বিবাহ বিভ্রাট ডটকম পর্ব-০৪

0
27

#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ৪)
নুসরাত জাহান লিজা

উৎপল ভেবেচিন্তে জাহিদকে কল দিল, রাত্রির বিবাহ ডটকমের গোয়েন্দা বিভাগ সেই সামলায়। সাথে ওর সবচাইতে কাছের বন্ধু।

“সূর্য আজকে কি পশ্চিম দিকেই উঠল? অমাবস্যার চাঁদ দেখছি যে!”

উৎপল কড়া গলায় বলল, “শালা, আমার জীবন-মরণ সংকট, আর তুই আছিস অমাবস্যার চাঁদ নিয়ে!”

“কেন দোস্ত? তোর কী হয়েছে? ক্যান্সার নাকি? বাসার সবাই জানে!”

“মাথামোটা, তুই এই বুদ্ধি নিয়ে গোয়েন্দাগিরি করিস কীভাবে?”

“বিয়ের পাত্রপাত্রীর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য শার্লক হোমস হবার দরকার হয় না৷ তুই তো বললি, তোর জীবন মরণ সংকট।

“আরে বলদ, ওটা তো কথার কথা বলেছি।”

“তাহলে ঝেড়ে কাশ তো দোস্ত।”

“রাত্রি তোর কাছে ইপ্সিতার বায়োডাটা দিয়েছে?”

“আমার কাছে এখন তেইশটা বায়োডাটা আছে। আমি কি নাম মুখস্ত রেখেছি নাকি!”

এরপর বলল, “আরে দাঁড়া দাঁড়া, মনে পড়েছে। হ্যাঁ দিয়েছে। ওটা আপাতত বন্ধ রাখতে বলেছিল, আমাকে। সেজন্য মনে আছে। মেয়েটার ভাই নাকি একটা গোঁয়ারগোবিন্দ। এমন লোকের ছায়াও রাত্রি মারাতে চায় না বলছিল। আবার একটু আগে কল করে বলল, কাজ শুরু করতে। হঠাৎ আমাদের ক্লায়েন্টের খোঁজ করছিস কেন?”

এরপর নাটুকে গলায় বলল, “দোস্ত ছিঃ, তুই পরকীয়া করবি?”

“নাউজুবিল্লাহ! এসব কী ধরনের কথা! তাছাড়া এখনো বিয়েই করতে পারলাম না।”

“গার্লফ্রেন্ড রেখে অন্য নারীর প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছিস কেন তাহলে?”

“আরে শালা, তুই আমার সামনে থাকলে এমন গাট্টা দিতাম, তুই প্যারালাইজড হয়ে যেতি।”

“এ্যাহ্! তুমি করতে পারবা আমি কইতে পারব না, তাই না?”

“আরে গাধা, ওইটাই আমার গার্লফ্রেন্ড।”

“ওহোহো, লা লা লা, লা লা লা…” রোমান্টিক মুভির প্রেমময় দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক গেয়ে উঠল জাহিদ।

উৎপল এবার প্রচণ্ড বিরক্ত হলো, বলল, “শোন, রাত্রির কানে আমার নামটা যেন না যায় ইপ্সিতার বয়ফ্রেন্ডের নাম হিসেবে।”

“যেখানে ক্রি মি না ল নিজেই তার ক্রা ই ন স্বীকার করছে, সেখানে আমি কেন রিপোর্ট করব না চান্দু।”

“তুই করবি না।’’

“আমি আমার এমপ্লইয়ারের কাছে লয়্যাল। আমি কেন এটা করব?”

“বন্ধুর জন্য এটুকু করতে পারবি না? আমি না থাকলে তোর সাথে সুপ্তির বিয়েটা কেচে যেত।”

“সেটা তো জানি। কিন্তু তুই একটু আগে আমাকে বলদ বলেছিস, গাধা বলেছিস! ভুলে গেলি?”

“গাধাকে গাধা বলায় অন্যায় নেই। তুই শুধু গাধা না, একেবারে উৎকৃষ্ট প্রজাতির গাধা।” কথাটা অবশ্য মনে মনে আওড়ালো, মুখে তেল মালিশ করল, তেল না ঢাললে কাজ হবে না এটা জানে।

“দোস্ত, শোন না, তুই আমার একমাত্র কাছের বন্ধু। এই মুহূর্তে আমার ত্রাণকর্তা। তুই এমন করলে হবে!”

“আচ্ছা, একটু ভেবে দেখি। শোন, নেক্সট উইকে ওয়ারফেজের কনসার্ট আছে। সেটার টিকিট কেটে দিলে ভেবে দেখতে পারে।”

ওর এত সাধের উপার্জন, “আমি ইনকাম করি তো তোকে কনসার্ট দেখাবার জন্য।”

“তাইলে আমি আজকেই রাত্রিকে রিপোর্টটা পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

“দোস্ত, তুই এমন করিস কেন। আচ্ছা যা টিকিট পাক্কা।”

“এই না হলে দোস্ত।”

“তোর মাথা। বেহুদা খরচ।”

যাক, একটা চিন্তা মথা থেকে নামল।

উৎপল লাঞ্চ আওয়ারে অফিস থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পাসে এলো ইপ্সিতার সাথে জরুরি আলোচনা সারতে। একটা ভয়াবহ মিশনে নামতে যাচ্ছে। তার রণকৌশল ঠিক না করে নামলে মাঠে মারা যাবে। প্রতিপক্ষ ভীষণ শক্তিশালী। তাই বাড়তি সতর্কতা অত্যন্ত জরুরি।

***
ইমরোজ বসে পরেরদিনের লেকচারের প্রেজেন্টেশন স্লাইড তৈরি করছিল। এরমধ্যে আনোয়ারা এসে পাশে বসলেন।

“কলেজটা তুলে বাড়িতে নিয়ে আসতে পারিস।”

“কেন মা?”

“বাড়িতে তোর সাথে একটু বসে দু-দন্ড গল্প করব, তারও জো নেই।”

ইমরোজ কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে রাখল, “বলো মা কী বলবে।”

“হ্যাঁ শুধু আমাকেই তো বলতে হবে। তোর আমার সাথে গল্প করার তো কিছু নেই।”

ইমরোজ মৃদু হেসে বলল, “ঠিক আছে। এখন থেকে গল্প করব তোমার সাথে।”

মায়ের মুখেও মৃদু হাসি ফুটল, “হ্যাঁ রে, কদ্দুর এগুলো, ইপ্সির বিয়ের ব্যাপারে?”

ইমরোজের হাসি মিলিয়ে গেল, বেয়াদব মেয়েটার কথা মনে পড়ল।

“জানি না।”

“জানিস না মানে কী?”

“জানি না মানে জানি না। ওদের দিয়েই কেন করতে হবে? অন্য ঘটক দেখি?”

সে রাত্রির মুখদর্শন করতে চায় না।

“এটা কী বলিস ইমু! সারা দুনিয়া যেখানে ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে, আমরা কেন এনালগে পড়ে থাকব। তাছাড়া ওদের রেকর্ড ভালো। উপরতলার শফিক ভাইয়ের ছেলের বিয়ে ওরাই করিয়ে দিয়েছে। খুব প্রশংসা শুনলাম। শুধু শুধু তো আর প্রশংসা করে না লোকে।”

যে মেয়ে পড়াশোনা নিয়ে মজা করে, উদ্ভব কথাবার্তা বলে সারাক্ষণ, তার তৈরি করা একটা প্রতিষ্ঠানের প্রশংসা ওর জন্য ঠিক হজম যোগ্য নয়, রীতিমতো অপাচ্য।

“শোন, ইপ্সির বিয়ে হলে এবার নিজের দিকে তাকা।”

ইমরোজ গোবেচারা মুখ করে বলল, “নিজেকে তো দেখিই আয়নায়।”

“তোর মাথায় কিছু নেই? লেকচারারের চাকরি কেমনে দিল তোকে?”

বলে তিনি উঠে চলে গেলেন, ইমরোজ বুঝতে পারল না, ওর ভুলটা কোথায়।

***
“একবার মায়ের সাথে রাত্রি আপুকে দেখা করিয়ে দিয়ে উস্কে দিতে পারলে কেল্লাফতে। বাকি কাজ মা নিজেই করবে। এমন পরিস্থিতি তৈরি করবে, ভাইয়া বাপ বাপ করে রাজি হয়ে যাবে।”

নিজের বুদ্ধিতে নিজের পিঠ চাপড়ে দিতে ইচ্ছে করল ইপ্সিতার।

উৎপলের মুখের মেঘ আরও গাঢ় হলো, তাই দেখে ইপ্সিতা বলল, “আইডিয়াটা দারুণ না?

উৎপল একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, “বহু আগে একটা জোক শুনেছিলাম। একজন লোকের একটা মেয়েকে খুব পছন্দ হয়েছে। সে এসে বন্ধুদের বলছে, ‘জানিস? ওর সাথে আমার বিয়ে ফিফটি পার্সেন্ট পাকা।’ বন্ধুরাও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘তাই নাকি? মেয়ে রাজি হয়েছে?’, এবার লোকটা আরও উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘আরে এখনো না। আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট রাজি, এখন ও রাজি হলেই হয়।’’”

উৎপলের কথা শুনে ইপ্সিতার মুখ কালো হয়ে গেল, “কী বলতে চাও?”

“তোমার ভাইয়াকে নাহয় আন্টি রাজি করাল, আমার বোনকে কীভাবে রাজি করাব?”

“তুমিও তোমার বাবা-মাকে কনভিন্স করবে। তাছাড়া ও তোমার ছোট বোন। তোমারও একটা ভূমিকা আছে।”

উৎপল ছেলেবেলায় ভীষণ চুপচাপ ছিল, কারো সাথে সেভাবে মিশতে পারত না। ফলতঃ দুরন্ত বাচ্চাদের কাছে মার খেয়ে বাসায় এসে কাঁদত। রাত্রি ওর দুই বছরের ছোট। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ ডানপিটে ধরনের। সে-ও ভাইয়ের সাথে খেলতে যেত। একবার একজন ওর সামনেই উৎপলকে মেরেছিল, রাত্রি চুপ থাকবে কেন! সে ব্যাট দিয়ে ওই ছেলের মাথায় মেরেছিল। ভাইয়ের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসা।

“আমরা আর ওদের সাথে খেলব না ভাইয়া। তুমি আর আমিই খেলব।”

তখন থেকে দুই ভাইবোন পরস্পরের খেলার সাথী। একবার ওদের ভীষণ ঝগড়া হয়েছিল, রাত্রি জেদ করে বৃষ্টিতে ভিজেছিল, এরপর প্রবল জ্বর বাঁধিয়েছিল। তখন ওর এত খারাপ লেগেছিল, অপরাধবোধে ভুগেছে যে কদিন সে অসুস্থ ছিল! এরপর থেকে সে আর রাত্রির সাথে ঝগড়া করেনি৷ খুঁনসুটি হয়। কিন্তু সিরিয়াস ঝগড়া হয়নি আর। বোনের প্রতিও ওর অপরিসীম ভালোবাসা। সহোদরার সমস্ত আবদার অনুযোগ সে হাসিমুখে মেনে এসেছে সবসময়। শুধু নিজের ‘লাভ লাইফ’ নিয়ে কিছু শেয়ার করেনি, অন্য একটা কারণে।

“প্রথম কথা, ওরা ছোট বাচ্চা না যে একটা ধমক দিয়ে বিয়েতে রাজি করানো যাবে। ওর চাওয়াও এখানে ইম্পর্ট্যান্ট। তাছাড়া কারো সম্পর্কে না জেনে তো বোনকে বিয়ে দিতে পারি না।”

“আমার ভাই মোটেও ফেলনা নয়। হুটহাট রেগে যায়, কিন্তু মানুষ হিসেবে ওর মতো ভালো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।”

সহসা ফোঁস করে উঠল ইপ্সিতা। ভ্রাতৃগর্বে চোখ চকচক করছে, “তাছাড়া, তোমার বোনের আমি খারাপ চাইব, এটা কী করে ভাবলে তুমি?”

অভিমান ঝরল গলায়, উৎপল ওর হাতটা আলতো করে ধরে বলল,

“আরে, আমি তাই বলেছি না-কি। আমি জানি তুমি আমার সাথে জড়িয়ে থাকা সবকিছুকে ভীষণ আপন মনে করো।”

প্রেয়সীর মান ভাঙিয়ে বলল, “তবে সবচাইতে বড় জিনিস যা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, তা হলো, ওরা কেউ কাউকে পছন্দ করে না।”

ইপ্সিতা কাঁদো কাঁদো মুখে বলে উঠল, “এখন তাহলে কী হবে? আমি তোমার বোনের ঠিক করা ছেলেকে বিয়ে করে সংসার শুরু করব? অসম্ভব!”

অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ভেবে উৎপল বলল, “একটা উপায় অবশ্য আছে।”

উৎসাহী হয়ে ইপ্সিতা বলল, “কী উপায়, তাড়াতাড়ি বলো।”

“বিয়েটা ওদের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিতে হবে।”

“মানে?”

“ওদেরকে এমন পরিস্থিতিতে এনে ফেলতে হবে, যেন দু’জনেই মনে করে ওদের বিয়ে না হলে ওরা গো-হারা হারবে। তখন দেখবে, নিজেরাই কেমন সুড়সুড় করে রাজি হয়ে যায়৷ আমরা তো জানি, ওরা একজনও হারতে পছন্দ করবে না। ‘বিনা রণে নাহি দেব সূচাগ্র মেদেনী’ মনোভাব ওদের, যা জেদি দুটোই।”

এবার মাথায় হাত দিয়ে ইপ্সিতা বলল, “কিন্তু সেটা কীভাবে করব আমরা?”

“সেটা এখনো ভাবিনি। তবে আজ থেকে আমাদের একটা নতুন মিশন শুরু হলো। মিশনটা শ্বাপদসংকুল।”

ইপ্সিতা বলল, “মিশন বিবাহ।”

উৎপল হেসে বলল, “হ্যাঁ। দুটো বিয়ের।”
………….
(ক্রমশ)