বুনোফুল পর্ব-০২

0
28

#বুনোফুল
রুবাইদা হৃদি
পর্ব সংখ্যা-০২
হাবিবের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম সে তার প্রাক্তন স্ত্রীর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে৷ সে চোখে কোনো ঘৃণা বা আক্রোশ নেই৷ আশেপাশে যে এতো মানুষ তবুও তার দৃষ্টি এক জায়গাতেই নিবব্ধ৷ আমার শাশুড়ী ব্যাপার টা খেয়াল করে হাবিব কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘হাবিব সব মিটমাট করে দে৷’

উনার ডাক শুনে হাবিব সাহেব হকচকিয়ে উঠলো যেন৷ এরপর ক্ষীণ সুরে বললেন,
‘আমি কি বলবো!’

‘কি বলবি মানে! তোর কি আক্কেল সব লাটে উঠলো?’

আমার শাশুড়ী বেশ রাগ নিয়েই বললেন কথাটা৷ তবে এতে হাবিব সাহেবের কোনো হেলদোল হলো না৷ সে মিতু নামক মানুষটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘হঠাৎ ফিরে আসলে যে?’

‘তোমার কাছে ফিরে এসেছি হাবিব৷’

মিতুর কথা শুনে উপস্থিত সবাই তাজ্জব বনে গেলো৷ আমার খালাশাশুড়ি তিনগুণ চেঁচামেচি করে বললেন,

‘ফাজলামো পাইছো? ঘরে নতুন বউ৷ তোমার তামশা দেখার সময় নাই আমাদের৷’

‘আহ খালা চুপ করো৷ আমি কথা বলছি তো৷’

হাবিব এক প্রকার ধমকের সুরেই কথাটা বলে ফেললো৷ তার কথাতে মিতু বেশ উৎফুল্ল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো৷ তার দৃষ্টির ভাষার মানে হলো,’দেখো নীরা আমি না থাকলেও তোমার স্বামীর সব আমার৷’

তবে আমার ভাবনা অবাক করে দিয়ে আমার শাশুড়ী আম্মা বেশ কঠোর গলায় বললেন,

‘হাবিব বউ নিয়ে ঘরে যা৷ মিতু তোমার যাবতীয় যা আছে সব আমার কাছে গচ্ছিত৷ তুমি আমার সাথে আমার ঘরে এসো৷’

‘হাবিবের সাথে আমার কথা আছে৷’

‘না কোনো কথা তুমি হাবিবের সাথে বলতে পারবে না৷ একজন পর পুরুষের সাথে কি কথা!’

আম্মার কথা শুবে হাবিব রুষ্ট গলায় বলল,

‘মিতু তুমি বলো৷’

মিতু অনুমতি পেয়েই হাবিব সাহেবের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো৷ তার অযাচিত কাজ দেখে আমার শাশুড়ী হাবিব কে টেনে সরিয়ে দিয়ে বলল,

‘তুই যদি এই মেয়ের সাথে আর একটা কথা বলিস৷ আমি আজকেই বি’ষ খাবো৷’

‘আম্মা তুমি পাগল হয়ে গেছো৷ নীরা আম্মাকে একটু বুঝাও৷’

উনার কথাতে আমার হেলদোল হলো না৷ একটা লোক কতোটা কাতর থাকলে এইরকম কথা বলতে পারে? তার হিসেব মিলাতে গিয়ে আমি আমার ভাবনাতে মশগুল৷
তবে আমার শাশুড়ী ছেলের কথাতে কেঁদেকেটে ভাসালেন৷ সে আহাজারি করে বারবার বললেন,

‘এই মেয়েটাকে বিয়ে নিজের ইচ্ছাতে করেছিলি৷ এই মেয়ে তোর বিপদে তোকে ফেলে অন্য ছেলের হাত ধরে চলে গেলো৷ তবুও তুই কোন মুখে এই মেয়ের সাথে কথা বলবি!’

হাবিব তার মায়ের কথা শুনে বেশ দমে গেলো৷ মিতু এরপরেও বেশ রাগারাগি করেও কোনো কূল কিনারা না করতে পেরে বললো,

‘হাবিব আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি৷’

‘আমরা পরে আলোচনা করবো মিতু৷ আম্মার থেকে তুমি তোমার সমস্ত গয়না নিয়ে যেও৷’

এরপর মিতু আর কোনো উচ্চবাচ্য করে নি৷ সে নিরব ভঙ্গিমায় সব বুঝে নিয়ে চলে গিয়েছে৷ তবে সে যাবার আগে আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো,’নীরা তুমি আসলেই ধূলোময়লা৷’

.

দিন মাসের হিসেব বোধহয় চোখের পলকেই ছুটে চলে৷ বিয়ের মাস টা কেমন করে যেন গড়িয়ে গেলো৷ তবে আমার আর হাবিবের সম্পর্কে একটা ফাঁটল সবার সম্মুখেই উন্মুক্ত৷ পাড়াপড়শি অনেকেই চাপা গুঞ্জন করে,’হাবিব নাকি মিতুকে ফিরিয়ে আনবে৷’
অনেকে আবার আফসোস করে বলে,’আহারে বাপ মা নাই৷ সাত কূলে যার কেউ নাই৷ এই মেয়েটা এখন যাবে কোথায়!’

তাদের কথা শুনে আসলেই আমি ভাবনায় আসছে আমি যাবো কোথায়!

.

বিয়ের আগে আমি সমীকরণ মেলাতে পারছিলাম৷ কেন এই শিক্ষিত লোকটা আমার মতো ঘর ভিটামাটি ছাড়া বাবা-মা ছাড়া অনাথ মেয়েকে বিয়ে করবে৷ ছোট বেলায় আমাকে আমার এক আত্মীয় এতিমখানায় রেখে যায়৷ তাদের ভাষ্যমতে আমার বাবা-মা কোনো এক কারণে দুজনেই সংসার থেকে বৈমুখ হয়ে আমাকে ফেলে দুজন দুদিকে চলে গেছে৷ এরপর থেকেই সাবালিকা হবার পর সেখান থেকে বেরিয়ে এনজিওয়ের মাধ্যমে একটা সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করার পর ন্যাশনাল থেকে অনার্সটা শেষ করতে পারলাম না৷ এরপর কাজের সন্ধানে ভবঘুরের মতো ঘুরতে ঘুরতে একটা কোম্পানি তে ইন্টারভিউ বোর্ডে হাবিব সাহেবের সাথে আমার পরিচয়৷ চাকরি টা নেহাৎ প্রয়োজন ছিলো বলেই দুদিন পর আবারো খোজ নিতে অফিসে যেতেই হাবিব সাহেব আমাকে একান্তে ডেকে বলেছিলেন,’আপনার চাকরিটা এখানে হবে না মিস.নীরা৷ ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে অন্য একজন কে সিলেক্ট করেছে৷’
আমি বেশ হতাশা নিয়ে ফিরে আসতে গেলেই হাবিব সাহেব আমার পথ আটকে বলেন উনি আমাকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন৷ উনার হাবভাবে নেহাৎ ভদ্র মানুষ মনে হলেও আমি লোকটাকে এড়িয়ে যেতে চাইতেই উনি অনুনয় করে বলেছিলেন,
‘আমাকে ভুল বুঝবেন না মিস.নীরা৷ আপনার যে চাকরিটা প্রয়োজন সেটা আমি অথোরিটিকে জানিয়েছিলাম৷ কিন্তু তারা অপারগ৷ আপনার থেকে অন্যদের পারফরম্যান্স ভালো ছিলো৷’

‘আচ্ছা সমস্যা নেই৷’

‘কিন্তু আমার বেশ সমস্যা আছে৷ আপনি চাইলে আমি সত্যিই আপনার উপকারে আসতে পারি৷’

‘পরে ভেবে দেখবো৷’

এই টুকটাক কথোপকথনের পর আমি চলে আসলেও হাবিব সাহেব আমার পিছু ছাড়েন নি৷ একপ্রকার বাধ্যগত আর ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস নিয়ে ভোগা আমি উনার ডাকে সাড়া দিলাম৷ লোকটা দু’দিনের মাঝে আমার জন্য চাকরি ও ম্যানেজ করে ফেললেন৷ উনার প্রতি কৃতজ্ঞতা বাড়তেই লোকটা আমাকে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার সুযোগ না দিয়েই হাওয়া হয়ে গেলো৷ ব্যাপার টা আমার কাছে বেশ বিব্রতকর ছিলো৷ তাই তো উনাকে খুজে বের করার জন্য মরিয়া হয়ে আগের সেই কোম্পানি তে খোজ নিয়ে জানতে পারলাম হাবিব সাহেব বেশ অসুস্থ৷ উনার অসুস্থতা আমাকে বেশ পোড়ালো৷ তাইতো আমি যেচে পড়েই ধন্যবাদ জানানোর জন্য উনার বাসায় এসেছিলাম৷ সেদিন টা ছিলো আমার জন্য আরো অপ্রীতিকর৷ হাবিব সাহেবের মা আমার পরিচয় জেনেই কোনোপ্রকার দ্বিধা ছাড়াই বলে বসলেন,
‘হাবিবের তোমার খুব দরকার মা৷ তুমি প্লিজ আমার হাবিবকে ছেড়ে যেও না৷’

আমি বেশ অবাক হলাম৷ আজব! যাকে আমি ধরলাম না তাকে ছাড়ার প্রশ্ন আসলো কোথা থেকে?
তবে প্রশ্নটা আমার মনে রাখতেই হাবিব সাহেবকে দেখে বুঝলাম লোকটা ইচ্ছে করেই অসুখ বাঁধিয়েছে৷ আমাকে দেখেই মেকি হেসে বললো,
‘আমি জানতাম আপনি আসবেন মিস.নীরা৷’

সেই আসাটাই বোধহয় আমার কাল হলো৷ যেই আমি একা বাঁচতে চেয়েছিলাম সেই আমি বোধহয় একটা শেকড়ের আশ্রয় খুজতে গিয়ে নিজের আত্মসম্মান ও বিলি করে দিলাম৷

বিকেলের দিকে আমার শাশুড়ী আমার ঘরে আসলেন৷ আমাকে দেখে হায়হায় করে বললেন,

‘নীরা তোমার পাশে আমি আছি৷ তবুও এমন মন খারাপ করে থেকো না৷’

‘মন খারাপ করছি না আম্মা৷ আমি শুধু ভাবছি হাবিব আমাকে বিয়েটা কেন করলেন!’

মহিলা আমার কথা শুনে বেশ কাচুমাচু করলেন৷ তবে আত্মগ্লানি থেকে বাঁচতেই হয়তো বললেন,

‘আসলে হাবিব মিতুকে বুঝাতে চেয়েছিল তার জন্য মেয়ের অভাব নেই৷’

‘তাই বলে এভাবে?’

‘ভুল বুঝো না৷ তোমার মাথার উপরে তো কেউ নেই৷ এইজন্যও৷’

উনার কথা শুনে আমি বেশ অবাক হলাম৷ তাই বলে আমি ফেলনা?
এরপর উনি আমার কাছ ঘেঁষে নিচু গলায় বললেন,

‘হাবিব কে নিজের করে বাঁধো৷ ওই মিতুকে এমনিই ভুলে যাবে৷’

‘আম্মা যে আমার না তাকে তো আমি শত চেষ্টা করেও বাধতে পারবো না৷’

আমার উত্তরে বেশ অসন্তোষ প্রকাশ করলেন উনি৷ এরপর আমার হাত ধরে বললেন,

‘একজন বউ চাইলে সব করতে পারে৷’

উনার কথাতে আমি কোনো প্রত্যুত্তর করলাম না৷ আজ বুঝলাম পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ থাকলে হয়তো এই যন্ত্রণা সহ্য করে একটা কাপুরুষের ঘর করতে হতো না৷

চলবে