#শেহনাজ _____{১৩}
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
নির্ভেজাল প্রভাত। এমির শাক বেছে রাখছে ঝুড়িতে। অনাবৃত তার গা। রোমশপূর্ণ উদাম গা শেহনাজকে বারবার লজ্জায় ফেলছে। শেহনাজ ভেবে পায় না এমিরের মতো একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে তার চোখে অসাধারণ হিসেবে ধরা দেয়? এমিরের ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্যে শেহনাজ প্রতিনিয়ত মজে যায়। বারংবার প্রেমে পরে যায় এমিরের। এ প্রেম এতটাই দৃঢ়, এতটাই গাঢ় যে এত এত খারাপ পরিস্থিতি তাদের আলাদা করতে পারেনি।
রান্নাবান্না শেষে এমির ডাকল শেহনাজকে। দুজন মেঝেতে বসে খাবার খেতে লাগল এক সাথে। এমির ঘুমে ঢুলছে। একটু পর তার ইন্টারভিউ। এখন এভাবে ঢুলছে কেন বুঝতে পারে না শেহনাজ। প্রশ্ন করে,
-” আপনি রাতে ঘুমোননি”?
এমির হাই তোলে। ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বলে,
-” কারেন্ট এসেছে ভোরে। ঘুম কি আর হয়”?
চোখ ছোট ছোট করে ফেলে শেহনাজ। ললাটে ভাঁজ প্রতীয়মান হয়। বলে,
-” কারেন্ট না এলে আমি ঘুমোলাম কি করে? আমি তো আরামে ঘুমোলাম”।
এমির নিজের অনুভূতি, যত্ন গুলোকে লুকোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করল। বলল,
-” এত গরমেও তুমি ঘুমোচ্ছিলে। ঘুম পেলে আর কিছু মনে থাকে তোমার”?
সন্দেহী চোখে তাকাল শেহনাজ,
-” কাল রাতে আপনি হাত পাখা ঘুরিয়েছেন”?
-” আমার অত দায় নেই। যে তোমাকে হাওয়া করবো”।
-” ভুলে যাচ্ছেন আমি আপনার একমাত্র বউ”।
-” সরি, আমি তোমাকে বিয়ে করিনি। তুমি আমাকে বিয়ে করেছো, জোর করে”।
ক্ষেপে গেল শেহনাজ। বলল,
-” করলেন কেন আপনি বিয়ে? আমি মারা গেলে আপনার তো কোনো যায় আসতো না”।
-” পাগল হয়েছো? এই বয়সে আবার জেলের ভাত খাবো? নো ওয়ে”।
আশ্চর্যিত হয়ে তাকাল শেহনাজ। লোকটা কত বদ। শুধুমাত্র কেস-কাসারির ভয়ে বিয়েতে রাজি হয়েছে? একটুও শেহনাজের প্রতি মায়া হয়নি সেদিন”?
শেহনাজ খাবার রেখে উঠে পরল। ফ্যাকাশে হলো ওর মুখ। কলেজ ইউনিফর্ম নেই, ব্যাগ কিংবা বই পত্র ও নেই। কিভাবে কলেজে যাবে ভেবে পায় না শেহনাজ। ভালো সুতির থ্রিপিস গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে যায় কলেজে। এমির ও তৈরী হয়ে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যায়। মনে মনে খুব করে চায় এবার চাকরিটা হোক। শেহনাজের সাথে তার ছোট্ট সংসার হোক।
_______
অনেকদিন পর কলেজে এলো শেহনাজ। নিজেকে আজ বড্ড স্বাধীন মনে হচ্ছে ওর। এই প্রথম শেহনাজ প্রত্যেকটা ক্লাস খুব মনোযোগ দিয়ে করল। টিফিন পিরিয়ডে তানিয়ার সাথে বসল ক্যাফেতে। শেহনাজকে দেখে তানিয়া খুব খুশি। অবশেষে মেয়েটা তার ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়েছে। এর চেয়ে সুখের আর কি হতে পারে?
তানিয়া দুটো পেস্ট্রি অর্ডার করল। সাথে দুটো ড্রিংকো। শেহনাজ বিব্রত হলো। হাতে যে একদম টাকা নেই। যা আছে তা তো গাড়ি ভাড়ায় লাগবে।
তানিয়াকে আটকাল শেহনাজ। ততক্ষণাৎ বলল,
-” আমার একদম খিদে নেই রে। আসার সময় এমির অনেক গুলো ফল খাইয়েছে। নিজের হাতে রান্না করা মজাদার খাবার খাইয়েছে। এখন একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না”।
তানিয়া শেহনাজের অঙ্গভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল। শেহনাজের গাল দুটো টেনে দিল। বলল,
-” সংসার তাহলে খুব আনন্দ নিয়ে করছিস বল? যে এমির ভাই কখনো কোনো মেয়ের দিকে তাকাতো না, তোর মতো প্রেসিয়াস মেয়েকেও পাত্তা দিতো না। সেই এমির ভাই বিয়ে করে এতটা সংসারী হয়ে উঠল? তোর জন্য এত মরিয়া হয়ে উঠল? বাহ্, তুই একটা জিনিয়াস নাজু। এমির ভাইয়ের কঠিন হৃদয় ও গলিয়ে ফেললি”?
শেহনাজের চোখে মুখে উচ্ছলতা। প্রিয় মানুষটাকে আপন করে পেয়ে গর্বে, আনন্দে ভরে উঠছে বুক। গাড় হেসে সে বলে,
-‘ ভালোবাসা দিয়ে সব কিছু জয় করা যায় রে। এমির, যাকে আমি মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি, সেও আমাকে ভালোবাসে। এর চেয়ে বেশি আমার আর কিছু চাওয়ার নেই তানু”।
পেস্ট্রি আর ড্রিংকো চলে এলো। শেহনাজ খেতে চাইল না। তানিয়া জোর করে খাওয়াল ওকে। বিল পে করল তানিয়াই। অবশেষে শেহনাজ একটু নিশ্চল হলো। বলল,
-” সাবিহা আপুর হাসব্যান্ড মানে তোর চাচ্চু এখন কোথায়”?
-” চাচ্চু তো চট্টগ্রামে থাকে”।
পুনরায় তানিয়া বলল,
-” আমার চাচি আসলেই এমির ভাইয়ার বোন”?
মাথা নাড়ল শেহনাজ। আশপাশে চোখ বুলাল। সতর্কতার সাথে বলল,
-” এমিরের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন বলে সাবিহা আপু বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল। এরপর আপুকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমির আপুকে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে”।
-” ওইদিন আমি চাচ্চুকে ফোন করেছিলাম। চাচ্চু বলল চাচি মানে সাবিহা আপু তার দোকানে সেলস গার্ল হয়ে কাজ করতো। চাচ্চুর আপুকে ওইসময় ভালো লেগে গিয়েছিল। তাই বছর না যেতেই চাচিকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছিল। কিন্তু আমায় বল এমির ভাইয়া বিজ্ঞাপন দিলে আমরা দেখলাম না কেন”?
শেহনাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
-” আরো ছ বছর আগে এমির যখন প্রথম শহরে এসেছিল তখন বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। তখন তুই আর আমি ছোট, ফোন হাতে থাকলেও ওই সব নিউজ আমরা থোরাই না দেখেছি। তোর চাচ্চু থাকতো চট্টগ্রামে। বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল ঢাকার অলিগলিতে। পাওয়া কি সম্ভব”?
-” এমির ভাইকে বলেছিস চাচির মৃত্যুর কথা”?
-” উঁহু বলিনি। বলবোও না। এমির এই ট্রমা নিতে পারবে না রে। সবে আমরা সংসার শুরু করেছি। জীবনের ছোট ছোট মুহুর্ত গুলো উপভোগ করছি। এসময় এমন একটা নিউজ পেলে এমির সইতে পারবে না”।
_____
ছুটি হতেই শেহনাজ বের বলো কলেজ থেকে। হাতে কয়েকটা বই আর খাতা। তানিয়ার থেকে এসব কালেক্ট করেছে হরেক রকম মিথ্যা কথা বলে। নিজের জীবনের ঝামেলা , দাম্পত্য কলহ নিয়ে কারো সাথে কথা বলতে চায় না শেহনাজ। নিজের জীবনের দুঃখ সে কেবল নিজের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। এতদিনে সে বুঝেছে, উপদেশ কিংবা জ্ঞান দিতে মানুষের অভাব হয় না। বিপদে সঙ্গী হতেই সবার আপত্তি”। পৃথিবী জ্ঞান দেয়, সঙ্গ দেয় না”।
রাস্তার ওপাড়ে তাকিয়ে শেহনাজ ভিষণ চমকে উঠল। মুখের হাসি প্রসারিত হলো। উজ্জ্বল হলো শেহনাজের চোখ। এমির দাঁড়িয়ে কলেজের সামনে। গায়ে শুভ্র শার্ট আর কালো প্যান্ট। গলায় টাই ঝোলানো। হাতে ফাইল। পেটানো, সুঠাম শরীরে শার্টটা লেপ্টে আছে নিদারুণ ভঙ্গিতে। বাহুদ্বয় আরো ফুলেছে মনে হচ্ছে। শেহনাজকে দেখেই হাও নাড়ল এমির। শেহনাজ খুশিতে আত্মহারা। দ্রুত এগিয়ে আসল এমিরের নিকট। উত্তেজিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,
-” আপনি এখানে কি করছেন”?
এমির শেহনাজকে পরখ করল। শেহনাজ সুন্দর, মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর। যেকোনো পুরুষ শেহনাজের মতো সুন্দরী রমণীকে আপন করতে চাইবে। শেহনাজের চঞ্চলতা, বিচক্ষণতা কিংবা অঙ্গভঙ্গি সবেতে যেন মায়া। এমিরের মাঝে মাঝে নিজেকে অত্যাধিক সৌভাগ্যবান মনে হয়। শেহনাজের মতত যত্নশীল, পাগলি একটা মেয়ে তাকে এতটা কি করে ভালোবাসে? এত কি করে চায়? কিছুই তো নেই তার। তবুও মেয়েটা হাসি মুখে সবকিছু মানিয়ে নিচ্ছে। বুঝতেই দিচ্ছে না এমিরের অপারগতা, আক্ষেপ।
শেহনাজের কপালের চুল গুলো সরিয়ে দিল এমির। বলল,
-” এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম তোমাকে নিয়ে যাই”।
শেহনাজ এমিরের কাঁধ চাপড়াল বলল,
-” সৃষ্টিকর্তা আপনাকে সুবুদ্ধি দিচ্ছে।। স্ত্রীকে কিভাবে প্যাম্পার করতে হয় শিখে যাচ্ছেন”।
এমির ঠোঁট বাকাল বলল,
-” আমার সুবুদ্ধি আছে। তোমার নেই”।
এমিরের পাশাপাশি হাটল শেহনাজ। রাস্তার পাশের দোকান থেকে শেহনাজকে চকবার আইসক্রিম কিনে দিল এমির। শেহনাজ যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। তার সবচেয়ে প্রিয় খাবারটি পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল শেহনাজ। এমিরের মুড আজ ভালো? জানতে ইচ্ছে হলো ওর।
-” আপনার মুড আজকে ভালো”?
এমির অমায়িক হাসল। বলল,
-” এ কথা কেন মনে হলো তোমার নাজ”?
-” আজ আপনি আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসছেন, হু হু”।
এমির জবাব দিল না তখনই। কিছুদূর হেঁটে যেতেই বলল,
-” আজ ব্যাংকে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। বড় ব্যাংক। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখেছিলাম নিউজপেপারে”।
শেহনাজ আইসক্রিমে কামড় বসাল। মুখে শীতল বরফের টুকরো নিয়েই বলল,
-” তারপর? ইন্টারভিউ কেমন আছেন হয়েছে”?
এমির শেহনাজের দিকে গভীর ভাবে তাকাল। চেয়েই রইল। শেহনাজ ভড়কাল খানিক। এমিরের এমঁ সম্মোহনী দৃষ্টি সহ্য হলো না ওর। লাজুক হাসল সে। এমিরের চোখে নিজেও চোখ বসাল। দুজন মানব মানবী একে অপরের দিকে কতটা ভালোবাসার নজরে দেখল তা প্রকৃতিও বোধহয় অনুধাবন করতে পারল। এমির সেসময় নিচু স্বরে বলল,
-” ক্যাশিয়ারের পদে চাকরি পেয়েছি শেহনাজ। আমি আর বেকার নই। তোমার স্বামী একটা বড় ব্যাংকের ক্যাশিয়ার”।
শেহনাজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মুখে কোনো ভাষা নেই। হাতে থাকা আইসক্রিম টা পরে গেল রাস্তায়। পাশ দিয়ে দ্রুত গতিতে বাইক চলল। এমির শেহনাজকে একটু টেনে নিজের কাছে আনল। শেহনাজ কখনো বাকরুদ্ধ। ঠোঁট কাঁপছে ওর। কান্না পাচ্ছে বাজে ভাবে। নিজেকে সংযত করল শেহনাজ। কণ্ঠ আটকে এলো ওর। থেমে থেমে বলল,
-” স..সত্যি, বল…ছেন”?
স্নিগ্ধ হেসে উপর নিচ মাথা নাড়াল এমির। এ হাসি শেহনাজের বুকে বিধল। দু চোখ বেয়ে নোনাজল গড়াল। এমির বুঝতে পারল শেহনাজকে। শেহনাজের কানের নিচে তিন আঙ্গুল রেখে মুখটা উঁচু করে ধরল। বলল,
-” কাঁদতে নেই। সব বিষয়ে এমন কাঁদতে আছে? বোকা, বাড়িতে চলো। সবাই দেখছে আমাদের”।
______
এমিররা যে বাড়িতে উঠেছে তা তিন ভবন বিশিষ্ট। প্রথম দুই ভবনে থাকে ভাড়াটিয়া। উপরের তলায় থাকেন বাড়িওয়ালা। বাড়িটির রং ক্যাটক্যাটে সবুজ। রঙ খসে পরেছে। শ্যাওলা জমেছে। শেহনাজদের ঘর একটাই। ঘরের সাথে এটাচড বাথরুম আর কিচেন। সাথে রয়েছে বড়সড় বেলকনি। পুরো রুম ধরতে গেলে ফাঁকা। এমির ভেবেছে প্রথম স্যালারি পেয়েই ঘরের আসবাবপত্র টুকটাক কিনে ফেলবে।
এমিরের আজ কাজে যাওয়ার প্রথম দিন। আজ সে ভোরের দিকে উঠেছে। এমিরের দেখাদেখি শেহনাজ ও উঠে পরেছে। এমিরের যদি সাহায্যের প্রয়োজন হয় এই ভেবে। এমির প্রথমে চা বসাল। এক কাপ চা বানিয়ে শেহনাজের দিকে বাড়িয়ে দিল। শেহনাজের হুট করে একটা কাহিনী মনে পরে গেল। একবার এমিরের জন্য চা বানাতে গিয়েছিল রান্নাঘরে। কাজল খালা সে কি বকা। একদমই চা টা বানাতে দিতে চাইছিল না। এমিরের জন্য সে জোর করেই চা বানিয়েছিল।
এরপর এমির রুটি বানাল গোল গোল করে। শেহনাজ পাশেই টুল পেতে বসে বসে দেখল। এমির রুটি বানিয়ে সেগুলো চুলোয় সেকল। দুটো ডিম ভাঁজল। রান্নাবান্না শেষে একসাথে খেয়ে উঠল ওরা। এমির তৈরী হলো চাকরির উদ্দেশ্যে। শেহনাজ টুকটাক জিনিস এগিয়ে দিল। যাবার সময় বারবার বলল,
-” গিয়ে কল করবেন, সময় পেলেই টেক্সট করবেন। আমি চিন্তায় থাকবো”।
এমির হাসে। মেয়েটা তার প্রতি এত উতলা, এত ভালোবাসে তাকে। মাঝে মাঝে এমির ভুলে যায় নিজেকে, নিজের অস্তিত্বকে। ইচ্ছে হয় নিজেকে শেহনাজের নিকট আত্মসমর্পণ করে দিতে আর বলতে ” আমি কেবল তোমার শেহনাজ। এক পৃথিবী সুখ পেলেও আমি তোমাকে ছাড়বো না”।
এমির বেরিয়ে এলে শেহনাজ বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। যতক্ষণ এমিরকে দেখা যায় ততক্ষণই এমিরকে দেখে সে। মনে মনে দোয়া করে যেন সব ঠিক থাকে। তার স্বামী যেন যথা সময়ে সুস্থ, ও সুন্দর ভাবে বাড়ি ফেরে।
এমির শেহনাজের মায়ায় পরেছে খানিক। কাজ করতে গিয়েও বারবার শেহনাজের কথা মাথায় ঘুরছে ওর। স্বাভাবিক চিন্তা যেমন শেহনাজ কি করছে? কি খাচ্ছে? কোনো দুর্ঘটনা ঘটায়নি তো? ফ্রি হয়েই এমির কল করল শেহনাজকে। শেহনাজ তখন ওয়াশরুমে। এমিরের সব শার্ট প্যান্ট ধুয়ে দিচ্ছে সে। এমিরের কল আসায় হন্তদন্ত হয়ে জামায় হাত মুছে তড়িঘড়ি করে কল ধরে।
-” কি করছো নাজ। কল ধরতে লেইট হলো কেন, আর ইউ বিজি”?
শেহনাজ হতবাক। এমির তাকে বারবার বিস্মিত করছে। তার খোঁজ খবর নিচ্ছে এত চাপের মাঝেও। এমন সারপ্রাইজ-ই তো শেহনাজ সবসময় চাইতো। হাসি মুখে বলে,
-” আমি তো বাথরুমে ছিলাম। জামাকাপড় ওয়াশ করছিলাম”। আপনি কি করছেন”?
-” ফ্রি হলাম মাত্র। খেতে বসেছি। তুমি খেয়েছো”?
-” হুহ্ খেয়েছি”।
-” রান্নাঘরে যেও না একদম। আজকের মতো রুটি খেয়ে নাও। আজ তাড়াতাড়ি ফিরবো। এসে রান্না করবো আমি। তুমি ভুলেও রান্নাঘরে যাবে না”।
-” আচ্ছা ঠিক আছে”।
-” হাতে মেডিসিন নিয়েছো”?
-” নিয়েছি”।
-” ভিজে আছো? দ্রুত গোসল করে নিও। নইলে ঠান্ডা লেগে যাবে। আর দরজা আটকে রেখো। কেউ বেল বাজালেই তড়িঘড়ি করে খুলবে না। জিজ্ঞেস করবে আগে। আমি হলে ডাকবো। আওয়াজ না পেলে দরজা খুলবে না”।
শেহনাজ মিটিমিটি হাসল। বলল,
-” আমাকে খুব মিস করছেন স্বামী”?
-” মিস করার কি আছে? সবসময় তো চোখের সামনেই থাকো”।
-” এখন তো নেই”।
-” রাখো, কাজ আছে। ভালো মানুষের মতো পড়তে বসবে”।
________
এমিরের রেজাল্ট শুনে কলেজ এবং ভার্সিটির টিচার গর্বিত। এমিরকে সম্মাননা দিতে ব্যাকুল তারা। জেলার মধ্যে এমির ফার্স্ট হয়েছে। রেজাল্ট অনেক ভালো। কলেজের সুনাম তরতর করে বেড়েছে। পত্রিকায় এমিরের ছবি ছাপা হয়েছে ইতিমধ্যে। বিভিন্ন টেলিভিশনের শিরোনামে রয়েছে এমির সাখাওয়াতের নাম। এমিরের সেসবে চিন্তা নেই। সে সংসার গোছাতে ব্যস্ত। সংসারের টানাপোড়েনে শরীর জ্বলে তার। কি খাবে, কি পড়বে ভেবে ভেবে রাতে ঘুম আসে না আজকাল। শেহনাজের স্যাক্রিফাইজ গুলো খুব পোড়ায় ওকে।
এমিরকে কল করে জানানো হলো সম্মাননার কথা। এমির তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। সে জানে শেহনাজ এ খবর পেলে খুশিতে লুটিয়ে পরবে। নতুন চাকরি। সবে একদিন আজ। ছুটি কি দিবে? দেওয়া তো উচিত ও নয়।
এমির ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ করল। অমায়িক মানুষ তিনি। প্রাণবন্ত। বয়স কিছুটা কমই। এমিরের ছবি পত্রিকায় দেখেছেন তিনি। গতকাল এমিরকে ইন্টারভিউ দিতে আসতে দেখেই তিনি ভেবে রেখেছিলেন এমিরকে ক্যাশিয়ার হিসেবে নিযুক্ত করবেন। এমির এলেই কিছু টুকটাক প্রশ্ন করে তিনি এমিরকে চাকরির অফারটা করেন। আজ ছুটি চাওয়ায় তিনি বাঁধা দিলেন না। এমির ছুটির কারণ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ব্যাখ্যা করল। অতঃপর ছুটি পেয়েও গেল।
রাত আটটার দিকে বাড়িতে ফিরল এমির। শেহনাজ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে এমিরের অপেক্ষায়। এমির বাড়ির সদর দরজায় ঢুকতেই শেহনাজ দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইল। এমিরকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে শরবত নিয়ে এলো। এমিরের প্রয়োজনীয় শার্ট আর লুঙ্গি বের করে রাখল। এমির ফ্রেশ হয়ে শরবত খেয়ে খানিক বিশ্রাম নিল। শেহনাজকে জানাল খবরটা।
-” আগামীকাল ছুটি নিয়েছি। বাড়িতেই থাকবো”।
শেহনাজ ধপ করে এমিরের পাশে বসল। বলল,
-“কেন? ছুটির কি প্রয়োজন?
-” কাল কলেজে যেতে হবে। কলেজের প্রিন্সিপাল ডেকেছেন”।
-” কারণ বলেছে”?
-” বলল আমার জন্য নাকি কিছু আয়োজন করবে। সম্মাননা দিবে মনে হচ্ছে”।
শেহনাজ খুব খুশি হলো। বলল,
-” ইশশ, কাল আপনাকে স্টেজে ডেকে পুরষ্কার দেওয়া হবে? সেজন্যই তো বলি মাঠে প্যান্ডেল সাজানো কেন”?
এমির চিরুনি দিয়ে মাথা আচড়াল। শেহনাজকে ডাকল কাছে। বলল,
-” চুলের এ অবস্থা কেন”?
শেহনাজ ঠোঁট উল্টাল। বলল,
-” শ্যাম্পু নিচ্ছি না অনেকদিন। চুল একদম শেষ”।
-” কাল সকালে আমাকে ডেকে দিও। আর কি কি লাগবে লিস্ট দিও”।
-” আপনি টাকা পাবেন কোথায়? এখন আমার ওসব লাগবে না। পরের মাসে বেতন পেয়ে কিনে দিলেই হবে”।
এমির ইশারায় শেহনাজকে বসতে বলল সামনে। শেহনাজ বসল। তার পিঠ ঠেকল এমিরের বুকে। এমির সযত্নে প্রিয়তমার চুল আছড়ে দিল। বিনুনি করে দিল অদক্ষ হাতে। বলল,
-” টাকা নিয়ে তুমি এত ভাবো কেন? ব্যবস্থা করে নিবো”।
-” ব্যবস্থা করবেন ঠিক আছে, কিন্তু কারো কাছে ধার করবেন না যেন”।
এমির নম্র হাসল। অতি আবেগে শেহনাজের মাথায় চুমু খেল। শব্দ হলো না কোনো। শেহনাজ টের ও পেল না সে শুষ্ক ঠোঁটের ভালোবাসার স্পর্শ।
চলবে?