বিবাহ বিভ্রাট ডটকম পর্ব-০২

0
33

#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ২)
নুসরাত জাহান লিজা

রাত্রি মনে করে বিয়ে নিয়ে কাজ করার মতো প্যারা পৃথিবীর আর কোনো প্রফেশনে নেই। একবার একটা বিয়ে প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছিল, কিন্তু কণের পাত্রের ডাক নাম পছন্দ হয়নি। এঙ্গেজমেন্টের দিন পাত্রের এক খালা ওই নামে ডাকায় মেয়ে বেঁকে বসে। সারাজীবন ওই পরিবারের মানুষেরা তাকে ওমুকের বউ বলে ডাকবে এটা সে নিতে পারবে না। নামটা যেন কী ছিল, এখন মনে নেই৷ অথচ ছেলে দেখতে সুদর্শন আর পেশায় ডাক্তার বলে পাত্রীপক্ষই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিল। এই নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে প্রায় ধুন্ধুমার লেগে যায় যায় অবস্থা। শেষ মুহূর্তে রাত্রির মধ্যস্থতায় সেই পরিস্থিতি ঠিক হয়েছিল, কিন্তু বিয়েটা হয়নি।

অনেকের আবার হাজারটা ক্রাইটেরিয়া থাকে, ছেলের নাক বেশি লম্বা হওয়া যাবে না, মেয়ে খাটো হওয়া যাবে না, চোখের রঙ কালো হতে হবে, সকালে ঘুম থেকে উঠে কিনা এসব তো থাকেই। সাথে ছেলে গোসল করে গামছা বা তোয়ালে বিছানায় রাখে কি-না এসবও অন্তর্ভুক্ত থাকে।

এরকম সমস্যা এড়াতে সে পাত্রপাত্রীর ইন্টারভিউ নিয়ে সমস্ত খুঁটিনাটি শুনে নেয়। রীতিমতো ইন্টারোগেশন চলে তখন। এত ব্যক্তিগত কথাবার্তার উত্তরও অনেকে দিতে চায় না অনেক সময়। তবে ওর কনভিন্সিং পাওয়ার ভালো।

এরকম উদ্ভট সব ঝামেলা মেটাতে সে গলদঘর্ম হয়। সারাক্ষণ মহাব্যস্ত থাকতে হয়, যে নাওয়া খাওয়া ভুলে যায়। তবে একেকটা বিয়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবার পরে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে৷ চ্যালেঞ্জ ফেস করতে সে আনন্দই পায়। নইতো জীবন পানসে হয়ে যেত।

ইনভেস্টিগেশন চলার সময় সে এই ব্যক্তিগত প্রশ্নোত্তর পর্ব সেরে ফেলে। আজ তিনজনকে শিডিউল দিয়েছে। এরমধ্যে একটা ইপ্সিতার। গত পরশু ইমরোজকে কল দিয়ে আজ বিকেল চারটায় একটা রেস্টুরেন্টের ঠিকানা দিয়ে সেখানে থাকতে বলেছে, বোনকে নিয়ে।

এখন তৈরি হচ্ছিল, মা এসে বললেন, “তোর বাবাকে গিয়ে বল খাবার দিয়েছি। তুইও আয়।”

“আজও ঝগড়া করেছ?”

“হ্যাঁ, ঝগড়া তো খালি আমিই করি৷ তোর বাপ তো নিরীহ মানুষ।”

রাত্রি হেসে ফেলল, “কী হয়েছে?”

“কী আবার হবে? আমি একটা উন্মাদ মানুষের সাথে সারাজীবন সংসার করলাম। যার দিন দুনিয়া সব খবরের কাগজ আর টিভির টকশো। টক শো যে যত মনোযোগ দিয়ে শোনে, আমার কথা তার অর্ধেক মনোযোগ দিয়েও যদি শুনত! আমি গিয়ে বললাম, আজ বড় আপা আসবে। সে বলল, আচ্ছা। কতক্ষণ পরে বাজারের ব্যাগ আর লিস্ট ধরিয়ে দিলাম, বলে কি-না ‘আজ এত আয়োজন কীসের জন্য?’ এখন বল, এই লোকের সাথে কী করা উচিত?”

“খুব খারাপ কাজ হয়েছে। তুমি এক কাজ করো, বাবাকে আজ আর খেতে দিও না৷ টকশো খেয়ে পেট ভরাক।”

সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলা রাত্রির কথা শুনে মায়া কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন, এরপর রেগে গিয়ে বললেন,

“রাত্রি, একদম ফাজলামি করবি না আমার সাথে। সকালে তোর বাবাকে কতগুলো ওষুধ খেতে হয় জানিস না? এভাবে বেআক্কেলের মতো কথাটা বলতে তোর বুক কাঁপল না একবারও?”

রাত্রি নিরীহ গলায় বলল, “তুমিই তো বললে বাবার সাথে কী করা উচিত, আমি সাজেশন দিলাম একটা।”

“আমি সংসার করছি একটা উন্মাদ মানুষের সাথে, দুইটা হাফ উন্মাদ জন্ম দিয়েছি। সবগুলোর মাথাই বাপের মতো, ঘিলু নাই। তোর খেতে হবে না। যা সামনে থেকে।”

রাত্রি হেসে তৈরি হওয়ায় মন দিল। মা সারাক্ষণ রেগে এটা সেটা বলতে থাকেন, বাবার প্রতি তার অভিযোগের অন্ত নেই, কিন্তু মায়ারও শেষ নেই৷ তার নামের পুরোটাই বাবা আর ওদের দুই ভাইবোনের জন্য।

একেবারে রেডি হয়ে সে বাবার ঘরে গেল, তিনি পত্রিকায় মুখ ডুবিয়ে বসে আছেন,

“বাবা, কী করছ?”

“দেখতেই তো পাচ্ছিস। আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?”

রাত্রি গলা নামিয়ে বলল, “মা কিন্তু রেগে আছে। ওদিকের পরিবেশ খুব গরম।”

“হোক, সব জ্বলেপুড়ে যাক। আমার কী!”

“মা বলেছে বড় খালামনি আসলে তার সাথে কিছুদিনের জন্য চলে যাবে।”

“সত্যিই বলেছে?”

“তোমার মনে হচ্ছে আমি মিথ্যা কথা বলছি? বলেছে এবার গেলে সহজে আর ফিরবে না।”

“তোর মা রাগ করে চলে যাবে, তুই মেয়ে হয়ে ওকে আটকাতে পারছিস না?”

“আমি কীভাবে আটকাব? রাগ তো তোমার সাথে করেছে।”

“একটা বুদ্ধি দে। তোর তো অনেক বুদ্ধি।”

“তুমি একটা কাজ করো, খেয়ে রান্নার প্রশংসা করো৷ দেখবে রাগ গলে পানি হয়ে গেছে।”

“আচ্ছা, যাচ্ছি।”

খাবার টেবিলে চারজনই বসেছে৷ উৎপলেরর চোখ এখনো ঘুমঘুম। খাচ্ছে দ্রুত।

বাবা খাবার মুখে তুলে বললেন, “তোমার হাতের রান্নার কোনো তুলনা হয় না মায়া। তোমার এই খিচুড়িটা আমার বড্ড প্রিয়।”

মায়ের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন, এরমধ্যে বাবা আবার বললেন,

“শুধু ঝালটা একটু বেশি হয়েছে। তোমার ঝাঁঝের কিছুটা এর সাথে ব্লেন্ড হয়েছে মনে হয়।”

মা চোখ দিয়ে আগুন ঝরিয়ে উঠে পড়লেন খাবার ফেলে।

রাত্রি মাথায় হাত দিল, ওর মিটমাট করে দেবার পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল।

উৎপল ঘটনা কী বুঝতে চেষ্টা করছে, রাত্রির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে সে ফিসফিস করে বলল,

“তোমার কাহিনী কী ভাইয়া? পরে খবর নিচ্ছি।”

উৎপল কারো কথাই বুঝতে পারল না, কেবল বুঝল বিচ্ছু বোন কিছু কী আন্দাজ করেছে ওর আর ইপ্সিতাকে নিয়ে! তা কী করে সম্ভব! সে আর কী কী করেছে গোবেচারা মুখ করে সেসব খতিয়ে ভাবার চেষ্টা করল।

***
ইমরোজ ইপ্সিতার ঘরের দরজায় নক করল,

ইপ্সিতা দরজা খুলে বলল, “ভাইয়া, এসো।”

ইমরোজ ঘরে ঢুকে আশেপাশে তাকিয়ে ঘরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করল কপাল কুঁচকে। বিছানায় কাঁথা বালিশ এলোমেলো, একপাশে চাদর উপরে উঠানো, অন্যপাশে ঝুলে আছে অনেকটা। টেবিলজুড়ে বইপত্র ছড়ানো ছিটানো।

টেবিলের কাছে এগিয়ে এসে দেখল গতকালের কফির মগে তলানিতে কফি শুকিয়ে গেছে,

“তোর ঘরের এমন অবস্থা কেন? এখানে মানুষ থাকতে পারে?”

“আমার এক্সাম চলছে ভাইয়া।”

“তাতে কী হয়েছে? এখন বড় হয়েছিস না? তাছাড়া রুচিবোধের একটা বিষয় আছে। কয়দিন পরে শ্বশুরবাড়ি যাবি।”

ইপ্সিতার মুখে চলে এসেছিল, “তোমার বউ হয়ে যে আসবে তার ঘর গোছানোর দরকার পড়বে না।”

উৎপলটা কেমন কে জানে, ওর ভাইয়ের মতো এমন খুঁতখুঁতে বাতিক অন্তত তার নেই, এটুকু সে নিশ্চিত। পরীক্ষা চলছে, বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি হচ্ছে নিয়মিত, আবার এলোমেলো করতেই হবে, যে জিনিসের এতটুকু স্থায়িত্ব নেই তা গুছিয়ে লাভটা কী!

কথা বলতে বলতে নিজেই টেবিল গোছানো শুরু করল ইমরোজ, সর্বনাশ, এখানে উৎপলের পাঠানো চিঠি আছে কিছু। ভাইয়ার হাতে পড়লে রক্ষা নেই।

সে হন্তদন্ত হয়ে টেবিলের কাছে এসে বলল, “ভাইয়া, তোমার করতে হবে না। আমি গুছিয়ে নেব। তোমার দেরি হয়ে যাবে কলেজে যেতে। তুমি বোসো না।”

ইমরোজ ঘড়ি দেখে নিয়ে সম্মত হয়ে বলল,
“ঠিক আছে, গুছিয়ে ফেলিস। যা বলতে এসেছিলাম, তুই কাল ফ্রি আছিস?”

“কেন?”

“না, আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে তোকে। একজন তোর সাথে কথা বলবে।”

“একজন কে? ভাইয়া, তোমার গার্লফ্রেন্ড হয়েছে? কংগ্রাচুলেশনস। আমি কাল ফ্রি আছি।” উত্তেজিত গলায় বলল ইপ্সিতা।

ইমরোজ রেগে গেছে, এত অল্পতেই তার ভাইটা কীভাবে রেগে যায় কে জানে!

“গার্লফ্রেন্ড? তোর মাথায় খালি এসব ঘুরে নাকি? একদম এসব আজেবাজে বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবি না বলে দিলাম।”

ইপ্সিতার মনে হচ্ছে সে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া তেইশ বছরের কোনো তরুণী না, সে ষোলো বছরের কিশোরী।

“তাহলে কে?”

“ঘটক। তোর সাথে কথা বলবে।”

“কীহ্!”

ইমরোজ বেরিয়ে যাচ্ছে, সে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। আগে জানলে কী আর বলত সে ফ্রি আছে। নিজের বোকামির জন্য নিজের মাথা দেয়ালে ঠুকতে ইচ্ছে করল ওর।

ইমরোজ বড় ভাই হিসেবে ওভার প্রোটেক্টিভ। একবার একটা ছেলে ওকে চিঠি দিয়েছিল, জীবনে প্রথমবার প্রেমপত্র পেয়েছিল, আজকাল তো কেউ চিঠিই লেখে না। ছেলেটাকে সে পাত্তা দেয়নি একদম, বাসায় এসে বলে দিয়েছিল। তখন কোন ক্লাসে পড়ত, এইটে বা নাইনে। তাই চিঠিটা খুব পড়তে ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু ইমরোজ সেই চিঠিটা নিয়ে সোজা ওই ছেলের বাসায় গিয়ে তার বাবার হাতে দিয়েছিল। আগে চিঠিটা পড়ে নিয়ে যদি বাসায় বলত! তখন এর জন্য আফসোস হয়েছিল।

ইমরোজ ওকে ভীষণ ভালোবাসে, স্নেহ করে এটা সে বোঝে৷ সে-ও ভাইকে খুব ভালোবাসে, সেখান থেকেই সমীহ করে।

***
ওই অভদ্র মেয়ের সাথে আবার মুখোমুখি বসতে হবে আজ, এটা ভেবেই ইমরোজের মন তেতো হয়ে আছে।

“ভাইয়া, এসবের জন্য এমন তাড়াহুড়োর কী আছে? আমার পরীক্ষাটা অন্তত শেষ হোক।”

“বিয়ে তো আর পরীক্ষার মধ্যে হচ্ছে না।”

ওরা রেস্টুরেন্টে ঢুকল এরপর ইপ্সিতা যাকে দেখল, তাকে সে এখানে আশা করেনি৷

এটা তো উৎপলেরর বোন রাত্রি, ওকে পরিবারের সবার ছবি দেখিয়েছে সে, সেখান থেকেই চেনে।

এরপর রাত্রি আর ইমরোজের মধ্যে যা ঘটলো, সাইক্লোন না সুনামি বলা যায় এটাকে! উৎপলের সাথে ওর বিয়ের ভবিষ্যত চিন্তা করে ইপ্সিতার মাথা বোঁ-বোঁ করতে লাগল।
………
(ক্রমশ)