিন দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে বললো, “নো, আজকের রাতটা এখানেই থাকতে বলেছেন আঙ্কেল। কাল তোদের কিছু আত্মীয়-স্বজনেরা ভাবিকে দেখতে আসবেন বোধহয়। বলতে পারিস ছোটোখাটো একটা অনুষ্ঠান হবে। আমরা ছাড়া সেই আয়োজনের দায়িত্ব আর নেবে কে?”

শিথিল অবাক হলো ভীষণ,“এতোদূর পর্যন্ত প্ল্যান করা শেষ? আমিই কিছু জানলাম না! মানে যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, পাড়া পড়শীর ঘুম নেই?”

স্বাধীন তাকে সান্ত্বনা দিলো,“থাক মন খারাপ করিস না প্রিয় বন্ধু। শহরে ফিরেই তোর আর ভাবির জন্য সুন্দর একটা ভাড়া বাড়ি খুঁজে দিবো আমরা। এরপর তোদের টুনাটুনির সংসারটা না হয় সুন্দর করে গুছিয়ে দিবো।”
_________

সারাদিনের ঝক্কি ঝামেলার পর অবশেষে নিরিবিলি বাসরঘরে দেখা হলো শিথিল আর আবৃত্তির। অল্প সময়েই পুরো ঘরটা এত সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজিয়ে ফেলেছে বন্ধুরা— দেখে অবাক হলো শিথিল। ঘরে প্রবেশ করে দরজা আটকাতেই দেখা মিললো বিছানায় জড়সড় হয়ে বসে থাকা আবৃত্তিকে। আহামরি কোনো সাজ নেই তার।পরনে খয়েরী রঙের সিল্কের শাড়ি, চুলে খোঁপা বাঁধা। তবে এবার সেই খোঁপায় জায়গা পেয়েছে চন্দ্রপ্রভা ফুল। সুহাসিনী নিজ হাতে তাকে সাজিয়েছে সন্ধ্যায়।

মোজাম্মেল হোসেন এবং মিশমি বিকেলেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।

শিথিল বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে লাজুক মেয়েটিকে দেখলো। বিছানায় না বসে গিয়ে বসলো চেয়ারে। তার নিজেরও একটু লজ্জা লাগছে। বিশেষ করে সবার সামনে দিয়ে যখন ঘরে ঢুকলো। ইশ! এতকাল সিঙ্গেল থাকা ছেলেটা কিনা এখন বিবাহিত। বউ নিয়ে এক ঘরে থাকবে!

পুরুষালি উপস্থিতি অনেকক্ষণ আগেই টের পেয়েছে আবৃত্তি। পারফিউমের সুঘ্রাণ নাকে এসে লেগেছে। দরজা লাগানোর শব্দে জড়সড় হয়ে বসেছে। কিন্তু কারো সাড়া না পেয়ে চট করে মুখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো, শিথিল অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। তা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। অপরাধীর ন্যায় কাঁচুমাচু মুখ করে জিজ্ঞেস করল, “রেগে আছেন?”

শিথিলের ধ্যান ভাঙলো বোধহয়। সরাসরি স্ত্রীর দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে স্থির তাকিয়ে থাকতে না পেরে চোখ সরিয়ে মুখ ভার করে আবৃত্তি বললো,“আমি… স্যরি।”

“কেনো?”

প্রত্যুত্তরে বলার মতো কিছু খুঁজে পেলো না সে। অধরে হাসি ফুটে উঠল শিথিলের। চেয়ার ছেড়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। আকাশে আধফালি চাঁদ। নিরব নিশীথ। গরমে স্বস্তি জোগাতে প্রাকৃতিক বাতাসের দেখা নেই। পূর্ণ দৃষ্টিতে স্ত্রী রূপী আবৃত্তির দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ যেন একটু দুষ্টু হেসে অন্যরকম কণ্ঠে ডাকলো,“মিষ্টি মেয়ে আবৃত্তি, ওখানেই সারা রাত্রি বসে থাকার পণ করেছো?”

সচকিত হয়ে উঠল আবৃত্তি। নিজেকে ভীষণ বোকা লাগছে তার। কী করবে, কী বলবে— কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছে না। ঘামছে শুধু।

শিথিল জানালায় পিঠ ঠেকিয়ে তার জড়তা ভাঙতে নরম, আদুরে গলায় বলে উঠল,“একটু জড়িয়ে ধরবে? শুনেছি, জড়িয়ে ধরলে নাকি রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, কষ্ট— সব হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মন খারাপ ভালো হয়ে যায়।”

দেহের সব কাঁপন থেমে গেলো আবৃত্তির। হিমশীতল হয়ে গেলো সারা দেহ। ফ্যালফ্যাল নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। শিথিল ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,“কী? ধরবে না?”

মুখে কোনো উত্তর দিলো না আবৃত্তি। নাকের পাটাতন ফুলে উঠেছে তার। এত আদরমাখা কণ্ঠে আজ পর্যন্ত তাকে এমন করে কেউ ডাকেনি। করেনি কখনো এত সুন্দর আবদার। তাই সেই আবদার ফিরিয়ে দিতে পারলো না আবৃত্তি। বিছানা থেকে নেমে ধীরে ধীরে এসে ঠাঁই নিলো পুরুষালি বুকে। দুই হাতের বেষ্টনীতে শিথিলও তাকে জড়িয়ে নিলো। আদুরে হাত বুলিয়ে দিলো পিঠে, মাথায়। ফিসফিস করে বললো,“আজ থেকে আবৃত্তির সকল একাকিত্বের অবসান ঘটলো। আবৃত্তির সুখ, দুঃখের সব দায় শিথিল হামদাদের উপর বর্তালো।”

বাঁধন শক্ত হলো আবৃত্তির। অতীতের কথা সে শুধরে নিলো। অবশেষে পৃথিবীতে তার একটা মানুষ হলো। এই গন্তব্যহীন জীবনে ভালোবাসা এলো। ভরাট কণ্ঠে বললো,“নিজের উপর ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে। এই আমিই কিনা নিজের সৌভাগ্যকে পায়ে মারাতে চেয়েছিলাম। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে সেদিন আপনাকে মাঝ রাস্তায় একা ফেলে চলে এসেছিলাম।”

“মাঝেমধ্যে একটু আধটু ভুল করতে হয়। নইলে এত সুন্দর মুহূর্ত পেতে কোথায়?”

মাথা তুলে মুখ উঁচু করে তাকালো আবৃত্তি। শিথিল যেন এতক্ষণ তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। জিজ্ঞেস করল,“এখনো কষ্ট লাগছে?”

“না।”

“আফসোস হচ্ছে?”

“প্রশ্নই ওঠে না।”

“ঘুমাবে নাকি আদর খাবে?”

“বহুদিন শান্তিতে ঘুমাই না।”

হাসলো শিথিল। সাদা আলো নিভিয়ে ড্রিম লাইট জ্বেলে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘন কালো চুলের ভাঁজে পরম যত্নে বিলি কাটতে কাটতে বললো,“ঘুমাও তবে। হ্যাভ অ্যা সুইট ড্রিম, মাই ডিয়ার ওয়াইফ।”

আবৃত্তি আবেশে চোখ বুজে নিলো। শিথিল ছেলেটা এত আদুরে কেনো?

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)