#শেহনাজ ______{১৬}
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
একসাথে বাবা-মায়ের সাথে খাওয়াদাওয়া সেরে শেহনাজ নিজের ঘরে ঢুকল। মুহুর্তেই উজ্জ্বল হলো শেহনাজের চোখ। সেই ঘর,সেই বিছানা। শেহনাজের গায়ের ঘ্রাণ, পারফিউমের ঘ্রাণ এখনো ভাসছে। ঘরের সব জিনিস গোছানো। বিছানার পুতুল গুলো যেন শেহনাজকে খুঁজছে। শেহনাজের হাস্যজ্জ্বল ছবিটি এখনো দেয়ালে লেগে আছে। শেহনাজ নিজ বিছানায় বসল। এতদিন পর মা-বাবার অভিমান দুর করতে পেরে বুক থেকে বোঝা নেমে গেল ওর। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হলো। ঘরের সব জিনিসপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল শেহনাজ। পরক্ষণে মনে পরল ওই খুনীর কথা। শেহনাজ তার স্টাডি রুমে ঢুকল। টেবিলে তার দামী ল্যাপটপটা অক্ষত অবস্থায় দেখতে পেয়ে আশা ফিরে পেল সে। ল্যাপটপ অন করল শেহনাজ। খুনী লোকটার ছবি ল্যাপটপের গুগল বক্সে সার্চ করল। লোকটাকে দেখে শেহনাজের মনে হয়েছে লোকটা দাগী আসামি। হতে পারে লোকটার নামে অনেক কেস আর ঘটনা রয়েছে। তাই ল্যাপটপের সব স্থানে শেহনাজ লোকটার ছবি দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে লোকটির আইডি পাওয়া গেল। একটি রাজনীতিবীদ এর ছবির সাথে খুনী লোকটার ছবি মিলে গিয়েছে। হুবহু একরকম। শেহনাজ বুঝল এই রাজনীতিবিদই খুনী আর নারী পাচারকারী।
শেহনাজ লোকটার ইনফর্মেশনে ক্লিক করল। এরপর কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য শেহনাজের সম্মুখে এলো। তব্দা খেল শেহনাজ। তার কি কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে?
লোকটির নাম বাহাদুর খান। চলাফেরা, আচার-আচরণ বাহাদুরের মতোই। ঢাকা শহরের বড় নেতা। গ্রামের বাড়ি জামালপুর। পড়াশোনা করেছে জামালপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজনীতিতে এসেছেন অনেকদিন আগে। পাঁচ বছর আগে ভোটে বিজয়ী হয়ে শহরের নেতা হয়েছে বাহাদুর খান। ঢাকায় বাড়ি আছে। জামালপুর তার গ্রামের বাড়ি।
শেহনাজ কিছু ভিডিও পেল লোকটার। তাতে ক্লিক করল। ভিডিও গুলো পজেটিভ। কখনো লোকটি ক্ষুধার্তকে খাবার দিচ্ছে, কখনো বস্ত্রহীনদের বস্ত্র দিচ্ছে, কখনো বা হসপিটালে চিকিৎসারত লোকদের আর্থিক সহায়তা এবং বিভিন্ন ধরণের সহায়তা দিচ্ছে। মানুষগুলো বাহাদুর খানের জয়জয়কার করছে। প্রাণ ভরে দোয়া দিচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশ নিয়ে বাহাদুর খান দেশের মানুষদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এলাকার মানুষদের বিপদে এগিয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় লোকটির ফ্যান ফলোয়ার লাখ লাখ। মানুষের কাছে বাহাদুর নামটি বড় সম্মানের। অন্য একটি ভিডিওতে দেখা গেল বাহাদুরকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। জনগন ক্ষেপে গেছে এজন্য। থানার সামনে অনশনে বসেছে হাজার দুয়েক মানুষ। অজস্র তেজ, রাগ তাদের অভিব্যক্তিতে। বাহাদুর কে ফিরিয়ে আনার সব রকম চেষ্টাই করছে জনগন। তাদের এহেন অন্ধ ভক্তি শেহনাজকে বাকরুদ্ধ করল। মানুষটাকে সবাই এত ভালোবাসে? এরপরের ভিডিওতে বাহাদুরের জামিনের দৃশ্য দেখা গেল। অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণিত হলো। স্বসম্মানে সে গাড়িতে উঠল। জনগনের উপচে পড়া খুশি।
শেহনাজের সবটা এলোমেলো লাগছে। সে রাজনীতি সম্পর্কে কিছুই জানে না। কে কখন ভোটে জয়ী হচ্ছে সে খবর ও রাখে না। তার জীবন চলে ফ্যান্টাসিতে, রিলস দেখে। আর বিগত কয়েকদিন ধরে সংসার, পড়াশোনা সামলে খবর দেখার ইচ্ছে হয়নি তার। নিজের সংসার নিয়েই সে ব্যস্ত ভিষণ। এসব দেখা বা জানার সময় কোথায়? কখনো সে চায়ের স্টলে যায়নি, ভিড় বাট্টায় যায়নি। রাজনৈতিক দল, কার্যকলাপ সম্পর্কে কেউ কখনো বলেনি তাকে। সেও আগ্রহ দেখায়নি এসবে। বাহাদুর খান যদি এতই ভালো হবে তাহলে এসব করছে কেন? মেয়েদের আটকে রাখছে কেন? কি চায় লোকটা? কেন করছে এসব?
শেহনাজ বেশ কিছুক্ষণ বাহাদুর খানের তথ্য গুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করল। সব খানেই তার সুনাম। কোথাও ব্যাড রিভিউ নেই। এমন একটা মানুষ কি করে এত বড় অপকর্ম করে? দ্বন্দ্বে ভুগল শেহনাজ। জনগন ভুল? নাকি সে ভুল? ঠিক আসলে কে? কিভাবে মেয়েগুলোকে উদ্ধার করবে? কার সাহায্য নিবে? তার কথা আদৌ কেউ বিশ্বাস করবে পুলিশ বা জনগন?
শেহনাজের ডাক পরল। টেবিল থেকে উঠল সে। ফোন আর ল্যাপটপ ঠিকঠাক করে রেখে শেহনাজ তার আব্বুর ঘরে গেল। সাইফুল আলম বালিশে হেলান দিয়ে বসে। শেহনাজকে দেখে কাছে ডাকলেন। বললেন,
-” বসো নাজ”।
শেহনাজ বসল বাবার পায়ের কাছে। বলল,
-” কিছু বলবে আব্বু”?
-” তুমি বাড়ি থেকে চলে যাবার পর আমি এমিরকে কল করেছিলাম। বলেছিলাম তোমাকে যেন ও ফিরিয়ে দেয়। বিনিময়ে অনেক টাকা আর ভালো একটা চাকরি দেবার অফার করেছিলাম। ছেলেটা রাজি হয়নি”।
হাসল শেহনাজ। গর্বিত হলো সে। সাইফুল আলম পুনরায় বললেন,
-” তোমাদের বিয়ের এক মাসের মাথায় এমির এ বাড়িতে এসেছিল। তোমাকে কি এ কথা বলেছে? বললে আর বলবো না”।
শেহনাজ দু পাশে ঘাড় নাড়ল। বলল,
-” আমাকে কিছু জানায়নি তো”।
-” এমির আমাকে এসে অনুরোধ করেছিল আমি যেন তোমাকে ক্ষমা করে দিই। তোমাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি। সে তোমাকে কিছুতেই তার থেকে সরাতে পারছে না। এ বিয়েটা যে একটা দুর্ঘটনা সেসব কথা আমাকে বলেছিল”।
অবাক হলো শেহনাজ। এমির এসব তাকে জানায়নি। এসবের কিছুই সে জানে না।
-” এমির নাকি তোমাকে ভালোবাসে না। তুমি ওকে বাধ্য করেছো সম্পর্ক বয়ে বেড়াতে। ও তোমাকে চায় না। তাই আমাকেই কিছু করতে বলেছিল। আরো বলেছিল তোমাকে যেন ফিরিয়ে এনে মানসিক চাপ যেন না দেই”।
শেহনাজ ভড়কাল। বলল,
-” তখন ও আমাকে ভালো না বাসলেও এখন খুব ভালোবাসে আব্বু। এখন আমরা খুব হ্যাপি আছি। ও চাইতো না আমি আমার এই বিলাসবহুল, আভিজাত্যপূর্ণ জীবন যাপন ছেড়ে ওর মতো বেকার, দরিদ্র ছেলের হাত ধরি। ও ভেবেছিল এসব আমার আবেগ। যেমনটা তুমি ভেবেছিলে, আবেগ কেটে গেলে আমি ঠিক নিজের ভুল বুঝতে পারবো”।
-” আর কিছু বলতে হবে না। সব আমি জানি। কিন্তু অভিমান ভুলে আমি আর আগাতে পারিনি। ইগোর জন্য তোমাদের বাড়িতে যেতে পারিনি। যাক গে এমির আমাকে একটা দলিল দিয়েছিল জানো”?
-” কিসের দলিল আব্বু”?
-” তুমি দেখবে”?
-” অবশ্যই”।
আলমিরা খুলে সাইফুল আলম একটি কাগজ বের করলেন। শেহনাজের হাতে দিলেন কাগজটা। এটা একটা দলিল। এমিরের সাক্ষর তাতে। শেহনাজ দলিলের লেখাগুলো পরল। লেখাগুলো কিছুটা এরকম,
আমি এমির সাখাওয়াত স্বইচ্ছায়, স্বজ্ঞানে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আমার স্ত্রী শেহনাজ আলমের বাড়ি, গাড়ি, অর্থ, বিষয়সম্পত্তি কিংবা ব্যবসায়ের কোনোকিছু আমি ভোগ করবো না, কখনো এর মালিকানা পাওয়ার চেষ্টা করবো না। আমার স্ত্রীর বিষয়সম্পত্তি কখনো ভাগ বাঁটোয়ারা হবে না। তার সম্পত্তি তারই থাকবে। শেহনাজ আলমের সম্পত্তিতে আমার কোনো অধিকার থাকবে না। এ বিষয়ে আমার কোনো মতামত ও থাকবে না।
এরপর নিচে এমিরের সাক্ষর দেয়া। সাথে আরো দুজন ব্যক্তির সাক্ষী দেয়া। শেহনাজের পড়া শেষ হতেই সাইফুল আলম বললেন,
-” সেদিনই বুঝেছি এমির ভালো ছেলে। তাই তোমাদের আর বিরক্ত করিনি। আমি জানতাম তুমি একদিন আসবে আমাদের কাছে”।
___
রাত আটটায় বাড়ি ফেরার পথে এমির শেহনাজের টেক্সটা দেখতে পেল। বিস্ময় চেপে ধরল তাকে। শেহনাজ ও বাড়িতে কেন? সবকিছু কি মিটে গেছে?
এমিরের কিছুটা ভালো লাগল। শেহনাজ তার মা-বাবার কাছে আছে, সব রাগ-অভিমান কেটে গেছে। এখন নিশ্চয় শেহনাজ খুব খুশি। মাঝরাতে হুট করে মেয়েটা কেঁদে উঠবে না। মা-বাবার কথা মনে করে আর মন খারাপ করে থাকবে না।
এমির বাড়ি ফিরল। শেহনাজের রান্না করা খাবার গুলো খেল। খাওয়া শেষে শুয়ে ফোন স্ক্রল করতে লাগল। শেহনাজ অনলাইনে নেই। মা-বাবার সাথে আছে বোধহয়। এমিরের মন টিকছে না। শেহনাজকে এ কয়েক ঘন্টা না দেখতে পেয়ে মনটা বড্ড অস্থির অস্থির করছে। ঘুমোনোর চেষ্টা করেও বিশেষ লাভ হলো না। শেহনাজ তার বুকে ঘুমায়। শেহনাজের চুলের ঘ্রাণ, শরীরের ঘ্রাণ না পেলে ঘুমোতে হাঁসফাঁস লাগে এমিরের। মেয়েটা সামনে থেকে ঘুরঘুর করবে, দুষ্টুমি করবে, অপ্রত্যাশিত বাক্য ছুড়বে এসবই তো চায় এমির। চায় শেহনাজ সর্বদা তার পাশে থাকুক।
এমির হৃদয়ের কথা শুনল। শেহনাজের রান্না করা খাবার গুলো ফ্রিজে রাখল। এরপর আলমিরা থেকে কিছু টাকা বের করে শেহনাজের বাড়ি ছুটল। যাবার পথে কিছু মিষ্টি আর ফলমূল কিনল। এতদিন পর এভাবে সে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে, কিছু না নিয়ে গেলে বেমানান লাগে।
এগারোটার দিকে এমির শেহনাজের বাড়ি এলো। এমির আসতেই শিমলা বেগম এমিরকে খেতে দিল। এমির খাবে না। শেহনাজের রান্না করা খাবার খেয়ে এসেছে। শিমলা বেগম তার কোনো কথাকেই পাত্তা দিল না। খাবার বেড়ে দিল। কিছুতেই ছারল না। এমির পেট ভরে খেয়ে উঠল। সাইফুল আলমের সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলল। অতঃপর শেহনাজের ঘরটাতে এলো। শেহনাজ শুয়ে আছে বা কাত হয়ে। এমির ডাকল,
-” শেহনাজ”।
শেহনাজ নড়েচড়ে উঠল। শরীরটা ভালো লাগছে না। পেটের ভিতর মোচরাচ্ছে। মনে হচ্ছে বমি হবে। শুয়ে ছিল এতক্ষণ। এমিরকে দেখে উঠে বসল। অবাক হলো খুব। এমির এলো কেন?
শেহনাজকে উঠে বসতে দেখে এমির কাছে এলো। শেহনাজের গালে হাত রেখে বলল,
-” সব ঠিক হয়ে গেছে। তুমি খুশি তো নাজ”?
মৃদ্যু হাসল শেহনাজ। বলল,
-” আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে”?
শেহনাজের ঠোঁটের কোণে আলতো করে চুমু খেল এমির। বলল,
-” তোমাকে ছাড়া ভালো লাগছিল না”।
শেহনাজ কথাটা শুনে খুশি হলো। কিন্তু চেপে গেল। বলল,
-” আমি আপনার অভ্যেসে পরিণত হয়েছি”।
শেহনাজ উঠল বিছানা থেকে। শেহনাজ তার বাবার পাঞ্জাবী এনে এমিরকে দিল। এমির পাঞ্জাবীটা পরল শেহনাজের সামনেই। শেহনাজ বলল,
-” খেতে দিবো? খিদে পেয়েছে না”?
-” উঁহু ডাল দিয়ে খেয়ে এসেছি। তোমার আম্মু আবার জোর করে খাওয়ালেন। তুমি খেয়েছো”?
-” খেয়েছি”।
-” তোমাকে অসুস্থ লাগছে”।
-” আপনি পাশে থাকলে অসুস্থতা আমাকে কাবু করতে পারে না”।
-” কোথায় খারাপ লাগছে? মাথা ব্যথা করছে? পিরিয়ড”?
হাসল শেহনাজ। বলল,
-” তেমন কিছু না। বউয়ের জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছেন মনে হচ্ছে”।
এমির সশব্দে হাসল। শেহনাজের গাল দুটো টেনে নেশাতুর কণ্ঠে বলল,
-” তুমি কি ম্যাজিক জানো নাজ”?
কপালে ভাঁজ পরে শেহনাজের। বলে,
-” ম্যাজিক “?
-‘ তা নয়তো কি? আমি কি করে তোমার জন্য এত উতলা হলাম নাজ? তোমাকে না দেখলে কেন এত অস্থির অস্থির লাগে আমার”?
মুখ চেপে হাসল শেহনাজ। পাঞ্জাবীর কলার টা ঠিক করে দিল। বলল,
-” বর সাহেব বুঝি প্রেমে পড়েছেন”?
স্মিথ হাসল এমির। শেহনাজের গাল দুটো চেপে ধরল আঙ্গুল দ্বারা। অধরে অধর রাখল। বলল,
-” উঁহু, ভালোবাসার জালে ফেঁসেছি”।
শেহনাজ পলকহীন চোখে চেয়ে রয়। সুখী লাগে নিজেকে। এমিরের বাহুডোরে আটকে থাকে। সময় গড়ায়। রাত বাড়ে। দুজনের অনুভূতি গুলো শব্দ ছাড়াই এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছোটে। বেশ কিছুক্ষণ পর এমির বলে,
-” আমার জীবনের সবকিছু মিথ্যে, সবকিছু ভুল। কেবল তুমি সত্য, তুমিই যথার্থ। আমার জীবনের সবটা জুড়ে শেহনাজ। আমার প্রথম আর শেষ ভালোবাসা”।
শেহনাজ মাথা উচায়। এমিরের মুখে ভালুবাসি
বলল শব্দটি শুনে গলা শুকিয়ে আসে। যে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য শেহনাজ দিন রাত ছটফট করেছে, মানুষটার পিছু পিছু বেহায়ার মতো ছুটে বেরিয়েছে। সেই মানুষটা আজ তাকে ভালোবাসি বলছে, ভালোবাসায় সিক্ত বুকে আগলে রাখছে। এই ভালোবাসাই তো চাইতো শেহনাজ। এমিরের এই ভালোবাসার জন্যই তো সে সবকিছু ছেড়েছে, নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়েছে। আজ শেহনাজ তার কাঙ্খিত ভালোবাসাটি পেয়েছে। খুশিতে শেহনাজের চোখ চিকচিক করে ওঠে। এমিরের বুকে চুমু আঁকে সে। এমির প্রেমের উত্তাপে জ্বলে। শেহনাজের আকুল আবেদনে সাড়া দেয় সে। শরীরের সাথে শরীর ঘেঁষে। শেহনাজের শরীরের ভাঁজে এমিরের মোলায়েম ছোঁয়া মিশে যায়। অধরে অধর রেখে গভীর থেকে গভীরতম প্রেমসুধা পান করে।
_______
সকালে শেহনাজ অভ্যেস বশত তাড়াতাড়ি উঠল। ছুটে গেল রান্নাঘরে। শিমলা বেগম মাংস রান্না করছেন। বাকি রান্নাগুলো শেষ। শেহনাজকে দেখে হাসলেন তিনি। বললেন,
-” এত সকালে উঠলি কেন? আরেকটু ঘুমোতি। এই সময় বিশ্রাম নিতে হয়”।
শেহনাজ লজ্জা পায় খানিক। মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। কড়াইয়ের পেয়াজ গুলো চামচ দিয়ে নাড়ে। বলে,
-” আমি এখন সকালেই উঠি আম্মু। সকালে রান্নাবান্না করি। ও অফিসে যায়, ওর টিফিন বক্স রেডি করে দেই। ঘরদোর গোছাই। থালাবাসন গুলো ধুই। এরপর খেয়েদেয়ে কলেজে যাই”।
শিমলা বেগম শেহনাজের এমন পরিবর্তনে ভিষণ অবাক হলেন। মেয়ে তার প্লেট ধুয়ে খেতে বসতো না, তার প্লেট ধুয়ে দিতে হতো। আর আজ এই মেয়ে নিজের সংসার সামলায়। ঘরের সব কাজ একাই করে। ভাবা যায়? এই মেয়ের চঞ্চলতা, অস্থিরতা আজ কোথায়?
শেহনাজ মাংস রাঁধে। শিমলা বেগমের সাথে টুকটাক গল্প করে। রান্নাবান্না শেষে সব গোছগাছ করে শেহনাজ। টেবিলে এনে সব কিছু সাজিয়ে রাখে। ঘরে গিয়ে দেখে এমির ঘুমে। হাসে শেহনাজ। তার ডিসিপ্লিন বরটা তার সাথে থেকে ইনডিসিপ্লিন হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠতে আজকাল বড্ড দেরী করে ফেলে মানুষটা।
শেহনাজ এমিরের বাহু ঝাঁকাল। ঘড়িতে সময় দেখে নিল। সাতটার কাছাকাছি। শেহনাজ উচ্চস্বরে ডাকল এমিরকে।
-” অ্যাই উঠুন। আটটা বাজতে চলল। লেইট হয়ে যাচ্ছে”।
এমির ধরফর করে ওঠে। পাশের ঘড়িটিতে নজর বুলায়। সাতটা বাজেনি এখনো। শেহনাজ শুধু শুধু ঢপ দিচ্ছে। হাই তোলে এমির। বলে,
-” মাত্র সাতটা বাজে। আরেকটু ঘুমাই”।
শেহনাজ চোখ পাকায়। ধমকায়,
-” একদম শুবেন না। আধঘন্টার পথ। এখনই উঠতে হবে। চাকরি চলে যাবে নইলে”।
এমির শুনল। ফ্রেশ হলো। গত রাতের শার্ট পরল। টাই লাগিয়ে দিল শেহনাজ। ওয়ালেট, ঘড়ি, ব্রাশ সব এগিয়ে দিল এমিরকে। যতক্ষণ এমির পুরোপুরি তৈরী না হয় ততক্ষণ শেহনাজ এমিরের সাথেই থাকল। তখন লোকটার কি লাগে এই ভেবে। এমির সকালে খায় না। শেহনাজ টিফিন বক্স রেডি করে এমিরকে অফিসে পাঠায়। প্রধান দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। বের হবার আগে এমির শেহনাজের কপালে গাড় চুম্বন করে। আড়াল থেকে লুকিয়ে সবটা দেখেন শিমলা বেগম। প্রশান্তি ছেয়ে গেল তার হৃদয়ে। একবার মনে হয়েছিল শেহনাজ খুশি তো? আসার পর থেকেই মনে হচ্ছিল শেহনাজের মন খারাপ। কিছু একটা নিয়ে ভাবছে। একবার মনে হয়েছিল এমিরের সাথে মেয়েটার ঝগড়া চলছে। তাই এতদিন পর মেয়ে তার এখানে এসেছে। কিন্তু এমিরের সাথে তার এত সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ তাকে প্রশান্তি দেয়। মেয়ে তার সুখেই আছে। এমিরের জন্য শেহনাজ যেমন পাগল, এমির ও তেমন শেহনাজকে চোখে হারায়।
শেহনাজ ন টার আগেই বাড়ি থেকে বের হলো। পরণে অফ হোয়াইট রঙের থ্রিপিস। মাথায় হিজাব। কানে ব্লুটুট হেডফোন। কলেজে যাবার নাম করে বেরিয়েছে শেহনাজ। আসার সময় সাইফুল আলমের কার নিয়ে বের হয়েছে সে। রিকশাওয়ালারা ও রাস্তায় যেতে চায় না। এজন্য শেহনাজ নিজেই গাড়ি চালিয়ে অটো স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল। এদিক দিয়েই বাহাদুর খান যাবে।
এখান থেকে গাড়িটিকে অনুসরণ করলে কেউ সন্দেহ করবে না।
শেহনাজের পরিকল্পনা মাফিক সব হলো। সেই গাড়িটা শেহনাজের গাড়ির পাশ দিয়ে ছুটে গেল। শেহনাজ তাড়াহুড়ো করল না। একটু থেমে গাড়িটিকে অনুসরণ করল। দুরত্ব বজায় রেখে পিছু পিছু চলল। শেহনাজের ভয় কমে গেছে। কোনো কিছুকে ভিতীকর লাগছে না ওর। মেয়েগুলোকে বিচার পাইয়ে দেয়ার জন্য সে মরিয়া হয়ে আছে।
গাড়ি থামল গুলিস্তানের একট প্রত্যন্ত অঞ্চলে। নেমে পরল বাহাদুর আর তার দুই চ্যালা। এগিয়ে গেল সম্মুখে। আশপাশের ঘর গুলো টিন আর খড়ের তৈরী। বাড়িগুলো নড়বড়ে। সামান্য ঝড় এলেই ভেঙে যাবে মনে হচ্ছে। কোনো ঘর আবার মাটিরও তৈরী। গাছপালা এখানে তেমন নেই বললেই চলে। ঘরের সামনে ড্রেনের রাস্তা। ময়লা,দুর্গন্ধযুক্ত পানি গুলো শব্দ করে চলে যাচ্ছে নিজ স্থানে। টয়লেটের নোংরা পানি আর আবর্জনার স্তূপ ঘরের বাইরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এখানকার ছেলে মেয়েগুলো সৌখিন নয়। পরণে ময়লা, ছেঁড়া পোশাকআসাক। রুক্ষ্ম, হ্যাংলা পাতলা শরীর ওদের। মনে হয় দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুধার্ত। চোখে মুখে বেদনা। দারিদ্রতা যেন এখানকার মানুষগুলোকে সেই পুরোনো দিনে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।
বাহাদুর লোকটা বস্তিতে পৌছাতেই বস্তির সকল মেয়ে আর মহিলারা জড়ো হলো। সবাই একে একে সালাম ঠুকল। বাহাদুর খান বাহাদুরের মতোই গর্বিত ভঙিতে সালামের উত্তর দিল। গাড়ি থেকে কিছু খাবারের প্যাকেট বের করল ওর চ্যালা গুলো। বাহাদুর সে খাবার গুলো বিতরণ করল সকলের মাঝে। সবাই খুব খুশি। ভালো খাবার পেয়ে আনন্দিত তারা। চোখ মুখে উচ্ছলতা ফুটে উঠেছে।
সেখানকার একজন মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে বাহাদুরের কাছে এলো। মিনতির সুরে বলল,
-” বাবা, আমার মাইয়ারর বয়স ষোল। সব কাম পারে। বস্তির অবস্থা তো জানোই। না খাইয়া পইড়া কোনো রকমে বাইচা আছি। তোমার গার্মেন্টসে ওরে একটা কাম জুটাই দেও না। এইহানকার অনেকরেই তো তুমি কামের হদিস দিছো”।
বাহাদুর হাসল। উত্তর দিল,
-” অবশ্যই দেবো চাচি। কেন দিবো না? আপনাদের সেবা করাই আমার ধর্ম। আমি চাই বস্তির মেয়েরা কাজ করার সুযোগ পাক। নিজের পায়ে দাঁড়াক। এই বস্তি যেন লোকালয়ে পরিবর্তিত হয়। এখানকার সবাই যেন শহরের মানুষদের মতো সব সুযোগ সুবিধা পায়। এজন্যই আমি দিনরাত পরিশ্রম করছি। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়েকে ভালো একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিবো”।
কথাটা শুনে মহিলা খুব খুশি হলো। তার মেয়েটিও হেসে উঠল। কৃতজ্ঞতায় ওদের চোখে পানি জমল। শ্রদ্ধা বোধ তরতর করে বেড়ে উঠল যেন।
একে একে অনেক গুলো মেয়ে এলো বাহাদুরের কাছে। সকলেই কাজ খুঁজছে। পেটের ক্ষুধা নিবারণ করার একটা আশা খুঁজে পেয়েছে তারা। খুশিতে কাঁদতে আরম্ভ করেছে। বাহাদুর সবাইকে আশ্বাস দেয়। সবার কথা শোনে। শেহনাজের মাথায় ঢোকে না কিছু। মানুষটা তো ভালো মানুষের মতোই চলছে। সবাই একে ভালোও বলছে। তবে কেন লোকটা এত নিষ্ঠুর কাজ করছে? আর কতদিন ধরে চলছে এসব?
শেহনাজের মাথায় গতকাল বাহাদুরের বলা কথাটি বেজে চলেছে। বলেছিল বস্তিতে আরো মেয়ে আছে। তাদের আনবে। এনে পাঠিয়ে দিবে। তবে কি এদেরকেই চাকরি পাইয়ে দেবার মিথ্যে আশা দেখিয়ে পাচার করছে লোকটা? অসহায়, অবলা, সহায়সম্বলহীন মেয়েদেরকে নিয়ে নোংরা খেলায় মেতেছে? শেহনাজের কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে উঠল। বুক ভার হলো ওর। চিনচিনে ব্যথা শুরু হলো মস্তিষ্কে।
চলবে?