বিবাহ বিভ্রাট ডটকম পর্ব-০৮

0
47

#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ৮)
নুসরাত জাহান লিজা

ইমরোজ কলেজ থেকে আজ সরাসরি বাসায় চলে এসেছে। পরীক্ষার খাতাগুলো দেখতে হবে। মাথায় এত টেনশন নিয়ে কি শান্তিতে কাজ করা যায়! মা একটা অসহনীয় চিন্তা ওর মাথায় চাপিয়ে দিয়েছেন৷ সাথে প্রায় প্রতিদিন ওই অভব্য মেয়েটা ভয়ংকর ভয়ংকর সব স্বপ্ন হয়ে ঘুমের মধ্যে এসে জ্বালিয়ে মারছে। সেজন্য খাতা দেখায় মন দিতে পারেনি। আজ না শেষ করলেই নয়।

দুপুরে খাবার টেবিলে মা হঠাৎ করে বললেন, “শোন না ইমু, ইপ্সির জন্য পাত্রের একটা শর্টলিস্ট দেবে রাত্রি। তুই কাল একবার ওর অফিসে গিয়ে ওই বায়োডাটা আর ছবিগুলো নিয়ে আসবি।”

“আমাকে কেন যেতে হবে? তোমার রাত্রি একটা দায়িত্ব নিয়েছে, বাসায় এসে দিয়ে যাওয়াটা ওর রেসপন্সিবিলিটির মধ্যে পড়ে।”

“ওকে বাসায় আনার জন্য দেখি তোর তর সইছে না, বাবু!”

ইমরোজ মাত্রই ভাত মুখে দিয়েছিল, সেটা গলায় আটকে গেল, কাঁশি হচ্ছিল, মা ওর পিঠে চাপড় দিতে দিতে বললেন,

“সাবধানে খাবি তো। এভাবে কেউ খায়? মনে হচ্ছে পেত্নী তাড়া করেছে।”

ইমরোজ মনে মনে আওড়ালো, “শুধু পেত্নী নয়, নিম্নস্তরের পেত্নী, শাকচুন্নী।”

পানি খেয়ে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, “ওই মেয়েকে নিয়ে এমন বাজে কথা বলবে না তো মা।”

“বিয়ের কথা বাজে কথা হলো? কী যুগ এলো!”

এবার আর ইমরোজ উত্তর দিল না, মা যা একবার বলেন সেখান থেকে তাকে টলানো যায় না৷ ওকে আগামীকাল ওই গরুর ভাগাড় সদৃশ বিশ্রী অফিসটায় যেতেই হবে, অযথা বেগড়বাই করে নিজের এনার্জি খরচ করে লাভ নেই৷ বরং ও চাইল, ইপ্সিতার বিয়েটা যত দ্রুত সম্ভব মিটে যাক, এই গ্যাড়াকল এমনিতেই মিটে যাবে!

আনোয়ারার মনে তখন অন্য অভিসন্ধি, তিনি চান ওরা দুটোতে কিছুটা যদি কাছাকাছি আসে। তিনি জানেন, ইমরোজের কানে তিনি রাত্রির সাথে বিয়ের কথাটা যখন একবার তুলে দিয়েছেন, পরেরবার তার ছেলে অন্য নজরে অবশ্যই দেখবে মেয়েটাকে৷ তখনই না মনে মনে দোলা লাগবে!

আবার নিজের ছেলেকে তিনি সর্বান্তকরণে চেনেন বলে এটাও জানেন, তার ছেলে যেকোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে গোলমেলে বানাতে ওস্তাদ। এমনিতে ভীষণ শান্ত আর ভদ্র, কিন্তু নিজের ইগোতে আঘাত লাগলে একটু বেশিই করে ফেলে। এটুকুই যা চিন্তার। তবে তিনি এটাও বিশ্বাস করেন রাগ থেকেই অনুরাগের জন্ম নেয়।

তার ছেলে যতই বাহ্যিকভাবে গোছালো মানুষ হোক, ভেতরটা ভীষণ এলোমেলো। ছেলেকে একটা সংসার গুছিয়ে না দিতে পারলে তিনি শান্তিতে চোখটাও বুঁজতে পারবেন না! তিনি তার সন্তানদের সুখী দেখতে চান৷

***
মায়া পানের বাটা নিয়ে বসেছেন, খাবার পরে ওষুধ খাইয়ে ভীষণ যত্ন করে স্বামীর জন্য পান বানিয়ে দেন তিনি।

বানের বোঁটায় চুন লাগিয়ে বাড়িয়ে দিতে দিতে তিনি বললেন, “বুঝলে উৎপলের বাবা, ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে। দুজনেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। উৎপলের পাশাপাশি এবার রাত্রির বিয়ে নিয়েও আমাদের ভাবার সময় এসেছে।”

“হ্যাঁ। অনেকদিন পরে একটা কাজের কথা বলেছ।”

“কী বলতে চাও? আমি সবসময় আজাইরা কথা বলি? এতই যখন অকাজের মানুষ আমি, দুইদিন বোনের বাড়িতে গিয়েছিলাম, দিনে চৌদ্দবার করে কল দিয়েছ কেন? বাড়ির বেগার খাটার জন্য?”

তিনি বুঝলেন অবস্থা বেগতিক দিকে মোড় নিচ্ছে, তিনি বরাবরই ভুল সময়ে বেফাঁস কথা বলে বিড়ম্বনায় পড়ে যান।

তিনি মনে মনে প্রমাদ গুণলেন, স্ত্রীকে বললেন, “আসলে তুমি না থাকলে খালি খালি লাগে বাসাটা৷ এইজন্য ফোন করেছি। তুমি গুণে রেখেছ নাকি?”

“গা জ্বালানো কথা একদম বলবে না।”

“আচ্ছা, বাদ দাও। কাজের কথা বলি। রাত্রিকে নিয়ে আমার চিন্তা হয় বড্ড। নিজের মর্জিমতো চলে অভ্যস্ত। যেখানে যাবে, সেই বাড়ির মানুষগুলো ওকে বুঝবে তো? যাকে বিয়ে করবে, সে ওকে কতটুকু বুঝতে পারবে? যদি না বুঝতে পারে, তাহলে আমার মা’টা ভীষণ কষ্ট পাবে।”

এই চিন্তাটা মায়ার মনেও আছে। রাত্রি খানিকটা উড়নচণ্ডী, প্রাণ খুলে হাসতে পারে, আবার রাগ হলে সেটাও প্রকাশ করে। নিজেকে লুকায় না কখনো। চমৎকার মনের মেয়ে। তবুও জীবনে চলার পথে কখনো কখনো কিছু ক্ষেত্রে আপোষ করতে হয়। হয়তো কিছু অভিনয়ও করতে হয় সুখী হবার জন্য। মেয়েটা সেটা পারে না, ওর উপরে কোনো মুখোশ নেই, টলটলে পানির মতো স্বচ্ছ, ভালো মতো তাকালেই মনের ছায়া স্পষ্ট ধরা পড়ে যায়! এমন মেয়ের যোগ্য সঙ্গী মিলবে তো!

***
ইপ্সিতা ইমরোজের ঘরে এসে দেখল ভীষণ মনোযোগ দিয়ে খাতা দেখছে। এই মুহূর্তে তার দুনিয়ায় এর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু যেন নেই!

“ভাইয়া, কী করছ?”

“দেখতেই তো পাচ্ছিস, তাহলে জিজ্ঞেস করছিস কেন?”

“সবসময় আমার সাথে খালি রাগ দেখাও। তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না।” কাঁদো কাঁদো গলায় বলল ইপ্সিতা।

ইমরোজ খাতা থেকে চোখ সরিয়ে বোনের দিকে একবার তাকাল, মা’য়ের কাছ থেকে এই জিনিসটা বেশ ভালো মতো রপ্ত করেছে মেয়েটা৷ ওর হঠাৎ করে কেন যেন হাসি পেয়ে গেল, বলল,

“তোকে কেউ একজন আমাদের বাড়ির সামনে ফেলে গিয়েছিল, ইয়া বড় পাতিলের মধ্যে। বাবা তোকে কুড়িয়ে পেয়ে বাসায় নিয়ে এসেছিল। তোকে ভালোবেসে কী করব?”

“তুমি খুব খারাপ ভাইয়া। তবে আমি কিন্তু বড় হয়ে গেছি এখন। এসব ফাও কথা বলে আমাকে ভোলাতে পারবে না।”

“তা হঠাৎ আমার কাছে? কী বলতে এসেছিস বলে ফেল।”

“এমনিই এসেছি। আচ্ছা ভাইয়া, তোমার কেমন মেয়ে পছন্দ?”

“বুঝলাম না, তোরা সবাই হঠাৎ করে আমার বিয়ে নিয়ে পড়েছিস কেন বলতো? কাহিনী কী?”

থতমত খেয়ে ইপ্সিতা বলল, “কোনো কাহিনী নেই। আমার বিয়ের জন্য তো তোমরা উঠেপড়ে লেগেছ। তুমি আমার বড়। এই বাড়িতে ভাবি না আসা পর্যন্ত আমি কিন্তু বিয়ে করছি না, এটা বলে রাখলাম। তুমি তোমার কাজ করো।”

বলে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে, বেশ সাহস নিয়ে গিয়েছিল, একটা কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো। নিজের বিয়েটা এভাবে যদি আরও কিছুদিন পিছিয়ে দেয়া যায়৷ এরমধ্যে ওদের সেটিং করিয়ে দিতে পারলে শান্তি।

ইপ্সিতা বেরিয়ে যাবার পরে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল ইমরোজ। এরপর আবার খাতা দেখতে শুরু করতেই মনে পড়ল, আগামীকাল তো বিবাহ ডটকমে যেতে হবে। আগেরবার এপয়েনমেন্ট নিয়ে যা হ্যাপা পোহাতে হয়েছিল, এবার তাই ভিজিটিং কার্ডটা খুঁজে বের করে এপয়েনমেন্টের জন্য দেয়া নম্বরে কল করে সিরিয়াল ফিক্স করল।

***
উৎপল গিটার নিয়ে টুংটাং করছিল, হঠাৎ রাত্রি এলো।

“ভাইয়া, তোমার জন্য একটা সুখবর আছে।”

উৎপল দ্বিধান্বিত গলায় বলল, “কী সুখবর?”

“তুমি বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলে না? আমি আমার ক্লায়েন্টদের মধ্যে একজনকে সিলেক্ট করেছি।”

উৎপল ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে মনের ঘুড়ি উড়াতে শুরু করেই দিয়েছিল, কিন্তু পরের কথা শুনে গোত্তা খেয়ে সুতো কেটে সেই ঘুড়ি কোথায় ছুটে গেল সেটা দেখার মানসিকতাও রইল না।

“ভাইয়া শোনো, মেয়ের নাম শোভা। ভীষণ ভালো মেয়ে। আমি নিজে ওর ইন্টারভিউ নিয়েছি। তুমি জানো তোমার সাথে কত্ত মিল? সে-ও তোমার মতোই বার্সেলোনা সাপোর্টার, খেলা নিয়ে কখনো ঝগড়া হবে না। নিজে নাক ডাকে না, কিন্তু বলেছে বর নাক ডাকলেও সমস্যা নেই৷ তুমি তো মাঝে মধ্যে একটু আধটু নাক ডাকো৷ শোভাও মশারি টাঙিয়ে শোয়। প্রায় সবই মিলে গেছে, ফেভারিট সিঙ্গার, রাইটার পর্যন্ত মিল, ভাবতে পারছ? দেখতেও সুন্দরী, খুব ভালো ফ্যামিলি।”

উৎপলের ওই মেয়ের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই, সে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রাত্রিকে দেখছে,

“এসব কী বলিস তুই? একদম না। তাছাড়া তোর গুড উইল নষ্ট হবে না? ক্লায়েন্টের সাথে নিজের পরিবারের কারো বিয়ে করাতে চাইলে?”

“আরে ভাইয়া, ওসব নিয়ে ভেবো না। তুমি যথেষ্ট কোয়ালিফাইড। আরেকটা কথা, তুমি নিজেই যে জাহিদ ভাইকে দিয়ে আইডিয়াটা আমার মাথায় দিয়েছ। সেটা আমি জানি। তাই এখন লজ্জা পেতে হবে না। ছবি আর বায়োডাটা দিয়ে গেলাম৷ আমি চলে যাচ্ছি, মন খুলে দেখো।”

বলে মৃদু হেসে রাত্রি বেরিয়ে গেল, উৎপল বজ্রাহত হয়ে বসে রইল। কী থেকে কী হয়ে গেল৷

“জাহিদ, শালা, তোকে একবার সামনে পাই, তোর সব চুল আমি টেনে টেনে তুলব। তারপর সেই চুল বিক্রি করে তোকে দেয়া ট্রিট আর কনসার্টের টাকা উশুল করব।”

এরপর মনে হলো, ওই গবেটের চুল কে কিনবে? ওর গোবর মাথার মগজটা খুলে যদি বিক্রি করা যেত, ঢের ভালো হতো।
…………
(ক্রমশ)