#হট_চকোলেট
পর্ব-৬
তমালকে অসময়ে নিজের অফিসে দেখে বেশ অবাক হলো অর্ক। তমাল এর আগে কখনো তার অফিসে আসেনি। আজ হুট করে না বলে চলে এলো। সে বিষ্ময় প্রকাশ করেই বলল, “কিরে দোস্ত, তুই এখানে? ঘটনা কী?”
তমাল বলল, “এলাম একটু কথা বলতে।”
“সন্ধ্যায় বাসায় চলে আসতি৷ এখন আর কী বা কথা বলতে পারব?”
“কথাগুলো বাসায় বলা যাবে না, এজন্যই এখানে এলাম৷ হাফ ডে ছুটি নিতে পারবি না?”
অর্ক মাথা চুলকে বলল, “দেখি ম্যানেজ করতে পারি কি না। বসের মেজাজ মর্জির ওপর ডিপেন্ড করে। তুই একটু ওয়েট কর, আমি দেখি।”
তমাল বসে অপেক্ষা করতে লাগল। অজস্র কথার এলোমেলো তার জট পাকিয়ে আছে তার মাথার ভেতর। কোথা থেকে শুরু করবে অনেক ভেবেও বের করতে পারেনি সে। শেষে ঠিক করেছে যা মনে আসবে বলে দেবে। তবে বলতেই হবে। শুভর ভরসায় থাকলে হবে না। তমাল আজ যে আসবে সেটা সে শুভকে জানায়নি।
অর্কর ছুটি ম্যানেজ হলো। সে হাসিমুখে এসে বলল, “চল। কোথায় যাবি?”
“এই পোড়া শহরে আর কোন জায়গা আছে রেস্টুরেন্ট চাড়া? চল খাওয়াদাওয়া করি, তারপর কথা হবে।”
ওরা পাশেই একটা ভালো চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাবার অর্ডার দিল। খাবার আসার ফাঁকে কথা শুরু করল অর্ক। “বলতে শুরু করে দে কী বলবি?”
“খেয়ে নেই।”
“কোনো ঝামেলায় ফেঁসে গেছিস নাকি? তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে কঠিন কন্সটিপেশনের রোগী।” হাসতে হাসতে বলল অর্ক।
তমাল হাসল না৷ কথাগুলো অর্ককে বলার মতো সাহস তার ক্রমশ কমছে। অর্ক কি নিতে পারবে? তাকে ভুল বুঝবে না তো?
অর্কর মনে হলো তমালকে একটু সহজ করা দরকার, সময় দেয়া দরকার। হয়তো কোনো জটিল সমস্যায় পড়ে গেছে বেচারা।
খাবার চলে এলে খেতে খেতে অর্ক জিজ্ঞেস করল, “শুভর কী হয়েছে রে? সে গ্রপে কোনো কথাবার্তা বলে না৷ ফোনটোনও করে না ইদানীং।”
“জানি না। আমার সাথেও যোগাযোগ নাই। ব্যস্ত হয়তো।”
“এমন কী ব্যস্ততা রে ভাই? আগে তো হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও ওর মিমস পাঠানো বন্ধ হতো না।”
“হয়তো মিমস দেখাই বন্ধ করে দিয়েছে ব্যস্ততায়।”
“হতে পারে। লাইফে কখন কার সাথে কী হয়ে যায় কে জানে!”
কথাটা অর্ক হালকাভাবে বললেও খেয়াল করল তমাল তার দিকে খুব অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
খাওয়াদাওয়া শেষে এক কাপ কফি নিয়ে তমাল বলতে শুরু করল, “তোকে কথাটা বলতে চাইছিলাম তোর বাসা থেকে দাওয়াত খেয়ে আসার পর থেকেই।”
অর্ক নড়েচড়ে বসল। “কী কথা?”
“তোর ওয়াইফ, মানে শারিকাকে আমি…”
তমালের ফোনটা বেজে উঠল। সে বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে কেটে দিতে গিয়ে দেখল কলটা এসেছে শুভর বাড়ির ল্যান্ডলাইন থেকে। সে একটু অবাক হয়ে ফোন ধরল। ওর বাড়ির বহু বছরের পুরানো গৃহকর্মী আমজাদ কল ধরে বলল, “হ্যালো তমাল ভাইয়া?”
“বল আমজাদ, কী হয়েছে?”
আমজাদ ভয়ার্ত গলায় বলল, “শুভ ভাইয়া ঘরের দরজা খুলতেছে না৷ রাত থেকা দরজা বন্ধ। দশটার সময় একবার ডাকলাম, বলল সকালে খাইব না। এখন আবার ডাকলাম, কথা বলে না। কত ধাক্কাধাক্কি করলাম, খোলে না। দরজা ভাঙব ভাবতেছি। আপনারে তার আগে জানাইলাম। একটু আসেন। আমার ডর লাগতেছে।”
“আসছি আমি।”
তমাল ফোন রাখতেই অর্ক জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“জানি না৷ শুভর বাড়ি চল।”
ওরা তড়িঘড়ি করে ছুটল শুভর বাড়ির দিকে।
তমাল আর অর্ক যখন পৌঁছুল তখন দরজা ভাঙা হয়েছে। শুভ বিছানায় পড়ে আছে। তার জ্ঞান নেই। ড্রেসিং টেবিলের আয়না ভেঙে চুরমার হয়ে ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। শুভর বিছানার সাইড টেবিলে একটা ঔষধের পাতা পড়ে আছে। তমাল কাছে গিয়ে তুলে দেখল ওটা ঘুমের ঔষধ।
অর্ক দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিতে গেল। তমাল শুভর নাড়ি দেখল। নাড়ির গতি খুব ক্ষীণ। তবুও তো আছে! স্বস্তি মিলল খানিকটা। সম্ভবত খেয়েছে বেশি দেরি হয়নি। দশটার দিকেও তো জ্ঞান ছিল। হাসপাতালে নিলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।
এসব ভাবতে ভাবতে তমালের চোখে পড়ল ঔষধের পাতার পাশই একটা নোটপ্যাডের খোলা পাতায় কিছু লেখা। চোখ বুলিয়েই দেখতে পেল ভয়ানক কথাগুলো। সবার অলক্ষ্যে চট করে পাতাটা ছিঁড়ে পকেটে ভরে ফেলল সে।
**********
শুভকে ইমারজেন্সিতে নেয়া হয়েছে। পেটের ভেতর ওয়াশ করতে হবে। খুবই বাজে অবস্থা।
তমালের এত রাগ লাগছে! একটা ছেলে কেমন করে এই কাজ করতে পারে? ওর স্নায়ু কি এতই দুর্বল ছিল? ও কি মেয়ে? মেয়ে হলে নাহয় মানা যেত৷ এসব ব্যাপারে মেয়েরা সমাজকে ভীষণ ভয় পায়। কিন্তু সে তো ছেলে। তার যদি দু’একটা স্ক্যান্ডাল বেরও হয়, দুদিন পরেই লোকে ভুলে যাবে। ফ্যামিলি নেই, বউ নেই, বাচ্চা নেই, ও কোন শোকে এমন একটা স্টেপ নিল কিছুতেই বুঝতে পারল না তমাল। তার যত না ভয় হচ্ছে তারচেয়ে বেশি রাগ লাগছে।
অর্ক মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। সে আসল ঘটনা জানে না। তমাল বলেছে, সেও কিছু জানে না। সে এমনিতেও শুভর ব্যাপারটা আজ অর্ককে বলত না, চেপে যেত। আর এখন তো ঘটনা আরো অনেক পেঁচিয়ে গেছে।
অর্ক ফোন করে শারিকাকে শুভর ব্যাপারটা জানিয়েছে। দেখা গেল কিছুক্ষণ পর শারিকাও এসে হাজির। মেয়েটাকে দেখে তমালের ইচ্ছে হলো ওর গলা চেপে ধরতে। মানুষ এত জঘন্য কেমন করে হয়?
শারিকার এসব ঘটনার কারনে তমালের নারী জাতির ওপরেই একধরনের বিদ্বেষ জন্মে গেছে। নিজের বউকেও অসহ্য লাগছিল। কথায় কথায় ঝগড়া লাগছিল। তাই নিজে থেকেই ওকে কয়েকদিনের জন্য বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন দিন দিন এমন অবস্থা হচ্ছে যে কোনো মেয়ে দেখলেই মেজাজ গরম হয়ে যায়।
শারিকাকে দেখে তমাল যেভাবে সেই জায়গা থেকে চলে গেল সেটা চোখ এড়াল না অর্কর। আজ তো তমাল শারিকার ব্যাপারেই কিছু বলতে যাচ্ছিল। কী বলতে চাইছিল সে? ভয়ানক কিছু? এই ভয়ানক পরিস্থিতিতেও কৌতুহল যেন গলায় এসে আটকে রইল অর্কর। তবে সে ধৈর্য ধরে বসে রইল।
ওয়াশ করার পর শুভ সে যাত্রায় বেঁচে গেল। তার অবস্থা স্টেবল হয়ে এলে শারিকাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল অর্ক। বলল আজ রাতে হাসপাতালে থাকবে।
রাতে সে আর তমাল হাসপাতালে রয়ে গেল। শুভর তখনো জ্ঞান ফেরেনি। অনেক রাতে একটা সুযোগমতো সময়ে অর্ক তমালকে ধরে বসল। “তুই দুপুরে কী বলতে চাইছিলি এখন বল।”
তমালের কোনোকিছু বলার মতো ইচ্ছে নেই এখন৷ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। সে কয়েক পলক অর্কর দিকে চেয়ে থেকে বলল, “পরে বলি?”
“নাহ। এখন বললেই ভালো হয়। আমার অনেক মাথা ধরে আছে।”
“ওসব বললে মাথা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হবে।”
“তুই বল।”
“আচ্ছা। বলছি কিছুটা। তুই আমাকে ভুল বুঝতে পারিস। ভাবতে পারিস মিথ্যে বলছি। বন্ধুত্ব শেষ করে দিতে পারিস। সব ডিপেন্ড করে তোর ওপর। তবে আমার বলা উচিত বলে আমি বলব।”
“এত ভণিতার কী আছে রে ভাই? সেই দুপুর থেকে তোর নখরামির চোটে কথাটাই শোনা হলো না৷ ফালতু!”
তমাল দুঃখে হেসে ফেলল। বলল, “তোর কোনোদিন শারিকাকে সন্দেহ হয়েছে?”
“কিরকম সন্দেহ?”
“ওর চরিত্র নিয়ে?”
অর্কর মনে পড়ল অনেক কথাই। ওর বিয়ের পর এক লোক ওকে ফোন করে খুব ডিসটার্ব করত। বলত, সে শারিকা অনেক ভালোবাসে। অর্ক যেন শারিকাকে তার কাছে পাঠিয়ে দেয়। শারিকাকে ছাড়া বাঁচবে না, ইত্যাদি। তবে শারিকা বলেছিল, ওটা তার পেছনে ঘোরা ব্যর্থ প্রেমিক। পাত্তা পায়নি বলে এমন করছে। অর্কর নিজেরও তাই মনে হয়েছিল।
এরপর শারিকাদের এলাকার এক ছেলে অর্ককে চায়ের দোকানে পেয়ে শারিকার ব্যাপারে অনেক নোংরা কথা বলেছিল। বলেছিল ওর টেস্ট এলাকার সবাই জানে। অর্ক ভীষণ রেগে গিয়েছিল সেবার৷ ছেলেটার সাথে মারামারি হয়ে গিয়েছিল তার৷ শারিকা এরপর বলেছিল, এই ছেলের স্বভাব খারাপ। সবার সংসারে আগুন লাগাতে চায়। অর্কর শারিকার কথা বিশ্বাস হয়েছিল।
একবার সে শারিকার হোয়াটসঅ্যাপে এক ছেলের প্রচন্ড আপত্তিকর ছবি আর টেক্সট পেয়েছিল। শারিকা বলেছিল, সে এই ছেলেকে চেনে না। হোয়াটসঅ্যাপে নাকি সব মেয়েদের কাছেই এরকম মেসেজ কমবেশি আসে। তখনো অর্ক শারিকাকেই বিশ্বাস করেছিল।
আজ তমালের এক কথায় তার সব বিশ্বাসের ভিত কেমন যেন নড়ে উঠল। সে খানিকটা ভীত গলায় জিজ্ঞেস করল, “ওর চরিত্র নিয়ে কেন আমি সন্দেহ করব?”
তমালের কথা বলতে একেবারেই ইচ্ছে করছিল না৷ সে অর্ককে নিয়ে হাসপাতাল কম্পাইন্ডের বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরাল। লম্বা একটা টান দিয়ে বলল, “শারিকা একটা ক্যারেক্টারলেস মেয়ে। ওর জীবনে আসা ছেলের সংখ্যা কম করে হলেও তোর বয়সের ডবল হবে।”
অর্কর চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। “তুই যা বলছিস ভেবে বলছিস? ও আমার বউ।”
“হ্যাঁ। সেজন্যই মনে হয়েছে তোকে জানানো জরুরি৷ ওকে আমি স্কুল থেকে চিনি।”
অর্ক এবার বেশ রেগে গেল, “স্কুল থেকে চিনিস মানে? তাহলে সেদিন বললি না কেন? সেদিন তো ভাব দেখালি জীবনে প্রথমবার ওকে দেখছিস৷”
“অর্ক, মাথা ঠান্ডা করে শোন। প্লিজ! সেদিন কথাটা না বলার কারন আছে। বলতে তো দিবি। শারিকা স্কুলে থাকাকালীন সময়ে ছেলেদের নাকি দড়ি দিয়ে ঘোরাতো। ক্লাসের কত ছেলের প্রেম করেছে গোপনে তার হিসাব নেই। কলেজে এক সিনিয়রের সাথে ওর মাখামাখি প্রেম পুরো কলেজ জানে। সেই ছেলেকে ডিচ করে সেকেন্ড ইয়ারে উঠতেই আবার জুনিয়রের সাথে জুটেছিল। এরপর ইউনিভার্সিটিতে…”
অর্ক তমালের কলার চেপে ধরে বলল, “চুপ! আর একটা শব্দও তুই বলবি না। আমার বউয়ের নামে যা নয় তাই বলে যাচ্ছিস, তোমার সাহস তো কম না!”
হতভম্ব তমাল কোনো পাল্টা জবাব দিতে পারল না৷ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। তার আশঙ্কা সত্যি হয়েছে৷ অর্ক তাকে বিশ্বাস করছে না। আর কিছু বলে কী লাভ?
কয়েক পলক এভাবেই কেটে গেল। তমালের দিকে ইস্পাত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল অর্ক। একসময় তাকে ছেড়ে দিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে হেটে চলে গেল রাস্তার দিকে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু