#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
#উপসংহার
রান্নাঘরের জানালায় চোখ রাখলেই দেখা যায় বড়ো বড়ো দালানের বদলে দিগন্তের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ সবুজ গাছগাছালি। কান পাতলেই শোনা যায় পাখির কলকাকলি, এক মধুর সকাল সঙ্গীত। আবৃত্তি সকালের নাস্তা তৈরির কাজে ব্যস্ত। আত্মীয়-স্বজনরা না থাকায় পুরো রান্নাঘর আজ তার দখলে।
বাড়িতে মানুষ বলতে মোটে তারা চারজন। গতকালও যে বাড়িটায় আত্মীয়-স্বজন, পরিচিতদের আনাগোনায় সরগরম ছিল, আজ সেখানে নেমে এসেছে একরকম নির্জনতা। যে যেভাবে এসেছিল, ঠিক সেভাবেই ফিরে গিয়েছে নিজের আপন ঠিকানায়।
শিথিলের ফুফুদের পরিবার গতকাল দুপুরে ভোজনের পর বিশ্রাম শেষে বিদায় নিয়েছেন। সুহাসিনী আর মেহমাদ ছেলেকে নিয়ে ফিরেছে বিকেলে। যাওয়ার আগে অবশ্য সদ্য বিবাহিত জীবনের নানা দায়দায়িত্ব নিয়ে ভাই বউকে বেশ কিছু পরামর্শও দিয়ে গিয়েছে সে।
শুরুতে আবৃত্তির মনে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছিল। শিথিলের আত্মীয়রাও যদি নিকটীয় মুখগুলোর মতোই তার রূপ, তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য করে? তবে তার সেই ভয়টা যেন চিরস্থায়ী হলো না। সব ভয় কাটিয়ে দিয়ে খুব সহজভাবে তাকে গ্ৰহণ করে নিয়েছে সকলে। বিশেষ করে শিথিলের ফুফুদের সৌজন্য ও মমতার ছায়ায় অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে সে।
সকালে বেশি কিছু রান্না করল না আবৃত্তি। গতকালের খাবার বেঁচে গিয়েছে। তাই ফ্রিজ থেকে রান্না করা মাংস বের করে গরম করে আটার রুটি বানালো শুধু। হামিদুল হক তখন জানালার ধারে নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসে কিছুক্ষণ আগে হাতে পাওয়া পত্রিকাটা পড়ছেন। আবৃত্তি টেবিলে খাবার পরিবেশন করল। মিহি স্বরে ডাকলো,“খেতে আসুন, বাবা।”
হামিদুল হক পত্রিকা থেকে চোখ না তুলেই মুচকি হেসে জবাব দিলেন,“আসছি।”
“আরেক কাপ চা খাবেন? এখন দিবো, নাকি খাওয়ার পর?”
“খাওয়ার পরেই দিও।”
এবার তার নজর গেলো শিথিলের দিকে। টিভি ছেড়ে রিমোট হাতে বসে আছে। স্ত্রীর কথা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে মনে হলো না। দৃষ্টি টিভিতে থাকলেও মনোযোগ অন্য কোথাও। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে তার জীবনটা বদলে গেলো। ইতি ঘটলো ব্যাচেলর, ছন্নছাড়া জীবনের। শোবার ঘরের আলমারি, ড্রেসিং টেবিলে স্থান পেলো মেয়েলি সব জিনিসপত্রের। এসব দেখে সে ভীষণ অবাক হচ্ছে, নিজেকে বিবাহিত ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।
আবৃত্তি মাথার ঘোমটা কপাল পর্যন্ত টানলো। ইদানিং অল্পতেই লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে সে। গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,“তোমাকেও চা দিবো, শিথিল?”
নড়ে উঠল শিথিল। বিস্ফোরিত নেত্রে তাকালো। তব্ধা খেয়ে গেলো যেন। হামিদুল হক টেবিলে গিয়ে বসেছেন। প্রত্যুত্তর না করায় ধমকালেন ছেলেকে,“কী রে, বউমা কিছু জিজ্ঞেস করছে। উত্তর দিচ্ছিস না কেনো?”
বাবার কথায় একঝাঁক লজ্জা ঘিরে ধরলো তাকে। হঠাৎ মেয়েটির এমন সম্বোধনে অবাক হলো। বাবার সামনে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে অস্বস্তিতে ঘেমে উঠল শরীর। বিয়ে যতটা না সহজ ছিল তার থেকেও কঠিন ব্যাপার হচ্ছে, সিঙ্গেল বাবার সামনে বউ নিয়ে সংসার করা। উফ, কি লজ্জাজনক! আমতা আমতা করে বললো,“না থাক।”
“খাবার বেড়েছি।”
‘পরে খাবো’ বলতে গিয়েও থেমে গেলো শিথিল। ইচ্ছে করল ছুটে চলে যেতে। কিন্তু বাবার ভয়ে গেলো না। চুপচাপ খেতে বসলো। মেয়েদের মতো এত কেনো লজ্জা লাগছে তার? ভেবে পাচ্ছে না কিছুতেই। আবৃত্তি দুজনের বাটিতেই আরেক চামচ মাংসের ঝোল তুলে দিলো। হামিদুল হক প্রশংসার সুরে বললেন,“বহুদিন পর গোল গোল রুটি খাচ্ছি। হারুনের তৈরি রুটি তো একেবারে নেপালের মানচিত্র। কখনো আগুনে পোড়া আবার কখনো নুনে পোড়া।”
সামান্য প্রশংসাতেও আবৃত্তির মুখে হাসি ফুটে উঠল। তার জীবনে কখনোই সে প্রশংসা শোনেনি। বরং প্রতি পদে পদে শুনে এসেছে নিজের দোষ ত্রুটি। খেতে খেতে ছেলের উদ্দেশ্যে হামিদুল হক বললেন, “হারুনকে নিয়ে আজ আমি একটু গ্ৰামে যাবো। তোর ফুফু, ফুফারাও উকিল সমেত উপস্থিত থাকবে সেখানে।ফিরতে ফিরতে রাত হতে পারে।”
“আমি সঙ্গে যাবো? তুমি একা একা সামলাতে পারবে? তমাল, ইরফানরা যেই হিংস্র!”
“তুই গেলে বাড়ি খালি পড়ে থাকবে। বউমা কী একা থাকবে নাকি? তোর ফুফাতো ভাইরাও থাকবে ওখানে তাই চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। পরেরবার তোকে নিয়ে যাবো। আর হ্যাঁ, একদম বাড়ি থেকে বের হয়ে টো টো করে ঘুরবি না।”
আড়চোখে আবৃত্তির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে শিথিল। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো,“আমরা কাল ঢাকা ফিরে যাচ্ছি।”
“সেকি, কাল?”
“হ্যাঁ, এতদিন লেখাপড়া থেকে দূরে থাকলে ক্ষতি হবে।”
“থাকবি কোথায়? সেই বন্দোবস্ত করেছিস? আমি তো আরও তোর বন্ধুদের বললাম, যাতে সুন্দর একটা ভাড়া বাসা খুঁজে দেয়।”
“ওদের কথা বাদ দাও। যেভাবে এতদিন ছিলাম এখনো সেভাবেই থাকবো। আবৃত্তি ওর হোস্টেলে থাকবে। সুবিধামতো বাসা খুঁজে পরের মাসে না হয় সেখানে উঠে যাবো।”
হামিদুল হক সেকথায় সায় জানালেন। খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই শিথিল কেটে পড়ল। হারুন চাচা বাড়ি ফিরলেন সকাল সাড়ে নয়টার দিকে। শিথিলের মতো উনিও টো টো কোম্পানির সদস্য। সুযোগ পেলেই খাওয়া-দাওয়া আর সময় ভুলে যেখানে সেখানে চলে যান। উনি আসতেই হামিদুল হক তৈরি হয়ে উনাকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলেন পৈতৃক নিবাসের উদ্দেশ্যে। ছায়াবিথী থেকে উনার গ্ৰামের বাড়ির দূরত্ব তেমন বেশি নয়। ওই তো মাত্র আধ ঘণ্টার পথ।
দুতলার বাড়িটা এখন পুরোপুরি নিস্তব্ধ। চারজনের বদলে এখন সদস্য সংখ্যা মাত্র দুইজন। গত রাত পর্যন্ত উত্তপ্ত গরম থাকলেও ভোর থেকে শুরু হয়েছে মেঘের তর্জন গর্জন। শিথিল সেই যে ঘরে ঢুকেছে আর বের হয়নি। দুপুরের জন্য ভাত রান্না করে ঘামে ভেজা দেহ নিয়ে ঘরে এলো আবৃত্তি। সামনে তাকাতেই নজরবন্দি হলো ঘুমন্ত পুরুষটিকে। শব্দহীন পায়ে সে এগিয়ে এসে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে হাত দুটো রাখলো বিছানার উপর। ঘুমন্ত শিথিলকে পূর্বে কখনো দেখা হয়নি তার। ঘুমালে ছেলেটাকে ভীষণ নিষ্পাপ লাগে, মনে হয় যেন অবুঝ এক শিশু। অথচ জেগে উঠলেই শুরু হয়ে যায় তার দৌড় ঝাঁপ। কথা শুনলে মনে হয় মহা জ্ঞানী এবং পরিপক্ক। শুনতেই ইচ্ছে করে বারবার। এক ধ্যানে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসলো আবৃত্তি। এই ছেলেটাই তার স্বামী! অবশেষে তার জীবনে মিললো ভালোবাসার দেখা এবং প্রাপ্তি। তারও তবে সংসার হলো? ভাবতেই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল শ্যামবর্ণের মুখখানা। চোখে জমলো অশ্রু।
বিছানায় উঠে কিছুটা ঝুঁকে বসলো। চিকন আঙুলে হাত চালালো চুলের ভাঁজে। এতোটুকুতেই লাজুক মেয়েটার যায় যায় অবস্থা। ভাবতেই অবাক লাগে, এই ছেলেটাই তার জীবনসঙ্গী। এর সঙ্গেই পাড়ি দিতে হবে বাকিটা পথ। অথচ আবৃত্তি এমন কাউকে কী কখনো আশা করেছিল? করেনি। সকলের থেকে শুনে এসেছে, এ মেয়েকে বিয়ে করবে কে? না আছে রূপ আর না আছে পরিবার। এসব শুনতে শুনতে ভাবার ফুরসতই তো পায়নি। শিথিল যেন তার জীবনে রবের দেওয়া এতদিন সহ্য করে আসা দুঃখর উপরি পাওনা, উপহার।
ঘুমটা ভেঙে গেলো শিথিলের। আচমকা চোখ মেলে তাকালো। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে ডাকলো,“আবৃত্তি!”
ধ্যান ভাঙলো আবৃত্তির। ঘাবড়ে গিয়ে সরে যেতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। হাতের কব্জি টেনে ধরে তাকে আটকে দিলো শিথিল। উঠে বসলো। বললো, “বিয়ের আগেও পালাই পালাই করেছো, বিয়ের পর থেকেও পালাই পালাই করছো। সমস্যা কী? ভূত নাকি রাক্ষস আমি? খেয়ে ফেলবো তোমায়? কোথায় যাবে পালিয়ে?”
“কোথায় পালিয়েছে? যহরের আজান দিয়েছে। তাই ডাকতে এসেছিলাম গোসলের জন্য।”
“তো ডাকোনি কেনো?”
“ঘুমাচ্ছিলে।”
থম মেরে কিছুক্ষণ বসে রইল শিথিল। মেয়েলি হাতটা এখনো তার হাতের মুঠোয়। মৃদু হেসে কৌতুক করে বললো,“সকাল থেকে মিষ্টি করে ডাকছো, ব্যাপার কী? ভালোবাসার রস তো এখনো পুরোপুরি খাইয়েছি বলে মনে পড়ছে না।”
এই সামান্য কথাতেও আবৃত্তির কান যেন গরম হয়ে উঠল। মাথা নিচু করে বললো,“আপু বলেছে।”
“কী বলেছে?”
“স্বামীকে নাম ধরে, তুমি করে সম্বোধন করতে।”
“আচ্ছা?”
“হু।”
“কোন আপু?”
“মিথিনের আম্মু।”
“আর কিছু বলেনি?”
“বলেছে, স্বামীর কথা শুনতে।”
“দারুণ তো!”
“ছাড়ো এবার।”
“কেনো? যাবে কোথায়?”
“গোসল করতে।”
“একা একা?”
“তো কী তোমাকে সঙ্গে নিয়ে?”
“চাইলে নিতে পারো। আসবো?”
চোখ রাঙালো আবৃত্তি। শিথিল হাত ছেড়ে দিয়ে হেসে বললো,“আচ্ছা, যাও।”
ছাড়া পেতেই দ্রুত বসা থেকে উঠে আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো আবৃত্তি। শিথিল চেয়ে চেয়ে সেসব দেখলো। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলে সংসার চলবে কী করে? নিজের পোশাক নিয়ে সেও চলে গেলো গোসল করতে। বাবার ঘরের বাথরুমে। তার গোসল অবশ্য আবৃত্তির আগেই হয়ে গেলো। তৈরি হয়ে হাঁক ছেড়ে ডেকে বললো,“আমি নামাজে যাচ্ছি। দরজা বাইরে থেকে লক করে যাচ্ছি।”
উত্তরের অপেক্ষা না করে এরপর দ্রুত চলে গেলো সে।
________
এক জীবনে মানুষ কী আর সব পায়? কেউ পরিবার, শৈশব হারিয়ে আগলে রাখার মতো ভালোবাসার একটা মানুষ পায় আবার কেউ বা সুন্দর সাজানো গোছানো একটা পরিবার, আনন্দময় শৈশব পেয়ে হারায় ভালোবাসা, প্রিয় মানুষ। তবে না পেলেও কী মানুষ ভুলতে পারে সেই প্রিয় মানুষটিকে? হয়তো পারে না। তাইতো কাজী নজরুল ইসলাম উনার কবিতায় বলে গিয়েছেন,
‘একি অসীম পিয়াসা
শত জনম গেলো তবু মিটিল না
তোমারে পাওয়ার আশা॥
সাগার চাহিয়া চাঁদে চির জনম কাঁদে
তেমনি যত নাহি পায় তোমা পানে ধায়
অসীম ভালোবাসা॥
তোমারে যে চাহিয়াছে ভুলে একদিন
সেই জানে তোমারে ভোলা কি কঠিন
তোমার স্মৃতি তার মরণের সাথি হয়
মেটে না প্রেমের পিয়াসা॥’
সুশ্রী সেসব মেনে নিয়েছে। মনের দুঃখ মনে লুকিয়ে শিখেছে সকলের সামনে প্রাণ খুলে হাসতে। জীবন তো এভাবেই চলে, চলতে চলতে কোথায় গিয়ে যে পৌঁছায়! মানুষ যতকাল বাঁচে ততকাল নতুন নতুন সময়, পরিবেশ, পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। তাকে ঘিরে নিত্য নতুন গল্প রচিত হয়। উপন্যাস তো শুধুই তার সেসকল গল্পের কিছু অংশ তুলে ধরার একটি মাধ্যম মাত্র।
সুযোগ পেলেই জামাতে গিয়ে নামাজ আদায় করে শিথিল। দুপুরের খাবার খেয়ে ঘরে বসে আবৃত্তির সঙ্গে হালকা হতে জম্পেশ আড্ডা দিয়ে এরপর আছরের নামাজের জন্য আবারো বের হলো সে। বলে গিয়েছে একেবারে মাগরিব পড়ে তারপর ফিরবে। বাবা আজ রাতে আর বাড়ি ফিরবেন না। ফোন করে বলেছেন, বড়ো ফুফুর বাড়িতে থাকবেন।
আবৃত্তি নামাজ আদায় করে নিজের জন্য চুলায় চা বসিয়ে পুরো বাড়ি চক্কর দিলো। এরপর চায়ের কাপ হাতে চলে এলো শোবার ঘরে। বুকশেলফে পড়ে থাকা বইগুলো নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখতে দেখতে নজর আটকে গেলো অপেক্ষা নামক উপন্যাসের বইটির উপর। এই বই পড়ে ছেলেবেলায় বালিশে মুখ গুঁজে সে কি কান্নাটাই না করেছিল আবৃত্তি! শিশির আপু তাকে বারবার সেদিন ধমকাচ্ছিল,“থাম আবৃত্তি, একদম কাঁদবি না বলে দিচ্ছি। এমন করলে তোকে আর কখনো আমার বই পড়তে দেবো না।”
কান্না থামালেও ফোঁপানোর শব্দ কিছুতেই তখন সে থামাতে পারছিল না। সবে কৈশোরে পা দিয়েছিল। তাই আবেগ ছিল কিছুটা বেশি। বইটা হাতে নিলো আবৃত্তি। পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখা মিললো প্রেমিকাকে হারানো সেই বেকার পুরুষের হাহাকার। তার নিচেই গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
“পৃথিবীর মানুষ ভালো থাকুক। একটা চাকরির অভাবে আর কোনো বেকার প্রেমিক না হারাক তার প্রিয়র চেয়েও অত্যন্ত প্রিয় প্রিয়তমাকে। নইলে পৃথিবী থেকে নিষিদ্ধ হোক এই স্বার্থান্বেষী ভালোবাসা।
—শিথিল”
বই বন্ধ করে রেখে দিতে গিয়েও রাখলো না। নজরে পড়ল মাঝ পৃষ্ঠার ভেতর থেকে উঁকি দেওয়া একটি কাগজ। কাগজটি বের করতে গিয়ে পরপর আরো দুটির সন্ধান পাওয়া গেলো। এ কাগজ নয়, বরং চিঠি। তা নিয়েই চেয়ারে বসলো সে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাপটা রাখলো টেবিলের উপর। ত্রস্ত হাতে ভাঁজ খুলে পড়া শুরু করতেই অবাক হলো,
‘মিষ্টি মেয়ে আবৃত্তি,
জানো, তোমার চোখ সুন্দর! সুন্দর ওই রিনরিনে কণ্ঠস্বর। সেদিনের সেই মেঘমেদুর দিনে প্রথম আমাদের চোখাচোখি হলো, পেছন থেকে অপরিচিত অধিকারে ভরা গাঢ় ডাক ভেসে এলো। পাশাপাশি বসে পাড়ি দিলাম কতটা পথ! আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল বারংবার। প্রবল সন্দেহ ডানা বাঁধলো মনে। এরপর কোনো এক মহাকালের গর্ভে সেসব ভুলে গেলাম আমি। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়া কথাটা তুমি বিশ্বাস করো? আমি করি না। তাই আমিও প্রেমে টেমে পড়িনি। বোধহয় ক্ষণকালের জন্য আগ্ৰহ বেড়েছিল। এরপর সময় পেরিয়ে আমাদের নিয়ম করে দেখা হতে লাগলো। দ্বিতীয় সাক্ষাতে মনে হলো, তুমি দারুণ চা বানাও। তৃতীয় সাক্ষাতে মনে হলো, তোমার জড়তাপূর্ণ হাসি সুন্দর। আমি কী কোনোভাবে তোমার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি? কারণ ছাড়া প্রেমে পড়া যায়? এর ব্যাখ্যা আমি আজো খুঁজে পেলাম না। কিন্তু! কিন্তু হঠাৎ করেই উপলব্ধি করলাম, ওই চোখ দুটো আমায় টানছে। যেমন টানে মহাকর্ষ বল?
ইতি—
নিজের অনুভূতি সম্পর্কে অজ্ঞ এক দ্বিধান্বিত পুরুষ।’
প্রথমটা পড়া শেষ করে দ্বিতীয় চিঠিটা খুললো আবৃত্তি। প্রথম চিঠির থেকে দেড় বছর পরের লেখা এটি।
‘তোমায় কি নামে সম্বোধন করবো আমি? চন্দ্রপ্রভা? যে সদা গাছের ডালে উজ্জ্বীবিত হয়ে ভালোবাসা ছড়ায় ধরিত্রীতে। কাজল লতা? যার চোখের গাঢ় কাজলে মন কেমনের বৃষ্টি ঝরে, লতার মতো মুড়িয়ে নেয় মায়ার চাদরে। নাকি মিষ্টি মেয়ে আবৃত্তি? যে নামের মতোই মিষ্টি এক কবিতা।
সম্বোধন নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ততা আজ না হয় থাক।মেঘমেদুর দিনে দ্বিধা, মন খারাপ মানায় না। আচ্ছা তুমি কী রোজ আকাশ দেখো? কিংবা দেখো কী সন্ধ্যার আকাশে উড়ে চলা দলবদ্ধ পাখিদের? ওদের মতো তোমারো কী কোনো বন্ধু আছে? যে বন্ধু হতাশ দিনের বাদল হয়ে দুঃখ সারায়? নেই, তাই তো? আমি জানি। কীভাবে জানি সেটা না হয় নাই বললাম। তোমার কী চিঠি পছন্দ? আমার অবশ্য তেমন একটা পছন্দ নয়। তবু বাবা আমায় চিঠি পাঠান— সম্বোধনহীন, ধমক দিয়ে। কিন্তু তোমায় আমি কেমন করে চিঠি লিখবো? কী লিখবো? ভেবে পাচ্ছি না। মন কেমন করছে। তোমায় দেখার পর থেকে হঠাৎ করে কী যে হলো? কী হলো আমার? বলতে পারবে, আবৃত্তি?
ইতি—
এক দ্বিধান্বিত পুরুষ’
তৃতীয় চিঠিতে এবার আর নেই কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব,
‘আবৃত্তি শুনছো?
আমি বোধহয় আমার অনুভূতির শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছি। যেখান থেকে সহজে ফেরা যায় না। উপলব্ধি করলাম, তোমার প্রতি অনুভূতিটা আমার ভালোলাগা এবং মায়ার চেয়েও বেশি। পেতেই হবে, গোটা একটা জীবন একসঙ্গে পাড়ি দিতে হবে এমন ধরণের। আচ্ছা, ভালোবাসা কী তবে এমনই হয়?
ইতি—
শিথিল’
চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে উঠল আবৃত্তির। কতক্ষণ যে ওভাবে বসে রইল কে জানে? একটানা বেশ কয়েকবার পড়ে ফেলল চিঠিগুলো। বুকে জড়িয়ে ধরে দম ফেলে তাকালো জানালার বাইরে। আজও সেদিনের সেই মেঘমেদুর দিন। অবাধ্য পত্র হেলেদুলে উড়ছে। আকাশ দখল করে নিয়েছে ছাই রঙা মেঘেদের দল। একটি কাগজ টেনে আবৃত্তি লিখতে বসলো। লেখা শেষ করে কাগজটা নোটবুক থেকে ছিঁড়ে আলাদা করে ভাঁজ করে বিছানার মাঝখানটায় রেখে দিলো। যেন সহসা যে কারোর চোখে পড়ে যায়। পরনের পোশাক বদলে গায়ে জড়ালো বিয়ের সেই বেনারসি আটপৌরে শাড়ি। চোখে গাঢ় কাজল দিলো। চুল করল খোঁপা। আলমারি ঘাঁটতে গিয়ে পেয়ে গেলো বেশ কয়েক জোড়া কাঁচের চুড়ির দেখা। তার সাথেও ছোট্ট একটা চিরকুট,“মেলায় গিয়ে ভীষণ পছন্দ হওয়ায় কিনে ফেলেছিলাম। কেনো যে কিনেছিলাম জানা নেই। আপাতত ভবিষ্যতের পবিত্র কোনো নারীর জন্য তোলা থাকুক।”
সেই চিরকুট পড়ে শেষমেশ কেঁদেই ফেলল আবৃত্তি। নষ্ট হওয়া কাজল মুছে ধৈর্য ধরে ফের কাজল পড়ল। হাত ভর্তি সবগুলো কাঁচের চুড়ি পরে বসে রইল বিশেষ মানুষটির অপেক্ষায়। বিড়বিড় করে গাইলো,
“সেই বিকেলে, বৃষ্টির জলে
অভিমান মাখা খেয়ালে,
তুমিও কি ভেঙেছিলে?
আকাশে, নিরব নিঃশ্বাসে
নীলকন্ঠ মেঘ হয়ে আসে,
তোমার দীর্ঘশ্বাস।”
সন্ধ্যার পরপর বাড়িতে ফিরে এলো শিথিল। বাইরে তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ ডেকে উঠছে ভয়ানক শব্দে। দরজা আটকে পিছু ফিরতেই চোখ দুটো আটকে গেলো সম্মুখে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর দিকে। ফের আরেকবার শিথিল নিজেকে হারিয়ে ফেলল ওই সুগভীর চোখে। সেই প্রথমবারের মতো বুকে বেজে উঠল সেই গানটা! তবে লাইন এবার ভিন্ন—
‘যখন খোলা চুলে হয়তো মনের ভুলে,
তাকাতো সে অবহেলে দু’চোখ মেলে,
হাজার কবিতা বেকার সবই তা
তার কথা কেউ বলে না,
সে প্রথম প্রেম আমার….
তার চাহনিতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো আবৃত্তি। জিজ্ঞেস করল,“চা খাবে?”
প্রশ্নটি করে উত্তরের অপেক্ষা সে করল না। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে পুনরায় বললো,“ঘরে গিয়ে বসো। আমি নিয়ে আসছি।”
শিথিল বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো তার পানে। ঘরে ফিরে পরনের সাদা শার্ট বদলে একটা টি-শার্ট পরিধান করে বিছানায় বসতেই দৃষ্টিগোচর হলো তার হাতঘড়ির নিচে চাপা পড়ে থাকা কাগজগুলো। তার মধ্য থেকে তিনটাই খুব সহজে চিনে ফেলল। অবাক হলো ভীষণ। এগুলো এখানে এলো কীভাবে? তারমানে আবৃত্তি দেখে ফেলেছে? চতুর্থ অচেনা কাগজটা খুলতেই দেখা মিললো গোটা গোটা কালো কালিতে লেখা বাক্যগুলো,
“আকাশের আজ ভীষণ মন খারাপ। কবিতা লেখার জন্য কবির ভান্ডারের শব্দরা হারিয়ে গিয়েছে। প্রকৃতি কন্যা উদাস বিকেলে বসে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে ফেলছে দীর্ঘশ্বাস। তাকে মেঘমেদুর দিনে কেউ ফুল দেয়নি। লাল কদম কিংবা হলদে চন্দ্রপ্রভায় দেয়নি ভালোবাসার ছোঁয়া। কেউ কী তবে তাকে ভালোবাসে না?”
একবার, দুবার পরপর বেশ কয়েকবার সরল চোখে চিরকুটটিতে চোখ বুলিয়ে অজান্তেই গম্ভীর অধরে ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি। এরপর শিথিল ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। পথে দেখা হলো আবৃত্তির সঙ্গে। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,“এই যে তোমার চা।”
“এসে খাবো।”
“যাচ্ছো কোথায়?”
“ঘরের ফুলকে প্রেম নিবেদন করার জন্য গাছের ফুল আনতে।”
এরপর আর সে থামলো না। রমণীর রিনরিনে কণ্ঠস্বর পর্যন্ত আটকাতে পারলো না তাকে। সে দরজা খুলে বাইরে থেকে তালা দিলো। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই চলে গেলো মৌমাছির মতো ফুলের সন্ধানে। তখনি ধরিত্রী অন্ধকার করে দিয়ে লোডশেডিং হলো। অন্ধকারকে ভয় পাওয়া আবৃত্তির মন ভিতু হয়ে গেলো। মোবাইলে আলো জ্বালাতে গিয়ে পড়ল বিড়ম্বনায়। চার্জ নেমে এসেছে দশের কোঠায়। যেকোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পুরো রান্নাঘর খুঁজে শেষমেশ মিললো মোমবাতির খোঁজ। সেটা জ্বালিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার সে দূর করল।
শিথিল হাঁটতে হাঁটতে ভিজে চলে এলো রাজবাড়ীর কদমতলায়। তবে কদমের দেখা পেলো না। ছেলেদের দল গাছ থেকে ফুলের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। সাড়ি সাড়ি ফুলের দোকান তখন বন্ধ। খালি হাতে তো আর ফেরা যায় না। তাই এধার ওধার ছুটে পিচ্ছল গাছে চড়ে নিয়ে এলো ফুটন্ত কাঠগোলাপ। বাড়ির গেট থেকে ছিঁড়ল প্রিয় চন্দ্রপ্রভা। ভেতরে প্রবেশ করেই খুঁজে ফিরলো স্ত্রীকে। আবৃত্তি তখন জানালায় উদাস দৃষ্টি মেলে আকাশ দেখছে। ভেজা হাতেই তার পেছনে এসে দাঁড়ায় শিথিল। কানে গুঁজে দেয় চন্দ্রপ্রভা আর হাতে ধরিয়ে দেয় কাঠগোলাপ। মোম নিভিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে নিজের ব্যক্তিগত আবৃত্তির কানে কানে ফিসফিস করে আবৃত্তি করে নিজের তৈরি কবিতা,
‘আঁধার রাতের বিভীষিকায়
খুচরো অনুভূতির ঝড় থামিয়ে,
নিরব ফুলের সুবাসে
প্রেম নিবেদন করলাম
আমার আবৃত্তিকে।
তারকামণ্ডলীকে ঢেকে রাখা
মেঘেদের সাক্ষী রেখে,
এই মেঘমেদুর দিনে
তার কাছে সঁপে দিলাম
শিথিলের গোটা জীবন।’
আবৃত্তি কাঁপলো খানিক। বৃষ্টির ঝনঝন নিরবধিতে কানে বাজতে লাগলো প্রেমের অমল ধ্বনি। মেঘমেদুর দিনে জন্মানো সব অনুভূতি পূর্ণতা পেলো।প্রেমপিপাসু দুই আত্মা আর দেহের মিলন ঘটলো। সাক্ষী রইল দূরের সেই ডেকে ওঠা ডাহুক পাখি, মেঘ আর বৃষ্টি।
(~সমাপ্ত~)
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম।)