আমীরা পর্ব-০৪

0
38

#আমীরা
#পর্ব- ৪
#শারমিন আঁচল নিপা

এবার আমার মাথায় মনে হচ্ছে কোনো পাথর চেপে ধরে রেখেছে। খুব খারাপ লাগছে। হালকা বমি ভাব আসছে, তবে বমি হবে বলে মনে হচ্ছে না। আমি এবার ঘুমাতে চেয়েও পারছিলাম না। সাবিরা আবারও আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,

“ভাবী খারাপ লাগছে আবার?”

আমি কেবল মাথা ঝাঁকালাম। অন্যদিকে তুশবা আর নির্ঝর প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। তবে আমি চাইলেও সেটা উপভোগ করতে পারছিলাম না। আশেপাশে তাকিয়ে কেবল পাহাড়ের বিস্তরণ দেখা যাচ্ছে। দু পাশেই পাহাড় আর মাঝখানের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে। আমি মাথা ব্যথা নিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মনটাকে ডাইবার্ট করার ভীষণ চেষ্টা করলাম। কিন্তু ব্যর্থ হলাম। সাবিরা আমাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। এখন কেন জানি না সাবিরাকে আমার নেতিবাচক কিছু মনে হচ্ছে না৷ বরং মনে হচ্ছে সে আমার অস্বস্তিটা বুঝতে পেরে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে। তবুও কেন জানি না বিশ্বাসটা মনে আসতেছে না৷ মনে হচ্ছে আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়ের দিকে আমি এগুচ্ছি।

এসব ভাবতে ভাবতেই গাড়িটা থেমে গেল। সন্ধ্যা নেমে এসেছে অনেক আগেই৷ চারদিকটা অন্ধকার। তুশবা গাড়িটা থামার সাথে সাথে আমার আর আমার হাসবেন্ডকে বলল

“আমাদের কিছু পথ হেঁটে যেতে হবে। পাহাড়ি এলাকা তো আমাদের বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য প্রশস্ত রাস্তা নেই৷ তাই সরু পথটুকু হেঁটে যেতে হবে। গাড়ির ড্রাইভার এখান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টোপথে ৫ কি:মি যাবে। এরপর একটা গ্যারেজে গাড়ি রেখে পরদিন রওনা দিবে। আর আমাদের এক সপ্তাহ পর নিতে আসবে। এ জায়গা থেকে দিনের বেলা ছোটো ছোটো টমা পাওয়া গেলেও এখন রাত হয়ে যাওয়ায় পাওয়া যাবে না।”

নির্ঝর কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করল

“টমা কী?”

তুশবা হেসে উত্তর দিল

“টমা হলো ছোটো সাইকেলের মতো কাঠের গাড়ি। পাহাড়ি সরু রাস্তা পার হতে ব্যবহার করা হয়। কাল সকালে আপনাকে দেখাব ভাইয়া৷”

নির্ঝর প্রতি উত্তরে বলল

“এতগুলো ব্যাগ নিয়ে এ মুহুর্তে কি ১ কি:মি হাঁটা সম্ভব? সবার কষ্ট হয়ে যাবে না? আর আমরা তো অভ্যস্ত না৷ এর মধ্যে আপনার ভাবী জার্নি করে সিক হয়ে আছে। ও একা শরীর নিয়ে হাঁটতে পারে কি’না সন্দেহ।”

তুশবা চিন্তিত গলায় উত্তর দিল

“এখন এ ছাড়া উপায় নেই। তারপরও আমি একটা চেষ্টা করছি। আমার ছোটো ভাইকে বলতেছি তার টমাটা নিয়ে এসে অন্তত ব্যাগ গুলো নিয়ে যেতে। এরপরও কষ্ট করে হেঁটেই যেতে হবে। সে এলকায় একমাত্র আমার ছোটো ভাইয়েই মোবাইল চালায়। সে সে ফোন চার্জ দিতে তাকে ১০ কি:মি পথ পার হয়ে লোকালয়ের একটা বাজারে যেতে হয়। নেট সবসময় পাওয়া যায় না তবুও মাঝে মাঝে যতটুকু পায় তা দিয়ে চলে যায়। আতীর গ্রামটা অনেক ভেতরে। আর ভাবী আপনি নাকি ভাইয়াকে বলতেছিলেন গুগলে এ নামের সন্ধান খুঁজে পাননি। পাবেনেই বা কীভাবে? এটা বান্দরবানের একদম ভেতরে অবস্থিত। বান্দরবনের অনেকেই এ গ্রামের নাম জানে না। এখানে ছোটো একটা জনগোষ্ঠীর বাস। এখানের মানুষ বাইরে খুব একটা যায় না। আর শিক্ষার আলো এখানে এখনও পৌঁছায়নি ঠিক করে। আমি ছোটো থেকে একটু অন্যরকম ছিলাম। তাই পড়াশোনার পেছন ছুটতে ছুটতে ঢাকা পর্যন্ত গিয়েছি, চাকুরি নিয়েছি। সাবিরাও আমার লেজ ধরে একই পথের পথিক। যাইহোক অনেক কথা বলে ফেললাম। আমি আমার ভাই মান্দিকে কল দিয়ে বলতেছি আসার জন্য।”

তুশবা তার ভাইকে কল দিয়ে বলল টমা নিয়ে আসতে। আমরা গাড়িতে বসেই অপেক্ষা করতে লাগলাম। সাবিরা গাড়ি থেকে নামল। আর নির্ঝর আমার পাশে আরও ঘেষে বসলো। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল

“তোমার কী এখনও মাথা ব্যথা করছে।”

নির্ঝরের কথার কোনো উত্তর আমি দিতে পারছিলাম না। নির্ঝরকে ট্রিপের প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল আমার ব্যাপারে বেখেয়ালি। একবার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পরও সে ঠিক করে আমার পাশে বসেনি। আমার ব্যাপারে একদম উদাসীন ছিল। তাই কিছুটা অভিমান আর শারিরীক দুর্বলতায় আমি কোনো উত্তরেই দিতে পারছিলাম না। চুপ করে চোখটা বন্ধ করে রইলাম। মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করতে লাগল। একদমই ভালো লাগছে না। ১ কি:মি পথ কীভাবে হাঁটব সে চিন্তায় করছিলাম। এ পাহাড়ি অন্ধকার পথ হাঁটার শক্তি আমার হবে ত? এ ভাবনায় আমাকে চিন্তিত করে তুলছে।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই একজন আসলো। হাতে হারিকেনের মতো কিছু একটা নিয়ে। তুশবা জানাল এটা তার ভাই মান্দি। তার ভাই সাইকেলের মতো সরু তিন চাকা ওয়ালা একটা কাঠের বাহনে করে এসেছে। এ বিশেষ বাহনকেই টমা বলে তারা। তাদের এলাকায় এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায় নি। তাই তারা প্রাকৃতিক উপায়ে একটা জ্বালানি ব্যবহার করে। জ্বালানীটা তারা জঙ্গলের একটা ফল, নাম ইশবা, যেটা অনেকটা নারিকেলের মতো শক্ত। সেটাকে আকৃতি দিয়ে সে জ্বালানিটা সেটার মধ্যে নিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। আর তাতে একটা গাছের শিকড় দিয়ে বেঁধে হাতে করে নিয়ে বহন করে। এ জ্বালানীটার পরিমাণ তাদের জানা। সেজন্য যে জায়গায় যায় সে জায়গার সময় অনুমান করে সে পরিমাণ জ্বালানি নিয়ে আগুন জ্বালায়। এ জ্বালানীটাকে তারা ডাব্বা বলে ডাকে।

মান্দি আসার সাথে সাথে আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামি। মান্দি, নির্ঝর আর আমাকে মাথা নীচু করে কুর্নিশের মতো করে হাতে একটা বিশেষ সাইন দেখাল। ডান হাতের আঙ্গুলটাকে সে কিছুটা পদ্মের কলির মতো করে সাইনটা দেখাল। তুশবার বর্ণণায় এটা হলো তাদের সম্মান প্রদর্শন। কোনো অতিথি আসলে তারা এভাবেই সম্মান প্রদর্শন করে। এ সম্মান প্রদর্শনের ধরণকে তাদের ভাষায় বিমোহশিয়া বলে। মোহশিয়া দেবীর নামকরণে এ নাম করা হয়েছে। তারা একজন বিশেষ দেবীর পূজা করে। তাদের নিজস্ব আলাদা ধর্ম আছে। আর সে ধর্মের নাম মোহমাতাদ্রি। আর সে ধর্মের দেবীর নাম মোহশিয়া৷

যাইহোক প্রসঙ্গে আসি। মান্দি আমাদের ব্যাগগুলো তার টমায় বেঁধে সে বাহন নিয়ে রওনা দিয়ে দিয়েছে। গাড়ির ড্রাইভারও গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলেছে। এখন আমরা চারজন কেবল দাঁড়িয়ে আছি। তুশবা তার মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে আমাদের সবাইকে বলল

“আমার পিছু পিছু হাঁটবেন। আমার মোবাইলের টর্চ বন্ধ হয়ে গেল অন্যদের ফোনের জ্বালাবেন। এভাবেই হাঁটতে হবে। আস্তে করে হাঁটলেও ৩০-৪৫ মিনিট সময় লাগবে। আমরা চেষ্টা করব একটু দ্রূত হাঁটতে।”

তুশবার কথা মতো আমরা হাঁটতে লাগলাম।।চারশপাশটা থমথমে। পাহাড়ের ভেতর থেকে জ/ন্তু, জা/নোয়ারের ডাক ধেয়ে আসছে। গরমেও শীত শীত ভাব। ভীষণ ভয় লাগছিল সে সাথে শরীর দুর্বল। তবুও হাঁটছিলাম। নির্ঝর আমার হাতটা ধরে অনেকটা টেনে টেনেই হাঁটছে বলা যায়। কিছু পথ হাঁটার পর তুশবার ফোনের টর্চ বন্ধ হয়ে গেল। সাথে সাথে একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম।

চলবে।