#হট_চকোলেট
পর্ব-৩
তমালের কাহিনী শুনে চোখ কপালে ওঠার জোগাড় হলো শুভর। না, তমালকে শারিকা ওর মতো করে ফাঁসায়নি, এদের ঘটনা অন্য। এই ঘটনাবলির শুরু অনেক আগে।
তমাল বলছে, “তখন স্কুলে পড়ি। ক্লাস এইট থেকে নাইনে ওঠার সময় আমাদের ক্লাসে একটা অদ্ভুত রকমের নতুন মেয়ে এলো। অদ্ভুত মানে মফস্বলে আমরা ছেলে মেয়েরা একটু আলাদা আলাদাই থাকতাম৷ ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে অত আন্তিরক বন্ধুত্ব হতো না৷ এই মেয়েটা আসার পর মেয়েদের সাথে সাথে ছেলেদের সাথেও খুব খাতির করে ফেলল। একেবারে যেন গলায় গলায় ভাব। ছেলেদের আড্ডায় এসে যোগ দেয়া, ওদের সাথে চায়ের দোকানে গিয়ে বসা, টুকটাক এডাল্ড জোক করা। প্রথম প্রথম খুবই অস্বস্তি হতো আমাদের। কিন্তু মাস কয়েক যেতে না যেতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। ও আমাদের ছেলে গ্যাংয়েরই একজন হয়ে গেল।
কিন্তু অস্বস্তি কাটার পর একটা নতুন সমস্যা দেখা দিল। আমরা সবাই কমবেশি মেয়েটার প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করলাম। সরাসরি কেউ কিছু বলতাম না, কিন্তু বুঝতে পারতাম। মেয়েদের সাথে অত ক্লোজভাবে আমরা কখনো মিশিনি, তাই মেয়েটা যখন আমাদের গা ঘেঁষে দাঁড়াত, কাঁধে হাত রেখে গল্প করত তখন আমাদের অন্যরকম ভালো লাগতে শুরু করল। ও ছেলেদের মতো জামাকাপড় পরত। যেহেতু মফস্বল ছিল, অত খোলামেলা সম্ভব না, দেখা যেত শার্ট প্যান্টের সাথে ওড়না ঝুলিয়ে এসেছে। আমাদের সাথে আড্ডা দেবার সময় সে ওড়না পাশে রেখে আমাদের মতোই শার্টের ওপরের বোতাম খুলে বসত। আমাদের ছেলেদের চোখ তখন কোথায় যেত তা আর বললাম না৷ ও ইচ্ছে করে এই কাজ করত জানি না। আমারা ওকে কোন দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছিলাম তাও খেয়াল করত কি না জানি না।
যাই হোক, এভাবে অনেকগুলো দিন পার হয়ে গেল। ফাইনাল পরীক্ষা আসবে আসবে করছে। এমন সময় একদিন মেয়েটা আমাকে একটা চিঠি দিল। চিঠিতে লেখা, আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি তো খুশিতে বাকবাকুম। সবার মধ্যে কি ওর আমাকেই মনে ধরল?
দেখা করলাম সেদিন বিকেলে। নদীর ধার, কাশবন দিয়ে হাত ধরে ঘুরলাম। ফেরার সময় হঠাৎ আমাকে চুমু খেল সে। আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না ব্যাপারটা। ওটা ছিল আমার ফার্স্ট কিস।
এরপর মাঝেমধ্যে লুকোচুরি করে দেখা করতাম৷ বার্ষিক পরীক্ষায় আমার সিট আর ওর সিট কাছাকাছি পড়েছিল। আমাদের রোল ওয়াইজ এমনভাবে সিট পড়ত যে আগে থেকে বোঝা যেত কার পাশে কার সিট পড়বে। পরীক্ষায় আমি ওকে যথাসম্ভব সাহায্য করলাম। বলা চলে ভালোভাবে পাশ করিয়ে দিলাম।
এরপর তো ছুটি হয়ে গেল। ওর সাথে তেমন যোগাযোগও হলো না। ক্লাস টেনে ওঠার পর প্রথম সপ্তাহে মেয়েটা আমাকে জানিয়ে দিল, তার খুব স্ট্রেস যাচ্ছে, সে সম্পর্ক কন্টিনিউ করতে পারছে না, কিছুদিন যেন আমরা একটু দূরত্ব বজায় রাখি।
আমার শুরু থেকেই সন্দেহ ছিল মেয়েটা পরীক্ষার জন্য আমার সাথে এসব করেছিল। নিশ্চিত হলাম তখন যখন দেখা গেল নতুন রোলে যার সাথে সিট পড়বে তার সাথে ওর বেশি মাখামাখি দেখে৷
যাই হোক, আমি আর পাত্তা দিলাম না। কিছুটা মুখচোরা টাইপ ছিলাম, ব্যাপারটা সবার কাছ থেকে চেপে গেলাম। আর একটা মেয়ের থেকে ইউজড হওয়ার কাহিনী তো সবার সাথে বলার মতো না।
আমাদের টেস্ট পরীক্ষার পর একটা ভয়াবহ জিনিস বের হলো। তখন অল্প ক’জনের কাছে এন্ড্রোয়েড ফোন আছে। সেই ফোনে ফোনেই দেখা গেল কিছু ছবি ভাইরাল হয়েছে। ওই মেয়েরই ছবি। গায়ে একটা পাতলা ওড়না ছাড়া আর কিছু নেই। কিছুদিন এটা নিয়ে বেশ শোরগোল চলল। মেয়েটা খুব কান্নাকাটি করল। ক্লাসের প্রায় সব ছেলেমেয়ে ওকে একপ্রকার বয়কট করে দিল।
এরও কিছুদিন পর জানা গেল আরও ভয়াবহ ঘটনা। এই মেয়ে শুধু আমার সাথেই না, ক্লাসের আরও অনেকের সাথে নানান রকম সুযোগ সুবিধা আদায় করার জন্য সম্পর্ক চালিয়ে গেছে। পরে কাজ আদায় হয়ে গেলে সম্পর্ক ডিসমিসও করে দিয়েছে। আর ওর ছবিগুলো ভাইরাল করেছিল পাশের এলাকার এক ছেলে, যার সাথে ওর প্রায় তিন বছরের সম্পর্ক ছিল। সম্পর্ক থাকাকালীন অন্য ছেলের সাথে ধরা খাবার পর ওই ছেলে কাজটা করেছে। যদিও মেয়েটা ওই ছবির ব্যাপারে বলেছিল যে সে শখ করে ওগুলো তুলেছিল, পরে ভুলে দোকানে সেই মেমোরি কার্ড দিয়েছিল গান লোড করতে, সেখান থেকে ভাইরাল হয়েছে৷ আমরা অবশ্য বেশিরভাগই ওর কথা বিশ্বাস করিনি।
তো এসব ঘটনার পর এসএসসি পরীক্ষা চলে এলো। আমরাও পরীক্ষার ঝামেলায় ওকে ভুলে গিয়েছিলাম৷ তোদেরও কখনো ওর কাহিনী বলা হয়নি।
সেদিন অর্কর বাড়িতে দাওয়াতে গিয়ে ওর বউকে দেখে আমার চোখ কপালে উঠে যায়৷ ওর বউ শারিকাই আমাদের স্কুলের সেই মেয়েটা।
তুই তো জানিস, অর্কর বিয়ের সময় বাবা কত অসুস্থ ছিল, আমি কোনোরকম বন্ধুত্বের খাতিরে গিয়ে খেয়ে এসেছি, ওর বউয়ের দিকে ভালো করে চেয়েও দেখিনি৷ তার ওপর ভারি মেকআপ করা ছিল। নইলে হয়তো তখনই চিনতে পারতাম।
সেদিন অর্কর সামনে কিছু বলতে পারিনি। এরপর ফেরার পর থেকে শারিকা আমাকে থ্রেট দিয়ে যাচ্ছে, যদি ওর ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গও অর্ক জানতে পারে, তাহলে সে আমাদের খবর করে ফেলবে। ফ্রেন্ড সার্কেল ধ্বংস করে দেবে। আমি বুঝতে পারছি না ও কেন বারবার ফ্রেন্ড সার্কেলের কথা বলছে। অর্কর সাথে বন্ধুত্ব এ কারনে নষ্ট হতে পারে, কিন্তু বারবার সে ফ্রেন্ড সার্কেলের কথাই কেন বলে যাচ্ছে!”
সব শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুভ বলল, “হয়তো আমি কারণটা বুঝতে পারছি।”
“কী কারণ?”
“তুই আমাকে ভুল বুঝবি না তো?”
“ভুল বুঝব কেন?”
“প্লিজ আমাকে খারাপ ভাবলেও ছেড়ে যাস না।”
“আরে কী হয়েছে বলবি?”
শুভ আস্তে আস্তে সবটা খুলে বলল। শুনে তমাল একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। ঘটনা অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। মেয়েটা কি অসম্ভব চতুর! একটা মেয়ে এত খারাপ কেমন করে হতে পারে?
শুভ বলল, “তোর কি মনে হয় আমি অনেক খারাপ মানুষ?”
“দেখ শুভ, তোকে আমি কত বছর ধরে চিনি বল তো? আর ওই মেয়েটাকেও চিনি। কিভাবে কী হয়েছে সেটা বুঝতে পারছি। তোর দোষ অবশ্যই ছিল, তুই অনেক জঘন্য একটা কাজ করেছিস। তবে তোকে খুব খারাপ মানুষও বলতে পারব না। খারাপ হলে তোর আজকের রিয়ালাইজেশনটা হতো না। যাকগে, এখন আমাদেরও বাঁচতে হবে আর অর্ককেও বাঁচাতে হবে।”
“কিন্তু কিভাবে?”
“আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। ওই মেয়ে এত সহজে তোকে পটিয়ে ফেলল, তাহলে ওর জন্য তোর মতো বা তোর থেকেও অনেক ধনী কাউকে পটিয়ে বিয়ে করে ফেলা কোনো ব্যাপারই ছিল না। তাহলে সে অর্কর মতো একটা মিডল ক্লাস, ছোটোখাটো চাকরিজীবী ছেলেকে কেন বিয়ে করল? ধনী কাউকে বিয়ে করলে ওর আর এসব করে নিজের শখ পূরণ করতে হতো না।”
“তাই তো!”
“শোন, অর্ককে এখন কিছু বলা যাবে না। আমরা চেষ্টা করি শারিকার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করার। ওর ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করলে অনেক খবর হয়তো পাওয়া যাবে। আমি স্কুলের দিকের বন্ধুবান্ধবের থেকে খোঁজ নিয়ে দেখি ওর স্কুল থেকে এ পর্যন্ত আসার কাহিনী জানা যায় কি না।”
“ঠিক আছে।”
“তুই এত চিন্তা করিস না। ভালো করে ঘুম দে। আর ওর আইডিটা ব্লক করে দে। অচেনা নাম্বারের কল রিসিভ করিস না। বাঁচতে চাইলে ওকে ইগনোর কর পুরোপুরি।”
“এখনই করি। তোর সামনে।”
শুভ শারিকার আইডি, ফোন নাম্বার সব ব্লক করে দিল।
তমাল উঠতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কথাটা মনে হতেই জিজ্ঞেস করল, “তোকে যে ও এতকিছু দেখাল, তুই স্ক্রিনশট নিসনি?”
“না তো। সেরকম কিছু মনেই আসেনি।”
“আর ও যদি তোর স্ক্রিনশট নিয়ে থাকে?”
শুভর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। গতরাতে যা হয়েছে তার স্ক্রিনশট থাকলে ব্যাপারটা শুধু বন্ধুত্বের না, ওর ইমেজের, এমনকি পুরো ক্যারিয়ারের জন্য হুমকি।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু