#হট_চকোলেট
পর্ব-৫
শুভ আর তমাল একসাথেই অর্কর মেসেজ ওপেন করল। অর্ক শুভর সেই পোস্টের স্ক্রিনশটটা পাঠিয়েছে। সাথে লিখেছে, “দেখ, মানুষ কত বেঈমান হয়! এটা পড়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। গা ঘিনঘিন করছে। যার সাথে আসল কাহিনী হয়েছে না জানি তার কেমন লাগছে!”
মেসেজটা পড়ে তমালের এত কষ্ট হলো যে সে কিছুক্ষণ চুপ করে ঠোঁট কামড়ে জানালার বাইরে চেয়ে রইল। যখন শুভর দিকে ফিরল, দেখল শুভ ফুঁপিয়ে কাঁদছে বাচ্চাদের মতো।
ওদের বন্ধুত্ব ইউনিভার্সিটি থেকে। ইউনিভার্সিটির হলে চার সিটের রুমে ওরা তিনজন থাকত। কত আড্ডা, কত স্মৃতি, কত সময় কাটানো, কত ভালোবাসা আর কঠিন বন্ধুত্ব ছিল তাদের মধ্যে! সবটা এভাবে মিথ্যে হয়ে গেল?
সত্যিই তো, এটা বেঈমানী। কেমন করে করল শুভ? শুভর মধ্যে ভালো কিছু করার পোটেনশিয়াল সবসময় বেশি ছিল৷ ওর মাথাটাও ছিল সবার থেকে পরিষ্কার। অন্যদের বিপদে সে সবসময় পাশে থাকত। এমন একটা ছেলে এই কাজ করতে পারে ভেবে তমালের ভেতরটা কেমন যেন বিষিয়ে যেতে থাকল। ইচ্ছে হলো ওর মুখে থুথু দিয়ে চলে যেতে এখান থেকে। আর কখনো এদিকে ফিরে না আসতে।
কিন্তু শুভর জন্যও তো তার ভালোবাসা আছে, বন্ধুত্বের টান আছে, সেই বন্ধু যাই করুক না কেন। আর শুভর যা মানসিক অবস্থা তাতে ওকে ধিক্কার দিয়ে ছেড়ে চলে যাওয়াটা রিস্কি হবে। তমাল হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়েই রইল। বুঝতে পারল না তার কী করা উচিত।
*********
অর্ক অফিস শেষে শারিকাকে আনতে গেল। বউকে ছাড়া বাড়িটা এত খা খা করে যে মনে হয় এই যেন তাকে গিলে খেতে এলো। আর শারিকা থাকলে মনে হয় চারপাশটা রঙিন আলোয় ঝলমল করছে৷
অথচ এই শারিকাকেই একসময় অপছন্দ করত অর্ক। শারিকা ওর দূর সম্পর্কের কাজিন ছিল। অর্কর বাবার ফুপাতো বোনের মেয়ে। ছোটোবেলায় গ্রামে গেলে একসাথে খেলাধুলা করত ওরা। শারিকা তাকে পছন্দ করত ছোটোবেলা থেকেই। কিন্তু মেয়েটা দুষ্টু আর বাচাল টাইপের ছিল বলে অর্কর ওকে বিরক্ত লাগত। ওর পছন্দ ছিল ঠান্ডা, মিষ্টি, ঘরোয়া ধরনের মেয়ে। কিন্তু শারিকা কোনোদিনই ওর পিছু ছাড়েনি। সেই ছোট্টবেলায় জোর করে খেলা থেকে শুরু করে হাইস্কুলে পড়াকালীন সময়ে জোর করে চালাঘরের পেছনের অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে চুমু খাওয়া, প্রতিটা কাজকর্ম দিয়ে সে বোঝাতে চেয়েছে অর্ককে তার চাই-ই চাই! আর অর্ক সারাজীবন ওকে দূরেই ঠেলে গেছে। ওর কোনো কাজেই অর্কর কোনোদিন আগ্রহ আসেনি। বরং সে উত্তরোত্তর বিরক্তই হয়ে গেছে।
তবে সময় সবসময় একরকম যায় না। স্কুল শেষ করার পর বহুদিন গ্রামে যাওয়া হয়নি অর্কর। ইউনিভার্সিটির পাট চুকিয়ে প্রায় আট বছর পর গ্রামে গিয়ে ওর দেখা হয় নতুন শারিকার সাথে। এই শারিকা আগের মতো বাচাল ঠিকই, কিন্তু ওর ভেতর কী যেন একটা তৈরি হয়েছে। সেটা ঠিক কী, অর্ক ধরতে পারেনি। কিন্তু আকৃষ্ট হয়েছিল প্রবলভাবে। ওর চাহনী, ওর অস্তিত্ব, সবটাই যেন অর্ককে ঘিরে ধরেছিল প্রবল আকর্ষণের মতো।
চোখ নাচিয়ে প্রথম কথাটা শারিকা বলেছিল, “কী এংরি ইয়াং ম্যান, আমার কথা মনে আছে? নাকি শহুরে সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখে এসে এদিকের সবকিছু মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে?”
অর্ক উত্তরে হেসে বলেছিল, “তোমাকে ভুলে যাওয়ার মতো এতটা মেমোরি লস এখনো হয়নি। তবে তুমি বদলে গেছ।”
“কিরকম?”
“সেটা বলতে পারছি না। জাস্ট বদলেছ এটা বুঝতে পারছি।”
শারিকা ওর দিকে দৃষ্টি দিয়ে তীর ছুঁড়ে বলেছিল, “বদলে গেছি। তবে আমার অনুভূতি বদলায়নি। এখনো আগের মতোই একজনকে ভীষণ করে চাইছি।”
বদলে যাওয়া সময়, বদলে যাওয়া শারিকা বা বদলে যাওয়া অর্কের মানসিকতা, ঠিক কী কারনে জানে না, শারিকার কথাটা শুনে অর্কর পুরো শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গিয়েছিল। শারিকাও বুঝতে পেরেছিল সেটা। চোখে চোখে কথা হয়ে গিয়েছিল যেন। সেবার গ্রামে গিয়ে প্রায় দশদিন কাটিয়েছিল অর্ক। গ্রহের মতো পুরোটা সময় শারিকা নামক আকর্ষণকারী নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে সে ঘুরে গেছে। সেই চালাঘরের পেছনের আঁধারে গিয়ে চুমু খেয়েছে স্বেচ্ছায়। ঠিক তারপরেই মনে হয়েছে, শারিকাকে না পেলে তার চলবে না।
শারিকাকে তখনই বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল অর্ক। শারিকা তো পারলে সেই মুহূর্তে কবুল বলে ফেলে। বাড়িতে অর্ক জানিয়ে দিল সে শারিকাকে বিয়ে করতে চায়।
তবে বাঁধ সাধলেন অর্কর মা। শারিকার চালচলন তার কখনো পছন্দ ছিল না। তার মতে, মেয়েটা অতিরিক্ত চালাক। একে বাড়ির বউ করলে না তার ছেলে সুখী হতে পারবে, না সুন্দর একটা সংসার হবে।
এই নিয়ে পুরো একদিন ক্যাচাল হলো। আত্মীয়স্বজন সবাই ভাগ হয়ে গেল। একেকজন একেক মত দিল। তবে অর্কর মা কোনোভাবেই এই সম্পর্ক মেনে নিতে নারাজ।
সেই রাতে মাঝরাত পেরিয়ে যাবার পর অর্কর ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুলে অর্ক দেখল শারিকা দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
শারিকা কথাবার্তা না বলে ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর অর্ককে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমাকে বিয়ে না করলে আমি কিন্তু গলায় দড়ি দেব।”
“প্লিজ শারিকা, এরকম ছেলেমানুষী করো না।”
শারিকা কাঁদতে কাঁদতে আরো কী কী যেন বলতে লাগল। এমন সময় দরজায় ধাক্কা পড়ল। একাধিক কণ্ঠস্বর শোনা গেল ওপাশে। অর্ক ঘাবড়ে গেল। কিন্তু শারিকা অদ্ভুত একটা কাজ করল। তক্ষুনি তাকে ছেড়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বিছানা এলোমেলো করে দিয়ে মাঝখানে গুটিশুটি হয়ে বসে রইল।
এদিকে দরজা ধাক্কানোর মাত্রা বাড়লে শারিকা বলল, “খুলে দাও না। হা করে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
অর্ক বুঝতে পারল কী হতে যাচ্ছে। কিন্তু দরজা না খুলে উপায় নেই। দরজা খোলা হলো। সবাই ঢুকে দেখল শারিকা আলুথালু বেশে জড়োসড়ো হয়ে অর্কর বিছানায় বসে আছে।
শারিকার ভাইয়েরা সে রাতে অর্ককে মারতে আসছিল। ওকে বাঁচিয়েছিল শারিকাই। সবার মাঝে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “ও আমাকে ডাকেনি, আমি নিজে থেকে এসেছি।”
সারারাত ধরে বিশাল নাটক হয়ে গেল। গ্রামের বাড়ি বলে কথা দ্রুত ছড়িয়েও পড়ল পুরো গ্রামে। পরদিন বাধ্য হয়ে তাদের বিয়ে দিয়ে দিল আত্মীয়স্বজন মিলে। পরে শহরে এসে ওদের রিসিপশনের অনুষ্ঠান হয়েছিল।
এত নাটকীয়তার জন্য অর্ক শারিকার প্রতি ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে থাকলেও বিয়ের রাতে রাগ মিটে গিয়েছিল শারিকাকে দেখে। কত ছলাকলা করে সে অর্কর রাগ ভাঙিয়েছিল ভাবলে অর্কর এখনো শিহরণ জাগে, হাসিও পায়।
অর্ককে দেখে শারিকা খুশি হয়ে গেল। “এসেছ তুমি? এসো ভেতরে এসো।”
শারিকা ওকে বসিয়ে লেবুর শরবত করে আনল। অর্ক বলল, “চলো আজই ফিরে যাবে।”
“কেন এক রাত থাকো এখানে?”
“নাহ, তুমিই চলো।”
শারিকা চোখ টিপে বলল, “আর বুঝি থাকতে পারছো না একা?”
অর্ক হেসে বলল, “নাহ।”
“আচ্ছা। তৈরি হয়ে আসছি এক্ষুনি।”
**********
শারিকার সাথে যোগাযোগ বন্ধের সপ্তাহখানেক পার হয়ে যাওয়ায় শুভ কিছুটা সামলে নিয়েছে। এদিকে তমাল বারবার বলছে, অর্ককে সব জানানো দরকার। ওর সাথে এত বড় ধোঁকা হতে পারে না। কিন্তু শুভর ইচ্ছে নেই কিছু জানানোর। এসব জানলে অর্কর সাথে সম্পর্কটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে। আর না হলেও আগের মতো তো আর থাকবে না। থাকা সম্ভব না।
তমালের সাথে দেখা হবার পর সে এটাই বোঝাচ্ছিল তমালকে। কিন্তু তমাল মানতে নারাজ। সে বলল, “তুই কি জানিস ইউনিভার্সিটি লাইফে এই মেয়ে কী করত? জানলে আর আমাকে নিষেধ করতে পারতিস না। আমি অর্কর সাথে এত বড় প্রতারণা জাস্ট মেনে নিতে পারছি না।”
“জানলেও তো ও কষ্ট পাবে।”
“এখন কষ্ট পাওয়া অনেক ভালো। দু’দিন পর বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেলে যদি ও জানতে পারে ওর বউ ইউনিভার্সিটি লাইফে জামাকাপড়ের মতো বয়ফ্রেন্ড বদলাতো, দুটো নাম্বার বেশি পাওয়ার জন্য…”
“থাক আমি আর শুনতে চাচ্ছি না।”
“এখন তো এসব বলে লাভ নেই। তোকে শুনতে হবে। আর রিয়েলিটি ফেইস করতে হবে।”
“আমার পয়েন্টটা বাদ দিয়ে বাকিটা অর্ককে জানানো যায় না? বন্ধুত্বটা নষ্ট করতেই হবে? এমনিতেও আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই।”
তমাল কিছু বলল না আর। সে নিজেও কনফিউজড।
সেই রাতেই প্রায় দুটোর দিকে অর্কর নাম্বার থেকে কল এলো শুভর কাছে। শুভ প্রচন্ড ঘাবড়ে গেল। মনে হলো, তমাল হয়তো সব বলে দিয়েছে অর্ককে। এসির মধ্যে বসেও ঘেমে উঠল সে। দুবার কল কেটে যাওয়ার পর তৃতীয়বার সে ধরল। “হ্যা…হ্যালো।”
ওপাশ থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে এলো, “ব্লক করেছ কেন? ব্লক খোলো বলছি!”
শারিকা! ঢোক গিয়ে অর্ক বলল, “কেন খুলব?”
“না খুললে আমি তোমার বন্ধুকে বলে দেব যে তুমি আমাকে কল করে ডিসটার্ব করেছ। উল্টোপাল্টা ছবি পাঠিয়ে হ্যারাস করেছ। ভিডিও কলে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে দেখিয়েছ।”
“হুম আর এসব যে বলবে তার কোনো প্রমাণ আছে তোমার কাছে?”
“আছে তো। তোমার ভিডিও কলের স্ক্রিনশট যত্নে রাখা আছে আমার কাছে। সেই রাতের কথা মনে আছে না? শেষ রাতের দিকে উত্তেজনার চরমে পৌঁছে গিয়েছিলে? ঠিক সেই মোমেন্টের স্ক্রিনশট আছে আমার কাছে। আশা করি তোমার ফ্রেন্ড সার্কেল বা পরিচিতজনের মধ্যে যারা মেয়ে আছে তাদের তোমার ন্যুড দেখতে দারুণ লাগবে! ড্রাইভে আপলোড করাই আছে। জাস্ট লিংকটা পাঠানো বাকি।”
শুভ ভয়ার্ত স্বর সামলানোর চেষ্টা করে বলল, “তোমার স্ক্রিনশটও আছে আমার কাছে।”
“তাই নাকি? কে বিশ্বাস করবে? আমার মুখে সবসময় ফিল্টার দেয়া ছিল। তোমার ওই স্ক্রিনশট কোনো কাজে আসবে না।”
এমনিতেও স্ক্রিনশট নেই। তার ওপর মুখে ফিল্টার দেয়ার কথাটা সত্য। শারিকার শরীর দেখেই শুভর এত মাথা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল যে মুখে অদ্ভুত সব ফিল্টার দেয়ার ব্যাপারটা তার খেয়ালেই আসেনি বা সে খেয়াল করতে চায়ওনি।
সে যন্ত্রের মতো জিজ্ঞেস করল, “কী চাই তোমার?”
“আপাতত একটা মোবাইল ফোন। খুব পুরানো হয়ে গেছে আমারটা বলেছিলাম তো।”
“ঠিক আছে।”
“আর আগে ব্লক তো খোলো।”
“খুলব না।”
“ওহ আচ্ছা। তাহলে ড্রাইভ লিংক…”
“খুলছি।”
“গুড বয়।”
“তুমি অর্কর মোবাইল থেকে ফোন করেছ কিভাবে?”
“অর্কর মোবাইলে আমার এক্সেস আছে। ও নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। খুব পরিশ্রম গেছে কি না! তোমাকে যা বলছি তাই করো। আজ রাতে ব্লক না খুললে সকালে তোমার সম্মান চিরতরে ব্লক হয়ে যাবে।”
কল রেখে শুভ মোবাইলটা ছুঁড়ে মারল আয়নার দিকে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়ল। ভাঙা কাচগুলো শুভর দিকে চেয়ে বলতে লাগল, ভেঙে দিলি তো আমাদের, এবার আমাদের দিয়ে নিজেকে শেষ করে দে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু