শেহনাজ পর্ব -১১

0
57

#শেহনাজ ______ {১১}
#লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

আজ ও ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পরছে। শীতল বাতাস ও বইছে। তিরতির করে কাঁপছে শেহনাজের চিত্ত। ললাটে জমেছে চিন্তা। সাবিহা আপু আর নেই এ কথাটা বারবার বেজে উঠছে শেহনাজের কানে। খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। এমির যদি কখনো এ কথা জানতে পারে মানুষটা খুব কষ্ট পাবে। এমির বেঁচে আছে আশায়, সেই আশাই যদি হারিয়ে যায় তবে এমির হয়তো বদলে যাবে। বদলে যাবে এমিরের জীবনের বাঁক। এ কথা সে কিভাবে জানাবে?

এমির পাটি বিছিয়ে খেতে বসেছে। ফারজানা খাবার বেড়ে দিতে দিতে শেহনাজকে ডাকল। শেহনাজ সে ডাক শুনে খাবারের ঘরটাতে উপস্থিত হলো। ফারজানা বলল ” বসো, খেয়ে নাও”।

শেহনাজের কান্না পাচ্ছে। কিছুই ভালো লাগছে না ওর। এ মুহূর্তে খাওয়ার কথা ভাবছে না মোটেই। সাবিহাকে সে চিনে না, জানে না। একদিন এমিরের মুখে তার গল্প শুনেছিল। তাতেই আপুর প্রতি শেহনাজের মনে আলাদা সম্মানের জায়গা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এমিরের তার বড় বোনের প্রতি এত ভালোবাসা দেখে তার ভালো লেগেছিল খুব। সে চেয়েছে আপু ফিরে আসুক। এমির নিজের বোনকে ফিরে পাক। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়।

মৃদ্যু হেসে শেহনাজ বলে, ” খাবো না আন্টি। খিদে নেই। আপনারা খেয়ে নিন”।

-” খাবে না কেন? তোমার জন্য টাকি মাছের ভর্তা বানালাম”।

শেহনাজ এমিরের পানে তাকাল। গলা শুকিয়ে এলো ওর। বলল, ” রেখে দিন। কাল খাবো”।

শেহনাজ ঘরে গিয়ে বসে রইল। ফোন ঘাটল কিছুক্ষণ। অপেক্ষা করল এমিরের জন্য। এমির কখন আসবে ঘরে? কখন অতীতের কথাগুলো বলবে তাকে? তার যে তর সইছে না।

_______

তানিয়ার মেসেজের রিপ্লাই এলো অনেক দেরিতে। রাত এগারোটার দিক। নয়ন আর সাদাত তখন ঘুমিয়ে কাদা। জেগে কেবল হাসান। লিখছিল উপন্যাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাশেই ছিল মুঠোফোন। টুং করে মেসেজের শব্দ আসা মাত্রই হাসান ফোনটা হাতে তুলে নিল। শার্টের কোণায় চশমার গ্লাস পরিষ্কার করে নিল। তানিয়া লিখেছে,

-” হ্যাঁ চিনি। আমরা এক স্কুলে পড়তাম। এ প্রশ্ন কেন করছেন”?

হাসান খুব অস্বস্তি বোধ করল। একই কলেজের স্টুডেন্ট তারা। তানিয়া তার জুনিয়র। দেখা হলেই তানিয়া বিনয়ের সাথে সালাম জানায় তাকে। কিন্তু এ প্রথম মেসেঞ্জারে তাদের কথা হচ্ছে। ঊর্মিকে নিয়ে প্রশ্ন করলে মেয়েটা কি হাসবে? ক্যাম্পাসের বড় ভাই তাকে নক দিয়েছে বলে কি বন্ধুদের সাথে গসিপ করবে?

-” আমাকে চিনেছো”?

তানিয়া উত্তরে লিখল,
-” জি চিনেছি। ঊর্মিকে আপনি কিভাবে চিনেন”?

-” বই কিনতে গিয়েছিলাম শিমুলতলীতে। সেখানেই পরিচয় হয়েছিল। ওর ঠিকানা দিতে পারবে আমায়”?

তানিয়া দোনামনা করে উত্তর দিল,
-” তা দিতে পারবো। কিন্তু কোন ঠিকানা চাইছেন? ওর শ্বশুরবাড়ির নাকি বাবার বাড়ির”?

হাসান ভড়কাল। চমকে উঠল। বেশ কিছুক্ষণ তানিয়ার টেক্সটের দিকে তাকিয়ে রইল। চিনচিনে সূক্ষ্ম ব্যথা হলো বুকে। অবশ, অসাড় হলো শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। তানিয়াকে নিজের অভিব্যক্তি বুঝতে দিল না হাসান। বলল,
-” ও বিবাহিত?

-” হুম। সপ্তাহ খানেক আগেই বিয়ে হয়েছে ওর। লাভ ম্যারেজ প্লাস অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ”।

হাসান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঊর্মি তাকে মনে রাখেনি। কখনো ভালোওবাসেনি। কিন্তু একসাথে ঘোরা, নিজেদের ভালোমন্দ জানা, বোঝা এসব কি একদম ঠুনকো বিষয় ছিল? এত কাছে থেকেও ঊর্মি বুঝতে পারেনি হাসানের মনের কথা? নাকি প্রশ্রয় দিয়েছে জেনেও?

হাসান লিখল,
-” আমার সাথে ওর শ্বশুর বাড়িতে যাবে একটু? ওর সাথে আমার কিছু কথা ছিল”।

-” আচ্ছা। আমাকে তারিখ আর সময়টা জানাবেন”।

হাসান অফলাইন হলো। নয়ন আর সাদাতের দিকে তাকাল। সাদাতের স্যালারি ভালো। প্রেমিকার সাথে বেশ ভালোই দিনকাল যাচ্ছে ওর। নয়নের জীবনে সেসব ঝামেলা নেই। ওর বাবা ওকে বিদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। সে নিয়ে নয়ন ও বেশ খুশিই। এমির হয়তো শেহনাজের সাথে সুখীই রয়েছে। কিন্তু সে? এত গুলো টাকা হারিয়ে বসল। হৃদয় চুরি করল ঊর্মি নামের মেয়েটি। এক গাদা অনুভূতির জোয়ারে ভাসিয়ে ঊর্মি বিয়ে করে নিল। সেও সুখেই আছে। সুখে নেই কেবল সে। নদীর মাঝে এসে আটকা পরে আছে। চারদিকে কেবল শূণ্যতা। কোথাও যাবার জায়গা নেই।

____

এরশাদ সাখাওয়াত এ বাড়ি থাকে না। মাসে একবার এসে ঘন্টা দুয়েক থেকে চলে যায়। কেন আসে তা সবার অজানা। গ্রামের লোকে তাকে পাগল বলে। উন্মাদের মতো চলাফেরা আর কথাবার্তার ধরণেই বোঝা যায় যে সে মানসিক রোগীর মতোই। কাজে কর্মে কোনো মিল নেই। অথচ এক সময় এ গ্রামের সকল বিচারকার্যের রায় সে দিতো।

এমির ঘাড় ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঘরে ঢুকল। বাড়ির পিছনের কাঁঠাল গাছ কেটে সে কাঠ বানিয়েছে সারা বিকাল ভরে। সে কাঠ দিয়েই আরো কয়েকদিন তাদের বাড়ির উনুন জ্বলবে। কাঠ কাটার সময় কুড়াল ব্যবহার করতে গিয়ে হাতে ফোসকা পরেছে এমিরের। শরীর ও ম্যাজ ম্যাজ করছে। সেই ব্যথায় সন্ধ্যের পরে জ্বর এসেছে।

শেহনাজকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এমির প্রশ্ন করল,
-” ঘুমাওনি”?

শেহনাজ তাকাল না। উত্তর দিল,
-” অপেক্ষা করছিলাম আপনার জন্য”।

এমির চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। শেহনাজের মায়া মুখের দিকে চেয়ে চোখ ফেরাতে বেগ পোহাতে হলো ওর। বলল,

-” বসো, আসছি”।

এমির বেরিয়ে গেল। শেহনাজ নিজেকে প্রস্তুত করল। এমিরের অতিত নিশ্চয়ই তার জন্য খুব সহজ হবে না। ধারাল কথাগুলো তার হৃদয়ে ব্লেটের মতো ক্ষত তৈরি করবে। তা জেনেও শেহনাজ নিজেকে স্থির রাখল। এমির এলো খানিকক্ষণ বাদেই। হাতে পুরোনো অ্যালবাম। গামছা দিয়ে অ্যালবামের উপরের ময়লা গুলো মুছল সে। শেহনাজের পাশে এসে বসল। অ্যালবাম খুলে শেহনাজকে একটি ছবি দেখাল সে। এমিরের ছোটবেলার ছবি। সাথে সাবিহা আর এমিরের আম্মা। শেহনাজকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলল,

-” এটা আমার আম্মা। আর এইযে সাবিহা আপু। মহুয়া তখন ও হয়নি”।

শেহনাজ ছবিটা ভালোমতো দেখল। এমিরের বয়স এখানে খুব কম। চেনা যাচ্ছে না ভালোভাবে। সাবিহা আপুকে প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে। এমিরের চেয়ে সে হয়তো দু তিন বছরের বড় ছিল। শেহনাজ বাকি ছবি গুলো দেখতে আরম্ভ করল। বলল,

-” আপনি দেখতে একদম আপনার আম্মার মতো”।

হাসল এমির। সে হাসিতে একরাশ দুঃখ দেখতে পেল শেহনাজ। এমির বলল,

-” আম্মা মারা যাবার পর আর সাবিহা বুবু চলে যাবার পর আমার জীবন বদলে গিয়েছিল। কোনো কিছুই ভালো লাগতো না আমার। গ্রামের লোকজন নানা রকম কথা বলতো। মনে হতো চলে যাই কোথাও। কিন্তু বুবুর মতো আমার অত সাহস ছিল না। তাই কোথাও যেতে পারিনি। সৎ মায়ের সাথেই থেকেছি।

নতুন মায়ের জীবনটাও দুর্বিষহ। ছোটবেলায় অ্যাক্সিডেন্টে উনি উনার ভাই আর বাবা-মাকে হারিয়েছেন। বড় হয়েছেন মামার বাড়িতে। আব্বা উনার প্রথম স্বামী নয়। উনার বিয়ে হয়েছিল একজন ব্যাংকারের সাথে। নাম নাহিদ পারভেজ। নতুন মা কে বিয়ে করার পর তাদের জীবন সুন্দর চলছিল। কিন্তু নাহিদ পারভেজ ছিলেন মাম্মাস বয়। মায়ের কথা ছাড়া এক ফোঁটা পানিও বোধহয় তিনি খেতেন না। মায়ের কথায় উঠতেন বসতেন। মা এসব সয়ে গিয়েছেন। মুখ বুঁজে শাশুড়ির মানসিক অত্যাচার সহ্য করেছেন। বিয়ের তিন বছরের মাথায় নাহিদ আঙ্কেল যে ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন তা আকস্মিক ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। চাকরিচ্যুত হয়ে পড়েন আঙ্কেল। নতুন মা তখন দিশেহারা। সংসার চালাতে হিমসিম খান। উনার শাশুড়ি উনার মামার বাড়ি থেকে যৌতুক আনার জন্য উনাকে বিভিন্ন ভাবে হেনস্তা করেন। আঙ্কেলের ব্যবসার জন্য অনেক টাকা চান। নতুন মা তবুও চুপ থাকেন। তার মামার সামর্থ্য নেই অত টাকা দেওয়ার। তিনি ধৈর্য ধরেন। কিন্তু লাভ হয়নি। উনার শাশুড়ি উনাকে একসময় বাড়ি থেকে বের করে দেন। নাহিদ আঙ্কেল প্রথমে ক্ষুব্ধ হলেও মায়ের কানপড়া শুনে দমে যান। চাইলেও স্ত্রীকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে পারেন না। সে যেন মায়ের হাতের পুতুল। তার জীবনের সকল সিদ্ধান্ত তার মায়ের বিধায় সে কখনো উচ্চবাচ্য করেনি।

নতুন মা আশায় দিন গোনে। এই বুঝি আঙ্কেল তাকে নিতে এলো। কিন্তু আঙ্কেল উনাকে ফিরিয়ে নেয়নি। ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছিল। আর নতুন মা তার ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ণ না করে ডিভোর্স লেটারে সাইন করে দিয়েছিল। তখন অত কাজ পাওয়া যেত না। নতুন মা পড়াশোনা তেমন করেননি বলে কাজ পাননি কোথাও। সেলাইয়ের কাজ করতেন মামার বাড়ি থেকে। অনেকগুলো বিয়ের প্রস্তাব এলেও তিনি নাকচ করে দেন। আঙ্কেল ছাড়া আর কাউকেই হৃদয়ে স্থান দিতে চাননি উনি।

তবে উনার মামা-মামীর আচরণ পরিবর্তন হতে শুরু করল তখন থেকে, যখন একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব নতুন মা নাকচ করে দিচ্ছিলেন। আঙ্কেলকে উনি এতটাই ভালোবাসতেন যে দ্বিতীয় বিয়ে করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কারো সাথে মিশতেন না তিনি। গুমড়ে কাঁদতেন। এরপর দিন যেতে লাগল। উনার বয়স বাড়তে লাগল। সময়ের পরিক্রমায় উনি সহজ হলেন। ঠিক করলেন আর মামার বাড়িতে বোঝা হয়ে দিন কাটাবেন না। বিয়েতে রাজি হলেন। কিন্তু এবার কেবল বয়স্ক আর দু-তিন সন্তানের পিতারাই প্রস্তাব নিয়ে আসছিল। কিংবা যারা আসছিল তাদের পাস্ট খুব জঘন্য ছিল। সেসময় উনার মামা-মামী হয়ে উঠেছিলেন হিংস্র। উনাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে পারলেই যেন বাঁচে। নানা ভাবে উনাকে গালিগালাজ করতো। একসময় হার মেনে নিলেন নতুন মা। মামা যার সাথে বিয়ে ঠিক করল উনি তাকেই বিয়ে করলেন। কিন্তু বিয়ের আগে উনি জানতেন আব্বার দুটি মাত্র সন্তান আর আব্বার স্ত্রী মারা গেছেন বছর তিনেক আগে। অথচ এখানে এসে জানলেন তার মামা তাকে ঠকিয়েছেন। বয়স্ক, কুৎসিত একজন লোকের সাথে বিয়ে দিয়েছে স্বেচ্ছায়। এজন্য মোটা অঙ্কের টাকাও নিয়েছেন আব্বার থেকে। এ কথা জানার পর উনি এতটাই ভেঙে পরলেন যে মেনে নিলেন নিজের ভাগ্য। প্রতিবাদ করলেন না কোনো।

এমির থামল। গলা শুকিয়ে এলো ওর। শেহনাজ পলকহীন চোখে তাকিয়ে। ফারজানার এমন করুণ অতীত তাকে ভিষণ পীড়া দিল। ভালো মানুষদের সাথেই কেন এমন হয়? বুঝতে পারে না শেহনাজ। মলিন হয়ে ওঠে ওর কায়া। বলে,

-” উনাকে দেখে বোঝাই যায় না উনার জীবন কাহিনী এত করুণ”।

এমির পুনরায় বলতে আরম্ভ করে,
-” বুবু চলে যাওয়ার পর আমি উনাকে সহ্য করতে পারতাম না। মনে মনে গালমন্দ করতাম। অনেক বাজে ব্যবহার করতাম। কিন্তু উনি সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন। বিনয় আর আন্তরিকতা মেশানো থাকতো উনার কণ্ঠে। এত কিছু হবার পর ও উনি আমাকে আর মহুয়াকে আগলে রাখতে চাইতেন।

শেহনাজ প্রশ্ন করল,
-” উনি উনার অতীত আপনাকে বলেছে? আপনি এসব জানলেন কিভাবে”?

-” আমি এসব জেনেছি অনেক পরে। উনার এলাকায় গিয়ে আমি খোঁজ খবর নিয়ে এসব জানতে পেরেছি। উনার মামী মৃত্যুর আগ মুহুর্তে আমাকে ডেকে পুরো গল্পটা শুনিয়েছিলেন”।

শেহনাজ ভারী শ্বাস ফেলল। এমির তা দেখে বলল,
-” আম্মার মৃত্যুর পর প্রায় সময় আম্মাকে স্বপ্নে দেখতাম। দেখতাম আম্মা কাঁদছে। তার গলায় মোটা দড়ি ঝুলছে। চিৎকার করে ডাকছে আমায়। বলছে ” এমির, বাপ আমার। তোর বাপরে কঠিন শাস্তি দিস। ওর জন্যে আমি মইরাও সুখ পাই নাই”।

আমার মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। আব্বাকে সেদিনের পর থেকেই সহ্য করতে পারতাম না। ওকে দেখলেই মেজাজ খারাপ হতো। অনেক সময় তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম। সেজন্য আব্বা আমার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। আব্বা চাইতো তার ব্যবসায় আমাকে নিতে। আমি রাজি হইনি। অবাধ্য হয়েছিলাম বলে আব্বা আমাকে অপছন্দের তালিকায় ফেলেছিল। এক রাতে আমার কি হলো জানা নাই। আম্মার জন্য ছটফট করতে করতে দম আটকে আসছিল। রাগে, ক্ষোভে রামদা বের করে আব্বার ঘরে গিয়েছিলাম। ওর গলায় ধরেছিলাম। যদিও মেরে ফেলার ইচ্ছা ছিল না। কেবল ভয় দেখাতেই চেয়েছিলাম। আব্বা আমাকে সেদিন থাপ্পড় মেরেছিল। পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দিয়েছিল। নতুন মা বারবার আব্বাকে বুঝিয়েছিলেন। আব্বা বোঝেনি। খুনের চেষ্টার অভিযোগে আমাকে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আব্বা যেহেতু গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিল তাই উনার কথা পুলিশ সহজেই বিশ্বাস করে নিয়েছিল। ছ মাস কারাগারে থাকার সময় আব্বা আমাকে একবার ও দেখতে যায়নি। আমি কারাগার থেকে বের হতে পেরেছিলাম শুধুমাত্র নতুন মায়ের জন্য। উনি আমাকে ওখান থেকে বের করতে সব ধরণের চেষ্টা করেছেন। একদিন পর পর পনেরো মাইল হেঁটে আমাকে দেখতে গিয়েছেন থানায়। আমাকে প্রতিনিয়ত ধৈর্য ধরতে বলেছেন। বলেছেন যে কোনো মূল্যে আমাকে ওখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবেন। দীর্ঘ ছ মাস আমি পৃথিবীর আলো বাতাস দেখিনি। কেঁদে কেঁদে চোখের পানিও শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাহিরের পরিবেশ দেখার জন্য কত রাত ছটফট করেছি, অপরাধীর তকমা পেয়ে হাঁসফাঁস করেছি। আব্বার করুণা হয়নি। সে তার নতুন স্ত্রী নিয়ে আনন্দে থেকেছে। আনন্দে থাকেনি কেবল আমার সৎ মা।

এমিরের চোখের কোণ ভিজে এলো। শেহনাজ কেঁদে ফেলল নীরবে। বুকের ভেতরটায় হাহাকার করে উঠল। এমিরের ব্যথা গুলো শুষে নিতে চাইল শেহনাজ। এমির তা দেখে মৃদ্যু হাসল। আবার বলতে শুরু করল,

-” ছ মাস পর কারাগার থেকে বের হবার হয়ে ভেবেছিলাম মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু না। আরো ভয়ানক পরিস্থিতিতে পড়লাম আমি। গ্রামের মানুষ আমাকে খুনী ভাবছিল। সবাই জানতো আমি আব্বাকে খুন করার চেষ্টা করেছি। অনেকে তো বলাবলি করতো আমি মহুয়াকেও মারতে চেয়েছি। পুরো এলাকায় আমার নামে ছিঃ ছিঃ পড়ে গিয়েছিল। আব্বার সমালোচনা তখন কিছুটা মুছে গিয়েছিল। লোকজন কানাঘুষা করতো আমাকে নিয়ে। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করতো। বুবুকে পাশে পেতে ইচ্ছে করতো।

এতকিছুর মধ্যে ভালো খবর ছিল আমার পরিক্ষার রেজাল্ট। এসএসসি তে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিলাম। নতুন মা খুব খুশি হয়েছিলেন। এতকিছুর মাঝেও তিনি আমাকে পড়াশোনা করতে বলতেন। কিন্তু আমার সে মানসিকতা ছিল না। নিজেকে একা করে ফেলেছিলাম আমি। সমাজের মানুষের ধিক্কার আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছিল। এরপর এক বছর আমি পড়াশোনার আগেপিছেও ছিলাম না। নতুন মা আর না পেরে আমাকে পরের বছর আবারও বোঝাতে লাগলেন। আমাকে বললেন শহরে চলে যেতে। বুবুকে খুঁজে পাওয়ার একমাত্র রাস্তা হলো শহরে চলে যাওয়া। বুবুকে নাকি শহরেই পাওয়া যাবে। এছাড়া এখানে থাকলে আমি ভালো কলেজে পড়তে পারবো না। নতুন পরিবেশ, নতুন জায়গায় গেলে আমি সুস্থ হয়ে উঠবো এটা উনার ধারণা ছিল। তাই বুবুকে খুঁজতে আর নিজের পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে আমি ঢাকায় যাই। ঢাকায় যাওয়ার ব্যবস্থা, কলেজে ভর্তির সকল দায়িত্ব উনি নিয়েছিলেন। আমি বুঝেছিলাম সৎ মায়ের প্রতি আমার আর রাগ নেই। তিনি আমার ভালোই চান।

আমি ঢাকায় আসার মাস চারেক পর মা টাকা দেওয়া কমাতে লাগলেন। লজ্জায় বলতে পারতাম না টাকার কথা। আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতাম টাকা পাঠাতে। তখনই উনি আমাকে জানালেন যে আব্বার জমিজমা, ব্যাংকের টাকা পয়সা, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সবকিছু আমার চাচা জলিল হাতিয়ে নিয়েছে। আব্বা তার ভাই জলিলকে খুব বিশ্বাস করতো। পড়াশোনা জানতো না বলে জলিল চাচা তাকে বিভিন্ন কাগজে, বিভিন্ন কৌশলে সাক্ষর করিয়ে নিয়েছে। আব্বার সকল সম্পত্তি আব্বা নিজের অজান্তেই ভাইয়ের নামে লিখে দিয়েছে। এ কথা জানার পর আমি আরো ভেঙে পড়ি। কলেজে পড়ি। মাস গেলে হাজার হাজার টাকা খরচ হয়। সে টাকা এখন পাবো কোথায়? এর মধ্যে আরো বিপদ এলো। আব্বা সম্পত্তি হারানোর শোকে প্যারালাইসড হয়ে গেল। আব্বার চিকিৎসা করতে আমাদের অবশিষ্ট শখের গরু-ছাগল বিক্রি করতে হলো। সুস্থ হবার পর ও আব্বা সুস্থ হয়নি। উন্মাদের মতো ব্যবহার করে, কোথায় যায়, কি করে কেউ জানে না। কাজবাজ করাও বন্ধ করে দিয়েছে তখন থেকেই। আমি দিক হারালাম। মেসের টাকা কিভাবে দিবো, কিভাবে চলবো বুঝতে পারছিলাম না।
মা আমার ভয় দূর করলেন। বললেন,

-” টাকা নিয়ে চিন্তা করো না। এই মাসটা টেনেটুনে চলো। আমি টাকা পাঠাবো সামনের মাসে”।

এরপর থেকে উনি আমাকে ভালো অঙ্কের টাকা পাঠাতেন। কিভাবে পাঠাতেন এ প্রশ্নের উত্তর উনার কাছে ছিল না। মহুয়ার থেকে জেনেছি উনি সেলাইয়ের কাজ করে টাকা উপার্জন করতেন। যেহেতু উনি খুব ভালো সেলাইয়ের কাজ জানতেন এবং গ্রামে উনাকে সবাই চিনতো তাই কাজটায় তিনি সফল হয়েছিলেন। এরপর একটা একটা করে ছাগল, মুরগী কিনে সেসব লালন-পালন করে, বিক্রি করে আমাকে টাকা পাঠাতেন উনি। সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর থেকে আমি টিউশন পড়াই। মা’র কাছ থেকে টাকা এখন তেমন নেই না। বরং দেবার চেষ্টা করি। কিন্তু বিশেষ লাভ হয় না। যেটুকু রোজগার করি তাতে মা বোন কে সুখী জীবনযাপন করাতে পারি না। এইযে এই ঘর-বাড়ি। কিছুই আমার নয়। এর এক অংশ ও আমি পাবো না। আমার কিছুই নেই শেহনাজ। কিচ্ছু না”।

এমির গড়গড় করে সব কিছু বলে দিল সহজ ভাবে। কিন্তু এমিরের বলার ধরণ, কণ্ঠের মলিনতা, চোখ, মুখ, ঠোঁট জানান দিল অতীত বলতে গিয়ে কতটা ভেঙে পরেছে ছেলেটা। শেহনাজের বুকটা মুচড়ে উঠল। অশ্রুতে ভিজে গেল কপোল। কথা গুলো আটকে গেল। খানিক দমে শেহনাজ বলল,
-” আপনি তো আছেন। আমি শুধু আপনাকেই চাই এমির। আমি মানিয়ে নিতে পারবো”।

এমির তাচ্ছিল্যের স্বরে হাসে। বলে,
-” আমাদের বিয়ের একটু পরেই তোমার বাবা ফোন করেছিল। বলেছিল তোমাকে ফিরিয়ে দিতে। তাহলে উনি আমাকে বড় একটা চাকরি পাইয়ে দিবেন”।

শেহনাজ চমকাল। বলল,
-” আব্বু এসব বলেছে”?

-” আমি তোমাকে চাইনি শেহনাজ। কিন্তু তোমার বিনিময়ে অন্যকিছুও চাইনি। তোমার বাবা আমাকে কখনো মানবে না। তিনি সকল সম্পত্তি থেকে তোমাকে বঞ্চিত করবেন। আমি চাই না তুমি তোমার পরিবারের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হও। এটা ভিষণ কষ্টের শেহনাজ। আমি চাই না তুমিও এ কষ্ট অনুভব করো। আমি চাই না তুমি অট্টালিকা ছেড়ে কুঁড়েঘরে এসে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো”।

শেহনাজ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,
-” আমি এখানে ঠিক আছি এমির”।

-” কিন্তু আমি ঠিক নেই। তোমাকে এভাবে দেখতে আমার ভালো লাগে না। আগে তুমি সেজেগুজে থাকতে, দামী জামাকাপড় পড়তে, তোমার চলাফেরায় যে আভিজাত্যের ছোঁয়া ছিল তা এখন আমি দেখি না। আমার খুব কষ্ট হয় শেহনাজ। তোমাকে এভাবে বদলাতে দেখে আমার রুহ কেঁপে ওঠে। নিজের কাছে নিজে প্রতিনিয়ত ছোট হচ্ছি আমি। আমি চাইনি তুমি এভাবে বাঁচ”।

শেহনাজ আচমকা এমিরকে জড়িয়ে ধরে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে। বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় এমিরকে। পিঠের কাছে হাত বুলায় যত্নের সাথে। এমির গলে খানিক। তার মাথা ঠেকে শেহনাজের ঘাড়ে। নেতিয়ে পরে ছেলেটা। চোখ বুজে আসে আপনাআপনি। শান্তি পায় কিছু সময়ের জন্য। বুকের ভার, বোঝা, যন্ত্রণা কমে। শেহনাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। বলে,

-” একদিন আপনার সব হবে। ওই একদিনের জন্য আমরা দুজন মিলে লড়বো”।

_____

বাসস্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শেহনাজ এমির আর মহুয়া। কিছুটা দুরেই ফারজানা দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ পরপরই শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে যাচ্ছেন তিনি। শেহনাজ প্রগাঢ় দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকাল। খেয়াল করল ফারজানার চেহারা খুব মায়াবী। দেখতে ভারী সুন্দর তিনি। সৌন্দর্যের কমতি নেই কোনো। এই বয়সেই মহিলা নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছেন। সন্তান জন্ম না দিয়েও তিনটি সন্তানের জননী হয়েছেন।

শেহনাজ ব্যাগটাকে রাখল বেঞ্চে। হেঁটে এগিয়ে গেল ফারজানার সামনে। বলল,

-” আমরা চলে যাচ্ছি ঠিকই তবে মাঝে মাঝেই এখানে চলে আসবো”।

হাসল ফারজানা। বলল,
-” অবশ্যই আসবে। আমি অপেক্ষা করবো”।

শেহনাজ এমির আর মহুয়াকে দেখল। বাস আসতে এখনো বিশ মিনিট দেরি হবে। এটাই সময় ফারজানার সাথে ব্যক্তিগত কথা বলার।

-” আপনার আর এমিরের বাবার বিয়ের সাত বছর পার হয়ে গেছে। আপনি এখনও কোনো সন্তান নেননি। এর কারণ কি জানতে পারি”?

ফারজানা নিশ্চুপ হয়ে গেল। কি বলবে তা ভাবল, কথা গোছাল। তা দেখে গভীর ভাবে হাসল শেহনাজ। বলল,
-“আচ্ছা আমি বলি? এমির আর মহুয়ার প্রতি ভালোবাসা কমে যাবে এই ভয়েই এতদিনেও আপনি কোনো সন্তান জন্ম দেননি। তাইতো”?

ফারজানা কোনো কথা বলল না। শেহনাজ বলে উঠল,
– আপনি এমিরকে গর্ভে ধারণ করেননি। কিন্তু এমিরের জন্য আপনি যা যা করেছেন তা অন্য কেউ হলে কখনো করতো না। এমির আপনাকে খুব ভালোবাসে। হয়তো প্রকাশ করে না কিন্তু আপনার প্রতি ওর সম্মান আকাশ ছোঁয়া”।

ফারজানা কথা বলতে পারল না। জড়তা চেপে ধরল তাকে। অশ্রুগুলো গড়ানোর প্রয়াস চালাল। বাস এলো। এমির আর শেহনাজ উঠতে লাগল বাসে। শেহনাজ সেসময় পিছু তাকিয়ে বলল,
-” আমি কি আপনাকে মা বলে ডাকতে পারি”?

হেসে ফেলল ফারজানা। খুশি হলো খুব। উপর নিচে মাথা নাড়ল। শেহনাজ জড়িয়ে ধরল তাকে। ভিষণ ভালোবাসার কণ্ঠে বলে উঠল,
-” মা, আপনি অনন্য। আপনাকে আমি খুব মিস করবো”।

বিদায় জানিয়ে ওরা বাসে উঠল। শেহনাজ বাসের জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো ওদের।
শেহনাজ এমির পাশাপাশি বসে। শেহনাজ নীরবে কেঁদে যাচ্ছে। এখানে থেকে শেহনাজ এখানকার মানুষগুলোকে চিনেছে, গ্রামের অনেক কিছুই সে বুঝেছে। সবচেয়ে বড় কথা ফারজানা আর মহুয়ার সাথে অনেক সুন্দর সুন্দর মেমোরি আছে শেহনাজের। আজ এখান থেকে চলে যেতে শেহনাজের ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। মানুষগুলোকে ছেড়ে যেতে মন চাইছে না ওর। এত আপ্যায়ন, মমতা সে আর কোথায় পাবে? এত ভালো শাশুড়ি আর কি কেউ হতে পারবে? গ্রামের এই সর্ষে খেত, আম গাছ, স্বচ্ছ নদীর পানি, পাড়ার বাচ্চারা, সুদীর্ঘ মাঠ এসব যেন শেহনাজকে থেকে যেতে বলছে। মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে।
শেহনাজ অঝোরে কাঁদতে থাকল। স্মৃতি গুলো ভেসে উঠল চোখের পাতায়। ফিরে যেতে ইচ্ছে করল। সবার এত এত ভালোবাসা আজীবন পেতে ইচ্ছে হলো ওর।

এমির সবটা পর্যবেক্ষণ করল। এখান থেকে চলে যেতে তার ও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। ঢাকায় যেতেই হবে।

এমির বলল,

-” এত কান্নাকাটি করার কি আছে? ঢাকাতেই তো যাচ্ছি। মহাকাশে যাচ্ছি না আমরা”।

শেহনাজ রাগ দেখাল। চোখের পানি মুছে বলল,
-” ওদের ছেড়ে যেতে আপনার কষ্ট হচ্ছে না”?

এমির স্পষ্ট, কাঠ কাঠ কণ্ঠে উত্তর দিল,
-” না”।
-” আমার খুব কষ্ট হচ্ছে”।
-” নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করো নাজ”।

ভেংচি কাটল শেহনাজ। তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠল,
-” মনকে যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম তাহলে আপনার মতো রসকষহীন, নিষ্ঠুর পুরুষকে বিয়ে করতাম না”।

এমির নিজেও রেগে গেল। বলল,
-” আমি কি তোমার পায়ে ধরে বলেছিলাম আমাকে বিয়ে করতে”?

দমে গেল শেহনাজ। হতাশ কণ্ঠে বলল,
-” তখন আমার আবেগে কাজ করছে, বিবেক কাজ করে নাই”।

-” এখন তো বিবেক কাজ করছে। চলে যাও এখন”।

শেহনাজ নাক ফুলাল। চুলগুলোকে ঠিক করতে করতে বলল,
-” বারেহ্, আমি চলে গেলে আপনি ডিভোর্সি পুরুষ হয়ে যাবেন। একটা কলঙ্ক লেগে যাবে গায়ে। কোনো যুবতী মেয়ে আপনাকে বিয়ে করতে চাইবে না। এত কিছু জেনেও আমি কি এত নির্দয় হতে পারি”?

চলবে?

নোটঃ রিচ/রিয়্যাক্ট দেখে আমি হতাশ। গল্পটা বেশি পর্বের হবে না। আর কয়েকটি পর্ব, এরপর এটার সমাপ্তি ঘটবে। যারা পাশে ছিলেন তাদের ভালোবাসা।❤