#স্বপ্নে_দেখা_রাজকন্যা
#৬ষ্ঠ_পর্ব
“আচ্ছা, আপনি এমন উদগ্রীব হয়ে আছেন কেনো আমার সাথে দেখা করতে? মতলব কি বলুন তো!”
দীপশিখার এমন প্রশ্নে চুপসে গেলো জাওয়াদ। মস্তিষ্ক ধপ করে সুইচ অফ করে ফেললো যেন। যে মতলবে সে প্রতিদিন দীপশিখার সাথে দেখা করতে চাইছে সেটা হলো দুঃস্বপ্ন থেকে পরিত্রাণ। কিন্তু সে কি করে দীপশিখাকে বলবে সেই কথা? কি করে বলবে,
“তোমাকে নিয়ে আমি আজকাল স্বপ্ন দেখছি, যে রাতে স্বপ্ন দেখি তারপর দিন আমার জীবনে লঙ্কা জ্বলে। আমার ধারনা তুমি আমার উপর জাদু করেছো। সেটাই হাতে নাতে ধরা আমার মতলব”
নাহ, বলা যাবে না। দীপশিখার কথায় স্পষ্ট সে তাকে অপছন্দ করে। এমন কথা বললে নিশ্চিত জুতো খুলে মারবে। এটা বাংলাদেশ, নারীর হাতে জুতো উঠলেই তার সমর্থন জানাতে তৎপর হয়ে যায় মানুষ। ফলে গণপিটুনী খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। পাভেল বেয়াদবটাও বলে দিয়েছে, গণপিটুনীতে সে হাত তুলে নিবে। দেখা যাবে ফোন দিলে বলে দিলো,
“এই অমানুষকে আমি চিনি না”
বলে রাস্তায় এককোনায় মারখেয়ে ভোঁতা হয়ে পড়ে থাকতে হবে। বিষয়টা কল্পনাতেই ভয়ংকর ঠেকছে। জাওয়াদ মাথা নাড়িয়ে বিষয়খানা ঝেড়ে ফেললো। দীপশিখা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মেয়েটার চাহনী ডেঞ্জারাস। জাওয়াদ তার চোখের দিকে তাকালে গুলিয়ে ফেলে সব। তখন জ্যোতির কথাটা স্মরণ হলো,
“মেয়েরা নারকেলের মতো, আল্লাহ আমাদের ভেতর একটা নরম হৃদয় দিয়েছে। যতই আমরা কঠিন হই না কেনো আমাদের মন গলবেই। কারোর মন গলে সহানুভূতিতে, কারোর মন গলে আদরে, কারোর মন গলে ভালোবাসায়। মেয়েদের মন গলা অনিবার্য”
দীপশিখাকে আদর, ভালোবাসায় মন গলানো যেত, কিন্তু জাওয়াদ তাকে ভালোবাসে না। ফলে সহানুভূতি একমাত্র উপায়। অনেক ভেবেচিন্তে বললো,
“আমার মতলব, আমি তোমাকে চিনতে চাই। আব্বার তোমাকে খুব পছন্দ। সে তোমাকে আমার বউ করার জন্য পাগল প্রায়। কিন্তু সমস্যা হল, আমি কমিটমেন্ট, রিলেশনে খুব আনাড়ি। আমার এক বছরের রিলেশন ব্রেকাপ হয়ে গেছে কিছুদিন আগে। তাই আমি সময় নিতে চাই। প্রতিদিন দেখা সাক্ষাৎ হলে আমরা একে অপরকে চিনতে পারবো, জানতে পারবো। বিয়ে তো করতেই হবে, হোয়াই ডোন্ট উই ট্রাই টু ন ইচ আদার! একে অপরকে জানলে হয়তো আমরা একে অপরকে পছন্দ করে ফেলবো। বিয়ের যাত্রাটা স্মুদ হবে”
“জানা, চিনার পর যদি পছন্দ না হয়?”
“দেন আমরা পিছিয়ে যাব, বিয়ে তো আর রোজ রোজ করবো না। আর তুমি ই তো বলেছো, একবার দেখায় কাউকে বোঝা যায় না”
দীপশিখা চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর অপ্রতীভ স্বরে বললো,
“চলুন বসি”
“তুমি বস। আমি ঠিক আছি”
“মানে কি? আপনি বসবেন না? আমি কি রাজহাসের মতো গলা উঁচিয়ে কথা বলবো?”
জাওয়াদ বিব্রতস্বরে বললো,
“ধুলোবালিতে আমার গা চুলকায়। মানে আমার একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা পছন্দ। ঘাসের উপর গরু হেটেছে, পটি করেছে না মুতু করেছে কে জানে। উপর থেকে জুতো খুলতে হবে। মুজোতে কাঁদা লাগবে”
“হয়েছে, বুঝছি আপনার শুচিবাই রোগ আছে”
“এটা রোগ না”
“রোগ না? অস্বাভাবিক মানুষের মত আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হচ্ছে আপনি আপনাকে পানিশমেন্ট দিয়েছি হোমওয়ার্ক না করার। আমার আবার এসব অসহ্য লাগে। নরম ঘাসে বসে পা ঝুলিয়ে বাদাম খাওয়ার মজাই আলাদা”
“তুমি খাও না, মানা কে করেছে”
দীপাশিখা “চ” সূচক শব্দ করে বললো,
“বাবার আপনাকে কি দেখে পছন্দ হলো বুঝছি না!”
জাওয়াদ ভ্রু কুচকে তাকালো। বলতে ইচ্ছে হলো,
“পছন্দ আমি তোমারও ছিলাম। নেহাৎ তোমার জাদুটোনায় আমার জীবনের চৌদ্দটা বেজে আছে, নয়তো আমার এতো ঠেকা পড়েনি তোমার সাথে বসে বকবক করবো”
কিন্তু বলা হলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাগ গিলে ফেললো সে। দীপশিখা হাই তুললো। তারপর গলা উঁচিয়ে বললো,
“আমার ঘুম তো নষ্ট করেছেন, আমার ঘাড়ও ব্যাথা করে দিচ্ছেন; অন্তত ভালোমানুষী দেখিয়ে এককাপ চা খাওয়ান। ৩০০ টাকার কফি বাঁচিয়ে দিলাম। ১০ টাকার চা খাওয়ান এবার”
দীপশিখার কথায় জোর করে দাঁত বের করে হাসলো জাওয়াদ। অপমান গায়ে মাখাবে না সে। মহারানী চা খাবে, সে খাওয়াবে। স্বপ্ন দেখে জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো দিন কাটানোর থেকে মহারানীকে চা খাওয়ানো ঢের ভালো। জাওয়াদ চা নিয়ে এলো। কিন্তু এক কাপ চা ই এনেছে। দীপশিখা অবাক স্বরে বললো,
“একি আপনার চা?”
“আমি বাহিরের খাবার খাই না, আনহাইজিন লাগে”
“ও ভুলে গেছিলাম, আপনি বিশেষ মানুষ। হয়তো আপনার পেট সোনা দিয়ে মোড়া, বাথরুমের সাথে সোনা বের হয়। এসব খেলে আপনার সোনার খনিতে জ্যাম লেগে যেতে পারে। থাক, আমি খাচ্ছি”
জাওয়াদ দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“তোমার এখানে আসার উদ্দেশ্য আমাকে অপমান করা তাই না?”
“আপনি না আমাকে চিনবেন? আমি শুধু আমাকে চিনাচ্ছি। অপমান মনে হলে বাদ দিন, দেখা করার প্রয়োজন নেই”
খুব স্বাভাবিক স্বরে কথাটা বললো দীপশিখা। জাওয়াদের মনে হলো কেউ তাকে ভিজিয়ে ভিজিয়ে থাপ্পড় মারছে। ক্ষুদ্ধ স্বরে বললো,
“তুমি আমাকে এতো অপছন্দ করো কেন বলতো?”
দীপশিখা নির্দ্বিধায় চায়ের কাপে চুমুক দিলো। স্মিত স্বরে বলল,
“আমি আপনাকে অপছন্দ করি না জাওয়াদ সাহেব”
“এজন্য অপমান করছো?”
দীপশিখার ঠোঁটে হালকা হাসি ভেসে উঠলো। হাসিটা খুব প্রাণবন্ত। ধীর স্বরে বললো,
“আপনি কি রাগ করছেন জাওয়াদ সাহেব?”
জাওয়াদ গম্ভীর স্বরে বললো,
“না”
“তাহলে আপনার মুখ টমেটোর মত লাল হয়ে গেছে কেন?”
“মোটেই না”
“অবশ্যই, প্রমাণ দিব?”
“ভালো হয়েছে”
দীপশিখার খুব হাসি পাচ্ছে। মানুষটি ছোট্ট কিশোরের মত মুখ ফুলিয়ে আছে। দীপশিখার মনে হলো সে ছয়বছর পূর্বের কিশোরকেই দেখছে যে কারোর সাথে মারপিট করে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের কিছু প্রবৃত্তি হয়তো কখনো বদলায় না। দীপশিখা চা শেষ করলো। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশের লাল রঙটা শুষে যাচ্ছে নিকষকালো আঁধারে।
****
দীপশিখাকে বাড়িতে পৌছে দিল জাওয়াদ। ঘড়িটা একবার দেখে নিলো। দীপশিখা বাইক থেকে নেমে বিনা কিছু বলেই চলে যেতে নিলে জাওয়াদ বলে উঠলো,
“অন্তত, ভেতরে আসার নিমন্ত্রণ দিতেই পারতে, কার্টেসি”
“কার্টেসি দেখানো আমার স্বভাবে নেই। জেনে নিন”
ভনিতাহীন উত্তর দিলো দীপশিখা। জাওয়াদ হাসলো। মেয়েটাকে এই বিকেলে যা চিনলো তার হলো সে খুব কাট কাট কথা বলা মানুষ। ফলে সেও কথা বাড়ালো না,
“কালকে সাতটার সময় সময় ফাঁকা রেখো”
“আচ্ছা”
“আর শোনো?”
দীপশিখা থামলো। কৌতুহলী হলো চাহনী। জাওয়াদ তখন গাঢ় স্বরে বললো,
“কালো রঙ্গে তোমাকে সুন্দর লাগে”
কথাটায় কি জানে ছিলো! দীপশিখা বিহ্বল তাকিয়ে রইলো। কঠিন প্রস্তরঘেরা হৃদয়টা হুট করে স্পন্দিত হলো বেসামালভাবে। থমকে গেলো তার চিন্তাগুলো। কথা হারিয়ে ফেললো সে। কান গরম হয়ে গেলো। দীপশিখাকে স্তম্ভিত দেখে হাসি প্রশস্ত হলো। বাইক স্টার্ট দিলো। নাহ, চার্ম তার এখনো কাজ করছে।
***
হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় বসলো দীপশিখা। তার গাল উষ্ণ হয়ে আছে এখনো। এসে ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়েছে। আজ তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি অথচ গরম লাগছে তার। সব দোষ ওই লোকটার। সারাদিন কিছু বলে নি, অথচ গেটে এসেই তার এমন কথা বলতে হলো। সে মিথ্যে বলেছে। দীপশিখা জানে তাকে মোটেই সুন্দর লাগছে না। তবুও সে বলেছে। কেনো বলেছে? দীপশিখা কিছুতেই মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না লোকটির কথা। এমন সময় টুং করে বেজে উঠলো মোবাইলটা। মোবাইলে একটা ম্যাসেজ। ম্যাসেজটা জাওয়াদ নামক ব্যক্তির। কিন্তু ম্যাসেজ দেখেই আক্কেলগুড়ুম হলো দীপশিখার, হতবিহ্বল চেয়ে রইলো। কারণ ম্যাসেজে লেখা,
“আমার কথা ভাবছো কি?”
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি