শেহনাজ পর্ব-০৯

0
58

#শেহনাজ _____ { ৯ }
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

গতরাতের তাণ্ডবের পর সকালটা এখন স্নিগ্ধ, নির্মল, শীতল। ক্ষেতখামারে পানি জমেছে। এমিরদের জমি খানিকটা উঁচু বিধায় পানি জমেনি। কিন্তু মাটিগুলো পিচ্ছিল হয়ে আছে। এমিরের মা ফারজানা আর মহুয়া কখন ফিরেছে জানে না শেহনাজ। সে ঘুম থেকে উঠেছে বেশ দেরি করে। উঠে দেখে ফারজানা ছাগলদের খেতে দিচ্ছে। শেহনাজকে দেখেই মুচকি হাসলেন। বলল,

-” রাতে গরম পরেনি। ঘুম ভালো হয়েছে”?

হাসে শেহনাজ ও। এগিয়ে আসে। কয়েকটা কাঁচা ঘাস ধীরে তুলে ধরে ছাগল গুলোর সামনে। বলে,

-” কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু আপনারা রাতে কোথায় ছিলেন? ফিরছিলেন না বলে আমার চিন্তা হচ্ছিল”।

-” মহুয়ার সখীর বাড়িতে রাত কাটিয়েছি। যে তাণ্ডব শুরু হলো, ঝুঁকি নেইনি”।

শেহনাজের শরীর চুলকাচ্ছে। এক জামা সে গত তিনদিন ধরে পরে আছে। গা থেকে দুর্গন্ধ বের হতো যদি না পারফিউম থাকতো জামাটায়। শেহনাজের এহেন অপ্রস্তুত ভঙ্গি বুঝতে পারল ফারজানা। সে এমিরকে ডাকল। এমির ব্রাশ করছে তখন। ফারজানার ডাক শুনে কলপাড়ে চলে গেল সে। মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে গামছায় মুখ মুছতে মুছতে এলো ওদের সামনে। ফারজানা বললেন,

-” শেহনাজকে নিয়ে নদীতে যাও তো বাবা। একটু গোসল করে নিবে ও”।

এমির বাঁধা দেয়। বলে,
-” আপনি যান, আমি কেন যাবো”?

-” আমার কাজ নেই? রান্না বসাবো না? ছাগল বিক্রি করতে যাবো আবার। এত সময় আছে? তুমিও তো গোসল করবে। এক সাথেই যাও”।

এমির বিরক্তিতে চ সূচক শব্দ করে। হনহনিয়ে চলে যায় ঘরে। শ্যাম্পু, সাবান নিয়ে নদীর পাড়ে অগ্রসর হয়। শেহনাজ এমিরের পিছু পিছু হাটে। নদীর পাড়ে পৌঁছে শেহনাজ বিস্ময় আটকে রাখতে পারে না। নদীর পাড়ে সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করা সিঁড়ি। নদীর পানি খুব স্বচ্ছ, পরিষ্কার। নদীর তিন পাড়ে সুপারি গাছ আর আগাছা। শেহনাজ চেয়ে রয় নির্নিমেষ। এমির সাবানের খাঁচটা সিড়িতে রেখে নেমে পরে নদীতে। শেহনাজ ভয় পায়। সে সাঁতার জানে না। যদি তলিয়ে যায়? এমির কি তাকে বাঁচাবে নাকি ফেলে রেখে চলে যাবে?

এমিরের ডাকে তার ধ্যান ভাঙে,

-” দাঁড়িয়ে থাকার জন্য এসেছো”?

শেহনাজ না সূচক দু ঘাড় নাড়ে। ধীরে ধীরে পানিতে নামে। ভয়ে ওর জান যায় যায় অবস্থা। এমির বুঝতে পারে। এগিয়ে এসে শেহনাজের হাত ধরে। মাঝামাঝি পানিতে এসে হাত ছাড়ে। বলে,

-” এখানেই ডুব দেবে। দুরে যেও না”।

-” আর আপনি”? প্রশ্ন করে শেহনাজ।

আমি সাঁতার কাটবো। ও পাড়ে যাবো।

এমির সাঁতার কাটতে শুরু করল। পানির ঝংকার তুলে এদিক ওদিক সাঁতরে বেড়াল। শেহনাজের ভারী মন খারাপ হলো। সাঁতার জানলে সেও এমিরের মতো পুরো নদীটায় বিচরণ করতে পারত। এক স্থানে বসে কেবল ডুব দিয়ে গোসল করতে হতো না।

______

গোসল শেষে শেহনাজ কি পরবে এ ভেবে চিন্তায় পরে গেল। ফারজানা ওকে নিজের সবচেয়ে সুন্দর শাড়িটা পরিয়ে দিল। শেহনাজ ঘরের ছোট আয়নায় মুখ দেখল নিজের। শেহনাজ কখনো গ্রামে আসেনি। গ্রামের আবহাওয়া, পানি শেহনাজের সয় না। একদিনে শেহনাজের গায়ের রঙ কিছুটা ফিকে হয়েছে। চোখের নিচটা কালচে হয়ে গেছে। মাথার চুলগুলো কেমন যেন হয়ে গেছে। নিজেকে দেখে শেহনাজ মলিন হাসে।

মহুয়া বারান্দার সামনের বাশের মাচায় উঠে পুতুল খেলছে। শেহনাজ পিচ্ছিল মাটির উপর সাবধানে হেঁটে মহুয়ার পাশে বসে। মহুয়া শেহনাজকে শাড়িতে দেখে চেয়ে থাকে। এত সুন্দর মেয়ে যেন সে আগে এ গ্রামে দেখেনি। শেহনাজ ওর অভিব্যক্তি বুঝে হাসে। জিজ্ঞেস করে,

-” তোমার নাম মহুয়া”?

মহুয়া মাথা নাড়ে। মিষ্টি হেসে উত্তর দেয়,

-” হ। আমার নাম মহুয়া”।

-” ভারী মিষ্টি নাম তোমার”।

মহুয়া পুনরায় হাসে। বলে,
-” তুমি আমাদের গ্রামের সবচাইতে সুন্দর মাইয়া”।

শেহনাজ মহুয়ার মাথায় হাত বুলায়। বলে,

-” চুল খোলা রেখেছো কেন? আসো বেঁধে দেই”।

মহুয়া ঘরে গিয়ে চিরুনি, আয়না, রাবার আর ক্লিপ নিয়ে আসে। শেহনাজ খুব সুন্দর করে স্টাইল করে মহুয়ার চুল বেঁধে দেয়। সহসা রাস্তা দিয়ে একজন বয়স্ক লোককে সাইকেলে করে বক্স নিয়ে যেতে দেখতে পায় শেহনাজ। সে কৌতুহল নিয়ে দেখে সেদিকে। লোকটা “মালাই মালাই” বলে ডাকছে আর কাঠের বক্সটাকে বারবার বন্ধ করে শব্দ করছে। শেহনাজ মহুয়াকে শুধোয়,

-” উনি কি বিক্রি করছেন”?

মহুয়া উত্তর দেয়,
-” মালাই। মালাই চিনো? আইসকিরিম”।

-” চলো আইসক্রিম খাই”।

-” দাঁড়াও মায়ের কাছে ট্যাকা চাই”।

শেহনাজ খেয়াল করে মহুয়া গ্রাম্য ভাষা আর শুদ্ধ ভাষা একত্রে করে অন্যরকম ভাষায় কথা বলে। সে বুঝতে পারে মহুয়া সবার সাথে গ্রাম্য ভাষায় কথা বললেও তার সাথে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে চায়। কিন্তু অভ্যেস নেই বলে শুদ্ধ অশুদ্ধ মিলে যায়। বলে,

-” তোমার ভাইয়ের কাছে টাকা চাও। বলবে আমি চেয়েছি”।

মহুয়া ছুটে যায় ঘরে। এমিরের কাছে টাকা চায় শেহনাজের নাম করে। এমির বারণ করে না। খুচরো পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে দেয়। শেহনাজ আর মহুয়া দৌড়ে আইসক্রিম ওয়ালার কাছে গিয়ে আইসক্রিম কিনে। দশ টাকার নারকেলের আইসক্রিম দেখে ভড়কায় শেহনাজ। এত কমদামি আইসক্রিম সে কখনো খায়নি। অস্বস্তি নিয়ে সে আইসক্রিম মুখে নেয়। মিষ্টি বরফের উপর নারকেল ছড়ানো হয়েছে। খেতে বেশ সুস্বাদু। শেহনাজের ভালো লাগল।

এমির বারান্দায় বসে মহুয়া আর শেহনাজের কার্যকলাপ দেখে। ভারী অবাক হয় সে। শেহনাজের মতো মেয়ে কিভাবে এ বাড়িতে রয়েছে বুঝে উঠতে পারে না এমির। মহুয়া আর ফারজানার সাথে তার এমন সুসম্পর্ক দেখে সে ভড়কায় ও খানিক। এমন জায়গায় শেহনাজ কিভাবে আছে? চলে যাচ্ছে না কেন?

____

সর্ষে খেতের মাঝখানে মাটির চিকন রাস্তা। গত রাতের বৃষ্টির কারণে মাটি একদম পিচ্ছিল হয়ে আছে। সর্ষে খেত যেন আলো ছড়াচ্ছে। আইলে পানি জমেছে। হলদেটে ফুল গুলো ভিষণ সুন্দর লাগছে শেহনাজের নিকট। বৃষ্টির তোপে কিছু ফুল নষ্ট হয়ে গেছে। ওরা যাচ্ছে হাটে। আজ হাটের দিন। সবকিছু পাওয়া যাবে বাজারে। কিছু মাছ মাংস কিনবে এমির। শেহনাজের জন্য কিছু কাপড় ও কিনবে।

এমির হাঁটছে আগে আগে। ওর গায়ে সাদা শার্ট আর জিন্স। সুঠাম দেহ নজর কাড়ছে। পিছনে শেহনাজ। সাদা রঙের শাড়ি পড়েছে সে। সাদা শাড়ির মাঝে সোনালী কাজ করা। আঁচলটা নীলচে রঙের। শুভ্র রঙের শাড়িতে শেহনাজকে অপরূপ সুন্দর লাগছে। এমনিতেই রাস্তার অবস্থা করুণ, তার উপর শাড়ি পড়ে হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। শাড়ি সামলাতে পারছে না একদম। এই বুঝি ধপাস করে পরে যাবে। ভাবতে ভাবতেই শেহনাজ হোঁচট খায়। নিজেকে বাঁচাতে চেপে ধরে এমিরের কাঁধ। এমিরের পিঠে এসে ওর বুক ঠেকে। চিবুক ঠেকে এমিরের ঘাড়ে। অপ্রস্তুত হয় এমির। রাগে খুব। চক্ষুদ্বয় তেজী হয়ে ওঠে। বলে,

-” দেখে হাঁটতে পারছো না? আরেকটু হলেই তো পরে যেতাম”।

শেহনাজ নিজেও রাগে। বলে,

-” আমার কি দোষ? শাড়ি পড়ে আমি ভালোভাবে হাঁটতে পারি না। আর মাটি এত পিছলে”।

-” তাহলে এসেছো কেন? আমি জোর করেছি”?

-” জোর করবেন কেন? স্বামীর পাশে পাশে স্ত্রী থাকবে এটাই তো নিয়ম।

এমির দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আলতো করে শেহনাজের হাত চেপে ধরে। শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে শেহনাজের অপর কাঁধে উঠিয়ে দেয়। মাথায় কাপড় দিয়ে দেয়। বলে,

-” সাবধানে এসো। তাড়াহুড়ো নেই”।

বাজারে গিয়ে এমির পোল্ট্রি মুরগী কেনে। সাথে কিনে কিছু গুঁড়ো আর বড় মাছ। ফেরার পথে শেহনাজের জন্য দুটো রেডিমেট থ্রিপিস আর তিনটে গজ কাপড় কিনে। শেহনাজ খুব খুশি। এই প্রথম গ্রামীণ হাটবাজার দেখেছে সে। এমিরকে বাজার করতে দেখেছে, এমিরের সাথে অনেকটা পথ হেঁটেছে। এ যেন শেহনাজের অনেক বড় পাওয়া। সারাটা দুপুর ওর খুব ভালো কাটল।

ফিরে আসার পর মহুয়া আর ফারজানা মাছ কুটতে বসল। শেহনাজ দাঁড়িয়ে দেখল শুধু। মাছ কাঁটার একদম অভ্যেস নেই ওর। অনেক মাছের নাম ও জানে না। এগিয়ে গিয়ে যে বলবে “আমি মাছ কুটবো” সে সাধ্য তার নেই। সে বসে দেখে কেবল। বিকেলের দিকে গ্রামের অনেক মহিলা দলবদ্ধ ভাবে শেহনাজকে দেখতে এমিরদের বাড়িতে আসে। একে একে সকলের সাথে কথা বলে শেহনাজ। সকলেই ওর রুপের প্রশংসা করে। টুকটাক ওর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। শেহনাজ হাসিমুখে সকলের সাথে মিশে। এমির এবার ভয় পেতে শুরু করে। শেহনাজ কি তবে যাবে না এখান থেকে? থেকে যাবে এখানে? শেহনাজের বাবাকে কি জবাব দিবে ও? তিনি যে বলেছিলেন শেহনাজকে যেভাবেই হোক ফিরিয়ে দিতে। তা কিভাবে সম্ভব হবে? এখানে ভালোমন্দ খাওয়া নেই, গোসল করার জন্য বিশুদ্ধ পানি নেই, কোনো সুযোগ সুবিধাও নেই। তবুও শেহনাজ কি সুন্দর নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। এমির হলে কি এসব পারতো? এমির অদুরে দাঁড়িয়ে শেহনাজের দিকে তাকিয়ে থাকে। শেহনাজের সবার প্রতি এত ভালো ব্যবহার তাকে আকৃষ্ট করে। তড়তড়িয়ে বেড়ে ওঠে প্রেম। শেহনাজ জানতে পারে না, বুঝতে পারে না। সে জানে না তার স্বামী তাকে ঠিক কতটা গভীরভাবে দেখে।

___

আজ রাতের খাবারের আইটেম গুলো বেশ ভালো। মুরগীর মাংস কষা আর ডিম ভাজা। শেহনাজ এখানে এসে এবারই তৃপ্তি সহকারে দু প্লেট ভাত খেল। খাওয়ার পর যে যার ঘরে শুতে গেল। এমির আর শেহনাজের জন্য একটি রুম বরাদ্দ। সে রুমের ফ্যান ভালো ঘুরে। ঘরটাও পরিপাটি, গোছানো।

নটা বাজার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পরল শেহনাজ। এমির ঘুমাল আরো পরে। সহসা মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেল শেহনাজের। উঠে বসল সে। আশপাশে তাকাল। এমির ওপাশ ঘুরে ঘুমিয়েছে। মাঝে রেখেছে বড়, মোটাসোটা কোলবালিশ। এমিরের গায়ে শার্ট। উপরের দুটো বোতাম খোলা। গরমের কারণে হয়তো খুলে রেখেছে।

শেহনাজ অতীত স্মৃতিচারণ করে। ভাবে তার মস্ত বড় বাড়িটার কথা। যেখানে শুধু তার রাজত্ব চলতো। বাড়ির বাইরের ফুলগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। প্রতিটি ফুল যেন ওকে ডাকছে। শেহনাজের মনে পরে তার আব্বু আম্মুর কথা? এখন তারা কি করছে? সুখ নিদ্রায় তলিয়ে আছে নাকি তার কথা ভেবে কান্নাকাটি করছে?

শেহনাজ ফোন বের করে। না তার আব্বুর একটিও কল আসেনি এ কদিনে। সে কেমন আছে, কি করছে তা নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই কারোর। হুট করে শেহনাজের কান্না পায়। চোখ দুটো জ্বলে উঠে। কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পরে পানি। পরিবারের কথা ভেবে ওর বুকে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়। তাদের আদর, ভালোবাসার মুহুর্ত বারংবার মানসপটে ভেসে ওঠে। কথা বলতে ইচ্ছে হয় তাদের সাথে। এ অন্ধকার ঘর শেহনাজের কষ্টগুলোকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এমির তাকে ভালোবাসে না, সহ্য করতে পারে না। ঘুমোনোর আগেও ফারজানার সাথে অন্য ঘরে গিয়ে চোটপাট করেছে এমির। শেহনাজ আড়াল থেকে সব শুনেছে। শেহনাজকে এমির এখানে চাইছে না। তাকে তাড়ানোর ফন্দি আটছে। এমির সহ্য করতে পারছে না শেহনাজকে।

তবুও শেহনাজ হাসিমুখে এখানে আছে। ভিখিরির মতো পরে আছে এমিরের পিছনে। বেহায়ার মতো , নির্লজ্জের মতো ভালোবাসার জন্য হাপিত্যেশ করে মরছে। কি লাভ হচ্ছে এতে? এমির তাকে ঠিকমতো দেখে না, ভালোবাসে না। কেমন দুরে দুরে থাকে, এড়িয়ে যায়। কার জন্য তার এত ত্যাগ?
শেহনাজের কাছে এখন কিছুই নেই। না আছে ভালোবাসার মানুষ আর না আছে পরিবার। কচুরিপানার মতো সে ভেসে বেড়াচ্ছে। স্রোত যেদিকে বইবে সে সেদিকেই যাবে। তার আপনজন নেই, স্বান্ত্বনা দেওয়ার মানুষ নেই। এই অচেনা, অজানা স্থানে সে একা। একেবারে একা।

শেহনাজের কান্না বাড়তে থাকে। বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে সে। হেচকি ওঠে ওর। ফুঁপিয়ে কাঁদে। কান্নার দাপটে শেহনাজের শরীর ওঠানামা করে। গাল ভিজে একাকার। শেহনাজের ফোঁপানোর আওয়াজে এমিরের কান সজাগ হয়। চোখ মেলে সে। ঘাড় বাঁকিয়ে শেহনাজের দিকে দৃষ্টি মেলে। সহসা চমকে ওঠে সে। শেহনাজের কিছু হলো না তো?

এমির কোলবালিশ সরায়। উঠে বসে। শেহনাজের বাহুতে হাত রাখে। জিজ্ঞেস করে,

-” শেহনাজ, কি হয়েছে? কাঁদছো তুমি”?

শেহনাজ চোখ মুছে না। সরল স্বীকারোক্তি দেয়,

-” কাঁদছি”।

-” কেন? শরীর খারাপ লাগছে? মা কে ডাকবো”?

শেহনাজ উঠে বসে। অশ্রুসজল চোখে চেয়ে রয় এমিরের দিকে। সে চোখ দেখে এমিরের হৃদয় ছলকে ওঠে। ব্যাকুল হয়ে উঠে। থমকে যায় রক্ত চলাচল। পুনরায় উত্তেজিত কণ্ঠে শুধোয়,

-” বলো না। কি হয়েছে”?

নাক টানে শেহনাজ।
-” আব্বু আম্মুকে মনে পরছে।

-” তোমাকে তো বারবার বলেছি চলে যেতে। শেহনাজ, উনারা তোমাকে ভালোবাসে। এভাবে চলে আসায় একটু রাগ করেছে। তুমি ফিরে গেলে উনারা কিচ্ছু বলবেন না। উনারা কত কষ্ট পাচ্ছে তুমি জানো”?

শেহনাজের কান্না থামে। অবাক হয়ে সে তাকিয়ে থাকে এমিরের দিকে। শুষ্ক কণ্ঠে বলে,

-” আপনা সবার কষ্ট দেখতে পান। কেবল আমার কষ্ট আপনাকে ব্যথিত করে না। তাইনা?

আচমকা শেহনাজ তেতে ওঠে। আক্রমণ করে এমিরকে। এমিরের শার্টের কলার দু হাত দিয়ে চেপে ধরে। হিংস্র, উন্মাদ হয়ে ওঠে। নাক, চোখ লাল হয়ে যায় শেহনাজের। এমিরের নগ্ন ফর্সা ঘাড়ে নখের আঁচড় বসিয়ে দেয়। বলে,

-” তোর জন্য, শুধুমাত্র তোর জন্য আমি আমার বাবা-মাকে ছেড়েছি, আমার ঘর আমার বাড়ি ছেড়েছি। নিজের আভিজাত্য ছেড়েছি। শখ, আহ্লাদ সব বিসর্জন দিয়েছি। তোর জন্য আমি সেই ঢাকা থেকে এখানে চলে এসেছি। সকলের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আর তুই? তুই আমাকে মেরে ফেলতে চাইছিস? বারবার চলে যেতে বলছিস? অ্যাই তুই এত নিষ্ঠুর কেন? এত পাষাণ কেন? তোর হৃদয় আল্লাহ্ কি দিয়ে বানিয়েছে হ্যাঁ? তোর জন্য আমি সব ছেঁড়েছুঁড়ে এসেছি। নিজের সত্তাকে ঝেরে ফেলেছি। ব্যক্তিত্ব মর্যাদা বিসর্জন দিয়েছি। ভেবেছি আর কিছু না পাই, অন্তত তোর ভালোবাসা পাবো। সেই ভালোবাসার জোরেই আমি শেহনাজ টিকে থাকবো। কিন্তু না। তুই তো নির্দয়, তোর মন গলে না। আরেহ একটা কুকুরও যদি দিনরাত পিছু পিছু ঘুরে, মানুষের তার প্রতি মায়া জন্মে। কুকুরটাকে রুটি ছিঁড়ে খেতে দেয়, হাত বুলিয়ে দেয়। আর তুই? তুই আমার সাথে একটু ভালো ব্যবহারও করতে পারিস না।

পুনরায় ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে শেহনাজ। ছেড়ে দেয় এমিরের শার্টের কলার। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে,

-” এক পাক্ষিক ভালোবাসায় আমি জ্বলে পুড়ে মরছি। আপনার একটুও মায়া হয় না আমার প্রতি। একটুও করুণা হয় না। আমি কি এতই খারাপ? আমাকে কি একটু ভালোবাসা যায় না”?

এমির নির্বাক। ওর মুখে কোনো কথা নেই। তাকিয়ে থাকে এক ধ্যানে শেহনাজের দিকে। শেহনাজের এই সহজ সরল স্বীকারোক্তি তার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে। জ্বলে ওঠে বক্ষপিঞ্জর। গলা শুকিয়ে আসে। তার সামনের মেয়েটির এমন করুণ পরিণতি সে চায়নি। মেয়েটির ভালো ভেবেই তো এতকাল সে দুরে সরে থেকেছে। কিন্তু শেহনাজ যে ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছে তা সে টের পায়নি।

এমিরের ভিতরটা জ্বলছে। চোখ বেয়ে নামতে চাইছে অশ্রু। চোখের কোণ রক্তিম হয়ে গেছে। বিধাতা তার ভাগ্যকে কেন এভাবে লিখল? শেহনাজ কাঁদতে কাঁদতে মাথা রাখে এমিরের বুকে। এমির নিরুত্তর। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই ওর মাঝে। মুর্তির ন্যায় বসে থাকে। শেহনাজের চোখের পানিতে ভিজে যায় এমিরের শুভ্র শার্ট। এমির তবুও ঠায় বসে। বিন্দুমাত্র স্বান্ত্বনার ভঙিতে শেহনাজের পিঠে হাত দেয় না, আহ্লাদ দেয় না।

শেহনাজের কান্নার স্বর ধীরে ধীরে কমে। কমে যায় ফোপানোর আওয়াজ। শেহনাজের এই কান্না এমিরকে ব্যথিত করেছে কিনা বোঝা যায় না। শেহনাজ নিজের কর্মে নিজেই অবাক হয়। মনে জমা সব কথা উগড়ে দিয়ে মন কিছুটা শান্ত হয় ওর। ঘুম আসে খুব। এমিরের বুকে লেপ্টে থাকে। রাত বাড়ে। খেকশেয়ালের ভয়ঙ্কর ডাক ভেসে আসে। নিদ্রায় তলিয়ে যায় শেহনাজ। খানিক বসে এমির শেহনাজকে বুক থেকে সরিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। আজকে ওর ঘুম হবে না নিশ্চিত। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায় এমির। সতর্ক হয়ে দরজা খোলে। বাইরে বেরিয়ে এসে সে গভীর শ্বাস টানে। অদূরে থাকা মায়ের কবরের সামনে এসে দাঁড়ায় এমির। জিয়ারত করে। শেষে মন খারাপে, অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে,

-” শেহনাজকে খুশি করার, ওকে সুখে রাখার সাধ্য আমার নাই আম্মা। আমার ঘর বাড়ি কিচ্ছু নাই। পেটের ভাত খুঁজতে খুব কষ্ট হয় আম্মা। কাউকে ভালো রাখতে পারি না আমি। কেমনে ওরে ভালোবাসি আম্মা? অভাব আসলে যে ভালোবাসা হারাই যায়। আমি আর মানুষ হারানোর কষ্ট সহ্য করতে পারবো না আম্মা। একদম পারবো না”।

চলবে।