স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা পর্ব-১১

0
48

#স্বপ্নে_দেখা_রাজকন্যা
#১১তম_পর্ব

“তাহলে তুমি আমাকে পছন্দ কর, বলো?”

জাওয়াদের আকস্মিক কথায় মুহূর্তের জন্য জমায়িত সকল অনুভূতিগুলো হাওয়ায় উবে গেলো। থতমত খেলো চিংকি। সে মোটেই প্রস্তুত ছিলো না এমন কিছু শোনার জন্য। ক্ষণসময়ের জন্য সে ভেসে গিয়েছিলো মুহূর্তের আবেগে। সেই আবেগের তাড়নায় সে জাওয়াদকে সান্ত্বনা দিতে চাইছিলো। বোঝাতে চাইছিলো সে কখনোই তাকে তার বাহিরের সৌন্দর্যের জন্য তাকে পছন্দ করে নি। কিন্তু সেই কথাটি এই চালাক পুরুষটি এমন বাজে ভাবে ধরে বসবে তার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। হতচকিত স্বরে বললো,
“না, মোটেই না”

জাওয়াদ শব্দ করে হেসে উঠলো। তার হাসির ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হল নিস্তব্ধ রাতের অলিগলিতে। চিংকি অভিভূত নয়নে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। মানুষটির অকৃত্রিম হাসিটা সুন্দর। জাওয়াদ হাসতে হাসতেই বললো,
“তুমি আমাকে পছন্দ না করলে সমস্যা নেই। তবে অপছন্দের সারিতে ফেলিও না”

চিংকি চোখমুখ কুচকে বললো,
“কেনো?”
“কারোর অপছন্দের সারিতে থাকা ভয়ানক ব্যাপার। বলা তো যায় না, কোন বদদোয়া লেগে যায়”
“আমি এসব বদদোয়া টদদোয়া দেই না”
“রাগ পুষে রাখো?”
“না”
“তাহলে আমার উপর তোমার কোনো রাগ নেই?”
“আপনার উপর আমার রাগ থাকবে কেনো?”

অবাক কণ্ঠে শুধালো চিংকি। জাওয়াদ হাসলো। দূর্বোধ্য হাসি। চিংকি সেই হাসির অর্থ বুঝলো না। তবে মস্তিষ্কের তটে উঁকি দিল প্রবীন স্মৃতি। চিংকি দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তাকালো ঘুটঘুটে আঁধারে দূর আকাশে টিমটিম করে জ্বলা নক্ষত্রের দিকে। ম্রিয়মান স্বরে বললো,
“রাগ যদি থেকেও থাকে সেটা সময়ের প্রবাহে জং ধরে গেছে। এখন অনুভূতিগুলো খুব ঝাপসা”

জাওয়াদ চুপ রইলো। চিংকি এখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। শীতল হিম বাতাস ছুয়ে যাচ্ছে মুখশ্রী। আঁধারের আকাশের চাঁদটাকে দেখতে সুন্দর লাগছে। ঘোর লাগছে। কেউ খুব আড়ালে বাতাবরণে যেনো মাদকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। জাওয়াদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা প্রাচীরটা একটু একটু করে ভাঙছে। সেই সাথে হৃদয়ের লুকায়িত প্রকোষ্ঠে বন্দি পুরোনো অনুভূতিগুলো নিজের মুক্তির ফরমান জানালো। খুব ধীর স্বরে বললো,
“আচ্ছা জাওয়াদ সাহেব? আপনার কি মনে আছে ওই ফেয়ারওয়েলের দিন আপনাকে একটা মোটামত, বাজে দেখতে মেয়ে একটা প্রেমপত্র দিয়েছিলো? অবশ্য আপনাকে সেদিন অনেকেই প্রেমপত্র দিয়েছিলো। মনে থাকার কথাও না। এমন প্রেমপত্র আপনি দিনে দশটা পান। আচ্ছা, সেদিন যদি আপনার বন্ধুর সাথে ঝামেলা না হত, তাহলে কি সেদিনটা ভিন্ন হত?”

চিংকি জানে অবান্তর একটি প্রশ্ন। তবুও কেনো এই প্রশ্নটা করলো সে? হয়তো কিশোরী চিংকি এখনো সেই সুন্দর, দয়ালু কিশোরের উত্তরের অপেক্ষা করছে। হয়তো সেই প্রথম প্রেমের আবেগটা কোথাও না কোথাও এখনো তার হৃদয়ে জড়িয়ে আছে। চিংকি খুব বিব্রত হল প্রশ্নটি করার পর। তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। এক অব্যক্ত শক্তি তাকে একেবারে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। অন্তঃস্থল থেকে বারংবার একটা কথাই এলো,
“প্লিজ ভুলে যান। ভুলে যান। কিছু বলি নি আমি”

যখন মুখ ফুটে বলতে গেলো তখনই কাঁধে ভারী কিছু অনুভূত হল। কিছুক্ষণ বাদেই ভারী নিঃশ্বাস অনুভূত হলো। স্তব্ধ হয়ে গেলো সে। মানুষটি ঘুমিয়ে গেছে? হ্যা, জাওয়াদ ঘুমিয়ে গেছে। তাও তার কাঁধে মাথা রেখে। কোনো মানুষ কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে যেতে পারে এই প্রথম দেখলো চিংকি। ভাবতেই হেসে উঠলো চিংকি। অন্তর থেকে বিশাল ভার কিছু নেমে গেলো যেন। হাসিটা মিলিয়ে গেলো না। রয়ে গেল তার ঠোঁটের কোনে। উষ্ণ এক অনুভূতি হৃদয়কে দোলা দিলো। রাতটা অনেক শান্ত, সুন্দর। পাশের পাগল মানুষটা আরোও সুন্দর।

*****

সূর্যের প্রথম কিরণ চোখে পড়তেই চোখ কুচকে গেলো জাওয়াদের। কুয়াশাস্নাত সমীরণ বইছে। চোখ ফেলতেই দেখলো ধরণীর আঁধার একটু একটু করে শুষে নিচ্ছে সূর্যের নরম প্রভা। শান্ত প্রকৃতি, নিস্তব্ধতা চিরে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। এতো উপর থেকে কমলা সূর্যের একাংশ দেখা যাচ্ছে। জাওয়াদের মস্তিষ্ক সতেজ হতেই অনুভূত হলো সে নরম কিছুতে মাথা রেখেছে। ফলে স্নায়ু সোচ্চার হলো। তখন টের পেলো সে চিংকির কোলে ভুস ভুস করে ঘুমাচ্ছিলো। দুচোখ মেলে উপরে চাইলো। মেয়েটা বসে বসে মাথা নুইয়ে ঘুমাচ্ছে। সূর্যের নরম আভা তার শ্যাম মুখে এসে ভিড়েছে। সারাটা রাত একভাবে বসে ছিলো সে। জাওয়াদ বোকার মত চেয়ে রইলো চিংকির দিকে। ঘুম ভাঙ্গতে এমন কিছু দেখবে কল্পনাতীত ছিলো। উপরন্তু তার ঘুমন্ত শান্ত মুখখানা দেখতেই ইচ্ছে করছে। অথচ তাদের এখন বাড়ি ফেরা উচিত। সে কখন ঘুমিয়ে গেছে নিজেরও খেয়াল নেই। সারাদিনের ধকলে কখন চোখ বুজে এসেছিলো টের অবধি পায় নি। কারোর গায়ে ঘেষাঘেষী করা অপছন্দ জাওয়াদের। অথচ সে নিশ্চিন্তে চিংকির কোলে ঘুমাচ্ছে। নিজের এমন পরিবর্তনে সে নিজেও অবাক। বিস্ময় তার চিন্তা চেতনাকে ঘিরে ধরলো। জাওয়াদ গতকাল থেকে অদ্ভুত আচারণ করছে। অবান্তর কারনে রাত বিরাতে হীম ঠান্ডায় একটা মেয়ের বাড়িতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। একরকম জোরপূর্বক সে মেয়েটিকে সাথে নিয়ে বের হলো। কারণ তাকে তার জীবনের বাজের দিনের গল্প শুনাবে। শুধু সেখানেই সে সীমাবদ্ধ ছিলো না। সে তাকে তার কোলে নিশ্চিন্তে সকাল অবধি ঘুমালো। কথা বলতে বলতে কে ঘুমায়? আকাশে চাঁদ, খোলা পরিবেশে মানুষকে প্রেম করতে শুনেছে অথচ এমন বেপরোয়াভাবে ঘুমাতে কাউকে শুনে নি।

উঠে বসলো জাওয়াদ। ঘড়িতে তখন সময় ছয়টা ত্রিশ। সুর্যের নরম আভায় আলোকিত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে মস্তিষ্ককোষগুলো তরান্বিত হলো। নিজের অবুদ্ধিতায় নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হলো। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মায়া হল। কি অসহায়ের মত ঘুমাচ্ছে। ডাকতে ইচ্ছে করছে না মোটেই। কিন্তু ডাকতে হবে। কারণ ওদিকের কি অবস্থা সে জানে না। তরঙ্গিনী আপু কি সামলিয়ে নিয়েছে? কে জানে?

জাওয়াদ মাথা চুলকালো। মস্তিষ্ক মোটেই কাজ করছে না তার। আলতো করে ডাকলো চিংকিকে। দুবার ডাকতেই ফোলা ফোলা চোখে তাকালো। চোখজোড়ায় রাজ্যের ঘুম। জাওয়াদ মৃদু স্বরে বললো,
“বাড়ি যাবে না?”

জাওয়াদের কথায় ঘুম ছুটে পালালো সে। মস্তিষ্ক সতেজ হতেই একরাশ চিন্তা হানা দিলো। সারারাত সে বাহিরে। বাসার কি অবস্থা কিছুই জানা নেই! বাবা নিশ্চয়ই এখন উঠে গেছে। শীতল হাওয়াতেও ঘামতে লাগলো চিংকি।

*****

জাওয়াদের মোটরসাইকেল থামলো ঠিক চিংকির বাড়ির নিচে। চিংকি তাড়াহুড়ো করে নামলো বাইক থেকে। হুড়মুড় করে বাড়িতে ঢুকতে গেলেই হাত টেনে ধরলো জাওয়াদ। মৃদু স্বরে বললো,
“সরি”

অন্য সময় হলে চিংকি বোধ হয় দু কথা শুনিয়ে দিত। কিন্তু আজ পারলো না। কেনো যেনো মানুষটি অসহায় চাহনীতে কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না। বরং স্বর নরম হলো,
“আপনি বাড়ি যান, অফিস আছে তো। পরে কথা বলব”
“পরে কথা বলবে তো?”
“হু”

চিংকির কথা শুনতেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো জাওয়াদের। প্রফুল্ল চিত্তে বাইকে স্টার্ট দিল সে। তরঙ্গিনী চুপিসারে দরজা খুলে দিলো। ঘরের প্রতিটা প্রাণী এখনো ঘুমে। মোস্তফা সাহেব সকালে আজ উঠতে পারেন নি। তাতে সুবিধাই হল দুবোনের। চিংকি সরাসরি নিজের ঘরে চলে গেলো। তরঙ্গিনীর চোখমুখ শক্ত। সে কঠিন স্বরে শুধালো,
“রাতভর কোথায় ফস্টিনষ্টি করছিলি?”

তরঙ্গিনীর প্রশ্নে চোখ বড়বড় হয়ে গেল চিংকি। তরঙ্গিনীর এমন অশ্লীল ভাষ্যের প্রয়োগে সে বাকরুদ্ধ হলো। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী নিরুপমা কবিরের মেয়ের এমন অভদ্র ভাষার প্রয়োগ শুনলে নিরুপমা নির্ঘাত একবার ভিড়মি খেতেন, দুদিন বিলাপ চলতো, তৃতীয়দিন তরঙ্গিনীর স্বামীকে বাড়ি ডেকে একেবারে দক্ষযজ্ঞ। ভাগ্যিস তিনি শুনেন নি। চিংকি হতাশ স্বরে বললো,
“এ কেমন বিশ্রী ভাষা আপু?”
“আহা! তুমি রাত বিরাতে ওই ছাগলের সাথে রঙ্গ করবে আর আমি বললে দোষ। সত্যি করে বল, রাতভর কই ছিলি?”
“আমি মোটেই রঙ্গ করি নি আপু। উনি আমাকে উনাদের একটা অর্ধনির্মিত ফ্লাটে নিয়ে গেছিলেন। আর এমন কিছুই হয় নি। আমি এত চিপ না”
“আহাহা! নেকুপিসি। কিছু বুঝি না আমি? সত্যি করে বল। চুমু খেয়েছে?”

তরঙ্গিনীর এমন জেরায় বারবার হতবাক হচ্ছে চিংকি। একপ্রকার অপ্রসন্ন মুখোভঙ্গি করে বললো,
“ছিঃ, না”
“জড়িয়ে ধরেছে?”
“নাহ”
“হাত ধরে বসেছিলো?”
“উহু”

চিংকির উত্তরে তরঙ্গিনী হতাশ গলায় শুধালো,
“ছা/গ/ল/টা করেছে কি তাহলে?”
“কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে”
“ও মাই গড! কি করেছিস রে চিংকি!”

একপ্রকার আর্তনাদ করে উঠলো তরঙ্গিনী। চিংকি তার মুখ চেপে ধরে বললো,
“চেঁচাচ্ছিস কেন?”

তার হাত সরিয়ে তরঙ্গিনী চিন্তিত গলায় উত্তর দিলো,
“চিংকিরে তুই শেষ! মামলা একেবারে জন্ডিস”
“মানে?”

তরঙ্গিনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিজ্ঞ স্বরে বললো,
“সাইন্স বলে যদি কোনো ছেলে কোনো মেয়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমায়, সেই ছেলে নির্ঘাত তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ছা/গ/লটা তোর প্রেমে পড়েছে শতভাগ নিশ্চিত আমি”
“আপু, এবার দুলাভাই আসলে তুই মাথার চিকিৎসাটা করাস প্লিজ”

চিংকি ওড়না খুলে বিছানায় রেখে বসলো। তরঙ্গিনী তার হাত ধরে বললো,
“তুই বিশ্বাস করছিস না আমাকে?”
“নাহ, করছি না। করার কথাও না। আর তুই প্রেম নিয়ে এতো জানিস কি করে? তুই তো কখনো প্রেম করিস নি”

কথাটা শুনতেই তরঙ্গিনী হাসলো। যার অর্থ বুঝতে একেবারেই সময় লাগলো না চিংকি। চোখ বড়বড় করে বললো,
“তারমানে, দুলাভাইয়ের সাথে তোর বিয়েটা?”
“লাভ কাম এরেঞ্জ”
“তুই তো তলে তলে”
“নজর দিস না। তোরটাও হচ্ছে এরেঞ্জ কাম লাআআআআভ”
“মোটেই লাআআভ নয়”

তরঙ্গিনী গালে হাত দিয়ে দুষ্টু স্বরে বললো,
“সত্যি করে বল, তুই একেবারেই পছন্দ করিস না ছাগলটাকে?”
“বারবার ছাগল বলবে নাতো”
“জ্বলে”
“ধ্যাত। তুমি যাও আমি ঘুমাবো”
“কেনো? রাতে ঘুমাতে দেয় নি”
“ছিঃ মানুষ শুনলে কি বলবে? দুলাভাইকে এবার আসলে বলতে হবে তোর ব্রেনের চিকিৎসা করাতে। যা এখান থেকে”

তরঙ্গিনী গুনগুন করতে করতে বেরিয়ে গেল,
“প্রেমে পড়েছে মন প্রেমে পড়েছে
অচেনা এক মানুষ আমায় পাগল করেছে
প্রেমে পড়েছে মন প্রেমে পড়েছে
অচেনা এক মানুষ আমায় পাগল করেছে”

দীপশিখা দরজা আটকে দিলো। বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। তার ঘুম আসছে না। রাতের স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কে জীবন্ত এখনো। এমন একটা রাত এই ধলা গরু দিবে কল্পনাতেই ছিলো না। ফলে মোবাইলফোনটা হাতে নিলো সে। ম্যাসেজ করলো জাওয়াদকে,
“এতো সুন্দর স্মৃতির জন্য, ধন্যবাদ”……………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি