#বুনোফুল
পর্ব সংখ্যা-০১
রুবাইদা হৃদি
বিয়ের রাতেই শুনলাম আমার স্বামী হাবিবের একটা গোপন সমস্যা আছে৷ ব্যাপার টা এতোটাই গভীর যে সে তার দুর্বলতা গুলো বলতে গিয়ে বারবার কান্না গুলো গিলছে৷ আমি কোনোদিন পুরুষ মানুষকে কান্না করতে দেখিনি৷ তবে আমার না দেখা জিনিস টা বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামীর থেকে দেখতে পাবো ভাবিনি৷ আমি কিছুটা বিব্রত অবস্থায় হাবিব সাহেবকে বললাম,’আমরা এই বিষয়ে কাল কথা বলবো৷’
‘না নীরা আপনাকে কথাগুলো শুনতে হবেই৷’
হাবিব স্পষ্ট ভাষায় আদেশের সুরে কথাটা বললো৷ আমি কিঞ্চিৎ বিরক্ত বোধ করছি৷ বিয়ে নিয়ে সব মেয়ের মাঝেই আশা আকাঙ্ক্ষা থাকে৷ আমারো খানিকটা ছিলো বৈকি৷ আমি হাপিত্যেশ না করে লাল বেনারসি টা গুছিয়ে পা তুলে বসলাম৷ হাবিব আমার দিকে তাকিয়ে ভারাক্রান্ত গলায় বলল,
‘আমি কখনো আপনাকে মা হবার অনুভূতি দিতে পারবো না নীরা৷ আমার ভেতরে সেই সক্ষমতা নেই৷ বছর দুয়েক আগে মাথায় গুরুতর আঘাত পাবার ফলে আমার বড় অক্ষমতাটা ধরতে পারি৷ যদিওবা ব্যাপার টা আমার আপনাকে বিয়ের আগে জানানো দরকার ছিলো কিন্তু আমি এতোটাই অপারগ আর ভীতু ছিলাম বিষয়টা গোছানোর আগেই চট করে বিয়েটা হয়ে গেলো৷’
‘ব্যাপার টা অপ্রত্যশিত৷ এতে আপনার হাত নেই৷’
‘তবুও আপনি আমার সাথে জড়িয়ে গেছেন৷ সারাজীবন এই অক্ষমতা আপনাকেও বয়ে বেড়াতে হবে৷’
আমি ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লাম৷ এতোক্ষণে আমার ভেতরে জোট বাধা প্রশ্ন গুলোর উত্তর মিললো৷
চুপ থাকতে দেখে হাবিব সাহেব উঠে দাঁড়ালেন৷ অস্থির ভাবে বললেন,
‘আপনি বোধহয় আমাকে প্রতারক ভাবছেন?’
‘না৷ আমি আপনার ব্যাপারে কিছুই ভাবছি না৷’
হাবিব সাহেব আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন না৷ বেশ অপরাধবোধ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন৷ আমি বেশ স্বাভাবিক বেশভূষায় বসে রইলাম৷ বসে থাকতে থাকতে আমার মেরুদণ্ডের হাড় টনটন করছে৷ ভণিতা না করে বললাম,
‘আমি একটু ফ্রেশ হয়ে শুতে চাই৷’
উনি কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না৷ আমি স্বাভাবিক ভাবে ফ্রেশ হয়ে আসলাম৷ তখনো হাবিব সাহেব ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছেন৷ উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার সামনে হাতজোড় করে বললেন,
‘প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না৷ আমি আপনাকে খুব ভালো রাখবো৷ সব সুখ এনে দিবো৷ তবুও আমাকে ছেড়ে দিয়ে সমাজের কাছে ছোট করবেন না৷’
‘আচ্ছা করবো না৷ আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন৷’
আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম৷ তবে আমার ভেতরে তখন অস্বাভাবিক ঝড় হচ্ছিলো৷ যেন কালবৈশাখীর তান্ডব৷ আচ্ছা আমি যদি একই কথা হাবিব সাহেব কে বলতাম লোকটা কি আমাকে মেনে নিতো?
প্রশ্ন টা করতে চেয়েও করলাম না৷ গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বিছানার এক কোণে পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলতেই হাবিব সাহেব লাইট টা অফ করে দিয়ে আবারো বললেন,
‘আমি খুবই দুঃখিত নীরা৷’
আমি উত্তর দিতে পারলাম না৷ তবে চোখ থেকে কয়েকশো পানির ফোঁটা বেয়ে পরলো৷ আমার কষ্ট হাবিব সাহেবের অক্ষমতা নিয়ে নয়৷ একটা সম্পর্কের শুরুতেই গলদ সেই সম্পর্ক টা বয়ে বেড়ানো নেহাৎ বোঝার সমতুল্য!
.
সকালে উঠতে বেশ খানিক বেলা গড়ালো৷ যদিওবা আমার দেরিতে উঠার অভ্যাস নেই৷ কিন্তু কাল সারা রাত্রি জেগেই ছিলাম৷ পাশে বসা হাবিব সাহেব ও যে জেগে ছিলেন তা তার নড়াচড়ার শব্দেই টের পেয়েছিলাম৷ তবে ফজরের পর চোখটা লেগে গেছে৷ আমি কিছুটা সংকোচ নিয়ে উঠে বসতেই দেখলাম ঘরের দরজা ভিজিয়ে রাখা৷ হাবিব সাহেব ঘরে নেই৷ তার ঘরে না থাকাটা আমাকে কিছুটা স্বস্তি দিলো যেন৷
ঘরের চারদিকে তাকিয়ে প্রশান্তি বিরাজ করলেও মনে শান্তি মিললো না৷ আমার মতো ঘর পোড়া গরুর ঘর হয়েও যেন হলো না৷
.
ঘর থেকে বের হতে বেশ সংকোচ বোধ করলেও বাইরে বের হতেই হাবিব সাহেবের আম্মা মানে আমার শাশুড়ী বেশ সমাদরে আমার কাছে এলেন৷ আমাকে এক হাতে জড়িয়ে বললেন,
‘কি খাবে বউ? ডিম পোচ করে দিবো?’
আমি উনার কথা শুনে বিব্রতবোধ করলাম৷ আমতা আমতা করে শুধালাম,
‘ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেলো৷’
‘এতো ভেবো না বউ৷ তুমি আমার মেয়ে৷ তোমার দোষ গুন সব আমি বুঝে নিবো৷’
মহিলার কথা শুনে অদ্ভুত লাগলো৷ হয়তো তার ভেতরে সত্ত্বা আলাদা৷ কিন্তু নিজেদের অপারগতা ঢাকতেই বোধহয় এই সমাদর৷ যত্রতত্র ভেবে আমার বুক চিড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো৷
ডাইনিং টেবিলে অনেক অজানা মানুষের সমাগম৷ আমাকে দেখেই একেকজন ভালোমন্দের খোজ খবর নিলো৷ কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে আমার শাশুড়ীকে উদ্দেশ্য করে বললো,’বউ তো ভারী মিষ্টি দেখতে হাবিবের মা৷’
আমার শাশুড়ী তখন আমার হাতটা শক্ত করে ধরে গর্বের হাসি দিলো৷ উনি আমাকে এরপর খুব যত্নের সাথে প্লেটে খাবার তুলে দিলেন৷ আমি যারপরনাই হতাশ হয়ে খাবার একটু আধটু মুখে তুলতেই কেউ একজন বলে বসলো,
‘তা বউয়ের না-কি চোদ্দ কুলে কেউ নাই৷’
আমি খাবার টুকু মুখে পুরে মধ্যবয়সী মহিলার দিকে তাকাতেই আমার শাশুড়ী হইহই করে বললেন,
‘চৌদ্দ কুলের সব কুল ই তো আমরা খালা৷’
‘তা ঠিক আছে৷ তাই বইলা হাবিব শশুর বাড়ি যাইবো না?’
‘বউ দিয়াই তো কাম৷ এর আগের বার তো সব পাইয়া ও হারাইলো৷’
অন্য একজন কথাটা বলতেই আমার শাশুড়ী কথাখানি ঘুরিয়ে দেবার ছলে বলল,
‘আমাদের কি টাকাকড়ি কম আছে! শশুর বাড়ি যাবার ইচ্ছা হলে ছেলে আর বউ দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবে৷’
ভদ্রমহিলার কথা শুনে টেবিলে বেশ রমরমা পরিবেশ ফিরে এলো৷ তবে আমার ভেতরে কষ্ট গুলো দলা পাকিয়ে বেড়ালো৷ আমাকে চুপ থাকতে দেখে দাদি শাশুড়ী বললেন,
‘মানুষের কথায় মন খারাপ কইরো না বউ৷ মানুষের কাম পেছনে সমালোচনা করা৷’
আমি প্রত্যুত্তরে কিছু বললাম না৷
খাওয়া দাওয়ার পর্ব সারতেই তোড়জোড় লাগলো আমাকে সাজানো নিয়ে৷ তবে সকাল গড়িয়ে দুপুর ঠেকলেও হাবিব সাহেবের দেখা আমি পাই নি৷ কাউকে জিগ্যেস করবো সেই মানুষিকতা আপাতত নেই৷ তবে আমার সমবয়সী এক মেয়ে নিচু স্বরে আমার শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে বললো,
‘হাবিব ভাই হলো ভবঘুরে মানুষ৷ আগে অবশ্য এমন ছিলো না৷ ইদানীং দেখি কেমন যেন হয়ে গেছে৷’
‘কেমন হয়েছে!’ আমি প্রশ্ন করতেই মেয়েটা গলার খাঁদ নিচে নামিয়ে বলল,
‘মিতু ভাবী উনাকে ফেলে চলে যাবার পর থেকেই হাবিব ভাই সব ব্যবসা বাণিজ্য লাটে উঠিয়েছে৷ অবশ্য এতে ভাইয়ের কোনো দোষ নেই৷ সবই কপালের দোষ৷’
‘উনার আগে একটা বিয়ে হয়েছিলো?’
‘বিয়ে কি ভাবী! ভাইয়ের তো তিন বছরের প্রেম এরপর দুই বছরের সংসার৷ আল্লাহ আপনি জানেন না? হায়হায়৷’
মেয়েটা আতংকে আর্তনাদ করে উঠলো যেন৷ তার শঙ্কিত মুখ দেখে আশ্বাস দিয়ে বললাম,
‘কথাটা আমি কাউকে বলবো না৷’
‘বাঁচালেন ভাবী৷ খালাম্মা যে খাটাশ৷ আমার চুল একটাও মাথায় রাখতো না৷’
আমি বিমূঢ় হয়ে শাড়ির কুচিটা গুজলাম৷ এরপর মেয়েটিকে বললাম,
‘মারিয়া তুমি চলে যাও৷ বাকিটুকু আমি করতে পারবো৷’
‘না আমি করে দেই৷ খালাম্মা রেগে যাবেন৷’
‘রাগবেন না৷ তুমি নিশ্চিন্তে থাকো৷’
আমার কথা শুনে আশ্বস্ত হয়ে মেয়েটি বেরিয়ে গেলো৷ তবে আমি!
এক বুক হতাশা নিয়ে অতল গহব্বরে হারিয়ে যাচ্ছি৷ হাবিব সাহেব আমাকে না ঠকালেও তো পারতেন!
.
দুপুর গড়াতেই বাড়িতে মেহমানে ভরে গেলো৷ একে একে অনেকেই নতুন বউ দেখতে আসলেন৷ তবে আড়ালে আবডালে অনেকেই কিছুটা মুখ লুকিয়ে বলে গেলেন,
‘আগের বউ থেকে সুন্দরী তবে জাত তো নাই৷’
কথাটা এতোটাই আঘাত করলো আমি সারা দুপুর চোখে ঝাপসা দেখলাম৷ মনে মনে হাবিব সাহেবকে দোষারোপ করলাম৷ এতোটা অপমান বোধহয় আমার প্রাপ্য ছিলো না৷ তবে হাবিব সাহেব আমার দূর্বলতার সুযোগ নিয়েছেন সব ভাবেই৷
দুপুরের খাবার পর্বের সময় হাবিব সাহেবের সাথে আমার দেখা হলো৷ সে একটা সাদা পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়েছে৷ শ্যামবর্ণের পুরুষটি নেহাৎ সুর্দশন৷ তবে তার বাহ্যিক দিকে বিবেচনা করার থেকে আত্মিক দিক থেকে যে নিকৃষ্ট৷
এরপর অনেকটা সময় অনুষ্ঠানের ঝক্কি সামলাতে গিয়ে আমরা একে অপরকে ভুলে গেলাম৷ এর মাঝে আমাদের একে অপরের দৃষ্টি আমি উনার দিকে এক পলক তাকাতেই উনি মুখে হাসি ভাব বজায় রাখলেন৷ মাথা চুলকিয়ে বললেন,
‘আসলে অফিসে তলব পরেছিলো তো৷’
আমি উত্তর দিলাম না৷ তবে পাশাপাশি বসতেই আমি আত্মগ্লানি তে কেঁপে উঠলাম৷ ঘামে হাতের তালু ভিজে উঠলো৷ হালকা মেকআপ যেন ঘাম লুকোতে পারলো না৷ আমাকে দেখে হাবিব সাহেব ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিগ্যেস করলো,
‘নীরা আপনি ঠিক আছেন!’
‘জ্বী৷’
আমার উত্তরে হাবিব সন্তুষ্ট হলেন না বোঝা গেলো৷ আমার কাছাকাছি এসে কপালে হাত ঠেকাতে চাইলে আমি কিছু টা দূরে সরে দাড়িয়ে বললাম,
‘ঠিক আছি আমি৷’,
‘দেখে তো মনে হচ্ছে শরীর খারাপ৷’
‘শরীরের অসুখ তো চোখে দেখা যায় হাবিব সাহেব৷ তবে মনের ভেতরকার এই হাহাকারের কি করবেন?’
আমার প্রশ্ন শুনে হাবিব বেশ সংকুচিত স্বরে জবাব দিলো,
‘আপনি আমার উপর রেগে আছেন?’
‘রাগ তো হয় আপন মানুষের সাথে৷’
হাবিব সাহেব আমার কথাতে বেশ মর্মাহত হলেন৷
‘পৃথিবীতে তো স্বামীই স্ত্রীর নিকট আপন৷’
উনার কথাতে আমি হাসলাম৷ হাসতে হাসতে আমার চোয়াল ব্যথা হয়ে এলো৷ হাবিব সাহেব আমার পাগলের মতো হাসি দেখে কিছু টা ঘাবড়ে গেলেন৷
‘আপনি বোধহয় আমাকে ভুল বুঝছেন৷’
‘না আমি আপনাকে কোনোটাই বুঝছি না৷ আমি শুধু আমাকে বোঝার চেষ্টা করছি৷’
‘কিভাবে!’
‘ও আপনি বুঝবেন না৷ আমার কথা গুলো আমার কাছেই থাক৷’
আমার কথা শুনে হাবিব সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ এরপর অপরাধী কন্ঠে বললেন,
‘আমি আপনাকে খুব সুন্দর একটা জীবন উপহার দিতে চাই নীরা৷’
আমি হাবিব সাহেবের কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম৷ কিছুক্ষণ বাদে উনি আমার পাশে এসে বসলেন৷ আমি অস্থির হয়ে বললাম,
‘আমাকে কিছুটা সময় দিন৷’
‘আপনাকে আমি সারাজীবন সময় দিবো৷’
উনি আমার হাত ধরে বললেন৷ তবে আমি হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললাম,
‘ঘুমাবো৷’
উনি হতাশ হয়ে উঠে চলে গেলেন৷ আমি উনার হতাশা দেখে বেশ মজা পেলাম৷ পুরুষ মানুষ আসলে চায় কি!
বিয়ের ঝামালা শেষ হবার পর দিন সকালে বেশ চেঁচামেচিতে ঘুম ছুটে গেলো৷ আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসতেই দেখলাম হাবিব সাহেব অদ্ভুত ভঙ্গিতে দরজা দিয়ে ঢুকলেন৷ একদম অগোছালো এলোমেলো৷ আমাকে দেখে উনি মাথানিচু করে বললেন,
‘নীরা বাইরে মিতু এসেছে৷’
‘মিতু কে?’
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করতেই উনি শঙ্কিত কন্ঠে বললেন,
‘আমার প্রাক্তন স্ত্রী৷’
চলবে…