আমীরা পর্ব-০৬

0
36

#আমীরা
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৬

কুয়াশামাখা সকাল। বেশ সকালেই আমি উঠেছি। বাইরে পাখির ডাক। পোকার শব্দ৷ ঢাকায় অস্বস্তিকর গরম হলেও এখানে সকালে বেশ ঠান্ডা। অনেকটা শীত কালের আমেজ। ভালো লাগছিল চারপাশটা। জানালা দিয়ে দূর পর্যন্ত পাহাড়ের সৌন্দর্য অবলোকন করতে চোখ দুটো মেলে তাকালাম। হঠাৎ আমার চোখে পড়ল সাবিরা আর নির্ঝর একসাথে কথা বলছে। বিষয় টা দেখে আমার একদম ভালো ঠেকছিল না। ঘর থেকে বের হয়ে সেখানে যাওয়ার জন্য রওনা হলাম। সামনেই মান্দিকে দেখতে পেলাম৷ মান্দি বাংলা বুঝে । তাই মান্দিকে জিজ্ঞেস করলাম তুশবা কোথায়? মান্দি জানাল তুশবা দূরের একটা হাটে গেছে বাজার করতে৷ এ কথা শুনে আমার বুকে যেন একটা ব্যথা অনুভব হলো। এবার আমি বুঝতে পারলাম সাবিরার সাথে নির্ঝরের কিছু একটা চলছে। সাবিরার সামনে নির্ঝর সবসময় আমার ব্যাপারে উদাসীন ছিল। ট্রিপে আসা নিয়ে সে সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত ছিল কিন্তু আসার পথে সে একদম আমার খেয়াল রাখেনি। সারাক্ষণ কী নিয়ে যেন ভাবনায় ডুবে ছিল। আমি আস্তে করে মাচা থেকে নামলাম নীচে। পাহাড়ি রাস্তা আঁকা বাঁকা পথ। দেখতে মনে হয় এতটুকু পথ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা বেশ দূরে। উঁচু নীচু, কখনও খাড়া, কখনও নামানো পথ। শীত শীত আমেজেও হাঁটতে গিয়ে ঘাম পড়ছে। সে সাথে হালকা শ্বাস কষ্ট। কিছুক্ষণের পথ যেতে সময় লাগল ১৫ মিনিটের উপর। আমি কাছাকাছি গিয়ে গাছের আড়াল হলাম। কানে তাদের কথোপকথনের শব্দ শুনা যাচ্ছে। তারা স্বাভাবিক গলাতেই কথা বলছে। এর প্রথম কারণ হতে পারে এখানের মানুষ তাদের কথা বুঝবে না আর তুশবাও এখন আশেপাশে নেই। আমার মতো তুশবা তো সাবিরাকে সন্দেহ করবে না। আমি ভালো করে কথা শুনতে গিয়ে বুঝলাম তারা আমাকে নিয়েই কথা বলছে। সাবিরা নির্ঝরকে বলছে

“আপনি নিশিতার প্রতি যতবারেই সিরিয়াস হবেন আমি ততবারেই সেটা ভেঙে দিব। নিশিতার ব্যাপারে এমন সিরিয়াসনেস আমি একদম সহ্য করব না। আর সবচেয়ে বড়ো বিষয়, নিশিতার দিকে তাকালেও আমি চোখ তুলে নিব। আমি একটা মেয়ে হয়ে এগুলো সহ্য করব না। আপনি আমার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানেন না। প্রতারণা আমরা কখনও মাফ করব না। আপনাকে আমি আতীরেই পুতে ফেলব। আর তুশবাকে যদি ভুল কিছু বলে আমার থেকে মনোযোগ সরানোর চেষ্টা করেন এটার ফলও ভালো হবে না। এটা আপনার ঢাকা না এটা আতীর। আর আতীর কখনও বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করবে না। ভালোবাসা নিয়ে বিশ্বাস ঘাতকতা তো আরও সহ্য করবে না। আমি তো এটা মানতেই পারব না। নিশিতাকে নিয়ে এত সিরিয়াস হয়ে লাভ নেই। যতই সিরিয়াস হবেন আমি ততই ঝামেলা করব। আর বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি এটাই প্রমাণ করে দিব, নিশিতাকে বিয়ে করা ওর ভুল নয় বরং আপনার ভুল ছিল৷

নির্ঝর একদম চুপ হয়ে গেল। আমি এবার পরিষ্কার বুঝতে পারলাম সাবিরা নির্ঝরকে অনেক পছন্দ করে। নির্ঝরও হয়তো সাবিরাকে সুযোগ দিয়েছে কিন্তু এখন হয়তো ফিরতে চাচ্ছে কিন্তু সাবিরা সেটা মানতে নারাজ। এসব নিয়েই তাদের মধ্যে ঝামেলা। তবে আমার ভীষণ খারাপ লাগছে এটা ভেবে নির্ঝর কেন আমাকে ঠকাল। সে যদি সাবিরাকে একটুও সুযোগ না দিত তাহলে সাবিরা তো এভাবে গলা উঁচিয়ে কথা বলতে পারত না। নিশ্চয় সে সুযোগ দিয়েছে বলেই কথা বলছে। আমি সাবিরাকে একদম সহ্য করতে পারছি না। মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা করছে। নিজেকে সামলে আমি আবার ঘরের দিকে রওনা হলাম। আঁকা বাঁকা পথে কত যে হোঁচট খেয়ে আসলাম হিসাব নেই। আমি এসে মাচায় বসলাম। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মাচায় বসার কিছুক্ষণ পরেই সাবিরা আর নির্ঝর আসলো। নির্ঝর আমাকে আনমনা হয়ে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল

“শরীর কী বেশি খারাপ লাগছে?”

আমি হালকা গলায় উত্তর দিলাম

“মাথা যন্ত্রণা করছে।”

নির্ঝর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

“ঔষধ দিচ্ছি খেয়ে নাও।”

এই বলে সে ঘরে ঢুকলো। সাবিরাও তার সাথে প্রবেশ করলো। সেজন্য আমিও গেলাম। নির্ঝর পুরো ব্যাগ খুঁজে একটা ঔষধও পেল না। সাবিরার দিকে নির্ঝর তাকাল। সাবিরা জাস্ট একটু ব্যঙ্গ করে মুখ ভেচকি দিয়ে হাসলো। আমি বুঝতে পারলাম কাজটা সাবিরায় করেছে। আমি যেন আর নিতে পারছি না। তবে এখান থেকে বের হতে হবে আমাকে। শরীর রাগে ক্ষোভে জ্বলছে আমার।

সাবিরা চলে গেল। আমি নির্ঝরের কাছে গিয়ে তাকে ধরে কেঁদে দিলাম। আমি আর কিছুই বলতে পারছি না। নির্ঝর আমাকে ধরে বলল

“কাঁদছো কেন?”

আমি কেঁদে কেঁদে সকল কষ্ট বুকে চেপে উত্তর দিলাম

“আমি এখান থেকে যেতে চাই৷”

নির্ঝর আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল আমরা পরশু চলে যাব। গাড়ি পরশু আসতে বলব। তুমি রেস্ট নাও। এই বলে সে আমাকে বিছানায় বসিয়ে বাইরে গেল। আমি বিছানায় স্থির হতে পারলাম না। আমি বিছানা থেকে উঠে দরজার পাশে আড়াল হয়ে দাঁড়ালাম। নির্ঝর দরজা থেকে সামনে গিয়ে সাবিরাকে বলে উঠল

“কাজটা ঠিক করো নি।”

সাবিরা কেবল হাসলো। আমার অস্থিরতা আমাকে গ্রাস করতেছে। সময় কাটছে না একদম। সকালের নাস্তাও গলা দিয়ে নামছে না। তুশবা নির্ঝরকে নিয়ে ঘুরতে গেলেও আমি যাইনি। বিছানা ছেড়ে একদম যেতে ইচ্ছা করছে না আমার। তাই নিজেকে বিছানাতেই আবদ্ধ করে রাখলাম। আমি যাইনি দেখে সাবিরাও যায়নি। তবে ওকে যতই আমার সামনে দেখছি ততই আমার শরীর খারাপ বাড়ছে৷

তুশবা আর নির্ঝর ঘুরে ফিরেছে বিকেল ৪ টায়। এর মধ্যে সাবিরা অনেকবার বলেছে আমাকে কিছু খেতে কিন্তু নির্ঝরকে ছাড়া আমার গলা দিয়ে কিছু নামবে না। তাই নির্ঝরের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। নির্ঝর আসার পর একটিু স্বস্তি লাগতে শুরু করল৷ সে এসে ফ্রেশ হলো। তারপর ঠিক ৫ টায় আমরা খেতে বসলাম। খাওয়া শেষ করে আমার চোখটা ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল৷ আমি যখন চোখ খুললাম তখন নিজেকে দেখেই চমকে গেলাম। এটা কী সত্যিই দেখছি আমি?
……