বুনোফুল পর্ব-০৮

0
235

#বুনোফুল
পর্ব-৮
রুবাইদা হৃদি

আমাদের বিবাহিত জীবনের সুতো সেই প্রথম রাতেই কেটে গিয়েছে৷ সুতোটা জোড়া লাগানোর জন্য ইদানীং হাবিব সাহেব আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন৷ এই ধরুন আমার থার্ড ইয়ারের ফাইনাল চলছে৷ উনি আমাকে প্রতিনিয়ত নিয়ে ঢ়াকা যান৷ দীর্ঘ চার ঘন্টা অপেক্ষা করে আমাকে সাথে নিয়েই ফেরেন৷ তবে আমি এই সবে ভালোবাসা খুজে পাই না৷ কেমন ভোঁতা অনুভূতি আষ্ঠেপৃষ্ঠে রাখে৷ আজকে আমার শেষ পরীক্ষা৷ আমি সকাল সকাল প্রস্তুতি নিয়ে বের হতেই হাবিব সাহেব শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে আসলেন৷ আমি বললাম,

‘আজ না গেলেও চলবে৷’

‘হঠাৎ এই কথা বললেন যে?’

‘আপনার অফিস কামাই করে প্রত্যেকদিন আমার সাথে যাচ্ছেন৷ আম্মা তো আমার উপর রাগ করবেন৷’

উনি ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললেন,

‘কেনো আম্মা আপনাকে কি বলেছে?’

‘কিছুই বলে নি৷ আমি নিজের মতো চলতে চাই হাবিব সাহেব৷’

উনি আমার কথায় অসন্তুষ্ট হলেন৷ তবে আমি নিজের অনুভূতি আবেগ সবটাই বিসর্জন দিয়ে ফেলেছি৷
কেনো দিয়েছি জানেন? হাবিব সাহেবকে যদি মিতু আজ এসে বলে তাকে ঘরে তুলতে হাবিব সাহেব মেনে নিবেন৷
আমি সেই বুনোফুলের মতো আগাছাতেই পরে থাকবো৷ আমার শাশুড়ী অবশ্য এখন আমাকে কিছু বলেন না৷ সে নিজের মতো সব করে৷

.
ওইদিন রাতে একটা ভুল হয়ে গেলো৷ সেই ভুলের মাশুল কিভাবে দিবো আমার জানা নেই৷ হাবিব সাহেব আমার কাছে আসতে আমি উনাকে ফিরিয়ে দিতে পারি নি৷ কেনো পারি নি জানি না আমি৷ তবে সেই রাতের পর থেকে আমাদের ঘর আলাদা হয়েছে৷ আমি এখনো প্রতি রাতে কান্না করি৷ হাবিব সাহেবের কোনো ভাবাবেগ নেই৷ এরপর আমার কাছে এসে বললেন,

‘আপনি আমার থেকে দূরে দূরে থাকছেন কেনো?’

আমি মাথা নীচু করে ফেলি৷ এর উত্তর আমার জানা নেই৷ আর আমি দিতেও চাই না৷ উনি বেশ রুষ্ট গলায় বললেন,

‘স্বামীর হক পালন করা কি অপরাধ?নাকি আপনি এখনো ওই ঘটনা ভুলতে পারছেন না৷’

উনার এই প্রশ্নে আমি আমি উত্তর দিলাম,

‘আমার সময় লাগবে৷’

‘আর কতো নীরা? দেড় বছর কি কম!’

‘না কম না৷ তবে আমার সব মানিয়ে নিতে সময় লাগে৷ আপনার মায়ের ভাষ্যমতে আমি অন্যরকম যে৷’

উনি আমার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ আমি সেসব কথা বাদ দিয়ে প্রশ্ন করলাম,

‘আপনার বিদেশ যাবার ব্যাপারটা কি হলো?’

‘যাবো না৷ ভিসা রিজেক্ট করে দিয়েছে৷’

‘মিতু কোথায়?’

আমার এই প্রশ্নে উনি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললেন,

‘আমি খোজ রাখি না৷’

এরপর উনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন৷ আমি মিথ্যে বলবো না৷ উনি যখন বের হয়ে যাচ্ছিলেন তখন আমার পিছু ডেকে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো,

‘হাবিব সাহেব আপনি আমাকে আর দু চারটে দিন সময় দিন৷ কিন্তু কথা দিন আমার সাথে ওইরকম আর করবেন না৷’

তবে সে কথা আর বলা হলো না৷ উনার প্রতি একটু দূর্লভ টান অনুভূত হচ্ছিলো আমার৷
সেই টান থেকেই আমি আমার সব আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে উনার সাথে সংসার করার চেষ্টায় নিম্নোক্ত হই৷
নিজের বিছানা বালিশ নিয়ে ওই ঘরে রেখে আসি৷ আমার শাশুড়ী আম্মা আমার কান্ডকারখানা দেখে বললেন,

‘যাক দেরিতে হলেও সুবুদ্ধি ফিরেছে৷’

‘মানুষকে তো দুবার সুযোগ দেওয়া যায় তাই না আম্মা?’

‘দেওয়া যায়৷ আমি চাই তোমরা ভালো থাকো৷’

আমি মুচকি হাসলাম৷ এখন ঘরে অশান্তি কমে গিয়েছে৷ হাবিন সাহেবের সাথা আমার সম্পর্কের সুতোটা নতুন মোড় নিয়েছে৷
ঘুম থেকে উঠে দুজন মিলে এক কাপে চা খাওয়া৷ একসাথে বৃষ্টিবিলাস৷ কতোকিছুই যেন হয়ে গেলো আমাদের মাঝে৷ আমরা একসাথে কক্সবাজারে গিয়েছি৷ সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে হাবিব সাহেন আমাকে বলেছেন,

‘নীরা তোমার জন্য আমার ভালোবাসা এই বিশাল সমুদ্রের মতো৷ যা কখনো শেষ হবার নয়৷’

উনার কথা শুনে আমি সেদিন বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলেছিলাম৷ তবে সেই সুখ আমার বেশিদিন টিকে নি৷ বাড়ি ফিরে বুঝেছিলাম সমুদ্র যেমন বিশাল তেমনি বিশাল তার ঢেউয়ের বহর৷ আমার ভালোবাসার সংসারে একটা ঢেউ ঢুকেছিলো৷ যার নাম মিতু৷ আমি এবারে মিতুর দোষ দিবো না৷
হাবিব সাহেব যখন শুনলেন মিতুর ডিভোর্স হয়েছে সেই থেকে মিতুর সাথে যোগাযোগ করা শুরু করলেন৷
এক বিছানায় শুয়ে৷ পাশাপাশি বালিশে আমি বুঝতাম উনি মিতুর সাথে মেসেজিং করছেন৷ ব্যাপারটা আমি ধরেছিলাম হাবিব সাহেবের মোবাইলে একটা আননোন নাম্বার থেকে বারবার কল আসছিলো৷ হাবিব সাহেব রুমে না থাকায় আমি কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে মিতু আহ্লাদী কন্ঠে বলে উঠে,

‘তোমাকে আমি বড্ড মিস করছি হাবিব৷ মেসেজে কথা বলতে আমার বোরিং লাগে৷’

আমি কোনো উত্তর দেই নি৷ কল টা কেটে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পরেছিলাম৷ হাবিব সাহেব রুমে আসতেই উনার কলার চেপে ধরে জিগ্যেস করেছিলাম,

‘আমাকে আবার কেন ঠকালেন?’

উনি অপরাধী কন্ঠে বলেছিলেন,

‘মিতুকে আমি ভুলতে পারি না নীরা৷ ওর সাথে আমি একটু কথাই বলবো৷’

আমি কোনো উত্তর দিতে পারি নি৷ মানুষটা আসলেই ভালোবাসা অন্ধ৷ হয়তো মিতু ওর প্রথম প্রেম বলেই৷

.
আমার গোছানো জীবনটা সত্যি সত্যি এলোমেলো হয়ে গিয়েছে৷ পড়ালেখার মাঝেও একটা ছন্দপতন হয়েছে৷ তবে হাবিব সাহেব পুরোদমে মিতুর প্রতি ঝুকে গিয়েছে৷
আমার শাশুড়ী ব্যাপার টা ধরতে পারলেন৷ ছেলেকে খুব শাসালেন৷ আমার দুই ননাস এসে ভাইকে বুঝালেন৷ তবে সে এই বুঝে আবার সেই যা তাই৷
আমার শাশুড়ী আম্মা আমাকে ডেকে একদিন বললেন,

‘নীরা আমি তোমার সাথে বেশ অন্যায় করেছি৷ যেই অন্যায়ের কোনো প্রতিদান হবে না৷ তবে আমি তোমাকে বলছি আজ থেকে তোমার মা আমি৷ তুমি এতিম না৷ তুমি আমার বাকি দুই মেয়ের মতো মেয়ে৷ হাবিব থাকুক ওর মতো৷ যাদের মেরুদণ্ড সোজা না তাদের সাথে পেরে উঠা যায় না৷ তুমি তোমার পড়াশোনা শেষ করো ভালোভাবে৷ এই মা তোমার সকল দায়িত্ব নিবে৷’

আম্মার এই কথাতে সেদিন আমার ভেঙে যাওয়া আত্মসম্মান আবার ফিরে পেয়েছিলাম৷ ফাইনাল ইয়ারের ফাইনাল একদম এসে পরেছিলো৷ আমি খুব মন দিয়ে আরো ভালো ভাবে প্রস্তুতি নিলাম৷
এরপর পরীক্ষা গুলোতে হাবিব সাহেবের বদলে আম্মা আমার সাথে যাচ্ছিলেন৷ আর হাবিব সাহেব উনি সব ফেলে আবারো মিতুর দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে গিয়েছিলেন৷ আমি অবশ্য সেই খবর রাখি না৷ তবে রাত হলে নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়৷ নিজের প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি হয়৷

.
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হতেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আইএলটিএস দিবো৷ টার্গেট করলাম যে ভাবেই হোক ইটালি তে যাবো৷ তবে টাকা?
এই চিন্তায় তিন চার দিন ঠিক ভাবে ঘুম হলো না৷ কাজ কর‍তে গিয়ে একের পর এক ভুল হলো৷ আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘তোমার শরীর ভালো না?’

আমি সবজি গুলো তাড়াহুড়ো করে কাটতে কাটতে বললাম,

‘রাতে ঘুম হয় নি৷’

উনি আমার হাত ধরে মায়াময় কন্ঠে বললেন,

‘তুমি আমাকে এখনো মা মানতে পারছো না তাই না?’

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,

‘আমি মেনে নিয়েছি আম্মা৷ কিন্তু আমি এভাবে বাঁচতে পারছি না৷ আপনিই বলুন আমি তো হাবিব কে সুযোগ দিয়েছি৷ তবুও উনি আমার সাথে এমনটা করলেন কেনো!’

‘অমানুষ তো কখনো মানুষ হয় না৷ এই মেয়েটাকে বিয়ে করার আগের আমি বারবার মানা করেছিলাম৷ আবার এখন!’

উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ আমি চুপ থেকে বললাম,

‘আম্মা আমি বাইরে মাস্টার্স করার জন্য যেতে চাই৷ কিন্তু অনেক টাকার দরকার৷’

‘যাবে৷ তুমি তোমার মতো চেষ্টা করো৷ যতো টাকা লাগবে আমি দিবো৷’

আম্মার কথা শুনে আমি সত্যিই আশ্বাস পেলাম৷

চলবে