স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা পর্ব-১২

0
50

#স্বপ্নে_দেখা_রাজকন্যা
#১২তম_পর্ব

“এতো সুন্দর স্মৃতির জন্য, ধন্যবাদ”

ম্যাসেজটা করেই ফোন রেখে দিলো দীপশিখা। হৃদয়ের কোনো কোণায় এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব হচ্ছে। ছয় বছর পূর্বের সেই বদ্ধ জানালা আবারো খুলতে ইচ্ছে করছে। কঠিন হৃদয় দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়তে চাইছে। কিশোরী দীপশিখার মতো বোকাপ্রেম নয়, সত্যি সত্যি প্রেম। পারবে। কিশোর জাওয়াদের নয়, সে প্রেমে পড়তে চায় রাত বিরাতে পাগলামি করা ধলা গরুর। এমন প্রেম যেখানে একে অপরকে আবিষ্কার করতে পারবে, একে অপরের প্রতি সমর্পিত হতে পারে। এমন প্রেম যা দীপশিখাকে পূর্ণতা দিবে। তার জীর্ণশীর্ণ, মলিন মন ক্যানভাসে রঙ ঢেলে দিবে। যে প্রেম তার সাদামাটা জীবটাকে একটা সুন্দর গল্প দিবে। যে গল্প সে শুনাবে কোনো বিষন্ন রাতের জ্যোৎস্নাকে। কোনো ভোরের শিশিরে লিখবে এক নীরব গান, যার শেষ সুরটা হবে জাওয়াদ আর তাকে নিয়ে। দীপশিখার চোখ বুজে এলো। এক অকৃত্রিম হাসিমুখ নিয়ে ঘুমাতে গেলো সে।

*****

চাকরীর জীবনে এই প্রথমবার দেরিতে এলো জাওয়াদ। নেত্রপল্লবে ঘুমের রাজ্য আর শরীর ভর্তি ক্লান্তি নিয়ে এগারোটার সময় অফিস পৌছালো জাওয়াদ। তিনটা প্রজেক্টে সে জড়িত। সামনে কোম্পানির এমডির ভিজিট আসছে। ইনচার্জ সামনের সপ্তাহে দেশের বাহিরে যাচ্ছেন। জাওয়াদের নামও উঠেছিল। কিন্তু জাওয়াদ নিজের পাসপোর্ট বাহানা দিয়ে যায় নি। আসল কারণ ছিলো দু সপ্তাহের জন্য চিংকির দর্শন হবে না। ফলে ইনচার্জ সব প্রজেক্টের দায়িত্ব তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। তখন মনে হলো, ভিডিও কলেও চিংকির সাথে কথা বলা যেন। মুখোদর্শন তো একভাবে হলেই হয়। কিন্তু কিছুই করার নেই। কাজের চাপ বেড়েছে। সেই সাথে ইনচার্জের বকাঝকাও। প্রায় প্রতিদিন এমন ক্লান্ত শরীর আর চোখভর্তি ঘুম নিয়ে অফিসে আসায় সে তার চক্ষুশূল হচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ করার সুযোগ দেয় নি জাওয়াদ। আজ সেই সুযোগ দিয়েছে সে। মাথা পেতে তার সব কটুক্তি মেনে নিয়েছে সে। “জী ভাই, জী ভাই” করে বেরিয়ে এলো সে। নিজের টেবিলে বসতেই মোবাইল টুং করে বেজে উঠলো। মোবাইলের দিকে তাকাতেই সেখানে চিংকির ম্যাসেজ উঠলো,
“আজ আমি ভার্সিটি যাচ্ছি না, টিউশনেও যাব না”

জাওয়াদ সাথে সাথেই তাকে ফোন দিয়ে বসলো। তিনবারের মাথায় ফোন ধরলো চিংকি। ঘুম ঘুম গলায় উত্তর দিলো,
“কি হলো?”

চিংকির এমন ঘুমে জড়ানো স্বর এবং সহজ কথার ভঙ্গিতে জাওয়াদ একটু থামলো। গোছালো কথাগুলো। ভরাট স্বরে বললো,
“তুমি কি ঘুমাচ্ছো?”
“এটা জিজ্ঞেস করতে ফোন দিয়েছেন?”

জাওয়াদের মনে হলো মেয়েটা হাসছে। ফলে মাথা চুলকে বললো,
“না, ভাবলাম তোমার শরীর ঠিক আছে কি না?”
“আমি ঠিক আছি জাওয়াদ সাহেব। আমার ঘুম পূরণ হচ্ছে না। তাই ঘুমের জন্য আজকের দিন অঘোষিত ছুটি”
“তাহলে আমরা দেখা করবো কখন?”
“একদিন না দেখা করলে কি আপনার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়বে?”
“পড়তেও পারে। ইউ নেভার নো, হয়তো আরোও ভয়ানক কিছু হতে পারে”

ওপাশ থেকে হাসির উচ্চ শব্দ কানে এলো। মেয়েটা রেগে নেই। যাক রাত্রিভ্রমণটা কাজে এলো। যদি গতরাতের ঠান্ডার মধ্যে বাইক চালানোটা খুব বুদ্ধিমানের কিছু ছিলো না। কারণ জাওয়াদের গলা ভেঙ্গে গেছে। নাক বন্ধ হয়ে আছে। গাও ব্যাথা। কিন্তু চিংকি রেগে নেই। সে হেসে হেসে কথা বলছে। এটাই মনের শান্তি। কিন্তু আজ দেখা হবে না, ব্যাপারটি খুব ভাবাচ্ছে তাকে। তখন ওপাশ থেকে মৃদু স্বর বললো,
“জাওয়াদ সাহেব আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমাদের সকালটাই একে অপরের মুখ দেখে হয়েছে। আজকের দিনের কোটা ওখানেই পূরণ হয়ে গেছে। তাই আজ আমি ঘর থেকে বের হচ্ছি না। এখন ঘুমাবো। রাখছি”

বলেই মেয়েটা ফোন রেখে দিলো। জাওয়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চিংকির এই কাটকাট স্বভাবগুলোতে সে অভ্যস্ত। মেয়েটির আনুষ্ঠিকতা বা সামাজিকতার বালাই নেই। সে কখনো অপর মানুষটির জন্য অপেক্ষা করবে না। জাওয়াদের স্বভাবের একেবারে উলটো। হয়তো একারণেই সে সবচেয়ে আলাদা। চিংকি ঠিক বলেছে আজ সকালের সূচনাই হয়েছে তার মুখ দর্শনে। সুতরাং আজকের দিনে দেখা না হলেও সমস্যা নেই। ফলে ঠোঁটের কোণায় উন্মোচিত হলো হাসি। এর মধ্যেই পাশের কলিগ শুধালো,
“একা একা হাসছো কেনো জাওয়াদ?”
“না তো”
“তুমি খুব বদলে গেছো”
“তাই নাকি?”
“হ্যা”

কলিগের কথার উত্তর দিলো না জাওয়াদ। ভাবনার মেঘ ভিড়লো মস্তিষ্কে। সত্যি কি সে বদলে গেছে?

****

রাতের আদুরে চাঁদ ঘিরে মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে। ব্যস্ত শহরের জ্যামজট ছাপিয়ে, অসম্ভব মাথা ব্যথা এবং শরীর ব্যাথা নিয়ে বাড়ি ফিরলো জাওয়াদ। শরীরের প্রতিটা অংশে অসহনীয় ব্যাথা। মনে হচ্ছে তাকে ধরে কেউ নির্মমভাবে গণপিটুনি দিয়েছে। চুলগুলো ভিজে গেছে ঘামে। তাপমাত্রা হুট করেই বেড়ে গেছে। শীতের রুক্ষ্ণতা ঢাকা নামক শহর থেকে কোনো কথাবার্তা ছাড়াই পালাতে চাইছে তাতে সন্দেহ রইলো না। ফলে জ্যাকেটটা হাতে ঝুলিয়ে কলিংবেল বাজালো। তাকে অবাক করে দরজা খুললো পাভেল। প্রথমে মনে হল পাভেলের প্লাস্টিক সার্জারি হয়েছে। চিনতে কষ্ট হচ্ছে। অবশ্য কতদিন এই মুখখানা সে দেখে নি, হিসেব করা হয় নি। ফলে নিস্পৃহ স্বরে জাওয়াদ শুধালো,
“তোর বাড়ি ঘর নেই? আমার বাড়ি কি?”

পাভেল খেঁচিয়ে উত্তর দিলো,
“তুই বেঁচে আছিস নাকি চিংকি তোকে বদ করেছে দেখতে এসেছি”

বসার ঘরে টিভি ছেড়ে বসেছিলো জ্যোতি। কোলে একটা পপকর্ণের বাটি। টিভিতে কোরিয়ান একটি সিরিজ চলছে। চিং চিং ফুং ফাং শব্দে মাথা ব্যাথাটা বাড়লো যেন জাওয়াদের। এসেই দুম করে প্লাগ খুলে ফেললো। জ্যোতি কিছু বলার আগেই কঠিন স্বরে বললো,
“এই ছাগলকে বিদায় করে দরজা আটকে দিবি। আর ঘরে শব্দ করবি না”
“এটা অন্যায় ভাইয়া”

পকেট থেকে মানিব্যাগটা জ্যোতির হাতে ধরিয়ে বললো,
“শব্দ যেন না হয়”

জ্যোতি টাকাপ্রেমী নারী। সে হেডফোন দিয়েও তার সিরিজ দেখে নিবে। পাভেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“চলো পাভেল ভাই, বাড়ি যাও”
“রাখ তোর বাড়ি”

*****

পাভেল ক্ষিপ্ত দৃষ্টি তাকিয়ে রয়েছে জাওয়াদের দিকে। যে পান থেকে চুন খসলেই তাকে জরুরি তলব করে নিয়ে আসতো সেই ছেলে বিগত পনেরোদিন তাকে একটা কল দেয় নি। ফলে নিজেই ছুটে এসেছে জাওয়াদকে দেখতে। তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ বলা যাচ্ছে না। কেমন ছন্নছাড়া কবি কবি ভাব চলে এসেছে তার মাঝে। চুল উশকো খুশকো, চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ অথচ মুখমন্ডলে সন্তুষ্টি। প্রেম প্রেম গন্ধও তার আশপাশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। জাওয়াদ জামা বদলে ফেলেছে। একটা পাতলা সাদা টি-শার্ট পড়লো। বিছানায় বসতে বসতে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বললো,
“তুই কি এখানে থাকবি আজকে? আমার মুখ দেখে রাত কাটাবি?”
“আগে তো হেগে শুচতে গেলেও আমাকে ফোন দিতি, এখন আমি সামনে বসে থাকলেও সমস্যা?”

জাওয়াদের চোখে মুখে বিরক্তি প্রখর হল। একেই মাথা ব্যাথা, জ্বর জ্বর লাগছে। উপর থেকে পাভেলের অসংগত কথাগুলো মেজাজ চড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে কঠিন স্বরে বললো,
“আমি ভালো আছি, এবার বাড়ি যা”
“সে দেখতেই পাচ্ছি। শুনলাম গতরাতে নাকি তুই বাড়ি ফিরিস নি। কই ছিলি? চিংকির বাড়ির সামনে?”

জ্যোতির মুখটা সেলোটেপ দিয়ে আটকে রাখতে পারলে ভালো হত। নিশ্চয়ই ঘুষ খেয়ে সব গরগর করে বলে দিয়েছে। পাভেলের চোখে মুখে চাপা হাসি। কৌতুক কণ্ঠে শুধালো,
“তা চিংকির জাদু টোনা ধরতে পেরেছিস নাকি সেই জাদুটোনায় নিজেই পিছলে গেছিস?”
“চিংকি মোটেই জাদুটোনা করে না। ফাও বকিস না”
“ও বাবা, আমি ফাও বকছি? এই ভাষ্য তোর ছিল”
“ভুল ছিলো। শি ইজ ডিফারেন্ট। ইউনিক”

বলেই মৃদু হাসলো জাওয়াদ। পাভেল কিছু সময় হতভম্ব তাকিয়ে রইলো। তারপর বিদ্রুপ টেনে বললো,
“কেস তো জন্ডিস। তোর হাল দেখে তো মনে হচ্ছে মেয়েটা আসলেই জাদু জানে। মানে এই কদিনে তো তুই চিংকি মালা জপছিস?”
“অফ যা গাধা”
“মানে আমার বিশ্বাস করতে হবে তুমি চিংকির প্রেমে পড়ো নি?”
“মোটেই না, পাগল তুই?”

পাভেল হতভম্ব স্বরে শুধালো,
“তাহলে তোদের মধ্যে কি চলছে? মানে তোদের ফিউচার কি? দু বাড়ি বিয়ের কথা বলছে, আংকেল আজকেও আমাকে ডেস্পারেটলি জিজ্ঞেস করলো তোদের মধ্যে কি চলছে? তুই কি ওকে বিয়ে করবি?”
“অবশ্যই না”
“তাহলে তুই কি চাচ্ছিস? জ্যোতির ভাষ্য অনুযায়ী তুই প্রতিদিন ওর সাথে দেখা করছিস। গত রাত ওর সাথে ছিলি! এগুলো শুধু স্বপ্নের জন্য? তুই ওর স্বপ্নের ভয়ে ওর সাথে সময় কাটাচ্ছিস? তারপর? তারপর কি? তোর ভাষ্যমতে তুই চিংকির প্রেমে পড়িস নি, তুই চিংকিকে বিয়ে করতে চাস না। তাহলে তোদের মধ্যকার সম্পর্কটা কি? আল্টিমেটলি কি চাচ্ছিস তুই?

পাভেলের প্রশ্নে স্তম্ভিত হলো জাওয়াদ। তার কাছে উত্তর নেই। মাথাটা ব্যাথা করছে প্রচন্ড। জাওয়াদের প্রশ্নগুলো অত্যন্ত যন্ত্রণা দিচ্ছে। ফলে পাভেলকে ঠেলে ঠুলে ঘর থেকে বের করলো। মুখের উপর দরজা লাগানোর পূর্বে কড়া স্বরে বললো,
“আমাকে নিয়ে তোর এতো ভাবা লাগবে না”

******

শীতের মৃদু শীতলতায় হু হু করে জ্বর উঠলো জাওয়াদের। মধ্যরাতের বিষন্ন জ্বর। যে জ্বরে শরীরের প্রতিটি কোণ চিৎকার করে জানান দেয় অসহনীয় বেদনার। মস্তিষ্ক ভারী হয়ে যায় কিছু অযথা চিন্তায়। ঘুমাতে চাইলেও মস্তিষ্ক সজাগ। পানি পিপাসায় গলা শুকিয়ে এলো। কিন্তু শরীরটাকে টেনে তোলার সামর্থ্য নেই আত্মার। ঝাপসা চিন্তা চেতনায় এক গোলগাল, শ্যামলা মুখ ভেসে উঠলো। নীল রঙ্গের শাড়ির আঁচলটা উড়ছে তার। খোপা করা চুল থেকে কিছু অবাধ্য চুল ঢিলে হয়ে কপালে পড়ছে। মুখখানা দেখে বুকের মধ্যিখানে শান্তি আসলেও সেই শান্তির স্থায়ীকাল হলো ক্ষীন। যখন তার চোখজোড়ার বিষন্ন দৃষ্টি তাকে শুধালো,
“কেনো ঠকাচ্ছো আমাকে?”

জাওয়াদের মনে হলো তার হৃদয়ে কেউ ভোঁতা ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে। এতো অসহনীয় যন্ত্রণা অনুভূত হলো। অধৈর্য্য হয়ে গেলো জাওয়াদ। হৃদয়টা ছিড়ে আসার অদ্ভুত অনাহুত নীল ব্যথা তাকে দূর্বল করে দিলো। ভিজে এলো নয়ন। সেই ঝাপসা অবয়বকে নিজের মাঝে আগলে রাখার দূর্নিবার ইচ্ছে হলো। কিন্তু অভিমানিনী তাকে সুযোগ দিলো না। ফলে অতল কৃষ্ণ গহবরে হারিয়ে যেতে লাগলো জাওয়াদ। “একটু শোনো” বলার অবকাশ পেলো না জাওয়াদ। তার পূর্বেই চেতনা হারালো। যখন চোখ মেললো, নিজেকে আবিষ্কার করলো হাসপাতালের বিছানায়। আর প্রথম যে মুখখানা দেখলো সেটা হলো চিংকির, গোলগাল, শ্যামলা, স্নিগ্ধ সেই মুখ……………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি