বুনোফুল পর্ব-০৭

0
27

#বুনোফুল
পর্ব-০৭
রুবাইদা হৃদি
ভোরবেলা অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে ঘুম ছুটে গেলো৷ আমি দেখলাম আমার মা-বাবা আমাকে নিতে এসেছেন৷ উনারা খুব কাঁদছেন৷ আর হাবিব সাহেব মুখ কাঁচুমাচু করে বলছেন,’নীরা আপনি আমি আর মিতু একসাথে খুব ভালো থাকবো৷’
আমার বাবা রেগে গিয়ে হাবিব সাহেবকে ধাক্কা দিয়ে একটা উঁচু ব্রিজ থেকে ফেলে দিতে গেলেন৷
এতোটুকু দেখার পর বাকিটুকু মনে নেই৷ বোধহয় আমার অবচেতন মন এইটাই চায়৷ এইজন্যই কাল্পনিক দুটো মানুষ আমার স্বপ্নে এসেছিলেন৷
তবুও তো এসেছে৷ এই ভেবেই আমার কিছুটা মনে শান্তি বিরাজ করছে৷
তবে ভালোলাগা টুকু উবে গেলো৷ চোখ মেলে দেখলাম হাবিব সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন৷ তার নির্ঘুম রাতের ছোয়া চোখে লেগে আছে৷
কাল উনার সাথে আমার ওই পর্যন্তই কথা হয়েছে৷ কথাটা আমিই বাড়াই নি৷ যার যার পাপের শাস্তি তাকেই ভোগ করতে হয়৷ আমাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে উনি চোখ বুজে রইলেন৷ আমি উঠে আড়মোড়া ভেঙে বললাম,

‘এবার মিতু কতটাকা নিয়েছে?’

উনি আমার প্রশ্নে ফট করে চোখ মেলে তাকালেন৷ অবাক হয়ে বললেন,

‘আপনি জানলেন কিভাবে!’

‘সবটাই বুঝি হাবিব সাহেব৷ আপনার ভুল হয়তো এখনো ভাঙে নি৷ সে যাই হোক গতদিন আমার থেকে যে টাকাটা নিয়েছিলেন ফেরত দিলে উপকৃত হতাম৷’

‘আপনি আমার সাথে এমন ব্যবহার করছেন কেনো!’

উনার প্রশ্ন শুনে আমি বেশ হতাশ হলাম৷ বললাম,

‘আমি তো কিছুই করি নি হাবিব সাহেব৷ আপনি একটু মনে করে দেখুন আপনি কি কি করেছিলেন৷’

‘আমি তো স্বীকার করেছি৷ শুনুন আপনি যখন কাউকে ভালোবাসবেন তখন তার যতোই দোষ থাক একটা মোহ আপনার থেকেই যাবে৷ আমিও তো মানুষ৷’

হাবিব সাহেবের যুক্তি শুনে আমি হাসলাম৷ এতোটাই হাসলাম হাসতে হাসতে আমার চোয়াল ব্যথা হয়ে এলো৷ উনি আমার দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন৷
আসলে মানুষ ভালোবাসায় অন্ধ৷ হাবিব সাহেবের কথা না শুনলে বুঝতে পারতাম না৷

‘তা এখন কি পদক্ষেপ নিবেন? না-কি মিতু আবার পালিয়ে বেড়াচ্ছে!’

‘না৷ ওর বর্তমান স্বামী গত কাল দেশে এসেছে৷ আমি এইজন্যই কাল ওর বাসায় গিয়েছিলাম৷’

উনি আহত কন্ঠে বললেন৷ আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম,

‘আপনি জানলেন কিভাবে!’

‘ও নিজেই বলেছে৷ বিয়েতে ওর হাত ছিলো না৷ কিন্তু ফাহাদ মানে মিতুর বর্তমান৷ সে আমাকে প্রমাণ সহ বলেছে মিতু স্বইচ্ছাতেই তার সাথে বিয়ে হয়েছে৷ এবং আমাদের বৈবাহিক সম্পর্ক থাকাকালীন থেকেই মিতুর ফাহাদের সাথে জড়িত৷’

‘আপনার প্রাক্তন তো অনেক ধুরন্ধর৷’

আমার উত্তরে তাকে বেশ মলিন দেখালো৷ ধীর কন্ঠে বললেন,

‘আমি কি করবো বুঝতে পারছি না৷ সব এলোমেলো হয়ে গেলো যেন৷ ইমিডিয়েট টাকা জমা দিতে হবে৷’

‘উনি আপনার কতো টাকা নিয়েছে?’

‘পাঁচ লাখ মতো৷ মিতু আমার কার্ডের পিন জানতো৷ কয়েক ধাপে টাকা তুলেছে এটিএম থেকে৷ আমি ব্যাপার টা ধরতে পারি নি৷ গত পরশু ব্যাংক থেকে স্টেটমেন্ট বের করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি৷ এইজন্যই মিতুকে ফোন দিয়েছিলাম কিন্তু সে অস্বীকার করেছে৷ আমি দুই মাস আগে ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম যখন মিতু প্রায়ই আসতো৷ আমার কার্ড ও ছাড়া আর কে ব্যবহার করবে! ওর সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখা কর‍তে চাইলে নিজে থেকেই স্বীকার করে ফাহাদের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে৷ এবং ফাহাদ দেশে এসেছে৷ আমি যখন আমার ঘটনা ফাহাদকে বললাম ও সাবলীল ভাবে কি বলে জানেন? ও আমাকে বলে আমিই নাকি গাঁধা৷ যাকে মিতু বারবার ধোকা দেয়৷’

হাবিব সাহেব বলেই উঠে দাঁড়ালেন৷ এরপর বললেন,

‘নীরা আমি সত্যিই গাঁধা৷ এখনো আমার মন মিতুকে চাইছে৷ কিন্তু বিবেক বলছে আমি গাঁধা৷ আমি কি করবো বলুন তো! পুরুষদের এতো আবেগপ্রবণ হতে হয়?’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

‘জানি না৷ আপনি চাইলে মিতুর সাথে আবারো সংসার করতে পারেন৷ যদি ওর স্বামী ওকে তালাক দেয়৷’

আমার কথার পৃষ্ঠে উনি জবাব দিলেন না৷ আমি আবার বললাম,

‘বিদেশ যাবেন কেনো?’

‘মিতুকে ভুলতে৷ কিন্তু ও যখন ফিরে এলো তখন মিতুর সাথে দূর দেশে সংসার করার স্বপ্নে বিভোর হয়েই বিদেশ যাবার জন্য বিভিন্ন এজেন্সি তে ঘুরেছি৷ ভেবেছিলাম ওয়ার্ক ভিসায় ঢুকবো৷ এরপর কয়েক বছর পর মিতুকে নিয়ে যাবো৷’

‘আর আমার কি হতো?’

আমি প্রশ্ন করতেই উনার চোখের দিকে তাকালাম৷ কিন্তু উনাকে একফোটাও বিচলিত দেখালো না৷ হতাশ কন্ঠে বলতো,

‘নীরা আপনাকে একটা সত্য কথা বলি৷ আপনাকে বিয়ে করার পেছনে দুটো সত্য আছে৷ এক হলো আমার মা আর সমাজ৷ যারা আমাকে বারবার হেয় করতো৷ আর দুই নাম্বার হলো আপনাকে সামাজিক ভাবে একটা পরিচয় দেওয়া৷ আপনি যেখানে জব খুজতে গিয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগের আশা ছিলেন আপনি৷ এইগুলা তারা আমার সামনেই আলাপ আলোচনা করেছিলো৷ যদিও আপনাকে তখন বিয়ে করবো ভাবি নি৷ মাকে কথা গুলো বলতেই সে বিয়ের প্রস্তাব দিতে বলে৷ এরপরের কাহিনি আপনার জানা৷’

হাবিব সাহেবের কথা শুনে আমি বেশ মর্মাহত হলাম৷ এতোদিন ভাবতাম লোকটা চাপে পরে বিয়ে করেছে৷ এখন সে বলছে আমাকে দয়া করছে৷ উনি এরপর কথা বাড়াতে চাইলেও আমি কোনো কথা বলি নি৷

.
সকালে নাস্তার সময় আমার শাশুড়ী হাবিব সাহেবকে দেখেই বললেন,

‘বাড়িতে থাকতে চাইলে আমার কথা মান্য করে চলতে হবে৷’

হাবিব সাহেব সবে পরোটা হাতে নিয়েছিলেন৷ অসন্তোষ গলায় বললেন,

‘আম্মা আপনার কথা কেউ অমান্য করে না৷ আপনি সব বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন৷’

উনার উত্তর শুনে আম্মা প্রচন্ড রেগে গেলেন৷ তবে আমি ঠান্ডা কন্ঠে বললাম,

‘আম্মা আমি সবটা মেনে চলবো৷ আর কালকের সব ব্যবহারের জন্য দুঃখিত৷ কিন্তু আম্মা,আমাকে পড়ার সুযোগ দিতে হবে৷ এইটা আমার অনুরোধ৷’

আমার কথা শুনে ভদ্র মহিলা বেশ অবাক হলেন৷ আমি মাথা নিচু করে আবার বললাম,

‘আম্মা আমি মন থেকে দুঃখিত৷’

‘আজ সূর্য কোনদিকে উঠলো৷ আমি তো ভাবি নাই মরার আগে এই দিন দেখতে হবে৷’

উনি কটাক্ষ করে বললেন৷ তবে আমি রাগ করলাম না৷ ঠান্ডা মাথায় বললাম,

‘আম্মা আমি আজ কলেজে যেতে পারবো?’

‘যাবাই তো৷ না যেতে দিলে তো বলবা শাশুড়ী খারাপ৷’

আমি মাথা নীচু করে রইলাম৷ হাবিব সাহেব সব কিছুতে উচ্ছিষ্ট হয়ে পরে রইলেন যেন৷

.
আজকে পরিবেশ বেশ ঠান্ডা৷ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে৷ আমি খুব যত্ন করে পরিপাটি হয়ে রেডি হলাম৷ আমি ভালো থাকার একটা সূক্ষ্ম উপায় বের করেছি৷ ভালো থাকতে হলে হাবিব সাহেবের কথা ভোলা যাবে না৷ লোকটা শুধুমাত্র মিতুর ক্ষেত্রেই বোকা৷ কিন্তু সব ক্ষেত্রে চালাক৷ প্রয়োজনে সবাইকে ব্যবহার করে৷
হাবিব সাহেবের ভাষ্যমতে উনি আমাকে সামাজিক পরিচয় দিয়েছেন৷ আমি উনার সামাজিকতা নিয়েই নিজের টুকু গুছিয়ে নিবো৷

চলবে