#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ৬)
নুসরাত জাহান লিজা
ইমরোজ সবে ফ্রেশ হয়ে একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে, এরমধ্যে মা’র আগমন ঘটল। ইমরোজ প্রমাদ গুণল। যখন তিনি তারা কুখ্যাত ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে কাজ হাসিল করতে চান, তখন যেমন অভিব্যক্তি তার মুখাবয়বে থাকে, এখনকার অভিব্যক্তি ঠিক তেমন।
“কী করছিস বাবু?” গলায় মধু ঢেলে প্রশ্ন করলেন আনোয়ারা।
ইমরোজ উঠে বসতে বসতে বলল, “কিছু না মা। বসো। কী বলবে?”
“আমি কিছু বলতেই শুধু তোর ঘরে আসি? এটা তুই বলতে পারলি?”
এটারই ভয় পাচ্ছিল সে, তটস্থ হয়ে বলল, “সেটা আবার কখন বললাম। তুমি বসো না, মা!”
আনোয়ারা ছেলের বিছানার পাশে বসলেন, এরপর বললেন, “আজ রাত্রির সাথে কথা হলো।”
“রাত্রি কে?”
চট করে ছেলের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “রাত্রি কে মানে? আরে বিবাহ ডটকম… ”
এটুকু বলতেই মনে পড়ল রাত্রিকে, একটা চূড়ান্ত অভব্য মেয়ে।
“অহ্। সবসময় সবার নাম মনে থাকে নাকি!”
“এখন থেকে মনে রাখবি।”
“কেন? সে কী মহারানী ভিক্টোরিয়া নাকি বিল গেটস যে তার নাম মনে রাখতে হবে?”
“যারা উপকার করে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হয়।”
ইমরোজ আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও রাত্রি নামের মহা ঝামেলাবাজ মেয়েটি ওর কী উপকার করেছে মনে করতে পারল না। সে বলল,
“তা সে কী উপকার করেছে? নমুনাটা শুনি একটু?”
বলার পরে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো, এভাবে কথা সে বলে না। সে অত্যন্ত ভদ্রভাবে ভদ্রলোকের মতো কথা বলে। ওই মেয়ের নাম মনে করতেই তার কথা বলার ধরন ওর মধ্যে চলে এলো না-কি! সর্বনাশ!
“এটা কী ধরনের কথা ইমু? ও তোর একমাত্র বোনের বিয়ে দিচ্ছে। এটা উপকার নয়?”
“বিয়ে দিয়ে দিক আগে। তারপর যত খুশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। ওর একটা ছবি ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রেখো।”
“সেটা মন্দ হয় না। ওকেই বাসায় এনে রাখতে পারলে আরও ভালো হয়!’
“ওকে বাসায় এনে রাখবে মানে?”
“মানে আবার কী? একটা বাসায় অন্য একটা মেয়ে যেভাবে আসে, সেভাবেই আসবে। ঘরে আমার একটা বিবাহ উপযুক্ত ছেলে আছে, সে-ও একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে।”
ইমরোজের এতক্ষণ ক্লান্ত লাগছিল, চোখ বুঁজে আসছিল, কিন্তু মায়ের কথায় ওর ঘুম আর ক্লান্তি ঝপ করে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে আতঙ্কিত গলায় বলল,
“মা, এসব কী বলছ? ওই পাগল মেয়েকে ঘরে আনার আগে আমাকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দাও মা।”
আনোয়ারা পূর্ণদৃষ্টিতে ছেলেকে একবার জরিপ করে নিলেন, এরপর হুমকির সুরে বললেন,
“শুনলাম, ওর সাথে ঝগড়া করেছিস পায়ে পারা দিয়ে। ইপ্সির বিয়ে পর্যন্ত আরেকবার যদি আমার কানে এটা আসে, তোর গলায় ওকে ঝুলিয়ে তবে আমি দম নেব।”
বলে উঠে চলে গেলেন, ইমরোজের হাত চলে গেছে ওর গলায়। এই গলায় ওরকম একটা মেয়ে ঝোলানোর চাইতে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে যাওয়া ঢের ভালো বলে মনে হলো। কিন্তু এত দুর্মতি ওর হয়নি।
মা নিশ্চয়ই ওকে কথার কথা বলেছেন, নিজের পেটের ছেলের সাথে এমন অবিচার তিনি করবেন না নিশ্চয়ই। করতে চাইলেও সে মানবে কেন!
এসব সাত-পাঁচ ভেবে চিন্তাটাকে সরিয়ে রাখতে চাইলেও, অবচেতন মন বোধহয় সেটাকে এত সহজে সরাতে পারেনি। তাই তো এমন ভয়ংকর দুঃস্বপ্নটা দেখল।
ওর এই ঘরটাই সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো। নিজের চিরচেনা ঘরটা অচেনা বলে মনে হলো। ওই তো একটা মেয়ে ঘোমটা দিয়ে বসে আসে। ইমরোজ এগিয়ে এসে বলল,
“তুমি কে?” সে বর বেশে আছে, মেয়েটার বধূ বেশ, তবুও এমন প্রশ্ন কেন করল এটাই ভাবছিল।
একটা চেনা কণ্ঠ ভেসে এলো, “আমি রাত্রি।”
কথাটা কয়েকবারে প্রতিধ্বনিত হলো কানে, “এখানে কী করছো?”
এবার ঘোমটা সরিয়ে একটা নিরীহ মুখ বেরিয়ে এলো, কিন্তু যতই নিরীহ হোক, চোখ দু’টোতে আগুন,
“আমার তো এখানেই থাকার কথা। তুমি আজকের এই সুন্দর রাতে কিনা আমাকে ভুলে গেছ, এর জন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে।”
ইমরোজ আঁতকে উঠে বলল, “শাস্তি মানে?”
রাত্রি এগিয়ে আসছে ওর দিকে, কী আশ্চর্য, ওর পায়ে যেন শেকড় গজিয়ে ওখানেই গেঁথে আছে। এক ইঞ্চি নড়তে পারছে না। রাত্রি স্লো মোশনে এগিয়ে আসছে। মুখে হিং স্র তা। ওর হাতে একটা ফুলের মালা, এটা কী ফুল সেটা চিনতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু রাত্রি ওর কাছে এগিয়ে আসতেই ফুলগুলো মিলিয়ে গেল ভোজবাজির মতো, মালা কোথায়,ওর হাতে একটা দড়ি।
ওর গলায় দড়িটা প্যাঁচিয়ে ধরে টানছে রাত্রি। এই পর্যায়ে ভয়াবহ আতঙ্কে ইমরোজের ঘুম ভেঙে গেল। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। উঠে বসে লাইট জ্বালালো, না ঘরটা ঠিকই আছে। ওর চিরচেনা ঘর। এখানে পেত্নী রূপী কোনো মেয়েও নেই। এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে পুরো ব্যাপারটা যে একটা বীভৎস স্বপ্ন, এটা ভেবে স্বস্তি পেল।
মেয়েটার সাহস তো কম না, ওকে অপমান করে সাধ মেটেনি, আবার স্বপ্নের মধ্যে এসে জ্বালিয়ে মারছে। সে ওকে কিছুতেই ছাড়বে না।
***
মায়া আজ বড় বোনের বাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন। দু’দিন ছিলেন না, এরমধ্যে রান্নাঘরটা একেবারে গোয়াল ঘর হয়ে আছে। চম্পা আজ আসেনি, এসব তাকে একা হাতে সামলাতে হচ্ছে।
তিনি গজগজ করতে করতে রান্নাঘরটা ভদ্রস্থ করছিলেন, তখন উৎপল এলো।
“মা, কী করো?”
“তোর চোখ নেই? দেখতে পাচ্ছিস না কী করি?”
উৎপল বুঝল হাওয়া গরম, সে বলল, “মা, একটা কথা ছিল।”
“বল। বলে ধন্য কর।”
উৎপল একটু ইতস্তত করল, এরপর বলল, “মা, বলছিলাম কী, রাত্রি তো অনেক বড় হয়েছে।”
“সেটা তোর এতদিনে চোখে পড়েছে?”
“সবকিছুরই এমন উল্টো মানে বের করো কেন মা? ভালো কথা বলতে এসেছিলাম।”
এবার মায়া খানিকটা শান্ত হলেন, তিনি উৎপলের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়েছিলেন, মেয়ে রাজি নয়। এতে তিনি অপমানিত বোধ করেছেন। তার অমন হীরার টুকরো ছেলে!
“বল।”
“ওর বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভাবছ?”
“তোর সন্ধানে ভালো ছেলে থাকলে বল।”
“আছে মা। কলেজের বাংলা লেকচারার। আমার একটা ফ্রেন্ডের বড় ভাই। ভালো ফ্যামিলি। ছেলের মা রাত্রির স্কুলের টিচার ছিলেন।”
“তোর ফ্রেন্ড? ছেলে ফ্রেন্ড নাকি মেয়ে ফ্রেন্ড?”
“মা, আমি তোমাকে একটা ভালো ছেলের খোঁজ দিচ্ছি, আর তুমি কিনা আমার পেছনে পড়লে!”
“আমার সবার পেছনেই পড়তে হয়। গায়ে গতরে যতই বড় হ, তোর মাথায় ঘিলু একটু কম আছে, বাপের ঘিলু পেয়েছিস কি-না। নিজে নিজে ভুলভাল একটা মেয়ে ধরে নিয়ে এলে, এই যে বলে রাখলাম, আমি কিন্তু মানবো না।”
উৎপল যতটা সম্ভব গোবেচারা মুখ করে বলল, “কী যে বলো না মা! আমি খুব ভালো ছেলে।”
“হলেই ভালো। তা ছেলের বাবা কী করেন?”
“উনি অনেকদিন আগে মারা গেছেন।”
“ও। আচ্ছা, দেখি, তুই খোঁজখবর নে ভালো করে। ছেলে ভালো হলে আমাদের সমস্যা নেই। সমস্যা হলো মেয়েটাকে নিয়ে। কী একটা প্রতিষ্ঠান চালায়, বিবাহ ডটকম। নিজের বিয়েরই খবর নেই।”
উৎপল বেরিয়ে যাচ্ছিল, আবার ফিরে এসে কাঁচুমাচু মুখে বলল, “মা, একটা কথা, এই কথা যে আমি তোমাকে বললাম, এটা আবার ওকে বলো না যেন। এখনই বলার দরকারও নেই। সময় সুযোগ মতো বলো।”
বাইরে এসে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল উৎপল, মা কী করে যেন সবকিছু সন্দেহের নজরে দেখেন। আরেকটু হলে ধরা পড়েই যাচ্ছিল।
***
রাত্রি গপাগপ গিলছে, মা কড়া গলায় বললেন, “তোর ট্রেন ছুটে যাচ্ছে? এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন? আস্তে খা।”
রাত্রি খাবার মুখে নিয়ে সেটা গলধঃকরণ করে কোনোমতে হড়বড় করে বলল, “আজ একটা বিয়ে আছে মা। বহুত ঝামেলাবাজ পার্টি। ছেলের চাচা একটা খাটাস ধরনের মানুষ। তক্কে তক্কে আছে বিয়েটা ভণ্ডুল করার। আমাকে থাকতেই হবে।”
“বিয়ে ভণ্ডুল করার ইচ্ছে থাকলে রাজি হয়েছে কেন?”
“যৌতুক আদায়ের ধান্দায় আছে। পাত্রের গার্ডিয়ান সে। এই সুযোগে যদি কিছু হাতিয়ে নেয়া যায়। এমন কত কাহিনী যে আমার ম্যানেজ করতে হয়। যন্ত্রে যেমন মাঝেমধ্যে গোলযোগ হয়, বিয়েতেও এসব গোলযোগ হয়। কত আজাইরা ঝামেলা যে এসে জড় হয়!”
“বিবাহ ডটকম না রেখে বিবাহ বিভ্রাট ডটকম রাখিস তাহলে। এত গোলযোগ মেটাতে হয় যেহেতু। এসব মেটানো ঘটকের কাজ নাকি?”
“আমরা সাধারণ ঘটক নাকি। ম্যাচ মেকার বলো। আমরা যে কার্যক্রম চালাই, এসবও তো আগে কখনো শোনোনি।”
“পার্থক্য কী?”
“পার্থক্য বোঝানোর সময় নেই এখন। কাজ মিটিয়ে আসি। পরে বুঝিয়ে বলব।”
বলেই তার আঁচলে ভেজা হাত মুছে দৌড়ে রুমে ঢুকে ভ্যানিটি ব্যাগটা নিয়ে দৌড় দিল।
“রাত্রি, এটা কী বাজে অভ্যাস। কতবার না করেছি তোকে।”
রাত্রি অবশ্য কথাটা শোনার সময় পায়নি।
উৎপলের বলা কথাটা মায়ার মনে ধরেছে, দুনিয়ার সব মানুষের বিয়ে দিতে হন্যে হয়ে প্রাণপাত করছে, নিজের দিকে নজর নেই। নিজের একটা ঘর হলে মেয়েটা থিতু হবে। নইলে এমন উড়নচণ্ডী থেকে যাবে। মেঘে মেঘে বেলা তো হয়েই গেছে। এটাই সঠিক সময়। আর দেরি করা সমীচীন হবে না। উৎপলের বাবার সাথে কথা বলতে হবে!