স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা পর্ব-১৭

0
47

#স্বপ্নে_দেখা_রাজকন্যা
#১৭তম_পর্ব (ধামাকা পর্ব)

জাওয়াদ পাভেলের সাথে বেরিয়ে গেলো। জাওয়াদ চোখ মুখ কঠিন হয়ে আছে। পাভেল রয়ে সয়ে বললো,
“কি করবি এখন?”
“বিয়ে ভাঙ্গবো সেই সাথে স্বপ্ন থেকেও পরিত্রাণ পাব”
“স্বপ্নের থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে হয় তোকে চিংকির লালা খেতে হবে নয়তো ওকে বিয়ে করতে হবে একর্ডিংলি ওই পঁচাবাবা”
“পড়াবাবা”
“একই কথা। তুই ওর লালাও খাবি না আবার ওকে বিয়েও করবি না। তাহলে স্বপ্নের পরিত্রাণ কিভাবে পাবি শুনি?”

জাওয়াদ চুপ করে রয়েছে। তার চোয়াল শক্ত। পাভেলের জিজ্ঞেসাবাদে বিরক্তির রেখা উন্মোচিত হলো কপালে। সমান্তরাল রেখাগুলো কুঞ্চিত হল। কঠিন, দৃঢ় স্বরে বললো,
“এমন কিছু করবো যেন চিংকি নিজ থেকে আমার সাথে বিয়ে ভাঙ্গে”

পাভেলের কপালে ভাঁজ পড়লো। বিরস গলায় বললো,
“দোস্ত একটা কথা বলবি?”
“কি?”
“তুই সত্যি চিংকির প্রেমে পড়িস নি?”

জাওয়াদ ক্ষিপ্র চোখে তাকালো। তার দৃষ্টির প্রখরতা অনুভব করলেও পাভেল মিয়ে গেলো না। সে আবার শুধালো,
“সত্যি?”
“মাথায় কি স্ট্যাম্প করে রাখবো?”
“না আসলে তুই যেভাবে ওর দিকে ঠিক সেই দৃষ্টিতে তাকাস, যে দৃষ্টি আমি জ্যোতির দিকে তাকিয়ে থাকি। হ্যাংলা, নির্লজ্জ, পরোয়াহীন নজর”

জাওয়াদ চুপ করে রইলো। পাভেলের এমন উক্তিতে তার মুখভাবে ক্ষীণ পরিবর্তন এলো যেন। মনে হলো দ্বিধাগ্রস্থ জাওয়াদ আরো বেশি দ্বিধায় জড়িয়ে পড়েছে। হয়তো এই উক্তিটা তার চিন্তাচেতনাকে কিঞ্চিত নাড়িয়ে দিয়েছে। জাওয়াদের স্বভাব ভালো করেই জানে পাভেল। এই স্বপ্নরহস্যের সমাধান তার কাছে নেই, তবে সে নিজ থেকে একটা যুক্তি দাঁড় করেছে। কিন্তু সেই যুক্তিটা অবশ্য জাওয়াদকে বলা হয় নি। জাওয়াদ বিশ্বাস করতে চাইবে না তাই এড়িয়ে যাওয়াই উচিত। সে অপেক্ষা করলো জাওয়াদের উত্তরের। কিন্তু উত্তর পেলো না। হতাশ হলো যেন সে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে খুব আস্তে বললো,
“মন ভাঙ্গার থেকে বিশ্বাস ভাঙ্গার আঘাতটা প্রখর হয়।”

জাওয়াদ ম্লান স্বরে উত্তর দিল,
“এজন্যই বিয়েটা ভাঙ্গতে চাই। চিংকি একটা ভালো ছেলে ডিজার্ভ করে, যে ওকে ভালোবাসবে। আমি ওকে ভালোবাসি না”

শেষ কথাতা যেন জোর দিয়ে বললো। পাভেল মুচকি হেসে বললো,
“দেখিস, পরে যেন আবার আফসোস না হয়”

জাওয়াদ উপেক্ষা করলো তার কথা। সে কেনো আফসোস করবে? জাওয়াদ কখনোই বিয়ে করার উদ্দেশ্যে চিংকির সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে নি। তার পরিকল্পনা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। চিংকির প্রতি তার অনুভূতিটা সহমর্মিতা এবং মায়ার। মায়া কারণ মেয়েটি একদলা পাকানো মায়া মেঘ। তার শক্ত আবরণের দীপশিখার ভেতর তুলতুলে চিংকিটুকুতে এক অলীক ইন্দ্রজাল আছে। সেই ইন্দ্রজালকে এড়িয়ে চলা অসম্ভব। কোনো মানুষ এই তুলতুলে চিংকির ইন্দ্রজাল কাঁটতে পারবে না। অপরদিকে সহমর্মিতার সৃষ্টি হয়েছে চিংকির প্রতি দুর্ব্যবহার থেকে। যে জাওয়াদ কখনো কারোর সাথে খারাপ আচরণ করে নি সে প্রথমবার অন্যের রাগের শিকার করেছিলো পনেরো বর্ষীয় কিশোরীকে। সেই থেকে বিশ্রী এক আত্মগ্লানি হয়েছে তার। সেই আত্মগ্লানি থেকে ক্ষমা পাবার বুভুক্ষা। জাওয়াদ চিংকির সাথে কেবল সখ্যতা রাখতে চায়। চিংকিকে সে ভালোবাসে না। ভালোবাসায় সে প্রমত্ততা থাকতে হয়, যে মাতাল উন্মাদনা শিরায় শিরায় থাকা উচিত তেমন কিছুই চিংকির জন্য জাওয়াদ অনুভব করে না। তাহলে সেটাকে ভালোবাসা বলা চলে না। সেদিন রান্নাঘরে যা হয়েছিলো, তাকে ক্ষণ সময়ের জন্য হরমোনের গন্ডগোল বলে আখ্যা করেছে জাওয়াদ। চিংকির প্রতি সে হয়তো আকর্ষিত হয়েছিলো। কিন্তু সেই আকর্ষণকে ভালোবাসার নাম দেওয়ার মত মুর্খ নয় জাওয়াদ। কিন্তু বিয়েতে হ্যা বলার পর থেকে জাওয়াদের মনে এক তীব্র ভয় কাজ করছে। সে চিংকির সাথে তার এই সখ্যতাকে নষ্ট করতে চায় না। সে চিংকিকে আঘাত করতে ভয় পাচ্ছে। তার ধারণা চিংকি হয়তো আবারো দূর্বল হচ্ছে। তাই তাকে প্রশ্রয় দিয়ে আকন্ঠ প্রেমে ডুবিয়ে ফেলা ঘোরতর অন্যায় হবে। তাই বিয়ে ভাঙ্গা অত্যাবশ্যক। যে করেই হোক বিয়েটা ভাঙ্গতেই হবে। জাওয়াদের একবার মনে হলো সবটা খুলে বলবে সে চিংকিকে, ক্ষমা চেয়ে নিবে। তার ম্রিয়মান মুখখানা কল্পনা করতেই শিউরে উঠে সে। চিংকিকে আঘাত করার সাহস নেই তার। তাই তাকে আঘাত না দিয়ে তার জীবন থেকে সরে যেতে চায় জাওয়াদ।

****

সূর্য ডুবে গেছে, কিন্তু রেশ কাটে নি তার। লাল আলোখানা এখনো শুষে নেয় নি তমসা। খোলা জানালার ধারে খোলা চুলে বসে আছে চিংকি। তার চোখ ভেজা। মনখানা আদ্র হয়ে আছে। বাদামী দামী কাগজে মনের সকল ভাব উগড়ে দিয়ে তুলোর মতো হালকা লাগছে ভেতরটা। দীপশিখার প্রেমরোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই তার। তার হুটহাট ভীষণ কান্না পায়, মনে হয় পৃথিবীর সকল দুঃখ তাকে আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে। আবার মাঝে মাঝে আনন্দের লহর তার হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে তুলে। এমন তো দীপশিখা ছিলো না। তার এই অনিয়ন্ত্রিত মনোভাব তো কোনোকালেই ছিলো না। সে ছিলো সুসজ্জিত জীবনের অধিকারিনী। তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিলো খুবই সুন্দর করে সাজানো। তার এই সুসজ্জিত জীবনে কোনো বিষন্নতার স্থান ছিলো না। নিজেকে নিজের সাজানো জগতে আকন্ঠ ডুবিয়ে দিব্যি চলছিলো তার জীবন। অথচ এখন সব এলোমেলো, বিশৃঙ্খল। কতগুলো দিন গেলো সে একটা সিনেমা দেখে নি। তার এখন সিনেমার স্ক্রিনপ্লে তে মন বসে না। একঘেয়েমি লাগে ভিডিও বানাতে। রিভিউ পোস্ট করতে। তার সেই ভারী চোখের মনিতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে ভালো লাগে। তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। মনে হয় কথাগুলো পেটের ভেতর দলামচা হচ্ছে। মানুষটি যখন ভারী গলায় বলে,
“কি করছো?”

দীপশিখা বেসামাল হয়ে যায়। সব কথা হারিয়ে যায়। তখন দীপশিখা হয়ে যায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শ্রোতা। নির্বুদ্ধিতায় লজ্জা পায় দীপশিখা। তবুও সে বারংবার একই কাজ করে। দীপশিখা সবার সামনে এমন নয়, শুধু একটি মানুষের জন্যই সে এমন। জাওয়াদ নামক মানুষটিকে একটু নয় এক আকাশ সমান ভালোবেসে ফেলেছে সে। তাই তো হৃদস্পন্দের বেসামাল নগরীর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছে এই জাওয়াদ হামিদ। পাতাটা একটা কারুকাজ খচিত খামে ভরলো সে। সেদিনের ঘড়িটার সাথে এই খামটাও দিবে সে জাওয়াদকে। সামনে চৌদ্দ ফেব্রুয়ারি। পলাশের মৃদু গন্ধে মোরা ফাগুন হাওয়ায় একখানা প্রেমপত্র নিশ্চয়ই বেমানান নয়।

*****

বিয়ে ভাঙ্গার জন্য জাওয়াদ কর্মসূচী বানালো। এই কয়দিনে চিংকি বিষয়ক সে একটি তালিকা বানিয়েছে। তার শিরোনাম,
“চিংকির স্বভার এবং বৈশিষ্ট্যঃ
১. চিংকি স্বাধীনচেতা, সে নিজের উপর জোর পছন্দ করে না।
২. চিংকি নিজের গন্ডিতে থাকতে পছন্দ করে।
৩. চিংকি কুসংস্কার অপছন্দ করে
৪. সে খুব বেশি ঠোঁটকাঁটা।
৫. চিংকি অগোছালো নয়
৬. চিংকি খাওয়ার সময় শব্দ করে না, তবে সে নোংরা খাবারের ব্যাপারে শৌখিন………”

এভাবে সে দশটি পয়েন্ট করেছে। তার মধ্যে প্রথম এবন তৃতীয় পয়েন্টটিকে গোল করলো। স্বাধীনচেতা চিংকিকে অস্বাধীন করার ক্ষমতা একমাত্র মামীর আছে। জাওয়াদের মামী পড়াবাবা বিশ্বাসী মানবী। তিনি চিংকির জন্য এ বাড়ি থেকে পাঠানো সব জামা কাপড় পড়িয়ে এনেছেন। ব্যাপারটি চিংকিকে জানালে সে ক্ষেপে যাবে। এটা নিয়ে ঝামেলা হবে। ঝামেলা হলেই বিয়ে ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। জাওয়াদের বিয়ে ভাঙ্গার কর্মসূচি শুনে পাভেল হাসতে হাসতে বললো,
“আপনি ভেবেছেন
পৃথিবীতে গাধা নেই;
অথচ পৃথিবীতে গাধার অভাব নেই— কবি হয়তো তোর জন্য এই কবিতা লিখেছিলেন”

*****

চৌদ্দ তারিখ, ভালোবাসা দিবস। কোন বলদ চৌদ্দ তারিখকে ভালোবাসা দিবস বলে আখ্যা করেছে জাওয়াদের জানা নেই। নিশ্চয়ই কোনো ব্যর্থ প্রেমিক নিজের ভালোবাসাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জাহির করতে একটি দিন বেছে নিয়েছে। যেন কেউ তাকে উত্তম মধ্যম করতে আসলে সে বলতে পারে আজ ভালোবাসা দিবস, আজ ভালোবাসা জাহির করতে নেই মানা। তার কথায় বিবাহিত এবং বাকি প্রেমিকরাও নিজের পকেটের দুর্দশা কমাতে সম্মতি প্রদান করেছে। নারীদের বুঝিয়েছে এই একদিন ই তোমরা উপহার পাবে। সেই থেকে উৎপত্তি ভালোবাসা দিবসের। এখনের জেনারেশনের একটি গোটা সপ্তাহ এই ভালোবাসার নামে উৎসর্গ অথচ ভালোবাসা কি সেই অনুভূতিটাই এখনো পায় নি জাওয়াদ। তাই ভালোবাসা সপ্তাহকে একটা ফালতু ট্রেন্ড ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না জাওয়াদের। কিন্তু বোনকে কি করে বুঝাবে? জ্যোতি রীতিমত পরিকল্পনা করে ফেলেছে সে বইমেলায় যাবে ভালোবাসা দিবসে। তার দলভারী করেছে চিংকির সাথে। চিংকির বইমেলায় যাবার ইচ্ছে প্রবল। সে বইপোকা মানুষ। একটা লম্বা লিস্ট করেছে সে কাদের বই কিনবে। শুক্রবার হওয়ায় সে উছিলা দিতে পারলো না। জ্যোতি যেহেতু যাচ্ছে পাভেলও লেজ হয়েছে। দাঁত কেলিয়ে বললো,
“একদম ডাবল ডেট হয়ে যাবে”

জাওয়াদ কড়া স্বরে বললো,
“তুই আমার সাথেই থাকবি”
“মানুষ কি মনে করবে? শাহবাগীরা আমাকে ভিন্ন মিনিং এ নিতে পারে”
“তোমার মিনিং সব আমি বের করে দিব। আমার বোনের দু মিটারের মধ্যে তুই থাকবি না”

পাভেল চেপে গেলো। পরিকল্পনা মোতাবেক পল্লবী থেকে তারা মেট্রোতে উঠলো। নামবে টিএসসি। মেট্রোতে এক চুল জায়গা নেই। সবাই শাড়ি পড়ে মাথায় ফুলেল ক্রাউন পড়ে সেজেগুজে বইমেলায় যাচ্ছে। চারটে বাজে অথচ মানুষের ভিড় এক রত্তি কম নয়। ত্রিশ জনের লাইন পেরিয়ে কোনোমতে চারটে টিকিট কিনে তারা মেট্রোতে ঠেলেঠুলে কোনোমতে উঠলো। মেট্রোতে উঠতেই আলাদা হয়ে গেলো চারজন। জ্যোতিকে আগলে নিলো পাভেল। আর চিংকি লেপ্টে রইলো জাওয়াদের সাথে। মানুষ পারলে একে অন্যের গায়ে ঢুকে পড়ে।

মেট্রোর চতুর্থ বগির একেবারে শেষ কর্ণারে কোনো মতে দাঁড়িয়ে আছে দীপশিখা এবং জাওয়াদ। ডানদিকের দরজাটা ঘেষে দাঁড়ানো দীপশিখা৷ এবং তার ঠিক সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে জাওয়াদ৷ সে কিঞ্চিত ঝুঁকে আছে। মনে হচ্ছে সে যেন কিছু আড়াল করতে চাইছে। কোনো মূল্যবান জিনিস যা এই পৃথিবী থেকে আগলে রাখার প্রচেষ্টা করছে সে। এতো জোরে এসি ছাড়ার পরও গরমে ঘামছে জাওয়াদ। তার পাঞ্জাবির প্রথম দুটো বোতাম খোলা। উন্মুক্ত বুকখানা কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে। দীপশিখার নাক খানা বাঁধছে জাওয়াদের গলায়। এক ঝাঝালো, কড়া গন্ধ নাকে বিঁধছে। ভালো লাগছে। চোখ তুলে তাকালেই তার কন্ঠস্থি দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ খুব নিষিদ্ধ ইচ্ছে উঁকি দিলো মনের বাঁকে। কন্ঠস্থি ছুঁয়ে দেখার প্রলোভন জাগলো রমনীর মনে। ছুঁয়ে দিলে কেমন লাগবে জাওয়াদের? আশপাশটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে খুব ব্যতিক্রমধর্মী কাজ করে বসলো মেয়েটি। পাজোড়া একটু উঁচু করে সকলের চক্ষুগোচরে ঠোঁট ঠেকালো জাওয়াদের গলার কাছে। মুহূর্তের জন্য জাওয়াদ স্তব্ধ হয়ে গেলো। তার চোখজোড়া বিস্ফারিত হলো। ঝাঁকুনি খেলো পুরো শরীর। তাকে আরোও চমকে দিয়ে চিংকি তার কানে ফিসফিস করে বললো,
“জাওয়াদ সাহেব, কাজটা ভালো হলো না”

******

মেলায় একখানা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটলো। জাওয়াদের প্রাক্তন শাম্মীর সাথে অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নে দেখা হলো। সে তার বর্তমান প্রেমিকের সাথে এসেছিলো। চিংকি তখন কিনছিলো অজান্তা অহির “ভালোবাসারা ভালো নেই” বইটি। এই বইটির প্রচ্ছদ তার খুব পছন্দ হয়েছে। বেগুনী রঙটা চোখে লেগে আছে যেন। বইটা পড়ে একটা ভিডিও বানাবে সে। আরোও কিছু বইও কেনার আছে। জাওয়াদ তার বই কেনার প্রবণতা দেখে মাথা চুলকালো। এই মেয়েকে বিয়ে করলে বই কিনতে কিনতেই তার অবস্থা খারাপ হবে। ঠিক তখনই পেছন থেকে একটি স্বর কানে এলো,
“জাওয়াদ না?”

জাওয়াদ স্বরটা চিনে ফেললো চট করে। এই মেয়ের স্বর একবছর সে শুনেছে। এতো সহজে কি ভোলা যায়? শাম্মী তার প্রেমিক সমেত এগিয়ে এলো। জাওয়াদ একটু অস্বস্থিবোধ করলো। শাম্মীর সাথে তার ব্রেকাপটা খুব একটা সভ্যভাবে হয় নি। মেয়েটা তাকে অনেক যা তা শুনিয়েছে। অথচ এখন দাঁত কেলাচ্ছে যেন কিছু হয় নি। প্রফুল্ল চিত্তে বললো,
“তুমি বইমেলায়? তোমার তো ভিড় ভালো লাগে না”

জাওয়াদ জোর করে হাসলো। মেয়েটা খুঁচিয়ে কথা বলার একটা বাতিক আছে। এদিকে তার প্রেমিকের দিকেও নজর ঘোরালো জাওয়াদ। বেশভূষায় প্রমাণিত খুব বড়লোকের ছেলে। ঠোঁটে এক বিশ্রী ভর্ৎসনা। জাওয়াদের সহ্য হল না, তাই ফট করে বলে উঠলো,
“আসলে দীপশিখার বই পড়ার অভ্যাস। তাই আসা”

বলেই নিজের হাতের মুঠোতে দীপশিখার নরম হাতটা গলালো। দীপশিখা খানিকটা বিব্রত হলো। মেয়েটির দৃষ্টি হুট করেই যেন ক্রুর হয়ে গেলো তার প্রতি। দীপশিখা একদফা মেয়েটিকে দেখলো। খুবই চমৎকার নারী। রুপবতী সে, পেলব শুভ্র গালে গোলাপের আভা, পদ্মের মতো চোখ, ঠোঁটজোড়া পুরুষের হৃদয়ে দামাদল বাজাবে যেন। এমন সুন্দর নারীকে জাওয়াদের পাশে একেবারে খাপেখাপ বানাবে যেন। দীপশিখা এই প্রথম যেন ঈর্ষা অনুভব করলো। নিজের কদর্য রুপে হীনবোধ হল। কিন্তু তাতে সে মোটেই দমে গেলো না। বরংক জাওয়াদের হাতে হাত গলিয়ে শুধালো,
“কে উনি?”

জাওয়াদ স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“আমার প্রাক্তন”

প্রাক্তন কথাটা কানে বিঁধলো। প্রাক্তন শব্দের সাথে মিশে থাকে একদলা দীর্ঘশ্বাস আর কিছু স্মৃতি। যে স্মৃতিকে মুছে ফেলা যায় না চট করে। মুছে ফেললে একটা অনুভূতিকে লাঞ্চনা করা হয়। চিংকির মনে হলো তার চোখ জ্বলছে। হুট করেই এক বিরহ স্রোত তাকে ধাক্কা দিয়েছে। সে নিজেকে সামলালো খুব কষ্টে। শ্যামা তখন শুধালো,
“নতুন গার্লফ্রেন্ড?”
“না তো, ও আমার হবু স্ত্রী”

জাওয়াদের জড়তাহীন উত্তরে বুকের অস্বস্তির মেঘগুলো যেনো বাস্প হয়ে গেলো। কিন্তু শাম্মীর ঠোঁটে তাচ্ছিল্যভরা হাসি লক্ষ করলো। সে অনেকটা বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বললো,
“আমাকে দাওয়াত দিবে না?”
“তুমি সাজতে বসলে আমার বিয়ে শেষ হয়ে যাবে, থাক এতো কষ্ট করার দরকার নেই”

জাওয়াদের কথায় শাম্মীর হাসি উবে গেলো। অপমানিতবোধ করলো সে। কঠিন স্বরে বললো,
“আমার একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে, ঘরের কাপড় পড়ে তো আর বেরিয়ে যেতে পারি না”
“সেটাই বলছি, তোমার স্ট্যান্ডার্ডে আমি যাই না। দীপশিখা তোমার কেনাকাটা হয়ে গেছে? জ্যোতি আর পাভেল অপেক্ষা করছে। আসছি শাম্মী”

বলেই দীপশিখার হাত ধরে হনহন করে হাটা ধরলো সে। দীপশিখা তার রোষে ঝলসে যাওয়া মুখখানা একবার দেখে নিলো। লোকটি কি প্রাক্তনের উপর ক্ষুদ্ধ নাকি তার কথায় ক্ষুদ্ধ বুঝতে পারলো না।

****

সোডিয়ামের হলদেটে ধিকধিক আলোয় লম্বা দেখা যাচ্ছে ছায়াগুলো। পাশাপাশি হাটছে জাওয়াদ এবং দীপশিখা। রিকশা গলির মুখেই নামিয়ে দিয়েছে। ভেতরে যাবে না সে। ফলে হাটতেই হচ্ছে তাদের। দীপশিখার হাতে দু ব্যাগ বই। মোট সতেরোটা বই কিনেছে সে। নতুন পুরাতন লেখক কাউকেই বাদ দেয় নি যেন। বাড়ির গেটের কাছটায় এসেই জাওয়াদ বললো,
“আমি যাই তাহলে?”
“একটু দাঁড়ান”

দীপশিখা ব্যস্ত হলো। ফলে কৌতুহলী হলো জাওয়াদ। শুধালো,
“কি?”

দীপশিখা নিজের হাতের ব্যাগগুলো রেখে নিজের ব্যাগে কিছু খুঁজতে লাগলো। অতঃপর একটা র‍্যাপিং পেপারে মোড়া চারকোনা বাক্স বের করে এগিয়ে দিলো জাওয়াদের দিকে। জাওয়াদ বাক্সটা দেখে বললো,
“এটা কি?”
“ভালোবাসা দিবসের ছোট উপহার”
“তুমি এসব বিশ্বাস কর?”
“করি আবার করি না। আসলে উপহারটা দিতে চাইছিলাম। কিন্তু বিশেষ দিন পাচ্ছিলাম না। যদিও প্রতিটি দিন ই বিশেষ তবুও…”

জাওয়াদ ম্রিয়মান স্বরে বললো,
“তোমরা মেয়েরা এই বিশেষ দিনের কনসেপ্ট যে কোথা থেকে পাও। শাম্মীও এমন ছিলো।“

হুট করে শাম্মীর কথা উঠায় দীপশিখার অস্বস্তিভরা মনটা নড়ে উঠলো। জাওয়াদও থেমে গেলো। শুকনো গলায় বললো,
“থ্যাংক্স। কিছু দিলাম না বলে রাগ কর না। আসছি”

তখন-ই হাত টেনে ধরলো দীপশিখা। তার চোখের দৃষ্টি অপরিচিত ঠেকলো জাওয়াদের। কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই সে কড়া স্বরে বললো,
“কথাটা শেষ করুন”
“কি কথা?”
“শাম্মীর কথা। শাম্মী কি কি করতো, আমি শুনবো”

জাওয়াদ মাথা চুলকালো। শাম্মীর সাথে দেখা হবার পর থেকেই তার কথা মাথায় ঘুরছিলো। ইচ্ছাকৃত ভাবে সে বলে নি। কিন্তু চিংকিকে কে বুঝাবে? ফলে ইতস্তত স্বরে বললো,
“কিছু মনে করো না প্লিজ। ওভাবে বলতে চাই নি। এসব ডে ফে আমার ভালো লাগে না। শাম্মী আবার এসবে খুব পারদর্শী ছিলো। ওইজন্যই বলেছি। ওর সাথে তোমার তুলনা করি নি। সরি”
“শুকনো সরি আমি নিব না”
“তাহলে?”
“শাস্তি পেতে হবে”

জাওয়াদ হতবিহ্বল হলো, অবাক স্বরে শুধালো,
“কি শাস্তি?”
“চোখ বুঝুন”
“কি?”
“চোখ বিস্ফারিত করতে বলি নি, বলেছি চোখ বুঝুন”

জাওয়াদ অসহায়বোধ করলো। মেয়েটি কি চোখ বুঝতে বলে তার মাথা ফাঁটিয়ে দিবে? হতেও পারে। চিংকির রাগ অনেক। মাথা ফাঁটিয়ে দেব্র সম্ভাবনা শতভাগ। তবুও চোখ বুঝলো জাওয়াদ। হঠাৎ শীতল স্পর্শ পেলো গালে। কৌতুহল জন্মাতেই ঠোঁটের আলতো স্পর্শে কেঁপে উঠলো সারা শরীর। শিরা উপশিরা পেরিয়ে হৃদপিন্ডে ঝড় উঠলো। কখন সেই চুম্বন গভীর হলো টের পেলো না। নিজেকে ছাড়িয়েও নিলো না। অলীক সম্মোহনীর ইন্দ্রজালে বাঁধা পড়লো। নীরব বসন্তের মৃদু গন্ধে প্রতিলিপিত হলো এক নিষিদ্ধ মুহূর্তের কাব্যকাথা।

*****

আজ চিংকি এবং জাওয়াদের হলুদ। একটু পর ভেন্যুতে যাবে তারা। সারা ঘরময় বিয়ের উত্তেজনা ছড়িয়ে আছে। একটু পর পর মেয়েদের উচচস্বর কানে আসছে। জাওয়াদ একটি হলুদ পাঞ্জাবি পড়েছে। কিন্তু সে তীব্র অশান্তিতে ঝলসে যাচ্ছে। জাওয়াদের মস্তিষ্ক তীব্র দ্বিধার সাথে যুদ্ধ করছে প্রতিটি মুহূর্তে, যে ভয়টা পাচ্ছিল সেই ভয়টা সত্যি হয়ে গেছে। চিংকি দ্বিতীয়বারের মত তার প্রেমে আকণ্ঠ ডুবেছে। যে প্রশ্রয়টা সে দিয়েছে সেই প্রশ্রয়ে মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। সেও একটা ভুল করে বসেছে। মোহজালে সে পিছলে গেছে। সেদিন রাতে দূরে সরিয়ে ফেলে নি সে চিংকিকে। চিংকির চোখে অনুভূতির জোয়ারকে অদেখা করতে পারে নি। এই ভুল তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সে নিজের মনুষত্ববোধে নিজেই ধিক্কার জানালো। সে তো সবসময় নিজেকে স্বচ্ছ রাখতে চেয়েছিলো। তাহলে কেনো নিজেকে সপে দিলো ওই রমনীর কাছে। কেনো তার নরম ওষ্ঠের ছোঁয়ায় নিজেকে গুড়িয়ে দিলো। অসহ্য জ্বালাময়ী আবেদন তো কম পায় নি। শাম্মী বহুবার তাকে কাছে চেয়েছে। অথচ সে কখনোই তাতে ধরা দেয় নি। তবে চিংকি-ই কেন? চিংকিকে আঘাত না দিয়ে সরিয়ে দেবার পরিকল্পনাগুলো এক এক করে বিফল হচ্ছে। চিংকির স্বভাববিরোধী কাজগুলো সে হাসিমুখে করছে কারণ সে বিয়েতে ঝামেলা চায় না। একটু পর তাদের হলুদ। হয়তো বিয়েটাও হয়ে যাবে। চিংকির সাথে এই কদিন বেশ এড়িয়ে চলেছে সে। ম্যাসেজের জবার সে দেয় না। চিংকির সাথে দেখা করে না। স্বপ্নটাও আজকাল তাকে ভয় দেখাচ্ছে না। লালাঘটিত বানীটা তারমানে সত্য। চিংকি শুধালে বলে আমার অফিসে কাজ। তার কাছে কোনো উপায় নেই। চিংকিকে ভালোবাসে না সে। চিংকি এমন একটা সংসার সংসার খেলার স্বপ্ন দেখছে যা জাওয়াদ তাকে দিতে পারবে না। এই সত্যিটা আজ না হয় কাল ঠিকই চিংকি জানবে। তখন খুব কষ্ট পাবে। তাকে কষ্ট দেবার কথা ভাবতেই বুকে ব্যাথা হলো।

“ভাইয়া, চল বের হব”

জ্যোতির কণ্ঠে স্বম্বিত ফিরলো। আব্দুল হামিদ কড়া স্বরে বললো,
“একটা পাঞ্জাবি পড়তে এতো সময় লাগে?”

জাওয়াদ কিছুই বললো না। পাভেল বন্ধুর লম্বা মুখখানা দেখলো। সে জানে জাওয়াদ খুবই দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। নিজের অনুভূতির সাথে যুদ্ধ করা বড়ই কঠিন।

****

বরকনে পাশাপাশি বসে আছে। হলুদের কার্যক্রম শুধু হয়েছে। এক এক করে সবাই হলুদ দিচ্ছে বরকনেকে। চিংকির পরণে একটা হলুদ জামদানি। গা ভর্তি ফুলের গহনা। কড়া ফুলের গন্ধ নাকে এসে ভিড়ছে। হালকা সাজে মেয়েটিকে চমৎকার লাগছে। সে একটু শুকিয়েছে হয়তো। ডায়েট করেছে বোধ হয়। সকলের অগোচরে জাওয়াদের কানে ফিসফিসিয়ে সে বললো,
“আমাকে কেমন লাগছে?”

জাওয়াদ মলিন স্বরে বললো,
“সুন্দর লাগছে”

কথাটা শুনতেই চিংকির ঠোঁটে ছড়িয়ে গেলো মিষ্টি হাসি। সে কৌতুক করে বললো,
“ধলা গরুর বউ বউ কি লাগছে?”

জাওয়াদ উত্তর দিতে পারলো না শুধু হাসলো। অনুষ্ঠানে নাচ গান হলো। জ্যোতিও নাচলো। হলুদ কার্যক্রম শেষে খাওয়া দাওয়ার পালা। জাওয়াদ যেন হাসফাস করতে লাগলো অভিনয় করতে করতে। ফলে সবার আড়ালে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ালো সে। পাভেল এসে দাঁড়ালো তার পাশে। হাতে একটা প্লেট। যেখানে সব খাবারের আইটেম। খেতে খেতে বললো,
“বিয়েটা তাহলে হচ্ছে বল?”
“খাচ্ছিস খা না। মাথা খাস না”
“খেপছিস কেন? গরিবের কথা বাসি হলে ফলে। এসব ছাড়। চিংকি ভালো মেয়ে। বিয়ে করে ফেল। ল্যাটা চুকে যাক। আর স্বীকার না করতে চাইলেও ওকে ভালোবাসিস এটা তো মিথ্যে নয়। নাহলে চুমু খায় কে শুনি”
“আমি মোটেই ওকে ভালোবাসি বলে চুমু খাই নি। স্বপ্নের দোষ কাটাতে ওকে বাঁধা দেই নি”

পাভেলের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। ধারালো গলায় বললো,
“আমাকে বিশ্বাস করতে হবে তুই এতো স্বার্থপর?”
“আমি সবসময় স্বার্থপর, শুরু থেকে। সেই সাথে আমি ভীতু; ভয় পাই আমার রেপুটেশন নষ্ট হবার, ভয় পাই আব্বার মারের, ভয় পাই স্বপ্নকে। নিজের ভয় কাটানোর জন্য আমি মিথ্যে বলি, মানুষ আমার ক্ষতি করলেও মেনে নেই, আমাকে অপমান করলেও আমি হাসি মুখে তা সয়ে যাই, রাগ গিলে ফেলি, নিজের সাথে নিজে ছলনা করি, নিজেকে আড়াল করি। তোর মনে হয় দুনিয়ার মানুষকে যে জাওয়াদকে আমি দেখাই সেই জাওয়াদ আসলেই জাওয়াদ? আজ স্বপ্নের ভয় না থাকলে আমি কখনোই চিংকির সামনে আসতাম না। আর আব্বার ভয় না থাকলে আমি কখনো এই বিয়ে করতাম না”

বলে পেছনে ঘুরতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো সে। চিংকি দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ পাংশুটে বর্ণ। চোখে এক তীব্র অবিশ্বাস। অস্পষ্ট স্বরে শুধালো,
“কিসের স্বপ্ন?………”

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি