#শেহনাজ _____অন্তিম পর্ব( প্রথমাংশ )
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
রাতের আঁধারে অন্ধকারাচ্ছন্ন চারপাশ। মাঠে খরগোশরা খেলছে। আলাদা বাতি আছে ফ্ল্যাটের সামনে। সে আলোতে খরগোশ গুলোকে সুন্দর দেখাচ্ছে। শেহনাজ তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। মনটা খুব খারাপ ওর। বিষাদে ছেয়ে আছে হৃদয়। বুকের ভেতরে যন্ত্রণা গুলো দলা পাকিয়ে আছে। শেহনাজের এখন একটা ভরসার কাঁধ প্রয়োজন, আন্তরিকতা, ভালোবাসায় পূর্ণ দুটি চোখ প্রয়োজন। এমির রাস্তায়। জানাল পনেরো মিনিট লাগবে ফিরতে। শেহনাজ সেজন্য ছাদে এসে দাঁড়িয়ে আছে। এমিরের জন্য অপেক্ষা করছে ।
এমির ফিরল বিশ মিনিটের মাথায়। শেহনাজ ছাদ থেকে নামল না। শেহনাজের ধারণা এমির তাকে খুঁজে না পেয়ে এখানেই আসবে। হলোও তাই। এমির ঘরে ঢুকে শেহনাজকে পেল না। সাইফুল আলম আর শিমলা বেগমের ঘরেও নেই ও। এমির একটু চিন্তায় পরল। গলার টাই খুলতে খুলতে দৌড়ে উঠে গেল ছাদে। শেহনাজ গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে। আকাশের দিকে তার মুখ। চাঁদের টিমটিমে আলোয় শেহনাজের মন খারাপের রেশ ধরতে পারল এমির। ধীর পায়ে শেহনাজের কাছে এলো সে। ডাকল,
-” শেহনাজ”।
শেহনাজ পিছু ফিরল। এমির দাঁড়িয়ে। শুভ্র শার্টে তাকে দারুণ লাগছে। একটু আগে শেহনাজের যে মন খারাপ ছিল, তা মুছে গেল এমিরের মুখ দেখে। মানুষটার মাঝে এত কিসের সুখ? এত কিসের মায়া? বুঝে পায় না শেহনাজ। সর্বক্ষণ কেবল চেয়ে থাকতেই ইচ্ছে হয়। শেহনাজ হাসল মৃদ্যু। বলল,
-” পনেরো মিনিটের কথা বলা বিশ মিনিট লাগালেন? এখানে আসতে আরো পাঁচ মিনিট অর্থাৎ আমার কাছে আসতে আপনার পঁচিশ মিনিট সময় লাগল”?
এমির হাসল। এগিয়ে এলো। টাইখানা খুলে ছাদের গ্রিলে রাখল। শেহনাজের দু পাশে হাত রেখে বলল,
-” তোমার কাছে আসতে আমার ন্যানো সেকেন্ডের ও প্রয়োজন হয় না। কেননা আমি তোমার সাথেই আছি সবসময়।
শেহনাজের হাত আঁকড়ে ধরল এমির। চুমু খেল হাতের উল্টো পিঠে। সেই হাতটি শেহনাজের বুকে চেপে ধরল এমির। সম্মোহনী তার হৃদয়। শেহনাজের প্রতি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ চোখ দুটি শেহনাজের চোখেই নিবদ্ধ। নেশাক্ত লাগে এমিরকে। একটু সময় নিয়ে বলে,
-” তোমার এ বুকে আমি আছি। এই দেহে আমি আছি। তোমার ভাবনা-চিন্তা, তোমার ভালোলাগায়, ভালোবাসায় সব কিছুতেই কেবল এই এমির সাখাওয়াত আছে। তাহলে দূরে আর রইলাম কই”?
শেহনাজ মুগ্ধ চোখে তাকায় এমিরের পানে। মনে হয় বছরের পর বছর মানুষটাকে দেখে না সে। সেই সুদর্শন চেহারা, মেল পারফিউম এর ঘ্রাণ কতদিন তার রন্ধ্রে পৌছায় না।
দুষ্টুমির ছলে হাসল শেহনাজ। ঠোঁট বাকাল। বলল,
-” আমাকে কথার জালে আটকাচ্ছেন? ফ্লার্টিং হুহ”?
-” শেহনাজকে বাহুডোরে আটকাতে ফ্লার্টিং স্কিলস এর প্রয়োজন নেই। শেহনাজ কোনো কারণ ছাড়াই আমার”।
শেহনাজের কি হলো জানা নেই। তার শরীরটা দুলে উঠল। চোখের কোণে জমল অশ্রু। এমিরকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল। যেন এমির হারিয়ে যাচ্ছে, তাকে হারাতে বসেছে শেহনাজ। এমির হাসল। শেহনাজের পিঠে হাত বুলাল। সময় গড়াল। শেহনাজ ছাড়ল না এমিরকে। এমিরের বুকে লেপ্টে রইল অনেকক্ষণ। দুজনের কারো যেন কোনো তাড়া নেই। একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ ও যেন তারা অনুভব করছে। এমিরের মনে হলো শার্টের বুকের অংশ ভিজে যাচ্ছে। গরম হয়ে উঠছে বুক। শেহনাজ কাঁদছে বুঝি? থমকাল এমির। চিন্তিত হলো ভিষণ। উত্তেজিত দেখাল ওকে। ততক্ষণাৎ শুধাল,
-” শেহনাজ, কাঁদছো কেন? কি হয়েছে”?
এমির ছাড়াতে চাইল শেহনাজকে নিজের থেকে। শেহনাজ ছাড়ল না এমিরকে। আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখল। শেহনাজের এত জোর কোথা থেকে এলো সে জানে না। এমির পুনরায় শুধাল,
-” পাগলি, বলবে তো কি হয়েছে”?
শেহনাজ মুখ তুলল। গাল ভিজে গেছে তার। চোখ দুটো টলটলে, গভীর। এমিরের চোখে চোখ রেখে সে বলল,
-” আমি আপনাকে ভালোবাসি এমির। বড্ড বেশি ভালোবাসি”।
এমির চমকাল। শেহনাজের এমন ক্রন্দনরত কণ্ঠ তাকে ব্যথিত করল। ছলকে উঠল হৃদয়। অদ্ভুত যন্ত্রণায় পিষ্ট হলো মন। বলল,
-” আমি জানি তো। কাঁদছো কেন? কেউ বকেছে? দেখি তাকাও আমার দিকে। কে বকেছে? ব্যথা পেয়েছো কোথাও”?
এমিরের কথা গুলো বড়দের মতো শোনাল। যেন কোনো বাচ্চার কাছে তার কান্নার কারণ জানতে চাইছে সে। আদুরে কণ্ঠে একটু খানি আশকারা দিচ্ছে। ফিক করে হাসল শেহনাজ। পুনরায় দমে গেল। বলল,
-” আমার ভালো লাগছে না কিছুই”।
-” কেন ভালো লাগছে না? এই তো আমি। তবুও এত বিষাদ কেন”?
শেহনাজ চোখ মুছল। নাক টানন। কান্না থামাল। সবকিছু ঠিকঠাক করে এমিরকে ছাড়ল। একটু আগের কান্নার কথা ভুলে গেল সে। কথা ঘুরিয়ে বলল,
-” এত সুখ দেখে আমার কান্না পায়। কখনো তো ভাবিনি আপনি এভাবে আমাকে ভালোবাসবেন। তাই আপনার একটু আহ্লাদ পেলেই গলে যাই”।
হাসল এমির। শেহনাজের মাথায় হাত বুলাল। দুজন তাকিয়ে রইল গোলাকার চাঁদের দিকে, অসংখ্য জ্বলজ্বল, ঝিকিমিকি তারার দিকে। তারা যেন মিটিমিটি হাসছে। তাদের প্রেমময় মুহূর্তকে পিটপিট করে দেখছে।
________
বাড়ির সকলে একসাথে খেতে বসেছে। সকলের মাঝে আনন্দ। পুরো বাড়িটা সুখে মুখরিত হয়ে আছে। শেহনাজ এতদিন পর বাড়ি ফেরায় বাড়িটা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
এমির আর শেহনাজ পাশপাশি দুটো চেয়ারে বসেছে। সামনেই হরেক রকম খাবার-দাবার। এককেকটি খাবার থেকে একেকরকম ঘ্রাণ আসছে। এমির খেতে আরম্ভ করেছে। শেহনাজের খেতে ইচ্ছে করছে না। গা গোলাচ্ছে। এত সুন্দর খাবারের ঘ্রাণ তার কাছে বিদঘুটে লাগছে। শেহনাজকে এভাবে বসে থাকতে দেখে শিমলা বেগম তাড়া দিলেন,
-” কিরে, খাচ্ছিস না কেন? বসে আছিস যে”?
শেহনাজ ভোঁতা মুখে মায়ের দিকে তাকাল। একটুও রুচি নেই ওর। কোনো কিছুই খেতে মন চাইছে না। পেটের ভিতরের সব যেন বের হয়ে আসতে চাইছে।
-” আম্মু খেতে ইচ্ছে করছে না”।
সাইফুল আলম খেতে খেতে বললেন,
-” খেয়ে নাও। এ সময় পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়”।
কথাটা শোনা মাত্র এমির শেহনাজের দিকে তাকাল। শেহনাজের বোধহয় সহ্য হলো না সে দৃষ্টি। হড়হড় করে সে বমি করে দিল মেঝেতে। ঝাঁঝে চোখ গিয়ে অশ্রু গড়াল শেহনাজের। মাথাটা ভনভন করে ঘুরে উঠল। এমির এঁটো হাতেই আগলে ধরল শেহনাজকে। গালে হাত রাখল। শুধাল,
-” নাজ, শরীর খারাপ লাগছে? বমি হলো কেন”?
শেহনাজ আরেক দফায় এমিরের বুকে বমি করল। এমিরের সাদা শার্টটা হলদেটে হয়ে গেল। পেট খালি হতেই শেহনাজ থামল। ক্লান্ত হলো ভিষণ। চোখ বুজে জড়িয়ে রইল এমিরের পিঠ। এমির চিন্তিত ভিষণ। চোখে মুখে আতঙ্ক। শেহনাজের এমন অসুস্থতা তাকে দুর্বল করে ফেলেছে। শিমলা বেগমের কাছে শেহনাজকে সঁপে দিয়ে এমির ফোন বের করল। কল দিতে উদ্যত হতেই তাকে থামাল সাইফুল আলম। শিমলা বেগম বললেন,
-” শেহনাজ মা হতে চলেছে এমির। এ সময় এমনটা হয়ই। চিন্তা করো না”।
এমির চমকাল ভিষণ। নিষ্পলক দৃষ্টিতে শেহনাজের পানে তাকিয়ে রইল। বাকরুদ্ধ সে। ভিতরতা অস্থির হয়ে উঠেছে। কি বলবে? কি করবে কিছুই মস্তিষ্কে খেলছে না। কেবল শেহনাজকে দেখছে সে। কণ্ঠনালী আটকে গেছে। শব্দ বের হচ্ছে না।
শিমলা বেগম শেহনাজের শরীর ভালো করে মুছিয়ে, পোশাক পরিবর্তন করে ওকে ঘরে নিয়ে এলো। দুধ আর কিছু ফলমূল রেখে দিল পাশে। কিছুক্ষণ শেহনাজের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। এমির ততক্ষণে শার্ট বদলেছে, হাত ধুয়েছে। আর খাওয়ার ইচ্ছে হয়নি ওর। সময় নিয়ে এমির ঘরে আসতেই শিমলা বেগম চলে গেলেন। এমির টুল টেনে শেহনাজের বিছানার পাশে বসল। তার চোখের ভাষা বুঝতে পারল না শেহনাজ। এমির কি খুশি হয়নি?
-” আপনি খুশি হননি”?
একবাক্যে উত্তর দিল এমির,
-” হয়েছি”।
-” কিন্তু আপনাকে দেখে তা মনে হচ্ছে না”।
-” কি মনে হচ্ছে”?
-” জানি না”।
-” শেহনাজ”।
-” হু”?
-” তুমি আগে থেকে জানতে?
-” জানতাম।
-” আমায় বলোনি কেন”?
-” সময় হলে বলবো ভেবেছিলাম”।
-” সময় কি এখন হয়েছে? নাকি আজ ধরা পড়ে গিয়ে বলতে বাধ্য হয়েছো।
শেহনাজের বুক কাঁপছে। খচখচ করছে। এমির কি বাচ্চার কথা জেনে খুশি হয়নি? হলে এমন করে কথা বলবে কেন? যখন কথাটা তাকে জানানো হলো তখনও এমির নিরুত্তর। এখন ও কেমন গম্ভীর।
-” ক মাস চলছে?
-‘ দুই, আড়াই মাস।
এমির উঠে দাঁড়াল। গম্ভীর কণ্ঠে বল,
-” পিতা হবার সুখ থেকে আমাকে বঞ্চিত কেন করলে শেহনাজ? আগে জানানো যেতো না আমায়”?
এমিরের এহেন মলিন কণ্ঠে শিরদাঁড়া কেঁপে উঠল শেহনাজের।
শেহনাজ উঠে বসল। মাথা চক্কর কাটল। বলল,
-” আমি তো নিজেই বুঝতে পারিনি। কলেজে যাবার পথে টেস্ট করিয়েছি সপ্তাহ খানেক আগে”।
এমির শেহনাজের ললাটে অধর ঠেকাল। গভীর চুমু। সে অধর চেপে ধরল ঠোঁটেও। অনেক কথা যেন বলে দিতে চায় অধর দ্বারা। এমিরের চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, ঝাপসা। অশ্রুকণা গড়িয়ে পরে শেহনাজের বুকে। থমকায় শেহনাজ। এমির চুম্বন শেষে বলে,
-” আমি খুব খুশি নাজ। এত খুশি আমি আগে কখনো হইনি। কখখনো না”।
শেহনাজ প্রাণ ফিরে পেল। গভীর ভাবে হাসল। বলল,
-” আপনি সত্যিই খুশি হয়েছেন”?
এমির বাচ্চাদের ন্যায় উপর নিচ মাথা ঝাঁকাল। হাসি মুখে বলল,
-” খুউউব”।
________
আজ রবিবার। সকাল থেকেই রবি মামা তার তেজ ছড়িয়েছে। ঘরে বসে অবশ্য সে রোদ সহজে টের পাওয়া যায় না। এসির নিচে বসে রবি মামার তেজ গায়ে লাগে না। তবুও আজকের দিনটি অর্থবহ।
এমির কাজে গিয়েছে। শিমলা বেগমের শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে। শেহনাজ এ সময়ে কি করবে বুঝতে পারছে না। সে খেয়েদেয়ে ছুটে গেল সাইফুল আলমের ঘরে। সাইফুল আলম চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। চোখে চশমা। সকল মনোযোগ খবরে। শেহনাজ ধীর পায়ে সাইফুল আলমের নিকট এলো। হাসি মুখে বলল,
-” গ্যুড মর্নিং আব্বু”।
সাইফুল আলম কাগজ থেকে মুখ তুললেন। বললেন,
-” গ্যুড মর্নিং সোনা মা”।
শেহনাজ সাইফুল আলমের চেয়ারের হাতলে বসল। বলল,
-” কি দেখছো এত? আজকের টাটকা খবর কোনটি”?
সাইফুল আলম ছোট ছোট চোখ করে শেহনাজের পানে তাকালেন। বললেন,
-” আগামীকাল ভোট, ইলেকশন। সে খবরই পড়ছি” ।
শেহনাজ চমকে উঠল। উঠে দাঁড়াল চেয়ারের হাতল ছেড়ে বলল,
-” কাল ভোট হবে”?
-” হুম। কেন”?
শেহনাজ নিজেকে স্বাভাবিক করল। বলল,
-” তুমি কাকে ভোট দিবে আব্বু”?
-” কাকে আবার? বাহাদুর খানকে”।
” কেন? অন্য কাউকে কেন ভোট দিবে না”?
-” কারণ ও ক্ষমতাবান। জনগনের পাশে দাঁড়ানোর, দেশকে উন্নত করার ক্ষমতা ওর আছে”।
শেহনাজ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। বলল,
-” ভুল বললে। বাহাদুর খান তোমাকে টাকা দিয়েছে। এজন্য তুমি তাকে ভোট দিবেই। তাই নয় কি”?
সাইফুল আলম ভারী চমকালেন। কৌতুহলি কণ্ঠে বললেন;
-” তুমি এসব প্রশ্ন করছো কেন? এসব বিষয়ে তো তোমার কোনোদিন আগ্রহ ছিল না”।
শেহনাজ দম ছাড়ল। স্বাভাবিক স্বরে বলল,
-” জানি না। হুট করে আগ্রহ জন্মেছে। আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিলে না”?
-” টাকা তো দিবেই। আমার ব্যবসার সকলে এমনকি রেস্টুরেন্টের অনেক লোক ওকে ভোট দিবে। বিনিময়ে ও আমাকে টাকা দিবে না? এটা আমার প্রাপ্য”।
-” এ টাকাটা যদি অন্য কেউ দিতো? তাকে ভোট দিতে”?
-” এ শহরে বাহাদুর খানের কোনো কম্পিটিটর নেই মা। একজন ছিল, লোকটা মারা গেছে। এখন ভোটে কেবল বাহাদুর খান-ই দাঁড়িয়েছে। ওর প্রতিযোগী হয়ে আর কারো দাঁড়ানোর সাহস নেই”।
-” লোকটা কবে মারা গেছে বাবা”? উনার নাম কি”?
-” শহীদুল হক। এইতো মাস তিনেক হয়েছে। তুমি এসব জিজ্ঞেস করছো হঠাৎ”?
-” না এমনিই। রাজনীতি সম্পর্কে তো কিছু জানি না আমি। তাই টুকটাক জানতে ইচ্ছে হলো”।
শেহনাজ সাইফুল আলমের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সাইফুল আলম পুনরায় চোখ খবরের কাগজে রাখলেন। মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগছে শেহনাজের। এত বড় মাপের ব্যক্তি বাহাদুর। তার বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা ওর আছে? কিন্তু প্রমাণ। ওর যে এটাই হাতিয়ার। প্রমাণ গুলো ওর কাছে আছে। সেগুলোকেই কাজে লাগাবে ও।
শেহনাজ গুগোল ও শহীদুল হকের ছবি খুঁজে পেল। এই তো সেই বয়স্ক লোক, যাকে বাহাদুর খান রাস্তার মাঝখানে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল। শেহনাজ তৈরী হয়ে নিল। লেডিস প্যান্ট আর লঙ ফ্রক পড়ল। সাইফুল আলমের কারটিকে নিয়ে বের হলো থানার উদ্দেশ্যে।
_______
দুটো ত্রিশ মিনিটে শেহনাজ পৌঁছাল থানায়। থানায় পৌছে জানতে পারল এস আই সাহেব থানায় নেই। একটার সময় খেতে গিয়েছেন। এখনও আসেননি। শেহনাজকে বসতে দেওয়া হলো। আধঘন্টা বসে রইল সে। এস আই এর আসার খবর নেই। শেহনাজ বিরক্ত হলো খানিক। জুনিয়র ইন্সপেক্টর বসে আছে ডেস্কে। শেহনাজ তার নিকট গেল। বলল,
-” এস আই কখন আসবেন”?
ইন্সপেক্টর তাকাল শেহনাজের দিকে। লাবণ্যময় শেহনাজকে দেখে সে তাকিয়ে রইল স্বল্পক্ষণ। শেহনাজের অস্বস্তি হলো। বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে ফেলল সে। বলল,
-“বলছেন না কেন”?
-” উনার আসতে দেরি হবে। আমাকে বলুন। কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি”?
শেহনাজ রাজি হলো না। বলল,
-” না গুরুত্বপূর্ণ কেস। উনাকেই বলবো”।
লোকটি আশ্বাস দিল,
-” বসুন। চিন্তা করবেন না ম্যাম। আপনাকে প্রটেক্ট করা, আপনার কেস, ইনফর্মেশন সিকিউরড রাখা আমাদের দায়িত্ব। এস আই সাহেব কি নিজে কোনো কাজ করবে? করাবে আমাকে দিয়েই। আপনি বলুন”।
শেহনাজ দোনামোনো করল। অতঃপর লোকটির আশ্বাস, কথা বলার ধরণে দমল সে। বলল,
-“এ শহরের সবচে বড় নেতা, বাহাদুর খান তার প্রতিযোগী শহীদুল হককে খুন করেছেন। উনাকে আপনারা অ্যারেস্ট করুন”।
ইন্সপেক্টর থতমত খেল ভিষণ। বড় বড় চোখ করে বলল,
-” উনার নামে এসব বলছেন কোন সাহসে? শুধুমাত্র আপনার কথায় আমরা উনাকে অ্যারেস্ট করতে পারি না”।
শেহনাজের খুব রাগ হলো। নিজেকে সংযত করে বলল,
-” উনি ঠিক কতটা জঘন্য আপনি জানেন না। উনি নারী পাচার চক্রের সাথে জড়িত। অসহায়, অবলা মেয়েদের কাজ পাইয়ে দেবার মিথ্যে আশ্বাস দেখিয়ে তাদের বিক্রি করে দেয়। উনি খুব নিষ্ঠুর একজন মানুষ। আমার চোখের সামনে উনি মানুষ খুন করেছেন”।
-” আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে”?
-” হ্যাঁ অবশ্যই আছে”।
শেহনাজ দুটো ফোন ক্যারি করে। একটি তার বাবার দেয়া আরেকটি এমির কিনে দিয়েছে কয়েকদিন আগে। শেহনাজ এমিরের ফোনটা ব্যবহার করতো না। কিন্তু আজ কি মনে করে সে দুটো ফোনই নিয়ে এসেছে। দুটো ফোনেই বাহাদুর খানের ভিডিও আছে। কোনোভাবে ডিলিট হয়ে গেলে অপর ফোন ব্যবহার করবে বলেই শেহনাজ ফোনটা এনেছে।
শেহনাজ তার বাবার দেওয়া দামী ফোনটা বের করে বাহাদুর খানের সব ভিডিও দেখাল ইন্সপেক্টরকে। সব ভিডিও, ফটো দেখে চমকালেন ইন্সপেক্টর। কিছু সময় রয়েসয়ে বললেন,
-” এই ভিডিও গুলো যে ইডিট করা নয় তা বোঝার জন্য আমাদের টাইম লাগবে। ফোনটা দিন। এখানেই বসুন। চেক করে আসছি”।
লোকটা ফোন নিয়ে চলে গেল অন্য ডেস্কে। শেহনাজ বসে রইল। মনের বোঝা হালকা হল খানিক। ভিতরটাতে শান্তি পেল। লোকটা ফিরে এলো দশ মিনিট পর। এসে ডেস্কে বসতে বসতে বলল,
-” আরেকটু টাইম লাগবে ম্যাম। অপেক্ষা করুন। আপনার সাহস আছে বলতে হবে। উনার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করা যার তার কাজ নয়”।
শেহনাজ ভিষণ গর্বিত বোধ করল। বলল,
-” আগামীকাল ইলেকশন। আশা করছি এর আগেই আপনারা উনাকে গ্রেফতার করবেন”।
শেহনাজ আরো কিছুক্ষণ বসে রইল। থানায় তেমন মানুষ নেই। যে যার কাজে ব্যস্ত। শেহনাজকে চা দেওয়া হলো। শেহনাজ কিছু না ভেবেই চা পান করল। এতক্ষণ ধরে বসে থেকে খিদে পেয়েছিল বিধায় অত কিছু ভাবল না। চা টা খেয়েই ওর অস্বস্তি হতে শুরু করল। শেহনাজ নিজের মৃত্যু টের পেল তখন, যখন সে বুঝতে পারল চায়ে কিছু একটা মেশানো হয়েছে। তার হাত পা অসাড় হয়ে এলো। চোখ বুজে আসল। শেহনাজ পার্স হাতড়ে অন্য ফোনটি কোনোমতে নিজের প্যান্টের পকেটে গুজল। ভয়াবহ ঘুম এলো ওর। সেকেন্ডের মাঝেই ঘুমে তলিয়ে গেল শেহনাজ। কাউকে ডাকার জন্য মুখ খুলতেও পারল না। কেবল কানে এলো ইন্সপেক্টরের গলা। সে বলছে ” এই ম্যাডাম অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ডাক্তার ডাকো কেউ”।
চলবে?
#শেহনাজ _____অন্তিম পর্ব (শেষাংশ)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
এখন রাত কি দিন তা টের পাবার অবকাশ নেই। চারপাশ অন্ধকার। কোথাও কোনোরূপ শব্দ নেই। গুন গুন করে কেউ কথা বলছে। কাঁদছে। নিকষ কালো আঁধারে শেহনাজ শুয়ে আছে। ব্যথায় টনটন করছে শরীর। চোখের পাতা খুলতে গিয়ে বেশ কসরত্ করতে হচ্ছে শেহনাজকে। জ্বলে উঠছে পেটের ভিতরটা। খিদেয় চো চো করছে পেট।
শেহনাজ উঠে বসল। ওর হাত বাঁধা। মুখে কাপড় বাঁধা। শেহনাজ চোখ মেলে। কাউকে যে ডাকবে সে জোর কিংবা সাধ্য তার নেই। মুখের কাপড়টা বেশ শক্ত করেই বেঁধেছে ওরা। চোয়াল ব্যথা করছে। শেহনাজ পা দিয়ে শব্দ করে মেঝেতে। মুখ দিয়ে শব্দ করে কোনোরকম। হাত পা নাড়াচাড়া করতেই তার বোধগম্য হয় এ ঘরে সে একা নেই। আরো অনেকেই আছে। কারা আছে? নারী না পুরুষ? শেহনাজ ভীত হয়ে তাকায়। কারো শরীরে পা লাগে। ব্যক্তিটি উঠে বসে। চোখ ডলে ভালোমতো শেহনাজের পানে তাকায়। এ অন্ধকারে কেবল জ্বলজ্বল করে শেহনাজের গভীর চোখ।
হুট করে ঘরটাতে আলো জ্বালায় একটি মেয়ে। ততক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে শেহনাজ। বিপদের আশঙ্কা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। চোখ মেললেই বুঝি ভয়াবহ ঘটনা দেখতে হবে শেহনাজকে। এ ভয়ে সে দীর্ঘ সময় নিয়ে চোখ মেলে। ছোট্ট ঘরটিতে কোনো আসবাবপত্র নেই। কেবল একটি জগ আর স্টিলের গ্লাস রাখা। ঘরে আট-নয়টি মেয়ে বসে আছে। সকলের হাতে পায়ে গভীর ক্ষত। শুকনো মুখ। কালচে দাগ মুখ জুড়ে। সকলের দেহ রুগ্ন। মন হচ্ছে অনেকদিন ধরে ভালোমন্দ খেতে পায় না। তাদের চোখে মুখে শত শোক।
শেহনাজ মুখ দিয়ে অস্ফুটে শব্দ করল। পা নাড়ল। তার এমন হম্বিতম্বি দেখে জেগে থাকা মেয়েটি কাছে এলো। খুলে দিল শেহনাজের মুখের বাঁধন। হাতের বাঁধন ও খুলে দিল। জিজ্ঞেস করল,
-” পানি খাবে”?
শেহনাজ মাথা নাড়ে। অর্থাৎ তার পিপাপা পেয়েছে। মেয়েটি গ্লাস ভর্তি করে পানি দিল শেহনাজকে। শেহনাজ দু ঢোক গিলেই পানিটুকু রেখে দিল। খালি পেটে পানি গেলে আরো পেট ব্যথা করে। শেহনাজ স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” এটা কোথায়? আমরা কোথায় আছি”?
মেয়েটি তাকাল শেহনাজের পানে। সে চোখে গভীর দুঃখ, যন্ত্রণা। শেহনাজ বাকি সবার দিকে তাকাল। থমকাল সে। এই মেয়েগুলোকেই তো বাহাদুর জিম্মি করেছিল। গভীর, ঘন জঙ্গলের মাঝে থাকা পুরোনো, শ্যাওলা জমা বাঙলো তে আটকে রেখেছিল ওদের। তবে কি শেহনাজ ওই জঙ্গলটাতে আছে?
মেয়েটি বলল,
-” আমি জানি না এটা কোথায়।
শেহনাজ ততক্ষণাৎ উঠে দাঁড়াল। বাকি মেয়ে গুলো ঘুমিয়ে আছে। তাদের শরীরে দাগের চিহ্ন গুলো গভীর। নাজুক দেখাচ্ছে সকলকে। পোশাকআসাকের ঠিক নেই। শেহনাজ সব গুলো মেয়েকে ঘুম থেকে তুলল একে একে। জেগে থাকা মেয়েটি নির্বিকার। তার কোনো প্রকার ভয়, আক্ষেপ নেই। কিংবা পালানোর আগ্রহ ও নেই। সে চেয়ে আছে শেহনাজের দিকে, অসম্ভব রূপবতী নারীর দিকে। শেহনাজ সবাইকে একত্রে করে বলল,
-” তোমার এখানে বসে আছো কেন? চলো পালাই”।
সকলের নিকট শেহনাজের কথাটি অবান্তর, বোকা বলে মনে হলো। হাসল তাচ্ছিল্যের সুরে। একটি মেয়ে বলল,
-” পালানোর পথ থাকলে কি আমরা এখানে পড়ে থাকি”?
শেহনাজ নিজের বোকামি ধরতে পারল। বুঝতে পারল বিষয়টা। তড়িঘড়ি করে প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে এমিরের ফোনে কল করল। ভয়াবহ অস্থিরতা ঘিরে ধরল শেহনাজকে। খুব করে চাইল এমির শত ব্যস্ততার মাঝেও তার ফোন ধরুক। কিন্তু তা আর হলো না। ব্যর্থ হলো শেহনাজ। ফোনে রিং হতে না হতেই বাহির থেকে পা ফেলার শব্দ শুনল শেহনাজ। ভয়ে জড়সড় হলো সে। দ্রুত ফোনটা সাইলেন্ট করে প্যান্টের পকেটে গুজল।
একটি ছেলে ঢুকল ঘরে। পরণে ডক্টরদের সাদা ইউনিফর্ম, গলায় সেথোস্কোপ ঝোলানো। শেহনাজকে দেখে গাড় হাসল ছেলেটি। বলল,
-” সব ঠিকঠাক ম্যাডাম?
শেহনাজ ঘৃণা ভরে দেখল তাকে। গা গুলাল ওর। বলল,
-” আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে? আর কেন”?
আরো একটি ছেলে এলো ঘরে, চেয়ার নিয়ে। ডক্টরের বেশভূষায় থাকা লোকটি বসল সেথায়। রয়েসয়ে বলল,
-” বাঘের সাথে লড়তে এসেছিস কেন? মরার ভয় নেই”?
শেহনাজ থমকাল। কি করবে ভেবে পেল না। অস্থির অস্থির লাগল ওর। অজানা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে আশপাশ দেখল। মেয়েগুলোকে নির্জীব, প্রাণহীন বলে মনে হচ্ছে। তাদের বুঝি বাঁচার আকাঙ্খা ফুরিয়ে গেছে। কোনো প্রকার অভিব্যক্তি দেখাচ্ছে না তারা। কিন্তু শেহনাজ যে বাঁচতে চায়। সুখী হয়ে বাঁচতে চায়। এ শহরের অলিগলিতে হেসে খেলে বেড়াতে চায় এমিরের সাথে। এত দ্রুত মরার সাধ যে ওর নেই।
-” থানা থেকে আপনি আমাকে কিডন্যাপ করেছেন তাইনা”?
-” হুম ঠিক ধরেছিস”।
-” কেন করেছেন এমনটা”?
-” বাহাদুর খানের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগার করেছিস এটা তোর মস্ত বড় অন্যায়। আরো বড় অন্যায় করেছিস ভিডিও গুলো থানা পর্যন্ত টেনে এনে। ওই জুনিয়র ইন্সপেক্টর বাহাদুর ভাইয়ের লোক বুঝলি? বাহাদুর ভাইকে সব বলে দিয়েছে। তোর চায়ে ওষুধ মিশিয়েছে। আমি ডাক্তার সেজে তোর চিকিৎসা করার কথা বলে নিয়ে এলাম”।
শেহনাজ চমকাল ভিষণ। হু হু করে কেঁপে উঠল কায়া। জ্বলে উঠল বক্ষস্থল। বিপদের আশঙ্কা ওকে মূর্তি বানিয়ে দিল। তবু দমল না সে। নিজের ভয়কে যথাসম্ভব ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করল। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-“এই কুৎসিত কাজটা করতে আপনাদের বিবেকে বাঁধল না”?
ছেলেটি শেহনাজের প্রশ্নের উত্তর দিল না। উঠে চলে গেল সেখান থেকে। হাঁসফাঁস করে উঠল শেহনাজ। মৃত্যু কে সচক্ষে দেখতে পেয়ে নিদারুণ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পরল। খানিকক্ষণ বাদেই ঘরে কেউ ঢুকল। অন্যান্য মেয়ে গুলো জড়সড় ভঙ্গিতে ঘরের এক কোণে গিয়ে ঠেকল। চোখেমুখে ওদের আতঙ্ক। গা কাঁপছে সকলের। শেহনাজ খেয়াল করল। মাথা উঁচু করে তাকাল সম্মুখের লোকটির পানে। বাহাদুর খান। লোকটাকে চিনতে একটুও অসুবিধে হলো না শেহনাজের। ঘৃণায়, ক্ষোভে ওর চোখের কোণ রক্তিম হয়ে উঠল। বাহাদুর এসে চেয়ারে বসল। শেহনাজ এক পলক দেখল তাকে। বাহাদুর সুদর্শন। বয়স অত বেশি না। সাদা পাঞ্জাবীতে লোকটাকে দারুণ লাগে। তার পোশাকআসাক শুভ্র হলেও মন, মস্তিষ্ক কালো, নোংরা। শেহনাজের ইচ্ছে হলো লোকটাকে এ মুহূর্তে মেরে ফেলতে। কিন্তু সে যে অক্ষম।
বাহাদুর সিগারেট ধরাল। সুখটান দিল। ধোঁয়া উড়িয়ে শেহনাজকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
-” নাম কি তোর”?
শেহনাজ গাঢ় চোখে চাইল। সে চোখে রাগ, ক্রোধ, প্রতিশোধের নেশা। চোখ দিয়েই যেন ভষ্ম করে দিতে চায় লোকটাকে। স্বর নামিয়ে বলে,
-” শেহনাজ আলম”।
-” ওই ভিডিও গুলো পেলি কোথায়? তুই আমাকে ফলো করিস”?
শেহনাজ ঘাবড়াল না মোটেই। বাকি মেয়েগুলো তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল শেহনাজের দিকে। চোখের ইশারায় শেহনাজকে নরম থাকতে বলল। শেহনাজ শুনল না। রাগ, জেদ ওকে উন্মাদ করে তুলল। সত্য কথাই বলল,
-” আপনাকে ফলো করার প্রয়োজন পড়েনি। আপনি নিজে থেকেই আমার চোখে ধরা পড়েছেন। যে রাস্তায় আপনার প্রতিযোগী শহীদুল হককে মেরেছিলেন, সে রাস্তার পাশেই আমি থাকি”।
লোকটি একটি সিগারেট শেষ করে আরো একটি সিগারেট ধরাল। খানিক হেসে বলল,
-” ওই রাস্তার সকলেই আমাকে চেনে, জানে। কেউ তো মুখ খোলেনি। তুই কেন নিজের মৃত্যু ডেকে আনলি? বয়স তোর কম, এত দ্রুত মরার শখ”?
শেহনাজ সশব্দে হাসল। বলল,
-” আপনার কি মনে হয়? আমি আপনাকে ভয় পাই? আপনার মতো কাপুরুষকে আমি ভয় পাই না। একটুও না”।
বাহাদুরের হাসি নিভে গেল। মেয়েটি তাকে ভয় পাচ্ছে না জেনে তার রাগ হলো ভিষণ। শব্দ করে সে চেয়ার থেকে উঠল। শেহনাজের সম্মুখে এগিয়ে এলো। শেহনাজের চোখে চোখ রাখল। বাহাদুরের তীক্ষ্ম, সুচালো দৃষ্টি শেহনাজকে নত করতে পারল না। এতে যেন ক্ষোভ বাড়ল বাহাদুরের। শেহনাজের গাল তিন আঙ্গুল দ্বারা চেপে ধরল সে। উচ্চস্বরে বলল,
-“ভয় পাস না আমাকে? কি বলিস তুই? আমি কাপুরুষ? তোর এত সাহস তুই আমার চোখে চোখ রাখিস”?
শেহনাজের চোখে পানি নেই। ভয়কে গিলে খায় ও। লোকটার সামনে একটুও নত হতে ইচ্ছে করে না শেহনাজের, দমতে ইচ্ছে করে না। আরো তেজী কণ্ঠে সে বলে,
-” নিজের দিকে চেয়ে দেখুন। আপনি ঠিক কতটা পরিমাণে নোংরা, জঘন্য তা চেয়ে দেখুন। উপলব্ধি করুন। আপনি মানুষটা পৃথিবীর কাছে অভিশাপ স্বরূপ”।
শেহনাজের কথা শেষ হতেই বাহাদুর তার শক্তপোক্ত, পুরুষালি হাত দিয়ে থাপ্পড় বসার শেহনাজের গালে। ব্যথায় জ্বলে উঠল শেহনাজের গাল। গালে দাগ বসে গেল আঙ্গুলের। কপাল গিয়ে ঠেকল দেয়ালের কাছে। বেঁধে রাখা চুলগুলো খুলে চোখেমুখে লেপ্টে রইল। শেহনাজ চোখ বন্ধ করল। কিছু ভেবে বলল,
-” আপনি আমাকে মেরে ফেলতে চান তাই তো? বেশ! মেরে ফেলুন। কিন্তু আমি মারা গেলে আপনি এই সমাজে টিকে থাকতে পারবেন ভেবেছেন”?
পর পর আরো দুটো চড় পরল শেহনাজের ব্যথাতুর গালে। ঠোঁটের ফিনকিতে রক্ত জমাট বেঁধে গেল। ফর্সা, হলদেটে চেহারা লাল রঙ ধারণ করল। ব্যথায় টনটন করে উঠল পুরো মুখ। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা গিলল শেহনাজ। বাহাদুর শেহনাজের চুলের মুঠি ধরে দাঁড় করাল। দেয়ালের সাথে সজোরে ধাক্কা দিল। শব্দ হলো জোরে। মেয়েগুলো ভয়ে তটস্থ। কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে সকলে। প্রচণ্ড ব্যথা পেল শেহনাজ। ফুলে ফেপে উঠল কপাল। কিছুক্ষণের জন্য শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয় কাজ করা বন্ধ করে দিল। শেহনাজ তবুও কাঁদল না। ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে ফেলা মেয়েটি আজ এত ধৈর্য কোথা থেকে পেল জানা নেই। ওকে কাঁদতে না দেখে, অনুনয়, হাহাকার করতে না দেখে বাহাদুর চমকাল। অন্য মেয়েগুলো তো এতক্ষণে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়। এ মেয়ের সমস্যা কি?
বাহাদুর থামল। গর্জে উঠল। শেহনাজ তবুও মৃদ্যু হাসল। বলল,
-” আপনার কুকর্মের প্রমাণ আমি আরো অনেকের ফোনে সংরক্ষণ করে রেখেছি। আমি মারা গেলে ওরা আপনাকে ছিঁড়ে খাবে। মেরে ফেলুন আমাকে। কোনো সমস্যা নেই”।
শেহনাজ মিথ্যে বলল। মিথ্যে বলা ছাড়া এখন আর কোনো উপায় নেই। আগামীকাল নির্বাচন। বাহাদুর চাইবে না কোনোরকম দাগ তার চরিত্রে লাগুক। বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে প্রতিনিয়ত মিথ্যে বলতে হয়। শেহনাজ ও তাই করল। পুনরায় বলল,
-” আপনার এই মুখোশের আড়ালে থাকা নোংরা চরিত্রের কথা আমি ছাড়াও আরো অনেকে জানে। কতজনকে মারবেন আপনি? আমি হারিয়ে গেলে ওরা চুপ করে থাকবে ভেবেছেন”?
উন্মাদের মতো আচরণ করল বাহাদুর। শেহনাজের উক্ত কথায় দমল সে। ভয় পেয়েছে বোঝা গেল। রয়েসয়ে নিচু কণ্ঠে বলল,
-” কাকে পাঠিয়েছিস ভিডিও গুলো? বল কার কাছে আছে ওগুলো”?
শেহনাজ মনে মনে খুশি হল। বলল,
-” বলবো, কিন্তু তার আগে ওই মেয়েগুলোকে ছেড়ে দিতে হবে”।
বাহাদুর হাসল। সুন্দর হাসি। গালে টোল পরে। এত সুন্দর লোকের এত কুৎসিত রূপ শেহনাজকে বিমর্ষ করে তোলে। বাহাদুর বলে,
-” নিজের বাপের কথাই শুনি না, আর তুই কোন চ্যাটের বা’ল? তোর কথা শুনমু ক্যান? হারামজাদী, ক কার কাছে ওই ভিডিও দিছোস”?
-” ওদের ছেড়ে দিন। আমাকে ছেড়ে দিন। আমি সব ভিডিও ডিলিট করে দিবো”।
বাহাদুর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বলল,
-” আমারে বলদা পাইছোস? তোর মতো মাইয়ারে আমি বিশ্বাস করমু ভাবলি কেমনে। মা’গী তোর শরীর যদি কামড়াইয়া কুত্তারে দিতে পারতাম, মনডা শান্তি পাইতো”।
শেহনাজ কেঁপে ওঠে। এই প্রথম কেউ ওর সাথে এত খারাপ ব্যবহার করছে। অশ্রাব্য গালিগালাজ এই প্রথম কেউ তাকে করছে। রক্ত শূণ্য হয়ে পড়েছে শেহনাজ। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে শরীর। বাহাদুরের নোংরা কথা গুলো কাঁটার ন্যায় বিঁধছে গলায়। কান দুটো ঝা ঝা করছে। বাহাদুর পুনরায় গালি গালাজ ছুড়ল,
-” শরীর কুটকুট করে তোর? আমার পিছনে লাগতে আসছোস। আমার দিকে কেউ চোখ তুইলা তাকাইলে তার চোখ আমি তুইলা ফেলি। তোর মতো বে”শ্যার লগে প্রতিরাতে শুই। তোরে নষ্ট করতে কয় সেকেন্ড লাগবো আমার”?
শেহনাজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকায়। শারীরিক যন্ত্রণার চেয়ে বাহাদুরের এই নোংরা কথা গুলো খুব গায়ে লাগে শেহনাজের। গা গুলিয়ে আসে ওর। ঝিমঝিম করে ওঠে মগজ। মস্তিষ্কে বাজতে থাকে বাহাদুরের গালি গুলো। বাহাদুরের বাজে ইঙ্গিত, লোলুপ দৃষ্টি শেহনাজকে গুটিয়ে ফেলে। এরূপ পরিস্থিতিতে শেহনাজ আগে কখনো আটকায়নি। তার কান্না পাচ্ছে। গা দুলছে। ভেতরে চলছে কালবৈশাখীর ঝড়। লজ্জা, ঘৃণায় রি রি করছে শরীর।
-” আমাকে আপনার বে’শ্যা মনে হয়? ছিঃ কত জঘন্য মনোভাব আপনার। অবশ্য আপনার মতো নর্দমার কিট অন্যকে আর কি ভাবতে পারে? আপনি একটা শুয়োর, শকুন। অসহায়, অবলা মেয়েদেরকে ফাঁদে ফেলে তাদের জীবন নরকে পরিণত করেন। জনগনের হক মেরে খান। শহরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে চান। লজ্জা করে না না? একটুও অনুশোচনা হয় না? এই মেয়েগুলোর জীবন নষ্ট করতে একটুও বিবেকে বাঁধে না? আপনার মা আপনাকে এই শিক্ষা দিয়েছে? নারীদের সম্মান করতে শেখায়নি? নাকি আপনি কোনো জারজ সন্তান? কোনো পতিতালয়ে জন্মেছেন আপনি”?
বাহাদুরের রাগ উপচে পড়ে। বাকি মেয়েগুলো তখনও কাঁদছে। এত মারামারি খুনোখুনি ওদের সহ্য হচ্ছে না বোধহয়। শেহনাজের এমন তেজ তাদের বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। বাহাদুর শেহনাজের একদম নিকটে এলো। শেহনাজের গলা চেপে ধরল সে। আকস্মিক আক্রমণে শেহনাজ কাবু হলো। বাহাদুরের হাতের থাবায় গলায় দাগ বসে গেল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলো শেহনাজের। দম আটকে এলো। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল প্রায়। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে এলো। এই বুঝি শেহনাজ মারা যাবে। এক নোংরা পুরুষের হাতে তার মৃত্যু হবে ভাবতেই শেহনাজের কষ্ট বাড়ল। শ্বাস আটকে আসছে। বড়জোর কয়েক সেকেন্ড বাঁচবে। চোখ উল্টে যাচ্ছে। দম নিতে না পারার তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করছে শেহনাজ। এর মধ্যেই বাহাদুর ছেড়ে দিল শেহনাজকে। চুলের মুঠি ধরে একের পর এক চড় বসাল। খুক খুক করে কেশে উঠল শেহনাজ। বাহাদুর ওকে ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শেহনাজ বসে পরল মেঝেতে। ঘন ঘন দম ছাড়ল। মৃত্যুর এত নিকটে গিয়ে ফিরে এসে শেহনাজ উপলব্ধি করল তার আয়ু কম।
সৃষ্টিকর্তা ওকে বেশিদিনের জন্য পৃথিবীতে ছেড়ে দেননি।
______
শেহনাজের শরীর চলছে না। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওকে। টেনে হিঁচড়ে শরীরটাকে বাথরুমে নিয়ে এলো শেহনাজ। বাইরে কড়া পাহারাদারের ব্যবস্থা করেছে বাহাদুর। পালিয়ে যাবার কোনো সুযোগ নেই। ফোনটা প্যান্টের পকেটে রয়েছে। ছোট ফোন বিধায় পকেট থেকে বেরিয়ে পরেনি। ভাগ্যিস ফোনটা এনেছিল সাথে করে। শেহনাজ ফোনে থাকা সমস্ত ভিডিও এমিরের মেসেঞ্জারে পাঠাল। অতঃপর ফোন করল এমিরকে। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাঁপছে শেহনাজের। ধরা পরে যাবার ভয়ে শুকিয়ে আছে গলা। তবুও চেষ্টার কমতি রাখল না। এমিরকে সব জানাতে উদ্যত হলো।
এমির চলে এসেছে শেহনাজদের বাড়ির সামনে। হাতে কিছু শুকনো খাবার। শেহনাজ পছন্দ করে এসব। রোজ বাড়ি ফেরার পথে শেহনাজের জন্য খাবার কিনে আনে এমির। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গেট পেরিয়ে সিঁড়িতে উঠতেই ফোন বেজে উঠল এমিরের। ফোনের স্ক্রিণে শেহনাজের হাস্যজ্জ্বল মুখ ভেসে উঠল। মৃদ্য হাসল এমির। কল ধরল। বলল,
-‘ এই তো পাখি, এসে গেছি। দরজা খোলো। এক মিনিটে আসছি”।
এমিরের এহেন আদুরে কণ্ঠে ভেঙে পরল শেহনাজ। দুর্বল হলো শরীর। ফুঁপিয়ে উঠল সে। দু হাতে মুখ চেপে ধরল। ফিসফিস করে বলল,
-” আমাকে বাঁচান এমির। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে”।
শেহনাজের ক্রন্দনরত কণ্ঠ আর ফোঁপানোর আওয়াজ শুনে এমির উত্তেজিত হয়ে পরল। চিন্তার রেশ ঢুকে গেল মনে। ততক্ষণাৎ প্রশ্ন করল,
-” কি বলছো নাজ? কে মারবে? কোথায় আছো তুমি”?
শেহনাজ চোখ মুছল। বেশিক্ষণ বাথরুমে থাকতে পারবে না। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বাহাদুরের চ্যালা গুলো সন্দেহ করতে পারে। নিজেকে স্বাভাবিক করল শেহনাজ। বলল,
-” আপনাকে কিছু ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছি। ওগুলো দেখলেই সব বুঝবেন। আমাদের শহরের নেতা বাহাদুর খানের কুকর্মের কিছু ও
প্রমাণ আমি রেকর্ড করে ছিলাম। থানায় গিয়ে মামলা করেছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত থানার ছোটখাটো পুলিশ গুলো বাহাদুর খানের লোক। ওরা আমাকে তুলে নিয়ে এসেছে এমির। মেরে ফেলবে আমায়। আপনি কিছু একটা করুন এমির। আমি মরতে চাই না”।
এমিরের হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বক্ষস্থল কাঁপছে ওর। জিভ অসাড় হয়ে আসছে। শেহনাজের সব কথা শুনে এমির বলল,
-” তোমার কিছু হবে না পাখি। আমি আসছি। কিচ্ছু হবে না তোমার। তুমি কোথায় আছো বলো আমায়? আমি আসছি এক্ষুণি”।
শেহনাজ ঠিকানা জানাল। ফোন কাটল। ফোনটা সাইলেন্ট করে পুনরায় পকেটে গুজল। বের হবার সময় বাথরুমের এক কোণায় একটি চুলের কাটা দেখতে পেল শেহনাজ। এখানকার কোনো মেয়ের হবে হয়তো। কাটার দু পাশের লোহা ধারাল, তীরের মতো সুচালো। একবার যদি কাঁটা টা গলায় ঢুকে যায়? মরে যাবে না? শেহনাজ হাসল। তুখোড়, গভীর হাসি। আর কোথাও কোনো অস্ত্র পেল না যা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করা যায়। কাটাটি পকেটে রেখে শেহনাজ বেরিয়ে এলো। ছেলেগুলো বাইরেই দাঁড়িয়ে। হাতে বন্দুক। শরীরে আরো অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে বোধহয়। পালিয়ে যাবার পথ খোঁজে না শেহনাজ। সে যদি এখান থেকে ফেরে, মেয়েগুলোকে সাথে নিয়েই ফিরবে । এই বিশাল বাড়িটিতে অনেক গুলো ঘর। সব গুলো ঘরের বাইরেই পাহারাদার নিযুক্ত করে রেখেছে বাহাদূর। শেহনাজ অবাক হয়ে সব ঘরগুলোতে চোখ বুলাল। তার মানে আরো মেয়ে আছে এখানে? শতশত মেয়েকে বন্দী করে রেখেছে বাহাদুর?
শেহনাজকে টেনে হিঁচড়ে আবার ও ছোট্ট ঘরটিতে ছুঁড়ে মারা হলো। শেহনাজের মনে হলো কেউ তার শরীরের হাড় গুলোকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে। মেরুদণ্ড সোজা করতে পারছে না শেহনাজ। চোখ মুখ ফুলে একাকার। হাতে পায়ে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। শেহনাজ বুঝেছে বাহাদুর এত দ্রুত ওকে মারবে না। প্রমাণ আরো আছে শুনে বাহাদুর কিছুটা ভয় পেয়েছে। শেহনাজকে নিয়ে কি করবে এই ভেবে নিশ্চিত মাথা ঘামাচ্ছে বাহাদুর। ভেবেই হাসল শেহনাজ। তার মতো তুচ্ছ একটা মেয়েকে বাহাদুরের মতো প্রভাবশালী লোক ভয় পাচ্ছে? এ ও সম্ভব?
____
এমির দৌড়ে শেহনাজের ঘরে ঢুকল। মেসেঞ্জারে ঢুকে দেখল শেহনাজ কিছু ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছে। এমিরের ভিতরে যন্ত্রণা হচ্ছে। শেহনাজের চিন্তায় বুক ভার হয়ে আসছে। একটি ভিডিও এমির টেনে টেনে দেখল। তাতেই সবটা মস্তিষ্কে ঢুকে গেল ওর। ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা শেহনাজের বাবার ঘরে ঢুকল এমির। সাইফুল আলম বেলকনিতে বসে আছেন। এমির ছুটে গিয়ে সাইফুল আলমের পা জড়িয়ে ধরল। এমিরের চোখ জ্বলছে। বুক কাঁপছে। সাইফুল আলমের পা ধরেই সে বলল,
-” আব্বু শেহনাজ বিপদে পরেছে। ওর খুব বিপদ। আপনি দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন”।
আর কিছু বলতে পারল না এমির। কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো।
সাইফুল আলম চমকালেন এমিরকে এভাবে দেখে। শেহনাজের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে তার চোখটা লেগে গিয়েছিল। চোখ মেলল এমিরের ধরফর করে ওঠা কণ্ঠের ধ্বনিতে। এমিরের এহেন রূপ দেখে ভয় পেলেন তিনি। বললেন,
-” শেহনাজের বিপদ? কি হয়েছে? ও এখনো বাড়ি ফেরেনি”?
এমির নিজে যতটুকু জানে ততটুকু সংক্ষেপে জানাল। সবটা শুনে আরো চমকালেন সাইফুল আলম। সকালে শেহনাজের বলা কথাগুলো ভেসে উঠল মানসপটে। মেয়েটা এত দূর চলে গিয়েছে? বাহাদুরের মতো লোক তো ওকে খুবলে খাবে। কি করবে এবার? চিন্তায় তিনি মুচড়ে উঠলেন। বললেন,
-” শেহনাজ ঠিক আছে? ওর কিছু হয়নি তো”?
এমির আরো বিমর্ষ। চোখ মুখে আতঙ্ক ওর। শেহনাজকে হারিয়ে ফেলার ভয়টা বোঝা যাচ্ছে।
-” জানি না। ও বিপদে আছে। ওকে বাঁচাতে হবে। সাভার থানার লোকগুলো ওকে বাহাদুরের হাতে তুলে দিয়েছে। পুলিশ নিয়ে গেলে হবে না। আপনি দয়া করে থানার এস আই কিংবা কোনো বড় অফিসারের সাথে কথা বলুন আব্বু। আমি নাজকে হারাতে পারবো না। জানি না ও কি অবস্থায় আছে। আমার বাচ্চা ঠিক আছে কিনা আমি জানি না। যা করার দ্রুত করতে হবে”।
সাইফুল আলম কেঁদে ফেললেন। নিজেকে সামলাতে হিমশিম খেলেন। তার জানা শোনা অনেক বড় বড় অফিসারের নম্বর আছে। তাদের সাথে উনার সম্পর্ক ভালো। তিনি দেরি করলেন না। ততক্ষণাৎ ঢাকার এস পি, সিনিয়র অফিসার, আই এস কে কল করলেন। দু তিনটে থানায় যোগাযোগ করলেন। অনেক পুলিশ ফোর্স নিয়ে বের হলেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থণা করলেন শেহনাজ যেন সুস্থ থাকে।
_____
একের পর এক সিগারেট ধরাচ্ছে বাহাদুর। ক্ষমতা হারানোর ভয়ের প্রকোপ বাড়ছে। কাল নির্বাচন। এ সময় শেহনাজ নামক মেয়েকে মারবে নাকি বাঁচিয়ে রাখবে বুঝে উঠতে পারছে না। তার এক ছেলে তাকে বলল,
-” বস, মাইরা ফেলেন। যা হয় পরে দেখা যাইবো। বাঁচাই রাখলে আপনারই ক্ষতি। মাইয়ার তেজ ব্যাপক।
বাহাদুর চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
-” প্রমাণ নাকি আরো আছে। মাইরা ফেললে প্রমাণ পামু কই শা’লা। খা’নকি প্ল্যান কইরা সব করছে। মরার ভয় ও নাই। মরার ভয় থাকলে মুখ খুলতো এতক্ষণে”।
ছেলেটি বলল,
-” কিন্তু বস ওই মাইয়ার ভয় নাই, যাদের কাছে প্রমাণ আছে তাদের ভয় তো আছে। ওরা এত সহজে মুখ খুলবো নাকি? মাইয়াডারে এমন ভাবে মারতে হইবো যেন দেশের প্রত্যেকটা মানুষ ভয় পাইয়া যায়”।
বাহাদূর ভাবল খানিক। ভ্রূ চুলকে বলল,
-” মাইয়া আগুন সুন্দরী। ফিগার দেখছোস? ওর মতো তেজী মাইয়ারে বিছানায় নিলে শান্তি লাগে। দুর্বল মাইয়া মানুষ মৃত মানুষের মতো। ওদের লগে শুইয়া মজা পাই না”।
হাসল ছেলেটি। হেসে উঠল বাহাদূর ও। পৌরষত্ব জেগে উঠল যেন। চোখে দেখা গেল নারীর নেশা। পাঞ্জাবীর কলার টেনে চলে গেল শেহনাজকে বন্দী করে রাখা ঘরটিতে। শেহনাজ তখন শুয়ে আছে। মনে দুশ্চিন্তা। শরীরের প্রতিটি শিরায় শিরায় ব্যথা। নড়তেও ভয় করছে এখন। পেটের ব্যথা বেড়েছে। ডাঙায় আটকে পড়া আধমরা মাছের মতো তড়পাচ্ছে শেহনাজ। বাহাদুর ঘরে ঢুকল। শেহনাজের অতি কাছে এসে বসল। শেহনাজ ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। এতে বাহাদুর আরো বেশি উত্তেজিত হলো। শেহনাজের কব্জি টেনে ধরে উঠাল। ঘর থেকে টানতে টানতে বের করল তাকে। শেহনাজ বিস্ময়ে বিমূঢ়। কি করতে চাইছে লোকটা? প্রশ্ন ছুঁড়ল শেহনাজ। হাত ছাড়িয়ে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল। বলল,
-” কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমায়? জানোয়ার, পিচাশ, ছাড় আমাকে”।
হাসল বাহাদুর। আরো শক্তি প্রয়োগ করে শেহনাজকে টেনে অন্য ঘরে নিয়ে এলো। ছুঁড়ে মারল বিছানায়। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। বলল,
-” তোর মৃত্যু অবধারিত বুঝলি? মেরে ফেলার আগে একটু ছুঁয়ে দিবো তোকে। দেখি কত তড়পাতে পারিস তুই। সতীত্ব হারানোর পর ও তোর তেজ থাকে কি করে আমি দেখবো”।
শেহনাজ ঘাবড়াল ভিষণ। বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। অশ্রুকণা এবার বাঁধ মানল না কোনো। পেটে হাত রাখল শেহনাজ। বাচ্চাটার সবে আড়াই মাস। এ সময় শারীরিক মিলন হলে বাচ্চাটার ক্ষতি হতে পারে। তার এ শরীরের উপর শুধুমাত্র এমিরের অধিকার। আর কাউকে সে অধিকার শেহনাজ দিতে পারবে না। অন্য কোনো পর পুরুষ শেহনাজকে ছোবে এ কথা ভাবতেও পারে না শেহনাজ। যন্ত্রণা গুলো তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। এমির কখন আসবে? কখন তাকে এ নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করবে? নাকি আজ বাহাদুরের মতো নরপিচাশের হাতে শেহনাজের সতীত্ব বিলীন হবে? শেহনাজকে নোংরা ভাবে ছুঁয়ে দিবে লোকটা? ভাবতে পারে না শেহনাজ। এতক্ষণের জমিয়ে রাখা ভয়, আক্রোশ, হতাশা বেরিয়ে আসে। আর্তনাদ, চিৎকারে কেঁপে ওঠে ঘরটি। শেহনাজ লুটিয়ে পরে মেঝেতে। বলে,
-” আমাকে মেরে ফেলুন কিন্তু আমার সম্মানহানি করবেন না। এ কলঙ্ক আমি বয়ে বেড়াতে পারবো না। আপনি আমাকে মেরে ফেলুন। কষ্ট, যন্ত্রণা দিয়ে মারুন। তবুও আমার গায়ে হাত দেবেন না। আমাকে অপবিত্র করবেন না। আমার পেটে আমার সন্তান। ওর কোনো ক্ষতি করবেন না দয়া করে”।
বাহাদুর এবার যেন শেহনাজের দুর্বলতা খুঁজে পেল। বিশ্রীভাবে হাসল সে। শেহনাজের স্কার্ফটা খুলে ফেলল। শেহনাজ ধাক্কা দিল বাহাদুরকে। নিজেকে ওর হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করল। বাহাদুরের মতো পেশিবহুল, দানবীয় শরীরের শক্তির কাছে টিকতে পারল না শেহনাজ। শেহনাজের হাত মুচড়ে ধাক্কা দিয়ে ফেল দিল দূরে। শেহনাজ ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল। ঘরটিতে থাকা খাটের কোণার সাথে ধাক্কা খেল। পেটে চাপ লাগল সজোরে। চিৎকার করে উঠল শেহনাজ। পেটের ব্যথা বাড়ল। নাড়িভুঁড়ি পেঁচিয়ে ধরেছে যেন। যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল শেহনাজ। বাহাদূর এগিয়ে এসে শেহনাজের ঘাড়ে মুখ ডুবাল। শেহনাজ চমকে উঠল। ভয়, আতঙ্ক গ্রাস করল ওকে। থেমে কিছু ভাবল। বাহাদুর শেহনাজের ঘাড়ে কামড়াতে আরম্ভ করেছে। চুমু দিচ্ছে অনবরত। তার উত্তেজনা, আকাঙ্খা, শারীরিক চাহিদা বেড়ে চলেছে। আর কোনো দিক তার খেয়ালে নেই। নোংরা নেশায় মত্ত সে। মেয়েলি শরীরে সুখ খুঁজে চলেছে। শেহনাজ মুহূর্তটা কাজে লাগাল। প্যান্টের পকেটে থাকা কাটা বের করে চোখ বন্ধ করে বাহাদুরের গলায় বিঁধিয়ে দিল। আর্তনাদ করে উঠল বাহাদূর। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ছেড়ে দিল শেহনাজকে। লাথি দিয়ে সরিয়ে দিল দুরে। শেহনাজ পুনরায় এগিয়ে এসে পরপর চার বার কাঁটা টি বাহাদুরের গলায় ঢুকিয়ে বের করল। বাহাদুরের আক্রমণ থামল। টলতে লাগল সে। যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস করে উঠল। তার গলার পাশ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হলো। তপ্ত, লালচে তরল দ্বারা ভিজে গেল বাহাদুরের শুভ্র পাঞ্জাবী। গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করল। তেড়ে এসে শেহনাজের গলা চেপে ধরল বাহাদুর। আক্রোশ মেটাতে উদ্যত হলো। শেহনাজের দম বন্ধ হয়ে এলো। তবুও দমে থাকল না। কাটা দিয়ে পুনরায় বাহাদুরের চোখে গেঁথে দিল। বাহাদুর চেঁচাতেই ওর মুখ চেপে ধরল শেহনাজ। অন্য হাত দ্বারা বাহাদুরের আঙ্গুল মুচড়ে দিল। ইচ্ছে মতো কিল ঘুষি দিতে লাগল। নিজের ব্যথা, যন্ত্রণা উপেক্ষা করে শেহনাজ কেবল সেসকল মেয়েগুলোর কথা ভাবল, যারা দিনের পর দিন বাহাদুরের পায়ের নিচে থেকেছে। বাহাদুরের জন্য যে মেয়ে গুলোকে পতিতালয়ে যেতে হয়েছে। যাদের বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। তার যা খুশি হয়ে যাক, সে বাঁচুক বা মরুক। ওই মেয়েগুলোকে রক্ষা করতে হবে। সবাইকে তাদের পরিবারের নিকট ফেরত পাঠাতে হবে। শেহনাজের প্রতিশোধ স্পৃহা বাড়ল। ঘরে নজর বুলাল সে। বাহাদুর গোঙ্গাচ্ছে। চোখ উল্টে আসছে লোকটার। শেহনাজ কয়েক সেকেন্ডের জন্য বাহাদুরের মুখ থেকে হাত সরাল। ছোট্ট টেবিলের উপর থাকা ফুলদানিটা তুলে বাহাদুরের মাথায় প্রহার করল। সাথে সাথেই বাহাদুরের যন্ত্রণা প্রশমিত হলো। চোখ বুজল বাহাদুর। লুটিয়ে পরল মেঝেতে। শেহনাজ তবুও ঝুঁকি নিল না। বাহাদুরের শ্বাস চলছে কিনা তা অবলোকন করল কিছুক্ষণ। না প্রাণ নেই। মারা গেছে বাহাদুর। হাসল শেহনাজ। বিছানায় গিয়ে স্থির হয়ে বসল। পেটে হাত রাখল শেহনাজ। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। পেটের ব্যথাটা কমেছে এখন। বাচ্চাটা কি ঠিক আছে? এবার যে পালাতে হবে। শেহনাজ উঠে দাঁড়াল। তার পা বেয়ে রক্তের ফোঁটা অবিরত গড়াচ্ছে। চমকাল শেহনাজ। ভয়ে জবুথবু হয়ে তাকাল নিজের গোপন অঙ্গের দিকে। রক্তের প্রবাহ বাড়ছে। ভিজে গেছে মেঝে। পেট হালকা লাগছে। বাচ্চাটা কি মারা গেল?
চিৎকার করল না শেহনাজ। মুখ চেপে কাঁদল। শ্বাস নিতে কষ্ট হলো ওর। অঝর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে শরীর দুর্বল হয়ে উঠল। যন্ত্রণা, কষ্ট চেপে গেল শেহনাজ। শব্দহীন ভাবে দরজা খুলে বাইরে তাকাল। এ ঘরের সামনে কেউ নেই। কিন্তু এর পরের ঘরটার বাইরে ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে আছে। শেহনাজ ফোন বের করল। উপরের গ্লাস গুলো ফেটে গেছে। ভাগ্যিস ওরা জানে না শেহনাজের কাছে ফোন ছিল। নইলে কি হতো? শেহনাজ এমিরের নম্বরে ডায়াল করল। সাথে সাথে ফোন তুলল এমির। বলল,
-” এসে গেছি শেহনাজ। আরেকটু। তোমার কিছু হয়নি না? আমার বাচ্চা ঠিক আছে”?
শেহনাজ হু হু করে কেঁদে উঠল। আর্তনাদ করে উঠল। বলল,
-” ও নেই এমির। ও নেই। আমি ওকে বাঁচাতে পারিনি। আমাদের সন্তান মারা গেছে। আমার গর্ভে ওর অস্তিত্ব নেই। আমি ওকে মেরে ফেলেছি। আমি..আমি ওকে বাঁচাতে পারিনি”।
এমির থমকাল। ফোনটা হাত থেকে পরে গেল। হু হু করে কেপে উঠল এমিরের বুক। চোখ বুজে নিল সে। দু ফোঁটা অশ্রু ঝরল গাল বেয়ে। নিদারুণ কষ্টে মাথা চেপে ধরল এমির। বাচ্চাটা নেই? শেহনাজের গর্ভে বেড়ে ওঠা বাচ্চাটা
পৃথিবীর আলো দেখতে পাবে না? এমিরকে বাবা বলে ডাকবে না? ছোট ছোট আঙ্গুল দিয়ে এমিরের আঙ্গুল ধরবে না? বাচ্চাটাকে এমির কোলে নিতে পারবে না? একজন বাবার কাছে এর চেয়ে যন্ত্রণা আর কি হতে পারে? এমিরের সন্তান নেই। ওকে খুন করা হয়েছে। বিধাতা এ কোন খেলা খেলল তাদের সাথে? কেন খেলল? নিষ্পাপ বাচ্চাটার কি দোষ ছিল? সে কার কি ক্ষতি করেছে?
এমিরের পাশেই সাইফুল আলম বসে ছিলেন। শেহনাজের ফোন দেখে তিনি কিছুটা শান্তি পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
-” কি বলল শেহনাজ? ঠিক আছে তো”?
এমির মাথা নাড়ল নীরবে। হুট করে যেন সে শান্ত, স্থির হয়ে গেছে। বুকের পাশটা জ্বলছে। ভেঙে পড়েছে এমির। বাবা হবার আনন্দের চেয়ে বাবা না হতে পারার শোক যে ঢের বেশি তা বুঝতে পারছে। আনন্দ চিরকাল থাকে না, কিন্তু দুঃখ? দুঃখ বছরের পর বছর কুড়ে কুড়ে খায়। ধীর কণ্ঠে এমির উত্তর দেয়,
-” আমাদের সন্তান নেই। ওরা আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে আব্বু”।
সাইফুল আলম ঘাবড়ে গেলেন ভিষণ। অসহনীয় ব্যথায় বুক ভার হলো তার। মাথা নত করলেন তিনি। চোখ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরল। নিজেকে অনেক বেশি দোষী মনে হলো। মেয়েটার সাথে সে তো কম অন্যায় করেনি। নত কণ্ঠে বলল,
-” সব দোষ আমার। আমার জন্যই মেয়েটার আজ এই অবস্থা। শেহনাজ সকালে এসেছিল আমার কাছে। বাহাদুরকে নিয়ে প্রশ্ন করছিল। শেহনাজ হয়তো আমাকে ওই প্রমাণ গুলোর কথা বলতেই এসেছিল। কিন্তু আমার কথা শুনে মেয়েটা ভয় পেয়েছে। ও বুঝেছে যে আমি ওকে এসব কাজে এপ্রিশিয়েট করবো না, বাঁধা দেবো। বাহাদুরের সাথে লড়াইয়ে নামতে আমি কিছুতেই রাজি হবো না ও বুঝেছিল। তাই ও সব একা একা করেছে। নিজের কথা একটুও ভাবেনি”।
এমির চোখ বুজল। বিড়বিড় করে আওড়াল,
-” শেহনাজ, আমার শেহনাজ। আর কিছুক্ষণ। এক জীবনে আমি অনেক কিছু হারিয়েছি। তোমায় হারাতে পারবো না। তোমাকে হারানোর শোক সৃষ্টিকর্তা যেন আমাকে না দেয়। একবার শুধু তোমাকে পাই। সারাজীবনের জন্য আগলে রাখবো। কখোনো একা ছাড়বো না”।
অস্পষ্ট আওয়াজে আরো কিছুক্ষণ বিড়বিড় করল এমির। তার এই কথাগুলো কেবল সেই বুঝল। এক আধ ফোটা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে এমির প্রার্থনা করল। অন্তত শেহনাজ যেন অক্ষত থাকে।
পুলিশ ফোর্স সহ এমিররা পৌছাল কিছুক্ষণ পরেই। এমির প্রথমেই শেহনাজকে খুঁজল। পুলিশ গুলো একে একে বাহাদুরের সব ছেলেদের ধরে ফেলল। সবগুলো রুম থেকে প্রায় ষাট জন মেয়েকে বের করা হলো। সকলের স্টেইটমেন্ট নেওয়া হলো। শেহনাজকে খুঁজে পাওয়া গেল বদ্ধ ঘরে। বাহাদুরের লাশের পাশে। শেহনাজকে দেখা মাত্রই এমির ছুটে গেল। জড়িয়ে ধরল শেহনাজকে। শেহনাজ ক্লান্ত, দুর্বল চোখে এমিরকে দেখল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মৃদ্যু হাসল সে। চোখ আপনাআপনি বুজে এলো। শরীরের সবটকু ভার এমিরের উপর ন্যস্ত করেই ক্ষান্ত হলো শেহনাজ। এমির এমন ভাবে শেহনাজকে আগলে নিল যেন বুকের ভিতর মেয়েটাকে ঢুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। এমিরের এহেন শক্তভাবে জড়িয়ে ধরায় শেহনাজ ব্যথা পেল শরীরে। তবুও চুপটি করে বুকের মাঝে লুকিয়ে রইল। আবেশে বুজে নিল চোখ। আহ্ কি শান্তি! প্রিয় মানুষের বুকে এত সুখ কেন?
_______
টানা তিনদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি শেহনাজ। শেহনাজের শরীরের অবস্থা বিশেষ ভালো ছিল না। সারা শরীরে ক্ষত, মাথায় আঘাত। হাতের কব্জি থেকে হাড় খানিকটা ছুটে গেছে। পুরো মুখে অসংখ্য কাটাছেঁড়া, ব্যথার ছড়াছড়ি। সবচেয়ে বড় অসুস্থত?
#শেহনাজ ____অন্তিম পর্ব (শেষাংশ)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
টানা তিনদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি শেহনাজ। শেহনাজের শরীরের অবস্থা বিশেষ ভালো ছিল না। সারা শরীরে ক্ষত, মাথায় আঘাত। হাতের কব্জি থেকে হাড় খানিকটা ছুটে গেছে। পুরো মুখে অসংখ্য কাটাছেঁড়া, ব্যথার ছড়াছড়ি। সবচেয়ে বড় অসুস্থতা হলো শেহনাজের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা মৃত ভ্রূণের রক্ত। বাচ্চাটা নষ্ট হওয়ায় অনেক ব্লাড বেরিয়েছে। আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছিল শেহনাজ। শারীরিক কষ্টের চেয়ে মানসিক যাতনা তাকে তুলনামূলক বেশি পুড়িয়েছে, ভেঙেছে। নিজের অক্ষমতা, অপারগতা, আক্ষেপে শেহনাজ এ তিন দিন জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়েছে। এমিরের অবস্থা বর্ণনা করা যাবে না। গত তিন দিন সে সর্বক্ষণ হাসপাতালে থেকেছে। কয়েক মিনিটের জন্যও ঘুমোয়নি, বাড়ি ফেরেনি। এক ঢোক পানিও গেলেনি। শিমলা বেগম বাড়ি ফেরার কথা বারংবার বুঝিয়েছে এমিরকে। দু এক মুঠো খেতে অনুরোধ করেছে। এমির শোনেনি কারো কথা। মূর্তির ন্যায় বসে থেকেছে করিডোরে। কাতর হৃদয়ে কেবিনের বাইরে অপেক্ষা করেছে। তার মুখ খানা শুষ্ক, মলিন। প্রিয়তমার এমন অসুস্থতায় অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পরেছে সে। যেন কোনো কিছু বলার বা করার বোধশক্তি কিংবা ক্ষমতা হারিয়েছে এমির।
তিন দিন পর শেহনাজকে দেখতে কেবিনে এলো এমির। ইচ্ছে করেই এ তিন দিন শেহনাজের সম্মুখে আসেনি সে। শেহনাজের এমন করুণ দশা দেখতে ইচ্ছে করেনি কেন যেন। শেহনাজ এমিরকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। নিজের চেয়ে বেশি বোঝে এমিরকে। মেয়েটা এক পলকেই এমিরের মনের অবস্থা ধরে ফেলবে এই ভয়ে এমির কয়েক দিন দুরে দুরে থেকেছে। তাকে দেখে শেহনাজ না আবার দুর্বল হয়ে পড়ে।
এমির টুল টেনে বসল বিছানার পাশে। শেহনাজ শুয়ে আছে। হাতে ক্যানোলা। স্যালাইন চলছে। এমির শেহনাজের মাথায় হাত বুলাল। বদ্ধ চোখ জোড়া মেলল শেহনাজ। অস্ফুট স্বরে বলল,
-” কেমন আছো এমির”?
এই ছোট্ট, সাধারণ প্রশ্নেও এমিরের বক্ষস্থল কেঁপে উঠল। চোখের অশ্রু গুলো ঠিকড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। শেহনাজকে কি করে বোঝাবে সে ভালো নেই? শেহনাজের এরূপ অবস্থা এমিরকে কতটা পুড়িয়েছে, ভেঙেছে কিভাবে বোঝাবে? এ তিন দিনের একেকটি সেকেন্ড তার কতটা যন্ত্রণায় কেটেছে তা কি করে বলবে শেহনাজকে? বিশ্বাস করবে মেয়েটা? বিশ্বাস করবে যে এমির তার জন্য উন্মাদ হয়ে গেছে। তাকে কাছে পাওয়ার জন্য এমিরের বুকটা কতটা কাতর হয়ে আছে শেহনাজ তা বুঝবে? উপলব্ধি করতে পারবে এমিরের ভিতরের এক রাশ যন্ত্রণা গুলো।
রয়েসয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে এমির। শেহনাজের সামনে গলা শুকিয়ে আসছে ওর। জিভ ভার হয়ে আছে। ঢোক গিলে সে বলল,
-” এ প্রশ্ন আমার তোমাকে করা উচিত। তুমি ঠিক আছো নাজ? কষ্ট হয় এখনও? ব্যথা হয়”?
এমিরের আদুরে কণ্ঠে শেহনাজ দমে গেল। নীরবে, নিভৃতে দু ফোটা তপ্ত পানি গড়াল চোখের পাশ বেয়ে। বালিশ ভিজে গেল নোনাজলে। বুকের উচাতন বেড়ে গেল। বলল,
-“কষ্ট হয় এমির। খুব কষ্ট হয়। নিজের অক্ষমতা, অপারগতার কথা ভেবে কষ্ট হয় ভিষণ। বুকটা জ্বলে”।
এমির নিজেকে শান্ত রাখে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। শেহনাজের কপালে গভীর চুমু আঁকে সে। স্বান্ত্বনা দেয়,
-” সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো। আমরা আবারও বাচ্চা নেয়ার পরিকল্পনা করবো। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, দেখে নিও। শুধু তুমি ঠিক হয়ে যাও। আর কিচ্ছু চাই না আমার”।
শেহনাজ শুনল না সে স্বান্ত্বনা। বলল,
-” ওর তো সবে আড়াই মাস হয়েছিল এমির। ওর উপস্থিতি, ওর নড়াচড়া, ওর হার্টবিট কোনো কিছুই টের পেতাম না আমি। তবুও ও নেই শুনে খুব ব্যথা হচ্ছে বুকে। যন্ত্রণায় বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে। একে বুঝি নাড়ির টান বলে এমির? একেই বুঝি মাতৃত্ব বলে”?
এমিরের হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হলো। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। জিভ অসাড় হয়ে এলো। শেহনাজকে স্বান্ত্বনা দিতে এসে সে বুঝল তার নিজেরই একটু স্বান্ত্বনা, একটু মনোবল দরকার। নইলে শেহনাজ স্বাভাবিক হতে পারবে না।
শেহনাজ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করল এমিরকে। এ ক দিনে এমিরের চোখের নিচে কালি পড়েছে, দেবে গেছে চোখ। শুকিয়ে গেছে অনেকটা। সারাক্ষণ ভারিক্কি মেজাজ, ব্যক্তিত্ব নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষটাকে এখন শান্ত, ধীর-স্থির বলে মনে হচ্ছে। মানুষটার এহেন অবস্থা পীড়া দিচ্ছে শেহনাজকে। নরম কণ্ঠে সে শুধাল,
-” ঠিক মতো নিজের যত্ন নিচ্ছো না? এমন ফ্যাকাশে লাগছে কেন মুখ? আমি তো এখন ঠিক আছি। চিন্তা করছো কেন”?
হাসল এমির। বলল,
-” আমার যত্ন নেয়ার জন্য তো তুমি আছোই। তুমি ছাড়া এ অগোছালো আমিকে আর কে গোছাবে? তুমি সুস্থ হয়ে উঠলে আমি আবার আগের মতো হয়ে যাবো। তাই আগে তোমাকে সুস্থ হতে হবে”।
-“ও আমাকে বাজে ভাবে ছুঁতে চেয়েছিল এমির। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি ওকে বেশি কিছু করতে দিইনি। তার আগেই আমি ওকে আঘাত করেছি। মেরে ফেলেছি ওকে। আমি অপবিত্র হয়ে যাইনি বিশ্বাস করো”।
ঢুকরে কেঁদে উঠল শেহনাজ। এমির গম্ভীর হয়ে উঠল। চোখের কার্ণিশ রক্তিম হয়ে উঠল। এক হাত ডুবিয়ে দিল শেহনাজের গালে। শক্ত, কাটকাট কণ্ঠে বলল,
-” এসব কথা তুমি আর মুখে আনবে না নাজ। যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আর ভাববে না। তুমি অপবিত্র নও। বাহাদুরের মতো নোংরা লোক তোমাকে অপবিত্র করতে পারবে না”।
-” কিন্তু….,
-” কোনো কিন্তু নয়। তুমি আমার কাছে এখনও ঠিক আগের মতোই আছো। তুমি শুধু আমার শেহনাজ। আমি তোমাকে আগের চেয়ে আরো বেশি ভালোবাসবো, যত্ন নেবো। তুমি নিষ্পাপ। তোমার হৃদয়ে কেবল আমিই আছি। আমার নাজ, তুমি কলঙ্কিত নও। তোমাকে ওরা কলঙ্কিত করতে পারবে না। আমার নিকট তুমি স্নিদ্ধ, শুভ্র”।
শেহনাজ মাথা উঁচু করে এমিরের মুখের সামনে নিজের শুষ্ক অধর এগিয়ে দিল। হাসল এমির। নিজের অধর জোড়া চেপে ধরল শেহনাজের ওষ্ঠদ্বয়ে। গভীর চুমু খেল একে অপরকে। দম নেয়ার ফুরসৎ পেল না দুজন। খানিকক্ষণ নিবিড় সুখ যাপন করে ছাড়ল একে অপরকে। এমির শেহনাজের হাতে; চোখে, মুখে, ঘাড়ে চুমু খেল। নিজের অভিব্যক্তি, ভালোবাসা দ্বারা বোঝানোর চেষ্টা করল যে শেহনাজকে সে ভুল বোঝেনি। শেহনাজকে সে এখনো আগের মতোই ভালোবাসে। একটুও বদলায়নি এমির। বাহাদুরের নোংরা ছোঁয়া তাদের ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলেনি।
এমির শেহনাজের মাথা টিপে দিচ্ছে। চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শেহনাজ পুনরায় চোখ বুজল। মাথা ব্যথা করছে ভিষণ। চোখ মেলতে ইচ্ছে করছে না। পুলিশ এসেছে ইতোমধ্যে। থানার সেই জুনিয়র ইন্সপেক্টরকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। বাহাদুরের বিরুদ্ধে থাকা প্রমাণ গুলোও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরেছে। জনগন রীতিমতো ক্ষেপে উঠেছে। নির্বাচন বাতিল করা হয়েছে। বাহাদুরকে যারা এতদিন মাথায় তুলে রেখেছিল, তারাই আজ বাহাদুরের ছবি পা দিয়ে পিষছে, রাস্তার অলিগলিতে থাকা পোস্টার টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বাহাদুরের লাশ পোস্টমর্টেম করা হয়েছে। ওকে যে খুন করা হয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই কারো। শেহনাজ নিজেও সে কথা অকপটে স্বীকার করেছে। এখন শেহনাজ কিছুটা সুস্থ বিধায় পুলিশ এসেছে তাকে দেখতে। হাসপাতালের বাইরে ভীড় জমেছে। বাহাদুরের বাংলোয় আটকে থাকা সকল মেয়ে ও তাদের পরিবার শেহনাজকে দেখতে এসেছে। শহীদুল হকের স্ত্রী আর ছেলে মেয়েরাও এসেছে। সবাইকে সামলাচ্ছে পুলিশ ফোর্স। থানার এস আই কেবিনের দরজায় কড়া নারল। উনাকে কেবিনে ঢুকতে দেখে ভয় পেল শেহনাজ। বাহাদুরকে মেরে ফেলার অপরাধে কি তাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে ওরা? নিয়ে যেতে এসেছে? এস আই কে দেখে এমির টুল ছেড়ে উঠতে নিতেই তাকে আটকাল শেহনাজ। এমিরের বাহু চেপে ধরল সে। এমির শেহনাজকে আশ্বাস দিল চোখের ইশারায়। ভয় পেতে না করল। সে এখান থেকে যাবে না সে ভরসা দিল।
এস আই এসে টুলে বসল। শেহনাজ নিজেকে গুটিয়ে নিল। তিনি প্রথমে শেহনাজের নিকট দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন,
-” উই আর এক্সট্রেমলি স্যরি শেহনাজ। আমাদের পুলিশ ফোর্সের জন্যই তুমি এত বড় বিপদে পড়লে। নইলে সব কিছু প্রমাণ করা তোমার পক্ষে খুব সহজ ছিল। তোমাকে এতটা আঘাতপ্রাপ্ত হতে হতো না, যদি আমরা আমাদের দায়িত্ব প্রথমেই ঠিক ভাবে পালন করতাম। পুলিশ ফোর্স থেকে ওই জুনিয়র ইন্সপেক্টর কে আমরা বহিষ্কার করেছি। এ ভুল আর কখনো হবে না। আইন নিজেদের ধারা বজায় রাখবে”।
পুনরায় বলল,
-” এতটুকু বয়সেই তুমি যা করে দেখালে হ্যাটস অফ টু ইউ। তোমার জন্য অনেক গুলো মেয়ে তাদের মর্যাদা বজায় রেখেই পরিবারের কাছে ফিরতে পেরেছে। একজন খুনিকেও আমরা চিনতে পেরেছি। অযোগ্য নেতাকে শনাক্থ করতে পেরেছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ”।
শেহনাজ হাসল একটু। বলল,
-” আমি শুধু চেয়েছি মেয়ে গুলো ভালো থাকুক। কোনো নোংরা ষড়যন্ত্র ওদের জীবন যেন শেষ করে দিতে না পারে সেজন্য এতটা পথ পেরিয়েছি। আইন মানুষের রক্ষক স্যার। বাহাদুরের মতো নেতারা সে আইনকে নিছক খেলনা বানিয়ে ফেলেছে। আপনার কাছে অনুরোধ এসকল বিষয় গুলো একটু দেখবেন। টাকার বিনিময়ে কেউ যেন আইনকে কিনে নিতে না পারে তা একটু দেখবেন”।
-” অবশ্যই। আমরা এবার থেকে আরো কঠোর হবার চেষ্টা করবো। তার আগে বলো বাহাদুরকে তুমি খুন করলে কেন। এ কারণেই”?
শেহনাজ ভয় পেল। কারাগারে আটক করে রাখবে নাকি ওকে? আর কি পৃথিবীর আলো বাতাস দেখতে দিবে না? কি বলবে এখন? কোনো কথা বলল না শেহনাজ। সবকিছু চুপচাপ শুনছিল এমির। এবার এগিয়ে এলো সে। বলল,
-“বাহাদুর শেহনাজকে রে’ইপ করতে চেয়েছিল। আত্মরক্ষা করতে গিয়ে শেহনাজ ওকে খুন করতে বাধ্য হয়েছে। আমার জানামতে এক্ষেত্রে কোনো সাজা পাওয়ার আইন নেই। দন্ডবিধি-১৮৬০,১০০(৩) অনুযায়ী
নারী ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পেতে ধর্ষণের চেষ্টাকারীকে হত্যা করলে তা খুন বলে গণ্য হবে না”।
হাসলেন এস আই। মনে মনে এমিরের জ্ঞানের তারিফ করলেন। বললেন,
-” রিল্যাক্স মিস্টার এমির। আপনার স্ত্রী কে আমরা অ্যারেস্ট করতে আসিনি। আপনার স্ত্রী যা করেছে তাতে আমাদের উচিত উনাকে পুরস্কৃত করা। আমরা ওকে দেখতে এসেছি। এর জন্য যে আমরাই দায়ী”।
এমির স্বস্তি বোধ করল। শেহনাজের ভয় কমল। একেক করে সাইফুল আলম, শিমলা বেগম শেহনাজকে দেখে গেল। ভিক্টিম মেয়েগুলো শেহনাজকে দেখতে এসে অনেক গল্প করল। শতশত ধন্যবাদ জানাল ওকে। শহীদুল হকের স্ত্রী কান্নাকাটি করলেন শেহনাজকে দেখে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। শেহনাজ তৃপ্ত হলো। বুকের ভার কমে এলো।
পরিশিষ্ট
_________
সময় চলে যাচ্ছে নিজস্ব গতিতে। গরমকাল এসেছে। গ্রীষ্মের দাবদাহে পুড়ছে সকলে। আম, কাঁঠাল পেকেছে। জন জীবন বদলেছে অনেক। মেসের সম্মুখের রাস্তা পাকা হয়েছে। সকলেই নিজেদের জীবন গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। নয়ন ইতালিতে পাড়ি জমিয়েছে। যেদিন চলে যাচ্ছিল সেদিন সে কি কান্না নয়নের। কেঁদেকেটে বন্যা বানিয়ে দিচ্ছিল নয়ন। কিছুতেই যেতে চাইছিল না। বাচ্চাদের মতো এমিরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল অনেকক্ষণ। কেঁদেছে সাদাত আর এমির ও। বন্ধুদের এহেন হারিয়ে যাওয়া বড় কষ্টের ছিল সকলের কাছে। এখন নয়ন নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে বিদেশের মাটিতে। দিন চলে যাচ্ছে আগের মতো করেই।
সাদাত আর সোহার ব্রেক আপ হয়ে গেছে কোনো একটি কারণে। তাদের এখন আর যোগাযোগ নেই। সোহা বিয়ে করে ফেলেছে। সাদাত বর্তমানে নিজের কর্মে সক্রিয় রয়েছে। প্রেম আর বিয়েতে তার ব্যাপক ভয়। আর বিয়ে করবে না বলে ভেবে রেখেছে।
হাসান এখন মোটামুটি জনপ্রিয় লেখক। তার লেখা সাহিত্য জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একের পর এক পাণ্ডুলিপি চাইছে প্রকাশকরা। ব্যস্ত সময় পার করছে সে। বইয়ের মাঝে ডুবে থাকে প্রায়ক্ষণ। সময় পেলেই লিখতে বসে। তবে হাসানের জীবনেও ম্যাজিক্যাল ঘটনা ঘটেছে। তানিয়ার সাথে ডেট করছে হাসান। ভোলাভালা, সাধাসিধে ছেলেটা তানিয়ার মতো অপরিপক্ক মেয়ের প্রেমে পড়েছে। দীর্ঘদিন চ্যাট, ফোনালাপের পর ওরা বুঝতে পেরেছে তারা একে অপরকে ভালোবাসে। কিছুদিন পরই তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
______
শেহনাজের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এমির সর্বক্ষণ ওকে গাইড করেছে। ফলশ্রুতিতে শেহনাজ ভালো মার্কস পেয়ে পাস করেছে। বর্তমানে ভার্সিটিতে পড়ছে শেহনাজ। ব্যাংকে কর্মরত এমিরের স্যালারি বেড়েছে। এছাড়া একটি সরকারি কলেজে সকালের শিফটে পড়ায় সে। কোনো কিছুর অভাব নেই এখন ওদের সংসারে।
সকাল সকাল পত্রিকা, খবরের কাগজ দিতে লোক এসেছে। শেহনাজ ঘুমোচ্ছে। এমির উঠে বসল। দরজা খুলে খবরের কাগজ আর পত্রিকা সংগ্রহ করল। শেহনাজ এখন এসব পড়ে সময় কাটায়। পৃথিবীর সব খবর সে রাখে।
এমির ডাকল শেহনাজকে,
-” নাজ ওঠো। দশটা বাজে সোনা। উঠে পড়”।
শেহনাজ ডাক শুনল। কিন্তু উঠল না। একটু নড়েচড়ে আবার ঘুমোতে লাগল। এমির আর ডাকল না শেহনাজকে। উঠে গিয়ে রুটি আর অমলেট করল। ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে পুনরায় ডাকল শেহনাজকে।
-” অ্যাই মেয়ে, ওঠো। খেয়ে নাও। আবার বাচ্চা এতক্ষণ ধরে না খেয়ে আছে তোমার জন্য। ওঠো। কান ধরে জাগাতে হবে”?
-” উঠছি তো। এত তাড়া দিতে হয়”?
শেহনাজ আড়মোড়া ভাঙল। হাই তুলে উঠে বসল। তাকে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল এমির। সাত মাসের গর্ভবতী শেহনাজ। পেট ফুলেছে ওর। পায়ে পানি জমেছে। এহেন অবস্থায় হাঁটাচলা করতে কিছুটা বেগ পেতে হয়।
শেহনাজ ব্রাশ করল। চুলটুল বাঁধল। এমির খাইয়ে দিল ওকে। হাত পা টিপে দিল। বলল,
-” ঠিক মতো খেতে হবে নাজ। নিজের যত্ন নিতে হবে। একটু পর ফল খাবে। ফল খেলে বাচ্চার পুষ্টি বাড়বে। ঠিক আছে”?
বাচ্চাদের মতো দু পাশে মাথা নাড়ল শেহনাজ। বলল,
-” অত খেতে ইচ্ছে করে না”।
পেটের দিকে আঙ্গুল তাক করে আবার বলল,
-” ও কবে আসবে আমার কোলে? কবে আমি ওকে জড়িয়ে ধরবো? এ পেট নিয়ে আর ঘুরতে ইচ্ছে করে না”।
হাসল এমির। বলল,
-” আর দু মাস। একটু সহ্য করো পাখি”।
শেহনাজ বুঝল। বলল,
-” ও কার মতো হবে? আমার মতো? নাকি তোমার মতো”?
-” যার মতোই হোক। ও আমাদের সন্তান, এটাই ইম্পর্ট্যান্ট। তোমার মতো হোক। তোমার মতো সাহসী, শক্তিশালী, ছটফটে, দুরন্ত হোক। আমার একটা ছোট্ট শেহনাজ চাই”।
ভেংচি কাটল শেহনাজ। বলল,
-” আগে তো বলতে আমি বেহায়া, নির্লজ্জ। এখন আমার মতোই বাচ্চা চাইছো”?
এমির গভীর ভাবে দেখল শেহনাজকে। ওই ঘটনার পর বেশ কিছুদিন মানসিক ট্রমার মাঝে ছিল শেহনাজ। নিজেকে গোছাতে অনেকটা সময় নিয়েছে সে। এমির ততদিন কত দুঃখেই না দিন কাটিয়েছে। শেহনাজের মতো চটপটে মেয়ে একদম শান্ত হয়ে গিয়েছিল। কথা বলতো না ঠিকমতো, খেতো না। রাত হলেই বাচ্চার কথা ভেবে কান্নাকাটি করতো। এমির সবকিছু ছেড়ে শুধু শেহনাজকে সামলাতো, আশ্বাস দিতো। একটি নতুন দিনের আশায় অপেক্ষা করতো। আহ্ কি ভয়ঙ্কর দিনগুলো ছিল।
_____
ছাদের গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে এমির। চাঁদ গাড় আলো ছড়াচ্ছে। রাস্তায় যানবাহন চলাচলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এমির চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাসল আনমনে। চাঁদকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
-” তোমার সাথে কেন মানুষের তুলনা করা হয় চাঁদ? আমি তো মনে করি মানুষ পৃথিবীর সমস্ত তুলনার উর্ধ্বে। আমার শেহনাজ তোমার চেয়েও উজ্জ্বল। তোমার চেয়েও পবিত্র”।
বলেই ফিক করে হাসল এমির। দন্ত চকচক করে উঠল ওর। অগোছালো অবিন্যস্ত চুলগুলো ছড়িয়ে রইল ললাটে। বলল,
-” এই রে। আমিও তো তুলনা করে ফেললাম। তবে তোমার সাথে শেহনাজের নয়, শেহনাজের সাথে তোমাকে তুলনা করলাম। শেহনাজ এমন একটি মেয়ে, যাকে ভালো না বেসে পারা যায় না, যাকে আপন করতে একটুও দ্বিধা হয় না। শেহনাজ আস্ত একটা মায়া। যে মায়ায় পরে আমার এক জীবন কাটিয়ে দেয়ার শখ”।
আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা একটি তারার দিকে তাকিয়ে এমির পুনরায় বলল,
-” আম্মা। আমি আজ অনেক খুশি আম্মা। শেহনাজের সাথে আমি অনেক সুখী । শেহনাজের মতো মেয়ে হয় না আম্মা। আমি ভেবে পাই না শেহনাজ কি করে এত ভালোবাসতে পারে? কি করে এত বদলাতে পারে ভালোবাসার মানুষের জন্য? আমার জন্য মেয়েটা কতকিছুই না সহ্য করেছে। তুমি যদি দেখতে পেতে তবে বুঝতে। এত কিছুর পরও মেয়েটা আমাকে ছাড়েনি কখনো। আলাদা হয়নি আমার থেকে। আমি কি ওর ভালোবাসার যোগ্য আম্মা? আমি কি ওকে ডিজার্ভ করি”?
ছলছল করে উঠল এমিরের চোখ। কাঁদতে আরম্ভ করল ছেলেটা। বসে পরল ছাদের কোণ ঘেঁষে। বিড়বিড় করে বলল,
-” আমার নাজ। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার এত এত খুশির কারণ শুধুমাত্র তুমি নাজ। তুমি ছাড়া এই এমির শূণ্য।
তোমার এই ঋণ আমি কি করে শোধ করবো নাজ? তুমি আমায় যতটা ভালোবাসো সব কড়ায়গন্ডায় পুষিয়ে দিলে কি এ ঋণ শোধ হবে? নাকি এ ঋণ কখনো শোধ হবার নয়?
সমাপ্ত
(নোটঃ #শেহনাজ উপন্যাস নয়, গল্প। এটি একটি নারীকেন্দ্রিক গল্প। যেখানে আমি একটি মেয়েকে ভালোবাসার মানুষের জন্য উন্মাদ বানিয়েছি। মেয়েটিকে অন্য সব মেয়েদের থেকে আলাদা করেছি। শেহনাজ নামক নিখুঁত মেয়েটিকে বারংবার ভেঙে আবার গড়েছি। পুরুষকেন্দ্রিক গল্প, উপন্যাস পড়ে হাঁপিয়ে যাওয়া পাঠকরা এ গল্পটি পড়তে পারবে। নায়ক সবকিছু করবে, নায়কের বিশাল বর্ণনা থাকবে গল্প জুড়ে, এমন গল্পের বাইরে গিয়ে লিখেছি এটা। তাই নাম রেখেছি শেহনাজ। আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য গুলো এ পর্বে অবশ্যই জানাবেন।)