মেঘমেদুর দিনে পর্ব-৩২+৩৩

0
54

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩২]

গাজীপুর থেকে মালিবাগ পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেলো মোজাম্মেল হোসেন এবং মিশমির। শাহিনূর এতক্ষণ ধরে তাদের অপেক্ষাতেই বসে ছিলেন। ভেতরে ঢুকেই স্ত্রীর হাতে বেশ কয়েকটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন,“ধরো এগুলো, তোমাদের তিনজনের জন্য গরম গরম বিরিয়ানি, চিকেন চাপ, বাদামের শরবত আর রসমালাই নিয়ে এসেছি। আমি আর মিশমি কিন্তু বাইরে থেকেই খেয়ে এসেছি। শাফিন কোথায়?”

বলেই গলা উঁচিয়ে ডাকলেন,“শাফিন, সুশ্রী?”

প্যাকেটগুলো টেবিলে নিয়ে রাখলেন শাহিনূর।জিজ্ঞেস করলেন,“বাসা থেকে গেলে তিনজন অথচ ফিরে এলে দুইজন। আরেকজন কোথায়?”

প্রশ্নের উত্তরটা মোজাম্মেল হোসেন দিলেন না। মিশমিকে ইশারা করে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,“খাবার বেড়ে সুশ্রী আর শাফিনকে নিয়ে তুমি খেতে বসে পড়। আমি বরং গোসল করে আসি। তুইও ঘরে যা মিশমি।”

প্রশ্নটা যে ভদ্রলোক এড়িয়ে গেলেন তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলেন শাহিনূর। তাই আপাতত ছেড়ে দিলেন। ফ্রেশ হয়ে আসুক তখন না হয় চেপে ধরা যাবে। উনারা যেতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো শাফিন আর সুশ্রী। খাবারগুলো দেখে শাফিনের খুশি যেন আর ধরে না। বাইরের খাবার তার বরাবরই প্রিয়। এসেই সে বসে পড়ল খেতে। সুশ্রী গোমড়া মুখে বললো,“অল্প দিও, আম্মু।”

“অল্প দিবো মানে? শরীরের কী অবস্থা হয়েছে সেই খেয়াল আছে?সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকলেই চলবে? যা দিবো চুপচাপ খেয়ে নিবি।”

“পেটে যতটুকু জায়গা নেবে ততটুকুই তো খাবো নাকি?”

“আমায় এসব শেখাতে আসিস না। মনে রাখিস, আমি তোর পেটে হইনি বরং তুই আমার পেটে হয়েছিস।”

দমে গেলো সুশ্রী। এই জন্যই সকালের নাস্তা ব্যতীত পরিবারের সঙ্গে সহজে সে খেতে বসে না। মা তাকে জোর করে ঠেসেঠুসে বেশি খাবার খাওয়াতে চায়‌।

খাওয়া যখন প্রায় শেষের দিকে তখনি হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মিশমি। রান্নাঘর থেকে পিরিচ আর চামচ এনে চেয়ার টেনে বসলো রসমালাই খেতে। সুশ্রী জিজ্ঞেস করল,“কোথায় গিয়েছিলি? কেমন কাটলো দিন? আর আবৃত্তি কোথায়?”

“দিন ভালোই কেটেছে। গিয়েছিলাম ঢাকার বাইরে। আর আবৃত্তি আপু শ্বশুরবাড়িতে।”

পাল্টা প্রশ্ন করল না সুশ্রী। ভেবে নিলো ছোটো বোন রসিকতা করছে তার সঙ্গে। তবে শাহিনূরের ললাটে ভাঁজ পড়ল। চিন্তিত হয়ে ধমকালেন,“অযথা ফাইজলামি করলে দিবো একটা থাপ্পড়। সত্যি করে বল, আবৃত্তি কোথায়? কাল তোর ছোটো খালার শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক আসবে আংটি পরাতে। তারপরেও তোর বাবা কোথায় রেখে এলো তাকে? আমার মাথা কী সবার সামনে হেট করতে চায়?”

মোজাম্মেল হোসেন সবে গোসল সেরে এসেছেন। স্ত্রীর কথা শ্রবণাতীত হতেই এবার আর কথা ঘুরালেন না বা এড়িয়ে গেলেন না। গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন,“ও মজা করছে না। যা বলছে সত্যি বলছে। তুমি তোমার বোনের শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে আসতে নিষেধ করে দাও।”

উপস্থিত বাকি দুই নারী চরিত্র চমকালো। শাহিনূর বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,“মানে? কী বলছো?”

“আমরা গাজীপুর গিয়েছিলাম। যেহেতু আবৃত্তির অভিভাবক আমি তাই ওর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার শুধুই আমার। এমনকি বিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও আমার। তাই বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।”

“কার সঙ্গে?”

“শিথিলের সঙ্গে।”

মুহূর্তেই স্থানটিতে যেন বিস্ফোরণ ঘটলো। খাওয়া থেমে গেলো সুশ্রীর। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। শাহিনূরও অবাক, বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। চেঁচামেচি করতে গিয়েও পারলেন না। ধীর কণ্ঠে বললেন,“কী আবোল-তাবোল বলছো?”

“আবোল-তাবোল বলছি না। তোমার একগুঁয়েমির কারণে তো আর দুটো ছেলে-মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেতে পারি না, তাই ওদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। আমি আর শিথিলের বাবা দুজনে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছি।”

“আমাকে না জানিয়ে?”

“তোমাকে জানিয়েই বা কী হতো? সেই মাঝখানে বাঁধা সৃষ্টি করতে। তাই জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি।”

বিপরীতে কী বলবেন বা বলা উচিত বুঝতে পারলেন না শাহিনূর। আবারো নিরব রইলেন। কত সময়ের জন্য কে জানে? হঠাৎ করেই সেই নিরবতা রূপ নিলো রাগে। তুমুল রাগ। আশপাশ ভস্ম করে দেওয়ার মতো রাগ। ধাপধুপ পা ফেলে চলে গেলেন শোবার ঘরে। অথচ সবে নিজের জন্য প্লেটে খাবার বেড়েছিলেন তিনি। সেই খাবার আর খাওয়া হলো না। মোজাম্মেল হোসেন তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেন,“তোদের মা রেগে গেছে। বিরক্ত করিস না। খেয়েদেয়ে সব গুছিয়ে শাফিনকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়িস। আর সুশ্রী, একদম রাত জাগবি না বলে দিচ্ছি।”

এরপর তিনিও আর দাঁড়ালেন না। পিছু নিলেন স্ত্রীর। মেয়েরা বুঝলো, বাসায় এখন ঝামেলা চলবে। সুশ্রীর গলা দিয়েও আর খাবার নামলো না। মেয়েটা কেমন করে যেন বাসি ফুলের মতো নেতিয়ে পড়ল। ঘোলাটে হয়ে গেলো আঁখি। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্লান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,“হ্যাঁ রে মিশমি, নিয়ম অনুযায়ী আজ তাদের বাসর রাত তাই না?”

হাস্যোজ্জ্বল মিশমির বুকটা বড়ো বোনের অসহায় কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত বাক্যে ধ্বক করে উঠল আচমকাই। মনে পড়ে গেলো সেদিন রাতের সমস্ত ঘটনা। কণ্ঠনালী দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না তার। কথা বলতে গিয়ে সুশ্রীর গলা কেঁপে উঠল। পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ল, “আমায় একবারও জানালি না কেনো? এত পর হয়ে গিয়েছি?”

এই মুহূর্তে এসে মিশমির ভীষণ কান্না পেলো। সাফাই গাওয়ার ভঙিতে বললো,“আমি ওখানে গিয়েই সবটা জেনেছি। আবৃত্তি আপুও তাই।”

“শিথিল ভাই নিশ্চয়ই অনেক খুশি হয়েছেন? আর আবৃত্তি? যাক, মেয়েটা অন্তত জীবনে একজন ভালো, আগলে রাখার মতো মানুষ পেয়েছে। আচ্ছা, ওদের একসঙ্গে দেখতে কেমন লাগছিল? ভীষণ সুন্দর তাই না? ছবি আছে তোর কাছে?”

মিশমি ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ঠোঁট উল্টে কান্না আটকে রাখার প্রয়াস চালালো। সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে বোনের মনের অবস্থা। ভালোবাসার মানুষকে অন্যের হয়ে যেতে দেখা বা শোনার মতো বিদীর্ণ কষ্ট কী আর আছে? সুশ্রী হাত ধুয়ে উঠে গেলো। যেতে যেতে বললো,“থাক লাগবে না। কষ্ট বাড়বে। এগুলো একটু গুছিয়ে রাখিস, প্লিজ। আমার কেমন যেন লাগছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, একটু ঘুমানো প্রয়োজন।”

মিশমি পেছন থেকে ডেকে বললো,“দরজা আটকাস না, আপু। আজ আমরা একসঙ্গে ঘুমাবো।”

কিন্তু সেকথা সুশ্রীর শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে মনে হলো না। মুহূর্তেই খট করে দরজা লাগানোর শব্দ হলো। মিশমি হতাশ হলো। আফসোস হলো খুব। যদি আরো আগে সে টের পেতো! তাহলে হয়তো এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে কিছুতেই দিতো না।

দুর্বল শরীরটা ঠেলেঠুলে বিছানায় এনে ছেড়ে দিলো সুশ্রী। মৃগী রোগীদের মতো শরীরটা তার কাঁপছে। শব্দ করে কান্না করার মতো শক্তিটুকু যেন হারিয়ে গিয়েছে কোথাও। নিঃশব্দে চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রু। ভালোবাসা এত করুণ কেনো? সমাপ্তিতে যদি না পাওয়াই থাকে নিয়তি, তাহলে এতশত অনুভূতি জেগে ওঠার প্রয়োজন কী ছিল? সুশ্রীর মনে হতে লাগলো সে হ্যালুসিনেশন করছে। শিথিলের সেই পরিচিত হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ভেসে উঠছে চোখের সামনে। তার দিকেই চেয়ে আছে, ঘোলাটে দু’চোখ অথচ কত আকুতি! হাত বাড়িয়ে ডাকছে তাকে। অস্পষ্ট সেই ডাক— তবুও নিখুঁতভাবে হৃদয় ভেদ করছে সুশ্রীর।সেই ডাকে সাড়া দিতে চাইলো মেয়েটি। অনেক কষ্টে উঠে বসলো। কিন্তু তার কল্পনা ছুটে গেলো। সারা ঘরে তাকিয়ে দেখলো— শিথিল নেই, কোথাও নেই, কেউ নেই। একা, নিঃসঙ্গ ঘরটা নিঃশব্দে ভয়ানকভাবে চেয়ে আছে তার দিকে।

নড়বড়ে পায়ে হেঁটে গিয়ে পড়ার টেবিলে বসলো সে। কাঁপা কাঁপা আঙুলে ধরলো সফেদ কাগজের উপর কলম। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে লিখে ফেলল অগোছালো কিছু শব্দের বুননে আস্ত এক গোপন চিঠি,

‘প্রিয় শিথিল ভাই,
এক আকাশের নিচে এত কাছাকাছি থাকার পরেও আপনি জানতে পারলেন না, এক নারীর আপনার প্রতি আকাশসম প্রেম আর হাহাকারের কথা। জানলেন না, আপনার জন্য পাহাড়সম ভালোবাসা জমিয়ে রেখে, কতশত দিবারাত্রি নিদ্রাহীন কাটিয়ে দেওয়া— ‘সুন্দরী’ খেতাব পাওয়া এক নারীর কথা। জানলেন না, আপনার হাসি আর দিপ্তী ছড়ানো চেহারা কল্পনায় বন্দি করে কিশোরী থেকে যুবতী হওয়া, হেরে যাওয়া মেয়েটির কথা।
আমি আজ হেরে গেছি। কী করুণ, কী লজ্জাজনক সেই হার! আপনাকে পাওয়ার যুদ্ধে এত বাজেভাবে হারতে হবে— এ কথা যদি শুরুতেই একবার জানতে পারতাম, তাহলে আজ হয়তো এত বড়ো সর্বনাশ আমার হতো না। অথচ আপনি কিছুই জানলেন না। এই আফসোস, এই হাহাকার— আমি রাখবো কোথায়? কীভাবে বয়ে বেড়াবো সারাজীবন? এত ভার সইবো কেমনে?

অতঃপর, লুকোচুপি ভালোবেসে আপনাকে পাওয়ার অপেক্ষা আমার ফুরোলো। ছাই হয়ে উড়ে গেলো ছোট্ট একটি সংসার সাজানোর স্বপ্ন।
আপনি চিরকাল ভালো থাকুন, সুখে থাকুন। শরীরে জড়িয়ে রাখুন অন্য নারীর গন্ধ। আর আমি? আমি না হয় মানিয়ে নেবো। খুঁজে নেবো বেঁচে থাকার কোনো এক পথ। কারণ, একতরফা ভালোবাসায় ব্যর্থ হওয়া মানুষদের যে কখনো ভালো থাকতে নেই— ভালো থাকা তাদের জন্য স্রেফ অপূর্ণ, অবিচ্ছেদ্য একটি স্বপ্ন।

ইতি—
হেরে যাওয়া এক ব্যর্থ নারী।’

কলম থেমে গেলো সুশ্রীর। চোখের অশ্রুতে ভিজতে লাগলো কাঁচা হাতের লেখা চিঠি। ঘরের আনাচে কানাচে ভ্যাপসা গরম মিশে কান্নার ভার বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রবল যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস করছে সদ্য অনুভূতিতে আঘাত হানা ক্লান্ত দেহ। দূর কোথা থেকে ভেসে আসছে গানের কিছু লাইন—
‘আমি কাউকে বলিনি সে নাম
কেউ জানেনা, না জানে আড়াল
জানে কান্নার রং, জানে জোছনার ছায়া।’

নাক টেনে কান্না আটকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টায় দম আটকে এলো তার। গলার কাছে দলা পাকানো আহাজারি, আর চোখ ভেজানো শত সহস্র না বলা কথা যেন একসঙ্গে চেপে বসেছে বুকে। চিঠির অস্তিত্ব মুছে দিতে হাত বাড়িয়ে ড্রয়ারের খুঁটিনাটি জিনিসপত্র হাতড়ে কাঁপা আঙুলে খুঁজে বের করল সে দেশলাই। কাঠির মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই আগুনেই পুড়িয়ে দিল অন্তিম চিঠির পৃষ্ঠা। চোখের পলক ফেলার আগেই আগুনে ভস্ম হয়ে গেলো তার সমস্ত না বলা কথা। চোখের সামনে ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে গেল, একটা বেদনা দায়ক রাত— ছোট্ট একটা সংসার, একটু ভালোবাসা, একটা সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ।

জানালার ধারে গিয়ে ছাইগুলো ছুঁড়ে দিলো বাইরে—বড়োই অবহেলায়, অথচ অপার মমতায়। যেন বুকের গভীরে সযত্নে লালন করা অনুভূতিগুলোকে চিরতরে বিদায় জানাচ্ছে সে।
একতরফা ভালোবাসার প্রমাণ যে জমিয়ে রাখতে নেই। লোকে জানলে বলবে কী?
________

বাইরে তখনো অন্ধকার। চারিদিক থেকে ভেসে আসছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। শহুরে জীবনে এত সুমধুর শব্দ তেমন একটা শোনা যায় না। তবে আবৃত্তির ঘুমটা ভাঙলো কারো ডাকে। ঘুমের ঘোরেই সে শুনতে পেলো কেউ তাকে ডাকছে,“আবৃত্তি! আর কত ঘুমাবে? এবার উঠে পড়। এই আবৃত্তি!”

ঘুম ঘুম চোখ দুটো মেলে তাকালো আবৃত্তি। দৃষ্টিগোচর হলো তার দিকে ঝুঁকে থাকা একটি পরিচিত মুখ। সঙ্গে সঙ্গে শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠল সে।ভয়ে থু থু ছিটালো বুকে। ভারি কতক শ্বাস ফেলে পলকহীন চোখে অচেনা এই ঘর, আসবাব দেখে গতকালের সমস্ত কিছু ভেসে উঠল স্মৃতির পাতায়। নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় লাগলো কিছুটা। শিথিল কোমল স্বরে বললো,“ভয় পেয়েছো?”

আবৃত্তি ফিরে তাকালো তার দিকে। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। জিজ্ঞেস করল,“সকাল হয়ে গিয়েছে?”

প্রশ্নটা করেই তাকালো পর্দার আড়ালে থাকা বন্ধ জানালায়। শিথিল বললো,“এখনো পুরোপুরি হয়নি। কিছুক্ষণ আগে ফজরের আজান দিয়েছে। নামাজের ওয়াক্ত চলছে। নামাজ পড়বে না? আমি মসজিদে যাচ্ছি। দরজা আটকে দিয়ে তুমিও অযু করে নামাজে বসো। জায়নামাজ আলমারির প্রথম ড্রয়ারে পেয়ে যাবে।”

সম্মতি দিলো আবৃত্তি। শিথিল আর দাঁড়াল না সেখানে। দরজা খুলে ঘর থেকে বের হলো। দ্বিতীয় তলায় গিয়ে সবকটা বন্ধুকে ঘুম থেকে একপ্রকার টেনে হেঁচড়ে তুলে তাদের নিয়েই রওনা দিলো মসজিদের উদ্দেশ্যে। সে যেতেই দরজা আটকে হাতমুখ ধুয়ে শাড়ি বদলে থ্রী পিস পরিধান করল আবৃত্তি। অযু করে নিজেও বসলো নামাজ পড়তে।

নামাজ শেষে জায়নামাজ ভাঁজ করে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। বাইরের অন্ধকার কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে আবছা আলো ফুটছে চারিদিকে। কাছে পিঠে কোথাও থেকে যেন ভেসে আসছে মিহি কণ্ঠের কোরআন তেলাওয়াত। এত সুমধুর তেলাওয়াত এতকাল শুধু ইউটিউবেই শুনেছে আবৃত্তি।

ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে পাঁচটার এদিক ওদিক। মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানলো আবৃত্তি। ঘর থেকে অতি সাবধানে সে বেরিয়ে এলো। বাড়ির পরিবেশ এখনো নিস্তব্ধ। ঘুম ভাঙেনি কারো।

দুতলা বিশিষ্ট বাড়িটায় শিথিলের ঘর হচ্ছে নিচতলায়। নিচতলায় শোবার ঘর তিনটা, একটি রান্নাঘর আর লাগোয়া একটি বাথরুম। যদিও ঘরেও এটাচ বাথরুম রয়েছে। তবে দ্বিতীয় তলায় এখনো যাওয়া হয়নি তার। বউ হয়ে এসেছেই তো গতকাল। শিথিলের ঘর থেকে বেরিয়ে যেই ঘরটা সামনে পড়ে সেটা খালি। সেই খালি ঘর পেরিয়ে প্রথম ঘরটির সামনে যেতেই দেখা মিললো স্বল্প কৃত্রিম আলোর। আবৃত্তি খেয়াল করল, এতক্ষণ ধরে ভেসে আসা সুমধুর কোরআন তেলাওয়াতের উৎস তবে এখানেই। উঁকি দিবে কি, দিবে না সেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে লাগলো। অনুমতি ছাড়া কারো ঘরে উঁকি দেওয়া অনুচিত।

বেশ কিছুক্ষণ ভেবে উল্টো দিকে ঘুরে আবারো ঘরের দিকে পা বাড়াতেই দরজাটা পুরোপুরি খুলে গিয়ে সাদা আলোয় ঝলমল করে উঠল ড্রয়িং রুম। আবৃত্তি থেমে দাঁড়াল। পিছু ফিরতেই দৃষ্টিগোচর হলো এক বয়স্ক লোককে। মাথায় চাপ প্রয়োগ করতেই মনে পড়ল, ইনিই শিথিলের বাবা। তার শ্বশুরমশাই। কিছুটা ঘাবড়ে গেলো আবৃত্তি। কেনো যে ঘর থেকে বের হতে গিয়েছিল? ভেবেই রাগ হলো নিজের উপর। চাপা স্বরে সালাম দিলো,“আসসালামু আলাইকুম।”

হামিদুল হক অমায়িক হাসলেন। স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। শুভ সকাল, আবৃত্তি মা।”

চকিতে মুখ তুলে তাকায় আবৃত্তি। শেষ বাক্যে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে সৌজন্য হাসে। হামিদুল হক ততক্ষণে ঘরের আলো নিভিয়ে ড্রয়িং রুমের বিশাল জানালাটা খুলে দিয়েছেন। তৎক্ষণাৎ শা শা করে জানালার পর্দা উড়িয়ে সকালের স্নিগ্ধ বাতাস প্রবেশ করল ভেতরে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,“শিথিল কোথায়? ঘরে?”

“না, নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছে।”

“ওহ, চা খাবে?”

দুদিকে মাথা নাড়ায় আবৃত্তি,“না।”

“আরে খেয়েই দেখো। বুড়ো হলেও আমার তৈরি চা কিন্তু মন্দ নয়।রোজ ফজরের নামাজ পড়ে তেলাওয়াত করে এক কাপ চা ছাড়া চলে না।”

আবৃত্তি শুনলো সে কথা। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে সাহস সঞ্চয় করে বললো,“তাহলে আমি বানাই? চা কিন্তু আমিও ভালোই বানাই।”

“বানাবে? আচ্ছা বানাও তবে। আমি কিন্তু আদা চা খাই। চিনি এক চামচ দিবে।”

“আচ্ছা।”

“তাহলে আমি বাগানে যাই? চা নিয়ে তুমি ওখানেই এসো। বাপ, বেটিতে মিলে প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে চা খাবো। ভোরের আলো, বাতাস স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী।”

বলেই শব্দ করে হাসলেন হামিদুল হক। আবৃত্তি মাথা তুলে তাকালো। বাপ, বেটি শব্দ দুটো শুনতেই ইতস্তত বোধ করল। এই সমস্ত কিছুই তার কাছে নতুন। এত সুন্দর আচরণ, আবদার! হামিদুল হক তার মুখখানা যেন খুব সহজেই পড়ে ফেলতে পারলেন। বললেন, “শ্বশুর কিন্তু বাবার মতোই। বলতে পারো দ্বিতীয় বাবা। শিথিল, সুহাসিনীর মতো তুমিও আমায় বাবা বলেই কিন্তু ডাকবে। ঠিক আছে?”

“আচ্ছা।”

“এবার ডেকে ফেলো দেখি।”

চাপা স্বভাবের হওয়ায় এবারো ব্যর্থ হলো আবৃত্তি। চুপ করে রইল। বিব্রত হলেই তার মুখে ঘাম জমে। হামিদুল হক অবশ্য জোরাজুরি করলেন না। সময় হলে মেয়ে এমনিতেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তাই দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন,“ব্যাপার না, হুটহাট কাউকে বাবা বলে ডাকা যায় না। একটু সময় লাগে। একসময় ঠিক অভ্যাস হয়ে যাবে।”

উনি যেতেই রান্নাঘরে প্রবেশ করল আবৃত্তি। শিথিল, সুশ্রী, মিশমির থেকে যতটা শুনেছিল তারচেয়েও ভদ্রলোকের আচরণ সুন্দর এবং অমায়িক।

আবৃত্তির রং চা পছন্দ নয়। তাই নিজের জন্য দুধ চা আর শ্বশুরের জন্য রং চা বানালো। সিল্কে পেয়ে গেলো মিষ্টি ছাড়া কুকিজের প্যাকেট।সেখান থেকেই কয়েকটা কুকিজ একটা বাটিতে সাজিয়ে ট্রে নিয়ে চলে এলো বাড়ির বাইরে।

শিথিলদের বাড়ির বাইরে অর্থাৎ রাউন্ড এরিয়ায় বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে, নতুন রঙ করা হয়েছে বাড়িটিতে। পেছনের দিকে বিল্ডিংয়ের সাথে লাগোয়া দুটি আম গাছ, একটি কাঁঠাল আর বেল গাছ রয়েছে।সামনের দিকের একপাশে রয়েছে করমচা গাছ এবং একটি বেঞ্চ। অপরপাশে শুধু ফুল গাছ আর ফুল গাছ। তার মধ্যে গেটের কাছে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা চন্দ্রপ্রভা গাছটা একটু বেশিই দ্যুতি ছড়াচ্ছে যেন। গতকাল এসেই তা খেয়াল করেছে আবৃত্তি। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে মুচকি হাসির রেখা।

ট্রে থেকে চায়ের কাপটা শ্বশুরের দিকে বাড়িয়ে দিলো আবৃত্তি। এবার সম্বোধন করেই বললো,“আপনার চা, বাবা।”

অবাক চোখে তাকালেন হামিদুল হক। অধরে প্রশান্তির দেখা মিললো। এত দ্রুতই যে মেয়েটা মানিয়ে নিতে পারবে বুঝতে পারেননি। মাথা নাড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। নাহ, চা টাও বেশ ভালোই বানায়। ছেলে তবে নিজের জন্য একেবারে রত্ন পছন্দ করেছে। বললেন,“আজ কিন্তু তোমার ফুফু শাশুড়িরা পরিবার সমেত তোমাকে দেখতে আসবে, মা।”

“আজ?”

“হ্যাঁ, তোমার ফুফু শাশুড়িরা দেশে ফিরেছে গতকাল রাতে। কয়েকদিন থেকে চলে যাবে। আবার কবে না কবে আসবে কে জানে? তাই ভাতিজা বিয়ে করেছে শুনেই ওরা কিছুটা ক্ষেপে গিয়েছে। তুমি এ নিয়ে চিন্তা করো না। সুহাসিনীকে আমি বলে রেখেছি। ও নিজ দায়িত্বে সব ব্যবস্থা করে নিবে‌। তোমায়ও তৈরি করে দিবে। তুমি শুধু ওকে একটু সাহায্য করো। নতুন বউ বলে কথা!”

একটু থেমে তারপর বললেন,“বউ ভাতের অনুষ্ঠান তো নিয়ম অনুযায়ী আজ কালকের মধ্যেই করা উচিত ছিল কিন্তু হঠাৎ বিয়ে হওয়ায় তা করা হচ্ছে না। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন। একমাত্র ছেলের বিয়েতে তো আর আলাদা করে সবাইকে বলা হয়নি তাই বৌ ভাতটা ধুমধাম করে না করলেই নয়। একটু প্রস্তুতি লাগবে। এই মাসটা যাক পরের মাসেই না হয় করবো।”

এভাবেই শ্বশুর বউমার মধ্যে চলতে আরম্ভ করল এক কথা থেকে বহু কথা। ধীরে ধীরে জড়তা কাটিয়ে উঠতে লাগলো যেন আবৃত্তি। বেলা কিছুটা বাড়তেই বাড়িতে অবস্থানরত সকলের ঘুম ভাঙলো। চা পর্ব সমাপ্ত করে সকলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সে চলে এলো ঘরে।

মিথিন ঘুম থেকে উঠে মায়ের হাতে ব্রাশ করে এদিক ওদিক না দেখেই চলে এলো মামার ঘরে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে চিৎকার করে ডাকলো,“বউ! বউ!”

আবৃত্তি সবে গোসল সেরে বেরিয়েছে। ননদের আদেশ। বাচ্চাটা দৌড়ে এসে তাকে জাপটে ধরতেই মুচকি হেসে কোলে তুলে নিলো। গতকাল সন্ধ্যায় দুজনার বেশ ভাব হয়েছে। জিজ্ঞেস করল,“ঘুম ভেঙেছে, মিথিন বুড়ার?”

উত্তর না দিয়ে স্বভাবসুলভ হাসলো মিথিন। বললো, “তোমাকে একন বউ বউ লাগছে না ক্যানো?”

“সাজ মুছে ফেলেছি তাই।”

“ক্যানো মুছেছো?”

“বিয়ে হয়ে গেছে তাই।”

“বিয়ে হয়ে গেছে?”

“হুম, কালই না বিয়ে হলো?”

“নিচে নামাও, বউ।”

ছটফট করে উঠল মিথিন। শিথিল এতক্ষণ বন্ধুদের সঙ্গেই ছিল। তাদের সাথেই নাস্তা করে ড্রয়িং রুমে আড্ডা দিচ্ছিল। দরজার কাছে আসতেই তাদের সমস্ত কথা সে শুনলো। সদ্য স্নান করা ব্যক্তিগত রমণীকে দেখে তার চোখ জোড়া থমকে গেলো। গলায় এসে আটকে গেলো রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটি অংশ—
“মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে,
বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা।
মেঘের মতো গুচ্ছ কেশরাশি
শিথান ঢাকি পড়েছে ভারে ভারে;

আবৃত্তির কোল থেকে ততক্ষণে নিচে নেমে এসেছে মিথিন। দরজার সামনে মামাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকলো,“মামু!”

সেই ডাকে শিথিল নড়েচড়ে উঠল। কাব্যিক ভ্রম ভাঙলো। ভেতরে ঢুকে ভ্রু কুটি করে ভাগ্নের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,“কে তোর বউ?”

মামার প্রশ্নে আবৃত্তির দিকে আঙুল তাক করে দেখিয়ে উত্তর দিলো মিথিন,“এইটা।”

“কার বউ?”

“আমার।”

“নিশ্চিত তোর জাউড়া বাপ শিখিয়েছে?”

অবলীলায় মাথা নাড়াল মিথিন। যেন তার বাপের নাম আসলেই জাউরা। শিথিল এসে বিছানায় বসলো। দুই হাতে ভাগ্নের বাহু ধরে বললো,“উহুম, এইটা আমার বউ। কাল বিয়ে করেছিলাম, ভুলে গিয়েছিস?”

“তোমার বউ?”

“হ্যাঁ, আর তোর মামী। বুঝেছিস? মামার বউ হয় মামী। জোরে জোরে মামী বলে ডাক।”

বরাবরের মতো এবারো বাধ্যগত ছেলের মতো মামার কথা শুনলো মিথিন। পিছু ফিরে ডাকলো,“মামী!”

শিথিলের পছন্দ হলো না ডাকটা। মন বদলালো। ফের বললো,“না রে মিথিন, এই ডাকটা ভালো লাগছে না। মামানি ডাক।”

“আবার মামানি?”

“হ্যাঁ, বেগুন বেসনে চুবালে যেমন হয় বেগুনী? ঠিক তেমনি মামার বউ হয় মামানি। এটাই কনফার্ম। ডাক ব্যাটা মামানি বলে।”

“মামানি!”

আবৃত্তি এবার ভীষণ লজ্জা পেলো। লজ্জায় ঘোমটা টানলো সিঁথি পর্যন্ত। মিছেমিছি ধমকালো,“বাচ্চা ছেলেকে কী শেখাচ্ছেন এসব?”

“রিয়্যালিটি শেখাচ্ছি। জামাইয়ের সঙ্গে কিউট একটা ভাগ্নে ফ্রি পেয়েছো। অনুভূতি কেমন, আবৃত্তি?”

“ভালো।”

বলেই আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল আবৃত্তি।

চলবে ________

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩৩]

ভাদ্র মাসের তীব্র রোদ পড়েছে বাইরে। চারপাশ ঝলসে যাওয়ার মতো গরম, কিন্তু ঘরের ভেতরটায় আজ অন্যরকম ব্যস্ততা। বহুদিন পর বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন দিয়ে ভরে উঠেছে। ঘরের কোথাও যেন পা ফেলার জায়গাটুকুও অবশিষ্ট নেই। প্রতিটি কানায় ভরে উঠেছে মানুষের চাপা গুঞ্জন, হাসি আর কথাবার্তার আওয়াজ। চারপাশ ভরে উঠেছে চেনা মুখ, প্রিয় কণ্ঠস্বর, পুরোনো গন্ধ। আত্মীয়-স্বজন আর পরিচিতদের আনাগোনায় বাড়িটা ফিরে পেয়েছে হারানো চঞ্চলতা।
শিথিলের বন্ধুরা আগেভাগেই দুপুরের খাবার খেয়ে বিদায় নিয়েছে। গন্তব্য শান্তদের বাড়ি। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে রাতের ট্রেনে ফিরে যাবে তারা ঢাকায়। আবার কবে সবাই একসঙ্গে হবে, কেউ তো আর জানে না সেকথা। তাই শান্ত-ই জোর করল সবাইকে।

বসার ঘরের সোফাগুলো দখল করে আছেন শিথিলের ফুফু ও ফুফারা। ফুফাতো ভাই-বোনেরা বসেছে কিছুটা দূরে, চেয়ারে। চেয়ারগুলো হারুন চাচা অন্যান্য ঘর থেকে এনে দিয়েছেন তাদের বসার জন্য। বাড়ি জুড়ে মিথিনের সঙ্গে ছোটাছুটি করছে তাদের বাচ্চারা। তাতে যেন আরো কোলাহলপূর্ণ হয়ে উঠেছে পরিবেশ। এমন সময় বড়ো ফুফু নাসরিনের কণ্ঠস্বর থেকে ঝরে পড়ল অভিযোগ,“সেদিন জন্ম নেওয়া ছেলেটাকে হঠাৎ ধুম করে বিয়ে দিলি তাও আবার কাউকে না জানিয়ে। ওর কী সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার বয়স হয়েছে? সেসব না হয় আপাতত বাদই দিলাম। অন্তত আমাদের তো জানাতে পারতি? তোর থেকে কিন্তু এটা আমি আশা করিনি, হামিদ।”

ছোটো বোন বিলকিসও সহমত পোষণ করলেন,“এইটা তুমি ঠিক করলে না ছোটো ভাইজান। আর কয়েকটা দিন কী অপেক্ষা করা যেতো না?”

হামিদুল হকের মুখে হাসি নেই। চুপচাপ মাথা পেতে মেনে নিলেন বোনদের অভিযোগ। বুঝিয়ে বললেন ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনার আংশিক। কিছুক্ষণ নিরব থেকে ফের বললেন,“রাগ করিস না তোরা। যার বিয়ে সেই তো জানতে পেরেছে বিয়ের দিন দুপুরে।”

বড়ো ফুফা আজমল সায় দিয়ে বললেন,“আমি কিন্তু হামিদের সিদ্ধান্তকে সম্মান করছি। দিনকাল ভালো না। পথেঘাটে মেয়েবাজি করে হারামে জড়ানোর চেয়ে হালাল উপায় অবলম্বন করে বিয়ে করেছে। একদম ঠিক কাজ করেছে।”

“তা কই সেই হাড়ে বজ্জাতটা?” ছোটো ফুফু জিজ্ঞেস করলেন।

নাম নিতে না নিতেই ছোটো ফুফুর ছেলে আরবিনের সঙ্গে বাড়িতে প্রবেশ করল শিথিল। সবাইকে সালাম দিয়ে বসে পড়ল বড়ো ফুফার পাশে। নাসরিন জিজ্ঞেস করলেন,“বিয়েতে দাওয়াত না দিয়ে এখন যে বিভিন্ন তাল বাহানা দাঁড় করাচ্ছে তোর বাপ! তার জন্য তোর বাপকে এখন আমাদের কী করা উচিত, তুই বল।”

“আমার আপু তো আমার পিঠে, বাহুতে ধামধুম কিল ঘুষি মেরে দেয়। তুমিও মারতে পারো। এল্ডার সিস্টার বলে কথা!”

হামিদুল হক ছেলেকে চোখ রাঙালেন কিন্তু সেসবে পাত্তা দিতে দেখা গেলো না শিথিলকে। ভদ্রমহিলা হেসে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,“তোর বউ কোথায়?”

“ঘরে মনে হয়।”

বিলকিস মুখ বাঁকিয়ে বললেন,“তো এখানে নিয়ে আসছিস না কেনো? আমাদের দেখাবি না?”

ছোটো ফুফুর সঙ্গে শিথিলের বয়সের পার্থক্য চৌদ্দ। তাই দুজনের মধ্যকার ফুফু ভাতিজার থেকে শত্রুতার সম্পর্কই একটু বেশি। এর অবশ্য কারণ একটা আছে। ছোটো বেলায় বিলকিসকে যেদিন পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল তার আগেরদিন বিকেলেই হাত থেকে কেড়ে নিয়ে শিথিলের চকলেট খেয়ে নেওয়ায় ফুফুর গালে নতুন গজানো দাঁত দিয়ে কামড় মেরেছিল সে। সেই কামড়ের চোটে কি বিচ্ছিরি এক দাগই না পড়েছিল কিশোরী মুখে!সেই দাগের স্থায়িত্ব ছিল টানা দেড় মাস। আর বিয়েটাও গিয়েছিল সেবারের মতো ভেঙে।

শিথিল ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,“গিফট এনেছো সঙ্গে?”

“গিফট পেতে হলে আগে আগে বিয়ের কথা জানাতে হয়। তাহলেই না বিদেশ থেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম।”

“তোমাদের গিফট মানেই তো ওই ডাব শ্যাম্পু, লাক্স সাবান আর গোটা কতক চকলেট। এত বছর ধরে এগুলো ছাড়া তো আর কিছুই আনতে দেখলাম না। বাবার ঘর তল্লাশি করলে এখনো কতগুলো পাওয়া যাবে। যা দিয়ে অনায়াসে একটা মুদি দোকান খোলা যাবে।”

নাসরিন থাপ্পড় মারলেন ভাতিজার বাহুতে। বিলকিস অভিযোগ করলেন ভাইয়ের কাছে,“দেখো ভাইজান, এই বদমাইশ কী বলে!”

“বিচার দিয়ে লাভ নেই। তোমাদের মতো অপ্রিয় বিদেশী আত্মীয়-স্বজন থাকার পরেও আমার কোনো লাভ লস নেই। আমি যদি কখনো বিদেশে যাই তাহলে কখনোই আমার ভাগ্নে আর বোনকে এসব পাঠাবো না। শুধু গোল্ড আর আইফোন পাঠাবো।”

মেহমাদ সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন ছুঁড়ল,“আর আমার জন্য?”

“বোন দিয়েছি, ভাগ্নে দিয়েছি এরপরেও আর কী চান দুলা ব্রো?”

“তুমি দাওনি, আমি অর্জন করেছি।”

“ওই একই ব্যাপার।”

শালা দুলাভাইয়ের খুনসুটির খবর কারোর অজানা নয়। হামিদুল হক হেসে উঠে গেলেন সেখান থেকে। কোনো এক কাজের বাহানায়। বিলকিস বললেন, “এবার ডাক তোর বউকে। দেখে একটু চোখ জুড়াই।”

“ডাকা যাবে না। দেখতে হলে তোমরা মেয়ে মানুষরা ঘরে গিয়ে দেখে এসো।”

“সে কোন রাজ্যের মহারানী যে ঘরে গিয়ে দেখে আসতে হবে?”

“আমার রাজ্যের।”

বড়ো ফুফা মুখ ভার করে বললেন,“সেকি রে শিথিল! আমাদের বউ দেখাবি না?”

“না।”

“কেনো?”

“আপনাদের আমি ভালোবাসি তাই।”

“ভালোবাসার সাথে বউ না দেখানোর কী সম্পর্ক?”

“কোনো সম্পর্ক নেই। এমনিই বউকে পর পুরুষের সামনে আনবো না।”

বিলকিস কথা কেড়ে নিলেন,“তোর বউ কী এমন পর্দা করে যে ফুফা শ্বশুর, দেওরদের সামনে আসতে পারবে না? শুনেছি তো এখনো লেখাপড়া করে।”

“বাইরে বের হলে বোরকা আর হিজাব পরে বের হতো। এখন যেহেতু আমার বউ সেহেতু বউকে নিকাব, হাত মোজা, পা মোজাও পরাবো। যখন ইচ্ছে হবে শুধু আমিই দেখবো। আর পড়ে তো গার্লস কলেজে অনার্স। ওইটা ব্যাপার না।”

আর কথা বাড়ালেন না উনারা। মেনে নিলেন ছেলের যুক্তি। সব নারীরাই হাঁটা ধরলেন ঘরের দিকে। নতুন বউ দেখার উদ্দেশ্যে।

আবৃত্তি তৈরি হয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে বিছানায়। রান্নার দিকটা সুশ্রীর সামলানোর কথা থাকলেও মাংস, পোলাও, পায়েস, ডাল সে নিজেই রান্না করেছে। যতই হোক,নতুন বউ বলে কথা! বিয়ের পর যে নতুন বউদের রান্না করে সবাইকে খাওয়াতে হয় তা আবৃত্তি জানে। তখনি ঘরে এলো সুহাসিনী। ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,“মাথায় ঘোমটা দিয়ে ঠিক হয়ে বসো। ফুপিরা আসছে।”

ননদের কথায় কপাল পর্যন্ত ঘোমটা টেনে ঠিক হয়ে বসলো আবৃত্তি। নাসরিন, বিলকিস প্রবেশ করলেন ভেতরে। উনাদের পেছনে বড়ো জনের দুই ছেলের বউ। উনাদের চাহনিতে ভয়ে দুরু দুরু করছে আবৃত্তির বুক। তবে তার ভয়কে পুরোপুরি দূর করে দিয়ে দুজনেই হেসে বসলেন তার দুপাশে। ছোটো ছোটো দুটো গহনার বাক্স হাতে ধরিয়ে দিয়ে নাসরিন বললেন,“আমরা হচ্ছি তোমার ফুফু শাশুড়ি। আমি বড়ো, তোমার শ্বশুরের থেকেও বড়ো। আর ও হচ্ছে সবার ছোটো। গতকাল দেশে ফিরে তোমাদের বিয়ের কথা জানতে পারলাম। তাই আর দেরি না করে আজই চলে এলাম তোমাকে দেখতে।”

আবৃত্তি প্রত্যুত্তরে কৃত্রিম হাসলো। বিলকিস উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,“তা তোমার আর শিথিলের কী প্রেমের বিয়ে? কীভাবে হলো শুনি?”

আবৃত্তি ঘাবড়ে গেলো বোধহয়। সুহাসিনী তার হয়ে উত্তর দিলো,“আরে প্রেমের বিয়ে না ফুপি। নূর আন্টির কথা মনে আছে তোমাদের? ওই যে মায়ের খালাতো বোন? আন্টির ননদের মেয়ে আবৃত্তি। শিথিলকে তো তোমরা জানোই? একবার যা পছন্দ হবে তা ওর লাগবেই। ওভাবেই আরকি আবৃত্তিকেও পছন্দ হয়েছে। ব্যস, তারপর বাবার কাছে বিয়ের আবদার। পরে আঙ্কেল আর বাবা মিলে সাদামাটা ভাবে বিয়েটা দিয়ে দিলো।”

ব্যাপারটা এবার সকলের কাছেই পরিষ্কার। নাসরিন প্রশ্ন করলেন,“তা তোমার বাবা-মা কী করেন? ভাই- বোন কয়জন? নিজের সম্পর্কে একটু বলো, শুনি।”

“মা নেই, ছেলেবেলায় মারা গিয়েছেন।”

সঙ্গে সঙ্গে আফসোসের সুর ভেসে এলো। সান্ত্বনা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,“আর বাবা?”

ভেতর থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলো আবৃত্তি। এই প্রশ্নের মুখোমুখি হলেই সে কথা বলতে ভুলে যায়। আঁতকে ওঠে। সুহাসিনী-ই বড়ো বোনের মতো সামলে নিলো পরিস্থিতি,“আর পাঁচটা বাঙালি পুরুষ যা করে তাই করেছে। সবাই তো আর আমাদের বাবা আর তোমাদের ভাইয়ের মতো নয়, ফুপি। বাদ দাও এসব। মেয়েটা এমনিতেই নতুন পরিবেশে, নতুন মানুষদের দেখে ঘাবড়ে গিয়েছে।”

ভদ্রমহিলা দুজন মেনে নিলেন সেই কথা। দীর্ঘ জীবন দেশের বাইরে থাকায় উনাদের চিন্তাধারা আর পাঁচটা বাঙালি নারীদের মতো অবশ্য পুরোপুরি এক নয়। মানুষের চেহারা বা অবস্থান নিয়ে কটাক্ষ করতে উনারা জানেন না। কথাবার্তা, পরিচয় পর্ব শেষে সবাই গিয়ে খেতে বসলো। শিথিলের কড়া নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিলকিস জোরপূর্বক আবৃত্তিকে নিয়ে গেলো সেখানে।

খেতে বসে পারিবারিক, রাজনৈতিক, সামাজিক নানা ধরণের আলোচনা চললো। এক ফাঁকে চাপা স্বরে নাসরিন জিজ্ঞেস করলেন,“বড়ো ভাইজানকে আসতে বলিসনি, হামিদ? এলো না যে?”

“হারুনের হাত দিয়ে বিয়ের আগেরদিন একবার গ্ৰামে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সেই চিঠির উত্তরও আসেনি এমনকি বিয়েতেও সে আসেনি। কাল নিজে ফোন করে বলেছিলাম তবুও এলো না। সামান্য সম্পত্তির জন্য যদি ভাই-বোনদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয় তাহলে আর কী করার আছে?”

নাসরিন মাথা নাড়ান। মগ্ন হন কোনো এক চিন্তায়। বাপের ঘরে এমন একটা অমানুষ যে কীভাবে হলো?

দুপুরের খাওয়া শেষে সবাই যখন বিশ্রাম নিচ্ছে তখনি শ্বশুরের ঘরে ডাক পড়ল আবৃত্তির। গুটি গুটি পায়ে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল সে‌। দরজায় টোকা দিয়ে কোমল স্বরে অনুমতি চাইলো,“আসবো বাবা?”

ভেতর থেকে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো,“এসো।”

অনুমতি পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করল আবৃত্তি। সম্মুখে তাকাতেই দেখতে পেলো বিছানায় বেশ কতগুলো শাড়ি এবং কাঠের একটা বাক্স নিয়ে বসে আছেন শ্বশুরমশাই। হামিদুল হক ইশারায় তাকেও বসতে বললেন। আবৃত্তি বসতেই তিনি হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে উঠলেন,“এখানে যেই শাড়িগুলো দেখছো, সব তোমার শাশুড়ির। কিছু সে বেঁচে থাকতে কেনা হয়েছে আবার কিছু তার মৃত্যুর পর।”

“মৃত্যুর পর?” অবাক হলো আবৃত্তি।

ভদ্রলোক মৃদু হাসলেন,“শাড়ি পরতে ভীষণ পছন্দ করতো তোমার শাশুড়ি মা। শিথিলের মতোই বেকার অবস্থায় বিয়ে করায় নতুন স্ত্রীকে তেমন দামি শাড়ি কিনে দিতে পারিনি। দিতে হয়েছিল সস্তা, সুতির ছাপা শাড়ি। এক ধোয়া দিলেই বালতির পর বালতি রঙ ধুয়ে উঠতো। পরে অবশ্য চাকরি পেয়ে সেই দিন বদলেছিল আমাদের। আলমারিতে সস্তা শাড়ির বদলে স্থান পেয়েছিল টাঙ্গাইল, জামদানি, মসলিনসহ আর কত কি! প্রতি ঈদে নিজের জন্য পাঞ্জাবি কিনতে গিয়ে সাথে কেনা হতো শাড়ি। তবে তোমার শাশুড়ির যেন মন পড়েছিল পুরোনো সেই সস্তা শাড়িতেই। সেই অভ্যাস আমার বদলায়নি। সে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও আমি কিনেই গিয়েছি একের পর এক শাড়ি।
সেসব গল্প অন্য কোনোদিন না হয় করবো। তোমার সঙ্গে আমার অনেক গল্প করার আছে। এই শাড়িগুলো এখন থেকে তোমার। তুমি পরবে। সুহাসিনীকে অর্ধেক দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে মায়ের স্মৃতি হিসেবে এর থেকে মাত্র দুইটা পুরোনো শাড়ি নিয়েছিল। বলেছিল, এগুলো তুমি শিথিলের বিয়ের পর ওর বউকে দিও। ওহ একটা কথা বলে রাখি, তোমার ননদ কিন্তু অনেক ভালো একটা মেয়ে। সর্বদা তার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। যত তাকে আপন করে নিবে ততই ভালোবাসা পাবে‌। দুটো ছেলে- মেয়েকেই আমি অনেক যত্নে বড়ো করেছি তো!”

থামলেন হামিদুল হক। কাঠের বাক্স খুলে বের করলেন কিছু ছিমছাম নিত্য পরার জন্য গয়না। পুত্রবধূর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,“তোমার শাশুড়ি বেঁচে থাকলে আজ হয়তো সে-ই এগুলো তোমার হাতে তুলে দিয়ে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতো। কিন্তু সে তো নেই তাই আমাকেই তার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এগুলো সব পুরোনো আমলের ডিজাইন। তখনকার সময় এসব ডিজাইন-ই চলতো। আমি একা পুরুষ মানুষ তাই এগুলোই পালিশ করে এতদিন আঁকড়ে ধরে রেখেছিলাম। এখন তুমি এসেছো তাই এগুলো সব তোমার। আরো আছে, তবে সেগুলো লকারে। বাড়ি বেশিরভাগ সময় ফাঁকা পড়ে থাকে। কখন চোর ডাকাত ঢুকে পড়ে তার তো কোনো ঠিকঠিকানা নেই। বাড়িতে মানুষের ভিড় কমুক তখন না হয় এনে দিবো। তোমার পছন্দ মতো স্বর্ণাকারের দোকানে গিয়ে ডিজাইন বদলে নিও।”

বাক্সর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আবৃত্তি। চোখে জমলো অশ্রু। নাক টেনে মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো, “আমার জন্মদাতা পিতাও আমার সঙ্গে হেসে দুটো কথা বলেনি কখনো। পালন করেনি কোনো দায়িত্ব। অথচ বিয়ের পর থেকে আপনি!
আপনার হাসি দেখে, কথা শুনে কিছুতেই আপনাকে আমার শ্বশুর বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আপনি আমার বাবা।”

“আমি তো তোমার বাবাই। মনে নেই আজ সকালে বললাম, শ্বশুর হচ্ছে দ্বিতীয় বাবা। তারপর থেকে কতবার বাবা বলে ডাকলে!”

আবৃত্তি এবার কেঁদেই ফেলল ফুঁপিয়ে। হামিদুল হক মিছেমিছি ধমকালেন,“আহা কাঁদে কেনো, মা? চোখ থেকে পানি মোছো। মোছো বলছি। এভাবে কাঁদতে নেই।”

সেকথা শুনলো না আবৃত্তি। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। সে কাঁদবেই। এত বছর বাদে সে একটা বাবা পেয়েছে। সেই খুশিতেও তো মানুষ একটু কাঁদে নাকি? সুযোগ পেলে আরেকবার নিজের বাবার মুখোমুখি হয়ে এই মানুষটিকে নিয়ে সে দেখিয়ে দিবে, বাবা আসলে কেমন হয়!
___________

বাসার ভেতরকার অবস্থা ভীষণ ছিমছাম, নিরব। গত রাতে ঝগড়াঝাটির পর সকাল থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আর কোনো কথাবার্তা নেই। একে অপরকে এড়িয়ে চলছেন তারা। মিশমির থেকে আংশিক ঘটনা শুনে ভয়ে ভয়ে চুপচাপ কাজ করছে মিতা। মোজাম্মেল হোসেন বাড়িতে নেই। সকালের নাস্তা করে সেই যে দোকানে গিয়েছেন তারপর দুপুরে খেতেও আসেননি। এমনকি বিকেলে এসে ভাত ঘুমও দেননি আজ। মিশমি গিয়েছে কলেজে, শাফিন স্কুল থেকে এসে গোসল সেরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েছে। তাও নিজে নিজে। মা রেগে থাকলে সে ভদ্র বাচ্চা হয়েই থাকে। মার খাওয়ার ভয়ে। আর সুশ্রী! সে তো ঘরবন্দি হয়েই বসে আছে।

শাহিনূর ঘর থেকে বের হয়ে টেবিলে খেতে বসলেন। মিতাকে জিজ্ঞেস করলেন,“সুশ্রী খেয়েছে?”

“না, আপু তো আজ ঘর থেকেই বের হয়নি। সকালে একবার নক করেছিলাম ঘর ঝাড়ু দেওয়ার জন্য কিন্তু সাড়াশব্দ করেনি।”

কথাটা শুনে ললাটে ভাঁজ পড়ল শাহিনূরের। স্বামীর সঙ্গে রাগের জেরে সেই যে রাতে ঘরে গিয়েছিলেন এরপর আর ছেলে-মেয়েদের খবর নেওয়া হয়নি। সকালে মিশমিই শাফিনকে স্কুলের জন্য রেডি করে দিয়েছিল। চিন্তায় পড়লেন শাহিনূর। উনার বড়ো মেয়ে এমন কখনো করে না। কলেজ, ক্লাস মিস দেয় না। এমনকি কম খেলেও সময় মতো খায়‌। অনিয়ম করে না। তাই খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলেন তিনি। হাত ধুয়ে এসে দাঁড়ালেন বড়ো কন্যার ঘরের সামনে। দরজায় বেশ কয়েকবার করাঘাত করে ডাকলেন,“সুশ্রী! ঘুমিয়ে আছিস? এই অসময়ে কীসের ঘুম? দরজা খোল।”

ভেতর থেকে কোনো উত্তর এলো না। এমন করেই কাটলো প্রায় মিনিট দশেক সময়। চিন্তা বাড়লো শাহিনূরের। এমন কখনো তো মেয়েটা করে না। তার ঘুম মোটেও গাঢ় নয়। তবে? চিন্তিত কণ্ঠে শেষবারের মতো বললেন,“দরজা খুলবি নাকি তোর বাবাকে ফোন করবো? আজিজকে এনে দরজা ভাঙবো?”

কথাটায় কাজ দিলো। মিনিট দুয়েক পর খুলে গেলো দরজা। ভেতরে রাতের মতো অন্ধকার। সুশ্রীর মাথার চুল থেকে শুরু করে পরনের পোশাকটা পর্যন্ত বিশ্রী রকমের এলোমেলো। চোখের নিচে পড়েছে নির্ঘুম রাতের ছাপ। মেয়ের অবস্থা দেখে ভারি অবাক হলেন শাহিনূর। দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে লাইট জ্বালালেন। খুলে দিলেন বন্ধ জানালা। কেমন এক বিদঘুটে গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। উনার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মেয়ের একি দুর্দশা? সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে আগাগোড়া তাকে দেখলেন।

সুশ্রীর শরীরে দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। দরজা খুলে দিয়ে এসেই সে বসে পড়ল বিছানায়। শাহিনূরের নজর তার দিক থেকে গিয়ে পড়ল মেঝেতে শুকিয়ে যাওয়া ছোপ ছোপ রক্তের দাগের উপর। বুক কেঁপে উঠল উনার। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে ভালো করে লক্ষ্য করতেই দেখা মিললো ফর্সা হাতের কব্জির উপর বেশ কয়েকটা কাটা দাগের। সেখানেও জমাট বেঁধে আছে রক্ত। বিছানায় রক্তাক্ত ব্লেড। পড়ার টেবিলের বইগুলো এখানে সেখানে ছড়ানো। মাথা ঘুরে উঠল শাহিনূরের। ছুটে গিয়ে মেয়ের পাশে বসে জড়িয়ে নিলেন তাকে।কান্নাজড়িত ভারি, চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,“মা! আমার মা! কী হয়েছে? এই অবস্থা কেনো তোর? হাত কাটলো কীভাবে?”

মাতৃ ছোঁয়া পেয়ে নিজেকে সামলাতে পারলো না সুশ্রী। হো হো করে কেঁদে উঠল। শেষ রাতে মেয়েটার যে কী হলো কে জানে? এমন বোঝদার মেয়ে কিনা একটা ছেলের জন্য বিশ্রী এক কান্ড ঘটাতে পর্যন্ত গিয়েছিল! মেয়ের কান্নায় সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল শাহিনূরের। উনার আদরের, বোঝদার, সুন্দর মেয়েটা কাঁদছে! তার রক্ত শুকিয়ে আছে মেঝেতে! এই মেয়েকে শাহিনূর কত ভালোবাসেন! যক্ষের ধন উনার। একে নিয়ে উনার কত স্বপ্ন! কত আশা, ভরসা! এই মেয়ে তো উনার গর্ব! শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মেয়েকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রাখলেন শাহিনূর। পারলে যেন ভেতরেই ঢুকিয়ে ফেলতেন। কী করবেন না করবেন কিছুই যেন বুঝতে পারছেন না। স্বামীকে ফোন করে সবটা জানাবেন? নাকি হাসপাতালে নিয়ে যাবেন? সারা শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে অস্থির কণ্ঠ বললেন,“আমার মায়ের কী হয়েছে? বল আম্মুকে। কেউ কিছু বলেছে? কিছু করেছে? কী করেছে শুধু বল একবার। জানে মেরে ফেলবো। কেউ ছুঁয়েছে?”

শেষ কথাটা বলতে গিয়ে কণ্ঠনালী কাঁপলো উনার। মেয়ের মা হওয়া যে অত সহজ নয়। সারাক্ষণ মাথায় আজেবাজে চিন্তা ঘুরতে থাকে। মায়ের হাহাকারে কান্নার বেগ বাড়লো সুশ্রীর। এই সময়ে এমন বিশ্বস্ত হাত আর বুকের যেন ভীষণ প্রয়োজন ছিল তার।মায়ের ছটফটানি দেখে নাক টেনে ভাঙা গলায় বললো, “আমার কষ্ট হচ্ছে, আম্মু। খুব কষ্ট হচ্ছে। মাথা ব্যথা করছে। এখন আমি কী করবো, আম্মু?”

কি করুণ সেই সুর! কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন শাহিনূর। নিজের চিন্তায় নিজেই লজ্জিত হলেন। কে কী করবে? মেয়ে তো গতকাল বিকেল থেকেই ঘরে‌। তাহলে কী হয়েছে তার? প্রশ্ন করতে গিয়েও করলেন না শাহিনূর। নিজ চেষ্টায় কিছু বুঝতেও পারলেন না। দুজনার মনের দূরত্ব যে সহস্র মাইলের চেয়েও বেশি। অজস্র চুমু খেলেন মেয়েকে। ছেড়ে দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো সারা ঘর খুঁজে বের করলেন ফার্স্ট এইড বক্স। ক্ষত স্থান পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। মিতাকে ডাকতে গিয়েও ডাকলেন না।তিনি চান না উনার পবিত্র, নিষ্পাপ মেয়েকে কেউ এমন রূপে দেখুক। পুরো ঘরটা ঝড়ের গতিতে যতটুকু সম্ভব গুছিয়ে ফেললেন। আবার এসে বসলেন মেয়ের পাশে। সারা শরীর বরফের মতো জমে আছে। কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। খানিক সময় ভেবে কণ্ঠে নমনীয়তা ঢেলে বললেন,“মাথা ব্যথা করছে? আয় শ্যাম্পু করে গোসল করিয়ে দেই। হালকা লাগবে।”

“করবো না, আম্মু। তুমি যাও।”

শাহিনূর শুনলেন না সেকথা। ছোটবেলায় অসুস্থ হলেই কান্নাকাটি করতো এই মেয়ে। তখন জোর করে ওকে গোসল করিয়ে খাইয়ে দিতেন তিনি। বুকে নিয়ে ঘুম পাড়াতেন। এরপর সব অসুখ বাপ বাপ বলে পালাতো। আজকেও তাই করার সিদ্ধান্ত নিলেন। টেনে নিয়ে গেলেন বাথরুমে। জোর করেই আহ্লাদী কথায় ভুলিয়ে গোসল করালেন। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছিয়ে তারপর হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকালেন চুল। পায়ে পা উল্টে বারবার পড়ে যেতে গেলেই তাকে ধরে নিচ্ছেন শাহিনূর। যেন ফিরে গিয়েছেন সেই ছোটবেলায়। যতই হোক, মা তো! মানুষ হিসেবে যেমনি হন, মা হিসেবে তিনি আদর্শ, কোমলমতী।

মিতাকে চেঁচিয়ে ডাকতেই মিতা এসে হাজির হলো। শাহিনূর সুশ্রীকে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হতে বলে গেলেন,“ও অসুস্থ। ঘরটা তুই ভালো করে গুছিয়ে দে‌। গোছানো শেষ হলে পারফিউম স্প্রে করে দিবি, বিচ্ছিরি গন্ধটা যেন দূর হয়।”

মিতা মাথা নেড়ে নেমে পড়ল কাজে। শাহিনূর মেয়েকে ধরে নিয়ে এলেন নিজের ঘরে। বিছানায় বসিয়ে নিয়ে এলেন গরুর মাংস আর সাথে বেশ কয়েকটা ভাজা মরিচ দিয়ে ঝাল ঝাল করে ভাত মাখিয়ে। মুখের মধ্যে জোর করেই ঠেসে দিয়ে বললেন,“কী হয়েছে জিজ্ঞেস করবো না। যদি মনে হয়, আম্মুকে বলা যাবে না তাহলে বলতে হবে না। কিন্তু এভাবে নিজেকে কষ্ট দিতে নেই, মা। তোমার আব্বু-আম্মু তোমাকে কত ভালোবাসে, বলো! তোমার ছোটো ছোটো দুই ভাই-বোন তোমাকে একটু না দেখলে অস্থির হয়ে যায়। তোমার নানু সারাক্ষণ তোমার নামে এর ওর কাছে সুনাম করে। তুমি যদি অসুস্থ হয়ে পড়, নিজেকে কষ্ট দাও, রক্ত ঝরিয়ে নিজেকে ধ্বংস করতে চাও, পাগলামি করো তাহলে আমাদের কী হবে? আদৌ কী তুমি ধ্বংস হবে? না। বরং ধ্বংস হবে তোমার আপন মানুষেরা। তোমার মতো মিষ্টি একটা মেয়ে কেনো যে এমন করেছে বা করছে তা আমি জানি না। তবে মনে রাখবে, আমরাই তোমার আপনজন। তোমার সব পরিস্থিতিতে আমরা তোমার পাশে আছি। আর কখনো এমন করো না, আম্মু। মনে দুঃখ পুষে রেখো না। সহ্য ক্ষমতা হারালে, এসে জড়িয়ে ধরে না হয় একটু কেঁদে মন হালকা করো। আমায় না বলতে পারলে আল্লাহকে বলো। তবুও তুমি কষ্ট পেও না। তোমার কষ্ট দেখলে আমাদেরও ভীষণ কষ্ট হয়।”

শাহিনূরও কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সুশ্রী চমকালো। তার কান্না থেমে গিয়েছে। এমন করে তো কখনো সে ভেবে দেখেনি? বরং ভেবেছে শুধু নিজের একপাক্ষিক প্রেম, ভালোবাসার কথা। আম্মুকে সে আবার জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। সারাজীবন শুধু জেনে এসেছে বাবাই তাকে বেশি ভালোবাসে। অথচ আজ! এই মুহূর্তে!

যখন তার হুঁশ ফিরবে, যখন ধোঁয়াশা কাটিয়ে ফিরে আসবে বাস্তব জীবনে— তখন হয়তো নিজের করা অবুঝপনার জন্য ভীষণ আফসোস করবে সুশ্রী। মরীচিকার পেছনে ছুটে সে নিজের ক্ষতি করতে চেয়েছিল। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছিল নিজের সুন্দর, সুস্থ পরিবারকে। আফসোস তো তাকে করতেই হবে!

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)