#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (পর্ব ১৭)
নুসরাত জাহান লিজা
ইমরোজের বাড়িতে এসেও বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা যেন শেষ হবার নামই নিচ্ছে না। নানা কারণেই ওদের অনেক আত্মীয়স্বজনের সাথে খুব একটা দহরম মহরম নেই। তবুও ছেলের বিয়ে উপলক্ষে তাদের দাওয়াত দিয়েছেন আনোয়ারা। তাদের নানাজনের নানা মত, আবদার সবকিছুর ঝাঁপি খুলে বসেছে ওদের বসার ঘরে।
রাত্রি সম্পর্কে তাদের কৌতূহলের শেষ নেই। তার পেশা নিয়েও কারোর কারোর মাথা ব্যথা। রাত্রির ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। এখন মনে হচ্ছে বিয়ের সিদ্ধান্তটা না নিলেই বুঝি ভালো হতো। বিরক্ত হয়ে সে কিছু বলতেই যাচ্ছিল এরমধ্যে আনোয়ারা এলেন। তিনি মহা ব্যস্ত। এতবড় আয়োজন তাকে একা হাতে সামলাতে হচ্ছে। ইপ্সিতা সাথে থাকছে, তবে তাতে খুব বেশি উপকার যে হচ্ছে, এটা তিনি বলতে পারছেন না।
“ওদের উপর দিয়ে অনেক ঝক্কি গেছে। এখন রেস্ট দরকার। ইপ্সিতা, রাত্রিকে নিয়ে যা ওর ঘরে।” এরপর রাত্রির উদ্দেশ্যে বললেন,
“মা, যাও, ফ্রেশ হয়ে নাও। এরপর রেস্ট করো। কোনো প্রয়োজন হলে অবশ্যই আমাকে জানাতে দ্বিধা করবে না মা। আমি এখন থেকে তোমারও মা।”
“এসো ভাবি।”
হাঁফ ছেড়ে ইপ্সিতার সাথে ইমরোজের ঘরে এলো রাত্রি। পুরো ঘর ফুলে সাজানো। চমৎকার সৌরভ ছড়াচ্ছে ফুলগুলো। ভীষণ পরিপাটি ঘরটা। চোখ বুলিয়ে পুরো ঘর পর্যবেক্ষণ করল সে।
“ভাবি, ঘর পছন্দ হয়েছে তোমার? আমি নিজের হাতে সাজিয়েছি।”
“হ্যাঁ।” ভাবি সম্বোধনটা একেবারে নতুন ওর জন্য। আজ থেকে এটা ওর নতুন পরিবার। এই মানুষগুলোও ওর পরিবারের সদস্য। একটা শব্দ উচ্চারণে কেমন করে অপরিচিত একটা পরিবার মুহূর্তেই কাছের হয়ে যায়!
রাত্রি ঠিক করেছে ওর শত্রুতা ইমরোজের সাথে। যা শোধ তোলার তার কাছ থেকেই তুলবে। বাকিরা এর অন্তর্ভুক্ত নয়। আনোয়ারাকে সে আগে থেকেই পছন্দ করত, ওর প্রিয় শিক্ষকের তালিকায় প্রথমদিকেই থাকবেন। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে পুরো ক্লাস আপন করে নেবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার। তার কোনো ক্লাস ওর কাছে বোরিং লাগেনি। পড়াশোনার মতো এত বিরক্তিকর একটা জিনিসকে কী করে যেন ভীষণ মজাদার উপাদান হিসেবে উপস্থাপন করতে পারতেন। মাঝেমধ্যে যে রেগে যেতেন না, তা নয়, তবে তার যৌক্তিক কারণ থাকত।
ইপ্সিতাকেও ওর পছন্দ হয়েছে। ভীষণ চপলমতি, মিষ্টি একটা মেয়ে। এই মেয়েটার বিয়ের দায়িত্ব নিতে গিয়ে সে-ই বিয়ে করে ফেলল বিরক্তিকর এক লোককে।
যার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে এই বাড়িতে এসেছে, তাকেই কেবল মনে ধরেনি ওর। নাক উঁচু, দাম্ভিক আর বোকার হদ্দ এক লোক ইমরোজ। যাকে দেখলেই গা জ্বলে যায়!
“তোমার কোনো হেল্প লাগবে ভাবি?”
আনমনে ভাবছিল রাত্রি, ইপ্সিতার প্রশ্নে সম্বিত ফিরল ওর, “না, আমি পারব। তুমিও নিশ্চয়ই ক্লান্ত। বিশ্রাম করো, যাও।”
“আমার নাম্বার তো আছে তোমার কাছে। কোনো দরকার হলে জানিও। তোমার স্যুটকেস আনিয়ে রেখেছি। পানি, হাল্কা খাবার আছে টেবিলে।”
ইপ্সিতা বেরিয়ে যাচ্ছিল, পেছন থেকে রাত্রি বলল, “থ্যাংক ইউ।”
ইপ্সিতা ঘুরে মৃদু হাসি উপহার দিয়ে বেরিয়ে গেল।
রাত্রি দরজা বন্ধ করে শাড়ি, গহনার জঞ্জাল থেকে বের হয়ে মেকআপ তোলায় মন দিল। কিছুক্ষণ পরে দরজায় মৃদু কড়া নাড়ার শব্দে সে দরজা খুলে দিল। ইমরোজ দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। এখনো বরের বেশভূষায় সজ্জিত।
রাত্রি কথা না বলে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ইমরোজকে জায়গা করে দিল ভেতরে ঢোকার। ইমরোজ ভেতরে ঢুকে নিজের ঘরটাকে পর্যবেক্ষণ করল একবার। চিরচেনা ঘরকে কেমন আচেনা বলে ভ্রম হচ্ছে। ওর এত কষ্ট করে পরিপাটি করে রাখা ঘরটায় ফুল টুল দিয়ে কেমন করে রেখেছে।
চোখ গেল বিছানায়। সেখানে রাত্রির বদলে রাখা শাড়ি এলোমেলো করে রাখা। ড্রেসিং টেবিলের ওপরে এলোমেলো করে রাখা গহনা আর প্রসাধন সামগ্রী। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গেছে। এসব অগোছালো করে রাখা ওর সহ্যের বাইরে।
“নিজের জিনিস গুছিয়ে রাখতে শেখেননি? এভাবে কেউ রাখে? আমি ফ্রেশ হয়ে এসে যেন এমন না দেখি।”
রাত্রির মেজাজ বিগড়ে গেল, সে এসব গুছিয়ে রাখবে ভেবেছিল, সময় হয়নি। কিন্তু এখন সে ভুলেও কাজটা করবে না। শত্রুপক্ষের দূর্বলতা শনাক্ত করাটা যু দ্ধের প্রথম শর্ত। যাতে সময়মতো দূর্বল জায়গায় আঘাত করা যায়। ঘর গুছিয়ে রাখা মাস্টার মশাইয়ের অপছন্দ তবে! সে উত্তর দিল না। গ্লাসে পানি ঢেলে নিল, ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে। বিদায় নেবার কিছুক্ষণ আগে বড় খালামনি একগাদা খাইয়ে দিয়েছেন। এখন খাবার দেখেই গা গুলাচ্ছে।
ইমরোজ শেরওয়ানি পাল্টে ঘরে এসে দেখল পানি খেয়ে গ্লাসে অর্ধেক পানি সমেত টেবিলে রেখে দিয়েছে মেয়েটা। টেবলের অনেককিছুই ছড়ানো ছিটানো। নিজের জায়গায় শুয়ে ইমরোজের জন্য নির্ধারিত জায়গায় শাড়িটা রেখে দিয়েছে৷ গহনাগাঁটি সরিয়েছে শুধু। কিন্তু রাত্রির সমস্ত প্রসাধনী বের করে ড্রেসিং টেবিলের ওপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। এসব জঞ্জালের ভীড়ে নিজের ব্যবহার্য জিনিসপত্রই খুঁজে পাচ্ছে না।
সে রাত্রির দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে কী বলে গিয়েছিলাম শুনতে পাননি?”
“আমি কানে খাটো নই। অবশ্যই শুনেছি।”
“তাহলে করেননি কেন?”
“আমার সমস্যা হচ্ছে না। তাই করতে ইচ্ছে করেনি। আপনার সমস্যা হলে আপনি গুছিয়ে রাখুন।”
“আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন।”
“শুরুটা আপনি করেছেন। ভেতরে ঢুকেই যেভাবে কথা বলেছেন, সেটা মোটেও ভদ্রোচিত নয়। আপনি আমাকে অপমান করেছেন। আমি আগেই বলেছি, টিট ফর ট্যাট নীতিতে বিশ্বাসী আমি। আমি না ভীষণ ক্লান্ত। শুভ রাত্রি।”
“অশুভ রাত্রি।”
সে রাত্রির কথার কাউন্টার দিতে গিয়েই শুভ রাত্রির বিপরীত কথাটা বলেছিল। কিন্তু বলতে বলতেই বুঝতে পারল, ওর জীবনে এই রাত্রি নামক এই মেয়েটি আসলেই অশুভ। আক্ষরিক অর্থ হোক বা ভাবার্থ, সবভাবেই রাত্রি অশুভ আজ ওর জন্য।
“বুঝতে পেরেছেন বলে ভালো লাগল।”
বলেই আবারও শুয়ে পড়ল রাত্রি।
“আপনি এটা করতে পারেন না। উঠে এসব জঞ্জাল পরিষ্কার করুন। তারপর ঘুমান। আমি কেন আপনার কাজ করে দেব?”
“নতুন বউয়ের শাড়ি ভাঁজ করলে আপনার ইগোতে লাগবে বুঝি?”
এমন ক্যাটক্যাটে হাসি দেখে তিরিক্ষি মেজাজ আরও দফারফা হয়ে গেল। কিন্তু ইমরোজের কী-ই বা করার আছে! একটা মেয়ের সাথে সে তো অভদ্র হতে পারে না! সে নেহায়েত ভদ্রলোক বলে এই মেয়ে চূড়ান্ত অভব্যতা করে আরেকবার পার পেয়ে গেল।
ইমরোজ ভেবেছিল শাড়িটা মেঝেতে ফেলে দিয়ে শুয়ে পড়বে। কিন্তু নোংরা অগোছালো ঘরে ওর কোনোভাবেই ঘুম আসবে না। অগত্যা রাত্রির বিয়ের জমকালো শাড়িটা ভাঁজ করতে উদ্যত হলো। কিন্তু শাড়ির দৈর্ঘ্যের জন্য এর আগামাথা খুঁজে পেল না।
মায়ের শাড়ি সে অনেকবার ভাঁজ করে দিয়েছে, কিন্তু মা একপাশে ধরেছেন, সে অন্যপাশে। একা একা শাড়ি ভাঁজ করা ইহজগতের সবচাইতে কঠিন কাজ বলে মনে হচ্ছিল ওর। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে রাত্রিকে বলল,
“আপনি একপাশে ধরুন তো, আমি একা একা পারছি না।”
“রুমে এসে এভাবে বললে আপনার এই দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।”
“দেখুন, আমিও ক্লান্ত, প্লিজ, হেল্প করুন।”
রাত্রি এবার উঠে এলো। এক প্রান্ত ধরে অন্য প্রান্ত ইমরোজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এখন শুনতে ভালো লাগছে। আমার আবার দয়ার শরীর। কেউ সাহায্য চাইলে না করতে পারি না।”
ইমরোজ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিল। ওর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বাতিক আজকের জন্য ওকে হারিয়ে দিল। হিসেবের খাতায় আরেকটা হার যুক্ত হবার পাশাপাশি আরেকটা প্রতিশোধের কারণও যুক্ত হলো!
রাত্রির চাইতে হাত খানেক দূরত্বে শুয়ে ইমরোজের মনে হলো, ওর নিজের ঘর, নিজের বিছানা সবকিছু অযাচিতভাবে যেন অন্য কেউ দখল করে নিল!
***
উৎপল পুরো দিনটায় ইপ্সিতাকে দূর থেকে দেখেছে। কাছাকাছি গেলেই টেক্সট করেছে,
“এখন আমার আশেপাশে আসবে না। শেষ মুহূর্তে এসে ধরা পড়ে সব পন্ড হয়ে যাবে।”
সে-ও সতর্ক থেকেছে। মেয়েটাকে এত অপূর্ব দেখাচ্ছিল আজকে। মনকে শাসন করে চোখ সরাতে হয়েছে। তবুও কী করে যেন চোরা দৃষ্টি প্রেয়সীর দিকে চলে যেত!
রাত্রিকেও অপূর্ব লাগছিল। বোনকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। আজ আরেকবার উপলব্ধি করল। একটা মানুষের অনুপস্থিতি কী করে পুরো বাড়ি একরাশ শূন্যতায় নিমজ্জিত করে ফেলতে পারে, আজকের আগে উৎপল কোনোদিন উপলব্ধি করেনি!
ভাইয়ের প্রতি আদরের ছোটবোনের অধিকারবোধ প্রবল। বয়সে ছোট হলেও রাত্রি ওর মেন্টরও ছিল। ছেলেবেলা থেকে ঢাল হয়ে ওর পাশে ছিল! আজ যেন সমস্ত অধিকার ছেড়ে ওকে একা করে এই বাড়ির আলো কেড়ে নিয়ে অন্য বাড়িতে নিজের আলো ছড়াতে গেল। সহসা বুক ভারী হয়ে এলো উৎপলের। সাথে একটা আশঙ্কা। রাত্রি যেদিন জানবে, ওকে ক্ষমা করতে পারবে তো!
নিজের স্বার্থের জন্যই শুধু নয়, সব যাচাই-বাছাই করেই এই প্ল্যানে সম্মতি দিয়েছিল সে! নিজে জানার পাশাপাশি জাহিদকে দিয়ে সে-ও ইমরোজ সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিল সে। ইপ্সিতার কাছ থেকে তো জেনেইছিল। তাছাড়া বোনটা নিজেদের খুব কাছেই থাকবে, এটাও মাথায় এসেছিল ওর। কিন্তু রাত্রির চোখে এসব পড়বে কি! নাকি শুধু একজন স্বার্থপর মানুষ হিসেবে ওকে চিহ্নিত করবে সে! উৎপল সহ্য করতে পারবে না তবে!
***
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস ইমরোজের। ঘুম ভেঙে পাশে রাত্রিকে পরম শান্তিতে ঘুমাতে দেখল সে। এখন দেখলে কে বলবে, এই মেয়ে এত ভয়ংকর!
প্রথমে ঠাহর করতে পারল না, তন্দ্রাচ্ছন্নতা কাটতেই রাতে করা রাত্রির ব্যবহার মনে পড়ে গেল ওর। ওর জীবন অশান্ত করে এত শান্তিতে ঘুমাবে, আর সে বসে বসে মেনে নেবে, এতটা উদার সে একেবারেই নয়।
উঠে বিছানা থেকে নেমে অকারণে শব্দ করতে লাগল। জোরে ড্রয়ার খুলে আবার বন্ধ করল। গ্লাস হাতে নিয়ে সশব্দে টেবিলে রাখল। কাজগুলো বেশ কয়েকবার করতে করতে অবশেষে সে সফল হলো!
রাত্রিরও ওর মতোই বোধহয় ঘুম ভেঙে মনে করতে সময় লাগল নিজের অবস্থান সম্পর্কে। সে গলায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আপনি কি ইঁদুর? এভাবে সারাঘরময় খুটখাট শব্দ করছেন কেন?”
“ভালো লাগছে তাই করছি। আপনার মতো আমিও টিট ফর ট্যাট নীতিতে বিশ্বাসী। শুভ সকাল।”
বলেই ওয়াশরুমে চলে গেল ইমরোজ। অসহ্য রাগ হলো রাত্রির। এমনিতেই নতুন জায়গায় ওর ভালো ঘুম হয়নি। তার উপরে এত সকালে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস নেই ওর৷ এখন ঘুম পুরো না হওয়ায় মাথা ব্যথা করছে।
“টিট ফর ট্যাট কী জিনিস, হাড়ে হাড়ে তোকে যদি টের না পাওয়াই তবে আমার নামও রাত্রি না।”
(ক্রমশ)