বুনোফুল পর্ব-০৬

0
33

#বুনোফুল
পর্ব-০৬
রুবাইদা হৃদি

হাবিব সাহেব ভোররাতে আমার ঘরে এলেন৷ উনার পায়ের শব্দে আমি হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলাম৷ উনি আমাকে দেখে বিব্রতকর একটা হাসি দিলেন৷ কাল রাতে উনি বাসায় ফেরেনি৷ অবশ্য এই নিয়ে তার মা অনেক চিল্লাচিল্লি ও করেছেন৷ আমি কোনো কিছু ই বলি নি৷
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বিচলিত কন্ঠে বললেন,

‘আপনার কাছে হাজার পাঁচেক টাকা হবে?’

‘আমি টাকা কোথায় পাবো!’

আমি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললাম৷ সদ্য ঘুম থেকে উঠায় উনাকে আমার বেশ বিরক্তিকর লাগছে৷ উনি অনুনয় করে বললেন,

‘প্লিজ থাকলে দিন৷ আমি কোথাও থেকে টাকা উঠাতে পারছি না৷’

‘এই ভোররাতে আপনার টাকার প্রয়োজন কেনো?’

‘মিতুর বাসায় যাবো৷ একটা বোঝাপড়া আছে৷’

‘কি বোঝাপড়া? আর আপনি রাতে কোথায় ছিলেন?’

‘ঢাকায় ছিলাম৷ আর এতো প্রশ্ন করবেন না৷ টাকা যদি থাকে দিন৷’

আমি আগ বাড়িয়ে আর কোনো প্রশ্ন করলাম না৷ তবে উনার চেহারা আর হাবভাবে বোঝা যাচ্ছে বেশ গন্ডগোল আছে৷
আমার কাছে থাকা তিন হাজার টাকা ব্যাগ থেকে বের করে উনার দিকে বাড়িয়ে দিলাম৷ হাবিব সাহেব একপ্রকার ছিনিয়ে নিলেন যেন৷ আমাকে বললেন,

‘ধন্যবাদ নীরা৷ আপনি বোধহয় আমার জীবনে দ্বিতীয় বার এতো বড় উপকার করলেন৷ আর শুনেন,বাসায় আমার কথা জিগ্যেস করলে বলবেন আমি ঢাকা গিয়েছি মাল আনার জন্য৷’

‘আচ্ছা৷’

‘ফিরে এসে সবটা বলবো৷’

উনার কথাতে আমি বেশ অবাক হলাম৷ উনি হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে গেলেন৷

.
নাস্তার সময় আম্মা একপ্রকার চেপে ধরলেন আমাকে৷ রাশভারি কন্ঠে বললেন,

‘হাবিব রাতে বাসায় ফিরেছিলো?’

‘না৷’

‘কোথায় গিয়েছিলো৷’

‘আমি জানি না আম্মা৷’

আমার উত্তরে উনি ধমকে উঠলেন৷ রাগ দেখিয়ে বললেন,

‘তাহলে কি জানো! নিজের স্বামী ধরে রাখতে পারো না৷ আবার তার টাকায় ফুটানি করো৷’

উনার কথা শুনে আমি সুন্দর ভাবে বললাম,

‘আপনার ছেলের তো দোষের শেষ নেই আম্মা৷ নিজের দোষের জন্য বউ গেলো৷ এরপর আমাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করলো৷ আবার আমাকে দুই চার টাকা দিলেও আপনাদের কষ্ট লাগে৷’

উনি আমার কথা শুনে চোখ রাঙালেন৷ হাতে থাকা কাঁচের প্লেট টা ছুড়ে ফেললেন৷ এরপর বললেন,

‘এই প্লেটের মূল্য ও তোমার থেকে বেশি৷ শুধুমাত্র আমার ছেলের জন্যই তোমাকে এনেছিলাম৷ নয়তো আমার ঘরে পা দেবার যোগ্যতা তোমার নেই৷’

‘ আমি এইটা ভালো ভাবেই জানি আম্মা৷ এইজন্যই তো ওই শোকেসে রাখা প্লেটের মতো দরকার না হলেও রেখে দিয়েছেন৷ জানেন তো আম্ম! মানুষ দামি জিনিস টাকেই দরকারে ব্যবহার করে৷’

আমি বলেই খাবার নিয়ে উঠে চলে এলাম৷ মহিলা বেশ অনেকক্ষণ সময় আমাকে গালমন্দ করলেন৷
ঘন্টাখানেক বাদেই বড় আপা ফোন দিয়ে আবারো আমাকে গালমন্দ করলেন৷ আমি উনাকে সবটা বলার সুযোগ দিয়ে বললাম,

‘আপা আপনার ভাই কিন্তু সমাজের চোখে অনেক নীচু পর্যায়ে আছে৷ আপনাদের তো সাত কপালের ভাগ্য আমার মতো অভাগা এখনো আপনাদের জন্য সমাজ রক্ষা করে চলেছে৷’

আমি বলতেই উনি আমাকে মা বাপ তুলে গালি দিলেন৷ আমি অসহায়ের মতো শুনে গেলাম৷ মানুষ বোধহয় এতোটাই জঘন্য হয়৷

.
বিকেল গড়াতেই হাবিব সাহেব বাসায় ফিরলেন৷ আমাকে দেখে ক্লান্ত গলায় বললেন,

‘আমাকে একগ্লাস ঠান্ডা পানি এনে দিবেন৷’

আমি বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রিজ থেকে পানি নিয়ে এলাম৷ উনি ঢকঢক করে পুরো পানিটা পান করার পর সটান বিছানায় শুয়ে পরলেন৷
একহাত কপালে রেখে বললেন,

‘নীরা আমি একটু ঘুমাবো৷ আপনি লাইট অফ করে রুমে থাকলে থাকতে পারেন৷’

উনার কথাতে আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাইট অফ করে দিলাম৷ বারান্দার পাশে রাখা বেতের ছোট চেয়ার রাখা৷ আমি চুপচাপ বসে বসে আকাশ দেখলাম৷ বিচিত্র আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনা হতেই বুঝতে পারলাম হাবিন সাহেব উঠে আমার পাশে এসে মেঝেতে বসেছে৷ আমাকে অনুনয় করে বললেন,

‘আপনাকে একটা অনুরোধ করবো নীরা?’

‘আপনার কাছে আমার অনুরোধ আমাকে কোনো কিছুতে অনুরোধ করবেন না৷’

উনি বেশ মর্মাহত হলেন আমার কথাতে৷ আমি উঠে চলে আসতেই উনি বললেন,

‘প্লিজ বসে থাকুন৷’

‘আমার কাজ আছে৷’

‘আপনার বদদোয়া বোধহয় কাজে লেগেছে নীরা৷’

আমি উনার কথাতে বেশ অবাক হলাম৷ তবে হেসে বললাম,

‘আমার দোয়া কিংবা বদদোয়া কোনোটাই আপনার জন্য নয় হাবিব সাহেব৷’

‘আমি তো আপনার সাথে অন্যায় করি নি নীরা! বিয়ে করাটা কি অন্যায় ছিলো?’

উনার কথাতে আমি বেশ অবাক হচ্ছি৷ এ কি! চোর চুরি করে বলে আমি চোর নই৷

‘বিয়ে করাটা অন্যায় নয়৷ তবে বিয়ে করার পর প্রাক্তন ফিরে এলে তার পিছুপিছু সুড়সুড় করে যাওয়া অন্যায়৷ এরপর মিথ্যা দিয়ে একটা সম্পর্ক শুরু করাটাও অন্যায়৷’

‘আমি সেই অন্যায়ের শাস্তি পাচ্ছি নীরা৷ আমি জানতাম মিতুকে ওর ফ্যামিলি আমার থেকে দূরে সরিয়েছে৷ কিন্তু না৷ ও ওর খালাতো ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করেই আমার জীবন থেকে চলে গিয়েছে৷ এবং গত কয়েক মাস আগে ওরা বিয়েও করেছে৷’

উনি বলে থামলেন৷ তবে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই৷ মিতু সম্পর্কিত কোনো কথাতে আমি হস্তক্ষেপ করতে নারাজ৷ উনি শুকনো ঢোক গিলে বললেন,

‘আমি জানতাম ওর বিয়ে হয় নি৷ ও আমাকে তাই জানিয়েছে৷ ওর বর্তমান স্বামী দুবাই থাকে৷’

‘আপনি খোজ খবর নেন নি?’

‘কিভাবে নিবো! মিতু আমার বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি বেড়াতে যাবে বলে গিয়েছিলো৷ এরপর থেকে ফ্যামিলি সহ গায়েব৷ পরবর্তীতে ওর থেকেই তালাকনামা আমাকে পাঠানো হয়৷ ওর বড় ভাই আমাকে ভলে মিতুকে আমার কাছে ফেরত পাঠাবে না৷ আর মিতু আমার সাথে যোগাযোগ করবে না৷’

হাবিব সাহেবের কথা শুনে আমার কিছুটা দুঃখ লাগলো৷ আমি কোনো প্রত্যুত্তর করলাম না৷ উনি আবার বললেন,

‘এই কথা শুনেই মা একপ্রকার আমাকে মানসিক চাপে ফেলে ডিভোর্স দিতে বাধ্য করে৷ এরপর মিতুকে আমি অনেক খুজেছি৷ ওরা এই শহরে ভাড়াটিয়া ছিলো৷ বরিশাল ওদের গ্রামের বাড়ি৷ আমি সেখানেও খোজ খবর নিয়েছিলাম৷ মিতুর সাথে আমার বিয়ের পর দিন ই আবার দেখা হয়৷’

‘আমাকে এতো কিছু বলছেন কেনো!’

‘না যার জন্য আমি এতোটা পাগল হয়ে দুনিয়া ভুলে গিয়েছিলাম৷ তার দেওয়া আঘাত তো স্বীকার করাতেই হবে৷’

‘হাবিব সাহেব আপনাকে একটা কথা বলি,আমাকে আমার মতো থাকতে দিন৷ আপনার জীবনের কোনো অংশে আমি যুক্ত হতে চাই না৷’

আমার কথাতে উনি বেশ আহত হলেন৷ ধীর কন্ঠে বললেন,

‘আমি আপনাক যুক্ত করছি না৷ আমার সব এলোমেলো লাগছে নীরা৷ আমি মিতুকে সেই কলেজ লাইফ থেকে চেয়েছি৷ মিতুকে যখন পেয়ে হারালাম তখন আমার মনে হতো আমি যেকোনো মূল্য মিতুকে চাই৷ ভালোবাসাতে তো কোনো অপরাধ নেই৷’

‘কিন্তু নিজের ভালোবাসা বাঁচিয়ে অন্য একটা মেয়েকে ঠকানো তে কোনো বাধা নেই তাই তো?’

আমি প্রশ্ন করতেই উনি হকচকিয়ে গেলেন৷ উনার আতংকিত মুখ দেখে আমার অদ্ভুত শান্তি লাগছে৷ এই দিন টা গত কয়েক মাসে আমি হাজার বার কল্পনা করেছি৷ এতো দ্রুত ফলে যাবে কে জানতো!

চলবে