#শেহনাজ _____{ ৭ }
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
এমিরদের পরিক্ষা চলছে। এখন কোনো কিছুতেই মন নেই ওর। মাথায় কেবল পরিক্ষার টেনশন। হাসান, সাদাত , নয়ন সবাই না খেয়ে, না ঘুমিয়ে পড়ছে। পরিক্ষার এই সময়গুলোতে এমির বা ওরা কেউই টিউশনিতে যায়নি। যতটুকু সময় পেয়েছে পড়াশোনায় মন দিয়েছে। এ কদিন শেহনাজ ও আসেনি এমিরের ধারে কাছে। এমির এখন মুক্ত, স্বাধীন। শেহনাজকে আশপাশে না দেখে দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়েছে সে। বোঝা নেমে গিয়েছে যেন। সর্বশেষ পরিক্ষা দিয়ে এমির প্রশান্তির শ্বাস টানে, চিন্তা মুক্ত হয়। পরিক্ষা যথেষ্ট ভালো হয়েছে। এবার শুধু ফলাফলের পালা।
অপরদিকে শেহনাজকে আজ দেখতে আসবে ছেলেপক্ষ। দেখতে আসবে বললে ভুল হবে। আজ তারা আসবে বিয়ে পাকা করতে। ছেলের নাম জিহাদ তালুকদার। সাইফুল আলমের ভাইয়ের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। ছেলের সাভারে নিজস্ব পোশাক কারখানা রয়েছে। ঢাকায় কাপড়ের কয়েকটা দোকান ও রয়েছে। এ ছেলে হাত ছাড়া করতে চায় না সাইফুল আলম। ছেলে দেখতেও মোটামুটি সুদর্শন।
শিমলা বেগম সকাল সকাল শেহনাজকে উঠালেন। শাড়ি পড়াতে চাইলেন। শেহনাজ রাজি নয় শাড়ি পরতে। এক ধ্যানে বসে আছে ঘরে। সর্বোপরি সে চায় ও না বিয়েটা করতে। তাই সকাল থেকেই মন খারাপ করে বসে আছে সে। কান্না করছে খুব। শেহনাজকে কোনো প্রকার সাজগোজ করতে না দেখে শিমলা বেগম ধমকে উঠলেন,
-” রেডি হচ্ছিস না কেন শেহনাজ? বিয়ে কি এখনই হচ্ছে। পরিক্ষার পরে বিয়ে। এখন শুধু আংটি পরাবে”।
শেহনাজ জেদি। যা সে চায় তা পাওয়ার সব রকম চেষ্টাই করে। এমিরকে ছাড়া ও বাঁচবে না। অন্য কাউকে বিয়ে করার তো প্রশ্নই উঠে না। চেঁচিয়ে বলে,
-” আমি বিয়ে করবো না। কেন আমাকে রাগাচ্ছো। তোমাদের মন মর্জি চলতে হবে আমাকে”?
-” রাগাচ্ছি মানে? মেয়ে হয়ে জন্মেছিস বিয়ে করবি না”?
শেহনাজ বেজায় চটেছে। আজ তার কোনোকিছুতেই কোনো যায় আসে না। এমিরকে যে কোনো মূল্যেই সে পেতে চায়। বলে,
-” করবো বিয়ে। কিন্তু নিজের পছন্দমতো”।
ভ্রূ কুঁচকে ফেলে শিমলা বেগম। সন্দেহ হয়।
-” তুই কি কাউকে ভালোবাসিস? সেদিন তোর স্যার ও কথা বলেছিল কেন”?
শেহনাজ নিজের রাগ কমায়। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে। নিজেকে ধাতস্থ করে। আজ যদি এ বিষয়ে না বলে তাহলে বিয়েটা হয়েই যাবে। এমিরকে সে পাবে না। তখন আফসোস হবে।
-” আমি একজনকে ভালোবাসি আম্মু। তাকেই বিয়ে করবো”।
-” কে সে? কাকে ভালোবাসিস”?
শেহনাজ গর্বিত ভঙ্গিতে তাকায়। এমির তার কাছে ভীষণ গর্বের, ভিষণ প্রিয়। বলে,
-” এমির সাখাওয়াত”।
শিমলা বেগম হতবাক। ছুটে এসে ধরে শেহনাজের বাহু। সশব্দে থাপ্পড় মারে শেহনাজের নরম গালে। দাগ বসে যায় সেথায়। শেহনাজ নিজেও হতভম্ব। মায়ের এমন রূপ তাকে কষ্ট দিচ্ছে। শিমলা বেগম শেহনাজকে ধাক্কা মেরে ছুঁড়ে ফেললেন,
-” এ কথা মুখেও আনবি না। তোর আব্বু জানতে পারলে একদম পুঁতে ফেলবে। আজ এনগেইজমেন্ট ঠিকঠাক মতো হতে দিবি। বাড়াবাড়ি একদম করবি না। ভালোবাসা বুঝিস তুই? বেশি বেড়ে গেছিস”।
শেহনাজ ভয় পায় না। পাশের ঘরে টিভি দেখছেন সাইফুল আলম। শেহনাজ ছুটে গেল সে ঘরে। আব্বুর সামনে এসে স্পষ্ট, কাঠকাঠ কণ্ঠে বলে উঠল,
-” আব্বু আমি একজনকে ভালোবাসি। তুমি যাকে আমার জন্য সিলেক্ট করেছো তাকে আমি বিয়ে করতে পারবো না”।
সাইফুল আলম শেহনাজের এ কথায় চমকে ও
উঠলেন। শেহনাজের এমন কণ্ঠ তাকে রাগালেও তিনি ধমক দিলেন না। নরম কণ্ঠে বললেন,
-” কাকে ভালোবাসো? সে কি আমার পছন্দ করা ছেলের চাইতেও ভালো”?
শেহনাজ ঘাবড়ায়। এবার বোধহয় রেগে যাবে আব্বু। শেহনাজ তার বাবা-মাকে খুব ভালোমতোই চেনে। এমিরকে মানবে না ওরা। নরম স্বরে বলে যে কোনো কাজ হবে না তা ওর জানা। তাই ভয় টুকু গিলে ফেলল ও। বলল,
-” আমার হোম টিউটর, এমির সাখাওয়াত”।
সাইফুল আলম রেগে গেলেন ভিষণ। শেহনাজের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন শেহনাজের ঘরে। বাইরে থেকে আটকে দিলেন দরজা। কঠোর আদেশ জারি করলেন ” একেবারে ছেলের বাড়ির লোকজনের এলেই দরজা খোলা হবে”।
_____
দুপুর হয়েছে। বেলকনির ফাঁক দিয়ে রোদ ঢুকছে ঘরে। শেহনাজের চোখ লাল। কেঁদে কেটে একাকার অবস্থা। নাক হয়ে আছে লালচে। চোখের কোণে এখনো পানি জমে আছে। শেহনাজ জানতো এই দিনটা আসবে। কিন্তু এত দ্রুত আসবে ভাবতে পারেনি। এমিরের ঢাকায় ঘর নেই, বাড়ি নেই। ভালো একটা চাকরিও নেই। এমন ছেলের সাথে কোনো মেয়ের বাবাই মেয়েকে দিবে না। তাইতো শেহনাজ ভেবেছিল এমির একটা ভালো চাকরি পেলে তবেই বিয়ের বিষয়ে কথা বলবে। কিন্তু শেহনাজের ভাগ্য সহায় হলো না। এমন জটিল পরিস্থিতিতে ওকে পরতে হলো। শিমলা বেগম কিছুক্ষণ আগে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। সাইফুল আলম রেগে আছেন। ভালো জামাকাপড় পরতে বলেছেন। নইলে শেহনাজকে আস্ত রাখবেন না তিনি। সাইফুল আলম বদরাগী মানুষ। যখন ভালোবাসবেন তখন মন প্রাণ উজার করে ভালোবাসবেন, কিন্তু যখন রেগে যান যখন কোনো কিছুই বুঝেন না।
শেহনাজ কালো রঙের জর্জেট গাউন পরেছে। মুখে কোনো প্রসাধনী নেই। মুখটা কেমধ ফ্যাকাশে, বিধ্বস্ত। শিমলা বেগম দরজা খোলেন। শেহনাজকে নিয়ে যান ড্রয়িংরুমে। একজন বয়স্ক মহিলা, আর একজন বয়স্ক পুরুষ এসেছেন ছেলের সাথে। শেহনাজ এক নজর ছেলেটার দিকে তাকাল। অবাক হলো খুব। ছেলেটার বয়স শেহনাজের চেয়ে অনেকটা বেশি। এমন একটা লোকের সাথে কিভাবে শেহনাজের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে ভেবে পায় না শেহনাজ। রাগে চক্ষুদ্বয় জ্বলে ওঠে। শিমলা বেগম তা দেখে চোখ পাকান। শেহনাজকে বসানো হয় ছেলে পক্ষের সামনে। নামধাম জিজ্ঞেস করা হয়। শেহনাজ সেসময় নম্র কণ্ঠে বলে,
-” আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি এই বিয়েতে রাজি নই। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। আপনারা প্লিজ চলে যান”।
অপ্রস্তুত হলেন সাইফুল আলম আর শিমলা বেগম। রাগান্বিত হলো ছেলেপক্ষ। অপমানিত হয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেল তারা। যাওয়ার আগে কিছু অপ্রত্যাশিত বাক্য বলে গেল। সাইফুল আলম অপমানিত হলেন বেশ। রেগে গেলেন ভিষণ। আজ পর্যন্ত কেউ তার সামনে গলা উঁচিয়ে কথা বলেনি। তাই ছেলে পক্ষের বলা কটু কথা গায়ে লাগল উনার। এই প্রথম শেহনাজের গায়ে হাত তুললেন তিনি। এতটাই সজোরে মারলেন যে শেহনাজ ছিটকে পরল মেঝেতে। ব্যথা পেল খুব। গাল দুটো জ্বলে উঠল যেন। সাইফুল আলম রেগে গেলে অনেক বাজে কথা বলেন। এটা তার অভ্যেস। রাগ হলে উনার মস্তিষ্ক কাজ করে না। শিমলা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন,
-” ওর মতো মেয়ে আমার দরকার নেই। আজ এই মুহুর্তে আমি ওকে ত্যাগ করলাম। ওর মুখটাও আমি দেখতে চাই না। ওকে বেরিয়ে যেতে বলো”।
পুনরায় থেমে বললেন,
-” যেদিন বিয়েতে রাজি হবে, সেদিনই ফিরবে। তা না হলে ফেরার প্রয়োজন নেই। ওই বেকার ছেলের হাত ধরা আর পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাওয়া একই কথা। বুঝে নিবো মেয়ে মরে গেছে”।
শেহনাজ বিস্ময়ে বিমূঢ়। বাকশক্তি হারাল সে। যন্ত্রণায় বুকের ভেতর তড়পাতে লাগল। অশ্রুকণা গড়াল মেঝেতে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে ওর। বাবা-মায়ের এমন রূপ তাকে পোড়াচ্ছে। শেহনাজ নিজেকে থামাল অনেক কষ্টে। হাতের দামী ফোনটা আর নিজের কিছু সার্কিফিকেট নিয়ে সেসময় বেরিয়ে পরল বাড়ি থেকে। যাওয়ার আগে বলে গেল,
-” তোমাদের আমি ভালোবাসি। কিন্তু এমির আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ওকে না পেলে আমি কোনোদিন সুখী হতে পারবো না। একদিন তুমিই বলবে এমির ভালো ছেলে। আমার জন্য উপযুক্ত। দেখে নিও”।
শেষবারের মতো মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন শিমলা বেগম,
-” শেহনাজ, মা আমার। ওই ছেলে তোর যোগ্যই না। ওকে বিয়ে করলে তোর জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। তোর বাবা কোথাও মুখ দেখাতে পারবে না। বোঝ একটু”।
পিছু তাকাল না শেহনাজ। বেরিয়ে গেল প্রধান দরজা দিয়ে। রয়ে গেল সকল স্মৃতি। শিমলা বেগম কেঁদে ফেললেন। সাইফুল আলম প্রতিক্রিয়া দেখালেন না।
______
শেহনাজ সারাদিন রইল তানিয়ার বাড়িতে। এমিরকে এ নিয়ে দশবার কল করেছে। এমির কল তুলছে না। শেহনাজের নম্বর ওর চেনা। তাই হয়তো তুলছে না।
শেহনাজ একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। চুপি চুপি তানিয়ার ঘর থেকে ধারাল ছুরি জোগাড় করল। সন্ধ্যে নামতেই এমিরদের মেসের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। আধঘন্টা পরে হাঁটতে হাঁটতে শেহনাজ পৌঁছাল সেখানে। এমিরকে পুনরায় কল করল। এইবার ফোনটা বন্ধ দেখাচ্ছে। হাসানকে কল করল শেহনাজ।
-” ভাইয়া, এমির আপনার সাথে”?
হাসান না বুঝে উত্তর দেয়,
-” হ্যাঁ আমার সাথেই।
-” আপনারা কোথায় এখন”?
-” ঘরেই তো।
-” উনাকে বলুন এক্ষুণি বের হতে। আমি আপনাদের বাড়ির সামনেই। উনি যদি এখন বের না হন কিছুক্ষণ পর আমার লাশ দেখতে পাবেন। আমি আমার পরিবার, পরিজন ছেড়ে একেবারে চলে এসেছি”।
বলেই শেহনাজ ঠোঁট বাঁচিয়ে হাসল। কল কাটল। এমির হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। সাথে ওর বন্ধুরা। এমির রেগে আছে বোঝা যাচ্ছে। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে একদম। কপালের রগ ফুলেফেপে উঠেছে। তার কঠিন চাহনি, দৃঢ় অবয়ব দেখে ভড়কাল না শেহনাজ। এমির এগিয়ে এলো সম্মুখে।
-” কি শুরু করেছো তুমি? ভালো কথা ভালো লাগে না? বলেছি না ভালোবাসি না? বুঝতে পারছো না”?
শেহনাজ হাসে। বলে,
-” আমাকে বিয়ে করবেন এমির ভাই”?
এমির কাঠকাঠ কণ্ঠে উত্তর দেয়,
-” না।
-” তাহলে আমি আপনাকে বিয়ে করবো। চলুন”।
-” তুমি তোমার সীমানা ভুলে যাচ্ছো শেহনাজ। বাড়ি ফিরে যাও”।
শেহনাজ পিছন থেকে ধারাল ছুরিটা বের করে। নিজের গলায় চেপে ধরে। শক্ত কণ্ঠে বলে,
-” আমি আমার বাবা-মাকে ছেড়ে চলে এসেছি শুধুমাত্র আপনার জন্য। আজ আপনি আমাকে বিয়ে না করলে আমি এখানেই সুইসাইড করবো”।
এমির বিরক্তিতে ঘাড় বাকায়। চুলগুলোকে ঠেলে দেয় পেছনে। রাগে দপদপ করছে ওর শিরা উপশিরা। ঠাডিয়ে চড় দিতে পারলে বুঝি শান্তি পেত। শেহনাজের এ কথাকে সে পাত্তা দিল না। নিছক মজা বলে ধরে নিল।
-” তোমার যা ইচ্ছে তুমি করো। কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করবো না”।
এমির চলে যেতে উদ্যত হলো। শেহনাজের কি হলো জানা নেই। নিজের জেদ বজায় রাখল সে। কথার খেলাপ করল না। ধারাল ছুরিটা কব্জির নিচের অংশে চেপে ধরল। চোখ বুজে ছুরি দিল টান। গলগল করে রক্ত বের হলো হাত থেকে। আঁতকে উঠল শেহনাজ। গুঙিয়ে উঠল। এমির পিছু ফিরল। রক্ত দেখে এমির নিজেও আঁতকে উঠল। ভয় পেল খুব। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। এগিয়ে এলো শেহনাজের কাছে। শেহনাজের গলার ওড়নাটা টেনে হাতে বেঁধে দিল। রাগী কণ্ঠে বলল,
-” হ্যাভ ইউ লস্ট ইওর মাইন্ড শেহনাজ? কি করলে এটা? শিরা কেটেছে নাকি? আল্লাহ্! এত রক্ত”!
শেহনাজ এবার ছুরিটা পেটের কাছে এনে ধরল।
-” আপনি ভেবেছেন আমি মজা করছি? আমার জেদ আপনার জানা নেই। আমি নিজেকে শেষ করে ফেলবো। এখন আপনারা আমাকে তাড়িয়ে দিবেন কিন্তু পরেরদিন আমার লাশটাই দেখতে পাবেন”।
এমির ভেবে পায় না এখন কি করবে। সাদাত এমিরকে বিয়েটা করে নিতে বলে। হাসান আর নয়ন ও তাতে সায় জানায়। এমির বেকায়দায় পরে। কিভাবে কি সামলাবে? কি করবে এখন? শেহনাজকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরতে দিবে? পরে কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে? সে কি একটুও শেহনাজের প্রতি দুর্বল নয়?
শেহনাজ ক্রূর হাসল। বলল,
-” আমি যদি মারা যাই, নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন এমির? একটা মানুষ আপনাকে ভালোবেসে জীবন দিয়ে দিয়েছে এ কথা আপনার মস্তিষ্কে বাজবে না?
____
কবুল বলতে এমির অনেক সময় নিল। দোটানায় ভুগল। সংশয় কাজ করল। কিন্তু শেহনাজের মনে ভয় নেই, দ্বিধা নেই। সে খুব খুশি। কবুল বলতে একটুও সময় নিল না সে। বিয়ের কার্যক্রম শেষ হতেই এমির শেহনাজের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিল। শেহনাজ খুশিতে প্রায় আত্মহারা। এমিরকে পেয়ে ভীষণ গর্বিত যেন।
ওরা দুজন একসাথে বাড়ি ফিরল রাতে। এমির আর শেহনাজের জন্য একটি রুম ভাড়া করা হলো। আজ থেকে ওরা ওখানেই থাকবে। শেহনাজ নিজের সংসার পেয়ে আনন্দে লাফাচ্ছে। অথচ এমিরের এসবে ধ্যান নেই। বিয়ের পর থেকেই ও চুপ। কথা বলছে না কারো সাথে। অতিত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। শেহনাজের সেসবে খেয়াল নেই। ঘরে ঢুকেই সে ঘরটা ঝাড়ু দিল, ভেজা কাপড় দিয়ে ঘর মুছল। এমির তখন মেঝের তোষকে বসে। কপালে হাত ঠেকিয়ে রেখেছে। বোধহয় চিন্তায় আছে।
শেহনাজ স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে আরম্ভ করল। এমিরের পাশে এসে বসল নিঃশব্দে। সাবলীল কণ্ঠে বলল,
-” আপনার কি মাথা ব্যথা করছে? আমি টিপে দিবো”?
এমির না সূচক মাথা নাড়াল। শেহনাজ শুনল না। পুনরায় বলল,
-” দিই না একটু মাসাজ করে। ভালো লাগবে”।
এমির রাগ দেখায়। চোখ পাকিয়ে তাকায়। শেহনাজ ভয় পায়। এমির কি এবার ওকে মারবে নাকি? সে অধিকার তো আছেই। দমে গেল সে। পাশে বসে এক মনে কথা বলতে লাগল। নিজের ছোট বেলার গল্প, বড় বেলার গল্প, স্কুল-কলেজের নিত্যনতুন জোকস। প্রকাশ করল নিজের অনুভূতি যা কেবল এমিরের জন্য সীমাবদ্ধ। এমির নিরব শ্রোতার ন্যায় শুনল। টু শব্দটি ও করল না। শেহনাজ ভাবল এমির বুঝি তার কথা মন দিয়ে শুনছে। খুশিতে গদগদ সে। রাতভর অনেক অনেক গল্প শোনাল এমিরকে। ভোরের দিকে কখন যে দু চোখ লেগে গেল টের পেল না।
সকালে শেহনাজ ঘুম থেকে উঠে এমিরকে পেল না। ভাবল হয়তো কোনো কাজে গিয়েছে। সকাল থেকে বিকেল অবধি অপেক্ষা করল এমিরের জন্য। কিন্তু এমির এলো না। ফোন বন্ধ। শেহনাজ চিন্তায় পরল। বারবার জানালা দিয়ে রাস্তা দেখল। এই বুঝি মানুষটা ফিরে। সন্ধ্যে নামতেই শেহনাজ ফোন করে সাদাত কে। চিন্তিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
-” এমির ভাই কি আপনাদের সাথে? সেই সকালে বেরিয়েছে। এখনো ফেরেনি”।
সাদাত জানায় এমির নেই তাদের সাথে। আজ দেখা করেনি। সাদাত শেহনাজকে ভরসা দেয়।
-” হয়তো কোনো কাজে আটকে পরেছে। রাতে ফিরবে। টেনশন করো না”।
শেহনাজের খুব খিদে পেয়েছে। ওর কাছে এক কানাকড়ি ও নেই। খিদেতে পেটে ব্যথা করছে। এমির নিশ্চয়ই আসার সময় তার জন্য খাবার নিয়ে আসবে। শেহনাজ চিন্তাগুলোকে ঝেরে ফেলার চেষ্টা করল। তবুও মন মানল না। সে রাতে এমির বাড়ি ফিরল না। শেহনাজ এবার কাঁদতে আরম্ভ করল। কোথায় গেল লোকটা? কেন গেল?
দু দিন, দু রাত পার হলেও এমির ফিরল না। শেহনাজ বুঝে নিল এমির আর ফিরবে না। যোগাযোগ রাখবে না তার সাথে। জোর করে বিয়ে করেছে বলে শেহনাজকে শাস্তি দিচ্ছে সে।
জামাকাপড় নেই শেহনাজের কাছে, খাওয়ার মতো কোনো খাবার ও নেই ঘরে। দুদিন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে শেহনাজ অসুস্থ হয়ে পরেছে প্রায়। চোখের নিচে কালি পরেছে। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কিভাবে এমিরের বন্ধুদের কল করবে শেহনাজ? কিভাবে মুখ দেখাবে ওদের? কিভাবে বলবে তার জন্যই এমির বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে?
সাদাত সকালে এমিরদের বাসায় আসে। এমিরের খোঁজ খবর নিতে। ঘরের সামনে এসে দেখে দরজা খোলা। শেহনাজ বা কাত হয়ে শুয়ে আছে। হাসিমুখে সাদাত দরজায় নক করে। শেহনাজ চমকে ওঠে। ভাবে এমির এসেছে। ততক্ষণাৎ হেসে পিছু ফেরে। কিন্তু সাদাত ভাইকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিষণ্ণ ঘিরে ধরে ওকে। সাদাত শুধোয়,
-” এমির কোথায়? দুদিন ধরে ফোন ধরছে না”।
শেহনাজ মাথা নত করে। চোখ ভিজে আসে তার। বলে,
-” উনি এখনো ফেরেননি”।
সাদাত আশ্চর্য হয়ে যায়। চেয়ে রয় শেহনাজের পানে। মেয়েটার মুখটা কেমন করুণ। অসুস্থ লাগছে শেহনাজকে। সাদাত এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,
-” তুমি কি অসুস্থ শেহনাজ”?
-” না ভাইয়া। দুদিন ধরে না খেয়ে আছি। তাই শরীরটা চলছে না”।
সাদাত হতবাক। এমিরের প্রতি তার রাগ তরতর করে বাড়ে। এমন বেয়াক্কেলে কাজ এমির করেছে? বিশ্বাস হচ্ছে না সাদাতের। এমির কিভাবে নিজের দায় এভাবে এড়িয়ে পালাল?
সাদাত হোটেল থেকে ভাত, মাছ কিনে আনে। শেহনাজ ক্ষুধার্ত থাকায় গোগ্রাসে গিলে ফেলে খাবার গুলো। দুদিন না খেয়ে সে যেন মরতে বসেছিল প্রায়। খাবার পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। পানি খেয়ে দম নেয় শেহনাজ। একটু শান্তি লাগে ওর। সাদাত জিজ্ঞেস করে,
-” এখন ভালো লাগছে”?
শেহনাজ মাথা নাড়ায়। গাঢ় শ্বাস ফেলে সাদাত। বলে,
-” আমি হয়তো জানি এমির কোথায় গেছে”।
শেহনাজের ফ্যাকাশে মুখে হাসি ফিরে এলো। উত্তেজিত হয়ে বলল,
-” কোথায় গেছে? বলুন আমায় ভাইয়া, কোথায় গেলে উনাকে পাবো”?
-” ওর যাওয়ার মতো একটা জায়গাই আছে। ওর গ্রামের বাড়ি, মানিকগঞ্জ। কিন্ত ও ওখানেই আছে কিনা আমি নিশ্চিত নই শেহনাজ”।
-” আপনি চেনেন ওদের বাড়ি”?
-” চিনি না তবে লোকেশনটা জানি। গ্রাম চিনি। এমির বলেছিল ওখানে গিয়ে ওর বাবার নাম বললেই সবাই দেখিয়ে দিবে”।
-” আমায় নিয়ে চলুন না সাদাত ভাই। আমি উনার কাছে ক্ষমা চাইবো। তবুও উনি ফিরে আসুক”।
সাদাত শেহনাজের মাথায় হাত বুলাল। সত্যিই এমির ভাগ্যবান। শেহনাজের মতো মেয়ে আজকাল পাওয়া দুষ্কর। মেয়েটা এত গভীরভাবে ভালোবাসতে পারে জানা ছিল না সাদাতের। এত কিছুর পরেও এমিরের জন্য শেহনাজের এহেন উৎকণ্ঠা, আকুলতা দেখে সাদাতের চোখে পানি এলো। সিদ্ধান্ত নিল এমিরের সাথে আর কখনো কথা বলবে না। এমিরের ভুলের শাস্তি সে এমিরকে দিবে। এমন নিষ্পাপ এক তরুণীর চোখে অশ্রু ঝরানোর শাস্তি যে বড় ভয়াবহ হবে। কিন্তু এমির কি আদৌ সেখানে আছে? ওকে কি পাওয়া যাবে? নাকি এমির হারিয়ে গেছে চিরতরে?
চলবে?
নোটঃ আগামী দু দিন লিখবো না। এটা আব্বুর ফোন। তিনি বাসায় থাকবেন না দুদিন।🙂