স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা পর্ব-১৪

0
54

#স্বপ্নে_দেখা_রাজকন্যা
#১৪তম_পর্ব

“তোমার সমস্যার কারণটা আমি মনে হয় ধরে ফেলেছি। আমার কাছে তা সমাধানের দুটো উপায়ও আছে। একটি সহজ অন্যটি জটিল। তবে তার পূর্বে আমার কিছু জানার আছে”

লোকটির মুখ থমথমে। চোখে মুখে চিন্তার প্রলেপ। তার কপালে সমান্তরাল রেখাগুলো প্রগাঢ় হয়েছে। ফলে জাওয়াদ এবং পাভেল মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। উৎকন্ঠিত গলায় শুধালো,
“কি সেই উপায়গুলো?”

পড়াবাবা একটা ডিম বের করে দিলো। এগিয়ে দিয়ে বললো,
“বলবো। তার আগে এই ডিমটা মাজায় বেঁধে রাখবে। একদিন মাজায় বেঁধে রাখবে। আগামীকাল ঠিক এই সময়ে আসবে। আমি ডিম ভেঙ্গে দেখবো। তারপর আমি উপায় বলবো”

ডিম দেখে মুখ বিকৃত করে ফেললো জাওয়াদ। জাওয়াদ অন্ধবিশ্বাসী নয়। ফলে মাজায় ডিম বেঁধে রাখার ব্যপারটি মোটেই পছন্দ হলো না তার। উপর থেকে শুচিবাই স্বভাব থাকায় মুখ বিকৃত করে শুধালো,
“এই ডিম বেঁধে কি হবে?”

লোকটির মুখে বিরক্তিভাব এলো না। হয়তো এমন প্রশ্ন তাকে বহু মানুষ জিজ্ঞেস করে। প্রশ্ন করা মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য তাকে অন্য জীব থেকে আলাদা করে। যদি প্রশ্ন করা বন্ধ হয়ে যায় তবে মানুষ হয়ে যাবে পোষ্য প্রাণী। পড়াবাবা মৃদু হেসে ভারী স্বরে বললেন,
“এই ডিম বলে দিবে তোমার উপর কোনো জাদুটোনা হয়েছে নাকি?”
“সেটা বুঝবেন কি করে?”
“সেটা আগামীকাল বুঝে যাবে”
“আমি মাজায় বাঁধতে পারবো না। ভেঙ্গে গেলে গায়ে মাখামাখি হবে। ডিমের গন্ধ আমার সহ্য হয় না”

লোকটি হাসলো। কপট হাসি। যে হাসি বুঝতে দেয় না তার মস্তিষ্কে কি চলছে। তারপর মৃদু স্বরে বললো,
“বেশ তোমার সংস্পর্শে রেখো, তাহলেই হবে। আমি যা ভাবছি সেটাই যদি হয় তবে ব্যাপারটা থেকে পরিত্রাণ সহজ হবে। কিন্তু যদি তেমন কিছু না হয়…”
“না হয়, তবে?”
“তবে আমার কাছে হয়তো এই সমস্যার সমাধান নেই”

জাওয়াদের মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। সূক্ষ্ণ ত্রাসের ছাপ পরিলক্ষিত হলো। স্বপ্ন সমস্যার কি কোনো পরিত্রাণ নেই? বাবা উঠে পড়ে লেগেছেন বিয়ের জন্য। এই সমস্যার কারণে জাওয়াদ বাবাকে কিছু বলতেও পারছে না। এর মাঝে পাশ থেকে পাভেল ফিসফিসিয়ে বললো,
“ঢপ মারছে। ডিমের ভেতর দিয়ে কি জ্বিন বের হবে? আজাইরা সব টাকা খাওয়ার ফন্দি”

জাওয়াদ বিরক্ত হলো বন্ধুর উপর। রাগী স্বরে বললো,
“স্বপ্ন পরিত্রাণের উপায় আছে তোর কাছে?”

পাভেল চুপ করে রইলো। বন্ধুকে তো মুখের উপর পাগল বলা যায় না। পড়াবাবা পাভেলের দিকে চেয়ে রহস্য করে হাসলো। একটা ছোট বাটি এগিয়ে বলল,
“তোমার বোধ হয় আমার যোগ্যতার উপর সন্দেহ। নাও এই বাটিটা ধর”
“বাটি দিয়ে কি করবো? আমার চাকরি আছে, ভিক্ষা করার প্রয়োজন নেই”
“বেশি কথা বলার বাতিক আছে তোমার, কিন্তু প্রেমিকার সামনে মুখ থেকে তো একটা শব্দও বের হয় না। প্রেমিকার ভাই জানলে কি হবে জানো তো?”

পড়াবাবার কথায় পাভেলের চোখ বিস্ফারিত হল। তার মুখ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করলো। অপলক, হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইলো কিছু সময়। তার হতভম্ব, বিহ্বল মুখখানা দেখে পড়াবাবার হাসি বিস্তৃত হলো। বাটিটা এগিয়ে বলল,
“পানিটা খাও”

পাভেল শুকনো স্বরে বলল,
“এই পানি খেলে কি হবে?”
“প্রেমিকার ভাইয়ের কাছে মার খাবে না”

পাভেলের সন্দিহানচোখে তাকালো। জাওয়াদ অবাক স্বরে বললো,
“তোর প্রেমিকার ভাই আছে নাকি?”

তার প্রশ্নে একটু অপ্রস্তুত হলো পাভেল। আমতা আমতা করে বললো,
“ভাই থাকা কি অপরাধ নাকি? বাপ আছে, মা আছে, ভাইও আছে”

জাওয়াদ খিঁচিয়ে উঠে বলল,
“আমি কখন বললাম অপরাধ? তুই ঘামছিস কেন?”

পাভেল কপালে হাত বুলালো। সে আসলেই ঘামছে। পড়াবাবা হাসছেন। তার হাসির শব্দ নেই। কিন্তু পাভেলের গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। সে কি ভয় পাচ্ছে? এই মানুষটি কি আসলেই আধ্যাত্মিক কিছু? তার কি কোনো অলৌকিক শক্তি আছে? কিন্তু এসব তো কেবলই কথার কথা। মানুষের মধ্যে কোনো অলৌকিক শক্তি থাকে না। কপটতা আর প্রভাবিত করার বুদ্ধিকেই আমরা হতদরিদ্র, সমস্যায় জর্জরিত কাঙ্গাল মানুষ অলৌকিক ক্ষমতার নাম দেই। পাভেলের এই অভিজ্ঞতা এই প্রথম হচ্ছে। মানুষটি সাইকিক টাইপ কিছু কি? যারা মন পড়তে পারে? পাভেল বাটিটা নিলো। চুমুক দিতেই পড়াবাবা মোলায়েম স্বরে বললো,
“তোমাদের বিয়েটা এই বছর ই হবে”

সাথে সাথেই পাভেল কাশতে শুরু করলো। নাকে মুখে পানি উঠে একাকার অবস্থা। জাওয়ার তার মাথায় হাত দিয়ে চাপড় দিচ্ছে। পাভেল কাশছে। জোরে জোরে কাশছে। কাশি থামছে না। পড়াবাবা হাসছেন। তার হাসিটা খুব বিশ্রী। ছমছম করা হাসি।

*****

জাওয়াদরা বাসায় ফিরলো বিকেলের দিকে। পাভেলের অবস্থা নাজেহাল। চোখ মুখে রুগ্ন ভাব ফুটে উঠেছে। পড়াবাবার পড়া পানি খাওয়ার পর থেকেই তার অবস্থা খারাপ। গা গুলাচ্ছে, বমি বমি পাচ্ছে। খচ্চর লোকটি নিশ্চয়ই কিছু মিশিয়ে দিয়েছে। নয়তো সুস্থ মানুষের এমন হবার কথা নয়। পাভেলের পানিটা খাওয়া উচিত হয় নি। কিন্তু প্রেমিকার কথাটা উঠায় সে দ্বিধান্বিত হয়ে গিয়েছিলো। কারণ প্রেমিকা বিষয়ক কথা সে কারোর কাছেই কখনো করে নি। জাওয়াদ পাভেলের এমন অবস্থা দেখে বেশ ভয় পেয়েছে। পড়াবাবাকে সে একেবারে বিশ্বাস করতে পারছে না আবার অবিশ্বাস করতে পারছে না। কারণ পাভেলের প্রেমিকার কথাটা তাকেও ভাবাচ্ছে। পাভেলের প্রেমিকা একটি রহস্য। অমীমাংসিত রহস্য। যে রহস্যের আঁচ সে পেয়েছে এক মাস হবে। সেখানে সেই মেয়ের কথা ওই লোকের জানার কথা না। তার ক্ষমতাকে একেবারে তাচ্ছিল্য করতে পারছে না সে। ডিমটা সে নিয়ে এসেছে। একটা থলেতে ভরে দিয়েছে পড়াবাবার সহযোগীরা। বাসায় ঢুকতেই পাভেলের মুখে মিষ্টি গুজে দিলো জ্যোতি। কারোর হাতে কিছু খাওয়া জাওয়াদের অপছন্দ। তার গা গুলায়। কিন্তু জ্যোতি নামক বদ মহিলাটি জানা সত্ত্বেও এই কাজ করবে। জাওয়াদ মুখ বিকৃত করে বলল,
“কিসের খুশিতে লাফাচ্ছিস? বাংলাদেশ কি তৃতীয় বারের মতো স্বাধীন হয়েছে নাকি অবশেষে পাশ করেছিস পরিসংখ্যানে”

জ্যোতি তার খোঁচাকে গা মাখালো না। কারণ সে খুব খুশী। সামনে বড়লোক হতে চলেছে সে। গদগদ স্বরে বলল,
“তুই যা খুশি তাই বল, আমি গা মাখাবো না। কারণ দিন পনেরোর মধ্যে আমার সুদিন আসছে”
“কি হবে দিন পনেরোতে?”
“তোর বিয়ে হবে আর আমি হব বড়লোক”

দাঁত বের করে উত্তর দিলো জ্যোতি। জাওয়াদ হতভম্ব দাঁড়িয়ে রইলো। বিয়ে মানে! চিংকি হ্যা বলে দিয়েছে? বড় মামার উচ্চ হাসির শব্দ কানে আসছে। তার প্রথম ঘটকালি সফল। এবার জ্যোতির পালা। পাত্র সে ঠিক করে দেখেছে। আব্দুল হামিদ সাহেব অনুমতি দিলেই সে পকেট থেকে ছবি বের করবে। কিন্তু আপাতত নিজেকে সংযত রেখেছেন। বিয়েটা হয়ে গেলেই নিজ থেকেই আব্দুল হামিদের সাথে কথা বলবেন। আব্দুল হামিদ সাহেব ছেলেকে জড়িয়ে বললেন,
“আমি আজ সত্যি অনেক খুশি”

জাওয়াদ পাথর হয়ে গেছে। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। পাভেলের দিকে তাকাতেই সে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বলল,
“অল দ্যা বেস্ট”

জাওয়াদ তার চিন্তার ঘোরে হুটুপুটি খাচ্ছিলোই, তখন ফোনে টিং করে সাউন্ড শোনা গেলো। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করতেই দেখলো চিংকির ম্যাসেজ,
“ঠিক ছয়টায় আমার টিউশন বাসার সামনে দাঁড়াবেন। কাজ আছে”

****

সরু গলির চতুর্থ বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দীপশিখা। পরণে একটি নীল সালোয়ার কামিজ। চুলগুলো বেণী করে এক পাশে দিয়ে রেখেছে। আজ চশমা পড়ে নি। লেন্স পড়েছে। ঠোঁটে খয়েরি লিপ্সটিক। চোখে কাজল। নিজ থেকেই সাজগোজ করেছে। তরঙ্গিনী তাকে সাজায় নি। সে সেজেছে জাওয়াদের জন্য। নিজের এমন কাছে দীপশিখার নিজের খুব হাসি পাচ্ছে। আগে যখন তরঙ্গিনীকে সাজতে দেখতো সে খুব কটাক্ষ করতো। কিন্তু আজ বুঝলো তরঙ্গিনীর সাজার রহস্য। সে তার প্রিয়তমের জন্য সাজতো। যেমন দীপশিখা আজ সেজেছে। প্রিয়তমের জন্য সাজতে ভালোই লাগে। দীপশিখা আজ ঠিক করেছে সে আজ মোটেই অপমান করবে না জাওয়াদকে। মিষ্টি মিষ্টি করে গল্প করবে। সেই গল্পের ফাঁকে তাকে বলবে মনের কথা,
“শুনুন মশাই, আপনার এতোদিনের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। চেনা জানার পাঠ চুকিয়ে এবার নতুন অধ্যায়ে পা রাখতে চাই”

আচ্ছা হুট করে এমন কথা বললে কি জাওয়াদ চমকে যাবে? সে যখন জেনেছে দীপশিখা বিয়ের জন্য রাজী হয়েছে তার অভিব্যক্তি কেমন ছিলো? সে খুশি হয়েছিলো? তার মুখের ভাব কেমন ছিলো? ইশ! দেখতে পারলে ভালো হতো! চিন্তার মেঘের মধ্যেই একটা বাইক খুব জোরে ব্রেক কষলো। হেলমেট খুলতে খুলতে অস্থির স্বরে জাওয়াদ শুধালো,
“কি কাজ?”

জাওয়াদ হাঁপাচ্ছে। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা তার। জাওয়াদের ফর্সা কপালে ঘামের বিন্দুগুলো সোডিয়ামের হলুদ আলোতে চকচক করছে। দীপশিখার মনে হলো এতো সুন্দর পুরুষ সে কখনো দেখে নি। হেসে শুধালো,
“আপনি কি বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে এসেছেন?”

জাওয়াদ অস্থির গলায় বললো,
“ভেবেছি জরুরি কিছু। তুমি তো এভাবে আসতে বল না। এবার বলো এতো জরুরি তলবের কারণ”

জাওয়াদের কথায় হাসলো দীপশিখা। উত্তর না দিয়ে বসলো জাওয়াদের পেছনে। ঘাড়ে হাত রেখে বললো,
“চলুন, ঘুরতে যাবো। আপনি আমাকে বাইকে করে রাতের শহর দেখাবেন”
“এখন?”
“কেনো? আমি তো আপনাকে কখনো বলি নি, “এখন?”। তাহলে আমার আবদারে আপনি কেন বলছেন?”

জাওয়াদ ভাষা হারিয়ে ফেললো। কি বলবে? ফলে অসহায় স্বরে বললো,
“কোথায় যাবে?”
“যেখানে আপনি নিয়ে যাবেন”………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি