#হট_চকোলেট
পর্ব-৪
তমাল চলে যাবার পর শুভ প্রায় সারাটাদিন অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে দিল। কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারল না সে। একেকবার একেক সম্ভাবনা মাথায় উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল, আর তার ভয় ক্রমশ বাড়তে লাগল। কোনোদিন ভাবেনি সে এমন সমস্যায় পড়তে হবে। তার তো চরিত্রের সমস্যা ছিল না৷ তবে এত সহজে সে কেমন করে ধরা দিত? এতটুকু সংযম কেন সে দেখাতে পারল না? নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে নিজের কাছেই ছোটো হতে লাগল সে।
সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ তার মনে হলো কারো পরামর্শ নিলে কেমন হয়? তমাল তার বন্ধু। তাদের চিন্তাধারার অনেক মিল। অন্য কেউ, যে তার সমস্যাটাকে অন্যভাবে দেখে সঠিক কোনো সমাধান দিতে পারনে এমন কারো সাহায্য নিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এই ভয়ানক লজ্জার কথা সে কাকে বলবে?
ভাবতে ভাবতেই নতুন একটা বুদ্ধি মাথায় এলো তার। ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ আছে যেগুলোতে পোস্ট করলে অনেকে ভালো ভালো পরামর্শ দিয়ে থাকেন। নিজের নাম লুকিয়ে অ্যানোনিমাসলি পোস্ট করলে কেউ তাকে চিনতেও পারবে না, আর সে হয়তো সঠিক সমাধানও পেতে পারবে।
বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে সে ঠিক করল পোস্টই করবে। তারপর যা হয় হবে। ফেসবুকে একটা সমস্যা সমাধানের গ্রুপে ঢুকে সে নিজের নাম ঢেকে পোস্ট করে ফেলল। কথাগুলো লেখার সময় তার নিজেরই এত গা ঘিনঘিন করতে লাগল যে কয়েকবার লেখা থামিয়ে চুপচাপ বসে রইল সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরোটা লিখে শেষ করে আর ভাবাভাবি না করে পোস্টটা করে দিল সে।
কিন্তু পোস্ট পেন্ডিং রয়ে গেল। এপ্রুভ হলো না সে রাতে। এদিকে শারিকার কল করার সময় হয়ে এসেছে।
শুভর ভয় হতে লাগল, শারিকা যদি তাকে না পেয়ে তার স্ক্রিনশট ফাঁস করে দেয়? এই স্ক্রিনশটের চিন্তাটা তাকে কিছুতেই স্থির হতে দিচ্ছে না। নাহ, শারিকার সাথে কথা বলতে হবে মনে হচ্ছে। কথায় কথায় জানতে হবে ওর কাছে এরকম কোনো প্রমাণ আছে কি না যা সে তার বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারে।
শুভ শারিকাকে আনব্লক করে রাখল। তবে নিজে থেকে কোনো মেসেজ দিল না। অপেক্ষা করতে লাগল শারিকার কলের আর একইসাথে পোস্ট এপ্রুভ হবার।
পোস্ট পেন্ডিং রয়ে গেলেও শারিকা ঠিকই রাত একটায় কল করল। আজ সে পাতলা গোলাপি একটা টিশার্ট পরে আছে। ভেতরে কিছু পরেনি বোঝাই যাচ্ছে। শুভ তখুনি একটা স্ক্রিনশট নিয়ে রাখল।
শারিকা নিজের চুলগুলো এলোমেলো করে বলল, “আমাকে কেমন লাগছে?”
শুভ ঢোক গিলে বলল, “ভালো।”
“তুমি সবসময় এত নার্ভাস থাকো কেন? ওহ স্যরি, কাল শেষের দিকে খুব একটিভ ছিলে। তার মানে তোমাকে একটিভ করতে কী করতে হবে তা আমার জানা আছে।”
“দেখো শারিকা, এসব উচিত হচ্ছে না।”
“খুব হচ্ছে। আমরা দু’জনে এডাল্ট। আমাদের যা খুশি আমরা করতে পারি। হু কেয়ারস?”
“তোমার হাজবেন্ড আমার বন্ধু।”
“ও না জানলেই তো হলো, তাই না? জানবে না। তুমি না বললেই হবে।”
“যদি অন্য কোনোভাবে জানে?”
“কিভাবে জানবে?”
“তোমার কল রেকর্ড থেকে, বা ধরো কোনো ছবি বা স্ক্রিনশট থেকে?”
“ধুর! কল হিস্টি সব ডিলিট করে রাখি। আর ছবিটবি আমি ফোনে রাখব কেন? পাগল নাকি? কোনো প্রমাণ নেই। কেউ ধরতে পারবে না। শোনো না, আমার একটা ভালো মোবাইল লাগবে৷ তোমাকে সুন্দর সুন্দর ভিডিও করে পাঠাব। এই ফোনটার ভিডিও কোয়ালিটি একদম বাজে!”
“আচ্ছা।”
“আচ্ছা কী? কিনে দেবে না বলো? প্লিজ? প্লিজ? প্রথম ভিডিওটা তোমাকে করে পাঠাব। প্রমিজ! আমার একটা লাল শাড়ি আছে, ওটা পরলে নাকি আমাকে অপ্সরার মতো লাগে। ওটা পরব। বলো কিনে দেবে মোবাইল?”
“দেব।”
“কবে?”
“দেখি।”
“দেখি? আমার আজই টাকা চাই। কাল শপিংয়ে যাব। নাকি তুমি সাথে গিয়ে কিনে দিতে চাও? কোনটা? দেখা হয়ে গেলে আরও অনেক কিছু হতেই পারে..” বলতে বলতে শারিকা টিশার্টটা গলা পর্যন্ত তুলে ফেলল। চোখে মাদক দৃষ্টি এনে বলল, “বলো, আজ কী চাও?”
শুভ স্ক্রিনশট নিতে ভুলল না৷ তার আজ কেমন যেন গা গুলিয়ে আসছে। শারিকার লোভী দৃষ্টি, ওর লোভী কথাবার্তা তাকে ভেতর থেকে যেন গলা চেপে ধরল। সে বলল, “আজ কিছু চাই না শারিকা। আমার প্রচন্ড মাথাব্যথা।”
“তার মানে তুমি মোবাইলটাও দেবে না?”
“ভেবে দেখব।”
শারিকা যেন ভীষণ আশাহত হলো। শুভরও খারাপ লাগছিল ওর মুখের ওপর ফোন রেখে দিতে। কিন্তু সে কাজটা করল। তারপর ব্লক করে দিল। আর চিন্তা নেই, এতটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে যে শারিকার কাছে কোনো স্ক্রিনশট অন্তত নেই।
ফোন রেখেও আর ঘুমাতে পারল না শুভ। ছটফট করতে লাগল কেবল। শারিকা তাকে আজও চুম্বকের মতো টানছে। অস্থির লাগছে। ওকে আবার ফোন করতে ইচ্ছে করছে। দেখতে ইচ্ছে করছে। কাছে পেতেও ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে কাল ওকে একটা মোবাইল কিনে দিয়ে ওর সাথে কিছুটা সময় কাটালে মন্দ হতো না। হোক বন্ধুর বউ, কিংবা খারাপ মেয়ে, যা খুশি তাই! কোনো মেয়ে এভাবে যেচে পড়ে এলে কোনো ছেলে কি তাকে ফিরিয়ে দেয় নাকি ফেরাতে পারে? সামান্য কিছু টাকাই তো খরচ করতে হতো। বিনিময়ে….ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুভ।
হঠাৎ মনে পড়ল শারিকার দুটো স্ক্রিনশট আছে তার কাছে। সেগুলো বের করল শুভ। আজকের মতো ছবিদুটোই তার উত্তেজনা প্রশমিত করতে সাহায্য করল।
********
সকালে উঠে আবার রাতে জন্য প্রচন্ড অপরাধবোধ ঘিরে ধরল শুভকে। প্রতিটা মানুষই গ্রে শেডের হয়। তার ভেতরের ধূসর রঙে সাদার পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। ধীরে ধীরে তাতে কালো রঙ মিশে যাচ্ছে। সে নিজেও চলে যাচ্ছে অন্ধকাল অতল গহ্বরে। ছি! কি ভীষণ বাজে কাজ করছে সে! সকালে উঠে প্রথম যে কাজটা সে করল তা হলো স্ক্রিনশট দুটো ডিলিট করা। আবার যাতে বের করতে না পারে সেজন্য একেবারে রিসাইকেল বিন থেকে ডিলিট করে দিল।
এরপর অফিসে চলে গেল সেদিনকার মতো।
কয়েকদিনের অমনোযোগীতার কারনে অনেক কাজ বাকি পড়েছিল। কাজ করতে করতে শুভ সারাদিনে তেমন কোনো সময় পেল না। একেবারে গিয়ে সময় পেল রাতে।
গোসল খাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে ফোনটা হাতে নিল সে। ফেসবুকে ঢুকেই দেখল অজস্র নোটিফিকেশন এসে ভর্তি হয়ে আছে। আসলে তার পোস্ট এপ্রুভ হয়েছে। সেখানে শত শত কমেন্ট৷ তার মধ্যে কেউ পরামর্শ দিয়ে থাকলেও তা খুঁজে পেল না শুভ। গালাগালির স্রোত বয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছেতাই গালি দিয়েছে মানুষ। তাকেও আর শারিকাকেও। সবগুলো পড়তে পারল না শুভ। রাগ লাগতে লাগল ভীষণ। কার ওপর রাগ তা অবশ্য বুঝতে পারল না। সে পোস্ট ডিলিট করে দিল।
************
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল তমালের ডাকে। সকাল সকাল তমালকে দেখে খানিকটা ঘাবড়ে গেল শুভ। উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে রে?”
তমালের চেহারা গম্ভীর। মুখ রাগে লাল হয়ে আছে। সে ডিভানে বসে নিজেকে একটু সামলানোর চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করল, “তুই ফেসবুকে তোর বন্ধুর বউয়ের সাথে প্রেমকাহিনী লিখে বেড়াচ্ছিস?”
শুভ ঢোক গিলল। সে তো পোস্ট করার আগে ভালো করে দেখে নিয়েছিল ওই গ্রুপে তার বন্ধুবান্ধব কেউই নেই। তাহলে তমাল জানল কেমন করে? সে পুরোপুরি অস্বীকার করে গেল, “আমি লিখিনি। আমি কেন লিখব?”
“তুই আমাকে যে কাহিনী শুনিয়েছিলি হুবহু সেটাই তো পড়লাম। পোস্ট যে দিয়েছে তার নাম ছিল না, কিন্তু আমি শিওর সেটা তুই।”
“কোথায় পড়লি?”
“কোথায় মানে? ওই পোস্টের স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়ে গেছে। হাজার হাজার শেয়ার হয়েছে। মনে হয় দেশের সবাই এতক্ষণে জেনে গেছে। ছি! তুই এটা কী করলি শুভ?”
শুভর আর অস্বীকার করার মুখ নেই। সে দুই হাতে মুখ ঢেকে বলল, “আমি জানি না আমি কী করছি। আমি সত্যিই জানি না। আমি কেন এত বড় বড় ভুল করছি? কী হয়েছে আমার?”
“তোর বোঝা উচিত ছিল এ ধরনের মুখরোচক গল্প ভাইরাল হতে সময় লাগে না। এসব কেউ ফেসবুকে লেখে? তুই পাগল?”
“পাগলই হয়ে গেছি আমি।”
“সেদিন ফেসবুকে এসব পোস্ট লেখালেখির কারনে এক কাপলের ডিভোর্স হয়ে গেল। লোকের মাথার ঘিলু কি সব দিন দিন উবে যাচ্ছে?”
“আমাকে একটা চড় মারবি তমাল?”
তমাল সত্যিই উঠে এসে শুভর দুই গালে দুটো চড় মারল। শুভ চুপচাপ চড় খেল। তমাল তো গতকালের ঘটনা জানে না। জানলে হয়তো দুটো লাথিও খেতে হতো। শুভর সাহস হলো না বলার। কোন মুখে বলবে?
শুভ জিজ্ঞেস করল, “এখন কি কিছু করার আছে?”
তমাল একটু শান্ত হয়ে বসে বলল, “শারিকার খবর পেয়েছি। অনেক কিছু জেনেছি। প্রমাণও আছে। আমার মনে হয় এটাই সময় অর্ককে সব জানিয়ে দেবার। তোর কাছেও প্রমান থাকলে ভালো হতো। একটা স্ক্রিনশট রাখলেও কাজ হতো। যাকগে! দেখা যাক কতদূর কী হয়। ওই ডাইনীর হাত থেকে অর্ককে আগে বাঁচাতে হবে। আর তোকেও।”
শুভর এবার নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে হলো। স্ক্রিনশট জোগাড় হয়েছিল, সে ডিলিট করে দিল! শালার এই স্ক্রিনশট জিনিসটা তার জীবনটাকে নরক বানিয়ে দেবে কে জানত!
সে মনে মনে বলল, “যে নিজেই দৌড়ে দৌড়ে আগুনে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে তাকে তুই কী বাঁচাবি তমাল? আমার তো মনে হয় অর্কও শারিকাকে ছাড়বে না। যত প্রমাণই থাকুক না কেন। ওই মেয়ের মধ্যে কী যেন আছে। কী আছে কে জানে!”
শুভ আর তমালের মোবাইলে এমন সময় একসাথে টুং করে নোটিফিকেশন এলো। ওদের ফ্রেন্ডস গ্রুপে মেসেজ দিয়েছে অর্ক। মেসেজ ওপেন করতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল শুভর।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু