মায়াকুমারী পর্ব-৩৭

0
72

#মায়াকুমারী ❤️
#মেহেরিন_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(৩৭/ক)
___________________

শুয়ে পড়ল দ্যুতি। শরীরটা কেমন নেতিয়ে এলো পুইলতার ন্যায়।

“এখন কী করব দ্যুতি?”

মৌন রইল সে।

“শাড়িগুলো কে নিতে পারে কিছু চিন্তা করেছিস?”

দ্যুতি নিরুত্তর। জাহান্নামে যাক শাড়িগুলো। শাড়ি দিয়ে কী করবে? তার জীবনের রঙ যেখানে মলিন,ধূসর সেখানে শাড়ি জাহান্নামের চুলোয় যাক!

“মেজ ভাইয়া শুনতে পেলে খুব সিনক্রিয়েট করবে। তুই কিছু বলিস না। আমরা বরং ওই শপে গিয়ে জিজ্ঞেস করব ওমন শাড়ি আর আছে কিনা!”

নীরব রইল দ্যুতি। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। প্রতিটি কথা বিষের ন্যায় লাগছে! একপলক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিশু। চিরুনি নিয়ে দ্যুতিকে তুলে চুলগুলো আঁচড়ে শক্ত করে বেঁধে দিলো। কেমন ঝট বাঁধিয়ে গিয়েছে চুলগুলো। হাত ধুয়ে ডাইনিংয়ে গেল। হটপটের ঢাকনা তুলতেই দেখল ভাত ভরা। ফুপা-ফুপি সামান্য খেয়েছিল ঔষধ খাওয়ার জন্য। ধূসর খায়নি। কেন খায়নি তার উপর রাগ করে বোধহয়। মুখটা মলিন হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করার অধিকার হারিয়ে ফেললো সকালে তাই নীরব রইল। প্লেটে ভাত বেড়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো।

“আবারও শুয়ে পড়লি কেন উঠ।”

চোখ বুজে রইল দ্যুতি। সকাল থেকে উপবাস দু’জন। এত ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার রুচি কি হয়? নিশুর শরীর কাঁপছে!

“উঠ না।”

হাত ধরে উঠায়। ভাত মেখে মুখের সামনে ধরলো। দ্যুতি নিলো না।

“প্লিজ একটু খা।”

“খিদে নেই।”

“আমার খিদে পেয়েছে। আমার জন্য একটু খা।”

“খাব না।”

“দ্যুতি মেজাজ খারাপ করিস না। সকাল থেকে অভুক্ত দু’জন। আমি আজকে একটা মেডিসিনও নিইনি। শুনতে পেলে খবর আছে। হাঁ কর।”

জোর করে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। দ্যুতির চোখে পানি ছলছল করছে। বাম হাত দিয়ে মুছে দিলো।

“থাক মনখারাপ করিস না। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখন কাঁদলে তো কিছু হবে না। দোয়া কর যাতে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখে।”

দ্যুতিকে খাইয়ে নিশু নিজেও খেয়ে নিলো। শুয়ে পড়ল দ্যুতি। প্লেট ধুয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকলো। কাল রাত থেকে শরীর স্বাস্থ্য খুব খারাপ তার। কী হয়েছে বুঝতে পারছে না নিশু। তলপেটটা ছিড়েখুঁড়ে যাচ্ছে কিন্তু নিশু স্থির। পাকনামি করে ধূসরের সঙ্গেও সম্পর্ক নষ্ট করেছে এখন না পারছে সহ্য করতে না পারছে বলতে! হাত ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ বুজতেই ভেসে উঠলো ছোট্ট বেলার স্মৃতি। ধূসরের বইখাতার মধ্যে আঁকিবুঁকি করতো,বইয়ের মধ্যে থাকা মানুষগুলোর ছবিতে টিপ,চুড়ি,লিপস্টিক এগুলো করতো। ধূসর বকাবকি করলেও কখনও গায়ে হাত তুলতো না। নিশু মার সহ্য করতে পারতো না। ছোটবেলায় ধ্রুবর মার খেয়ে বেশ কয়েকদিন বিছানায় ছিল। সেই থেকেই এলার্ট থাকে ধূসর। আজ হঠাৎ কী বুঝে থাপ্পড় মা’রলো! চোখজোড়া জলে টইটম্বুর হয়ে গেল ভরা বর্ষার বিলের মতো। কীভাবে পারলো তার গায়ে হাত তুলতে! অভিমানী হয় নিশু। আর কখনও কথা বলবে না মানুষটার সঙ্গে। চোখজোড়া ভেঙ্গেচুরে এলো।
___

বারবার কলিংবেল বাজতেই ডোর খুললো রিনা খালা। বাসায় প্রবেশ করলেন একজন লোক,চিনতে পারলো না তিনি।

“আপনে কেডা?”

“আসাদ সাহেব আছে?”

“হ।”

“উনাকে ডাকো।”

“আইচ্ছা আপনি বসেন।”

উপরে এসে আসাদ সাহেবকে বিস্তারিত জানালো রিনা খালা। টেনশনে একটু শুয়েছিলেন। চোখ লেগে আসতেই কাঁচা ঘুমে ব্যঘাত ঘটায় বিরক্ত হলেন। চোখ রগড়ে চশমা পরে লিভিং স্পেসের দিকে এগিয়ে যেতেই থমকালেন। মেজাজ খারাপ হলো উনার। একশো চুল্লির আগুনের ন্যায় দপদপ করতে লাগলো মস্তিষ্ক।

“তুমি!”

“হ্যাঁ।”

“কেন এসেছো?”

“নিশুকে নিতে।”

“কী বললে?”

“আমার মেয়েকে নিতে এসেছি।”

চোয়াল শক্ত করলেন আসাদ সাহেব।

“কেন?”

“আমার মেয়েকে নিয়ে যাব।”

“কীসের জন্য?”

“আপনার ছেলে স্ত্রীর মর্যাদা দিলো না এখানে রেখে কী লাভ?”

মুষ্টিবদ্ধ করলেন হাত।

“তোমাকে জানতে হবে না আমার পরিবার সম্পর্কে।”

“নিশু আমার মেয়ে।”

কষিয়ে একটা থাপ্পড় মা’রলেন উনার গালে।

“লম্পট!”

অগ্নি চোখে তাকালো নিশুর বাবা।

“তোর দুঃসাহস দেখে অবাক হচ্ছি!”

বাকবিতণ্ডা শুনতেই লিভিং স্পেসের দিকে এগিয়ে গেল ধূসর। ঘুম ভেঙে গেল দিলরুবা খাতুন সহ নিশু-দ্যুতির। এক এক করে লিভিং স্পেসে জড়ো হলো সবাই। নিজের বাবাকে দেখতেই চমকায় নিশু।

“আমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাব।”

“কোন অধিকারে?”

“আমার মেয়ে এই বাড়িতে কোনো অধিকার পেলো না,স্ত্রীর মর্যাদা পেলো না। কাজের লোকের মতো দিন-রাত খাটাচ্ছ!”

স্তব্ধ হলো নিশু। নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ধূসর। দিলরুবা খাতুন বললেন,”এইসব তুই কী বলছিস?”

“মিথ্যা কই বললাম?”

“তোর কীসের মেয়েরে? এই তোর মেয়ে আছে? তোর বউ মেরে ফেলতে নিয়েছিল একবার তখন কই ছিলি? আমি চিকিৎসা করে যখন সুস্থ করলাম,পুত্রবধূর মর্যাদা দিলাম এখন এসেছিস মেয়ে দাবি করতে? এতবছর কই ছিলি?”

“আমার সাথে ঝামেলা করো না। আমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাব।”

“কোন সাহসে?”

“আমার মেয়েকে বিয়ে দিবো। চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে ওকে পছন্দ করেছে।”

আচমকা ফুলদানি নিয়ে উনার মাথায় আঘাত করলেন আসাদ সাহেব।

“কত বড় সাহস তোর! আমার বাড়ির বউকে নিয়ে তুই বিয়ে দিবি! সেই কথা আবার আমার সামনে বড় গলায় বলছিস! জ্বীভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।”

এলোপাতাড়ি আঘাত করতে লাগলেন। অবশ্য সকাল থেকে মন্ত্রী সাহেবের উপর মেজাজ চটে আছে উনার।

“আমার টাকায় তোর সংসার চলে। গাঞ্জুরি,জুয়ারি,নেশাখোর! চাকরিবাকরি কিছু নাই সেই আমিই তোকে চালাই। আমি টাকাপয়সা না দিলে ভিক্ষা করা লাগতো তোর। আল্লাহর পরে আমি যদি তোদের দয়া না করতাম তাহলে তোরা স্বামী-স্ত্রী দুজন ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে কলকাতার রানু মন্ডলের মতো রাস্তাঘাটে বসে চুল থেকে উঁকুন ধরে ধরে মারতি! মেয়েকে পুঁজি করে আর কত টাকাপয়সা হাতাবি!”

“হাতানো লাগবে না। আমার মেয়ে এখন অনেক সম্পত্তির মালিক।”

চমকান আসাদ সাহেব।

“কী বললি?”

কাল মোবাইলে নিশুদের ছবি দেখে আইডিয়া করলো এইসব। তাই ঢাকায় আসা। কোনো একভাবে জানতে পারলেন নিশুর নামে সম্পত্তি দিয়েছেন আসাদ সাহেব। তাই ভাবলেন নিশুকে নিয়ে গেলে দুরকম লাভ হবে। চেয়ারম্যানের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সম্পত্তিটুকুও লিখিয়ে নিবেন। আর চেয়ারম্যানের ছেলে নিশুর জন্য পাগল হয়ে রয়েছে। সাড়ে তিন বছর আগে দেখেছিল। নিশুকে বিয়ে দিলে বলেছে অনেক টাকাপয়সাও দিবে যেটা দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে আরামসে সারাজীবন বসে বসে খেতে পারবেন।

“কার থেকে শুনলি?”

প্রতিত্তোর করলেন না।

“দিলরুবা তুমি বলেছো?”

“আমি কেন বলবো! ওর মনের মধ্যে এমনিতেই শয়তানি! আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছে হয়তো।”

“এই লোভী কী বললো এটা?”

“ওরে ভালো করে একটা রামধোলাই দিন। যত যন্ত্রণা দিয়েছে নিশুর মা আর ওকে। সেগুলো ওর পিঠের উপর দিয়ে দিন।”

পিতলের ফুলদানি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করে ফেললেন। অজ্ঞান হয়ে গেলেন তিনি।

“ধূসর,এই কীটপতঙ্গটাকে ময়লার বাগাড়ে ফেলে দিয়ে আয়। খবর্দার হসপিটালে না। শেয়াল-কুকুর ছিড়েখুঁড়ে খাক ওকে।”

সিকিউরিটি গার্ডের মাধ্যমে রাস্তা ফেলে দিয়ে এলো উনাকে। রাগে-জিদে কাঁপতে লাগলেন আসাদ সাহেব। সাহস কত! দশ বছর বয়স থেকে পেলেপুষে এত বড় করলেন,প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা খরচা করছেন মেয়ের পিছনে। ভালো স্কুল,কলেজ,ভার্সিটিতে পড়াচ্ছেন। প্রতিমাসে দেশ-বিদেশে নিয়ে বিদেশী ডাক্তার,ঔষধ সব মিলিয়ে কম খরচা যায় নাকি মেয়েটার পেছনে! রাজরানির হালে রেখেছেন তাও ওমন কথা। কখনো কেউ নিশুর সঙ্গে দুঃসাহস দেখায়নি উনার মা-বোন ছাড়া। আর এগুলো পছন্দ না উনার। কাঠ কাঠ গলায় এবার নিষেধ করে দিয়েছিলেন। আর সবাই ভালোবাসে মেয়েটাকে।
উনার পরিবারটাই ভালোবাসাময়। তিনি কখনো ভাবেননি নিশু উনার মেয়ে কিংবা পুত্রবধূ। বরং সবসময়ই আপন ভেবেছেন। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখল নিশু। খারাপ লাগলেও নীরব রইল। কেন জানি বাবার জন্য মায়া লাগল না। সাড়ে তিন বছর আগেও যখন গ্রামে গিয়েছিল তখন একটাবারও তার সঙ্গে কথা বলেনি মানুষটা। তার সৎমা এবং ভাইবোনেরা অপমানসূচক কত কথা বলেছিল প্রতিবাদটুকু করল না। আসার দিনও কথা বলেনি। এরপর আর গ্রামে যায়নি,সিদ্ধান্ত নিলো যাবেও না।
_____

চলবে~