বিবাহ বিভ্রাট ডটকম পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0
38

#বিবাহ_বিভ্রাট_ডটকম (শেষ পর্ব)
নুসরাত জাহান লিজা

এত আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ের আগে একটা ভজকট লেগে গেল। এক সপ্তাহ আগে কনভেনশন সেন্টারের বুকিং দিতে গিয়ে দেখা গেল, স্থান সংকুলান হবে না। সেটার অন্য ফ্লোরে আরেকটা বিয়ে, তাই তারা ব্যাকআপ দিতে পারবে না।

আগের হিসেবকে গড়বড় করে দিয়ে নতুন করে অতিথি সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এই বিড়ম্বনা। ইমরোজ দায়িত্ব নিয়েছিল, ওর এখন খাবি খাওয়া অবস্থা। এত অল্প সময়ে অন্য কোথাও হল পাওয়াও বিড়ম্বনা।

সব শুনে রাত্রি নিজেই মাঠে নামল, সে কয়েক বছর থেকে বিয়ের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে অসংখ্য বিয়ে এটেন্ড করতে হয়েছে। তাই অনেক জায়গায় ওর কানেকশন আছে। একদিনের চেষ্টায় কয়েক জায়গায় কথা বলে একটা সুবিধাজনক লোকেশনে পাওয়া গেল। তাও অন্য এক পার্টি বিয়ের জন্য বুক করেছিল, কিন্তু বিয়ের ডেট পিছিয়ে যাওয়ায় আজই বুকিং ক্যান্সেল করেছে। যাক, শেষ পর্যন্ত যে ব্যবস্থা হলো এটাই স্বস্তি।

ইমরোজ হাঁফ ছেড়ে বলল, “তুমি তো বেশ করিতকর্মা।”

রাত্রি বলল, “যাক, তাও স্বীকার করলে।”

“ওমনি শুরু হয়ে গেলো।”

“হবে না? কম তো আন্ডারএস্টিমেট করোনি আমার প্রোফেশনকে!”

“সে তো তুমিও করতে। আমি একা নাকি? এখন বলি?”

“হয়েছে, হয়েছে। জ্ঞানের জাহাজ আমার। আবার গাল ফুলিও না যেন। তাহলে আর বলব না।”

“শুধু শুধু গাল ফোলাতে যাব কেন?” গোমড়া মুখে বলল ইমরোজ।

রাত্রি সশব্দে হেসে ফেলল, “অলরেডি গাল দুটো ফুলে আছে। আবার বলছে ‘শুধু শুধু গাল ফোলাব কেন’!”

রাত্রিকে ওর মিমিক্রি করতে দেখে ইমরোজ হেসে ফেলল, এই মেয়ে শুধরাবে না। সে বলল,

“খালি ওকে আসতে দাও। তখন ও আমার টিমে চলে আসবে।”

“এ্যাহ্, থাকছে আমার পেটের মধ্যে, পক্ষ নেবে বাপের? মোটেও না।”

“আসলে দেখাই যাবে।”

রাত্রি বলল, “এখনই দল পাকাচ্ছ যে? আমি কি এখনো তোমার প্রতিপক্ষ?”

সুর অন্য দিকে যাচ্ছে দেখে ইমরোজ বলল, “যে আসছে সে তো আমাদের দু’জনেরই অংশ। তাই সবাই মিলে এক টিম। কোনো পক্ষ-বিপক্ষ নেই।”

“ফ্যামিলি টিম।”

রাত্রি ভাবছিল আরেকটু তাতিয়ে দেবে কি-না, কিন্তু থাক, এখনকার মতো যথেষ্ট হয়েছে।

পেটের উপরে হাত রেখে মনে মনে রাত্রি বলল, “তুই সুস্থ ভাবে আমাদের ঘরে আয়।”

***
উৎপল ইপ্সিতার বিয়ে হচ্ছে এতকিছু পেরিয়ে, তাতে আরও ভজকট না লাগলে হয়! মায়া আর রাত্রি ইপ্সিতা আর উৎপলকে সাথে নিয়ে গহনার অর্ডার দিয়ে এসেছিল। বিয়ের চারদিন বাকি থাকতে গহনা নিয়ে ফিরছিল উৎপল আর জাহিদ।

ফেরার পথে হাইজ্যাক হয়ে গেল বিয়ের গহনা। কিছু আগেই নিয়ে গেছে, আজ হার নিচ্ছিল। জিডি করে ফিরে এলো।

মায়া উৎপলকে বললেন, “সাবধানে ফিরবি না?”

“জুয়েলারি শপের বাইরে এদের দেখেছিলাম। তখন পাত্তা দিইনি। হয়তো ফলো করছিল। সন্ধ্যা সাতটা তেমন কোনো রাতও না। এরমধ্যে এমন হবে কে জানত!”

হাবিব সাহেব বললেন, “তাও ভালো ছু রি টুরি মে রে দেয়নি। এটাই শুকরিয়া। এখন আর বকাবকি করে লাভ কী!”

মায়া বললেন, “গহনা মেয়েদের জন্য বিশেষ কিছু। এর মায়া কাটানো সহজ না। তোমরা বুঝবে না।”

“তোমার সবকিছুতেই মায়া। এইজন্যই নাম মায়া। শুধু আমার জন্যই ওই জিনিসটা একটু কম!”

মায়া কটমটে দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকালেন, এই লোক এমন কেন এটা এত বছর সংসার করেও বুঝতে পারলেন না তিনি। বয়স হয়ে গেছে, নাতি-নাতনি আসতে যাচ্ছে, তবুও মানুষটা সিরিয়াস হতে শিখল না।

“না, মানে আছে অজস্র, কিন্তু প্রকাশ একটু কম। এই যা।”

মায়া আর কথা বাড়ালেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আপাতত নিজের বিয়ের সময়ে পাওয়া হারটাই দেবেন ইপ্সিতাকে। পরে যদি ইপ্সিতার কাছে সেকেলে মনে হয়, তখন নতুন করে ওটার ডিজাইন বদলাতে পারবে।

***
রাত্রিকে আনোয়ারা নিজেই ডাকলেন, সাথে ইমরোজকেও।

“শোন মা, তুই বরং ওই বাড়িতে যা। উৎপল তোর ভাই। তোর বাবা-মাও তোকে মিস করছে এত আয়োজনে। তোরও ভালো লাগবে। এই সময় যত হাসিখুশি থাকা যায় তত ভালো তোর জন্য।”

ইমরোজ কিছু বলতে গিয়েও বলল না। রাত্রি বলল, “মা, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু তুমি একা হাতে এত কাজ…”

“ইমু আছে তো। ও পারে এসব। এখন ভারি কাজ না করাই ভালো তোর জন্য। থাকলেও করতে দিতাম না।”

রাত্রি ঠিক করল, বিয়ের একদিন আগে যাবে, বিয়ের দিন সকাল বেলা চলে আসবে এখানে। অন্তত ইপ্সিতার সাজের সময় সাথে থাকতে হবে। মেয়েটা বিয়ের সাজ নিয়ে বেশ ভয়ে আছে। তাছাড়া বিয়ের দিন এখানে থাকাটা বেশি জরুরি মনে হলো। বৌ-ভাতে ওই বাসায় থাকবে।

রুমে আসতে ইমরোজ বলল, “তার মানে ইপ্সির বিয়ের আয়োজন তোমাকে ছাড়া করতে হবে আমার?”

“মিস করবে আমাকে?”

“খুব।”

“তাহলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমাকে কল দিও। বিয়ের আগে তো প্রেম করা হয়নি। দুইদিন না-হয় প্রেম করি। লং ডিসট্যান্ট রিলেশনশিপের মতো মনে হবে বিষয়টা!”

“খুব খুশি, না?”

“আমি দুই পক্ষই, বুঝলে! ওদের আলাদা আলাদা বিয়ে হলে অবশ্য দুটো বিয়ে খেতে পারতাম৷ এখন একটাতেই কাজ শেষ।”

ইমরোজ হেসে বলল, “ওদের একটা ধন্যবাদ কিন্তু আমরা দিতেই পারি।”

“কীসের জন্য?”

“ওরা কলকাঠি না নাড়লে কী আর তোমাকে পেতাম?”

রাত্রিও হেসে বলল, “এটা ভেবেই আমি আরও আগেই ওদের মাফ করে দিয়েছি।’’

***
রাত্রির ঘরে উৎপল এসে বসল।

“তোর মনে এখনো আমাকে নিয়ে কষ্ট আছে?”

রাত্রি ভাইয়ের মুখটা দেখল, ভালোবাসা চূড়ান্ত পরিণতি পেতে যাচ্ছে, চোখে-মুখে আচ্ছন্ন ভাব। উৎপল ওর কত প্রিয় সেটা কি সে জানে! প্রশ্নটা করেই ফেলল রাত্রি,

“ভাইয়া, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি সেটা কি তুমি জানো?”

উৎপল সস্নেহে বোনের মাথায় হাত রেখে বলল, “জানি রে পাগলি। তুই আমার শুধুমাত্র ছোট বোন না। আমার ঢাল। তুই আমার সাথে না থাকলে হয়তো আমি বুলিংয়ের শিকার হয়ে ট্রমাটিক সিচুয়েশনে চলে যেতাম। ছেলেবেলায় একটু বেশি চুপচাপ স্বভাবের জন্য আমার বয়সীরা অকারণেই আমাকে অপছন্দ করত, খোঁচাত। তুই তখন আমাকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিস। তোকে আমি কতটা ভরসা করি তুই জানিস?”

রাত্রি সচরাচর কাঁদে না, কিন্তু আজ কেন যেন দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল, প্রবল সুখে। এই ভালোবাসা কাজে প্রকাশ হতো সবসময়ই৷ আজ প্রথম প্রকাশ করল দুই পক্ষই।

“বিয়ে করলেও আমার কিন্তু চকলেট চাই।”

পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে কথাটা বলল রাত্রি।

“অবশ্যই, তোর চকলেটে ভাগ বসাবার জন্য তোর পুঁচকেটাও আসবে। দু’জনের জন্যই আনব তখন।”

রাত্রি হেসে ফেলল, “ইপ্সি তোমার ভরসায় আসছে। ওকে মানিয়ে নিতে সাহায্য কোরো, কমফোর্ট জোন দিও।’’

উৎপল মৃদু হাসল, তার সেই ছোট্ট ডানপিটে রগচটা বোনটা কেমন সংসারী হয়ে উঠেছে। মা হতে যাচ্ছে, বোনের সুখে ওরও আনন্দ হচ্ছে।

***
ইপ্সিতার সেন্সেটিভ স্কিন, কিছু নির্দিষ্ট প্রোডাক্টের বাইরে অন্যকিছু ব্যবহার করলেই স্কিনের বারোটা বেজে যায়। তাই বিয়ে উপলক্ষে কিছু প্রোডাক্ট আনিয়ে রেখেছিল। আজ বিয়ে। সকালে পার্লারে যাবার আগে খুঁজতে গিয়ে দেখল নেই।

রাত্রি সকালেই এসেছে, ইমরোজ আনতে গিয়েছিল। সে একাই আসতে চাইছিল, কিন্তু ইমরোজ নিজেই গেছে। সেদিন উৎপলের হাইজ্যাক হয়েছে বলে সে ভয় পেয়েছে। সকাল সাতটা বেশ সকাল।

রাত্রি বলল, “কোথায় রেখেছিলে?”

“রাতে বের করে ড্রেসিং টেবিলে রেখেছিলাম।”

ইপ্সিতার অস্থিরতা দেখে ইমরোজও রুমে এলো, “এইজন্যই বলি, রুমটা একটু গুছিয়ে রাখ। একটা জিনিস কোথায় রাখিস মনে করতে পারিস না।”

রাত্রি বলল, “আরে, আজ মেয়েটার একটা বিশেষ দিন। আজও রাগারাগি করতে হবে?”

ইপ্সিতার কাঁদোকাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে ইমরোজের ভারি মায়া হলো, বলল, “প্রোডাক্টগুলোর লিস্ট করে দে, নিয়ে আসি।”

“আজ তো শুক্রবার।”

রাত্রি ইপ্সিতার ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে দেখল বাইরে নূরী দাঁড়িয়ে আছে, কাচুমাচু ভঙ্গিতে।

“ভাবি, আমি সকালে ঘর ঝাড়ু দিতাছিলাম৷ তহন হাত লাইগা পইরা গেছে। দুইটা জিনিস ভাইঙ্গা গেছেগা। আমি ডরাইছিলাম। তাই লুকাইয়ে নিয়ে গেছি।”

“কই? দেখি দে তো।”

নূরী এবার ততোধিক কাচুমাচু মুখ করে বলল, “ভাবি, আমি ডরে ফালাইয়ে দিয়া আসছি বাইরে। ভাবছিলাম কমু না। কিন্তু আফারে কানতে দেইখা মনে কষ্ট লাগতাসে।”

বেশ দামী প্রোডাক্ট ছিল সেগুলো, ইপ্সিতা ততক্ষণে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। সেগুলোর জায়গা হয়েছে কি-না ডাস্টবিনে। নূরীকে কিছু বলল না। বেচারি বুঝতেই পারেনি হয়তো। এখন বলেই আর লাভ কী। কাঁদতে গিয়েও কাঁদল না। আগে হলে কেঁদে বুক ভাসাত। গত সাত-আট মাসে সত্যিই সে অনেকটা পরিণত হয়েছে৷

সে ওর দুজন ফ্রেন্ডকে কল দিল, কিছু কমন প্রোডাক্ট পেল, ওর পুরোনো কিছু ছিল। সেসব দিয়েই নাহয় কাজ চালানো যাবে। কী আর করা।

সাজ শেষ করে বেরিয়ে দেখল ঝুম বৃষ্টি। গতকালও বৃষ্টি হয়েছে। কোনোরকমে গাড়িতে উঠল সে। সাজ শেষে নিজেকে দেখে ইপ্সিতা যত খুশি হয়েছিল, আবহাওয়া দেখে মন কিঞ্চিৎ খারাপ হয়ে গেল। সব ঝামেলা ওদের বিয়ের জন্যই জমে ছিল! বিয়েটা ভালোই ভালোই যেন হয় এই দোয়া করল মনে মনে।

উৎপল মেসেজ দিয়েছিল, একটা ছবি দেবার জন্য। ইপ্সিতা গাড়িতে বসে উত্তর দিল,

“এই লুক এক্সক্লুসিভ জনাব। একেবারে ভ্যানুতেও দেখবেন।”

***
বরযাত্রী চলে এসেছে। ইপ্সিতার বান্ধবীদের সাথে পাত্রপক্ষের দর কষাকষি চলছে ভেতরে ঢোকা নিয়ে। জাহিদের মধ্যস্থতায় উৎপল ভেতরে আসতে পারল। খাওয়া শেষে বিয়েও সম্পন্ন হয়ে গেল। উৎপল আর ইপ্সিতা মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করল। বহু ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে অবশেষে ওরা পরস্পরকে পেল।

প্রাপ্তির আনন্দ এত সুন্দর হয়! এক পৃথিবী সুখে হৃদয় ভরে উঠল।

মায়া আর হাবিব সাহেব ইপ্সিতাকে এত আপন করে নিলেন, ওর মনে যত দ্বিধা ছিল সব নিমিষেই কেটে গেল। খুব আপন মনে হলো।

রাতে উৎপল আর ইপ্সিতা যখন একান্তে সময় পেল, তখন উৎপল উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,

“অবশেষে তোমাকে পেলাম ইপ্সি।”

“অনিশ্চয়তা ছিল বলেই হয়তো প্রাপ্তির আনন্দ এত মধুর মনে হচ্ছে।”

চমৎকার এই মুহূর্তটায় ওরা আবেগ আর ভালোবাসার মহাপ্লাবনে যেন ওরা ভেসে গেল। সঙ্গী হলো ভরসা আর প্রতিশ্রুতি।

***
জাহিদের সাথে আলাপ করতে গিয়ে ইমরোজ কথায় কথায় জেনেছে রাত্রি বিয়ের আগে ওর উপরেও সেই স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন চালিয়েছে। ও ভেবেছিল, যে মেয়ে নিজে অন্যের বিয়ে মেপে মেপে করায়, সে নিজের বিয়েতে কোনো মাপজোক করেনি। এটা ভেবেই সে খুশি ছিল, নিজেকে ‘স্পেশাল’ মনে হতো। মিছেই গর্ব করেছে মনে মনে।

রাত্রি বুঝতে পারল না এই ভদ্রলোকের মাথায় কী চলছে।

“আজ আবার কী ঘোঁট পাকাচ্ছেন লেকচারার সাহেব?”

প্রথমে গাইগুই করলেও রাত্রি কৌশলে ইমরোজের পেট থেকে কথা বের করে নিল।

অদ্ভুত ছেলেমানুষ এখনো এই মানুষটা, রাত্রি প্রশ্রয়ের হাসি ফুটিয়ে বলল,

“আরে বুদ্ধু, এইজন্য মন খারাপ করতে হয়? তুমি এমনিতেই আমার কাছে স্পেশাল। ভীষণ ভীষণ স্পেশাল। বুঝতে পারো না?”

ইমরোজ রাত্রির কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“পারি তো।”

“সমসময় এমনই থেকো। একটু পাগলাটে মানুষটাকেই আমি ভালোবাসি। কতটা জানি না।”

বলে রাত্রি ইমরোজের বুকের বাম পাশে কান পাতল, ইমরোজ বলল, “আমিও।”

রাত্রি বলল, “আমি অনুভব করতে পারছি৷ সব কথা মুখে না বললেও হৃদয় ঠিক বুঝে নেয়।”

হাজারটা বৈপরীত্য পরস্পরের মধ্যে, তবুও কী করে যেন মুহূর্তেগুলো সুন্দর হয়ে যায়! অপার্থিব হয়ে উঠে।

***
দুই সপ্তাহের মধ্যেই ইপ্সিতার মনে হচ্ছিল সে এত অল্প সময়ের মানিয়ে নিয়েছে। শুধু একটা সমস্যা হচ্ছে। উৎপলটা ভীষণ ঘুমকাতুরে। রাতে অনেক প্রস্তুতি নিয়ে গল্প করতে শুরু করে, একটু পরে সাড়াশব্দ না পেয়ে দেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রথম কয়েকদিন মায়া হয়েছিল। আহারে! নিশ্চয়ই ক্লান্ত থাকে। কিন্তু প্রতিদিন এমন কাহাতক সহ্য করা যায়।

“তুমি এমন ঘুমকাতুরে আগে বুঝিনি।”

“বুঝলে কী করতে?”

“বিয়ে নিয়ে আবার ভাবতাম।”

“আমাকে ছাড়া থাকতে পারতে?”

এমন মুখ করে কথাটা বলল, ইপ্সিতা বলল, “সেটাই তো। ভালোবেসে ফেঁসে গেছি।”

“তারপর?”

“তারপর আর কী! এখন এই ঘুমকাতুরে ছেলেটাকেই সারাজীবন সহ্য করতে হবে!’’

উৎপল হেসে ফেলল।

ইপ্সিতা খুব আগ্রহ নিয়ে মায়ার কাছে রান্না শিখছে। আগ্রহ দেখে তিনি আর নিষেধ করেননি। তবে সতর্ক করেছেন,

“এখন এসবের মধ্যে আসতে হবে না মা। পরীক্ষা সামনে। সেটা ভালোমতো দাও আগে। তোমার যদি কিছু করতে ইচ্ছে করে, পরীক্ষার পরে তারজন্যও নিজেকে প্রস্তুত করো। ঘর-সংসার পালিয়ে যাচ্ছে না।”

“আপনার কাছ থেকে শিখতে ভালো লাগছে মা। সেজন্য।”

কথায় কথায় সেদিন মায়া বললেন৷
“পুরোনো হারটা চাইলে নতুন করে পছন্দমতো ডিজাইনে গড়িয়ে নিতে পারো।”

ইপ্সিতা মৃদু হেসে বলল, “না মা, এটা তো আপনার স্মৃতির জিনিস। এটা এভাবেই থাকুক। আমার পরতে ভালো লেগেছে।”

হাবিব সাহেব আর মায়ার খুঁনসুটি অব্যাহত আছে, ইপ্সিতার ভীষণ মজা লাগে। খুঁনসুটির আড়ালের ভালোবাসাটা এত স্পষ্ট!

ইমরোজ এই বাড়িতে এলে অবশ্য ধন্দে পড়ে যায়! কোনদিকে যাওয়া নিরাপদ তাই বুঝতে পারে না।

আনোয়ারা মেয়েকে নিয়ে ভীষণ চিন্তা করতেন, অনেক অলস, ছেলেমানুষি আছে ভেতরে। সামনের জীবনে কী হয় না হয়! এখন স্বস্তি পান। ইপ্সিতা আর ইমরোজের সুখী সংসার দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগে।

***
ইমরোজ নতুন করে একটা উৎপাত শুরু করেছে। রাত্রি ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে গেছে। সময় যত ঘনিয়ে আসছে, এই মানুষটার পাগলামি তত বাড়ছে।

একেবারে প্রেসক্রাইবড ডায়েট চার্ট ধরে ধরে ওকে খাওয়ায়। সেদিন বলেছে,

“মাতৃত্বকালীন ছুটির পাশাপাশি পিতৃত্বকালীন ছুটি দ্রুত কার্যকর হোক।”

“কেন? ডিক্টেটরশিপ চালাতে আরও সুবিধা হতো তাহলে?”

রাত্রির হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। ব্লাডপ্রেশার উঠানামা করে। ওর টেনশন যে মেয়েটা কেন বোঝে না!

“এখন কিন্তু তুমি ছেলেমানুষি করছ। তোমার ভালো থাকার জন্য করছি এটা।”

রাত্রি বোঝে সবই, কিন্তু ইদানিং ওর মেজাজ মর্জিতেও পরিবর্তন এসেছে। মাঝেমধ্যে অকারণেই খিটখিটে আচরণ করে ফেলে ইমরোজের সাথে। পরক্ষণেই স্যরিও বলে। তবুও কেন যে করে!

ইমরোজ প্রায়ই নিজে রান্না করে রাত্রির জন্য। হুট করে শুটকি ভর্তা খেতে চায় ঝাল দিয়ে। এখন বেশি ঝাল খাওয়া ঠিক নয়। সব বিবেচনা করে ব্যালেন্স করে রান্না করে। ওর জন্য একজন এত কষ্ট করছে, এটা ভেবেই মন খারাপ হয়, রাগটাও মন খারাপ থেকে হয়।

আনোয়ারাও সবসময় খেয়াল রাখেন ওর। ওর মন ভালো রাখার ব্যবস্থা করেন। মায়াও প্রায়ই আসেন এখানে। ইচ্ছে ছিল, এই সময় তার কাছে রাখতে। কিন্তু ইমরোজের কলেজ দূরে হয়ে যায় ওই বাসা থেকে। তিনি চিন্তা করে দেখলেন, হবু বাবা এই জার্নিতে সাথে থাকুক। তাই আর জোর দিলেন না। মাঝেমধ্যে হাবিব সাহেবও এসে মেয়েকে দেখে যান।

“আমি কেমন ফুলে গেছি। আমাকে দেখতে খুব খারাপ লাগে এখন, তাই না?”

“তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগে রাত্রি। জীবনের সব স্টেজের আলাদা আলাদা সৌন্দর্য আছে। এই সৌন্দর্য ভীষণ অন্যরকম।”

রাত্রির বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। এত ধৈর্য কেন এই মানুষটার। নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হয়।

ডাক্তারের দেয়া ডেটের এক সপ্তাহ আগেই রাত নয়টার দিকে রাত্রির প্রবল ব্যথা শুরু হলো। ইমরোজ বাসাতেই ছিল। আনোয়াকে ডেকে আনল। এরপর সোজা হাসপাতালে।

কিছু জটিলতা ছিল, তবে সব ভালোই ভালোই সম্পন্ন হয়েছে। মা-সদ্য জন্মানো শিশু কন্যা দু’জনেই সুস্থ আছে। ইমরোজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আনোয়ারাও। মা ছেলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করল।

পরিশিষ্টঃ
ইমরোজ আর রাত্রির মেয়ের নাম রাখা হয়েছে আরিবা। তার বয়স এখন তিন বছর। আনোয়ারা নাতনিকে নিয়ে খেলেন। ইমরোজ মেয়েকে সহজে চোখের আড়াল করতে চায় না। রাত্রিরও চোখের মনি।

তবে আরিবা ভীষণ দুষ্টু হয়েছে। সে একটা বিষয় নিয়ে দ্বিধায় আছে। ইপ্সিতা আর উৎপলকে দেখলেই তার এই দ্বিধা জাগ্রত হয়। উৎপল বলল,

“আমি তোর কী হই?”

“মামা।”

এরপর ইপ্সিতাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ও কে?”

“মামি।”

ইপ্সিতা রেগে গেল উৎপলের উপরে, “একদম মামি বলবি না। এদিকে আয় তো পুঁচকে সোনা। আমি তোর ফুপু হই। বল ফুপু মনি।”

এবার দ্বিধা নিয়ে সে বলল, “ফু মনি।”

“ও হলো ফুপা।”

“ওইতা তো মামা।”

“না ফুপা।”

“তুমি ফু মনি, ও মামা। তুমি মামি, ও ফুপা।”

হেঁটে হেঁটে সে ইমরোজের কোলে গেল, “বাবার ভীষণ ন্যাওটা হয়েছে মেয়ে।

“বাবা, ফু মামি আর ফু মামা কী বলে বুঝি না তো।”

সবাই হেসে ফেলল এই অদ্ভুত ডাক শুনে। উৎপল বলল, “মা রে, তোর ফুপা মামা যা খুশি ডাকিস। কিন্তু এই ফু মামা ডাকিস না।”

রাত্রি এসে বলল, “আমার মেয়েকে আরও কনফিউজড করো তোমরা। এটাই ভালো হয়েছে।”

উৎপল ফিসফিস করে ইপ্সিতাকে বলল, “আমাদের এরকম একটা পুঁচকে কবে আসবে?”

ইপ্সিতাও একইরকমভাবে জবাব দিল, “আসবে আসবে।”

***
দুটো দম্পতির মধ্যে হাজারটা অমিল। একটুতেই মান-অভিমান চলে। কখনো কখনো মনে হয় বিয়ে মানেই বিভ্রাট। তবুও এই বিভ্রাট থেকেই জীবনে আনন্দের ফল্গুধারা নেমে আসে ওদের জীবনে। মান-অভিমান আসে অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী হয়ে। সেই পালা কেটে গেলেই ভালোবাসার জোছনাধারা ওদের ভিজিয়ে দিয়ে যায়।

রাত্রির পছন্দ ব্যান্ডের গান, ইমরোজের রবীন্দ্রসংগীত। রাত্রি ঝাল খেতে পছন্দ করে, ইমরোজ ঝাল কম খায়। ইমরোজ অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে ধরনের গোছানো, রাত্রির বাতিক নেই। রাত্রির বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে, ইমরোজের ঠান্ডার ধাত।

তবুও স্ত্রীর ইচ্ছা পূরণ করতে রাত্রির অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওর সাথে ছেলেমানুষি জেদ করে ভিজে জ্বর বাঁধায়।

আরিবা ঘর প্রায়ই এলোমেলো করে ফেলে, ইমরোজ নিজেই ধৈর্য ধরে গোছায়।

“এত খুঁতখুঁত করলে হয়? ছোট বাচ্চা তো।”

“কই খুঁতখুঁত করলাম। ছোট্ট বাচ্চা বলেই তো হাইজিন মেইনটেইন করি।”

“ওটাকে হাইজিন বলে না, ছুঁচিবাই বলে।” পাশ থেকে আনোয়ারা বললেন।

“হ্যাঁ, সব তো একদল জানি তো।”

“বাবা, হাইইন কী?”

“পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা।” আরিবার জন্য বোধগম্য হয় এভাবে বলার চেষ্টা করল ইমরোক।

এই শব্দ আরিবার বোঝার কথা না। তবুও বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল।

সে এলোমেলো করে খেলনা আবার গুছিয়ে জায়গামতো রাখার চেষ্টা করে। বাবার কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে ফেলেছে এইটুকু বয়সে।

“হচ্ছে তো বাপের ফটোকপি।”

“আমার মেয়ে অনেক কিউট। মায়ের মতো ক্যাটক্যাটে হবে নাকি!”

রাত্রি রাগি দৃষ্টিতে তাকালো, এরপর আনোয়ারাকে বলল, “তোমার ছেলের কাছে এখন আমাকে ক্যাটক্যাটে মনে হয়।”

“এসব কী ইমু?”

ইমরোজ কথাটা ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়া যায় এমন কিছু বলতে যাচ্ছিল। মেয়ের প্রশ্নে তাতে বিঘ্ন ঘটল।

“ক্যাতক্যাতে কী বাবা?”

কী বলতে যাচ্ছিল সেটা ভুলে গিয়ে মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলল,

“যারা কথায় কথায় ঝগড়া করে।”

“মা ঝগড়া করে?”

এবার জিভ কাটল ইমরোজ, তিন প্রজন্মের তিনজন তিন বয়সী নারী/মেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

সে কোনোমতে মেকি হাসি দিয়ে বলল, “মাঝেমধ্যে করে তো।”

রাত্রি রেগে ভেতরে চলে গেল, “মা দাগ করেছে।”

‘র’ একবার উচ্চারণ করতে পারে, আরেকবার পারে না। ইমরোজ মেয়েকে কোলে নিয়ে ভেতরে গেল।

আনোয়ারা হেসে ফেললেন। টুকরো টুকরো খুঁনসুটিময় ভালোবাসার স্বাক্ষী হতে কার না ভালো লাগে। ইমরোজ আর ইপ্সিতার বাবাকে মিস করেন শুধু। মানুষটা এই সুখ দেখে যেতে পারল না। তার জন্য দোয়া করে চোখ মোছেন তিনি।

রাত্রির নিষ্ঠা আর পরিশ্রম দেখে ইমরোজ মুগ্ধ হয়। মেয়েকে সামলে কেমন বিবাহ ডটকম চালায় শক্ত হাতে। এখন অফিসও বড় করেছে। সেই গোলমেলে বিবাহ ডটকম, রাত্রির এই জিনিসটাকে মাঝেমধ্যে হিংসেই হয় ওর। একটা প্রতিষ্ঠানের প্রতি হিংসা থেকেই সে নাম দিয়েছে ‘বিবাহ বিভ্রাট ডটকম।’

অবশ্য ওই গোলমেলে প্রতিষ্ঠান না থাকলে রাত্রিকে কী করে পেত ইমরোজ! শুধু সময়টা নিজে আরেকটু বেশি পেলেই হতো।
………………
(সমাপ্ত)